#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_17
কেবিনের ভেতর দুজন নারী-পুরুষ। জানালার কাঁচে হালকা আলো পড়ে ছায়া তৈরি করেছে। মাথার উপর ভন ভন করে ঘুরছে সিলিং ফ্যান।
তুরা হেঁচকি তুলতে তুলতে কাঁদছে। কোনো ভাবেই থামাতে পারছে না কান্না। চোখ লাল হয়ে গেছে, কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ব্যথা, আর মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব দুঃখ একসাথে এসে পড়েছে ওর কাছে।
নির্ভান ওর পাশে বসে মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। এক হাতে তুরার হাত শক্ত করে ধরে আছে, অন্য হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওর প্রতিটি ছোঁয়া যেন বলছে, “তুরা আমি সারা জীবন আছি তোমার পাশে, তুমি একা নয়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
নির্ভান ভেতরে ভেতরে ছিন্নভিন্ন, ভেঙে পড়েছিল নিজেও। গত রাতে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তুরার জীবনের সাথে নিজেকে জড়াবে না। বিয়ে করবে না তুরা কে।
ওর মনে হচ্ছিল ও তুরার জীবনে আসছিল বলেই তুরার সাথে এমন হয়েছে। সুহানা ওর জীবনে এসেছিল, আর অচিরেই হারিয়ে গিয়েছিল। তুরাও ওর জীবনে আসতো খুব শীগ্রই। ওর জীবনে আসার জন্যই বোধহয় এক্সি’ডেন্ট টা হয়েছে। ওর বার বার মনে হচ্ছিল ও যেই মেয়ের জীবনে জড়াবে সেই মেয়ের সাথেই বাজে কিছু ঘটবে।
ওর ভাবনা গুলো ওর মাকে বলেছিল, এটাও বলেছিল তুরার জীবনে জড়াবে না নিজেকে।
মেরি চৌধুরী ছেলের কথা শুনে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এই যুগে এসেও তাঁর ছেলে এমন কুসংস্কার বিশ্বাস করছে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এটা মাত্র একটা দুর্ঘটনা ছিল, তুরার জীবনে নিজেকে জড়ানোর জন্য এমন কিছু ঘটেনি।
নির্ভান কোনো ভাবেই মায়ের কথা বিশ্বাস করতে রাজি না। ওর দৃঢ় বিশ্বাস ওর জন্যই তুরার এমন হয়েছে। এতো দিন তো কিছু হলো না, গত কালই কেনো হলো? তূর্য যখন বলেছিল তুরা কে ওর কাছে বিয়ে দেবে তখনই নির্ভান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তুরা কে এখনই বিয়ে করে বাড়ি ফিরবে। আর ঠিক তখনই তুরার এক্সি’ডেন্ট হয়। এর মানে কি তাহলে? নির্ভান ওর জীবনে নিজেকে জড়াচ্ছে বলেই এমন টা হয়েছে।
মেরি চৌধুরী ছেলে কে বুঝিয়ে অনেক কিছু বলেন। নিজের মতো করে হাজার টা যুক্তি উপস্থাপন করেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে বিভিন্ন হুজুরদের বয়ান শোনান। এই চিন্তাধারা কুসংস্কার ব্যতীত কিছুই না। নির্ভান যদি এখন তুরা কে বিয়ে না করে পিছিয়ে যায় তাহলে তুরার জীবন আরো কঠিন হয়ে উঠবে। আর ভিরান তুরা কে ছাড়া কিভাবে থাকবে? নির্ভান নিজেও তো তুরা কে ভালোবেসে ফেলেছ।
নির্ভানের একটা ভুল সিদ্ধান্ত সব কিছু এলোমেলো করে দেবে। তুরার পরিবারের সবাইও ভাববে তুরা এখন স্বাভাবিক নেই বলে নির্ভান পিছিয়ে যাচ্ছে।
নির্ভানের মাথা কাজ করছিল না। মন আর যুক্তির লড়াইয়ে একে বারে পা’গ’লের মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। সব কিছু ঠিক হতে গিয়েও এলোমেলো হয়ে গেছে।
সব শেষে নির্ভান নিজের সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে আবার। যত যাই হয়ে যাক তুরা কেই বিয়ে করবে। যা হওয়ার হবে আল্লাহ ভরসা।
নির্ভান তুরার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“কেনো কাদঁছো এভাবে?”
“আমার সাথে কেনো এমন হলো?”
“ভাগ্যে যা ছিল হয়ে গেছে, কান্না বন্ধ করো এখন।”
“আমি তো এখন আর স্বাভাবিক নেই, আপনি তবুও বিয়ে করবেন?”
নির্ভান ওর হাত টা আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে,
“যদি বিয়ের পর এক্সিডেন্ট হতো?”
তুরা কিছু না বলে হেঁচকি তুলতে থাকে।
“তুরা আমি আছি তো তোমার জন্য, তুমি যেই অবস্থাতেই থাকো না কেন।”
তুরা কিছুই বলতে পারে না, শুধু কাঁদছে। তুরা স্পষ্ট বুঝতে পারছে নির্ভানের কণ্ঠ, হাতের কোমল স্পর্শ সব কিছুই ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, ওকে আগলে রাখার আশ্বাস দিচ্ছে। কেনো যেন তুরার আরো বেশি কান্না পাচ্ছে।
নির্ভান সোজা হয়ে বসে। তুরার চোখে চোখ রেখে বলে,
“কান্না করবে না একদম আর পা’গ’লামি তো করবেই না। তুমি আবার হাঁটবে একা একাই। চুপ চাপ শুয়ে থাকো আমি আসছি।”
“ভিরান কোথায়?”
“ওকে পাঠাচ্ছি ভেতরে, কাদবে না একদম।”
তুরার চোখের পানি আবার মুছিয়ে দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। ওকে দেখেই সবাই এগিয়ে আসে।
নির্ভান বলে,
“শান্ত হয়েছে এখন। ওর সামনে কান্না কা’টি করবেন না কেউ।”
“পাপা তুরার কাছে যাব।”
“হ্যাঁ যাও তোমার নানুর সাথে।”
সবাই আবার কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। নির্ভান পেছন থেকে তূর্য কে ডেকে ওঠে। তূর্য ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়েও থেমে যায়। ঘুরে নির্ভানের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“হ্যাঁ বলুন।”
“তুরার বার্থ সার্টিফিকেটে আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে না!”
“হ্যাঁ কিন্তু কেন?”
“বিয়ে করবো আজকেই। আপনি ফটোকপি নিয়ে আসুন আমি বাড়ি থেকে আসছি।”
তূর্য অবাক নির্ভানের কথা শুনে। বিস্মিত হয়ে বলে,
“কি বলছেন এসব? পরী অসুস্থ।”
“সেজন্যই এখন বিয়ে করব।”
________________
মাগরিবের পর কাজী সাহেব হাসপাতালেই আসেন। নির্ভানের কথার সাথে কেউ পেরে ওঠেনি। আজকে বিয়ে করবে মানে আজকেই করবে। তুরা সুস্থ হলে রিসেপশন পার্টি দেবে। ভিরান তো ভীষণ খুশি। তুরা কে একটু পর পর বলছে,
“তুরা আজকে তুমি সত্যি সত্যিই আমার পাপার কুইন হবে। অনেক মজা হবে, আমরা তিন জন একসাথে ঘুমাব।”
আরো কত কথা। ভিরানের কথা শুনে তুরা লজ্জা পাচ্ছে। মুক্তা শিকদার আর মেরি চৌধুরী হাসছেন ওর কথা শুনে।
কাজী কে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করেন নওশাদ চৌধুরী। নির্ভান বাদে বাকি সবাই কেবিনের ভেতরেই রয়েছে। তুরা শোয়া থেকে উঠে বসে আছে। গত রাত থেকে শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যাথা হয়ে গেছে, এখন আর শুয়ে থাকতে পারছে না।
রেজিস্ট্রি পেপারে আগেই সব কিছু লিখে নেন কাজী সাহেব। নির্ভান কেবিনের ডোর ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। হাতে ছোট একটা প্যাকেট। প্যাকেট টা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“এগুলো তুরা কে পরিয়ে দাও।”
মেরি চৌধুরী প্যাকেট টা হাতে নিয়ে ভেতর থেকে একটা বক্স বের করেন। বক্সের ভেতর একটা ডায়মন্ডের নাক ফুল, স্বর্ণের চেইন, একটা রিং।
নাক ফুল আর চেইন টা মেরি চৌধুরী পরিয়ে দেন। রিং টা রেখে দেন, নির্ভান পরিয়ে দেবে। ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকবে নির্ভান চৌধুরী হাসপাতালের কেবিনে বসে বিয়ে করেছিল। বউয়ের পরনে ছিল রোগীদের পোশাক আর নির্ভান চৌধুরীর পরনে ছিল সাধারণ টিশার্ট আর ট্রাউজার। গল্পের লেখক সানা শেখ, পেজ লিংক। অনেকেই গল্পটা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন তাই পেজের লিংক দেওয়া হয়েছে।
https://www.facebook.com/share/1B3bbHPkXb/
কাজী সাহেব রেজিস্ট্রি করার জন্য পেপার্স তুরার সামনে রেখে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলেন,
“এই জায়গায় তোমার নাম লিখো।”
তুরা কলম হাতে নিয়ে সকলের দিকে নজর বুলায়। সবাই বলে সই করে দেওয়ার জন্য। তুরা সই করে দেয়। নির্ভান কে সই করতে বললে নির্ভান নিজেও সই করে দেয়। আইনি আর ধর্মীয় দুই ভাবেই বিয়ে কমপ্লিট হয় দুজনের।
কয়েক জন নার্স সহ আশে পাশের কেবিন থেকেও কয়েক জন তুরার কেবিনে চলে এসেছে। কেবিনে আর একজন মানুষেরও জায়গা হবে না। হাসপাতালে বিয়ের কথা শুনেই আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসেছে সবাই। কেবিনের বাইরেও অনেকে দাঁড়িয়ে আছে।
তুরা তো লজ্জায় শেষ। মানে কি একটা অবস্থা! হাসপাতালের বেডে বসে বিয়ে করে নিলো।
নার্সরা নিজেরাও চলে যায় সাথে বাইরের সবাই কেও চলে যেতে বলে। কাজী সাহেব নিজেও চলে যান।
মেরি চৌধুরী ছেলের হাতে রিং টা গুঁজে দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। ওনার পেছন পেছন বাকি সবাই।
ভিরান যেতে না চাইলে তূর্য ওকে দোকানে নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে বের করে নিয়ে চলে যায়।
নির্ভান তুরার পাশে এসে বসে বেডে। লজ্জায় তুরা মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্য দিকে। ওর এখন ভীষণ লজ্জা করছে।
“ধরবো?”
তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
“বলছি তোমাকে ধরা যাবে নাকি?”
তুরা নির্ভানের কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে কপাল ভ্রু কুঁচকে নেয়। ওকে ধরা যাবে না কেন? তখন তো ঠিকই ধরেছিল। এখন ধরতে সমস্যা কোথায়?এখন ধরলে তো কিছু হবে না ওর। কপাল ভ্রু কুঁচকে রেখেই বলে,
“ধরুন।”
নির্ভান তুরার প্লাস্টার করা বাম হাত টা ধরে। অনামিকা আঙুলে রিং টা পরিয়ে দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তুরার মুখের দিকে তাকায়,
“আজ থেকে তুমি আমার জীবনের একাংশ। সব সময় সব রকম পরিস্থিতিতে তোমাকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব। আমার এই দেহে যত দিন জান আছে আমি তোমাকে আগলে রাখবো।”
তুরা কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে নির্ভানের মুখের দিকে। চোখে চোখ পড়ে একে অপরের। আজ সব বাধা অতিক্রম করে দুজন এক হয়ে গেছে। আর কেউ আলাদা করতে পারবে না ওদের।
দুজনের মাঝে শুধু নীরবতা আর সেই নীরবতার ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
নির্ভান হাত তুলে এক হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে তুরা কে। তুরার মাথা ঠেকায় নিজের বুকে,
“এখান টায় তোমার জায়গা। যখন ভয় পাবে এখানে এসে লুকাবে, আমি আগলে নেব।”
এই গল্প নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। গল্পের প্লট থিম কাহিনী বুঝতে পারেন না। এই গল্প টা কয়েক জন নিজেদের মতো করে লিখে পোস্ট করে তাই আপনারা বুঝতে পারেন না। সানা শেখের পেজ থেকে পড়বেন তাহলে বিভ্রান্ত হবেন না।
চলবে………..