#ভাঙা_পাঁজরে_বসন্ত
#সানা_শেখ
#পর্ব_19
ভিরান ঘুমিয়ে গেলে ওকে তুলে নিজের বাম পাশে শোয়ায় নির্ভান। ঘুমের ঘোরে যদি তুরা কে লাথি দেয় বা উপরে উঠে যায় সেজন্য। ভিরানের তো আবার বুকের উপর উঠে ঘুমোনোর অভ্যাস আছে।
তুরা আর ভিরান দুজনেই গভীর ঘুমে মগ্ন তবে নির্ভানের ঘুম আসছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তুরার দিকে তাকায় আবার। ওই তিন প্রাইভেট কার যেই তিন জন ড্রাইভ করছিল তাদের তিন জন কেই ধরেছে পুলিশ। নেক্সট শুনানি তে সকলের শাস্তি নির্ধারণ করা হবে। ওদের ধরার জন্য তূর্য আর নির্ভান অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছে দুদিন। বেপরোয়া গতিতে ড্রাইভ করে ওই একই দিনে ওরা আরো একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছিল।
নির্ভান হাত বাড়িয়ে তুরার গালে হাত ছোঁয়ায়। একটু এগিয়ে কাত হয়ে জড়িয়ে ধরে আলতো হাতে। একটু ঝুঁকে পড়ে ওষ্ঠ ছোঁয়ায় তুরার মেদুর গালে। নির্ভান নিজেকে যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন তুরার এই অবস্থা ওকেও ভেতর থেকে ভেঙে ফেলছে।
কিছুক্ষণ পর তুরা কে ছেড়ে দিয়ে ভিরানের দিকে ঘুরে শোয়। ভিরান কে বুকে আগলে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়। সকালে অফিসে যেতে হবে। এই কয়েক দিন মনের ভুলেও অফিসে যায়নি।
____________
সকালে ভিরানের ঘুম ভাঙে আগে। চোখ বন্ধ রেখেই কিছুক্ষণ মোড়ামোড়ি করে। চোখ মেলে তাকায়, ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের দুই পাশে তাকায়। বাবা কে দেখতে পেলেও তুরা কে দেখতে পায় না। তাড়াহুড়ো করে শোয়া থেকে উঠে বসে। ও তো মাঝখানে ছিল, তাহলে নির্ভান মাঝখানে গেলো কিভাবে? আর ও এই পাশে আসলো কিভাবে? নির্ভান কে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“পাপা আমাকে এই পাশে এনেছো কেন?”
ছেলের এক চিৎকারেই নির্ভানের ঘুম চাঙ্গে। তুরার দিক থেকে দ্রুত ছেলের দিকে ফেরে। শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে,
“কি হয়েছে পাপা?”
“আমি তো মাঝখানে ছিলাম, তুমি আমাকে এই পাশে এনেছো কেন?”
নির্ভান তুরার দিকে তাকায়। তুরা ঘুম জড়ানো চোখ দুটো দিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিরানের চিৎকার শুনে ওরো ঘুম ভেঙে গেছে।
নির্ভান ছেলে কে কোলে নিয়ে বলে,
“তুমি নিজেই ঘুমের ঘোরে আমার ওপর দিয়ে এই পাশে চলে এসেছ।”
“মিথ্যে বলছো তুমি।”
“মিথ্যে বলবো কেন? সত্যি বলছি। তুমি ঘুমের ঘোরে আমার বুকের ওপর উঠে গিয়েছিল। তারপর আবার বুকের ওপর থেকে নেমে এই পাশে শুয়ে ছিলে।”
“তাহলে আমাকে আবার মাঝখানে নাউনি কেন?”
“আমি ভেবেছি তুমি আর মাঝখানে যাবে না।”
ভিরান আবার কিছু বলতে তার আগেই নির্ভান ওকে নিয়ে বেড থেকে নামতে নামতে বলে,
“সকাল হয়ে গেছে, ফ্রেস হয়ে খাবার খেয়ে কিন্ডারগার্ডেনে যেতে হবে।”
“আমি যাব না তুরা কে ছেড়ে।”
“মা হয় তোমার। অনেক দিন হয়ে গেছে কিন্ডারগার্ডেনে যাও না। তোমার টিচাররা বার বার কল করে আমাকে।”
ভিরান কে ফ্রেস করিয়ে দিয়ে নির্ভান নিজেও দ্রুত ফ্রেস হয়ে নেয়। তুরা বেডে শুয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ভানের চোখে চোখ পড়তেই আবার দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে।
নির্ভান তুরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফ্রেস হবে না?”
তুরা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ায়। নির্ভান ডোর খুলে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়ায়। আশে পাশে নজর বুলিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে আসে। মুক্তা শিকদার রান্না বসিয়ে দিয়েছেন।
“মা তুরা ফ্রেস হবে।”
মুক্তা শিকদার পেছন ফিরে তাকান। চুলা বন্ধ করে নির্ভানের সাথে তুরার রুমে প্রবেশ করেন।
তুরা ভিরানের সাথে কথা বলছে।
__________
মুক্তা শিকদার তুরা কে খাইয়ে দিচ্ছেন তুরার রুমেই। নির্ভান ভিরান কে খাইয়ে দিচ্ছে ডাইনিং টেবিলে বসে। তূর্য আর তুহিন শিকদারও খাবার খাওয়া শুরু করেছেন। নির্ভানের জন্যও খাবার বেড়ে রাখা হয়েছে, তবে নির্ভান ছেলে কে খাইয়ে তারপর খাবে।
খাওয়া শেষ করে তূর্য ভিরান কে নিয়ে বের হয় কিন্ডারগার্ডেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে এসে একটা ভালো জব পেয়েছে তূর্য। ভাগ্নে কে খাওয়ানো, গোছল করানো, ওয়াশরুমে নিয়ে ফ্রেস করিয়ে দেওয়া। ভিরান বেচারা কে দিয়ে কি না করিয়েছে!
নির্ভান মুক্তা শিকদারের সাথে খাওয়া শুরু করে। তুহিন শিকদার অফিসের উদ্যেশ্যে বেরিয়ে গেছেন। নির্ভানের লেট হয়ে গেছে আজকে। আরো সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে এখন থেকে।
খাওয়া শেষ করে রুমে আসে। তুরা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ভানের আগমন বুঝতে পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। নির্ভান প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বেডের পাশে এসে দাঁড়ায়।
“সাবধানে থেকো, একা একা কিন্তু উঠে বসার চেষ্টা করবে না। ভিরান ফিরে আসলে ওকে নিজের আশে পাশে বেশি লাফালাফি করতে দেবে না। কখন আবার ব্যাথা দিয়ে ফেলবে। সময় মতো খাবার আর মেডিসিন খেয়ে নেবে।”
তুরা মৃদু স্বরে বলে,
“আচ্ছা।”
“টেনশন করবে না, খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।”
নির্ভান ডোরের দিকে এগিয়ে যায়, পেছন থেকে তাকিয়ে থাকে তুরা।
প্রথম যখন নির্ভান কে দেখেছিল তখন ভেবেছিল নির্ভান অনেক রাগী মানুষ। কেমন গম্ভীর হয়ে কথা বলতো। ওর গম্ভীর স্বর শুনে তো তুরার বুকের ভেতর কাঁপুনি তৈরি হয়ে যেত।
তারপর যত বার নির্ভান কে দেখেছিল প্রতি বার গম্ভীর নির্ভান কেই দেখেছিল।
অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসার পর থেকে নির্ভানের মধ্যে গাম্ভীর্যতা কমে এসেছিল। এখন কথা বলার সময় একদমই গম্ভীর লাগে না নির্ভান কে। যখন চুপ চাপ থাকে তখনই গম্ভীর লাগে।
___________________
দুপুরে তুরার ফোনে কল আসে। পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখে নির্ভান কল করেছে। হঠাৎই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। কল রিসিভ করে ফোন মুখের সামনে ধরে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নির্ভানের চেহারা।
তুরা চুপ করে থাকে। নির্ভান ফোনের স্ক্রিনে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলে,
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ, খেয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“মেডিসিন?”
“খেয়েছি।”
“ভিরান কোথায়?”
“ভাইয়ার সাথে ঘুমোতে গেছে।”
“তুমিও ঘুমাও।”
তুরা জড়তা দূরে ঠেলে মৃদু স্বরে বলে,
“আপনি খেয়েছেন?”
“খেতে যাব এখন।”
দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা যেন নেই। কথা ফুরিয়ে গেছে এত টুকুতেই। নির্ভান পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনে। তুরার এলোমেলো চুল গুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। শুঁকনো মলিন চেহারাও নির্ভানের কাছে দারুন লাগছে দেখতে।
তুরাও এলোমেলো ভাবে একটু পর পর ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। ফরমাল ড্রেসে নির্ভান কেও হ্যান্ডসাম লাগছে। সব রকম ড্রেসে বরাবরই হ্যান্ডসাম লাগে নির্ভান কে। তুরা কেনো যেনো নির্ভানের চোখে চোখ রাখতে পারে না। দু’বার বোধহয় নির্ভানের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিল। নির্ভান ওর ধারে কাছে থাকলে হার্টবিট বেড়ে যায়। বুকের ভেতর কম্পন সৃষ্টি হয়। ফোনে ভিডিও কলে কথা বলতে গেলেও এমন হয়।
“আচ্ছা ঘুমাও তুমি।”
“আপনিও খেয়ে নিয়েন দ্রুত।”
“আচ্ছা।”
নির্ভান ফোন রেখে দেয়। অফিসের কাজে একটুও মন বসছে না। কেমন যেন ধৈর্য হারা হয়ে উঠছে বার বার। আগে কোনো দিন নির্ভানের সাথে এমন হয়নি।
সন্ধ্যার পর উকিলের সাথে কথা বলতে যাবে। ওই তিন জন কে সর্বোচ্চ শাস্তি পাইয়ে ছাড়বে।
_____________
নির্ভান ফ্ল্যাটে ফিরে আসতে আসতে রাত দশ টা বেজে যায়। নিজের বাড়িতে গিয়েছিল সেখান থেকে ফিরতেই এত দেরি হয়ে গেল। কলিং বেল চাপতেই মুক্তা শিকদার ডোর খুলে দেন। নির্ভান ভেতরে প্রবেশ করে। ওর পরনে ট্রাউজার আর টিশার্ট।
মুক্তা শিকদার ডোর লক করে নির্ভানের দিকে ঘুরে বলেন,
“খেয়ে যাও একেবারে।”
“আপনারা সবাই খেয়েছেন?”
“হ্যাঁ, শুধু তুমিই বাকি আছো।”
“আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি। আম্মু ছাড়ছিল না তাই খেয়ে আসতে হয়েছে।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই।”
“শুয়ে পড়ুন তাহলে।”
নির্ভান তুরার রুমে প্রবেশ করে। ডোর লক করে হাতের ফাইল, ল্যাপটপ তুরার স্টাডি টেবিলের ওপর রাখে। এগিয়ে এসে দাঁড়ায় বেডের কাছে, ছেলে আর বউয়ের দিকে তাকায়। দুজনেই গভীর ঘুমে মগ্ন। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সব কিছু যেন কিভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
“তুরা নূরতাজ তুমি তো আমার ভাঙা পাঁজরে গেড়ে বসে গেছো, বসন্তের ফুলও ফুটিয়েছ। এটা কি হওয়ারই ছিল?”
ঘুমন্ত তুরার দিক থেকে কোনো উত্তর আসে না। নির্ভান নাইট ল্যাম্প অন করে মেইন লাইট অফ করে দেয়। বেডে উঠে ভিরান কে সরাতেই তুরার ঘুম ভেঙে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে নির্ভান কে দেখে বার কয়েক চোখ ঝামটা দেয়। ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
“ওকে ওদিকে নিচ্ছেন কেন?”
নির্ভান মাঝখানে শুতে শুতে বলে,
“এখানে থাকলে ঘুমের ঘোরে তোমার উপরে উঠে যাবে।”
“গত রাতে আপনি ওকে ওই পাশে নিয়েছিলেন?”
তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ।”
“তাহলে মিথ্যে বলেছিলেন কেন?”
“সত্যি বললে তো চেঁচামেচি শুরু করে দিত।”
তুরা একটু সময় চুপ করে থাকে।
“খেয়েছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কখন ফিরেছেন?”
“একটু আগেই।”
তুরা আর কিছু বলে না। ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে আবার। নির্ভান হয়তো শুনতে পাচ্ছে ওর হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিক শব্দ।
নির্ভান কাত হয়ে তুরার দিকে ফেরে। তুরার যেন এবার শ্বাস আটকে যাবে।
“তুমি নার্ভাস?”
“না।”
“কি হয়েছে তাহলে?”
“কিছু না।”
নির্ভান আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ঘুমাও।”
তুরা জমে রইল। ওর সারা অঙ্গে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। ওর বলতে ইচ্ছে করছে, “আপনি আমাকে ছেড়ে দূরে সরে ঘুমান। আপনি আমাকে এভাবে ধরায় মনে হয় বিদ্যুতের শক লাগছে।”
বলতে ইচ্ছে হলেও বলতে পারলো না তুরা। নির্ভান নিজেই ওকে ছেড়ে উল্টো ফিরে ছেলে কে বুকে আগলে নেয়।
“তুরা চোখ বন্ধ করে ঘুমাও।”
সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে নেয় তুরা। নির্ভান কি ওর মন পড়তে পারে?
চলবে…………