ভাঙা পাঁজরে বসন্ত পর্ব-১৩

0
14

#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_13

তূর্য রুমে ঢুকে শব্দ করে ডোর লাগায়। পুরো ফ্ল্যাট যেন কেঁপে ওঠে আরো একবার।

মুক্তা শিকদার হাজব্যান্ডের দিকে তাকান। তুহিন শিকদার গম্ভীর হয়ে ওনার দিকেই তাঁকিয়ে আছেন।
মুক্তা শিকদার বলেন,

“জন্মেছে আমার পেট থেকে আর হয়েছে নানা-দাদার মতো।”

“যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও তো বেশি রেগে গেছে। ওনাদের কিভাবে নিষেধ করবো এখানে না আসতে?”

“বাচ্চা ছেলে টা আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

“এমন পরিস্থিতি কেনো আসে যখন কিছুই করার থাকে না!”

মুক্তা শিকদার চুপ হয়ে থাকেন। তূর্য এখন যেই বিহেভ করলো তাতে চৌধুরী বাড়ির কেউ আসলে নির্ঘাত তাঁকে অপমান করবে এই ছেলে।

তুহিন শিকদার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,

“যা হবার তা আগামী কাল হবে, এখন ঘুম পেয়েছে চলো। সকালে আবার অফিসে যেতে হবে।”

লাইট অফ করে হাজব্যান্ডের পেছন পেছন রুমে চলে যান মুক্তা শিকদার।

তুরা বেডে উঠে শুয়ে আছে কিন্তু ঘুম নেই ওর দুই চোখে। ভাইয়ের এমন রাগ দেখে ওর বুকের ভেতর এখনো কাপছে। ভীষণ ভয়ও পেয়েছে বেচারি। অত জোরে কেউ চিৎকার করে ওঠে?

নির্ভানের কথা স্মরণ হয়। কম্পিত বুকে জোরে জোরে শব্দ হতে শুরু করে। ডান হাত টা বুকের বা পাশে চেপে ধরে। কেমন করছে বুকের ভেতর।

চোখ বন্ধ করতেই ফর্সা, লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ গড়নের নির্ভান ভেসে ওঠে। পুরুষ টা ওর সামনেই যেন দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর চোখে মুখে। একদৃষ্টে তাঁকিয়ে আছে ওর দিকেই। নির্ভান ওর দিকে এক কদম আগাতেই ফট করে চোখ মেলে তাকায় তুরা।

আশে পাশে নজর বুলায়, কেউ নেই রুমে। এই সব ওর ভ্রম ছিল, নিছক কল্পনা। কাঁথা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে চুপ হয়ে থাকে। চোখের সামনে আবার ভেসে ওঠে ভিরান আর নির্ভান।

এই দুজন এখন কিছুতেই মস্তিষ্ক থেকে বের হচ্ছে না।
_____________

নয়টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ড্রয়িং রুমে আসে তূর্য। মুক্তা শিকদার সোফায় বসে টিভি দেখছেন। ছেলে কে দেখেই টিভি অফ করে দিয়ে উঠে দাঁড়ান।

ছেলের সাথে কথা বলতেও এখন ভয় ভয় লাগছে। আবার না চিৎকার করে ওঠে। তূর্য মায়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলে,

“পরী কোথায়?”

“ঘুম থেকে ওঠেনি এখনো।”

“আব্বু?”

“খেয়ে অফিসে চলে গেছে। তুই আয় খেতে দেই।”

“বাড়তে থাকো, আমি পরী কে তুলে নিয়ে আসছি।”

“ঘুমোচ্ছো ঘুমাক।”

মায়ের কথা শোনে না তূর্য, বড় বড় কদমে এগিয়ে যায় বোনের রুমের দিকে। এত গুলো দিন পর বাড়িতে এসেছে, বোন কে রেখেই খেয়ে উঠবে নাকি?

মুক্তা শিকদার ফোস করে শ্বাস ছেড়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এগিয়ে যান। অন্য দিন সকাল আটটার মধ্যে ভিরান চলে আসে, আজকে এখনো আসেনি। তুহিন শিকদার বোধহয় না করেছেন ওনাদের এই বাড়িতে না আসতে।

তূর্য বোনের রুমে এসে দেখে তুরা এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
রুমের জানালা খুলে দিয়ে বেলকনির ডোরও খুলে দেয়। আবছা আলোর রুম টা এখন পুরোপুরি আলোকিত। এগিয়ে এসে নাইট ল্যাম্প অফ করে বোন কে ডাকতে শুরু করে।
তুরা মোড়ামোড়ি করে কাঁথা টেনে মাথা ঢেকে নেয়। ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

“আব্বু ঘুম হয়নি, পরে উঠবো যাও এখন।”

তূর্য বোনের উপর থেকে কাঁথা টেনে সরিয়ে নিতে নিতে বলে,

“পরী আমি আব্বু না, ওঠ চোখ খোল।”

চোখ মেলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়।

“ভাইয়া ঘুম হয়নি আমার।”

“খেয়ে আবার ঘুমাবি ওঠ।”

তূর্য টেনে তুলে বসায় তুরা কে। তুরা ভাইয়ের শরীর সাথে ঠেস দিয়ে বসে থাকে ঝিম ধরে। বেচারি ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না।

ভাইয়ের টানাটানিতে বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। সাধের ঘুম টা দিলো ভাঙিয়ে।

তূর্য বোনের বিছানা গুছিয়ে ঠিকঠাক করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

ওয়াশরুমে বসে রাতের ঘটনা স্মরণ হয় তুরার। এতক্ষণ তো সব ভুলেই গিয়েছিল। তূর্যের কথা শুনে তো স্বাভাবিকই লাগলো, রাগ বোধহয় কমে গেছে।

ক’টা বাজে? ভিরান আজকে এখনো আসেনি? নাকি এসেছিল ওর ভাই তাড়িয়ে দিয়েছে? ওর কাছে না আসতে পারলে তো ভিরান আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। ওকে ছাড়া কিভাবে থাকবে ভিরান? ভিরান কে একদিন দেখতে না পারলে তো তুরা নিজেও থাকতে পারবে না এখন।

ফ্রেস হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখে তূর্য সোফায় বসে আছে চুপ চাপ। তুরা আসতেই তুরা কে সাথে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে খাবার খেতে বসে।
তূর্য মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আম্মু তুমিও বসো।”

“তোরা খেয়ে নে, আমি পরে খাব।”

তূর্য মায়ের হাত ধরে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলে,

“পরে কেন? এখনই খাবে আমাদের সাথে।”

ছেলের কথা শুনে নিজের প্লেটে একটা ডিম ভাজি তুলে নেন। রুটি ছিঁড়ে ডিম ভাজি দিয়ে মুখে পুরতে পুরতে তুরা মায়ের মুখের দিকে তাকায়। ভাইয়ের ভয়ে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না।

মুক্তা শিকদার নিজেও মেয়ের মুখের দিকে তাকান। মেয়ের চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছেন মেয়ে কি বলতে চাইছে। ছেলে সামনে থাকায় কিছু বলতে পারলেন না।

কোনো কথা ছাড়াই তিন জনের খাওয়া শেষ হয়।
তূর্য খাওয়া শেষ করে চেয়ারেই বসে থাকে। তুরা অলস ভঙ্গিতে নিজের খাওয়া শেষ করে।
মায়ের খাওয়া শেষ হতেই তূর্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।

“চৌধুরী বাড়ি থেকে কেউ এসেছিল?”

মুক্তা শিকদার দ্রুত দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলেন,

“না, কেউ আসেনি।”

“নিষেধ করেছিলে?”

“তোর আব্বু বলেছে বোধহয়।”

“পরী আয়।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে ভাইয়ের পেছন পেছন সোফার কাছে এগিয়ে আসে। তূর্য ড্রয়িং রুমের একপাশে রাখা স্যুটকেস টেনে এনে সোফার সামনে রাখে একটা। রুম থেকে চাবি এনে লক খোলে। তুরা ভাইয়ের পাশেই ফ্লোরে ল্যাটা দিয়ে বসে পড়েছে।
ভেতর থেকে প্রথমেই বের করে নামি দামী সব চকলেট। স্যুটকেসের অর্ধেক শুধু চকলেট দিয়েই ভর্তি। চকলেট গুলো দেখে খুশিতে তুরার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে।
সব গুলো চকলেট তুরার কোলের উপর দেয় তূর্য। তুরার পা চকলেটের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। তুরা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

“এই সব গুলো আমার?”

“হ্যাঁ, আরো আছে।”

“অনেক দিন খেতে পারবো তাহলে।”

খুশিতে আত্মহারা বোন কে টেনে গালে একটা চুমু খায় তূর্য। তুরা নিজেও ভাই কে টেনে ভাইয়ের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওয়ালা গালে চুমু খায় দুটো।

একটা ঘড়ি বের করে তুরার হাতে পরিয়ে দেয়। তুরা হাত উল্টে পাল্টে দেখে, ঘড়িটা অনেক পছন্দ হয়েছে। এমন ঘড়ির আশা অনেক আগে থেকেই ছিল তুরার। বাবা মায়ের সাথে মার্কেটে গিয়ে কয়েক বার খুঁজেছিল কিন্তু পায়নি।

তূর্য আরো একটি ব্ল্যাক কালার ঘড়ি বের করে তুরার সামনে রাখে। এবার আনন্দে যেন ফেটে পড়বে তুরা।
চকলেট খেতে খেতে ঘড়িটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে। চকলেট নিজে খাওয়ার পাশাপাশি ভাইকেও খাওয়ায়।

তূর্য স্যুটকেসের সব কিছু বের করে তুরার সামনে রাখে।
তুরা একবার ভাই, একবার মা আর আরেকবার সামনে থাকা সব কিছুর দিকে তাকায়। খুশিতে এখন যেন পাগলই হয়ে যাবে। একটা চকলেট মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“আম্মু চকলেট খাও।”

“তুই খা।”

“তুমিও খাও ধরো।”

মুক্তা শিকদার চকলেট টা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করেন। না খাওয়া পর্যন্ত মেয়ে ছাড়বে না ওনাকে।

দ্বিতীয় স্যুটকেস টা এনে খোলে তূর্য। এটাতে বাবা মায়ের জন্য অনেক কিছু এনেছে। বাবা কে নিজের হাতে দেওয়া হলো না। রাতেই খুলতে চেয়েছিল কিন্তু রাগের কারণে আর খোলেনি তখন। এতই রাগ উঠেছিল যে ভুলেই গিয়েছিল স্যুটকেসের কথা।
___________

এগারোটা নাগাদ ময়লার পলিথিন হাতে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হন মুক্তা শিকদার। ময়লা ফেলে দিয়ে এসে দুপুরের খাবার রান্না করবেন।

ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে গেটের দিকে এগিয়ে আসেন। ভেতরে প্রবেশ করার আগেই পেছন থেকে নওশাদ চৌধুরীর গলার স্বর শুনতে পান। পেছন ফিরে তাঁকিয়ে দেখেন ভিরান কে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসছেন উনি।

রাস্তা পাড় হয়ে এসে দাঁড়ান মুক্তা শিকদারের সামনে।

“আপনি এখানেই আছেন ভালো হয়েছে আমাকে আর কষ্ট করে ভেতরে যেতে হলো না। অফিসে ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে, আমার জন্যই মিটিং আটকে আছে। আপনি ওকে নিয়ে যান আমি অফিসে যাই।”

মুক্তা শিকদার কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভিরান কে ওনার কোলে তুলে দিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যান নওশাদ চৌধুরী। নাতি কে এখানে পৌঁছে দেওয়ার চক্করে মিটিং আটকে রয়েছে ওনার জন্য।

মুক্তা শিকদার ভিরান কে কোলে নিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে যান। ভেবেছিলেন ভিরান আজকে আসবে না। এত দেরি করে কেনো আসলো আজ? ছেলে কে কি জবাব দেবেন? তূর্য যদি ভিরানের সামনে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে ভিরান তো ভয় পেয়ে যাবে।

ভয়ে ভয়ে ভিরান কে কোলে নিয়ে ফ্ল্যাটের ভেতর প্রবেশ করেন। কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে ডোর লক করেন।

ভিরান সোফার দিকে তাকিয়ে দেখে তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। খুশি হয়ে “মামা” বলে এক দৌড়ে গিয়ে তূর্যের দুই পা জড়িয়ে ধরে।

এমন ঘটনায় তূর্য থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কে এই ছেলে? আর ওকে মামা ডাকছে কেন?
মাথা নিচু করে ভিরানের দিকে তাকায়। ভিরান তূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“মামা কোলে।”

তূর্য তাঁকিয়ে দেখে বাচ্চা ছেলে টা কে। দেখতেই কেমন আদর আদর লাগছে। ভীষণ কিউট, মায়াবী আর সরল চাহনি। গলার স্বর এমন কেন? কি হয়েছে কণ্ঠস্বরে?
ভিরান আবার ডাকে,

“মামা কোলে নাও।”

কোলে তুলে নেয় তূর্য। ভিরান শক্ত করে তূর্যের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। দুই পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে তূর্যের কোমর। তূর্যের চারো পাশের সব কিছুই যেন হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই জড়িয়ে ধরে ভিরান কে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, ভালোও লাগছে। তুলতুলে শরীর থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে।

মায়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে দেখে উনি চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে ভয়ের মধ্যে আছেন।

ভিরান তূর্যের গলা ছেড়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। হাঁসি মুখে বলে,

“মামা।”

“কে মামা?”

“তুমি।”

“কার মামা?”

“আমার।”

“তুমি চেনো আমাকে?”

“হ্যাঁ।”

“কিভাবে চেনো? কোথায় দেখেছো আমাকে?”

“ফোনে।”

“ফোনে দেখেই চিনতে পেরে গেছো?”

“হ্যাঁ।”

“মামা তুমি তো ভীষণ কিউট।”

ভিরান খুশি হয়ে আবার ডাকে,

“মামা।”

তূর্য হাসি মুখে সাড়া দেয় আবার।

“হু।”

ভিরান উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলে,

“এসেছ?”

তূর্য হেঁসে বলে,

“হ্যাঁ।”

ভিরান টপাটপ বেশ কয়েক টা চুমু খায় তূর্যের কপালে আর গালে। নিজের গাল দেখিয়ে দিয়ে বলে,

“মামা আমাকেও আদর দাও।”

তূর্য হেঁসে ভিরানের গালে আর কপালে অনেক গুলো চুমু খায়। ভিরান আবারো চুমু খায় তূর্যের গালে কপালে। তূর্যের গলা জড়িয়ে ধরে তূর্যের গালের সাথে ঠেকিয়ে বলে,

“মামা তুমি অনেক ভালো।”

আবার হাসে তূর্য। হাসি মুখেই বলে,

“হেই মামা, কে তুমি? নাম কি তোমার?”

“আমি ভিরান, ভিরান চৌধুরী।”

তূর্যের হাঁসি হাঁসি মুখে হঠাৎ করেই অন্ধকার নেমে আসে। রাগী চোখে তাকায় মায়ের দিকে।
মুক্তা শিকদার ভয় জড়ানো গলায় বলেন,

“বাবা ওকে ছুঁড়ে মারিশ না, ম’রে যাবে বাচ্চা ছেলে টা।বাচ্চা টা এমনিতেই অসুস্থ, মাথা ঠাণ্ডা রাখ বাবা।”

চলবে…………