#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_16
হাসপাতালের করিডোরে সারি সারি করে রাখা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে নির্ভান। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা। ওর পাশে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন তুহিন শিকদার আর নওশাদ চৌধুরী।
তুহিন শিকদার এতক্ষণ একটু পর পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেও এখন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন।
মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যান টা ভোঁ ভোঁ শব্দ তৈরি করছে। আশে পাশে আর কেউ নেই। রাত এখন প্রায় বারোটা বেজে গেছে।
তুরা ওটিতে রয়েছে। তুরার ডান পায়ের অবস্থা খুবই বাজে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন ডান পা রাখা সম্ভব না। হাঁটুর উপর থেকে কে’টে ফেলতে হবে।
হাঁটু আর হাঁটুর নিচের হাড় এতটাই গুঁড়ো হয়ে গেছে যে জোড়া লাগানো অসম্ভব এবং চারপাশের রক্তনালী, স্নায়ু আর পেশী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পায়ের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, পা এখন বাঁচালেও পরে সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। এমন অবস্থায় চিকিৎসকরা কে’টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারণ সংক্রমণ বা গ্যাংগ্রিন হয়ে জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
তুরা কে রক্ত দিতে হয়েছে তিন ব্যাগ, আরো লাগবে। তুরার রক্ত o নেগেটিভ যা খুবই বিরল। ভাগ্য ক্রমে নির্ভানের রক্তও o নেগেটিভ। নির্ভান একাই দুই ব্যাগ রক্ত দিয়েছে, ওর কাছ থেকে আর নেওয়া সম্ভব না। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে এক ব্যাগ ছিল সেটাও দেওয়া হচ্ছে।
তূর্য অন্যান্য হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করছে রক্তের জন্য।
মুক্তা শিকদার কে কেবিনে রাখা হয়েছে। মেয়ের অবস্থা দেখে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। এখন ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ভিরানও কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে গেছে, ওকে মুক্তা শিকদারের পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মুক্তা শিকদারের কাছে মেরি চৌধুরী বসে আছেন।
ভিরানের হাত থেকে বেলুন ছুটে বাতাসের সাথে উড়ে রাস্তায় চলে গিয়েছিল। তুরা নিজের হাতের বেলুন ভিরানের হাতে দিয়ে ভিরানের উড়ে যাওয়া বেলুন নিয়ে আসার জন্য রাস্তায় যায়।
তুহিন শিকদার ভিরানের হাত মুক্তা শিকদারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেয়ের পেছন পেছন যান।
খালি রাস্তা চারপাশে শুধু স্ট্রিটলাইটের আলো। রাস্তা থেকে বেলুন কুড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তুরা। ঠিক তখনই দূর থেকে একটা প্রাইভেট কার দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল। হেডলাইটের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় তুরার। মুহূর্তেই দ্রুত গতিতে ছুটে আসা প্রাইভেট কার টা তুরা কে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। রাস্তায় ছিটকে পড়ে তুরা। পেছন পেছন আরো দুটো প্রাইভেট কার দ্রুত গতিতে ছুটে আসছিল। রাস্তায় পড়ে থাকা তুরার ডান পায়ের উপর দিয়ে দুটোর চাকা চলে যায় পর পর। প্রথম কারের ধাক্কা খেয়ে সেরকম কিছু না হলেও পরের দুটো তুরার মারাত্মক ক্ষতি করে চলে গেছে।
চারপাশে কোথাও থামেনি কার তিন টা। পেছন ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করেনি। গায়ের দাপট দেখিয়ে দ্রুত গতিতে মিলিয়ে গেছে চোখের পলকে।
প্রাইভেট কারে সম্ভবত যুবক ছেলেরা ছিল, কোথাও হয়তো ঘুরতে যাচ্ছে বা গিয়েছিল। নেশা করে ছিল কিনা কে জানে? এতো বড় রাস্তা থাকা সত্ত্বেও মানুষের গায়ের উপর দিয়ে তুলে দিয়েছে।
বাম পায়ে সেরকম কিছু হয়নি শুধু একটু একটু ছুলে গেছে। মাথায় বেশ আঘাত লেগেছে তবে মারাত্মক নয়। বাম হাতের হাড় ফেটে গেছে অল্প।
আরো দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে হাসপাতালে ফিরে আসে তূর্য। তূর্যের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। জ্ঞান ফেরার পর পাগলের মতো কেঁদেছিল।
নার্সের কাছে রক্তের ব্যাগ দুটো দিয়ে ওটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তাররা এখনো বের হয়নি ওটির ভেতর থেকে। অপারেশন শেষ হতে আরো কতক্ষন লাগবে জানা নেই কারো।
নির্ভান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ওর মাথা প্রচণ্ড রকমের ব্যাথা করছে। চোখে ঝাপসা দেখছে, মাথা ঘুরছে।
ছেলের চিন্তায় অনেক দিন ধরেই ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না, রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম হয় না। চিন্তায় চিন্তায় সময় কা’টে। আজকে তুরার অবস্থা দেখার পর থেকে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। দুই চোখে রক্ত উঠে গেছে। চোখ জ্বলছে, মাথা ব্যাথা করছে, বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। সব মিলিয়ে নির্ভানের অবস্থাও খারাপ, কখন যেন ঠাস করে পড়ে যায়।
তূর্যের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধের ওপর হাত রাখে। তূর্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নির্ভানের দিকে। নির্ভান আশ্বাস দিয়ে বলে,
“সব ঠিক হয়ে যাবে, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।”
নির্ভানের হাতের উপর হাত রাখে তূর্য। চোখ দুটো পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেছে। নির্ভান আবার বলে,
“চেয়ারে বসুন।”
“ভেতর থেকে ডাক্তার বেরিয়েছিল?”
“না।”
তূর্য ঢোঁক গিলে কান্না গিলে নেয়। প্রাণ প্রিয় বোনের এই অবস্থা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। কি থেকে কি হয়ে গেল? এখন তো সকলের খুশিতে আত্মহারা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন খুশির বদলে সকলের চোখেই পানি।
_________________
সময় টা বিকেল পাঁচ টা।
তুরার ঘুম ভেঙে যায়। জ্ঞান ফিরেছিল দুপুরের আগেই। আইসিইউ থেকে কেবিনে সিফট করা হয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর বাবা-মা, ভাই আর ভিরানের সাথে দেখা হয়েছিল।
তুরার শিয়রে বসে আছেন মুক্তা শিকদার। মেয়ে কে জেগে উঠতে দেখেই চোখের পানি মুছে নেন দ্রুত। তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“আম্মু এখনো কাদঁছো কেন? আমি তো ঠিক আছি, কিছু দিনের মধ্যেই তো হাত আর মাথার ক্ষত ঠিক হয়ে যাবে।”
মেয়ের কথা শুনে হু হু করে কেঁদে ওঠেন মুক্তা শিকদার।
“কাদঁছো কেনো এখনো?”
তূর্য ভেতরে প্রবেশ করে। নির্ভান বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই ভেতরে উঁকি দেয় একবার। তুরার নজরে আসে না নির্ভান। এখন পর্যন্ত তুরার সামনে আসেনি।
“ভাইয়া আম্মু কে কিছু বলোতো, আমার তো সেরকম কিছু হয়নি।”
তূর্য বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো পানিতে টুইটুম্বর। তুরা এখনো জানেই না ওর সাথে ওর নিজের একটা পা নেই। এখনো দেখেইনি নিজের পায়ের দিকে। বলেও নি কেউ।
ভিরান বাবার হাত ঝাঁকিয়ে বলে,
“পাপা তুরার তো একটা পা কে টে ফেলেছে, তুরা এখন হাঁটবে কিভাবে? এক পা দিতে তো ঠিক ভাবে হাঁটতে পারবে না।”
নির্ভান ঝুঁকে ছেলে কে কোলে তুলে নেয়।
“তুরার আরেকটা পা আমরা কিনে নিয়ে আসবো তারপর আবার তুরার দুটো পা হয়ে যাবে।”
“তখন তুরা আমার সাথে দৌঁড়াতে পারবে?”
“হ্যাঁ পাপা।”
“তাহলে চলো পা কিনে নিয়ে আসি।”
“এখন না তো, পরে আনবো।”
“তাহলে এখন হাঁটবে কিভাবে?”
“এখন হাঁটবে না।”
“তাহলে তুরা বাড়িতে যাবে কিভাবে? ও বুঝেছি কোলে করে নিয়ে যাবে!”
নির্ভান বলে না কিছু।
হঠাৎ ভেতর থেকে তুরার চিৎকার করে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। নির্ভান দ্রুত ভেতরে উঁকি দেয়। তুহিন শিকদার চেয়ার ছেড়ে উঠে কেবিনের ডোরের সামনে এসে দাঁড়ান নির্ভানের পাশে।
তুরা নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করছে আর কাদঁছে। মুক্তা শিকদার আর তূর্য ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু তুরা কোনো ভাবেই শান্ত হচ্ছে না।
“পাপা তুরা এমন করছে কেন?”
নির্ভান আর তুহিন শিকদার ভেতরে প্রবেশ করেন।
তুহিন শিকদার মেয়ে কে ধরে বলেন,
“তুরা শান্ত হ, কি হয়েছে এমন করছিস কেন?”
তুরা ডান হাতে বাবার হাত আঁকড়ে ধরে কাদতে কাদতে বলে,
“আব্বু আমার পা, আমার আরেক টা পা কোথায়? আমি হাটবো কিভাবে? দৌড়াবো কিভাবে?”
“কিচ্ছু হয়নি শান্ত হ।”
“আমার পা নেই।”
একই বাক্য উচ্চারণ করে আর পাগলের মতো কাদতে থাকে। বিশ্বাসই করতে পারছে না ওর একটা পা ওর শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
তিন জন মিলেও তুরা কে শান্ত করতে পারছে না। বেড থেকে যেন লাফিয়ে পড়ে যাবে এমন অবস্থা।
নির্ভান ভিরান কে পাশের বেডে বসিয়ে দেয়। তুরার কান্না দেখে ভিরান কান্না করে দিয়েছে।
ছেলে কে বসে থাকতে বলে নির্ভান তুরার পাশে এসে দাঁড়ায়।
“তুরা।”
শুনতে পায় না তুরা। নির্ভান আবার ডাকে। তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নির্ভানের দিকে।
“এমন পাগলামি করছো কেন? শান্ত হও কিছুই হয়নি।”
“কিছুই হয়নি? আমার একটা পা নেই, আমি দাঁড়াবো কিভাবে? হাটবো কিভাবে?”
শান্ত হয় না তুরা। নার্স চলে আসে কেবিনে, আশে পাশের কেবিন থেকেও কয়েক জন চলে এসেছে।
নার্স বাইরের সবাই কে বের করে দেয়। তুরা কে শান্ত করার চেষ্টা করলেও পারে না কেউ।
এরকম করতে থাকলে পায়ে ইন্টারনাল ব্লিডিং শুরু হবে। মাত্র গত রাতে সার্জারি হয়েছে।
নির্ভান সবাই কে তুরার পাশ থেকে সরিয়ে দেয়। তুরা কে ধরে জোরে ধমক দিয়ে ওঠে,
“একদম চুপ।”
রাম ধমক খেয়ে চুপ হয়ে যায় তুরা, মুহূর্তেই আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
“আপনারা সবাই একটু বাইরে যান, আমি কথা বলছি ওর সাথে।”
কারো বেরোনোর ইচ্ছে না থাকলেও নির্ভানের বার বার বলায় নার্স সহ সবাই বেরিয়ে যায়।
তুরা এখনো পাগলের মতো কেঁদেই চলেছে।
নির্ভান তুরার ডান হাত টা মুঠো করে ধরে, তুরা আবার তাকায় নির্ভানের মুখের দিকে। তাকিয়ে থাকে একে অপরের চোখের দিকে। নির্ভান বলে,
“তুরা শান্ত হও, সেরকম কিছুই হয়নি। তুমি বেঁচে আছো এটাই তো অনেক।”
“আমার একটা পা নেই।”
“একটা নেই আরেকটা তো আছে। অনেক মানুষের তো একটাও থাকে না।”
তুরার দুই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। নির্ভান হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
“কান্না বন্ধ করো।”
“আমি আর হাঁটতে পারবো না।”
“কে বলেছে পারবে না? অবশ্যই হাঁটতে পারবে।”
“পা ছাড়া কিভাবে হাটবো?”
“সুস্থ হও তারপর প্রোস্থেটিক লেগ বানাবো তখন হাঁটতে চলতে আর কোনো অসুবিধা হবে না।”
তুরার কান্না বন্ধ হয় না। কৃত্রিম পা কি আসল পায়ের মতো হবে নাকি? নির্ভান তুরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“তোমার কান্না দেখে ভিরান কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়বে। গত কাল থেকে কাদতে কাদতে এমনিতেই কিছুটা অসুস্থ হয়ে গেছে।”
তুরা নির্ভানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। নির্ভানের এমন চোখ মুখ দেখেও কষ্ট হচ্ছে তুরার। বাবা-মা, ভাই সবার চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছে এক দিনেই।
নির্ভান তুরার মুখ নিজের দিকে ফেরায়। চোখের পানি আবার মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
“তুমি বেঁচে আছো এটাই আমাদের জন্য অনেক। একটা পা না থাকলে খুব বেশি কিছু হবে না। প্রয়োজনে সারা জীবন তোমাকে কোলে নিয়ে পুরো দুনিয়া দেখাবো।”
নির্ভান এমন কথা শুনে তুরা ফ্যালফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নির্ভান ঝুঁকে তুরার মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে বালিশের উপর ভর ছেড়ে দেয়।
“আমি আছি তো তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটার জন্য।”
চলবে………..