#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_12
ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন মুক্তা শিকদার। ভিরান রাতে আর ঘুম থেকে ওঠেনি।। এখনো বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে। তুরা বেশ কয়েক বার ঘুম থেকে উঠেছিল। ঘুম কাতুরে মেয়েটার ঘুমই আসছিল না রাতে।
মুক্তা শিকদার মেয়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজেদের রুমে আসেন। দ্রুত ফ্রেস হয়ে ওযু করে ফজরের সালাত আদায় করেন।
সালাত শেষে রান্না করার জন্য রুম থেকে বের হন। ড্রয়িং রুমের লাইট অন করতে গিয়েও থেমে যান। একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ান সোফার কাছে। নাইট ল্যাম্পের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নির্ভান কে।
নির্ভান চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। দুই হাত বুকের উপর ভাঁজ করে রেখেছে। নির্ভানের জন্য ভীষণ মায়া হয় মুক্তা শিকদারের। স্ত্রী কে হারিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে আবার গড়ে উঠেছিল সন্তান কে আঁকড়ে ধরে। এখন আবার ছেলের এই অবস্থা। নির্ভানের জায়গায় যদি উনি থাকতেন তাহলে বোধহয় নির্ভানের মতোই বলতেন বা তার থেকেও বেশি কিছু বলতেন।
ঘুরে চলে যান কিচেনে। তুহিন শিকদার খাবার খেয়ে আবার অফিসে যাবেন।
____________
সাড়ে ছয় টা নাগাদ নির্ভানের ঘুম ভাঙে তুহিন শিকদারের ডাকে। ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে দ্রুত। কয়েক বার চোখ ঝামটা দিয়ে আবার তাকায়। মাথা ভার হয়ে রয়েছে। ঘুম এখনো হয়নি।
তুহিন শিকদার বলেন,
“ভিরান ঘুম থেকে উঠেছে। আপনাকে খুঁজছে এখন।”
নির্ভান সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
“কোথায় ভিরান?”
“তুরার রুমেই রয়েছে।”
“আন্টি কোথায়?”
“রান্না করছে।”
নির্ভান তুরার রুমের দিকে আগায়। পেছন পেছন তুহিন শিকদার নিজেও আগান।
রুমে এসে দেখে তুরা উবু হয়ে বসে ভিরানের সাথে কথা বলছে। ভিরান খুশি হয়ে তাঁকিয়ে আছে তুরার মুখের দিকে। তুরার একটা হাত দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
নির্ভান দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই ছেলে কে ডাকে,
“পাপা।”
ভিরান বাবার দিকে তাকায়। মুখের হাসি আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তুরা বেড থেকে নেমে দাড়ায়। নির্ভান ছেলের কাছে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয়। ভিরান বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে।
তুরা ওর কাছে থাকলেও বাবা ভীষণ মিস করছিল। ওর বাবা আর তুরা দুজন কেই চাই।
নির্ভান ছেলের মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
“ওয়াশরুমের চাপ আসেনি?”
ভিরান মাথা তুলে বাবার মুখের দিকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
নির্ভান ছেলে কে নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিলে তুহিন শিকদার তুরার ওয়াশরুম দেখিয়ে দেন।
নির্ভান রুম থেকে বের না হয়ে তুরার ওয়াশরুমেই প্রবেশ করে।
ছেলে কে ফ্রেস করিয়ে নিয়ে রুমে ফিরে আসে। বেডের উপর শুইয়ে রেখে ড্রয়িং রুমে আসে। সোফার ওপরে রাতে টাওয়েল রেখেছিল সেটা নিয়ে তুরার রুমে ফিরে আসে আবার। টাওয়েল ভিজিয়ে এনে ভিরানের গা, হাত, পা মুছিয়ে দেয়।
“পাপা তুমি শুয়ে থাকো, আমি ফ্রেস হয়ে এসে খাইয়ে দিব।”
মাথা নাড়ায় ভিরান। নির্ভান রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
অল্প সময়ের মধ্যে ফ্রেস হয়ে আবার এসে দাঁড়ায় তুরার রুমের সামনে। তুরা ভিরানের পাশে বসে গল্প শোনাচ্ছে। তুহিন শিকদার নেই রুমে।
নির্ভান দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। কিছু সময় চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তুরা মুখ তুলে তাকায় নির্ভানের দিকে। চোখাচোখি হয় দুজনের। দুজনের একজনও দৃষ্টি সরায় না, তাঁকিয়ে থাকে একভাবে। নির্ভানের মলিন চেহারা পীড়া দেয় তুরা কে। ভাবতে না চাইলেও নির্ভান চলে আসে ভাবনায়।
নির্ভান কাছে এগিয়ে আসতেই তুরা জড়সড় হয়ে বসে। তুরার সামনেই বসে নির্ভান। ঘুম কম হওয়ার কারণে তুরার চোখ মুখ পরিবর্তন হয়ে গেছে।
____________
নির্ভান ছেলে কে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন খাইয়ে দেয়। দশটা নাগাদ হসপিটালে নিয়ে যাবে।
মুক্তা শিকদার নির্ভান কে বলেন,
“স্যার চলুন খাবার খেয়ে নেবেন।”
নির্ভান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, তারপর বলে,
“আমি আঙ্কেলের বস তাও অফিসে। অফিসের বাইরে আমি কারো বস না। আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন।”
“খাবার বেড়েছি চলুন।”
“আপনারা খেয়ে নিন। আমি হসপিটালে যখন যাবো তখন খেয়ে নিবো বাইরে থেকে।”
“বাইরে থেকে কেনো খাবেন? আমি রান্না করেছি আপনার জন্য। আপনি না খেলে কষ্ট পাবো আমি।”
নির্ভান একটু চুপ থেকে বলে,
“আপনারা খেয়ে নিন, আমি একটু পর খাব।”
“পরে কেন? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।”
“সবাই চলে গেলে ভিরান তো একা থাকবে।”
“তুরা ভিরানের কাছে বসে থাকবে, আপনি চলুন।”
“তুরা খাবে না? ও আগে খেয়ে আসুক আমি পরে খাচ্ছি।”
মুক্তা শিকদার একটু ভেবে ভিরান কে নিজের কোলে তুলে নেন। ধরতে গেলে নির্ভান এখন এই বাড়ির গেস্ট, আর গেস্ট কে রেখে আগে আগে খেয়ে ওঠা মোটেও ভালো দেখায় না।
“আসুন এখন, তুরা আয়।”
মুক্তা শিকদার আগে আগে এগিয়ে যান। নির্ভান তুরার দিকে তাকিয়ে বেড থেকে নেমে বেরিয়ে যায়। তুরা নিজেও বেড থেকে নেমে দাড়ায়। নির্ভান যত বার ওর নাম উচ্চারণ করে তত বার ওর বুকের ভেতর কেমন যেন করে ওঠে। হার্টবিটের গতি বেড়ে যায় সাথে সাথেই। এর আগে কোনো দিনও তুরার সাথে এমন হয়নি।
মায়ের ডাক শুনে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে।
মুক্তা শিকদার ভিরান কে কোলে রেখেই তিন জন কে খাবার পরিবেশন করেন। নির্ভান ভিরান কে কোলে নিয়ে খেতে চাইলেও মুক্তা শিকদার দেন না। নির্ভান বার বার বলে ভিরান কে ওর কাছে দিয়ে মুক্তা শিকদার কে খেতে বসতে।
____________
নির্ভান ছেলে কে কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছে। তুরা কে নিজের সামনে থেকে সরতে দিচ্ছে না ভিরান। বার বার নির্ভান কে ঠেলছে তুরার পাশে বসার জন্য। নির্ভান তুরার পাশে যাচ্ছে না দেখে তুরা কে ওদের কাছে ডাকে। মুক্তা শিকদার দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন তিন জন কে। একটু আগেই তুহিন শিকদার অফিসে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছেন।
কলিং বেল বেজে ওঠে। চার জন তাকায় ডোরের দিকে। মুক্তা শিকদার এগিয়ে গিয়ে ডোর খুলে দেন। ডোরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন নওশাদ চৌধুরী আর মেরি চৌধুরী। পথ ছেড়ে দিয়ে দুজন কে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য বলেন।
নওশাদ চৌধুরী সোফার দিকে এগিয়ে নাতির উদ্যেশ্যে বলেন,
“দাদু ভাই কেমন আছো এখন?”
ভিরান খুশি হয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে শব্দ ছাড়া ওষ্ঠদয় নাড়িয়ে বলে,
“ভালো আছি দাদু ভাই, তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি দাদু ভাই। খাওয়া দাওয়া হয়েছে?”
মাথা নাড়ায় ভিরান।
নওশাদ চৌধুরী নাতির সাথে অল্প সময় পাড় করে উঠে দাঁড়ান। ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আমি অফিসে যাই, ডক্টর কি বলে আমাকে জানিও। ড্রাইভার তোমাদের কে হসপিটালে নিয়ে যাবে।”
নির্ভান মাথা নাড়ায় শুধু। মেরি চৌধুরী কে রেখে নওশাদ চৌধুরী বেরিয়ে যান অফিসের উদ্যেশ্যে।
সাড়ে নয়টা বাজতেই নির্ভান মুক্তা শিকদারের দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“আন্টি ভিরান কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে, সাথে তুরা কেও যেতে হবে। আপনারা দুজন…।”
মুক্তা শিকদার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“তুরা তৈরি হয়ে আয়।”
তুরা সোফা ছেড়ে উঠে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। মুক্তা শিকদার নিজেও রুমের দিকে এগিয়ে যান। নির্ভান ছেলে কে মায়ের কাছে দিয়ে নিজের প্যান্ট-শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
অল্প সময়ের মধ্যেই তিন জন তৈরি হয়ে নেয়। নির্ভান ছেলের ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেস করিয়ে দেয় আবার।
ভিরানের আগের সব রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন মায়ের কাছে দেয় নির্ভান। ছেলে আর বাকি তিন জন কে নিয়ে বের হয় ফ্ল্যাট থেকে। ভিরান তুরা কে নিজের আর বাবার কাছে কাছে রেখেছে। তুরা একটু পিছিয়ে গেলে বা সামনে গেলেই ভিরান উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাই বাধ্য হয়েই নির্ভানের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হচ্ছে।
মুক্তা শিকদার সকাল থেকে শুধু তিন জন কেই দেখে চলেছেন। প্রথম দিকে ওনার ভীষণ আপত্তি ছিল ভিরান আর নির্ভান কে নিয়ে। ওরা ওনার বাড়িতে আসুক এটা পছন্দ করতেন না তখন। পরিস্থিতির কারণে সহ্য করে নিতেন তখন। কিন্তু এখন ওনার কোনো আপত্তি নেই ওদের নিয়ে। ভিরানের প্রতি ভীষণ মায়া জন্মে গেছে। নির্ভানের অসহায়ত্ব দেখে ওনার নিজেকেই অসহায় লাগে। কেনো যেনো ওনার মন চাইছে মেয়ে কে নির্ভানের হাতে তুলে দিতে। ওনার মন বলছে নির্ভান ওনার মেয়ে কে ভালো রাখবে, আগলে রাখবে। বয়স কোনো ব্যাপার না, তুহিন শিকদার ওনার চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড়।
নিজের মনের কথা গুলো তুহিন শিকদার কে বলতে পারছেন না। তুহিন শিকদার কে বুঝিয়ে বললে উনি অমত করবেন না কিন্তু ওনাদের ছেলে তূর্য! তূর্য রাজি হবে বলে মনে হয় না। এই ছেলে বোন কে ভীষণ ভালোবাসে। বোন কে নিয়ে পোসেসিভও। একজন বাচ্চার বাবার কাছে বোন কে বিয়ে দিতে কোনো ভাবেই রাজি হবে না।
তুরা কে কোনো দিন একা ছাড়তে দেয়নি। স্কুল কলেজে সব সময় মুক্তা শিকদার কে আনা নেয়া করতে হয়েছে। তূর্যের কড়া নিষেধ বাণী ছিল, তুরা কে একা ছাড়া যাবে না। আলতু ফালতু মানুষের সাথে মিশতে পারবে না। ফোন ইউজ করতে পারবে না। ভাইয়ের এতো শাসন আর নিষেধ বাণীর কারণেই তুরা আঠারো বছরের হয়েও বোকা সোকা রয়ে গেছে। তুরার সব গুলো টিউটর ছিল মেয়ে। সিক্স থেকে পড়েছে গার্লস্ স্কুল আর কলেজে। এত কিছুর পর হঠাৎ করেই ঝড়ের মতো তুরার জীবনে এসেছে ভিরান চৌধুরী আর নির্ভান চৌধুরী। এই ঝড় তুরা কে উড়িয়ে না নিয়ে থামবে না বোধহয়।
ভিরান তুরা আর বাবা কে ছাড়া বসবে না। নির্ভান ছেলে কে কোলে নিয়ে ফ্রন্ট সিটে বসেছে। ছেলের লাফালাফি তে বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাড়ায়। একদিনেই শক্তি ডাবল হয়ে গেছে ভিরানের। গত কয়েক দিন নড়াচড়া করলো না, আর আজকে লাফালাফি করছে।
নির্ভান অসহায় চোখে তাকায় মুক্তা শিকদারের দিকে। ওনারা তিন জন পেছনে উঠে বসেছেন।
মেরি চৌধুরী বলেন,
“আমি সামনে গিয়ে বসছি।”
মুক্তা শিকদার কিছু বলেন না।
মেরি চৌধুরী নেমে গিয়ে ফ্রন্ট সিটে উঠে বসেন। নির্ভান দাঁড়িয়ে থাকে বাইরেই। মুক্তা শিকদার বলেন,
“নির্ভান উঠে আসুন।”
নির্ভান উঠে বসে তুরার পাশে। তুরার সাথে যেনো ছোঁয়া না লাগে সেজন্য চেপে বসে ডোরের দিকে। কিন্তু ভিরান? ও তুরার কাছে যাওয়ার জন্য ওদিকে ঠেলতে শুরু করে বাবা কে।
বাবার কোলে বসে থেকে তুরার কোলে পা তুলে দেয়। ঝুঁকে পড়ে তুরার বাম হাত টেনে এনে ধরে বসে রইল।
নির্ভান ছেলের দিকে তাকিয়ে তুরার দিকে তাকায়। তুরা ওর দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়।
মুক্তা শিকদারের দিকে তাঁকিয়ে দেখে উনি তাঁকিয়ে আছেন।
নির্ভান ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গাড়ি ছুটে চলে হসপিটালের উদ্যেশ্যে।
তুরা ডান হাতে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখে। নির্ভানের এত কাছে বসে ওর ভেতরে কেমন যেন হচ্ছে। হৃদয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কম্পন সৃষ্টি হয়েছে বুকে।
সকাল থেকে নতুন নতুন অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে অষ্টাদশী যুবতী তুরা।
____________
রাত তিন টা। তূর্য কে নিয়ে আধা ঘন্টা আগেই ফ্ল্যাটে ফিরেছে শিকদার ফ্যামিলি। তূর্য বাবা, মা, বোনের সাথে সময় কা’টি’য়ে একটু আগেই ওয়াশরুমে গেছে শাওয়ার নিতে। দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।
বিশ মিনিট পর চার জন আবার ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়। সবাই চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে এসেছে।
চার জন হাসি খুশিতে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেতে। মুক্তা শিকদার এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে রান্না করে রেখে গিয়েছিলেন। ছেলের পছন্দের আইটেম রান্না করেছেন আজ।
দীর্ঘ সাত বছর পর ছেলে আজ বাড়িতে ফিরেছে। তরুণ ছেলে টি এখন আর তরুণ নেই। পরিপক্ক একজন যুবকে পরিণত হয়েছে। মসৃণ গালে ঘন কালো চাপ দাড়ি হয়েছে। শুঁকনো চিকন দেহ খানা এখন লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ গড়নের হয়েছে। গায়ের রঙ আগের চেয়েও অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। গলার স্বর ভারী হয়েছে।
আগের তূর্য আর এখন কার তূর্যের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক।
ভিরান ঘুমিয়ে যাওয়ার পর নির্ভান ওকে নিয়ে গেছে দশটার পর। দুদিন ধরে ভিরান ঘুমিয়ে যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় নির্ভান। সকালে আবার দিয়ে যায়। ভিরান এখন প্রায় সুস্থ। নির্ভান এখন অফিসে যাওয়া আসা করে। অফিসের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে আবার।
খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর তূর্য সোফায় বসে বাবা আর বোনের সাথে। তুরা বড় ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে। তূর্য এক হাতে বোন কে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বোনের মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে মিষ্টি স্বরে ডাকে,
“পরী।”
তুরা হেসে ভাই কে আরো শক্ত করে ধরে সাড়া দেয়।
“হুম।”
“তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস। এখন আর কোলে নেওয়া যাবে না।”
“কোলে না নিতে পারলে কাঁধে নেবে।”
“কে বলে তোর মাথায় বুদ্ধি কম?”
“আব্বু-আম্মু।”
তূর্য শব্দ করে হেসে ওঠে। তুহিন শিকদার নিজেও হেসে ওঠেন। মুক্তা শিকদার ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে রেখে সোফার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,
“কি দেখে এতো হাসা হচ্ছে?”
তূর্য মায়ের দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“তোমরা দুজন বলো আমার পরীর মাথায় নাকি বুদ্ধি কম কিন্তু আমার পরীর মাথায় তো অনেক বুদ্ধি।”
“তোর পরীর মাথায় সব আজাইরা আর আজগুবি বুদ্ধি।”
তুরা গাল ফুলিয়ে বলে,
“মিথ্যে কথা।”
তূর্য বোনের গাল দুটো টিপে দিয়ে বলে,
“আমার পরীর উপর মিথ্যে দোষ কেনো দাও তোমরা?”
“মিথ্যে দোষ নাকি সত্যি দোষ সেটা আগামী দুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবি।”
তূর্য বোন কে আরেক টা চুমু খেয়ে বলে,
“আমি তোকে অনেক মিস করেছি পরী।”
“আমিও তোমাকে অনেক মিস করেছি ভাইয়া।”
তূর্য বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে। বোন টা ওর ভীষণ আদুরে। বোন টা জন্ম নেওয়ার পর তূর্য এতো বেশি খুশি হয়েছিল যে বলার মতন না। একদম সাদা ধবধবে ফর্সা ছোট একটা পরীর মতো শিশু কন্যা কে তূর্যের কোলে তুলে দিয়েছিল তূর্যের বাবা। বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তূর্যের মুখ দিয়ে প্রথম শব্দ বেরিয়েছিল “পরী” একটু থেমে আবার বলেছিল “আব্বু ওকে পরীর মতো দেখা যায়।” সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বোন কে পরী বলেই ডাকে। বোন হওয়ার খুশিতে আত্মহারা হয়ে টানা পনেরো দিন স্কুলে যায়নি। ওকে কোনো ভাবেই স্কুলে পাঠাতে সক্ষম হননি তুহিন শিকদার আর মুক্তা শিকদার।
ভিন দেশে পাড়ি জমানোর সময় বোনের জন্যই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছিল তূর্যের। বিশাল এক শূন্যতা ঘিরে ধরেছিল এতো গুলো বছর।
বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে তূর্যের নজর পড়ে টি টেবিলের নিচে। পা বাড়িয়ে টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনে ছোট একটি খেলনা গাড়ি।
কপাল ভ্রু কুঁচকে গাড়ি টা হাতে তুলে নেয়। বোন কে দেখিয়ে বলে,
“তুই এখনো এতো ছোট ছোট খেলনা দিয়ে খেলিস?”
তুরা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“এটা আমার না তো, এটা ভিরানের।”
অপরিচিত নাম শুনে তূর্যের কপালে ভাঁজ পড়ে বেশ কয়েক টা।
“কে ভিরান?”
ছেলের প্রশ্নে তুহিন শিকদার আর মুক্তা শিকদার চুপ হয়ে থাকেন। তুরা বলে,
“আব্বুর অফিসের বসের ছেলে।”
“ওর খেলনা এখানে কেন?”
মুক্তা শিকদার হাজব্যান্ড কে ইশারা করেন সব কিছু বলার জন্য। তুহিন শিকদার কিছু না বলে চুপ হয়ে থাকেন। তূর্য বাবা মায়ের দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“কি ইশারা করছো দুজন? কিছু লুকাচ্ছো নাকি আমার কাছ থেকে?”
মুক্তা শিকদার বলেন,
“না না কি লুকাব? কিছু লুকাচ্ছি না।”
“তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তোমরা।”
মুক্তা শিকদার সাহস যুগিয়ে থেমে থেমে পুরো ঘটনা খুলে বলেন প্রথম থেকে। পুরো টা চুপ চাপ শোনে তূর্য। তুরা আজকে জানতে পারলো নির্ভান ওকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। এতো দিন জানতোই না এই কথা।
তূর্য গম্ভীর স্বরে বলে,
“তোমরা কি বলেছ?”
“আমরা এখনো কিছু বলিনি।”
আকস্মিক চিৎকার করে ওঠে তূর্য। ভয় পেয়ে তুরা ভাইয়ের গলা ছেড়ে দেয়।
তূর্য চিৎকার করেই বলে,
“কেনো বলোনি? এখনো কিসের জন্য চুপ করে আছো তোমরা? আগামী কাল সকালে ওদের সাফ সাফ না করে দেবে। আর ওই ভিরান আর ওর বাপ যেন এই ফ্ল্যাটে না আসে সেটাও বলে দেবে স্পষ্ট করে। আগামী কাল যেন চৌধুরী বাড়ির কাউকে না দেখি এখানে। খেয়ে দেয়ে কাজ নেই এক বাচ্চার বাপের কাছে বোন বিয়ে দেব?”
একটু থেমে তুরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“যা গিয়ে ঘুমা, আর ভুলেও ওদের কারো সামনে যাবি না।”
তুরা ভয় পেয়ে সুরসুর করে উঠে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তূর্য রাগে গজগজ করতে করতে হাতে থাকা গাড়ি টা ছুঁড়ে দিয়ে ভেঙে ফেলে। বাবা মায়ের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। মেজাজ টাই খারাপ করে দিল। বাবা মায়ের কথা শুনে রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।
চলবে………