#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_18
নির্ভান তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আরো বসে থাকবে নাকি শুয়ে থাকবে?”
তুরা দৃষ্টি নত করে নিচু স্বরে বলে,
“শুয়ে থাকব।”
নির্ভান তুরা কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ধরে আস্তে করে শুইয়ে দেয়। তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে নির্ভানের মুখের দিকে তাকায় আবার। নির্ভান ঝুঁকে পড়ে তুরার মুখের কাছে, ওষ্ঠ ছোঁয়ায় ললাটে। তুরা চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। নির্ভান সোজা হয়ে দাঁড়ায় আবার। ডোর ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে ভিরান। দোকানে গিয়ে চিপস্ আর আইসক্রিম খেয়ে ফিরে এসেছে।
নির্ভান ছেলে কে তুলে বেডে বসায় তুরার পাশে। ভিরান তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায়। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
“পাপা তুরা তোমার কুইন হয়ে গেছে?”
ভিরানের কথা শুনে তুরা আবার লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নির্ভান বলে,
“হ্যাঁ, তুরা এখন আমার কুইন। তুমি এখন থেকে তুরা কে নাম ধরে ডাকবে না।”
“তাহলে কি বলে ডাকব?”
“মা নাহয় আম্মু বলে ডাকবে।”
“মা!”
তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার তাকায় দুজনের দিকে। নির্ভান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। নির্ভান তুরার দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে,
“তোমার ইচ্ছে।”
“তুরাম্মা।”
তুরার মনে পড়ে, এর আগেও একদিন ভিরান ওকে তুরাম্মা বলে ডেকেছিল। নির্ভান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুরাম্মা এটা আবার কেমন ডাক?”
“পাপার কুইন।”
নির্ভান কপাল ভ্রু কুঁচকে নেয়। তুরা বলে,
“ভিরানের যা ইচ্ছে হয় ডাকুক।”
“ভিরান চলো বাসায় যাব এখন।”
“তুরাও যাবে আমাদের সাথে?”
“আবার তুরা?”
“সরি।”
“তুরা এখন অসুস্থ, একটু সুস্থ হলে তারপর বাড়িতে নিয়ে যাব।”
“আম্মু সুস্থ হলে তারপর পর আম্মুর সাথে বাসায় যাব আমি।”
“এখানে কোথায় থাকবে তুমি?”
তুরার পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নির্ভান বলে,
“এখানে তোমার শোয়া নিষেধ।”
“কেন?”
“এটা ছোট বেড, দুজনের ভালো ভাবে হবে না। তুমি ঘুমের ঘোরে লাথি টাথি দিলে তোমার আম্মু কষ্ট পাবে।”
“আম্মু কে ছাড়া ঘুমাবো না আমি।”
“ভিরান জেদ করবে না। দেখতেই পাচ্ছো তোমার আম্মু অসুস্থ। সুস্থ হোক তারপর একসাথে ঘুমাবে।”
“আমরা তিন জন একসাথে ঘুমাব?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি তোমার লম্বা হাত দিয়ে আমাদের দুজন কে জড়িয়ে ধরবে?”
নির্ভান নিজের হাত লম্বা করে। ওর হাত লম্বা? তুরা মুচকি মুচকি হাসছে। ভিরান উত্তরের আশায় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ভান দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেও মুচকি হেসে বলে,
“হ্যাঁ।”
“পাপা আমি কিন্তু মাঝখানে ঘুমাব।”
“আচ্ছা, এখন চলো আমরা বাড়িতে যাই।”
“না, আমি যাব না। আমি ওই বেডে ঘুমাব।”
“ওখানে তোমার নানু ঘুমাবে। আমরা এখন যাব আবার সকালেই চলে আসব।”
“তুরা কে আমাদের সাথে নিয়ে চলো।”
হতাশ ভঙ্গিতে ছেলের মুখ পানে তাকিয়ে থাকে নির্ভান।
“তুরা তুমি ওকে বোঝাও আমি বাহির থেকে আসছি।”
তুরা মাথা নাড়ায়। নির্ভান বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
“তুরা আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না আমার। তোমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় খুব।”
“এখানে থাকতে তোমার কষ্ট হবে। আর দুই-তিন দিন বোধহয় হাসপাতালে থাকতে হবে তারপর বাড়িতে ফিরে যাব। এই দুই-তিন দিন তোমার পাপার সাথে একটু কষ্ট করে থাকো।”
“আদর দাও।”
মলিন স্বরে বলে মুখ এগিয়ে নেয় তুরার মুখের কাছে। তুরা ভিরানের সারা মুখে চুমু খায়। ডান হাত দিয়ে মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দেয়।
মুক্তা শিকদার আর মেরি চৌধুরী কেবিনের ভেতর প্রবেশ করেন।
নির্ভান আর তূর্য নিচে নেমে গেছে।
নওশাদ চৌধুরী তুহিন শিকদারের দিকে তাঁকিয়ে বলেন,
“বেয়াই সাহেব চলুন চা খেয়ে আসি।”
তুহিন শিকদার হেঁসে বলেন,
“স্যার এমন সম্বোধন শুনে কেমন যেন লাগছে।”
“স্যার আবার কি? আমি অফিসে আপনার বস, অফিসের বাইরে না। বেয়াই বলে ডাকুন।”
“আমার মুখ দিয়ে আসবে না এই ডাক।”
“কি আশ্চর্য কথা, বেয়াই কে বেয়াই ডাকবেন তাতে কিসের সমস্যা?”
“আচ্ছা চলুন চা খেয়ে আসি।”
“বেয়াই না ডাকলে যাব না আমি।”
“স্যার
বাকি কথা শেষ করার আগেই নওশাদ চৌধুরী বলেন,
“আবার স্যার, বেয়াই ডাকতে না পারলে ভাই ডাকুন।”
“আচ্ছা ভাই চলুন।”
দুজন হেসে একসাথে পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে।
_______________
আজকে তুরা কে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেবে। সব কিছু গোছগাছ শেষ। তুরা কে তৈরি করে দিয়েছেন মুক্তা শিকদার। নওশাদ চৌধুরী আর তুহিন শিকদার আজকে হাসপাতালে আসতে পারেননি। দুজনেই অফিসে গেছেন। তূর্য গেছে ছাড় পত্র নিয়ে আসার জন্য। ভিরান ওয়াশরুমে যেতে চাইলে মেরি চৌধুরী নিয়ে যান।
নির্ভান শাশুরি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুরা কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব।”
মুক্তা শিকদার অবাক হয়ে বলেন,
“কেন? তুরা তো এখনো অসুস্থ। সুস্থ হলে নাহয় তোমাদের বাড়িতে যাবে।”
“ভিরান তো তুরা কে ছাড়া থাকবে না, ভিরান কে ছাড়া আমিও থাকতে পারছি না আর। সবচেয়ে ভালো হয় দুজন কেই আমার কাছে নিয়ে যাই।”
“ওখানে গেলে তুরাকে কে দেখবে? তুমি তো সারা দিন অফিসেই থাকবে।”
“আম্মু আছে, মেড আছে। তাছাড়া আপনিও তো যাচ্ছেন আমাদের সাথে।”
“আমি তোমাদের সাথে গেলে তূর্য আর তোমার শশুর কে রেঁধে খাওয়াবে কে?”
“ওনারও যাবে।”
“তার কোনো দরকার নেই। তুরা কে আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই। তুমি বরং আমাদের সাথে চলো। তুরা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকবে।”
“আপনারাই আমাদের সাথে চলুন। সব দিক একা সামাল দিতে গিয়ে আপনি হিমশিম খেয়ে যাবেন। তুরার দেখাশোনা, এতো গুলো মানুষের রান্না, ভিরান কে দেখা। আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।”
“কিছু হবে না। ওখানে থাকলে তুরার মন ভালো থাকবে। তুমি নাহয় একটু কষ্ট করে সব দিক ম্যানেজ করে চলবে।”
নির্ভানের কোনো কথাই শোনেন না মুক্তা শিকদার। যতই মেয়ের শশুর বাড়ি হোক না কেন, এখনই কিভাবে ফুল ফ্যামিলি নিয়ে মেয়ের শশুর বাড়িতে গিয়ে থাকবেন? উনি একা গেলেও তূর্য আর তুহিন শিকদারের খাওয়া দাওয়ায় কষ্ট হয়ে যাবে।
_____________
শেষ পর্যন্ত তুরা দের ফ্ল্যাটেই আসতে হয়। তুরাও নিজের বাড়িতেই আসতে চাইছিল বার বার।
নির্ভান না পেরে শশুর বাড়িতেই ফিরে এসেছে।
তুরা কে কোলে তুলে তুরার রুমে নিয়ে আসে নির্ভান। তূর্য ব্যাগ দুটো তুরার রুমে দিয়ে চেঞ্জ করতে নিজের রুমে যায়। মুক্তা শিকদার রান্না করার জন্য দ্রুত চেঞ্জ করতে যান। মেরি চৌধুরী সোফায় বসেন।
নির্ভান ছেলে কে চেঞ্জ করিয়ে দেয়। এখন ওর কাপড় চোপড় আনার জন্য বাড়িতে যেতে হবে।
“আমি বাড়িতে যাচ্ছি, ভিরান কে তোমার পাশে লাফালাফি করতে দিও না ব্যাথা দেবে। ভিরান চুপ চাপ বসে থাকো, তোমার আম্মু কে ব্যাথা দিও না।”
“আচ্ছা, তুমি দ্রুত চলে এসো।”
“আচ্ছা আসছি।”
“আদর দিয়ে যাও।”
নির্ভান ছেলে কে আদর করে। ভিরান তুরা কে দেখিয়ে দিয়ে বলে,
“আম্মু কেও আদর দাও।”
নির্ভান তুরার দিকে তাকায়। তুরা লজ্জা পেয়ে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। নির্ভান পড়ে মহা ঝামেলায়। এখন ছেলের সামনে বউ কে আদর করবে নাকি?
“পাপা কি হলো, তুরা কে আদর দাও।”
“পরে দেব।”
“না না এখনই দেবে, আদর দিয়ে তারপর যাও তুরা ব্যাথা পেয়েছে তো।”
“আবার তুরা ডাকছ?”
“মনে থাকে না। পাপা আম্মু কে আদর দাও না প্লিজ।”
নির্ভান ঝুঁকে তুরার মুখের ওপর থেকে ওড়না টেনে সরিয়ে নিয়ে টপাটপ বেশ কয়েক টা চুমু খায়।
দ্রুত পায়ে ডোরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
“চুপ চাপ থাকো, আসছি আমি।”
“পাপা আম্মুর কাছ থেকে তো আদর নিলে না।”
“ভিরান চুপ করো, সবাই শুনবে তো।”
“শুনলে কি হবে?”
___________
রাতের খাবার খেয়ে ভিরান কে কোলে নিয়ে তুরার রুমে প্রবেশ করে নির্ভান। যদিও নির্ভান এখনই তুরার সাথে থাকতে চাইছিল না কিন্তু ভিরান তুরা আর বাবা কে ছাড়া ঘুমাবে না। ড্রয়িং এই নিয়ে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছে।
রাতের খাবার আর মেডিসিন খেয়ে আটটার পর পর তুরা ঘুমিয়ে গেছে। নির্ভান ছেলে কে ফ্রেস করিয়ে এনে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেস হয়ে আসে। ডোর লক করে বেডে উঠে শুয়ে পড়ে। নির্ভান আর তুরার মধ্যে বেশ খানিক টা দূরত্ব বজায় আছে। ভিরান দুজনের মাঝখানে শুয়ে আছে। বাবা কে কাছে পেলে মা কে পাচ্ছে না, মা কে কাছে পেলে বাবা কে পাচ্ছে না।
ভিরান তুরার দিকে চেপে গিয়ে বলে,
“পাপা এদিকে আসো, তোমার লম্বা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরো আমাদের দুজন কে।”
“এখন জড়িয়ে ধরা যাবে না, তোমার আম্মু ব্যাথা পাবে। তুমি এদিকে আসো।”
নাছর বান্দা ভিরান শোনে না বাবার কথা। ভিরানের ডাক শুনে তুরার ঘুম ভেঙে যায়।
“আম্মু পাপা কে এদিকে আসতে বলো।”
তুরা ঘুম ঘুম চোখ দুটো টেনে তুলে নির্ভানের দিকে তাকায়। নির্ভান বেডের ওই পাশ ঘেঁষে শুয়ে আছে।
চোখ বন্ধ করে ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
“এদিকে আসুন।”
ভিরান বাবার হাত ধরে টেনে আনার চেষ্টা করে। নির্ভান এগিয়ে আসে দুজনের কাছে। এভাবে টানাটানি করতে করতে তুরা কে ব্যাথা দিয়ে বসবে। কাত হয়ে শুয়ে নিজের লম্বা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে দুজন কে। দুজনের মাঝখানে শুয়ে চুপ হয়ে যায় ভিরান। আজকে ওর ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। বাবা আর মায়ের সাথে ঘুমাবে আজ।
নির্ভান তুরার মুখের দিকে তাকায়। তুরা চোখ বন্ধ করে আছে, ঘুমিয়েও গেছে বোধহয় আবার। নির্ভানের চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় তুরার মুখ দেখতে থাকে। এই তুরার মধ্যে স্পেশাল কিছু একটা আছে, অবশ্যই আছে। স্পেশাল কিছু না থাকলে নির্ভান কে মায়ায় ফেলা এতো সহজ ছিল না। নির্ভান তো দ্বিতীয় নারীর মায়ায় পড়তে চায়নি, ভালোবাসতে চায়নি, নিজের জীবনে জায়গা দিতে চায়নি।
এই মায়া আর ভালোবাসা সত্যিই ভয়ংকর। এরা কোনো বাধাই মানতে চায় না। তাইতো নির্ভান নিজের মন কে আটকে রাখতে পারেনি।
ভালো বাসতে না চেয়েও ভালোবেসে ফেলার মতো ভয়ংকর ব্যাপার আর একটাও নেই। সত্যিই নেই।
চলবে………….