ভালবাসা বাকি আছে পর্ব-২০+২১

0
444

#ভালবাসা_বাকি_আছে – ২০
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
(কপি করা নিষেধ)
কথা বলতে বলতেই বুশরাকে পাহাড়চূড়ার কিনারায় নিয়ে আসলো রায়হান। তারপর আলতো করে চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে নিল।

“এইটুকুনই? ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবা…”, বলতে বলতে চোখ খুললো বুশরা।

মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। মেঘের ফেনিল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো অবাক বিষ্ময়ে।

মিনিটখানেক পরে বললো, “আল্লাহ!!! এত সুন্দর কেন!!! আমি তো মরেই যাবো।“

বুশরার অভিব্যাক্তিতে হাসছে রায়হান। আর ঘোর কাটতেই আচমকা পেছন ফিরে রায়হানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুশরা।

“সত্যি সত্যি পা হড়কে পড়ে যাবে কিন্তু…“, বলতে বলতেই তাল সামলালো রায়হান।

“পড়ে যেতে দেবে?”, চোখে চোখ রেখে প্রশ্নটা করলো বুশরা।

পাহাড়চূড়ার একপাশে একটা ছোট্ট মন্দির আছে। শেষ আধাঘন্টা যে খাড়া সিড়িটা বেয়ে উঠে এসেছে ওরা, সেটা মূলত ভক্তদের আসার সুবিধার্থেই। নাহলে এপর্যন্ত আসা বেশ বিপদজনকই হত। দৃষ্টিসীমায় দিগন্তরেখা পর্যন্ত যতখানি মেঘের সমুদ্র দৃশ্যমান তাতে সাজেকভ্যালি আর ফুরোমোনের চূড়ার মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে পড় পার্থক্য জনমানবহীনতা। আর তাতেই বোধহয় এই আড়াই তিনঘন্টা ট্রেকিংয়ের সার্থকতা।

*****

ওরা এপর্যন্ত আসতে মানুষের দেখা পেয়েছিল হাতে গোনা দু চার পাচজন। এই মুহুর্তে আসেপাশে কোন মানুষই নাই। এমনকি মন্দিরেও কোন পুজারী দেখা যাচ্ছে না। বরং কান পাতলে নানান রকম পাখপাখালি, ঝি ঝি পোকার ডাক, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী তক্ষকের টক্ক টক্ক ডাক শোনা যাচ্ছে।

অনেকটা সময় ঠায় বসে রইলো ওরা। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখলো সামনের মেঘপুঞ্জ।

“আচ্ছা তুমি আমাকে এভাবে এতদূর নিয়ে আসলে কিভাবে? মানে ঘুমের ওষুধটা মিশিয়েছো কিসে? ওভারডোজ হইয়ে যেত যদি?”

মিটিমিটি হেসে রায়হান প্রশ্ন করল, ”তুমি কি হাতুড়ে ডাক্তার? আর কিসে আর কিভাবে মিশিয়েছি সেটা নিজেই অনুমান করো!”

“সেদিন রাতে তুমি বাড়িতে এসেছ কখন সেটাই তো আমি জানিনা। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হুট করে।“

“লাস্ট কবে হুট করে ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

একটু ভেবে বুশরা বলল, “কিন্তু রুকুও তো বাসায় ছিল না যে তোমার চামচামি করবে!“

উত্তর দিলনা রায়হান। বুশরা নিজেই বলতে শুরু করল, “রাতে আম্মা একা খেতে ইচ্ছা করছেনা দেখে আমাকে খাওয়ার জন্য জোর করল। খাওয়ার পর …। আম্মা? হতেই পারেনা…!“

রায়হান চুপ করে তাকিয়ে আছে বুশরার দিকে। ঠোট যেন কেউ অদৃশ্য স্কচটেপ দিয়ে আটকে রেখেছে। অথচ ওর চোখে হাসি হাসি ভাব। পৃথিবীতে খুব কম মানুষের চোখ হাসে। শুদ্ধ নির্মল সে হাসি।

*******

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রওনা না দিলে বাড়ি গিয়ে সব গুছিয়ে ঢাকার পথে ছুটতে হবে। বুশরার ফ্লাইট রাত দুইটায়। রুকু আর মা মিলে অবশ্য সব গুছিয়েই রেখেছে। তবু রায়হান আর দেরি করতে চাইছে না। লম্বা ফ্লাইটের আগে মেয়েটার একটু রেস্ট হলে ভালো হত।

আসার সময় যে পথে এসেছে ওদিকে আর গেল না ওরা। পাশের পাহাড়ে আর্মি ক্যাম্প আর হেলিপ্যাড। মাঝের সরু পথটুকু আসার সময় শক্ত করে বুশরার হাত ধরে রাখল রায়হান। ওপাশে গিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসল দুজনে। ফেরার আগে প্রকৃতিতে ডুবলো আরো একবার। একা দুজন তরুন তরুনী দেখে একজন আর্মি এসে টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করল। ব্যাগের উপরের পকেটেই কাবিনের ফটোকপি রাখা ছিল এ ধরনের ঝামেলা এড়াতে। তাই খুব একটা সমস্যা হল না।

আসার সময় রায়হান আর বুশরা যে পথে এসেছিল তাতে অনেক পাহাড় পেরিয়া আসার প্রচুর সময় লাগলেও সেই দীর্ঘ সিড়ির গোড়া পর্যন্ত ইটের রাস্তা ছিল। সেই তুলনায় ফেরার পথটা বেশ এডভেঞ্চারাস। সময় খুব একটা বেশি লাগবে না বলে ধীরে সুস্থে এগোলো ওরা। পুরো সময়টাতে মানুষটা বুশরার হাত ছাড়লনা বললেই চলে।

*******

ফোনে নেটওয়ার্ক আসতেই কাঙ্খিত ফোনটা পেল রায়হান। পাহাড়গুলো শেষ হয়েছে মেইন রাস্তার পাশে। ওদের গাড়িটা অপেক্ষা করছে রাস্তার একপাশে। খুব একটা সময় লাগলো না গাড়ির কাছে পৌঁছাতে। যে ছেলেটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল সে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিল।

যাত্রা শুরু হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। এলোমেলো বাতাসে বুশরার চুল উড়ছে। একটা পাঞ্চক্লিপ দিয়ে চুলগুলো আটকে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যে মজে গেল। তবে তা সাময়িক। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই ঢুলতে শুরু করলো। ব্যাপারটা রায়হান খেয়াল করলেও কিছু বলল না।

চট্টগ্রাম হাইওয়েতে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যাত্রাবিরতি দিয়ে খাওয়াদাওয়া করলো দুজনে। এবার আর পাশের সিটে বুশরাকে বসতে দিল না রায়হান। পেছনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বলল,

“হাত পা ছড়িয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। বাড়ি পৌঁছে আর সময় পাবে না।“

বুশরার, “ঘুম পায়নি তো”, বলায় কাজ হলো না। অগত্যা বাধ্য মেয়ের মত পেছনের সিটে গিয়ে বসল।

স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে রায়হান লুকিং গ্লাসের মধ্যে দিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটু আগে কি বললাম?”

বুশরা না শোনার ভান করল। তবে কিছুক্ষন পর বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘাড় বাকা হয়ে হেলে পড়ছে। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ ঘুমালে নির্ঘাত ঘাড়ব্যাথা করবে। রাগ করতে গিয়েও বুশরার বাচ্চামো চেহারা দেখে হেসে ফেলল রায়হান। ফাঁকা রাস্তা দেখে ধীরে সুস্থে ব্রেক কষলো।

গাড়ি থেকে নেমে পেছনে গিয়ে সাবধানে বুশরাকে শুইয়ে দিল সন্তর্পণে। মাথার নিচে একটা কুশন দিয়ে দিল। পাঞ্চক্লিপ খুলে গেছে। গোলগাল মুখটার উপর একগুচ্ছ চুল হুটোপুটি করছে। চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আনাড়ি হাতে চুলগুলো পাঞ্চক্লিপ দিয়ে আটকে দিল। তারপর আর দেরি করলো না। পেছন ফিরলে দেখতে পেত ঘুমঘুম চোখে বুশরা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

******

ওরা বাড়ি পৌছালো বিকালে। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে একটা লম্বা গোসল দিল বুশরা। রুকু আর ওর মা মিলে মোটামুটি সব গুছিয়েই রেখেছেন। হুট করে আসার প্রায় খালিহাতেই এসেছিল বুশরা। অথচ এখন ঢাউস দুটো লাগেজ বুশরার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে।

“এত কি রুকু?”

“আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেন আফা।”, ভ্রু কুঁচকে বলল রুকু।

“আম্মা..”

“অদরকারী কিছুই দেইনাই।”

বুশরা হেসে বলল, “আচারের বয়ামও তো তোমার দরকারী জিনিস আম্মা।”

“দরকারী জিনিস না? ঠিকই তো বয়াম চাইটা পুইটা শেষ করছো কয় মাসেই?”

“এহহ… মোটেই না। কে বলছে তোমাকে?”

“ভিডিও কলে দেখছি। তাও আরো একমাস আগে, তলানিতে কয়টা লাইগা ছিল।”

ধরা পড়ে গিয়ে মাথা চুলকালো বুশরা, “না খাইলে তো ছাতা পড়ে যাইতো। এত কষ্ট করে বানাইছো।”

রুকু হাসছে। হাসছে শিউলি বেগমও। রায়হান গোসল করে এসে দেখে ওর বউয়ের কাঁচুমাঁচু করা চেহারা সামনে দাঁড়িয়ে মা আর বোন হাসাহাসি করছে। আহারে বেচারা মেয়েটা। না জানি আসতে না আসতেই কি করে ধরাটা খেয়েছে।

বোনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে রায়হান বলল, “কি নিয়ে এত হাসাহাসি? আমাকেও একটু বল। আমিও হাসবো।”

রায়হানের দিকে তাকিয়ে চোখ কটমট করলো বুশরা। তাই দেখে ওরা আরেকচোট হাসলো।

তারপর সিরিয়াস মুখ করে রায়হান বলল, “আচ্ছা হাসাহাসি শেষ। রেডি তুমি? রওনা দিতে হবে আমাদের।”

কিছু মনে হতেই ছুটলেন শিউলি বেগম।

এদিকে বুশরা ভেংচি কেটে বলল, “আমি তো রেডি। আপনি কি এভাবেই যাবেন? চলেন যাই।”

“যাও ভাইয়া, লুংগি গেঞ্জিতে কিন্তু বেশ স্মার্ট লাগছে।”, মিটিমিটি হাসছে রুকু।

ভেজা চুলে আঙ্গুল চালিয়ে রায়হান বলল, “আমার তো যেতে সমস্যা না। কিন্তু এয়ারপোর্টে এত স্মার্ট জামাই নিয়ে যেতে তোর বান্ধবী লজ্জা পাবে না তো?”

“জি না। আমি লজ্জা পাবো না। তবে আপনি ভাইরাল হয়ে যাবেন তো এমপি সাহেব।”

টক মিষ্টি তর্কের সময় নেই একদম।

রায়হান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “রুকু দেখ তো ড্রাইভার চাচা আসছে কি না? লাগেজগুলো গাড়িতে ঠিকঠাক উঠালো কি না দেখ। ”

রুকু চলে গেল। ঘরে শুধু রায়হান আর বুশরা। আর একগুচ্ছ নিরবতা। আগেরবার যখন বুশরা চলে যাচ্ছিল তখন কি এতটা বিষাদ ভর করেছিলো বাতাসে? এতটা টান পড়ছিল কি হৃদয় নাম নাটাইতে?

এত টান। এত মায়া। নির্ঘাৎ এই মেয়ে মায়াকন্যা। জাদু জানে। বিড়বিড় করে বলল রায়হান। তারপর দুহাত বাড়াতেই চাপ অনুভব করলো বুকের উপর। মায়াকন্যার চোখের কোলে বিন্দু বিন্দু স্ফটিক। থামানোর সাধ্য নাই রায়হানের। না সাধ্য আছে নিজের চোখে জমা বিষাদবাষ্প উগরে দিয়ে ভারমুক্ত হওয়ার। আহা পুরুষজন্ম।

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “কোর্স শেষ হওয়ার আগে ভুলেও আর এসোনা। পরেরবার আসলে কিছুতেই যেতে দিবো না কিন্তু।”

বুশরা কি শুনলো আর কি বুঝলো কে জানে। তবে রায়হানের বাহুডোরে থমকে থমকে কেঁপে উঠছে হালকা শরীরটা।

দুর্যোগমুখর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তৎপর রায়হান বলল, “গাড়িতে গিয়ে বসো। সবার সাথে কান্নাকাটি পর্ব শেষ হওয়ার আগেই আমি রেডি হয়ে আসতেছি।”

একথা শুনে রণমুর্তি ধারণ করলো বুশরা। বাকিটা সহজেই অনুমেয়।

******

কান্নাকাটি চলল কয়েক দফা। দীর্ঘ ট্রেকিংয়ের পরপরই অনেকটা পথ ড্রাইভিং করে আসার ক্লান্ত রায়হান। তাই সাথে নিয়েছে ড্রাইভারকে। গাড়ির সামনের সিট ছাড়া বসে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না রায়হান। তবে স্ত্রীকে একা বসিয়ে সামনে বসতেও মন সায় দিল না। তাও আবার যে স্ত্রীকে কিনা সাথে পাবে বড়জোর কয়েক ঘন্টা।

বুশরা একটু পরপর চোখ মুছছে, নাক টানছে থেমে থেমে। দীর্ঘ কান্নাকাটিতে নাক বন্ধ হয়ে গেছে বুশরা। একটু পর মাথাব্যথা শুরু হবে নির্ঘাত। কাজেই কান্নাকাটি পর্ব থামানো দরকার। এদিকে ক্লান্তিতে রায়হানের চোখ ভেঙেচুরে আসছে ঘুম। সিটের উপর পা দুটা তুলে ওইটুকুন যায়গার মধ্যেই কাত হয়ে বুশরার কোলে মাথা রাখলো রায়হান।

“চুলগুলো টেনে দাও তো। ঘুম আসছে।”

চুপচাপ তাই করল বুশরা। তার আগে পাশের কুশনটা টেনে নিয়ে মাথার নিচে গুজে দিল যাতে একটু আরাম করে ঘুমাতে পারে মানুষটা। নাক টানাটানি কান্নাকাটি বন্ধ হল ঘুমের সুবিধার্থে।

****

এয়ারপোর্টে ঢোকার পরের ঘটনাগুলো ঘটল আগেরবারের মতই। আরেকদফা কান্নাকাটি শেষে বিদায় নিল বুশরা। মাত্র আঠারো ঘন্টার ব্যবধানে দুজনের শরীরী দুরত্ব শুন্য থেকে পাঁচ হাজার মাইলের কোঠায় গিয়ে ঠেকলো আবার। একজোড়া চাতকের তৃষ্ণার্ত জীবন শুরু হলো আরো একবার।

#ডাক্তার_মিস – সিকুয়েল
#ভালবাসা_বাকি,

#ভালবাসা_বাকি_আছে – ২১
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
(কপি করা নিষেধ) Rehana
জেটল্যাগ কাটিয়ে ওঠার আগেই ক্লাস, ল্যব, এসাইনমেন্ট নিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা বুশরার। রায়হানও ব্যাস্ত নতুন জীবনে। একদিক থেকে ভালই হয়েছে। জীবনসঙ্গীর অতিরিক্ত ব্যস্ততা মানুষকে যে একাকীত্বের ছোবল দেয় সেটা এখনো অনুভব করতে পারছে না দুজনের কেউই। যোগাযোগের পুরোদস্তুর মাধ্যম টেক্সট আর ইমেইল। ফোনকলে কথা হয় কালেভদ্রে। তাও দুয়েক মিনিট।

এত ব্যস্ততার মধ্যে একটা লাগেজ গত এক সপ্তাহেও খোলার সময় হয়নি। আজ ছুটির দিন হওয়ায় সকাল সকাল লাগেজ টেনে নিয়ে বসেছে বুশরা। কত পদের জিনিসপত্র যে বের হচ্ছে লাগেজ থেকে, হতবাক বুশরা।

প্রথমবার অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই এত বেশি ছিল যে লাগেজের ওজন নিয়ে টেনশন ছিল। তাই মনের খায়েশ মেটাতে পারেননি শিউলি বেগম। এবার সুযোগ পেয়ে বোধহয় সেটা সুদে আসলে উশুল করলেন। হলুদ, মরিচ, জিরা, গরম মশলা থেকে শুরু করে নাম না জানা যত ধরনের মশলা সম্ভব, কোন কিছুর গুড়া ই বাদ রাখেননি তিনি। তাই দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারে না বুশরা।

রাঙ্গামাটির পাহাড়ী আদিবাসি পল্লি থেকে কয়েকটা শাল কিনেছিল বুশরা। শিউলি বেগম, রুকু আর দুইতিনটা জা এর জন্য। আরেকটা নিয়েছিল তানিয়া আপুর জন্য। তাছাড়া তানিয়া আপুর প্রিয় লেখকের নতুন প্রকাশিত বই এনেছে দুটো। ভাগ্যিস শেষ মুহুর্তের তাড়াহুড়ায় এগুলো ছাড়া পড়ে যায়নি। প্যাকেটটা হাতে নিয়েই তানিয়াকে ফোন করল বুশরা।

“আপু ফ্রি আছো?”

“আমি তো ফ্রি, তুই কোথায় ডুব মারছিস বল তো। গত সপ্তাহে কয়েকবার ফোন করলাম। আনরিচেবল।“

“হঠাৎ করে দেশে গেছিলাম আপু।“

“কি খারাপ। একটা বার বলবি না? আম্মা একটা পার্সেল পাঠাতো।“

“সরি গো আপু। লাস্ট মোমেন্টের প্ল্যান। বোঝই তো।“

“আচ্ছা সমস্যা নাই। এমনিও যেই কয়দিনের জন্য গেছিস তাতে পার্সেল যায়গামত পৌঁছাতও না।“

“হু আসলেই আপু। এর মধ্যে একদিন ভোট ছিল। তারপর আবার রাঙামাটি গেছিলাম ঘুরতে।“

“ও হো। ভালই হানিমুন সেরে আসলি তো তাহলে।“, দুষ্টুমি করে বললেন তানিয়া আপু।

প্রসঙ্গ পাল্টাতে বুশরা বলল, “তুমি কি বাসায় আছো? আসবো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। চলে আয়। খিচুড়ি রান্না করতেছি।“

আর দেরি করল না বুশরা। একটা শপিং ব্যাগে শাল, বই আর দুইটা আচারের বয়াম নিয়ে তানিয়ার বাসায় রওনা দিল।

পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। কলিং বেলে দুইবার চাপ দিতেই দরজা খুলল তানিয়া।

বুশরাকে দেখেই তার প্রথম কথাটা হল, “এক সপ্তাহে পুরা চেহারাই পালটে গেছে তোর বুশরা। মাশাআল্লাহ আরো মিষ্টি দেখাচ্ছে। ঘটনা কি?”

এই প্রশ্নটা উত্তরের দাবি রাখে না। তানিয়ার কথায় শুধু মিষ্টি করে হাসল বুশরা।

শিউলি বেগমের আচারের সাথে তানিয়াপুর খিচুড়ি দিয়ে জম্পেশ খানাদানা হলো।

খেতে খেতে তানিয়া আপু বলল, “আন্টির আচার, মাশাআল্লাহ, এত্ত মজা হয়। শিখতে পারিস না?“

“শিখলেই কি এখানে বানানোর জিনিসপাতি পাওয়া যাবে?”, আক্ষেপ করে বলল বুশরা, “যেকয়দিন বয়াম ফাঁকা না হয় খিচুড়ি খেয়ে শান্তি।“

এরপরই বোমটা ফাটালেন তানিয়াপু, “তুই নাই আর এদিকে তো কাহিনি
হয়ে গেছে।“

“কি আপু?”

“ওই যে ওই বাঙালি ছেলেটা, ওকে তো ডিপোর্ট করছে।“

বাঙালি শুনে কৌতুহলী হয়ে উঠল বুশরা, “কোন ছেলেটা?”

“তোর ফ্রেন্ড না কি জানি। ওই যে মাথা ঘুরে পড়লি যেদিন, সেদিনের ছেলেটা, আরশ না কি জানি নাম।“

“আরে না আমার ফ্রেন্ড না আপু, যাস্ট ক্লাসমেট। বাঙালি দেখে টুকটাক কথা হইছে।“

“যাই হোক ছেলেটা ডেঞ্জারাস।“

“তা তো বোঝাই যায়?”

“তাহলে মিশতেন কেন ম্যাডাম? ওইদিন সে যে কাহিনী করছিল তাতে রায়হান ভাই না হয়ে অন্য কেউ হলে তোমার খবর ছিল বাছাধনো।”

“হু। তা কি করছে এই পোলা?”

“বিশাল কাহিনী। এক ইন্ডিয়ান মেয়ে ডিপার্টমেন্টে কমপ্লেইন করছে যে এই ছেলে তারে ফিজিক্যালি হ্যারাস করছে অর সামথিং। পুলিশ কেইসও হইছে। সম্ভবত লকআপেও ছিল। কি কি প্রুফ পাইছে জানি, পরে স্কলারশিপ, ভিসা সব ক্যান্সেল করে ব্যাটারে দেশে পাঠায়ে দিছে। “

ছেলেটা সুবিধার না বুঝেছিল বুশরা। রায়হানও সাবধান করেছিল। তবে কোন মেয়েকে ফিজিক্যালি হ্যারাস করে এই লেভেলের ধরা খাওয়ার মত বলদও মনে হয়নি।

একথা তানিয়া আপুকে বলতেই আপু বলল, “তা আর বলতে? সম্ভবত মেয়েটার সাথে লিভ ইন রিলেশনে ছিল ছেলেটা। চিট করতে গিয়ে ধরা খাইছে। পরে মেয়েও কম না। আচ্ছামত ফাঁসায়ে দিছে। একেই বলে যেমন বুনো ওল, তেমন বাঘা তেতুল।“

খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষে তানিয়ার হাতে শাল আর বইয়ের প্যাকেটটা তুলে দিল বুশরা। প্যাকেট খুলে খুশিতে কেঁদে ফেলল তানিয়া।

“তুই এত্ত ভালো কেন বুশরা। সবার খেয়াল থাকে তোর। আমার প্রিয় রাইটারের নামও মনে আছে তোর?“

“এই বিদেশ বিভূঁইয়ে তুমি তো আমার একমাত্র বোন আপু, তোমার আদরের বিনিময়ে এগুলা কিছুই না।“

দুপুরেও বুশরাকে না খাইয়ে ছাড়লো না তানিয়া। এর মধ্যে রায়হান ফোন করেছিল একবার। বুশরা তানিয়ার সাথে রান্নায় সাহায্য করছিল দেখে খেয়াল করেনি। পরে আবার যখন কলব্যাক করল ওপাশ থেকে যান্ত্রিক নারীকন্ঠের বিরক্তিকর বুলি।

এভাবেই কাটছে দিন। মাসদুয়েক কেটে গেছে ইতোমধ্যে। রায়হানের সাথে ঠিকমত কথা না হলেও শিউলি বেগমের সাথে নিয়মিতই কথা হয়। রুকু একটু ঝামেলায় আছে আজকাল। কি হয়েছে বলতে চায়না। তবে অস্থিরতাটা ঠিকই টের পাওয়া যায়।

গতকার রুকুকে চেপে ধরেছিল বুশরা। তাতে যা কিছুটা জানতে পেরেছে তাতে নিজেরই অস্থির লাগছে ওর। রাতে ভালো একটা ঘুম হয়নি। সকাল সকাল ক্লাস আছে দেখে চোখদুটো প্রায় টেনে খুলে বিছানার একপাশে পা ঝুলিয়ে বসল বুশরা।

ফোনে সারাদিনের রুটিন চেক করে উঠে দাঁড়ালো। আর তখনই ঘটল বিপত্তি। নির্ঘুম রাতের সাইড ইফেক্ট হিসেবে বুশরার সামনে দুলে উঠলো পুরো রুম, আসবাবপত্র, সবকিছু। কোন মতে বিছানার একপাশের স্ট্যান্ড ধরে তাল সামলালো ও। তবে তা মুহুর্তের জন্যই। চোখের পাতায় ঝাপসা পর্দা বুশরাকে ঠেলে দিল নিকষ কালো অন্ধকারে। একাকী বাসায় এই অনাহুত পরিস্থিতির কথা জানলো না কেউ।

চলবে…