#ভালবাসা_বাকি_আছে – ২২
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
(কপি করা নিষেধ)
রুকুর সাথে আরমান বিয়ে বিষয়ে ঝামেলা চলছে।
ও আচ্ছা আরমানের পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি। আরমান রুকুর হবু স্বামী। পৈত্রিক বাড়ি পাশের গ্রামেই। পেশায় ডাক্তার। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, ভাল বংশ, পেশা, সব মিলিয়ে “এলিজেবল ব্যাচেলর” যাকে বলে আর কি।
পারিবারিকভাবেই ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল প্রায় বছরখানেক আগে। তারপর ধীরে ধীরে আলাপ, পরিচয়, ভাললাগা, কে জানে কিছুটা হয়ত ভালবাসাও। সবকিছু ভালই চলছিল। আরমানের এফসিপিএস শেষ করেই বিয়ে করার কথা। ততদিনে বুশরাও দেশে ফিরে আসবে।
কিন্তু হঠাৎই আরমানের দাদী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওদের বাড়ি থেকে চাচ্ছে বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে। বলা যায়না কখন কি হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতে রুস্তম শেখও অমত করতে পারেননি।
কিন্তু মূল সমস্যাটা বাঁধে যখন বিয়ের বিষয়ে মুরুব্বীরা একসাথে আলোচনায় বসেন।
এইতো গত সপ্তাহের কথা।
আরমানের বাড়ি থেকে বয়োজেষ্ঠরা সবাই এসেছে। রুস্তম শেখের ভাইরাও আছেন। রুস্তম শেখ বলেছিলেন এখন কাবিন করে রাখা হোক। পরে বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে।
পাত্রপক্ষ বাড়িতে আসার আগে বাবাকে এই অনুরোধটা অবশ্য রুকু নিজেই করেছিল। প্রিয় বান্ধবী ও ভাবীকে রেখে বিয়ের ধুমধামে মন টানছিল না রুকুর। শিউলি বেগমও মেয়ের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। মুখে না বললেও রায়হানেরও তাই ইচ্ছা।
এদিকে রুস্তম শেখ ভাবলেন ছেলের বাড়ির অবস্থাও তো এই মুহুর্তে ভাল না, একটা মানুষ যায় যায় অবস্থা। কাজেই তারাও হয়ত এটাই পছন্দ করবেন।
কিন্তু এ কথা বলার সাথে সাথেই প্রথম আপত্তিটা আসে আরমানের ফুপার দিক থেকে।
“আমাদের বাড়ির একটা মান সম্মান আছে না বিয়াই? চোরের মতন চুপিচুপি বিয়েশাদী আমাদের বংশে হয়না।“
আরমানের চাচাও সায় দিয়ে বললেন, “তাই তো। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে এত কিপ্টেমি কিসের বিয়াই সাহেব? বিয়ে হওয়া লাগবে এমন যাতে সাত গ্রামের মানুষজন তাকায়ে থাকে।”
পাত্রপক্ষের বাঁকি মুরুব্বিরাও ফোড়ন কাটতে ভুললেন না।
রায়হান একবার বলার চেষ্টা করল, “আপনারা ভুল বুঝছেন। আব্বা তো বলেনাই অনুষ্ঠান করবে না। শুধু বলেছে…”
কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না। আরমানের বাবা বলল, “বিয়ের কথাবার্তায় ছোটদের নাক না গলানোই ভালো বাবা। আরমানকে দেখ। ও কিন্তু আমাদের কথার মাঝখানে ঢুকছে না।“
“আমি …”
লোকমান শেখ ইশারায় ভাতিজাকে চুপ করতে বললেন। রায়হান চুপ করল তবে ভেতরে ভেতরে মনোক্ষুণ্ণ হল।
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আরমানের ফুপা বলল, “তাহলে এবার দেনাপাওনার ব্যাপারটা ঠিক করে নেই কি বলেন?”
প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা করলেন না তিনি। নিজেই বললেন,
“দেনমোহর দশ লক্ষ নিরানব্বই টাকা। ঠিক আছে?“
রুস্তম শেখ বললেন, “এত?”
আরমানের বাবা বললেন, “কি বলেন বিয়াই সাহেব? আমার বড় ছেলের বিয়ে করাইছি আট লক্ষ নিরানব্বই টাকায়। আর আমার এই ছেলে তো ডাক্তার। একটা স্ট্যাটাস আছে না? দুইচার লাখ টাকা মোহর বলতে কি ভালো লাগবে?”
রুস্তম শেখের ব্যাপারটা পছন্দ হল না। তবে সরাসরি বিরোধিতা করাও ভালো দেখায় না।
তাই নমনীয়ভাবেই বললেন, “কিন্তু এটা উশুল করা জামাই কি উশুল করতে পারবে? বেশিদিন তো হয়নি চাকরির।”
“আপনি কোন দুনিয়ায় থাকেন বেয়াই সাহেব? এত টাকা উশুল করবে কোন দুঃখে? হাতের আর কানের গহনা দিবে আরমান, বাঁকি মোহর মিয়াবিবি বুঝে নিবে, এসব কি ভেঙ্গে বলার কথা?”
একেক জন একেক কথা বললেন।
মোহর নিয়ে এনাদের এমন মানষিকতা দেখে বিরক্ত হল রায়হান। তবে ছোট্ট বোনটার শান্তির কথা ভেবে চুপ থাকলো।
এতক্ষণে আরমানের মা আমতা আমতা করে বলল, “বুঝতেই তো পারছেন ছেলের চাকরির বেশিদিন হয় নি। হাতের আর কানের দিতেই তিন সাড়ে তিনভরি মত পড়ে যাবে। তাই গলা টা আপনারা সাজিয়ে দিয়েন।“
রুকুর জন্য বিয়ের সব গহনা বানানোই আছে। তারপরেও বিয়ের আগেই এমন অনুরোধ, নাকি অনুরোধের আড়ালে অন্য কিছু, শ্রুতিকটু ঠেকল রায়হানের কানে। বাবার চেহারায়ও কিছুটা অসোন্তষ খেয়াল করল ও।
অথচ আরমানের ফুপা অবলীলায় বললেন, “এসব কি বলছেন ভাবী? আমাদের বৌমা এমপির একমাত্র বোন বলে কথা। উনারা তো মেয়ে জামাইকে দুহাত ভরে দেবেনই। আপনার কিছুই বলা লাগবে না। ঠিক বলেছি না বেয়াই?”
বরাবরের মতই তিনি রুস্তম শেখ বা লোকমান শেখের উত্তরের আশায় বসে থাকলেন না। বরং কথার তুবড়ি চলতে থাকলো আগের মতই।
রায়হান আবার কিছু বলতে গেলে পাশ থেকে ওর হাত চেপে ধরলেন রুস্তম শেখ।
আরমান ভদ্র বাচ্চার মত চুপ করে বসে আছে।
পর্দার আড়াল থেকে সবই শুনছে রুকু। রাগে দুঃখে দুচোখ ফেটে জল আসছে ওর।
রায়হানের এসব আলোচনা ভাল লাগছে না। বোনের অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তা গ্রস করছে ওকে। আলোচনায় যেহেতু ওর কোন স্থান নেই ছোট মানুষ হয়ে বসে থাকার কোন। মানেই হয়না। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাত্রাপথেই মুখোমুখি হল বোনের অশ্রুশিক্ত চেহারার। মেয়েটা সবকিছুই শুনেছে বুঝে হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে।
“আমি একটা প্রশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দিবি বুড়ি।“
চোখের পানি আড়াল করে মাথা নাড়ল রুকু।
“তুই কি আরমানকে ভালবাসিস?”
রুকু উত্তর দিতে পারল না। বরং কেঁদে উঠল শশব্দে।
বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রায়হান বলল, “আহা … কাঁদে কেন মেয়েটা?”
রুকু আপ্রাণ চেষ্টা করে কান্না থামানোর। রায়হান ব্যথিত স্বরে বলে, “আচ্ছা, আমার উত্তর পেয়ে গেছি। কান্নাকাটি করিস না প্লিজ। হবু কনের চোখে পানি মানায় না।“
অনেক কষ্টে ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে কাটা কাটা শব্দে রুকু বলল, “এই আরমানকে আমি চিনি না ভাইয়া। একদমই না।“
চলবে…