ভাঙা পাঁজরে বসন্ত পর্ব-১৪

0
14

#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_14

ভিরান মুখ তুলে তূর্যের মুখের দিকে তাকায়। আদুরে গলায় বলে,

“মামা কি হয়েছে তোমার? তুমি আমাকে ছুঁড়ে ফেলবে?”

কথা গুলোতে কি যেনো ছিল? তূর্যের কলিজায় গিয়ে লেগেছে কথা গুলো। ভিরান পুনরায় বলে,

“মামা রেগে আছো কেন?”

তূর্য নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। নিজের রাগ যথা সম্ভব ঠান্ডা রেখে বলে,

“নামো আমার কোল থেকে।”

“কেন?”

“আমি তোমার মামা না।”

“তুমিই তো আমার মামা।”

“কে বলেছে?”

“কেউ বলেনি কিন্তু আমি জানি তুমি আমার মামা। নিদ্রা তো পাপা কে মামা ডাকে।”

“নিদ্রা কে?”

“আমার মনি’র মেয়ে?”

“মনি কে?”

মুক্তা শিকদার বলেন,

“ওর ফুপু কে মনি ডাকে, নিদ্রা ওর ফুপাতো বোন।”

ভিরান তূর্যের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে,

“তুমি অনেক প্রশ্ন করো।”

“আমি তোমার কেউ হই না, তুমি নামো আমার কোল থেকে।”

কথা গুলো বলে ভিরান কে কোল থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তূর্য। ভিরান দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে তূর্যের গলা। তূর্য ঝুঁকে ভিরান কে ছেড়ে দিলেও ভিরান ছাড়ে না। তূর্যের গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে রইল। কতক্ষন টানাটানি করেও যখন ভিরান কে ছাড়াতে পারে না তখন সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভিরান পুনরায় দুই পা দিয়ে তূর্যের কোমর পেঁচিয়ে ধরে।

মুক্তা শিকদার পারছেন না গড়াগড়ি করে হাসতে। ছেলের অবস্থা দেখে এই সিরিয়াস মুহূর্তেও তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। তূর্যের চেহারা হয়েছে দেখার মতো।

তূর্য সোফায় বসে পড়ে। ভিরান তখনো তূর্যের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। তূর্য গম্ভীর স্বরে বলে,

“ভিরান ছাড়ো আমাকে।”

“আদর দাও তাহলে ছেড়ে দেব।”

“আমি কেনো তোমাকে আদর দিব?”

“বিকজ তুমি আমার মামা।”

তূর্য ভিরানের গালে কপালে চুমু খায়। ভিরান নিজেও আদরের ঋণ শোধ করে তূর্যের গলা ছেড়ে নিচে নেমে দাঁড়ায়। মুক্তা শিকদারের দিকে তাঁকিয়ে বলে,

“নানু তুরা কোথায়?”

“রুমে।”

ভিরান তুরার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
তূর্য অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাঁকিয়ে বলে,

“এই টুকুন একটা ছেলে পরীর নাম ধরে ডাকছে!”

“নাম ধরেই ডাকে।”

তূর্য কৌতূহলী হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে তুরার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ভিরান দুই হাতে তুরার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে গালে। চুমু খাওয়া শেষ হলে নিজের গাল দেখিয়ে দেয়। তুরা চুমু দিচ্ছে না দেখে তুরার বুকে মাথা ঠেকিয়ে কোলের ওপর বসে থাকে ছোট ছোট হাতে জড়িয়ে ধরে। তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

“তুরা কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ কেন?”

তুরা চুপ হয়ে থাকে। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়ের দিকে। তূর্য কিছু না বলে ডোরের সামনে থেকে সরে যায়। তুরা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। নিজেও দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ভিরান কে। ঝুঁকে অসংখ্য চুমু খায়। ভিরান খুশি হয়ে বলে,

“তোমার মুড ঠিক হয়ে গেছে?”

তুরা নিজেও হেসে বলে,

“হ্যাঁ, কেমন আছো তুমি?”

“ভালো আছি, মামা আমাকে অনেক আদর করেছে।”

ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে থাকা তূর্য স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ভিরান আর তুরার অট্টহাসি। ভিরানের হাসির শব্দ হচ্ছে না খুব একটা তবে তুরার হাসির শব্দ হচ্ছে অনেক।

তূর্য কিচেনের দিকে তাকায়। মুক্তা শিকদার রান্না করার জন্য কিচেনে চলে গেছেন। তূর্য সোফা ছেড়ে উঠে কিচেনে আসে। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

“তুমি না বললে চৌধুরী বাড়ির কেউ আসবে না আর।”

“আমি তো ভেবেছি তোর আব্বু কিছু বলেছে। নওশাদ চৌধুরী ওকে আমার কোলে দিয়েই চলে গেছেন। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দেয়নি।”

“ভিরানের গলায় কি হয়েছে?”

মুক্তা শিকদার ছেলের মুখের দিকে তাকান। তূর্য চোখ মুখ গম্ভীর করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

“নির্ভান ভিরান কে তুরার কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য ভিরান কে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিল। ভিরান সেখানে গিয়ে তুরার জন্য কেঁদে কেটে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গত রাতে তো বলেছি কেমন মুমূর্ষ অবস্থা হয়েছিল। ভিরানের গলা আরো বসে গিয়েছিল, এখন কিছুটা ঠিক হয়েছে।”

তূর্য আর কিছু না বলে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে। গম্ভীর হয়ে বসে থাকে সোফায়।
___________

দুপুরের খাবার তিন জন একসাথেই খায়। ভিরানের জন্য চৌধুরী বাড়ি থেকে ড্রাইভার কে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছিলেন মেরি চৌধুরী। তুরা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে ভিরান কে। ভিরানের দুপুরের আর রাতের খাবার চৌধুরী বাড়ি থেকেই পাঠানো হয়। মাঝখানের সময় টুকু তে যা কিছু খায় তা তুরা দের টা খায়।

এমনিতেই ভিরান কে নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয় তুরা দের। তার উপর আবার ভিরানের জন্য আলাদা করে খাবার রান্না করা বিশাল ঝামেলার কাজ।

খাওয়া শেষে মেডিসিন খাইয়ে দেয়।
তূর্য নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়, ওর পেছন পেছন রুমে প্রবেশ করে ভিরান। ডোর ভিজিয়ে দিয়ে ঘুরে দাড়াতেই দেখে ভিরান দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। আশ্চর্য, এই ছেলে কখন রুমে প্রবেশ করলো?

“তুমি এখানে কেন?”

“তোমার কাছে এসেছি।”

“আমি ঘুমাবো এখন।”

“আমিও ঘুমাব।”

“পরীর কাছে যাও।”

“তুমি তুরা কে পরী বলো কেন?”

“কারণ তুরা আমার পরী।”

“মিথ্যে কথা, তুরা আমার আর আমার পাপার পরী, আমার পাপার ওয়াইফ, ফেয়ারি টেল কুইন।”

“ও তোমার পাপার ওয়াইফ না, ও আমার পরী।”

“ও আমার তুরা, আমার পাপার ওয়াইফ। ওকে আমি আমার পাপার কুইন বানাব। তুরা তোমার পরী না, তুরা তোমার বোন।”

“পাগলের মতো উল্টা পাল্টা কথা না বলে যাও এখান থেকে।”

“কোলে নাও।”

“পারবো না আমি।”

“মামা নাও না কোলে।”

ভিরানের মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে কোলে তুলে নেয়।

“চলো এখন ঘুমাই।”

তূর্য ভিরান কে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ভিরান রুমের দিকে ঠেলে বলে,

“মামা চলো ঘুমাই, তুরার কাছে পরে যাব।”

মুক্তা শিকদার আর তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে দুজনের দিকে তাকায়। ভিরান তূর্যের কোলে চড়েই রুমের দিকে ঠেলছে।

সোফার সামনে এসে কোল থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, ভিরান আগের মতোই গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে রইল। প্রায় কান্না করে দিয়ে বলে,

“মামা আমি তোমার সাথে ঘুমাব।”

ভিরানের জেদের কাছে হেরে ওকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায় তূর্য।
মুক্তা শিকদার দুজনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকেন। ভিরান তো শুধু তুরা কে না, তুরার পুরো ফ্যামিলি কেই চাইছে এখন। যেই ভিরান তুরার জন্য পাগল, তুরার পিছু ছাড়ে না। সেই ভিরান আজকে আঠার মতো তূর্যের পেছনে লেগেছে। মামার জন্য পাগল হয়ে গেছে এই টুকু সময়ের মধ্যেই।

বেডে শোয়াতে গেলে ভিরান তূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

“মামা ওয়াশরুমে যাব।”

তূর্য বিরক্ত হয়ে ভিরান কে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। এই ছেলে ওকে দিয়ে আর কি কি করাবে?

ফ্রেস করিয়ে এনে বেডে শুইয়ে দেয়, রুম অন্ধকার করে নিজেও শুয়ে পড়ে চিৎ হয়ে। ভিরান শোয়া থেকে উঠে তূর্যের বুকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে।

“এখানে উঠেছো কেন?”

ভিরান মুখ তুলে তূর্যের মুখের দিকে তাকায়। সরল চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,

“পাপা তো আমাকে এভাবেই বুকের উপর নিয়ে ঘুম পাড়ায়।”

“আমি তোমার পাপা নই।”

“তুমি তো আমার মামা।”

তূর্য আর একটা কথাও বলতে পারে না। এতো এতো রাগ কিভাবে যেনো গোলে গোলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জাদু আছে বাচ্চাটার মধ্যে।

এক হাতে জড়িয়ে ধরে, অন্য হাত তুলে ভিরানের পিঠে আদুরে চাপড় দিতে দিতে চোখ বন্ধ করে নেয়।
ভিরান নিজেও মামার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। মামার কাছে থাকতে ওর ভীষণ ভালো লাগছে। বার বার মামার কাছ থেকে আদর পেতে ইচ্ছে করছে। তুরার মতো মামা কেও অনেক ভালো লেগেছে।
___________

রাত এগারোটা বেজে গেছে কিছুক্ষন আগেই। নির্ভানের অফিসের কাজ শেষ হয়। ফাইলস, ল্যাপটপ রেখে ভবনের দিকে তাকায়। ভিরান কে নিয়ে আজকে এখনো আসছে না কেন? ভিরান ঘুমায়নি নাকি? নাকি সবাই ঘুমিয়ে গেছে?

নিজের ফোন হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটন চেপে দেখে ফোন অন হয় না। কয়েক বার চাপার পরেও যখন অন হয় না তখন বুঝতে পারে ফোন অফ হয়ে গেছে। চার্জের দিকে খেয়াল করা হয়নি। চার্জ নেই বোধহয়। ব্যস্ততার কারণে সারা দিনে একবারও চার্জ দেওয়া হয়নি ফোন টা।

উঁকি দেয় তুরার বেলকনির দিকে। বেলকনির লাইট অফ করা রয়েছে। কি করবে ভাবতে ভাবতে গাড়ি থেকে নেমে দাড়ায়। ভিরান ঘুমায়নি নাকি সবাই ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে গাড়ি লক করে গেটের ভেতর প্রবেশ করে। সংকোচ বোধ হলেও ধীরে ধীরে ভেতরে এগিয়ে যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তুরা দের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ায়। কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে রইল।
দ্বিতীয় বার চাপার জন্য হাত তুলতেই ডোর খুলে যায়। মুক্তা শিকদার ডোর খুলেছেন। নির্ভান ধীর স্বরে বলে,

“ভিরান ঘুমায়নি?”

মুক্তা শিকদার সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। নির্ভান সোজা সোফার দিকে তাকায়। তূর্যের বুকের ওপর উঠে বসে আছে। হেসে হেসে কথা বলছে তূর্যের সাথে, তূর্যও কি কি যেনো বলছে। ভিরান নিজে চকলেট খাচ্ছে তূর্য কেও খাইয়ে দিচ্ছে।
পাশের সিঙ্গেল সোফায় তুরা বসে বসে চকলেট খাচ্ছে আর দুজন কে দেখছে।

“ভিরান।”

ভিরান ডোরের দিকে তাকায়। তুরাও তাকায়। সোফায় শুয়ে থাকা তূর্য ভিরান কে দুই হাতে ধরে তারপর ঘাড় উল্টে ডোরের দিকে তাকায়।
ভিরান খুশি হয়ে বলে,

“মামা পাপা চলে এসেছে।”

তূর্য শোয়া থেকে উঠে বসে। পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নির্ভানের দিকে। মলিন চেহারায় ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভান। পরনে ট্রাউজার আর টিশার্ট। চুল গুলো কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। রাতে বোধহয় খায়নি, চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।

নির্ভান নিজেও তূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজকে প্রথম দুজন একে অপরকে দেখছে।
ডোরের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলে কে বলে,

“আজকে এখনো ঘুমাওনি কেন?”

ভিরান কিছু না বলে তূর্যের কোল থেকে নেমে দাড়ায়। তূর্যের হাত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

“চলো তোমাকে পাপার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমার পাপা অনেক ভালো।”

কথা বলতে বলতে তূর্য কে টেনে এনে নির্ভানের মুখোমুখি করে দাড় করায়।
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভিরান নিচ থেকে মুখ তুলে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে…………..