#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_3
মুক্তা শিকদার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
“এখন যাবি না কেন? একশো বার করে বললাম যাস না যাস না তবুও জেদ ধরে গেলি। গিয়ে আছাড় খেয়ে লুলা হয়ে ফিরলি। যদি হাত পা ভেঙে যেত তাহলে কি হতো? মায়ের কথা না শুনলে কি হয় বুঝতে পেরেছিস এখন?”
মাথা নাড়ায় তুরা, হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে।
____________
নওশাদ চৌধুরী অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নাতি কে রুমে পাঠিয়ে দেন ফ্রেস হওয়ার জন্য। তারপর বসা থেকে উঠে রুমের দিকে এগিয়ে যান ওয়াইফ কে নাতির কথা গুলো জানানোর জন্য।
ভিরান রুমে এসে দেখে ওর বাবা এখনো ওয়াশরুম থেকে বের হয়নি। নিজেই গায়ে থাকা পোশাক খুলে শুধু প্যান্ট পড়ে বসে থাকে ছোট চেয়ার টায়।
নির্ভান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ছেলে কে ফ্রেস করিয়ে দেয়। গা মুছিয়ে বেবি লোশন ক্রীম লাগিয়ে দিয়ে প্যান্ট আর টিশার্ট পড়িয়ে দেয়। নির্ভানের চোখ মুখের চেয়ে আজকে ভিরানের চোখ মুখ বেশি গম্ভীর থমথমে।
নির্ভান ছেলের চুল গুলো ব্রাশ করতে করতে বলে,
“চোখ মুখ এমন করে রেখেছো কেন?”
“কথা বলবে না তুমি আমার সাথে।”
নির্ভান অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
“কথা বলবো না কেনো পাপা?”
“বিকজ তুমি আমার কথা শোনেনি।”
“অকারণে এমন জেদ করছো কেন?”
“অকারণে জেদ করছি? আমি তুরা কে তোমার কুইন বানাব।”
“এটা সম্ভব নয়।”
“কেন? তুরা কে কত সুন্দর দেখতে, কি সুন্দর করে কথা বলে। জানো তুরা আমাকে আদর করেছিল। কোলে নিয়েছিল।”
“ভালো ছেলেদের সবাই আদর করে তাই তুরাও তোমাকে আদর করেছে।”
“নো, তুরা অন্য রকম।”
“তোমার টিউটর এসে পড়বে এখন, চলো স্টাডি রুমে।”
“আমি পড়বো না।”
“তুমি দিন দিন আমার অবাধ্য হয়ে যাচ্ছো ভিরান।”
“অবাধ্য তো তুমি, কারো কোনো কথা শোনো না।”
নির্ভান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর ভিরানের স্কুল ব্যাগ টা হাতে নিয়ে অন্য হাতে ভিরানের এক হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে স্টাডি রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
,
,
ভিরান কে পড়ানো শেষ করে টিউটর চলে যায়। ভার্সিটির একজন বয় স্টুডেন্ট ভিরান কে পড়ায়।
টিউটর চলে যাওয়ার পর ভিরান কে কোলে তুলে নিয়ে ডাইনিং রুমে আসে নির্ভান। বাবা-মা আর ছেলে কে সাথে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। নির্ভানের ছোট বোন বিভার বিয়ে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। বিভার শশুর আর হাজব্যান্ডের নিজস্ব বিজনেস আছে সেখানে।
ছেলে কে আগে খাইয়ে দিয়ে তারপর নির্ভান নিজে খায়।
খাওয়া শেষ করে সোফায় বসতেই ভিরান তুরার কথা তোলে। ছেলের মুখে আবার তুরার নাম শুনে নির্ভানের মেজাজ গরম হয়ে যায়। এই ছেলে কি শুরু করেছে সেই দুপুর থেকে? পুরো মাথা খারাপ বানিয়ে দিয়েছে ওর।
ছেলে কে কোলে তুলে জোর করে নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে বাবা-মা দুজন ওদের দুজনের চলে যাওয়া দেখেন।
নির্ভান রুমে এসে ডোর লক করে ছেলে কে বেডে শুইয়ে দিয়ে লাইট অফ করে নাইট ল্যাম্প অন করে শুয়ে পড়ে বেডে।
ভিরান রেগে বেডের ওপর পাশে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে।
নির্ভান ছেলে কে টেনে আনে নিজের কাছে। ভিরান আবার চলে যায়, নির্ভান আবার টেনে এনে নিজের বুকের উপর তুলে নেয়।
নির্ভান ছেলের মাথায় চুমু খেয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি পাপার সাথে রাগ করলে পাপা কষ্ট পায়।”
ভিরান মুখ তুলে বাবার মুখের দিকে তাকায়। অভিমানী স্বরে বলে,
“তুরা কে এনে দাও তাহলে আর রাগ করবো না।”
“তুরা কে আনা যাবে না পাপা।”
“কেনো যাবে না?”
“তুরা আমাদের জন্য না।”
“তাহলে কার জন্য?”
“অন্য কোনো এক রাজ্যের রাজার জন্য।”
“দাদু তো বলেছে তুমি রাজা, আমি রাজপুত্র আর আমাদের এই বিশাল বাড়িটা একটা রাজ্য।”
“এই বিশাল রাজ্যের জন্য আমি একদিন রানি নিয়ে আসবো তোমার জন্য। তুমি তখন রাজা হবে আর তোমার একটা রানি থাকবে। এখন ঘুমাও সকালে কিন্ডারগার্ডেনে যেতে হবে।”
“না, আমাদের এই প্যালেসের একমাত্র কুইন হবে তুরা। তুরা ছাড়া অন্য কাউকেই কুইন বানাব না আমি।”
ছেলের এক কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত নির্ভান।
কি করলে এই ছেলে তুরার নাম ভুলবে? মন মস্তিষ্কে একদম জেঁকে বসেছে তুরা।
চুপ চাপ কিছু সময় অতিবাহিত হয়। নির্ভান ভেবেছে ওর ছেলে ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণ করে একটু পরেই ভিরান বলে ওঠে,
“তুরা তোমার ওয়াইফ হলে আমাদের সাথে এই বেডেই ঘুমাবে তাইনা পাপা? তখন অনেক মজা হবে, তোমরা দুজন দুপাশে ঘুমাবে আর আমি মাঝখানে।”
নির্ভান নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেলছে। এই ছেলে আজকে ওর কাছে বকা খেয়ে তবেই বোধহয় ঘুমাবে।
“ভিরান চুপ চাপ ঘুমাও। তোমাকে কে বলেছে তুরা আমার ওয়াইফ হলে আমাদের সাথে ঘুমাবে?”
“কেউ বলেনি কিন্তু আমি জানি। দাদু তো দাদু ভাইয়ের ওয়াইফ তাই তারা দুজন সব সময় একসাথে ঘুমায়। মনি আর ফুপাও তো একসাথে ঘুমায়। তাহলে তুরা কেনো আমাদের সাথে ঘুমাবে না? তুরাও আমাদের সাথে ঘুমাবে।”
“তুমি দিন দিন দুষ্ট হয়ে যাচ্ছো পাপা।”
“আমি দুষ্টামি করি না পাপা।”
“তাহলে ঘুমাও এখন।”
চুপ চাপ শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যায় ভিরান।
ছেলে কে বুকের উপর রেখেই ফোন হাতে তুলে নেয় নির্ভান। ফোনের গ্যালারি ঘেঁটে সুহানার একটা পিক বের করে। ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে রইলো হাস্যোজ্বল সুহানার মুখের দিকে। মেয়েটা অনেক হাসিখুশি ছিল, ওকে অনেক ভালোবাসতো। ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে নির্ভান বির বির করে বলে,
“তোমাকে আমি ভালো রাখতে পারিনি সুহানা। তুমি কেনো অভিযোগ করোনি? কেনো বলোনি আমি কেনো তোমাকে সময় দিই না? কেনো এতো কাজ নিয়ে বিজি থাকি? কেনো তোমাকে বোঝার চেষ্টা করিনি? কেনো তোমার মনের জমানো কথা গুলো শুনতে চাইনি কখনও? কেনো কখনও জিজ্ঞেস করিনি তুমি কিছু বলবে? বলো আমি শুনছি। একটা বার তো অভিযোগ করতে পারতে। কেনো অভিযোগ করোনি বলো।”
অদৃশ্য কেউ একজন যেন বলে,
“ভালোবাসায় অভিযোগ থাকতে নেই নির্ভান। তুমি নতুন করে আবার জীবন শুরু করবে। তাকে সময় দেবে, সময় নিয়ে তার মনের কথা গুলো শুনবে। মাঝে মধ্যে তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। তোমার জীবনে ভালো একজন মানুষ আবার আসুক আর সে তোমাকে অনেক অনেক ভালো রাখুক। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি নির্ভান। তোমার মনের এক কোণে আমাকে রেখে দিও আর পুরো জায়গা টা অন্য কাউকে দিও। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুমি কেমন স্বভাব চরিত্রের মানুষ সেটা জেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। আমি কখনোই চাইনি আমার জন্য তুমি নিজের পার্সোনালিটি চেঞ্জ করো। আমি তোমার পার্সোনালিটির প্রেমেই হোঁচট খেয়ে পড়েছিলাম। আমাদের ছেলে কে সব সময় তোমার কাছে কাছে রাখবে। ওকে দূরে রাখবে না নিজের কাছ থেকে। সব শেষে আবারো বলতে চাই তুমি নতুন করে জীবন শুরু করবে।”
উঁহু অদৃশ্য কেউ এই কথা গুলো বলেনি বা বলছে না। নির্ভানের মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেউ একজন বলছে।
এই কথা গুলো সুহানা মৃত্যুর আগের দিন নির্ভান কে বলেছিল। সুহানা কে নিয়ে নির্ভান যখনই ভাবে তখন এই কথা গুলো ওর কানে বাজতে থাকে।
ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নেয়। তারপর সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে,
“হে আল্লাহ আমার সুহানা কে তুমি ভালো রেখো, ওকে জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু মোকাম দান করো।”
_____________
সকালে ঘুম থেকে উঠে রুমেই ফজরের নামাজ আদায় করে নির্ভান। চেঞ্জ করে জগিং করতে বেরিয়ে যায়।
জগিং করে বাড়িতে ফিরে এসে জানতে পারে ভিরান এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।
মেড কে খাবার রেডি করতে বলে রুমে চলে আসে। ছেলে কে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
অল্প সময়ের মধ্যে নিজে এবং ছেলে কে ফ্রেস করিয়ে দুজনেই টাওয়েল পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে।
নির্ভান আগে ট্রাউজার পড়ে নেয় তারপর ছেলে কে পড়াতে যায়। ভিরানের টাওয়েল খুলতে নিতেই ভিরান চেঁচিয়ে উঠে বলে,
“তুমি রোজ রোজ আমার টাওয়েল খোলো কেন? আমি কি তোমার টাওয়েল খুলে দেই?”
“ভিরান ড্রামা বন্ধ করো, দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার।”
“আমি ড্রামা করছি না।”
“তাহলে এমন করছো কেন?”
“আমি বড় হয়ে গেছি এখন। আমার টাওয়েল ছাড়ো।”
“এতক্ষণ ড্রেস ছাড়া গোছল করালাম তখন লজ্জা করলো না আর এখন টাওয়েল খুলে প্যান্ট পড়তে লজ্জা করছে? অদ্ভুত, হাত সরাও দ্রুত।”
ভিরানের হাত সরিয়ে টাওয়েল খুলে প্যান্ট পড়িয়ে দেয় নির্ভান। কিন্ডারগার্ডেনে যাওয়ার জন্য একে বারে তৈরি করিয়ে নিয়ে নিচে নেমে আসে নিজে একটা টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে।
ভিরান কে খাওয়ানোর সময় ভিরান বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি আজকে কিন্ডারগার্ডেনে যাব না।”
নির্ভান ভিরান কে সিদ্ধ ডিম খাওয়াতে খাওয়াতে বলে,
“কেনো যাবে না?”
“তুরা কে খুঁজতে যাব আজ।”
“কোথায়?”
“তোমার অফিসে।”
“প্রতিদিনের মতো ছুটির পর অফিসে যাবে।”
“আমি এখনই যাব।”
“এখন অফিস খোলেনি।”
“আমি কি এখন যাব নাকি? আমি তো তোমার সাথে যাব।”
“বেশি কথা না বলে খাও।”
ভিরান দাদার মুখের দিকে তাকায়। দাদা ইশারায় কিছু বলে। নির্ভান বাবার দিকে তাকাতেই তিনি ইনোসেন্ট মানুষের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে থাকে।
ভিরান কে খাওয়ানো শেষ করে ড্রাইভারের সাথে কিন্ডারগার্ডেনে পাঠিয়ে দেয় নির্ভান। ছেলে কে পাঠিয়ে দিয়ে এসে নিজে খেয়ে নেয় তারপর রুমে এসে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।
_____________________
সাড়ে এগারোটায় নওশাদ চৌধুরী আর ভিরান অফিসে আসে। নওশাদ চৌধুরী রেগুলার অফিসে আসেন না এখন।
দাদার কোলে চড়ে ভেতরে আসতে আসতে তুরা কে কেমন দেখতে তা ডিটেইলে বর্ণনা করছে ভিরান। নওশাদ চৌধুরী মন দিয়ে নাতির কথা শুনছেন। এই দিয়ে বোধহয় দশ বারো বার দিয়ে ফেললো তুরার বর্ণনা।
নির্ভানের কাছে না গিয়ে আগে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে আসেন নওশাদ চৌধুরী।
নাতির জেদের কারণে যদি ছেলে কে আবার বিয়ে করাতে পারেন তাহলে মন্দ কোথায়? ছেলে টা আর কত কাল এভাবে থাকবে?
গত কালকের সকাল নয়টার প্রবেশ গেটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে বলেন নওশাদ চৌধুরী।
ফুটেজ চালু করার কয়েক মিনিট পরেই চেঁচিয়ে উঠে ভিরান বলে,
“দাদু ভাই ওই যে তুরা। হোয়াইট ড্রেস পড়া, ওটাই তুরা।”
নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মনিটরের স্ক্রিনে তাকান নওশাদ চৌধুরী। তুরা কে চিনতে না পারলেও তুরার বাবা কে চিনতে পারেন। তুরার বাবা তুহিন শিকদার ওনাদের অফিসের ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত আছেন গত পনেরো বছর ধরে। ভদ্রলোক অনেক ভালো আর সৎ একজন মানুষ। তুরা কে দেখে ওনারও বেশ পছন্দ হয়, ভিরানের ভাষ্য অনুযায়ী আসলেই ফেয়ারি টেল মুভির কুইন গুলোর মতন দেখতে।
তুরা কে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওনার ছেলের চেয়ে তুরার বয়স অনেক কম। উনি ভেবেছিলেন তুরা হয়তো অন্য কোনো অফিসের স্টাফ হবে। কোনো প্রয়োজনে বোধহয় এই অফিসে এসেছিল।
নাতি কে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হতেই নির্ভানের নাম্বার থেকে কল আসে।
নির্ভান বাবার ফোনের রিংটোন শুনে ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাঁকিয়ে দেখে দুজন দাঁড়িয়ে আছে।
এগিয়ে এসে ছেলে কে কোলে তুলে নেয় নির্ভান। ভিরান দাদার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুরা কে এনে দেবে না দাদু ভাই?”
ছেলের মুখে পুনরায় তুরার নাম শুনে নির্ভানের চোখে মুখে অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে।
নওশাদ চৌধুরী ছেলের চেহারা দেখে চুপসে যান, কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারেন না।
নির্ভান ছেলে কে নিয়ে বেড রুমে চলে আসে।
ফ্রেস করিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ক্যাজুয়াল শার্ট প্যান্ট পড়িয়ে দেয় আবার।
পিয়ন খাবার দিয়ে যায় ভিরানের জন্য। নিজ হাতে ছেলে কে খাইয়ে দেয়।
পুরোটা সময় নওশাদ চৌধুরী সোফায় বসে থাকেন চুপ চাপ। এর মধ্যে ভিরান অনেক বার তুরা কে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে, নির্ভান প্রতি উত্তর করেনি।
খাওয়া শেষ হতেই বেড থেকে নেমে দাদার কাছে দৌড়ে আসে ভিরান। দাদার হাত ধরে টেনে বলে,
“দাদু ভাই চলো তুরা কে নিয়ে আসি।”
নওশাদ চৌধুরী কেমন যেন থমথমে স্বরে বলেন,
“তুরা আজকে অফিসে আসেনি।”
“তাহলে কোথায় আছে তুরা?”
“ওর বাড়িতে।”
“তাহলে চলো ওর বাড়ি থেকে নিয়ে আসি ওকে।”
“ওর বাড়ি তো আমি চিনি না দাদু ভাই।”
“তাহলে কে চেনে?”
“জানিনা না তো।”
“তুরার বাবার কাছে চলো, উনি তুরার বাড়ি চেনে।”
“তুরার বাবা কে?”
“ওই দাদু টা যার সাথে তুরা অফিসে এসেছিল।”
নাতির বুদ্ধি দেখে নওশাদ চৌধুরী একটু অবাক হন। একসাথে আসতে দেখেই বুঝতে পেরে গেছে উনি তুরার বাবা।
নওশাদ চৌধুরী ছেলের মুখের দিকে তাকান। নির্ভান গম্ভীর হয়ে বসে আছে। কারো দিকে তাকাচ্ছে না, ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
নওশাদ চৌধুরী থেমে থেমে বলেন,
“তুরা আমাদের ম্যানেজার তুহিন শিকদারের মেয়ে।”
নির্ভান মুখ তুলে তাকায়। থমথমে গম্ভীর স্বরে বলে,
“এটা জেনে আমি কি করব?”
“ভিরান
বাকি কথা শেষ করার আগেই নির্ভান বলে,
“ভিরান ছোট মানুষ, ওর সাথে তুমিও ছোট হইয়ো না।”
“বলছিলাম
“কাজ আছে আমার, আসছি। ভিরান কে দেখে রাখো একটু।”
নির্ভান বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ভিরান দাদার হাত ধরে টানতে থাকে তুরার বাবার কাছে যাওয়ার জন্য।
নওশাদ চৌধুরী গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। ভিরান যা চাইছে তা আদো কোনো দিন সম্ভব হবে কিনা আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।
______________
অফিস ছুটির পর ভিরান কে জোর করে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে নির্ভান। ভিরান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাদঁছে এখন। অফিসেও সারা দিন একটু পর পর কেঁদেছে। বাড়িতে ফেরার পর থেকে গলা ফাটিয়ে কাদঁছে এখন।
নির্ভান ছেলে কে সোফায় বসিয়ে দেয়। ভিরান সোফা থেকে নেমে বাইরের দিকে দৌড় শুরু করে।
নির্ভান আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্লান্ত দৃষ্টিতে ছেলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে।
দুপুরের পর থেকে নির্ভানের মেজাজ ভীষণ রকমের গরম হয়ে আছে। ছেলে কে বড় করতে চার বছরে যতটা না ক্লান্ত হয়েছে আজকে লাস্ট চার ঘণ্টায় তার চেয়ে অনেক বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছে। তুরার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে ভিরান। ছেলের আচরণে নির্ভান পা’গল হয়ে গেছে আজকে। আর সহ্য হচ্ছে না।
ইচ্ছে করছে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে।
নওশাদ চৌধুরী নাতি কে ধরে নিয়ে আসেন।
ভিরান দাদার কাছ থেকে ছোটার চেষ্টা করে কাদতে কাদতে বলে,
“আমাকে ছাড়ো, আমি তুরার কাছে যাব। তুমিও পঁচা, তুরা কে এনে দেবে বলেও এনে দাওনি।”
নওশাদ চৌধুরী নাতি কে শান্ত করার চেষ্টা করে বলেন,
“তুরা ওদের বাড়িতে নেই, তুরা ওর নানুর বাড়িতে গেছে। নানুর বাড়ি থেকে ফিরে আসলে আমরা গিয়ে নিয়ে আসব।”
“মিথ্যে বলছো তুমি।”
“তুমি শান্ত হও।”
“না তুরা কে এনে দাও।”
নির্ভান ছেলের উপর রেগে ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে বলে,
“ছেড়ে দাও ওকে, যেখানে যেতে চায় যেতে দাও। চার বছর ধরে আমি লালন পালন করছি, বড় করেছি আর এখন একদিনের পরিচয়ের একটা মেয়ে ওর কাছে বড় হয়ে গেছে? যেখানে যেতে চাইছে যেতে দাও, আর সহ্য হচ্ছে না এসব।”
বাবার এত জোরে চিৎকার শুনে ভিরানের কান্না বন্ধ হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এর আগে কোনো দিন বাবাকে এভাবে চিৎকার করতে দেখেনি ভিরান।
নির্ভান বাবার কাছে এগিয়ে এসে ভিরান কে জোর করে কোল থেকে নামায়। ছেড়ে দিয়ে বলে,
“যা কোথায় যাবি চলে যা। আর কখনো আসবি না আমার কাছে। আমার থেকে ওই তুরা তোর কাছে বড়? যা তুরার কাছে চলে যা।”
বাবা কে এভাবে কথা বলতে দেখে ভিরান আবার কেঁদে ওঠে। নির্ভান ছেলে কে ঠেলে ডোরের দিকে এগিয়ে দেয়। ভিরানের কি যেন হয়, ঠাস করে ফ্লোরে পড়ে যায়। ছেলে কে এভাবে পড়ে যেতে দেখে রাগ জেদ ভুলে নির্ভান ভিরানের নাম ধরে ডেকে ভিরানের কাছে হাটু গেড়ে বসে। ছেলে কে নিচ থেকে তুলে দেখে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে, এখন আর কাদঁছে না সম্ভবত শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নির্ভান ছেলের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। ছেলে কে ধরে কয়েক টা ঝাঁকি দেওয়ার পর ভিরান কেঁদে ওঠে আবার। হা করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে তুরার নাম ধরে কাঁদে।
নির্ভান ছেলে কে বুকে চেপে ধরে শক্ত করে। নির্ভানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। চার বছরে আজকের মতো এত রেগে জোরে ছেলের সাথে কথা বলেনি কখনও।
নির্ভান ছেলে কে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাহু দিয়ে চোখের পানি মুছে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুহিন আংকেল কে কল করে ওনার বাড়ির এড্রেস জেনে নাও।”
বলতে বলতে বাইরের দিকে এগিয়ে যায় ছেলে কে কোলে নিয়ে। পেছন পেছন দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান নওশাদ চৌধুরী।
চলবে………..