ভাঙা পাঁজরে বসন্ত পর্ব-১০

0
14

#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_10

দৌঁড়ে এসে ছেলে কে ধরে কোলে তুলে নেয় নির্ভান। ভিরান হাত পা ছোড়াছুড়ি করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ছাড়ো আমাকে, মিথ্যে বলেছো তুমি। তোমার সাথে যাব না আমি।”

“আমার কথা শোনো পাপা, আমরা অস্ট্রেলিয়া যাব তোমার মনি’র কাছে।”

“আমি যাব না।”

“তুরার জন্য গিফট কিনে নিয়ে আসবো ওখান থেকে, গিফট পেয়ে তুরা অনেক খুশি হবে।”

এক দমে ডাহা মিথ্যা কথা গুলো বলে দম নেয় নির্ভান।
এই কথা শুনেই ভিরানের কান্না বন্ধ হয়ে যায়। লাফালাফি বন্ধ করে শান্ত হয়। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে,

“তুরার জন্য গিফট আনতে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“আগে বলোনি কেন?”

“ভেবেছিলাম তোমাকে আর তুরা কে সারপ্রাইজ দিবো তাই।”

ভিরান খুশি হয়ে বলে,

“তাহলে তুরার জন্য একটা ট্যাব কিনে নিয়ে আসবো।”

“ট্যাব কেন?”

“তুরার ট্যাব নেই। বড় বড় চকলেটও নিয়ে আসবো কিন্তু। তুরা চকলেট অনেক পছন্দ করে। ওর জন্য কুইনের ড্রেসও নিয়ে আসবো সুন্দর সুন্দর।”

“সব কিছু নিয়ে আসবো, এখন চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“ওকে চলো তাহলে।”

নির্ভান স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। যাক অবশেষে শান্ত হয়েছে। একবার শুধু অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাতে পারলে হয় তারপর তুরার ভূ’ত মাথা থেকে কিভাবে বের করতে হবে খুব ভালো করেই জানা আছে।
_____________

তুরা উদাস মনে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে থেকে ভিরান আর আসবে না। ভিরানের জন্য মনটা ভীষণ ছটফট করছে। ভীষণ মায়া জন্মে গেছে ছেলেটার জন্য। দুপুরে খেতে বসে গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। গত দিন গুলোতে ভিরান আর তুরা একসাথে খেতে বসতো।

তুরা অনুভব করে ওর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ভাইয়া দূরে যাওয়ার পর ভাইয়ার জন্যও অনেক কান্না করেছিল তুরা। অনেক গুলো দিন কেঁদেছিল ভাইয়ের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে ভাইয়া কে ছেড়ে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে।

কয়েক দিন পর ভিরানের জন্যও এত কষ্ট হবে না। আস্তে আস্তে হয়তো ভিরানের মায়াও কা’টিয়ে উঠবে।
বেলকনি থেকে রুমে ফিরে রুম অন্ধকার করে বেডে উঠে শুয়ে পড়ে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে।
এই সময় টায় ভিরান কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকতো, আজকে একা একা ঘুম আসছে না।
_____________

সময় নিজ গতিতে ছুটে চলে। পেরিয়ে গেছে দুদিন। এই তিন দিনে ভিরানের সাথে ফোনেও কথা হয়নি তুরার। বাবার কাছ থেকে শুনেছে ভিরান নাকি অস্ট্রেলিয়ায় হাসি খুশি ভাবেই আছে। ফুপি আর তার পরিবারের সাথে ভালো সময় পাড় করছে।

তুরা টিভিতে হানি-বানি কার্টুন প্লে করে সোফায় বসে।
হানি-বানি, টম অ্যান্ড জেরি, মোটু-পাতলু, গোপাল ভাঁড় এই চার টা কার্টুন তুরার অনেক পছন্দের। রোজ এই কার্টুন গুলো দেখে আর দম ফাটা হাসিতে ফেটে পড়ে।
মুক্তা শিকদার বকাবকি, রাগারাগি করেও মেয়েকে এই কার্টুন দেখা থেকে দূরে সরাতে পারেন না। জোর করে দেখবে আর হা হা করে হাসবে। মাঝে মধ্যে তো হাসতে হাসতে সোফা থেকে নিচে পড়ে যায়।

মুক্তা শিকদার এসে বসেন মেয়ের পাশে। কার্টুন দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে তুরা। তুরার হানি কে বেশ পছন্দ। তুরা আর হানি দুজনেই একরকম। দুজনের একজনের মাথায়ও ব্রেইন নেই। যদিও তুরা হানির মতো উল্টা পাল্টা কাজ করে না কিন্তু মুক্তা শিকদার সব সময় তুরা কে হানির থেকেও বেশি গাধা আর অকাজের মনে করেন। হানি কাজ পারুক আর না পারুক তবুও তো করে। তুরা তো তাও করে না।

মুক্তা শিকদার কিছু সময় টিভির দিকে তাকিয়ে থাকেন তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“বাচ্চা ছেলে টা কয়েক দিনেই কেমন মায়া ধরিয়ে দিয়েছে। তিন দিন ধরে আসে না, কেমন যেন মনটা ছটফট করে। ভালো লাগে না কিছুই।”

তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়।
মলিন মুখে বলে,

“তুমিও ভিরান কে মিস করো?”

“করবো না!”

“অন্যের ছেলে কে নিয়ে এত ভাবতে হবে না, ভুলে যাও। ভাইয়া তো আসছে কিছু দিন পর। আসার সাথে সাথেই মেয়ে খুঁজে বিয়ে করিয়ে দেবে। তারপর ভাইয়ার ছেলে মেয়ে হলে তাদের কে নিয়ে থাকবে।”

মেয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে রইলেন মুক্তা শিকদার। বিস্ময় নিয়ে বলেন,

“তুই এত কথা কবে শিখলি? এত বুদ্ধি কিভাবে হলো তোর মাথায়?”

মা কে এত অবাক হতে দেখে তুরা নিজেও অবাক হয়ে বলে,

“কথা বলার সাথে বুদ্ধি হওয়ার কি সম্পর্ক?”

“তোর মাথায় তো এত বুদ্ধি ছিল না। শিখিয়ে দেওয়ার পরেও তো ঠিক ভাবে বলতে পারতি না। তোর থেকে তো ভিরানই বেশি গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলে। এখন দেখছি তুই বড়দের মতো কথা বলছিস। ভিরানের সাথে থাকতে থাকতে ভিরানের বাতাস লেগেছে দেখা যাচ্ছে।”

তুরা কিছু না বলে টিভির দিকে তাকায়। হানি পপাতের গলা চেপে গলা ব্যাথা ঠিক করার চেষ্টা করছে। পা টিপলে পা ব্যাথা ঠিক হয়, তাহলে গলা টিপলে গলা ব্যাথা কেনো ঠিক হবে না?
_____________

নির্ভান ছেলে, ছোট বোন বিভা আর বিভার মেয়ে নিদ্রা কে নিয়ে সারা দিন শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা সহ এদিক ওদিক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সারা দিন ঘুরাঘুরি শেষে সন্ধ্যা হতে হতেই ক্লান্ত হয়ে একাই ঘুমিয়ে যায়, ঘুম থেকে ওঠে পরের দিন সকালে। নির্ভান আবার নতুন পার্কে, চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে শান্ত করে রাখে।

তুরার কথা খুব একটা বলে না ভিরান। নির্ভান তো মহা খুশি। ওর প্ল্যান সাকসেস হচ্ছে। ও কোনো প্ল্যান করবে আর সেটা সাকসেস হবে না, এটা অসম্ভব।

সকালে বাড়ি থেকে নাস্তা সেরে তিন জন কে নিয়ে বের হয় নির্ভান।
সারা দিন ঘুরাঘুরি করে রাতে বাড়ি ফিরবে।
_____________

ভিরান বাংলাদেশে নেই আজ এগারো দিন।
ভিরানের মায়া কিছুটা কা’টি’য়ে উঠেছে মায়া। এখন আগের মতো অত খারাপ লাগে না, কষ্ট হয় না কিন্তু মনে পড়ে রোজ।

সন্ধ্যার পর সোফায় চিৎ পটাং হয়ে শুয়ে চিপস্ খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। দিনে দুই-তিন প্যাকেট চিপস্ খেতে না পারলে ওর ভালো লাগে না। বড় হয়ে গেলেও বাচ্চাদের মতো স্বভাব আছে এখনো।

কলিং বেল বেজে ওঠে। মুক্তা শিকদার তুরা কে ডেকে ডোর খুলে দিতে বলেন। তুরা না উঠে বাবার দিকে তাকায়। তুহিন শিকদার পেপারে চোখ দাবিয়ে রেখেছিলেন। মেয়ে উঠছে না বুঝতে পেরে পেপার মুখের সামনে থেকে সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকান। তুরা মুখে চিপস্ পুরতে পুরতে হেসে বলে,

“আব্বু তুমি দেখো।”

“অলস একটা।”

দাঁত বের করে হাসি দেয় তুরা। তুহিন শিকদার পেপারে রেখে দ্রুত পায়ে উঠে ডোরের দিকে এগিয়ে যান। লাগাতার কলিং বেল বেজেই চলেছে।

ডোর খুলে দিয়ে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকেন তুহিন শিকদার। মেরি চৌধুরী এতক্ষণ এভাবে কলিং বেল চাপছিলেন! অবাক করা ব্যাপার। ওনার পাশে শুঁকনো, ক্লান্ত, মলিন চোখ মুখে মুমূর্ষ ছেলে কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভান। ভিরানের এক হাতে ক্যানুলা লাগানো, নাকেও নাসোগ্যাস্ট্রিক টিউব লাগানো রয়েছে। ভিরানের অবস্থা দেখে আতকে ওঠেন তুহিন শিকদার। কি হয়েছে ভিরানের? নড়াচড়া করছে না একটুও, কেমন নিস্তেজ, ফ্যাকাশে চেহারা। এখন তো ওদের দুজনের অস্ট্রেলিয়ায় থাকার কথা। এখানে কি করছে?
আতঙ্কিত হয়ে নির্ভানের দিকে তাঁকিয়ে বলেন,

“স্যার ভিরানের কি হয়েছে?”

নির্ভান মলিন স্বরে বলে,

“তুরা কোথায়?”

“ভেতরে।”

তুহিন শিকদার কে পাশ কা’টি’য়ে ভেতরের দিকে পা বাড়ায় নির্ভান। ওর সাথে সাথে আগায় মেরি চৌধুরী। দ্রুত পায়ে এদিকেই আসছেন নওশাদ চৌধুরী।

নির্ভান সোফায় চিৎ পটাং হয়ে শুয়ে থাকা তুরার দিকে তাঁকিয়ে থাকে একটু সময়। বাচ্চা একটা মেয়ে, কেমন এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। খোলা চুল গুলো সোফার নিচে ঝুলে আছে এলোমেলো হয়ে।
নির্ভান ডাকে,

“তুরা।”

তুরা দ্রুত গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসে তাকায় নির্ভানের দিকে।
নির্ভান আবার ডাকে অসহায় স্বরে,

“তুরা।”

তুরা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ভিরানের দিকে তাঁকিয়ে এগিয়ে আসে দ্রুত। নির্ভানের সামনে দাঁড়িয়ে ভিরান কে ভালো ভাবে দেখে। চোখ মুখ তুলে নির্ভানের মুখের দিকে তাকায়। নির্ভানের চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। তুরা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,

“কি হয়েছে ভিরানের? ওকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

“আমার ছেলে টা কে বাঁচিয়ে দাও তুরা।”

নির্ভানের অসহায় গলার স্বর শুনে তুরার ভেতর পর্যন্ত নড়ে ওঠে। তুহিন শিকদার সহ বাকি তিন জন ওদের দুজনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুক্তা শিকদার অবাক হয়ে বাপ ছেলে কে দেখছেন। নির্ভান কে এমন দেখাচ্ছে কেন? ভিরানের কি হয়েছে?

তুরা আবার বলে,

“কি হয়েছে ভিরানের?”

“তোমার কাছে আসার জন্য খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কেঁদে কে’টে অসুস্থ হয়ে গেছে। দেখো কেমন হয়ে গেছে। গত কয়েক দিন ধরে খুব একটা নড়া চড়া করছে না, কথা বলে না, আমার দিকে তাকায় না। ফ্যালফ্যাল করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে আর তোমাকে ডাকে বির বির করে। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না তুরা।”

ঢোঁক গিলে থেমে থেমে কথা গুলো বলে নির্ভান।
নিস্তেজ ভিরান কে দেখে তুরার দু চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। নির্ভানের কষ্টে ওরো কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে বা টিভির পর্দায় যে কারো কষ্ট দেখলে তুরার কষ্ট হয়, কান্না আসে।
নির্ভান কোমল স্বরে ছেলে কে ডাকে,

“পাপা আমরা তুরার কাছে চলে এসেছি। চোখ খোলো দেখো তুরা তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তুরা তুমি ডাকো ভিরান কে।”

তুরা ভিরান কে ছুঁয়ে ডাকে,

“ভিরান ঘুমিয়ে পড়েছ? এই যে আমি তোমার সামনে।”

ভিরান তাকায় না, সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে আছে বোধহয় এখন। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময়ও তো জেগে ছিল, তাঁকিয়ে ছিল ফ্যালফ্যাল করে। দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল।
ভিরান কে তুরার কোলে তুলে দেয় নির্ভান।

“ওকে নিয়ে বেডে শুইয়ে দাও, ওর পাশ থেকে সরো না। ঘুম ভাঙার পর তোমাকে খুঁজবে।”

মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায় তুরা। নির্ভান তুরা কে পেছন থেকে দেখতে থাকে। তুরা চোখের আড়ালে চলে যেতেই তুহিন শিকদারের দিকে তাকায় নির্ভান। তুহিন শিকদার আর মুক্তা শিকদার ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে গেছে। ভিরানের এই অবস্থা দেখেই বোধহয় এমন হয়ে গেছে চেহারা।
তুহিন শিকদার পুনরায় একই প্রশ্ন করেন,

“স্যার ভিরানের কি হয়েছে?”

নির্ভান দুই কদম এগিয়ে তুহিন শিকদারের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ভাঙা স্বরে বলে,

“আমি ভেবেছিলাম তুরার কাছ থেকে ভিরান কে দূরে সরিয়ে নিলে ভিরান তুরা কে ভুলে যাবে, কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। ভিরান তুরা কে ভুলতে পারেনি, আর কোনো দিন পারবেও না।”

নির্ভান লম্বা শ্বাস টেনে নেয়। দম বন্ধ হয়ে আসছে ছেলের অবস্থা দেখে। ওর শরীর এখন আর চলছে না। কথা বলতে গেলেও হাঁপিয়ে উঠছে।
দুই হাতে তুহিন শিকদারের হাত মুঠো করে ধরে। মাথা নিচু করে বলে,

“আমি জানি আমি আপনার কাছে ভুল এবং অন্যায় আবদার করব। আমি এটাও জানি আমি তুরার উপযুক্ত না, তুরার যোগ্যও না আমি। তুরা আমার চেয়ে বেটার লাইফ পার্টনার ডিজার্ভ করে। তবুও আমি আজকে আপনার কাছে তুরা কে চাইছি সারা জীবনের জন্য। আমি তুরা কে আগলে রাখব, ভালো রাখব। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো সব সময় ওকে ভালো রাখার। আপনারা আপনাদের মেয়ে কে দিয়ে দিন আমাকে। আমি ওকে চুল পরিমাণ কষ্টও পেতে দিবো না। আল্লাহর কসম করে বলছি আমি ওর চুল পরিমাণ অযত্ন করবো না।”

চলবে………….