ভালবাসা বাকি আছে পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0
688

#ভালবাসা_বাকি_আছে
লেখনিঃ Hasin Rehana (কপি করা নিষেধ)
(পরিশিষ্ট-১)

রায়হানকে চিঠিটা পাঠানোর পর থেকেই অধীর আগ্রহে দিন গুনছে বুশরা। নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছে না কারন তাহলে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে। অগত্যা চুপচাপ থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে ভেতরে ভেতরে বড় বেশি অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

তার মধ্যে ইদানিং খুব মুড সুইং হচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে রায়হান ওকে যথেষ্ট এটেনশন দিচ্ছে না। ফলাফলস্বরূপ কথায় কথায় চেচামেচি করার বাতিক পেয়েছে বুশরাকে। চেচামেচিগুলো অবশ্য ঝগড়া পর্যন্ত যাচ্ছেনা রায়হানের ধৈর্যের কারনে। সেটাও ভালই বুঝতে পারছে ও। কিন্তু নিজেকে সামলাতেও পারছে না।

আবার এদিকে শরীরটাও খুব ভালো যাচ্ছেনা। প্রানপণ মনকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বুশরা। খাওয়াদাওয়া, ঘুম থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসারও আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মা সন্তান মিলে এক কঠিন লড়াই আসছে সামনে। তাই নিজেকে শক্ত না করে উপায় নেই।

ঘন্টাখানেক আগেও রায়হানের সাথে চ্যাট হয়েছে। ক্যাম্পাস থেকে কখন ফিরবে জিজ্ঞাসা করছিল। চিঠি পেয়ছে এমন কোন আভাস পায়নি। বেশ কয়েকদিন তো হলো। তাহলে কি চিঠি হারিয়ে গেল? আর এই চিঠির আশায় অপেক্ষা করলে হবে না। কিভাবে জানানো যায় যায়? ভিডিও কল? ক্যাম্পাস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় আনমনে এসব ভাবছিল বুশরা।

ভাবতে ভাবতেই বাসার সামনে রাস্তার অপরপাশে সাহেবি পোষাকে চেনা মুখ দেখে থমকে দাঁড়ালো বুশরা। মুড সুইং, ফ্রাসট্রেশন, দুশ্চিন্তা যে এত তাড়াতাড়ি হ্যালুশিনেশন পর্যন্ত গড়াবে বিশ্বাস করে না বুশরা। অবাক বিষ্ময়ে তকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে। সেই চেনা শরীরের আদল, দাড়ানোর ভঙ্গী, বুকের উপর দুহাত বেঁধে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকা। এক পা ও সামনে আগাতে পারছে না বুশরা, স্বপ্নভঙ্গের আশংকায়।

একসময় মানুষটা চলতে শুরু করল। রাস্তা পার হয়ে এসে দাঁড়ালো বুশরার থেকে একহাত দূরে।

“এই তোমার একটু পরে?”

কোন উত্তর না দিয়ে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে প্রিয় মানুষটার বুকে আছড়ে পড়ল আবেগী মেয়েটা। কান্নার দমকে দমকে কেঁপে উঠছে বুশরার শরীর। গর্ভে সন্তান আসার পর থেকেই এই হয়েছে এক জ্বালা। কিছু হলেই নোনাজলেরা বিদ্রোহ শুরু করে।

“আরে আরে, কাঁদছো কেন?”, মৃদু ধমক দিল রায়হান।

“বকা দিতে এসেছো?”, বুশরার কন্ঠে ঝাঁঝ।

“হুম”, বলে মৃদু ঝাঁকুনি দিল রায়হান।

ছলছল চোখে বুক থেকে মুখ তুলে বুশরা প্রশ্ন করল, “কোন প্রোগ্রামে এসেছো?”

“হু।“

“কতদিনের প্রোগ্রাম?”

“দু সপ্তাহ। বাই দ্য ওয়ে, বাসায় নিবা না? নাকি রাস্তায়ই সব কথা শেষ করে বিদায় করে দিবা?”

মেইন দরজার লক খুলতে খুলতে বুশরা প্রশ্ন করল, “প্রোগামে এসেছো, তো সেখানে যাও। এখানে কি?”

“প্রোগ্রামটা যে জুনিয়র শেখের আম্মুর সাথে, ম্যাম।“

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে স্বামীর মুখোপানে চাইলো বুশরা।

“চিঠি পেয়েছো তুমি? একবারও বলো নি? বরং আরো ব্যস্ততা দেখিয়েছো।“

রায়হানের বুকে দুমদাম কিল বসিয়ে আবার কাঁদতে শুরু করলো বুশরা। অভিমান উপচে পড়ছে চোখের কোল বেয়ে। ততক্ষণে ওরা লিভিং রুমে পৌঁছে গেছে। রায়হান বউকে টেনে এনে বিছানায় বসালো।

চোখের পানি মুছে দিয়ে প্রশ্ন করল, “এত কাঁদছ কেন? তুমি তো এত নরম ছিলে না। কষ্ট হলে ঝগড়া করো, বকো, আরো দুচারটা কিল ঘুষি দাও, যা খুশি করো। কাঁদা যাবে না।“

বুশরা নাক টেনে টেনে বলল, “হু। ঝগড়া ই তো করবো। আমি তো ঝগড়ুটে তাই না?”

বুশরার গালে টোকা দিয়ে রায়হান বলল, “তুমি ঝগড়ুটে না। তবে ঝগড়া করার সময় ভীষণ ভীষণ এট্রাকটিভ দেখায়। মনেহয় বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখি।“

বেশিরভাগ স্ত্রী বোধহর স্বামীর কাছে শাড়ী, গয়না, টাকা, পয়সা চায় না। চায় একটু ভালবাসার প্রকাশ। আর সময়ে অসময়ে সেটা না পেলে কেউ হয়ে যায় বাঘিনী, আর কেউ জীবন্মৃত। রায়হানের এইটুকুন কথায় বুশরা শান্ত বেড়ালছানার মত রায়হানের বুকের মধ্যে মাথা গুজলো।

এলোচুলে হাত বুলাতে বুলাতে রায়হান বলল, “কয়দিন দেশে থাকবো না। সব গুছিয়ে আসতে একটু দেরি হল, বউ। আর এজন্যই কয়দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম।“

“বললেই হতো।“

“আমি কি জানতাম যে আমার বউটা এত্ত কাঁদুনে হয়েছে?”

“কিহ?”

“না না। আমি কিছু বলিনি তো।“

আচমকা বুশরার পেটে চুমু খেল রায়হান। মাত্র দুয়েক সেকেন্ডের ঘটনা। অথচ এ কয়দিনের কি যেন নেই, কি যেন নেই অনুভূতিটা মুহুর্তেই লোপ পেল বুশরার।

সামনের কঠিন সময়ের আশংকা উপেক্ষা করে প্রথম বাবা মা হওয়ার বাঁধভাঙ্গা আনন্দ অনুভুতিটা যেন আজ পূর্ণতা পেল একে অপরের উপস্থিতিতে।

ডিনারের সময়ে রায়হান খেয়াল করল, বুশরা খুব আস্তে আস্তে খেল। বমি পাচ্ছে হয়ত। একটু পরপর লেবু শুকছে। তবু খাওয়া ছেড়ে উঠছে না।

“খেতে না পারলে রেখে দাও।“

চোখমুখ শক্ত করে বুশরা বলল, “এসময় বাবুর নিউট্রিশন প্রয়োজন। খেতে হবে ।“, মনে মনে বলল, “আর আগের মত দুর্বল হয়ে রাস্তাঘাটে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া যাবে না তো।“

রায়হানের খুব খারাপ লাগলো। যে মেয়েটা একসময় জোর করে এক লোকমা খেলে বমি করে ফেলতো সে গর্ভের সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য জোর করে খাচ্ছে।

“একা একা খুব কষ্টের সময় পার করতে হবে তোমার সামনে। আমার ভাবলেই খারাপ লাগছে। এত সাবধানতার পরেও…”

রায়হান কি বলতে চাইছে বুঝলো বুশরা। তাই কথা শেষ হওয়ার সময় দিল না। আলতো করে বলল, “সন্তান আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ামত। কত মানুষ সারা জীবন চেয়েও পায় না। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাদের বাবা মা হিসাবে কবুল করেছেন।“

“হাজারবার আলহামদুলিল্লাহ বলেছি বউ। কিন্তু এখানে এসে তোমার কষ্ট দেখে সহ্য হচ্ছেনা।“

“আল্লাহ সহজ করবে। ভরসা রাখো। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?”

রায়হান সম্মতি দিল। বুশরার খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে বিছানায় এসে বসল। রায়হানের খাওয়া তো অনেক আগেই শেষ হয়েছিল। বুশরাকে সংগ দিতে বসে ছিল। তাই সে ও এসে বুশরার পাশে বসল।

“তুমি কি চাও আমি দেশে ফিরি তোমার সাথে?”

“আমি চাইলে তুমি ফিরবে?”

“সন্দেহ আছে?”

“নাহ নেই।“

“তাহলে উত্তর দাও।”

“আমি চাইনা।”

“কেন? তোমার সন্তানের সুস্থতা তোমার প্রায়োরিটি হওয়া উচিত এখন।”

“একটু ভুল বললে। সন্তান আমার একার না। আর তুমি চাইলে আমাকে এই সুসংবাদ থেকে আড়ালে রাখতে পারতে। এক্সট্রিম কোন ডিসিশনও নিতে পারতে।“

“তুমিও একথা বলছো?”

“দেখেছো? আমার এই কথা তোমাকে আরও কেউ বলেছে। তুমি কিন্তু কানে নাও নি।“

“আমার বাচ্চা আমি খুন করতে পারি ভাবলে কি করে?”

“আর আমিও তোমার কাছে চাইতে পারিনা যে তুমি তোমার স্বপ্ন খুন করো। এই যে তুমি বললে, আমার বাচ্চা। আমি জানি তুমি ওকে সেইফ রাখবে।“

“আমি যদি নিজেই যেতে চাই?

“নিয়ে যাবো।“

তারপর বুশরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রায়হান আবার বলল, “সন্তান যেমন আমার, ঠিক তেমনি তোমারও। আর পড়াশুনাটা তোমার। তাই প্রেগনেন্সির সময়টা একা কষ্ট করবা, নাকি সবার আদরে আহ্লাদে বাড়িতে থাকবা সেটা তোমার সিদ্ধান্ত হোক। যে সিদ্ধান্তই নাও আমি তোমার পাশে থাকবো। আর হ্যাঁ, আমি জানি আমার বউ একজন যোদ্ধামানবী। ছোট্ট জীবনে শত ঝড় ঝাপটা একাই সামলে এতদূর এসেছে। আমাদের সন্তানও মায়ের সাথে সাথে যোদ্ধা বাবু হলে আমার কোন আপত্তি নাই।“

“আব্বা আম্মা কি মানবে?”

“স্বামী হিসেবে এটুকু আমার দায়িত্ব।“

“জানিয়েছো? আম্মা তো কিছু বললো না।“

“এখনো জানাই নি। গিয়ে সব সামলে নিব আমি। চিন্তা করো না। এসময় এত চিন্তা করতে নেই। সব চিন্তাদের ইজারা আমাকে দিয়ে শুধু নিজের যত্ন আর পড়াশুনাটা করো। অসুস্থ হলে কিন্তু কপালে শনি আছে তোমার।“

অনেকদিন পর রায়হানের বুকে মুখ গুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমের জগতে ডুব মারলো বুশরা।

সকালে বুশরার ঘুম ভাংলো একটু দেরিতে। চোখ মেলে পাশে রায়হানকে দেখতে পেলো না। আসলেই কি রায়হান এসেছিল? নাকি অসুস্থ মনের কল্পনা? ভাবতে ভাবতে মাথাটা দুহাতে চেপে ধরলো বুশরা। তখনই ঘরের দরজা খুট করে খুলে গেল।

মানুষটা বুশরার পাশে এসে প্রশ্ন করলো, “ঘুম ভেঙ্গেছে তোমার?”

চলবে…

#ভালবাসা_বাকি_আছে (হাসিন রেহেনা)
পরিশিষ্ট-২ (কপি করা নিষেধ)

রায়হান বাড়িতে জানায়নি এখনও সুখবরটা। কারন খবরটা শোনা মাত্রই শিউলি বেগম অস্থির হয়ে যাবেন বুশরা আর অনাগত বংশধরের চিন্তায়। দাদা দাদী হিসেবে উনারা চাইতেই পারেন যে বুশরা এবার তবে দেশে ফিরুক। তাদের দোষ দেওয়া যায়না। পরিস্থিতি জটিল হতে সময় লাগবেনা। আর সেটা সামাল দেওয়ার আগে রায়হানের নিজেরও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন বুশরা আসলেই একা বিদেশ বিভুঁইয়ে সবটা সামলে নিতে পারবে কি না। আবার মেয়েটাকে মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়েছুড়ে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইলে ও মানা করবে না একবারও। কিন্তু রায়হানের নিজেরই মন সায় দিচ্ছেনা।

এদিকে নিজের মনেই সংশয় রেখে বাবা মাকে বুঝানোর চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়নি রায়হানের কাছে। তাই কাজের খাতিরে বিদেশ যাচ্ছি বলে বুশরার কাছে চলে এসেছে রায়হান। এদিকটা সামলে ওদিকের ব্যবস্থা করা যাবে পরে। দু’সপ্তাহ সময়টা যথেষ্ট নয়, তবে এর বেশি সময় করে ওঠা মুশকিল ওর জন্য। আবার ডেলিভারির সময় আসতে হবে। ভাগ্যিস বুশরার সাথে না আসলেও এফ-টু ভিসা করে রেখেছিল রায়হান। নাহলে এত কম সময়ে আসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হতো না।

রায়হান এখানে এসেছে তিনদিন হলো। এই তিনদিনে বুশরাকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়েছে, আবার দিন শেষে নিয়ে এসেছে ও। বাসায় থাকার পুরো সময়টা এক গ্লাস পানিও নিজের হাতে ঢেলে খেতে দেয়নি রায়হান।

বুশরা কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছে, “তুমি কি পাগল? তুমি চলে গেলেই তো…”

তবে প্রতিবারই মুখের কথা মুখেই আটকে রাখার অভিনব কৌশল আবিষ্কার করেছে রায়হান। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছাচার মেনে নিচ্ছে বুশরা। খাওয়াদাওয়া, ঘুম, পড়াশুনা তো আগেই নিয়মের মধ্যে নিয়ে এসেছিল ও। বাকি ছিল মনের উপর নিয়ন্ত্রণ। রায়হান আসার পর বেয়াড়া মন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এখন। সব মিলিয়ে অনেকটাই সুস্থ বুশরা।

সপ্তাহান্তে তানিয়াকে দাওয়াত দিয়েছে ওরা। বুশরা ভেবেছিল আজ অন্তত কিছু রান্না করতে দিবে রায়হান। তবে সে আসায় গুড়েবালি। সবগুলো আইটেম রান্না করে ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত নিয়ে আসা পর্যন্ত সব করলো রায়হান। ও পুরো সময়ে বুশরার এক মাত্র কাজ ছিল কোলের উপর রাখা ফলের বাটি ফাঁকা করা।

খাওয়ার সময় রায়হান তানিয়াকে বলল, ” আপনার কথা অনেক শুনেছি বুশরার কাছে। আপনার জন্যই আমরা একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।”

সৌজন্যের হাসি হেসে তানিয়া বলল, “এই তো আর কিছুদিন, এরপর তো আমি চলে যাবো। মেয়েটাকে একা ফেলে যেতে আমারও খারাপ লাগবে খুব, তা ও এই অবস্থায়।”

“ওহ, আপনার কোর্স শেষ হয়ে যাচ্ছে?”

“হুম। আমি তো এক বছর আগে এসেছি বুশরার।”

রায়হানের মন খারাপ হয়ে গেল। ও ভেবেছিল তানিয়াকে প্রস্তাব করবে বুশরার সাথে এপার্টমেন্ট শেয়ারের জন্য। তানিয়ার সম্পর্কে যতটুকু শুনেছে, ওর মনে হয়েছিল তানিয়া প্রস্তাবটা ফেলে দেবে না। কিন্তু এখন তো সেই উপায় নেই।

“আসলে বুশরাকে এই অবস্থায় একা বেশিদিন রাখতে ভয় পাচ্ছি।”

তানিয়া বুশরার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মনে মনে ভাবলো, “জানা কথা, ডিগ্রী চুলায় যাক। বউকে বগলদাবা করে নিয়ে যেতে এসেছে।”

আর মুখে বললো, “তাহলে কি বুশরাকে নিয়ে ফিরছেন?”
“না। সম্ভব হলে আপনাকে বলতাম ওর সাথে এই সময়টা থাকার জন্য। তা তো সম্ভব না। অন্য কোন উপায় ভাবতে হবে।”

রাত হয়ে যাওয়ার আড্ডা আর বেশি আগালো না। রায়হানের এখন চিন্তা হচ্ছে। এমন সময়ে তানিয়ার কোর্স শেষ হতে পারে ভাবে নি ও। শ্যামবতী বুশরাকে ঠিক কখন কিভাবে ভালোবেসেছিল রায়হান, সেটা বোধহয় উপরওয়ালাই শুধু জানেন। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরে মেয়েটার চেহারার মাধুর্য বেড়েছে বহুগুণ। সেই নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলে ঘোর লাগে রায়হানের।
ঘোররালা কন্ঠে ফিসফিস করে বললো, “অনেক ভালবাসি প্রাণপাখি”। স্বামীর বাহুডোরে ঘুমন্ত বুশরা একটু নড়ে উঠলো। শোনা হল না মানুষটার সহজ স্বীকারোক্তি।

রুকুটাও এই সময় নিজের জীবনেই যে ধাক্কা খেয়েছে তাতে এখনই আইএলটিস পরীক্ষা দেওয়া, প্রফেসর ম্যানেজ করা, স্কলারশিপের চেষ্টা করা এসব ওর জন্য খুব কঠিন হয়ে যাবে। নাহলে বোনটা আসলে শুধু রায়হান কেন, বাড়ির সবাই ই নিশ্চিন্ত হতে পারতো। কিন্তু নিজেরা নিশ্চিন্ত হতে গিয়ে মেয়েটার উপর মানষিক চাপ বাড়াতে চায়না রায়হান। কারো কথা ভেবে নয়, নিজের মত করে গুছিয়ে নিক মেয়েটা।

নির্ঘুম রাত শেষে পরেরদিন বুশরাকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়ে কেনাকাটা করলো রায়হান। ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে বুশরা দেখলো পাগলের কান্ডকারখানা। রুমে সিসি ক্যামেরা ফিট করেছে রায়হান। ইন্টারনেট কানেকশন থাকায় দেশে বসেই বউয়ের উপর নজরদারি করতে পারবে এখন থেকে। কিন্তু বিপদ দেখলে কিইবা করতে পারবে তা নিয়ে নিজেই সন্দিহান। তবু নাই মামার চেয়ে কানামামা তো ভালো বলে নিজেকে সান্তনা দেয় রায়হান। আর রায়হানের পাগলামি দেখে কপাল চাপড়ায় বুশরা।

দুদিন পরে তানিয়া ফোন করে বুশরাকে। হড়বড় করে বলে, “আমার একটা ফ্রেন্ড আছে কাশ্মীরী। ওর ফ্ল্যাটমেটও কাশ্মীরী। ওর কোর্স শেষ হয়ে গেছে অলরেডি। হয়ত সপ্তাহখানেকের মধ্যে মুভ করবে। তুই চাইলে ওই ফ্ল্যাটে উঠতে পারিস। আমি কথা বলতে পারি। আমি ওদের ফ্ল্যাটে গেছি কয়েকবার, মেয়েটা ভালোই।”

বুশরা জানে রায়হান উপর উপর যাই বলুক, ভেতরে ভেতরে অনেক চিন্তা করছে। এসময় একটা ফ্ল্যাটমেট পেলে রায়হানের চিন্তা একটু হলেও কমবে।

“আপু আমি তোমাকে দুই মিনিটের মধ্যে ফোন করে জানাচ্ছি।”

তানিয়া হেসে বলে, “দুই মিনিট না, তুই সময় নিয়ে ভাব, ভাইয়ার সাথে কথা বল। আজকের মধ্যে জানালেই হবে।

” আচ্ছা আপু”, বলে ফোন রাখলো বুশরা।

কথা বলার সময় রায়হান বুশরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে রেখে ছিল। তাই ফোনের ওপারের কোন কথাই কান এড়ায়নি রায়হানের।

বুশরা কিছু বলার আগেই রায়হান বলল, “চলো বিকেলে দেখে আসি। সব দেখে পছন্দ হলে আমি শিফট করিয়ে দিয়ে যাই। পরে একা পারবা না এই অবস্থায়।”

পাঁচমিনিটের মধ্যেই তানিয়াকে কলব্যক করল বুশরা। বিকেলে তিনজন মিলেই গেল ফ্ল্যাট দেখতে। এটাচড ওয়াশরুম বারান্দাসহ ছোটখাটো ছিমছাম একটা রুম ফাঁকা হবে। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল ওদের। কিন্তু সমস্যা হলো মেয়েটা রুম ছেড়ে দেবে এক সপ্তাহ পরে। রায়হানের ফ্লাইট সেদিন রাতেই। অর্ধেক দিনের মধ্যে বাসা বদলানো খুব কঠিন হয়ে যাবে।

তবে কঠিন আর অসম্ভবের মধ্যেও তো কিছুটা পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যটুকুর উপরে ভরসা করেই নতুন বাসায় কথা দিয়ে এল রায়হান। এডভান্সও করে এল।

এরপরের কয়টা দিন গেল ঝড়ের গতিতে। বুশরা যতক্ষন ক্যাম্পাসে থাকে, রায়হান টুকটাক কেনাকাটা করে গুছাতে থাকে। প্রেগন্যান্সি জার্নিতে বুশরার কি কি লাগতে পারে সে নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছে অবশ্য আগে। মায়ের সাথে আলোচনা করতে পারলে সুবিধা হতো। কিন্তু সেটা যেহেতু করতে পারছে না তাই গুগলই ভরসা। আর বুশরা যতক্ষন বাড়িতে থাকে ততক্ষনতো খুনসুটিতেই কেটে যায়। বুশরার পেট এখনো সমানই বলা যায়। ভ্রুণটা বেড়ে উঠছে নিঃশব্দে। অথচ পেটে কান পেতে রায়হান যেভাবে কথা বলে তাতে মনে হবে বাবা আর বাবুর মধ্যে সেই লেভেলের টেলিকম্যুনিকেশন হচ্ছে, শুধু বুশরাই শুনতে পাচ্ছে না কিছু।

অবশেষে এসে গেল ফেরার দিন। নিজের লাগেজপত্র আগেই গুছিয়ে রেখেছিল রায়হান। বুশরার জিনিসপত্র গোছানো শুরু করেছে সকাল থেকে। দুপুর নাগাদ রুম ছেড়ে দিল কাশ্মীরী মেয়েটা। আগে থেকেই ডেলিভারি সার্ভিস বলা ছিল। কয়েক ঘন্টার খাটুনিতে নতুন ঘরটা আগেরটার মতই বসবাসযোগ্য হয়ে গেল প্রায়। পোর্টেবল সিসি ক্যামেরাটা রাখলো স্টাডি টেবিলের উপরে। পুরো ঘরে শেষবারের মত নজর বুলিয়ে বিছানায় বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রায়হান। অনলাইনে খাবার অর্ডার করেছিল, ঝটপট খাওয়াদাওরা সেরে নিল দুজনে। বুশরা এয়ারপোর্টে যেতে চাইলেও রায়হান তাতে আপত্তি জানালো।

“সারাদিন রেস্ট নিতে পারো নি। এখন আবার এতটা পথ যাওয়ার কোন দরকার নাই। রেস্ট নাও।“

“যাই না? আমি তো কিছুই করিনি। একটুও টায়ার্ড না।“

“তোমার কথা কে ভাবছে? বাবু টায়ার্ড।“

রায়হান সিরিয়াস মুখ করতে গিয়েও বুশরার কাঁদো কাঁদো চেহারা দেখে হেসে ফেলল। কপালে চুমু খেয়ে বললো, “আসি। সাবধানে থেকো।“

তারপর বেশ ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো, “আম্মুকে একদম বিরক্ত করবে না বাবাই। আমি কিন্তু রাগ করবো তাহলে।“

#ভালবাসা_বাকি_আছে (হাসিন রেহেনা)

পরিশিষ্ট – শেষ অংশ

অবশেষে আল্লাহর উপর ভরসা করে বুশরাকে রেখে দেশে আসে রায়হান। দু’সপ্তাহ দেশে না থাকায় অনেক কাজ জমে ছিল। সেসব গুছিয়ে নিতে খানিকটা সময় লাগলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বুশরার উপর নজরদারি চালাতে অবশ্য কমতি করলো অবশ্য। তবে কয়েকবার চেষ্টা করেও মা বাবাকে সুখবরটা দেওয়ার সুযোগ পেলো না। শোনামাত্রই অনাগত বংশধর আর বুশরার জন্য চিন্তায় অধীর হয়ে যাবেন তাঁরা। আর তাছাড়া এত বড় একটা বিষয় এতদিন না জানানোতে ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাও চিন্তার বিষয়।

এদিকে সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি এসেছে রুকু। সন্ধ্যায় ও ভাইয়ের ঘরে আসলো চা নিয়ে। আলোচনা করার একজন মানুষ পাওয়া গেল ভেবে রুকুকে দেখে খুশি হলো রায়হান। তবে ও কিছু বলার আগেই রুকু ইতস্তত করে বলল,

“ভাইয়া কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।“

রুকুর চেহারা দেখে রায়হান বুঝলো সিরিয়াস কিছু হবে হয়তোবা। নিজের মনের কথা চেপে বলল, “হ্যাঁ, বল না!”

“বিয়ের ব্যাপারে…”

“ও আচ্ছা এই বিষয়? আমি আসার পরেই আম্মা বলেছে। তুই চিন্তা করিস না। আমি আম্মাকে বলেছি বিয়ে নিয়ে এখন কোন কথা হবে না। তুই যতদিন না চাচ্ছিস কেউ জোর করবে না। প্রমিস!“

রুকুর চেহারার ইতস্তত ভাবটা কাটলো না ভাইয়ের কথা শুনে। রায়হান তা খেয়াল করে ওকে হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে বলল, “কি হয়েছে, বুড়ি?”

“ভাইয়া, আমার এক বন্ধু আছে। নাম মাহমুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স করেছে।“

রায়হান ঠিক বুঝতে পারছে না, রুকু ঠিক কেন ওর বন্ধুর বৃত্তান্ত শোনাচ্ছে। চাকরি বাকরির ব্যবস্থা? নাকি অন্য কিছু? তবে বোনের কথার মাঝে বাগড়া দিল না। এমনিতেই মেয়েটা থেমে থেমে কথা বলছে।

“একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে।“

রায়হান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। রুকু বলল, “বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চায়।“

“আচ্ছা। তুই কি চাস? কি বলেছিস?”

“হ্যাঁ/না কিছু বলিনি। বুঝতে পারছি না ভাইয়া। এজন্যই তো তোমার কাছে আসছি।“

“কেমন বন্ধু। ক্লাসমেট তো না। ফেসবুক?”

“এক্স ক্লাসমেট।“

“কিভাবে? সে না ঢাকা ভার্সিটির?”

“আমি যে ঢাবির বায়োকেমিস্ট্রিতে ভর্তি হইছিলাম ভুলে গেছো?”

“ও হ্যাঁ তুই তো একবছর ঢাবিতে ছিলি। সত্যি মনে ছিল না। মাহমুদও বায়োকেমিস্ট্রি?“

“হু। অন্যরা কেন জানি আমার সাথে মিশতে চাইতো না, মাহমুদের সাথে মোটামুটি একটা বন্ধুত্ব হয়েছিল। মাঝে অবশ্য যোগাযোগ ছিল না। বছরখানেক আগে মেডিক্যালে দেখা, মা কে নিয়ে এসেছিল। তারপর থেকেই টুকটাক কথা চলতে থাকে। ভার্সিটি চেঞ্জ করার পর নাকি আমাকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি।“

টেবিলের উপরে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে চুমুক দিল রুকু। রায়হান আগ্রহ নিয়ে বসে আছে পুরোটা শোনার। মাঝে একবার শিউলি বেগম এসেছিলেন খাওয়ার জন্য ডাকতে। পরে খাবে বলে জোর করে মাকে পাঠিয়ে দিয়েছে রায়হান।

একটু থেমে রুকু নিজেই আবার বলতে শুরু করলো,

“হঠাত করেই কিছুদিন আগে বললো আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম জানো? ও সেদিন হেসে বললো — তুমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলে না কেন তোমাকে খুঁজেছি? আমি তোমাকে পছন্দ করতাম, একচুয়ালি এখনো করি। তাই খুঁজেছি। যখন খুঁজে পেলাম তুমি তখন অন্য কারো বাগদত্তা। তাই আর বলা হয়নি। কিন্তু দেখো, উপরওয়ালা আবার আমাকে একটা সুযোগ দিয়েছে। আমি সুযোগটা কাজে লাগাতে চাই। প্লিজ, না ভেবেই না করে দিও না। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসোনা, ভালো বন্ধু ভাবো। জীবনসঙ্গীও কিন্তু বন্ধু হয়। একটু সুযোগ দিয়েই দেখো।“

“তারপর? তুই কি বললি?”

“আমি তখন মানা করে দিয়েছিলাম। তারপর আর ও এই বিষয়ে কোন কথা বলেনি। আগে যেমন বন্ধুর মত কথা বলেছে, সাপোর্ট দিয়েছে, তেমনই থেকেছে। কিন্তু কাল ও বলল, বাইরে চলে যাচ্ছে, চার পাঁচ বছরের জন্য, পিএইচডি করতে। তারপর থেকেই খারাপ লাগছে খুব। আমার তো অনেক বন্ধু নেই ভাইয়া। আরমানের সাথের ইনসিডেন্টটার পর মাহমুদ আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে।“

“তুই কি চাস? ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। আরমানের জন্য এখনো ফিলিংস বাকি থাকলে, আমি বলব, আরো সময় নে। না থাকলে আগাতে পারিস।”

“ভাইয়া আরমান চ্যাপ্টার ক্লোজড। মাহমুদকে নিয়ে আমি আসলে কনফিউজড। আমরা আসলেই ভালো বন্ধু। মানুষ হিসেবেও ছেলেটা ভালো। কিন্তু ওর পরিবারও যে আরমানের পরিবারের মত না কে জানে বলো।“

রায়হান একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা আমি খোঁজ নিচ্ছি। দুইচারটা দিন সময় দে আমাকে।“

“আচ্ছা ভাইয়া।“

চারদিন সময় চাইলেও রুকুর সাথে কথা বলার দুই দিনের মাঝেই মাহমুদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাড়ির খবর বের করে ফেলল রায়হান। একবার যে ভুল হয়েছে তা বারবার করার মানুষ না ও। অনেক বিচার বিবেচনার পরে রায়হানের মনে হলো ছেলেটা আর ওর পরিবার আসলেই খুব ভালো। বাবা মা দুজনেই স্কুল শিক্ষক। প্রভাব, প্রতিপত্তি, টাকা পয়সা অতটা নেই তবে মানুষ হিসেবে এলাকায় তাদের সুনাম আছে। মাহমুদের সাথেও দেখা করল রায়হান। খুব সাধারণ আর অমায়িক এই ছেলেটিকে নিজের বোনজামাই হিসেবে খুব পছন্দ হল ওর।

পরের শুক্রবার দুপুরে মাহমুদ, ওর মা-বাবা, দুই চাচা-চাচী আর খালা-খালু সহ আসলো রুকুকে দেখতে।

মাহমুদের বাবা ই বললেন, “আপনারা তো জানেন যে আমার ছেলেটা পিএইচডি করতে চলে যাচ্ছে কিছুদিন পর। তো আমরা চাচ্ছিলাম কাবিনটা করে ফেলতে, যাতে বউসহ ভিসার জন্য আবেদন করতে পারে। হাতে তো সময় নাই বেশি একটা।“

আসলে উনারা বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। সকলের সম্মতিতে খুব অনাড়ম্বরভাবে সেদিন বাদ আসর কাবিন হয়ে গেলে রুকু আর মাহমুদের। বিয়ে পড়ানোর আগেই দেনমোহরের তিন লক্ষ টাকাটা চেক লিখে দিল মাহমুদ। তবে অনুরোধ করলো যাতে ভিসা ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে টাকাটা না তোলা হয় ব্যংক থেকে।

নিজের অনুরোধের ব্যাখাটাও দিল নির্দ্বিধায়, “আসলে ফুল ফান্ডেড পিএইচডি অফার পেলেও, স্ত্রী নিয়ে যেতে লাখ দুয়েক টাকা ঘাটতি থেকে যাবে। সেজন্য ব্যাংক ব্যালেন্সটা দেখাতে হবে ভিসা পেতে। আর অল্পসময় চাকরি করে অন্য কোন সঞ্চয় করতে পারিনি যেটা দেখাতে পারবো।“

মাহমুদের সরল স্বীকারোক্ততি মুগ্ধ করল রুকুর বাড়ির সবাইকেই। এ নিয়ে কোন ওজর আপত্তি উঠলো না। আগে থেকে প্রস্তুতি না থাকায় কনে বিদায় হল না সেদিন। বরং মাহমুদকেই রেখে গেল বরপক্ষের মানুষজন। রাতটা শেখ বাড়িতে থেকে সকালে একসাথে ঢাকায় রওনা দিল দুজনেই। রুকুকে হোস্টেলের সামনে পৌঁছে দিয়ে মাহমুদ বলল, “সংসার করার জন্য তো সারাজীবন পড়ে আছে। বিয়ের আগে না সই, এখন কিছুদিন প্রেম প্রেম খেলি। কি বলো?”

রুকু লজ্জাবনত মুখে বলল, “আমি কি সংসার করার জন্য মরে যাচ্ছি?”

“কে যে কেন মরে যাচ্ছে…! সাবধানে থেকো, আল্লাহ হাফেজ।“

“এসো এসো আমার ঘরে এসো…”, গুনগুন করতে করতে ফিরে গেল মাহমুদ।

বুশরা একটু আফসোস করলো রুকুর বিয়েটা মিস করায়। ওকে আস্বস্ত করে রুকু বললো, “কি আর করার। গিফট কিনে রাখ। আমি এসে আদায় করবো?’

এসে আদায় করার ব্যাপারটা বুশরা ধরতে পারলনা। তবে পাল্টা উত্তর দিল, “এসেই দেখ না। বিশাল সারপ্রাইজ নিয়ে বসে আছি।“

রুকুও সারপ্রাইজের ব্যাপারটা ধরতে পারলো না। কারন রুকুর বিয়ের ব্যাপারটার মাঝে কাউকেই নিজের সুখবরটা বলতেই পারেনি রায়হান। তবে কতদিন আর এমন একটা ব্যপার চেপে রাখা যায়। সবাইকে জানাতে তো রায়হানেরও মন আঁকুপাঁকু করছে। অবশেষে একদিন বাবা মা কে একসাথে বসিয়ে রায়হান বলেই ফেলল, “আব্বা… আম্মা… একটা সুখবর আছে।“

দুজনকে ভেবে দেখার একটুখানি সময় দিয়ে বলল, “আমার আর বুশরারও আব্বা আম্মা ডাক শোনার দিন চলে আসতেছে।“

দুজন বৃদ্ধ মানুষের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মত। তবে কিছুক্ষণের মধ্যের হাসি আনন্দ উবে গেল শিউলি বেগমের চেহারা থেকে। রায়হান যেন অপেক্ষা করছিল এইটারই।

“আম্মা চিন্তা করো না। বুশরা ভালো আছে। পেটের বাবু ও।“

“এই সময় মেয়েদের আদরযত্ন দরকার। বিশ্রাম দরকার। এসব ছাড়া সে ভালো থাকে কেমনে?”

শিউলি বেগম বললেন, “বুশরাকে বলো দেশে আসতে। বাচ্চা হয়ে গেলে আবার পড়াশুনা করবে। আমি বাচ্চা পেলেপুশে বড় করে দিব। সমস্যা নাই তো।“

প্রমাদ গুনল রায়হান।

“আম্মা, আর কয়টা মাস পর তো বুশরার ফাইনাল পরীক্ষা। এখন সব ছেড়েছুড়ে আসলে পুরা কষ্ট লস। আর তাছাড়া কয়েক মাস হয়ে গেছে। এখন এতটা পথ প্লেনজার্নি করাও তো রিস্ক। বুঝতে চেষ্টা করো।“

শিউলি বেগম ভীষণ রাগ করলেন, “কয়েক মাস আমাকে কেউ জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? এই আমি তোমাদের মা? বুশরা তো অন্তত বলতে পারতো!”

রায়হান মায়ের হাত ধরে বুঝানোর চেষ্টা করলো, “আম্মা আমরা জানছি ই গতমাসে। আমিই বুশরাকে বলছি এই খবর আমি তোমাদের দিতে চাই। ওর কোন দোষ নাই। আর মধ্যে তো আমি কতদিন ছিলাম না দেশে। আর আসার পর তো রুকুর বিয়ে…। আম্মার রাগ করো না। দোহাই লাগে।“

মা ছেলের দ্বন্দে নাক গলালেন রুস্তম শেখ, “রায়হানের আম্মা। যা হইছে বাদ দাও। ছোট মানুষ ওরা।“

শিউলি বেগম বললেন, “কিসের ছোট মানুষ? দুইদিন পর বাপ মা হবে। তাও যদি আক্কেলজ্ঞান না হয়, আমি মা রাগ করতে পারবো না?“

“অবশ্যই পারবে আম্মা। আমাকে বকো, মারো, যা ইচ্ছা করো। কষ্ট পাইয়ো না।“

শিউলি বেগম বললেন, “আমি অতশত বুঝিনা। এই অবস্থায় মেয়েটাকে একা রাখবো না আমার। বাপ ব্যাটা সবকিছুতে আমার সাথে মনমানি করো। এবার আমার কথা শোন। হয় বুশরাকে দেশে আনার ব্যবস্থা করো। নাহলে আমার ওর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।“

রুস্তম শেখ স্ত্রীর তুলনায় অনেকটাই শান্ত। চিন্তাভাবনা না করে হাউকাউ করা তাঁর পছন্দ না। ভেবে চিন্তে মা ছেলের ঠান্ডা যুদ্ধের মধ্যে তিনি বললেন, “রায়হানের আম্মা, এইটা তো ঢাকা, রাজশাহী না যে বললাম আর চলে যাওয়া গেল। রুকু তো ইংল্যান্ড যাচ্ছে কদিন পর। তুমি এত চিন্তা করো না।“

ঠিক এই কারনেই বাবাকে সবকিছুর মুশকিল আসান ভাবে রায়হান। বিগত কয়দিনে এই বিষয়টা একবারও মাথায় আসেনি রায়হানের। শুনতে খুব স্বার্থপর মনে হলেও রায়হান খুব শান্তি পেল বিষয়টা ভেবে। শিউলি বেগমও বিষয়টা আমলে নিলেন। তবে রাগ পড়লো না এত সহজে। দুইদিন ছেলে, ছেলের বউয়ের সাথে কথা বললেন না তিনি। তৃতীয় দিন এক ফাঁকে সিসি ক্যামেরার এপটা মোবাইলে অন করে মায়ের বিছানায় রেখে আসলো রায়হান। ওজু করে নামাজ পড়বেন এমন সময় ফোনের স্ক্রিণে চোখ পড়ল শিউলি বেগমের। তারপর রাগ গলে জল হতে কতক্ষণই বা লাগে বলুন? ফোনের স্ক্রিনে হাত বুলিয়ে চুমু খেলেন মমতাময়ী মা। প্ল্যানটা দিয়েছিল রুকু। আর পর্দার আড়াল থেকে প্ল্যান সাক্সেসফুল হওয়া দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রায়হান।

দুই মাসের মাথায় রুকু আর মাহমুদ পাড়ি জমালো ইংল্যান্ড। বুশরার থেকে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টার দূরত্বে একটা ছোট্ট সংসার পেতে বসলো রুকু। রুকুর লাগজ থেকে বয়ামে বয়ামে আচার বের হতে দেখে মাহমুদ বললো, “এখনো তো প্রেমটাই ঠিক মত করে উঠতে পারলানা বিবি সাহেবা। এত তাড়াতাড়ি বংশধর বাড়ানোর চিন্তা করছেন শাশুড়িমা?”

কপট রাগ দেখিয়ে রুকু বলল, “তুমি বিয়ের আগে অনেক ভদ্র ছিলে।“

“তখন কি তুমি আমার বউ ছিলে?”, পালটা প্রশ্ন মাহমুদের। চোখেমুখে মিটিমিটি হাসি।

“না… এসব তো বুশরার জন্য।“

“ইউ মিন তোমার ভাবি?”

“ভাবি না সাহেব, আমার জান।“

“কি বলো? আমি কি তাহলে?”

“তুমি উড বি জান। বুঝছো? এদিকটা একটু গুছিয়ে আমি বুশরার কাছে যেতে চাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য।“

“ওকে।“

কয়েকদিন পর গাট্টিবস্তা বেঁধে রওনা দিল রুকু, সাথে অবশ্য মাহমুদও আছে। অপরিচিত দেশে তো হুট করে বউকে একা ছেড়ে দেওয়া যায়না। গাট্টিবস্তার সাইজ দেখে মাহমুদ ফোড়ন কাটলো, “তুমি কি একেবারে যাচ্ছো নাকি?”

রুকু বলল, “সব বুশরার আর ওর বাবুর জিনিসপত্র জনাব। আপনার বউ যথাসময়ে ফিরে আসবে।“

বাবুর কথা শুনে অবাক হল মাহমুদ। রুকু ওকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। মাহমুদ শুধু বলল, “তোমার জান তো দেখছি আয়রন লেডি!!“

রুকু গর্বভরে সায় দিল, “হুউম!”

সকাল সকাল রওনা দেওয়ায় ওরা বুশরার ওখানে পৌছালো বারোটায়। প্রাণের বান্ধবীকে এতদিন পর দেখে আনন্দের আতিশয্যে জড়িয়ে ধরল রুকু। বুশরা বলল, “এই আস্তে, এত দস্যিপনা করিস না পাগলি।“

“ওহ তাই তো”, বলে জিভ কাটলো রুকু।

তারপর বলল, “তুই নাকি আমার বিয়ের গিফট নিয়ে রেডি হয়ে আছিস? কই সেটা? ও আচ্ছা এই হচ্ছে মাহমুদ, আর মাহমুদ… এই হচ্ছে আমার…”

“জান। আমি বুঝছি।“

একটা রেস্টুরেন্টে হালকা খাওয়াদাওয়া করে বুশরা বলল, “আমার আজকে চেকআপের এপইয়েনমেন্ট আছে, যাবি আমার সাথে?”

হইহই করে তিনজনেই গেল হসপিটালে। ডাক্তার দেখানোর পর আল্ট্রাসনোগ্রাফি রুমে সময় রুকুকে সাথে নিয়ে গেল বুশরা। সারপ্রাইজটা তখনই পেল রুকু। আরেকটু হলে তো স্থান, কাল, পাত্র ভুলে খুশিতে চিৎকার দিয়ে দিত ও।

আল্ট্রাসনোর রুম থেকে বেরিয়ে বুশরা বলল, “ভাইয়াকে বলবি না ভুলেও। নাহলে তোর, একদিন কি আমার একদিন।“

বুশরাকে আরেকদফা জড়িয়ে ধরল রুকু।

“মাইর দিব কিন্তু রুকু। দস্যিপনা করবি না একদম।“

মাহমুদ তা দেখে বলল, “আপনার বান্ধবীটির বোধহয় মাথায় সমস্যা আছে। মুখে মুখে বলে আপনি নাকি ওর জান, এখন তো দেখছি জান নিয়ে টানাটানি করতে ওস্তাদ।“

স্বামীর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো রুকু।

মাহমুদ ফিরে গেল সেদিনই। রুকু থেকে গেল বুশরার সাথে। বুশরা ভালো আছে শুনে শিউলি বেগম, রায়হান, রুস্তম শেখ সবাইই একটু নিশ্চিন্ত হলেন। কয়েকদিন থেকে ফিরে গেল নিজের সংসারে। বুশরাও বাঁধা দিলনা। সংসার জীবনের শুরুটুকু একসাথে কাটানোর মর্ম বোঝে ও। রুকু এবারের মত চলে গেলেও আসা যাওয়াটা পরিণত হল রুটিনের মত। এক সপ্তাহ, দু সপ্তাহ পরপরই বক্স করে করে খাবার ফ্রিজে গুছিয়ে রেখে সংসার ফেলে চলে আসে রুকু। মাহমুদও ব্যপারটা প্রশ্রয় দেয়। শেষের দিকে বুশরার শরীর বেশ নাজুক হয়ে যায়। রুকু নিজে থেকে কিছুদিন যাওয়ার কথা না বললে মাহমুদই নিজে বলে “তোমার জানের জন্য মন পোড়াচ্ছে না? যাও ঘুরে আসো। শী নিডস ইউ।“

দেখতে দেখতে বুশরার ডেলিভারির ডেইট চলে আসলো। সত্যিকার অর্থে একদিন আগেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে এলো রুকু। সাথে অবশ্য এবার মাহমুদও এলো। দুইদিন সময় হাতে নিয়ে দেশ থেকে উড়াল দিয়েছে রায়হানও। কিন্তু বুশরার লেবারপেইন শুরু হলো রায়হান পৌছানোর আগেই। ভাগ্যিস রুকু ছিল।

বুশরার অবস্থা দেখে রুকু কান্নাকাটি করছে। এ সময়টাতে মাহমুদ দারুনভাবে সামলে নিল যাবতীয় দায়িত্ব। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌছালো রায়হান। কথা বলার মত অবস্থাতে ছিল না কেউই। আলগোছে স্ত্রীর কপালে দীর্ঘ চু্‌মু খেল রায়হান।ঠিক এই মুহুর্তটাতে অনাগত সন্তানের চিন্তা ছাপিয়ে বুশরাময় হয়ে উঠল রায়হানের মনোজগত।

সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার হিসেবে ঠিক কতক্ষণ পেরিয়েছে বলতে পারবে না রায়হান। অনন্ত অপেক্ষার অবসান হলো একসময়। নার্স তোয়ালে পেচানো ছোট্ট একটা পুতুল নিয়ে এসে দাঁড়ালো রায়হানের সামনে।

মাথার মধ্যে পাক খাওয়া হাজারো শব্দ হাতড়ে রায়হান জিজ্ঞাসা করল, “হাউ ইজ দ্য পেসেন্ট।“

নার্স হেসে বলল, “শী ইস এবসলুটলি ফাইন।“

এই সুযোগে হাত বাড়িয়ে বাবুটাকে কোলে নিল রুকু। ছোট্ট ছানাটা পিটপিট করে চেয়ে আছে নতুন পৃথিবীর অচেনা মানুষটার দিকে।

রায়হান চাইলেও সদ্যজাত ছেলেকে কোলে নিতে পারলো না বোনের কাছ থেকে। অসহায় চেহারার দিকে তাকিয়ে নার্স বলল, “ডোন্ট বি স্যাড ইয়ং ম্যান। ইউ হ্যাভ টু টেইক কেয়ার অফ এন্যাদার ওয়ান।“

নার্সের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না রায়হান। ঠিক তখনই আরেকজন নার্স বেরিয়ে এলো, কোলে একই রকমভাবে তোয়ালে দিয়ে পেচানো আরেকটা বাচ্চা নিয়ে। রায়হানের কোলে জীবন্ত পুতুলটাকে দিয়ে নার্স হাসলো।

বুশরার গর্ভে একই সাথে বেড়ে উঠছিল জমজ দুটো বাচ্চা। একটা ছেলে, আরেকটা মেয়ে। রুকু জানতো সেই আল্ট্রাসনোর দিন থেকেই। রায়হানকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল বুশরা। তাই রুকুও চেপে গেছে পুরো ব্যাপারটা।

সারপ্রাইজের চোটে হতবুদ্ধি রায়হান। একটা কথাও বলতে পারছে না। একবার ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, তো একবার মেয়ের। নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। বুশরাকে বেডে দিল ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। বাচ্চাদের চেহারা দেখে কেঁদে ফেলল বুশরা। এ কান্না যে কত সুখের কান্না তা একজন মা মাত্রই বোঝে শুধু। ভিডিও কলে নাতিপুতির মুখ দেখলেন শিউলি বেগম আর রুস্তম শেখ। বাড়ির অন্যরাও ফোনের সামনে হুড়োহুড়ি করল কিছুক্ষন। রায়হান স্ত্রীর পাশে চেয়ার টেনে বসে রইলো দীর্ঘসময়। আস্তে আস্তে চুলে বিলি কেটে দিল। রুকুকে নিয়ে মাহমুদ ওখান থেকে বেরিয়ে গেল একসময়। বুশরার ক্যানুলা লাগানো হাতে চুমু খেয়ে রায়হান বলল, “পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ দিয়েছো আজকে তুমি আমাকে। ভালবাসি। অনেক।“ একফোটা জল গড়িয়ে পড়ল বুশরার হাতে। ক্লান্ত শরীরে অস্ফুটস্বরে বুশরা বলল, “আমিও ভালবাসি খুব।“

দু সপ্তাহ স্ত্রী সন্তানের সাথেই থাকলো রায়হান। এসময় রুকুকে জোর করে পাঠিয়ে দিল ওর সংসারে। বলল, ও চলে গেলে তখন মাঝে মাঝে আসতে। মাহমুদের কাছেও বারবার ক্ষমা চাইল এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনার জন্য। প্রতিবারই মাহমুদ বলল, “ভাইয়া আমার তো কোন বোন নাই। ভাবি তো আমার বোনেরই মত। কেন বারবার ক্ষমা চাচ্ছেন বলুন তো? আর রুকু তখন বিয়েতে রাজি না হলে চারটা বছর কিন্তু আমি একাই কাটাতাম।“

বুশরার যে কয়দিন ইউনিভার্সিটিতে যেতে হয় রুকু বাচ্চাদুটাকে দেখে রাখে। আবার সপ্তাহান্তে ফিরে যায় নিজের সংসারে। রুকু এতটা সাপোর্ট দেওয়ার পরেও দুধের দুটো বাচ্চা সামলে পড়াশুনা খুব কষ্ট হয়ে যায় বুশরার। এভাবেই চলল মাস দেড়েক।

তারপর এলো রায়হান। প্রায় একমাস সময় নিয়ে এলো যাতে একসাথেই ফিরতে পারে। ছোট্ট বাবুদের নিয়ে একা জার্নি করা কঠিন হয়ে যাবে বুশরার জন্য তাই। পুরো মাসটা প্রতিটা মিনিট, সেকেন্ড, ঘন্টা বাচ্চাদের আগলে রাখলো পরম মমতায়। আর নির্ভারচিত্তে জানপ্রাণ দিয়ে পড়াশুনা করে পরীক্ষাগুলো দিল বুশরা।

পরীক্ষা শেষ হলো অবশেষে। বিদেশ বিভ্যুইয়ের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরছে ওরা সপরিবারে। রায়হানের কোলে মেঘ বাবু আর বুশরার বৃষ্টি সোনা। এয়ারপোর্টে ওদের বিদায় জানালো রুকু আর মাহমুদ।

মাহমুদের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো রুকু, “থ্যাঙ্ক ইউ মাই ডিয়ার হাজব্যান্ড।“

“কেন?”, প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মাহমুদের।

“একই দেশে থেকেও বুশরাকে এই সাপোর্টটা না দিতে পারলে অনেক কষ্ট লাগতো।“

“যা তোমার তাই আমারও। তোমার সুখ, তোমার কষ্ট। সব।“

একে অপরের হাতটা জড়িয়ে ধরল বিয়ের পর দীর্ঘ সময় বিবাহিত ব্যাচেলর জীবন কাটানো এই দম্পতি।

অসুস্থ শরীর নিয়েও এয়ারপোর্টে এসেছেন রুস্তম শেখ আর শিউলি বেগম।

শিউলি বেগম বারবার বলছেন, “প্লেন কি লেট নাকি?”

“প্লেন লেট না রায়হানের আম্মা। তোমার মনের ঘড়ি ফাস্ট।“

“খবরদার মজা করোনা আমার সাথে এখন। আর শোন, রায়হানের আম্মা ডাকটা পুরান হয়ে গেছে। মেঘবৃষ্টির দাদি ডাকার অভ্যাস করো।“

“আচ্ছা।“ , বলে হাই তুললেন রুস্তম শেখ। নাতিনাতনিদের দেখার খুশিতে তার পঞ্চাশোর্ধ বউয়ের চেহারার জেল্লা আজ অষ্টাদশী চঞ্চলা দেখাচ্ছে। তবে এ নিয়ে কোন মন্তব্য করলেন না। বেগম সাহেবার মেজাজ মর্জি ভালো না। কখন দেখা গেল ফেটে পড়বে।

শেখ দম্পতির ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গার দোরগোড়ায় যখন, ঠিক তখনই শেখ পরিবারের চার সদস্য দৃষ্টিসীমার মধ্যে ধরা দিল। রায়হান আর বুশরা দুজনেরই কোল আলো করে দুটা শান্ত, মিষ্টি বাবু। একটুও কান্নাকাটি নেই। লাগেজ ঠেলে এগিয়ে আসলো ওরা বাবা মায়ের কাছে। দুজনই ছো মেরে নিজেদের বংশুধর হস্তাগত করলেন বিন্দুমাত্র কালক্ষেপন না করে। পিচ্চিদুটো তাকিয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে। দাদাদাদীর নিখাদ আদর আহ্লাদের উষ্ণতায় কান্নাকাটির প্রশ্নই আসে না।
“এই দেখো দেখো, বাচ্চাদুটোর চেহারার সাথে সাথে হাসিরও কি মিল।”, বললেন শিউলি বেগম। একটু আগেই যে স্বামীর সাথে বেজায় রাগ করছিলেন তার ছিটেফোটাও নেই তাঁর কন্ঠে। রুস্তম শেখও হেসে হেসে বললেন, “একদম তোমার মত হইছে।”

রায়হান বলল, “দেখেছো বুশরা? আমাদের আর দামই নাই।“

বুশরা মুখ টিপে হেসে বলল, “হুম। তাই তো দেখছি। ভাগ্যিস একটা না। তাহলে তো এয়ারপোর্টেই দুজনের মারামারি বেঁধে যেত।“

এ কথায় পুরো শেখ পরিবারই হেসে উঠলো। মেঘবৃষ্টিও হেসে উঠলো কলকলিয়ে।

সমাপ্ত।

ডাক্তার মিস সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন