#ভাড়াটে_মরশুম – [০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
আব্বা পরপর দুটো সম্বন্ধ আনলেন আমার জন্য, দুটোই আমার পছন্দসই না হওয়ায় “না” করে দিয়েছি। আব্বা আমার “না” এর পরিবর্তে জোর করে কোনো প্রস্তাব চাপিয়ে দেননি, তবে আব্বা এতে ভীষণ হতাশ হয়েছেন মনে হলো। আগে যাও দু-চারটে কথা বলতেন এবার আরও বলা বন্ধ করলেন। এলাকাতে আমাকে নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলছে। মেয়ে বুড়ি হয়ে গেছে এখনো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। প্রস্তাব আসে এটাই তো বড়ো কথা, নয়তো এমন বুড়ি মেয়ে কেই বা ঘরে তুলে?
এ সমস্ত কথা-বার্তা আমার কানে এলেও আমি অস্বাভাবিক নির্বিকার। আমার সমস্ত চিন্তা আমার আব্বাকে নিয়ে। যে সিন্ডারেলা সে জানে তার জীবনের গল্প। আমি একা লড়েছি এই কয়েক বছর যাবৎ। কেউ একটু সাহায্য তো দূর, বুঝও দিতে আসেনি। সেই আমার পিঠ-পিছে এরা আমায় বুড়ি তকমা দিচ্ছে। আমি চলে গেলে নিশ্চয়ই আমার আব্বাকে তারা খাওয়াবে না। আমার লড়াই এক দুদিনের না যে ওদের কথায় আমি থেমে যাব। দেয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতেই মেরুদণ্ড শক্ত হয়েছে। এই মেরুদণ্ডের শক্ত খোলশ ভাঙার সাধ্য ওদের নেই। তবে আব্বার এসব ভালো লাগল না কিছুতেই। একে তো আমার বেতনে খাওয়ার খোঁটা শুনছেন, তার ওপর মানুষ তাকে বুঝ দেয় এমন চলতে থাকলে আমার বিয়েই হবে না। এসবের ভার মাঝেমধ্যে সইতে পারি না। মানুষদের মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা একই। অথচ সমাজ কথা শুনিয়ে, মন ভেঙেই পৈশাচিক আনন্দ পায়। এই সভ্য সমাজ যদি বুঝত তাদের কথার ছুঁরিতে অপরজন কতটা ক্ষত-বিক্ষত হয়, তবে তারা নিজেদের জিভ কেটে নিত।
প্রথম মাসে শরৎ আমাকে চমকে দিয়ে ঠিক সময়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। এতে আব্বা যেন তার প্রথম আয় হাতে পাবার মতোই খুশি হলেন। পরেরদিন ছিল শুক্রবার। আব্বা ভরপুর বাজার করলেন। পছন্দের মাছ আনলেন। তাজা শাক, মুরগী, খাসির মাংস, সব মিলিয়ে আব্বার যেন আজ ঈদ। পুরো মাসখানেক পর আব্বার এই খুশি দেখতে পেলাম আমি। আমার অশান্ত, অস্থির মন এক লহমায় ভালো হয়ে যায়। আব্বা আমাকে বললেন কোন কোন পদ খাবেন। আমি কসরত করে মাছ, খাসির মাংস কেটে চুলোয় বসিয়ে দেই। আব্বা ততক্ষণে জুম্মার নামাজে চলে যান। এক ঘণ্টা পরেও আমি রান্নাঘর থেকে এক পাও নড়িনি। আব্বা এতদিন পর আবদার করেছেন, আবদার পূরণ করতে কোনো বাঁধাই মানব না। চুলোর পাড়ে থাকতে থাকতে ঘেমে দু’বার গোসল দিয়ে ফেলেছি। আজকে বাইরে উত্তপ্ত গরম। তার ওপর এক ভাবে আগুনের সামনে কাটানো চারটে খানিক কথা নয়। এটা তারাই বোঝে যারা রান্নাঘরে রাঁধতে যায়। কপালের ওপর পড়া ছোটো চুলগুলো আমার কপাল, গালে ঘামে লেপ্টে আছে। মুখের চুল একটু বিরক্ত করলেও নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়েছি।
দুপুর সম্ভবত এখন দুটো ছুঁইছুঁই। আব্বা এখনো ফিরেননি। গরমের জন্য রান্নাঘরের জানালাটা খুলে রাখা। চুলোটা জানালা বরাবরই বসানো হয়েছে। চুলোর আঁচ কিছুটা কমিয়ে বাইরে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠি। জানালার ওপারেই শরৎ সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। অগোছালো মানুষটা জুম্মা উপলক্ষ্যে সাদা আয়রনবিহীন পাঞ্জাবি, পাজামা পরেছে। পাঞ্জাবির বিভিন্ন জায়গা কেমন কুঁচকে আছে, তবে এতটাও নয়। তার মাথায় টুপি। ঘন, জঙ্গল চুল-দাঁড়ি মনে হলো কিছুটা ছেটেছে। আমি বুক বরাবর হাত চেপে বললাম,
–“এভাবে ভূতের মতো এসে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
–“ভূত? তার মানে আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন?”
–“ভয় না পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়? আপনার ত্রি-সীমানায় কেউ আছে?”
শরৎ আমার ভয়-ভীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। সে বোধ হয় আমার ঘর্মাক্ত মুখটা পরখ করল। পরপর পেছনে বেঁধে রাখা হাত সামনে আনে। আমি হাতের দিকে তাকাতেই বুঝলাম মসজিদ থেকে দেওয়া জিলাপি। সে আমাকে জিলাপি সাধল না বরং নিতে বাধ্য করল।
–“জিলাপি খুব একটা পছন্দ না আমার। আগে যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেখানের এক বাচ্চাকে দিয়ে দিতাম। এখানের মসজিদে এবারই প্রথম জিলাপি পাওয়া। যেহেতু এখানে আমার পরিচিত কেউ নেই তাই আপনাকেই দিলাম।”
–“আপনার আমাকে বাচ্চা লাগে?”
–“কেন নয়? আপনার বাবার সাথে আমাকে দেখলেই কেমন নাক-মুখ কুঁচকে রাখেন। যেন আপনার থেকে আপনার বাবাকে আমি কেড়ে নিচ্ছি। এগুলো বাচ্চামো নয়? আপনার বয়স বেড়েছে ঠিক, কিন্তু আপনি ছোটো বাচ্চাটিই রয়েছেন।”
আমি তার কথায় ধ্যান দিলাম না। শরৎ সাহেব এমনিতেই বেশি পটরপটর করা মানুষ। তাই তার মুখে এত কথা শোনা অস্বাভাবিক না। শরৎ আমার জবাব না পেয়ে ফিরতি বলল,
–“আরে নিয়ে নিন দুঃখী মেয়ে। জিলাপিতে জাদু আছে, মন ভালো করার জাদু। এটলিষ্ট আপনার দুঃখের বাক্স কিছুটা সুখ দিয়ে ভরবে।”
–“তবে আপনি নিজে কেন খাচ্ছেন না?”
–“আমি জিলাপির নামে সুখ ভাগ করতে ভালোবাসি, প্রিয়াঞ্জনা।”
ভদ্রলোক এই প্রথম বোধ হয় আমার নাম ঠিকঠাক বলতে পারল। নয়তো পিতু, প্রিয়া, পৃথি, প্রিয়তা বলে আমাকে আরও বিরক্ত করে তুলত। ওনার একপ্রকার জোরাজুরিতেই আমার জিলাপি নিতে হলো।
এর মধ্যে আচমকা এক ঘটনা কানে এলো। মেজো চাচার মেয়ে কুসুম শরৎ নামের বেপরোয়া লোকটার প্রতি দূর্বল, তাকে ভয়াবহরকম পছন্দ করে বসে আছে। অথচ শরৎ সেভাবে কখনো তার সাথে কথাও বলে দেখেনি। মেয়েটা কীভাবে ফাঁসল বুঝে পেলাম না। মেজো চাচী এমনিতে যেমন নরম, সন্তানদের বেলায় তেমনই কঠিন। চাচী তো ভুল করেও দায়িত্বহীন, বেকার শরৎ-কে মেনে নিবেন না। কিন্তু মানা, না মানা পরের বিষয়— শরৎ কখনোই তো কুসুমকে সেভাবে লক্ষ্যই করেনি, ভালোবাসবে কখন?
কুসুমের ব্যাপারটা আমাকে প্রথম শরৎ সাহেবই জানায়। সেদিন প্রতিদিনকার মতো অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি। এসেই দেখি উনি কেচিগেটের সামনে পায়চারী করছে, যেখানে সচরাচর আব্বা থাকেন। তখনো বুঝিনি সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। শরৎ আমাকে দেখতেই আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। শরৎ কোনোপ্রকার হম্বিতম্বি না করে স্পষ্ট করে বলেছিল,
–“আপনার বোনকে সাবধানে রাখবেন, তাকে আমার সুবিধার লাগছে না। আমি আবার বড়োলোকী মেয়ে-ছেলেদের বিশেষ ভরসা করতে পারি না।”
–“মানে? কী করেছে কুসুম?”
–“ওহ, নাম বুঝি কুসুম? যাই হোক! সে আজকাল ঘনঘন আমার ঘরের কলিংবেল চাপছে। প্রত্যেকবার তার বিভিন্ন বাহানা। একবার খাবার দিতে আসে, একবার নিজে আমার শুকনো কাপড় ছাদ থেকে এনে দেয়। এই সমস্যা, সেই সমস্যা, এটা ওটা। বলতে গেলে আমি চরম বিরক্ত।”
শরৎ স্পষ্ট কথা বলার মানুষ শুরু থেকেই। অথচ সে কুসুমের ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলল না, যা বলল আকার-ইঙ্গিতে। যেন তার এ বিষয়ে বলতে আকাশচুম্বী অস্বস্তি। সে মেয়েলি ব্যাপার স্যাপার এড়িয়ে চলে, এমনকি মেয়েদেরকেও। তার জন্যে মেয়ে মানুষ নিছক ঝামেলা বই কিছু লাগে না। সে মেয়ে নামক আমার সাথেও যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে। এই লাগামহীন পুরুষের যেন সবথেকে বড়ো অস্বস্তি মেয়ে মানুষ। এবার কুসুমের বেলাতেও তার চোখে আমি স্পষ্ট বিব্রতবোধ, অস্বস্তি দেখতে পাই।
আমি শরৎ সাহেবের কথা শুনে সরাসরি কুসুমের সাথে দেখা করে এ সম্পর্কে কথা বললাম। সে স্বীকার করল, তার মনের কথা সব আমাকে ঝেড়ে দিল। সে বেপরোয়া, এলোমেলো পুরুষটাকে পছন্দ করে; তাকে অন্য চোখে দেখে। আমি বোঝালাম তাকে, সবকিছু আবেগ দিয়ে ভাবলে হয় না। যেটা কুসুমের জন্য ভালোবাসার, শরতের জন্য ঠিক ততটাই অস্বস্তির। যদি দুই পাক্ষিক টান থাকত, অনুভূতি একরকম হতো তবে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। আমি এটাও বুঝি, মানুষের হাতে মনের নিয়ন্ত্রণ নেই। গর্ধব মনটা কখন, কাকে মন দিয়ে বসে তা বোঝা দায়।
বিপত্তি ঘটল তখনই যখন কুসুমের কথাগুলো মেজো চাচী শুনে নিলেন। তিনি হাত তুলতে গেলে আমি তাকে থামালাম। কুসুম মেয়েটা বড্ড নাজুক, নরম। সবসময় বাবা-মায়ের প্রবল ভালোবাসা পেয়ে আসা মেয়ে হঠাৎই এমন কিছুর ভার যেন সইতে পারল না, হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে সে ভয়ে। মেজো চাচী কুসুমকে কিচ্ছু বললেন না, সঙ্গে সঙ্গে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
মেজো চাচী ভেতরের খবর কাউকে জানতে দিলেন না। এমনকি চাচাকেও না। কিন্তু আচমকাই তিনি কুসুমের জন্য ছেলে খোঁজা শুরু করে দিলেন। অথচ চাচীর কুসুমের জন্য দূর-দূরান্তেও বিয়ের চিন্তা ছিল না। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাত্র পেলেন। পাত্র সরকারী চাকরিজীবি। একপ্রকার তাড়াহুড়োর মধ্যে বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গেল।
আজ কুসুমের গায়ে হলুদ। আমার অফিস থেকে ফিরেই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে। মেজো চাচীর জোরাজুরিতে একটা হলুদ সুতির শাড়ি পরেছি। হলুদের অনুষ্ঠান উঠোনে করা হচ্ছে। যখন কুসুমকে স্টেজে গায়ে হলুদ দেওয়া হচ্ছে তখন দেখি স্টেজ থেকে দূরে একপাশে বসে শরৎ সাহেব খিঁচুড়ি গিলছে। আমার ভীষণ রাগ লাগল। যার জন্য এতকিছু সে এখানে আরাম করে খাচ্ছে, কী উদ্ভট কাণ্ড। আমি এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে। আমাকে দেখতেই সে প্রায় খালি হয়ে আসা প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“খিঁচুড়িটা দারুণ হয়েছে। আরেকটু এনে দিন তো। টাকা দিয়েই যেহেতু বিয়ে খেতে হবে, ভরপেট খেয়েই নেই তবে। টাকা উসুল করতে হবে তো।”
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—