#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৩১)
‘ তোমার হাজব্যান্ড! বাহ! অন্য মেয়েদের সাথে। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আর তোমার হাজব্যান্ড ক্লাবের ভেতরে দাঁড়িয়ে তাও আবার অন্য মেয়ের সাথে! ‘
লাবিবা কটমট করে তাকায়। ফ্লোরা গলায় আফসোস তুলে বলে,
‘ আহারে! রেগে যাচ্ছো কেনো? আমি কি বানিয়ে বলছি? নিশ্চয় কাছের কেউ টেউ হবে। ছেলেদের একটু স্পেস দেওয়া উচিত বুঝলে? নয়তো বেঁকে বসে। তুমি নিশ্চয় আমাকে কিছু বলবেনা। ‘
লাবিবা নজর ফিরিয়ে তানভীরের দিকে তাক করে। বর্তমানে সে শহরের মেইন পয়েন্টে এক বিলাসবহুল নাইট ক্লাবে অবস্থান করছে। দিন দুপুরেও এই ক্লাবের সামনের রাস্তায় সাধারণ কেউ হাটতে আসেনা। বড় লোক ছেলে মেয়েদের মাতলামো পনা চলতেই থাকে। যাদের টাকা রাখার জায়গা নেই তাঁরা এখানে আড্ডা দিতে আসে। তানভীরের জন্য আজ লাবিবাকে এখান অব্দি পৌঁছতে হয়েছে। সাত তলায় লিফটে উঠতে না পেরে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়িতে দৌড়ে উঠেছে। ক্লাবের দরজায় এসে হাঁটুতে ভর করে হাপাচ্ছে আর জলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে। ব্লাক কালার স্যুট পরা মেয়েটা এসে প্রথমেই তানভীর কে হাগ দিয়েছে। তারপর ইয়েলো কালার স্যুট পড়া মেয়েটা। এই মেয়েগুলোকে লাবিবা চেনেনা। তবে ছেলেগুলোর মধ্যে একজনকে চিনে। যে বড় চাচার ছেলে। লাবিবার অতি প্রিয় ভাই কবির। একজন এস আই। সেও মেয়েদুটোর সাথে ফ্রাংকলি হাগ দিচ্ছে। এসব দেখে রাগে যখন লাবিবার চোখ দুটো পানিতে টইটুম্বুর তখন দেখা যায় ভিড়ের মাঝে ফ্লোরাকে। ফ্লোরার হাতে হুইস্কি গ্লাস। লাবিবাকে সে নোটিশ করেছে। তার দিকেই এগিয়ে আসে। নজরে তাক করে তানভীর কে দেখে ফ্লোরার কন্ঠ ভীষণ দরদী হয়ে উঠে। অভিনয়ের সহিত বলে,
‘তোমার হাজব্যান্ড! বাহ! অন্য মেয়েদের সাথে।’
ফ্লোরা লাবিবাকে ইশারায় তার সাথে আসতে বলে। একটা ফাঁকা টেবিলে গিয়ে দুজনে বসে। লাবিবার সামনেই বরফ মিশিয়ে একটু একটু করে সিপ নেয়। এগিয়ে দেয় হাতের গ্লাস,
‘ খাবে?’
‘ না। তুমি হুইস্কিও খাও? ‘
লাবিবার অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। ফ্লোরা হালকা হাসে।
‘ কে বললো এটা হুইস্কি? আমার কাছে এটা ফ্রুট জুস। দেখো একদমি নেশা হয়না। ‘
আশ্চর্য ভাবে একদমি ফ্লোরার নেশা হলোনা। স্বাভাবিক রইলো। লাবিবার দৃষ্টি তানভীরেই আবদ্ধ দেখে ফ্লোরা ওকে জানালো,
‘ তানভীর এখানকার মেম্বার। আমিও মেম্বার। এতো অবাক হবার কিছু নেই। এখানে শুধু মানুষ মদ গিলতেই আসেনা। বরং চিল করতে আসে। তানভীরের সাথে মেয়ে দুটোকে দেখছো ওরা ফ্রেন্ড। তোমার ভাই কবির ও তানভীরের ফ্রেন্ড। আমি তাদের চিনি। অনেক আগে থেকেই। ‘
‘ চিল করার অনেক জায়গা আছে। এখানে কেনো?’
‘ যার যেটা পছন্দ! তানভীর বহু বছর দেশের বাইরে ছিলো। লাইফস্টাইল এর ব্যাপার স্যাপার ও আছে। বুঝতে হবে। ‘
ফ্লোরা যা বোঝাতে চেয়েছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে লাবিবা। উত্তর না করে এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছে। ফ্রেন্ডস এন্ড কাপল। কাপলের সংখ্যায় বেশী। তারা যে বেশ বড়লোক তাঁদের ড্রেসাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।এই ক্লাব সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছে। ভালো কিছু আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। তবে আজ এখানে এসে সর্বোপরি এটা বুঝলো যতটা খারাপ মানুষ বানিয়ে বলে তার অর্ধেকও না। ভেতরের পরিবেশটা কেমন যেনো। ভালোও লাগে আবার গায়েও কাটা দেয়। পাশের অন্য সেক্টরে ডিসকো চলছে। মদ খেয়ে মাতলামো! এটাতো যার যার চয়েজ।
‘ আমরা এখানে প্রায়ই আসতাম। বিশেষ বিশেষ রাতে। তোমার ভাসুর অবশ্য তেমন পছন্দ করতো না। আমার জোরেই আসা হতো। এন্ড উই ক্রিয়েট এ লট অফ রোমান্টিক এটমসফিয়ার এ্যারাউন্ড আস।’
‘ তুমি আগে থেকেই হুইস্কি খেতে? ‘
‘ তুমিও চাইলে খেতে পারো। নেশা হলে রোমান্স ভালো জমে। ‘
‘ চাইনা। ঐদিকে কি? ডিসকো? ‘
‘ হুম। যাবে? চলো। ‘
লাবিবা তানভীরের দিকে আরেকবার নজর বুলিয়ে নেয়। এখনো আড্ডায় মশগুল হয়ে আছে। লাবিবা যে এখানে আছে সেকি বুজতে পারছেনা? সেতো এক মাইল দূরে থাকলেও লাবিবা তাকে ফিল করে। লাবিবা কাছাকাছি থাকলে সে কেনো বুঝতে পারে না? মনের টান থাকলে তো বুঝবে। কিছুই তো নেই। বিয়ে হয়েছে অর্ধেক বছর চলে গেছে। এখনো দুজন দুজনের মতো দুই ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একডালে বাসা বাঁধা আর হবে বলেও মনে হয়না। লাবিবার ই কেনো তবে এতো দোটানা?
ডিসকোতে উপচে পড়া ভীড়। একজনের গায়ে সাথে আরেকজনের গা চাইলেই ঘেস খাচ্ছে। ফ্লোরার কোনো অস্বস্তি নেই। সে এসবে অভ্যস্ত। তার কোনো কিছুর পরোয়া নেই। কিন্তু লাবিবার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো। কিছু সময় পর লাবিবা ফিল করে তার আশেপাশের সবাই তার থেকে ডিস্টেন্স মেইনটেইন করছে। কোনো এক অদৃশ্য আবরণে লাবিবা আবৃত আছে। সেই আবরণের নাম তানভীর খান লাবিবা জানে। তানভীর যতই আড়ালে থাকুক তার উপস্থিতি লাবিবা ঠিকই বুঝতে পারে। সিউর হয় তানভীরের গলা শুনে।
একজন ফ্রেন্ডস জিজ্ঞেস করে,
‘ তানভীর মেয়েটাকে চিনিস? তোর পরিচিত?’
‘ হুম। ‘
‘ কে হয়?’
তানভীর কিছুক্ষণ নিবর চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
‘ আমার আত্মীয়। ‘
লাবিবা বাঁকা চোখে তাকায়। অতি শান্ত সে-ই চোখ। কোথাও যেনো অভিমান উঁকি দিচ্ছে। তানভীর রিয়েক্ট না করলেও কবির মুচকি হেঁসে বলে,
‘ আমার বোন। ‘
‘ কিরে আমরা তো জানতাম তুই হচ্ছিস তানভীরের ফ্রেন্ড। রিলেটিভস কবে থেকে হলি তবে? ‘
‘ ঐতো হয়ে গেলাম এভাবেই। ‘
বাসায় ফেরার সময় কবির বলে,
‘ আমার বোনকে হার্ট করেছিস তুই আজকে । ‘
‘ কিভাবে?’
‘ তুই জানিস না ও তোর থেকে কি ডিজার্ভ করে? বউকে আত্মীয় বলে পরিচয় দিচ্ছিস আর জিজ্ঞেস করিস কিভাবে?’
‘ মিথ্যে বলেছি? আত্তার সাথে যার সম্পর্ক তাকে তো আত্মীয় ই বলবো। বউ যদি অবুঝ হয় তাহলে আমার কি করার? তোর বোনের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক।’
পেছন পেছন আসছে লাবিবা। তানভীরের কথা শুনে ফিসফিসায়। ‘ কচুর সম্পর্ক। ‘
অর্ধ রাস্তায় গিয়ে তানভীর দাঁড়ায়। কবিরকে বলে,
‘ তোর বোনকে সামনে হাঁটতে বল। পেছন পেছন হাঁটা করা আমি পছন্দ করিনা। ‘
কবির জানতো না লাবিবা তাদের সাথে। সে পেছন ফিরতেই লাবিবাকে দেখতে পায়। লাবিবা এগিয়ে আসলে কবির লাবিবার হাত মুঠোয় নেয়। গম্ভীর মুখে বলে,
‘ পেছনে আছিস আওয়াজ দিতে হয়। আর ফ্লোরার সাথে ক্লাব অব্দি চলে গেছিস এসব কাকা জানে? এতো যে উড়ছিস কাকা জানলে আস্ত থাকবিনা। ‘
‘ আমার বিয়ে হয়ে গেছে ভাইয়া। তোমার কাকা আর আমার উপর এতো অধিকার ফলাতে পারবেনা। ‘
তানভীর আড়চোখে তাকায়। শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করে,
‘ আমাকে অধিকার ফলাতে বলছো?’
ওদের কথপোকথন এ কবির হাত ছেড়ে এগিয়ে যায়।
‘ না। আমার উপর আপনার কোনো অধিকার নেই। ‘
‘ তোমার বিয়েটা আমার সাথেই হয়েছে। ‘
‘ বেশীদিন আর এ সম্পর্ক থাকবে না। ‘
‘ মানে? থাকবেনা মানে কি? পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি?’
‘ আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে স্যার। আপনাকে আর বেশীদিন এই আত্মীয়ের পরিচয় বহন করতে হবেনা।’
‘ কার সিদ্ধান্ত?’
‘ আমার সিদ্ধান্ত। আপনাকে মুক্তি দিতে চাই। আপনি আমাকে যেটার জন্য সাহায্য করেছিলেন সেটা হয়ে গেছে। ডিভোর্সী মেয়েকে কেউ বিয়ে করবেনা। ‘
তানভীরের পা পেছন দিক ঘুরে যায়। লাবিবার সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা কত স্বাভাবিক। অথচ তার নিষ্ঠুর আচরণ। তানভীর কাতর স্বরে প্রশ্ন করে,
‘ এতোটা সাহস কে তোমাকে দিলো লাবিবা? বিয়েটা আমি তোমাকে স্বেচ্ছায় করেছি। একবারও ছাড়াছাড়ির কথা মাথায় আনি নি। তোমার মাথায় এসব কে ঢুকাচ্ছে? ফ্লোরা?’
‘ আমি কি এতোটা বোকা?’
‘ তাহলে কেনো চাইছো এমন?’
‘ ভালোবাসা ছাড়া কখনো সংসার হয়না। একটু হলেও মায়া থাকতে হয়। দিন শেষে আমিও চাই আমাকে কেউ ভালোবাসুক। আমার সঙ্গী হোক। সেখানে আপনার মনে আমার জন্য কোনো জায়গা নেই। বাসাটা বাধবো
কোথায়?’
‘ ভালোবাসলেই বলতে হবে? না বললে ভালোবাসা হয়না? ‘
‘ আমি কিছুই জানিনা।’
তানভীর আরো এগিয়ে এসে তানভীরকে ছুঁতে চায়। লাবিবা দু পা পিছিয়ে যায়। তেজী কন্ঠে প্রতিবাদ জানায়,
‘ এখনো আপনার গা থেকে মেয়েদের পারফিউম স্মেল আসছে। প্লিজ আমাকে ছুঁবেন না। ‘
‘ তুমি ভীষণ হিংসুটে লাবিবা। ওরা শুধুই আমার ফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ড না। ‘
‘ তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ‘
‘ তুমি আর ফ্লোরার সাথে মিশবে না। ‘
‘ ভাবী বলুন। ফ্লোরা না। এতো প্রেম মিশিয়ে আড়ালে ডাকবেন আমার সামনে না। ‘
‘ ফ্লোরার সাথে আমার কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই লাবিবা। এভাবে দিনের পর দিন ভুল বুঝে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখো না। ‘
‘ আমি জানি সেটা। ফ্লোরা আপু তামিম ভাইকে ভালোবাসে। আপনাকে না। ‘
‘ তাহলে পাত্তা দিচ্ছো কেনো তাকে?’
‘ কারণ সে আমার ভালো চায়। ‘
‘ সে যদি তোমার ভালো চাইতো তাহলে আমাদের মাঝে ডিস্টেন্স তৈরী করার চেষ্টা করতো না। ‘
‘ আপনার ভুল ধারণা। উনি তেমন কিছুই চেষ্টা করেনি। আপনি আমাকে আমার জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পারিনি। তাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘
‘ তুমি উল্টো বুঝছো লাবিবা। ‘
‘ তাহলো সিধে টা কি? আপনি আপনার মতো আমি আমার মতো। এটাই তো? বাঁধন টা ছিঁড়ে দিন । যদি নড়তেই হয় হাত পা নাড়াতে গিয়েও তো বাঁধা প্রাপ্ত হয়।’
‘ কি চাও তুমি?’
‘ এক সমুদ্র জল স্বচ্ছ ভালোবাসার অধিকারিণী হতে চাই। কোটি কোটি টন আবর্জনা মিশ্র হলেও যার স্বচ্ছতার অভাব হবেনা। ‘
চলবে।
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৩২)
বাবার রুম থেকে তানভীরকে রাগারাগি করে বেরিয়ে যেতে দেখে লাবিবা তব্দা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কানে এসব কি কথা এলো? কিছুক্ষন পূর্ব হতে সে বাবা এবং স্বামীর প্রায় কথপোকথন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছে। তানভীর যখন বাড়িতে আসে তখনই বারান্দা থেকে নোটিশ করেছে। গুটি গুটি পায়ে বেরিয়েও এসেছে। বাবার রুম থেকে গলা পেয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । রুমের ভেতর বাবা উঁচু গলায় কথা বলছে। মা তাঁকে থামানোর চেষ্টা করছে। তানভীর অতি ভদ্র ছেলের ন্যায় দাঁড়িয়ে শ্বশুরের রাগ সহ্য করছে।
‘ তোমার সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে আমি ঠেকে যায়নি। যে তুমি যখন ইচ্ছে তখন আমাকে বিরক্ত করবে। আমার মেয়েকে ঘরে পুরতে চেষ্টা করবে। তানভীর তোমাকে আমি এই শেষ বার বলে দিচ্ছি। আমার মেয়ের বেলায় আমি বিন্দু মাত্র কমপ্রোমাইজ করবো না। এরজন্য ই আমি বয়স্ক ছেলের সাথে কখনো মেয়ে বিয়ে দিতে চাইনি। তারা সবসময় ভাবে তাঁদের বয়স শেষের গোড়ায় আর এক্ষুনি তাদের সবকিছু লাগবে নয়তো সব ফুরিয়ে যাবে। ‘
সাবিনা থামানোর চেষ্টা করে,
‘ তুমি থামো। কিসব বলছো জামাইকে? ওর স্ত্রী ওর অবশ্যই অধিকার আছে। ‘
‘ কে দিয়েছে ওকে সেই অধিকার? বিয়ে দেবার সময় তো এই কথা হয়নি। আমার মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার পরই পাবে সেই অধিকার। যদি আমার মেয়ের মত থাকে। শোনো তানভীর। হয়তো তুমি অনেক বড় মাপের মানুষ। অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির সন্তান। তোমার তুলনায় আমরা কিছুই না। কিন্তু আমার মেয়েও তোমার থেকে কম আদরের না। তোমাকে প্রতিষ্ঠিত দেখার জন্য যদি তোমার বাবা মা কোলের ছেলেকে বিদেশ ভুঁইয়ে একা রেখে শুন্য ঘরে দিন কাটাতে পারে তাহলে আমিও চাইবো আমার মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার আগে সংসার জীবনে না পা রাখুক। আমার মেয়ের যে ফোকাস ব্রেক হয়েছে তার দায় নিশ্চয় তুমি এড়াতে পারবে না। ‘
‘ অন্যত্র বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেটা করার আগে আপনার ভাবা উচিৎ ছিলো আব্বু। ‘
‘ আমি সিউর ছিলাম সেই ঘরে আমার মেয়ে কখনোই যেতো না। আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকতো। কিন্তু ওরা আমার মেয়েকে অসম্মান করে চরম ভূল টা করলো। ‘
‘ আপনি কি জানেন আপনার মেয়ের সাথে সেই ছেলের যোগাযোগ আছে? ‘
‘ আমার মেয়ে সেরকম হতেই পারেনা। আমি আমার মেয়ের ভালো চাই। এটা কখনো ভেবো না যে আমি তোমাদের আলাদা করছি। ‘
‘ এক ও তো করছেন না। আপনি চাইছেন টা কি? ‘
‘ সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবো না। মেয়ে আমার সিদ্ধান্ত আমার। মেয়ে আত্ননির্ভরশীল হবার আগে আমি মেয়েকে সিদ্ধান্ত গ্ৰহনের অধিকার দিবো না। ‘
‘ আপনার জেদের কারণে লাবিবা যদি কোনো ট্রাপে পড়ে আমি কিন্তু আপনার কথা আর রাখতে পারবো না। ‘
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ধড়াক শব্দে দরজা খুলে তানভীর চলে যায় । লাবিবা থ দাঁড়িয়ে থাকে। তার অগোচরে তাকে নিয়েই বাবা আর স্বামীর মাঝে যে এক গোপন দ্বন্ড চলছে সেটা বুঝতে সময় নিলো না। তৎক্ষনাৎ ভেতর থেকে ডাক আসে। বাবার ডাকে লাবিবা সাড়া দেয়। সামনেই সাবিনা দাঁড়িয়ে ইসমাইলের সাথে ঝগড়া করছে।
‘ জামাই মেয়েকে নিয়ে যেতে চায় এতে তোমার সমস্যা কি? কি পেয়েছো কি তুমি? বার বার তোমার কাছে এসে হাত পাতে তোমার কথার খেলাপ যে ছেলে করে না আজ তাকে তুমি বয়সের খোটা দিলে? মেয়ের গার্ডিয়ানগিরি দেখালে? বিয়ের পর মেয়ের আসল গার্ডিয়ান তার হাজবেন্ড। এটা তুমি জানোনা? সভ্য শিক্ষিত জামাই আমার তাই মুখের উপর চার কথা শুনিয়ে দিলো না। তোমার মেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরছে। বাসায় থাকছে না। উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। লেখাপড়ায় মন নেই রেজাল্ট খারাপ করছে এতে তুমি জামাইয়ের দোষটা কোথায় পেলে? জামাই তো তোমার মেয়ের পাড়াও মাড়ায় না প্রয়োজন ছাড়া। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আমি। মেয়ে কেনো জামাই ছাড়া থাকবে? কি পেয়েছো কি তুমি? যা ইচ্ছে তাই করবে? এমন সোনামুখো জামাই তোমার বংশের কেউ পেয়েছে? ‘
লাবিবা আসতেই হাত টেনে সামনে নিয়ে সরাসরি জেরা করে,
‘ ঐ বাহুতরা ছেলের সাথে তোর যোগাযোগ আছে? আছে? কি হলো কথা বলছিস না কেনো? উত্তর দে। ‘
ইসমাইল প্রতিবাদ করে, ‘ আমার মেয়ে ধমকাচ্ছো কেনো ছাড়ো ওকে। ‘
‘ কি ছাড়বো? নাকি তুমিই আস্কারা দিচ্ছো? এই তোমার মনে কিছু নেই তো?’
‘ আজেবাজে কথা বলবেনা। কি থাকবে মনে? বরং তোমার মন পরিষ্কার করো। কুটিল প্রবৃত্তির মহিলা হয়ে আমার সংসার করতে এসো না। ‘
‘ মনের মধ্যে কুটিলতা আমার নাকি তোমার? মেয়ে আর জামাই কে আলাদা করতে উঠে পড়ে লেগেছো। মেয়ে বিগড়ে যাচ্ছে অথচ তাকে শাসন করা তো দূর আরো সায় জাগাচ্ছো। ‘
‘ আমার মেয়ে ঠিকই আছে। যে ছেলে আমার মেয়েকে অপমান করেছে তার মুখ ও আমার মেয়ে দেখবে না। আর তুমি বলছো যোগাযোগ আছে। আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করবো না। ‘
মধ্যম স্তরে ঝগড়া ফেলে লাবিবা রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। বুকটা ধূকপুক ধূকপুক করছে। আজ বিকেলেই ফাহাদের সাথে তার দেখা করার কথা। ফাহাদ তার অনেক বড় একটা উপকার করতে চলেছে। তানভীর সম্পর্কে অনেক কিছুই সে ফাহাদ থেকে জেনেছে। জানেনা তার কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা। এই সত্য মিথ্যার গ্যাড়াকলে সে অনেক দিন থেকেই ফেঁসে আছে। ফ্লোরা নামের হিরোইন টার ও কটাক্ষ রোজ রোজ সহ্য করছে। ফ্লোরার সাথে যতটা সময় কথা হয় তামিম তানভীরের ব্যপারে বেশ তথ্য পায়। একটা মানুষ যাকে ভালোবাসে সে মানুষটা পুরোপুরি অচেনা। তাকে কাছে থেকে চেনার কোনো উপায় নেই। দূর থেকে অধরাই থেকে গেছে। মানুষটা যে এসে পাশে দু দন্ড থাকবে তার জোগাড় নেই। অথচ মানুষটা তাকে পুরোপুরি নিয়ে যাবার জন্য অগোচরে বাবার কাছে আর্জি পেশ করছে। কই লাবিবাকে তো একবার ও বলেনা চলো আমার সাথে। লাবিবা তো হাসি মুখে পা বাড়াতো। বাবাকে নাহয় সেই বুঝিয়ে বলতো। মা বাবার ঝগড়া থামার নাম নেই। লাবিবা বাড়ির ভেতর খুঁজে রাস্তা অব্দি হেঁটে আসলো। তানভীর চলে গেছে। রাগের মাথায় দুদন্ড দাঁড়ায়নি । ইসমাইলের কথায় বেশ অপমান বোধ করেছে। কিন্তু এতো রাগ নিয়ে রাস্তায় গাড়ি চালানো কি ঠিক ?
অস্থির মনে লাবিবার প্রহর কাটে। একবুক ভয় নিয়ে লাবিবা দেখা করে ফাহাদের সাথে। ফাহাদ ঠোঁট এলিয়ে হাসে লাবিবাকে দেখে। প্রথমেই প্রেম নিবেদন জানায় মিস্ট কথা দিয়ে।
— লাবিবা তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আমার ভালোবাসার চাদরে টুপ করে লুকিয়ে বুকের ভেতর পুরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
লাবিবা উত্তরে মুচকি হাসে।
— আমাকে দেখে তো কত জনের কতকি ইচ্ছে করে! গুনে হিসাব মেলানো দায়। আমার আবার এসব মানুষকে ভীষন ভালো লাগে। মিশতে ইচ্ছে করে। তাঁদের সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করে। তাঁদের ইচ্ছের কারণ জানতে ইচ্ছে করে। শুধু তাঁদের ইচ্ছেটা পূরণ করতে ইচ্ছে করে না।
— সে তুমি চাইলেই পূরণ করতে পারো। তোমার হাজব্যান্ড তো আর তোমাকে ভালোবাসে না। তার গার্লফ্রেন্ড এর সংখ্যা তুমি হিসেব করে বের করতে পারবে না। সেই কথা ছাড়ো। রাজনীতি তে তার প্রশস্ত হাত। রাজনীতি কি জিনিস বুঝলেনা? উপর দিয়ে নিতী দেখানো কাজ। নিচ দিয়ে অবৈধ টাকার পাহাড়। তোমার শ্বশুরের আজ যে সম্পত্তি প্রতিপত্তি এককালে আজকের মতো ছিলো না। মধ্যবিত্ত ই ছিলো বলা যায়। আজ ডিসটিক্টে ধনী ব্যক্তিদের একজন। কোথা থেকে আসে এতো টাকা? সৎ ব্যক্তিরা আর যাই হোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে পারে না। আর এইসব লিড করে তোমার হাজব্যান্ড মি. তানভীর খান।
— আমার শ্বশুড়বাবা কতদিন থেকে রাজনীতি তে আছে?
— হবেই তো চল্লিশ বছর।
লাবিবা মুচকি হাসে।
— আচ্ছা। কি যেনো দেখাবে বলেছিলে। তানভীর খানের গার্লফ্রেন্ড নাকি দেখাবে? দেখাও দেখি।
ফাহাদ তাচ্ছিল্য হাসে। ফোন ঘেঁটে লাবিবার হাতে তুলে দেয়। মেয়েগুলোর ছবি দেখে লাবিবা সাথে সাথেই চিনতে পারে। সেদিনকার ক্লাবের মেয়ে। লাবিবার জানামতে মেয়েগুলো ম্যারিড। জাস্ট হ্যাংআউটের জন্য ই তাদের এখানে আসা। লাবিবা মুচকি মুচকি হাসলো। সেই হাসি বেশিক্ষন স্থায়ী হলোনা। এক রাশভারী পুরুষ কন্ঠে খাদে নেমে এলো।
‘ অর্পি, মোহনা, জানভি। আমার ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ড। জাস্ট ফ্রেন্ড। ‘
লাবিবার ঘুরে তাকানো প্রয়োজন হলোনা। মনে পড়ে গেলো সেই জাস্ট ফ্রেন্ডদের সাথে হাগ দেবার দৃশ্যপট। সব বুঝতে পেরেও মনের কোনে কোথাও যেনো কালিমা পড়েছিলো। সেটাই প্রখর হতে থাকলো। হাত থেকে ফোনটা এক ছোবলে মুঠোয় নিয়ে নিলো। দৃষ্টি সরাসরি ফাহাদের দিকে তাক করলো। ফাহাদ কাঁচুমাচু করতে লাগলো। এক্ষুনি সুযোগ বুঝে পালাবে পালাবে ভাব। কিন্তু ঘটনা চক্রে পালাতে পারলোনা ফাহাদ। তানভীরের শক্তপোক্ত হাত চেপে ধরলো ফাহাদের কাঁধ। পর পর নাকে পড়লো শক্ত মুষ্টির আঘাত। হুংকার ছাড়লো তানভীর, ‘ তোকে বারবার সাবধান করেছি। তাও আমার কথা শুনিস নি। যতবার না বলেছি ততোবার স্পর্ধা দেখিয়েছিস। গার্লফ্রেন্ড এর ছবি দেখানো হচ্ছে আমার তাইনা? শালা ভেবেছিলাম বউ আমার হয়ে গেছে কোনো শিয়ালে হুক্কা হুয়া করবেনা। একটুও স্বস্তি দিলি না। ঠিক ই লেজ নাড়াতে নাড়াতে চলে এলি। আজ তোর এমন অবস্থা করবো তোর বাপ তোকে চিনতে পারবেনা। ‘
ফাহাদ প্রতিবাদ করতে চাইলো। মুখ খুলতে গেলে ই তানভীর টুটি চেপে ধরলো।
‘ আমার বউয়ের ব্রেইন ওয়াশ করিস? ভাবীর সাথে আমি পরকিয়া করি তাইনা? তোর এই নষ্ট ব্রেইনটাই রাখবো না। ‘
একের পর এক আঘাতের সিস্টেম দেখে লাবিবা ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেলো। এই ট্রীপ শেষ হলে পরের ট্রীপ যে তাকে নিয়েই হবে সেটা বেশ বুঝতে পারলো। সকালের রাগটা বিকালে আজ ফাহাদের উপর তুলবে। তানভীর লাবিবাকে জায়গা মোতাবেক পেলো না। কিছুটা দূরে আবিষ্কার করতেই হুংকার ছাড়লো, ‘ এই একদম স্থান ত্যাগ করবেনা। তোমার সাথেও হবে আমার বোঝাপড়া।’
লাবিবার পিলাই কেঁপে উঠলো। যে সুযোগ ফাহাদ খুঁজছিলো সেই সুযোগ সে পেতেই উত্তর দিকে রাস্তা বরাবর ছুটলো। একটি বারের জন্য ও পেছন ফিরে তাকালো না।
চলবে __
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৩৩)
‘ তোর বোন কোথাই? ‘
সারারাত নাইট ডিউটি করে ঘুমিয়ে ছিলো কবির। সেই ঘুমের তেরোটা বাজায় ফোন। কানে তুলতে না তুলতেই গম্ভীরভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে তানভীর। বন্ধুর এমন কন্ঠে চট করে উঠে বসে কবির। নিজেকে ধাতস্থ করে।
‘ কি হয়েছে? ‘
‘ দেখ তোর বোন কোথায়? এক্ষুনি। ‘
কবির বিছানা ছাড়ে। বড় বড় পা চালায়। লাবিবার ক্যাটস দরজার সামনে চোঁখে পড়ে।
‘ বাসাতেই আছে। ‘
‘ দেখে রাখ। আমি আসছি তোর বোনকে নিতে। ‘
কবির কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঘ্যাট করে ফোন কেটে দেয়। কাহিনী কি? জানার জন্য তানভীর কে উল্টো কল করে। কানে আসে যানবাহনের শব্দ। তানভীর ড্রাইভ করছে বুঝতে পারে। তবুও জিজ্ঞেস করে, ‘ তানভীর। কি প্রব্লেম? বল। আমি দেখছি ব্যাপারটা। ‘
‘ বউ আমার কাছে ভালোবাসার আর্জি পেশ করেছে। এটা সত্য নয়। সত্যটা হচ্ছে বউ আমার লাইফে পুরোপুরি ভাবে এন্ট্রি নিতে চাইছে। ‘
‘ দেখ বারাবাড়ি কিছু করিস না। ‘
‘ জানিনা। ‘
কবির চিন্তিত মুখে লাবিবার রুম টেনে টেনে বের করে নিয়ে আসে। জানতে চায়,
‘ কি করেছিস তুই? ‘
‘ কিছুই না। ‘
‘ কিছুই না তাহলে তানভীর এতো রেগে আছে কেনো?’
‘ জানিনা। ‘
‘ মার খাবি বলে দিলাম লাবিবা। কি করেছিস বল। তানভীর যদি এখানে এসে সিনক্রিয়েট করে ব্যপারটা কাকার কানে গেলে বারাবারি পর্যায়ে চলে যাবে। কি করেছিস বল। ‘
‘ বারাবাড়ি। ‘
‘ কতটা?’
‘ বেশি না। একটুখানি। ‘
‘ কেনো করিস এসব? তুই কি বুঝিস না?’
‘ আমি যদি অশান্তির ভেতরে থাকি তাহলে কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবো না। ‘
‘ যা ইচ্ছা কর। ভাই ভাই বলে পরে চিল্লাবি না। ‘
গাড়ির শব্দ পেয়ে লাবিবা রুমে গিয়ে মুখ লুকায়। তানভীরের সামনে যেতে চায় না। বাইরে মা আছে ভাই আছে তারা সামলে নিবে। লাবিবা বাইরে যাবে না। কিন্তু তানভীর এসে মা ভাইকে দেখেও দেখলো না। ডাইরেক্ট দরজায় এসে কড়াঘাত ফেললো। কবির কিছু বলবে বলে কাঁধে হাত রাখলো। তানভীরের কড়া চাহনিতে আওয়াজ বেরোলো না।
‘ লাবিবা। ওপেন দ্যা ডোর। কাম আউট। ‘
দরজায় পর পর কড়াঘাত পড়লো। লাবিবা দরজা খুলার সাহস পাচ্ছে না। সাবিনা এতোক্ষনে জানতে চাইলো, ‘ কি হয়েছে বাবা?’
‘ আপনার মেয়ের মতিভ্রম হয়েছে। ‘ দাঁতে দাঁত চেপে আওড়ানো দেখে সাবিনা আর কথা বললো না। লাবিবা দরজা খুলছেনা দেখে তানভীর সাবিনার দিকে এগিয়ে গেলো।
‘ আম্মু আপনার মেয়েকে দরজা খুলতে বলেন। আমি এমনিতেই ডিস্টার্ব। বেশী রেগে গেলে কি করে বসবো তখন আমাকে বলতে আসবেন না। ‘
‘ সেটা তো বুঝেছি বাবা। কিন্তু আমার মেয়েটা করেছে কি সেটা তো জানতে হবে নাকি? তুমি তো বলছো না। ‘
‘ ও কিছুই করেনি। করেছেন আপনারা। এমন একটা ছেলের সাথে মেয়েকে মিশতে দিয়েছিলেন যে বিয়ের পরেও আপনার মেয়ে সেই ছেলের মায়া ত্যাগ করতে পারছেনা। ‘
‘ এতো বড় কথা বলো না। কোনো মায়া টায়া নেই। হয়তো ছেলেটাই আমার মেয়ের পিছে পড়ে আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি। ভয় পেয়ে আছে। রাগারাগি করোনা।’
সাবিনার ডাক শুনে লাবিবা স্বস্তি পায়। দরজা খুলতেই তানভীর হুড়মুড় করে ডুকে। কব্জি চেপে বাহিরে বের করে আনে।
‘ চলো ‘
‘ কোথায়?’
‘ আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে। ‘
‘ আমি যাবো না আপনার সাথে। ‘
‘ কথা বাড়াবেনা। চলো বলছি। ‘
‘ আম্মু আমি যাবোনা। তুমি কিছু বলছোনা কেনো?ভাইয়া?’
কবির বলে, ‘ তানভীর প্লিজ। বোন আমার। ‘
‘ আমার বউ। একটা কথা বলবিনা। ‘
সাবিনার দিকে তাকাতেই সাবিনা বলে,
‘ নিয়ে যাও ওকে।’
লাবিবা চিৎকার দিয়ে উঠে। ছটফট করে হাত ছাড়ানোর জন্য। বাম হাতে কামড় বসাতেই তানভীর ছেড়ে দেয়। কিন্তু লাবিবা সুবিধা করে উঠতে পারে না। এক চান্সেই ঘাড়ে তুলে ফেলে।
খান বাড়িতে সবাই ছুটছে তানভীরের পিছু পিছু। বাড়ির পুরুষদের ফোন দেওয়া হয়েছে। ছোট ছেলে রাগের মাথায় বউ তুলে নিয়ে এসেছে। নিশ্চয় বড় সড় কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে তাঁদের মধ্যে নয়তো তাদের ধৈর্য্যবান ছেলে এমন অধৈর্য্যের পরিচয় দিতো না। লাবিবা ভয়ে কাঁপছে। তানভীর কে বকে ঝকে সোহানা বের করে দিয়েছে রুম থেকে। বর্তমানে লাবিবা শ্বাশুড়ী মা সোহানার বুকে মুখ গুঁজে আছে। তানভীরের রাগের তোপে লাবিবা এখনো কাঁপছে। এতো রাগ মানুষটার আজ নিজের চোখে দেখলো। সোহানা এতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে লাবিবা একটার ও উত্তর দিচ্ছে না। উত্তর দেবার অবস্থায় লাবিবা নেই। একটু আগে অনেক কথাই সে বলে ফেলেছে। তার আগে খেয়েছে পর পর দু গালে দুটো থাপ্পড়। তানভীর রুমে এনেই দরজা বন্ধ করে দেয়। রাগের মাথায় লাবিবার দু গালে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। টসটসে গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে যায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে লাবিবা। হিযআপের উপর দিয়েই চুলের মুঠি চেপে ধরে শক্ত করে, ব্যথায় লাবিবা চিৎকার করে উঠে। লাবিবার চিৎকারের শব্দে তানভীর আরো রেগে যায়। মুখের উপর মুখ এনে বলে,
‘ বাপ বেটিতে কি পেয়েছিস কি আমাকে? কি শুরু করেছিস আমার সাথে এগুলো? বল? উত্তর দে। আমার কথা কেনো শুনিস না? কখনো কোন বিষয়ে না করেছি তোকে? কোন বাধা এসেছে আমার থেকে? শুধু বলেছিলাম ঐ ফাহাদ্দাইর সাথে যোগাযোগ রাখবি না। ইভেন আমি ছাড়া কোনো বাইরের ছেলেই যেনো তোর কাছাকাছি না আসতে পারে। তাঁদের কেই জায়গা দিয়ে রেখেছিস তুই। নোংরামো শুরু করেছিস! আমাকে কি তোর চোখে পড়ে না? ‘
‘চুল ছাড়ুন ব্যথা পাচ্ছি আমি। ‘
‘ ব্যথা পাবার জন্য ই ধরেছি। ব্যথা তোর একার ই লাগে? আমার লাগে না? ‘
আরো শক্ত করে চেপে ধরতেই চিৎকার করে উঠে লাবিবা। ‘ আহ খান সাহেব!’ চোখ বন্ধ করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতেই চুলের গোছা ছেড়ে দেয় তানভীর। কিন্তু উপর থেকে এক বিন্দু সরে দাঁড়ায় না। লাবিবা কাঁদতে কাঁদতেই বলে , ‘ এতো জেলাসি কেনো আপনার? আমাকে তো ভালোই বাসেন না। ‘
‘ একবার ও বলেছি তোকে ভালোবাসি না? কতটা ভালোবাসি তুই কল্পনাও করতে পারবিনা।যন্ত্রনা কর,ব্যাথা দে, বকা দে গালি দে যা ইচ্ছে কর কিন্তু কোনো পরপুরুষ কে জীবনে জড়াতে কেনো যাস? কয়েকটা দিন তোর সহ্য হয়না তাইনা? আর তোর জন্য আমি তিনবছর ধরে ওয়েট করতে পারি। ‘
‘ আমি কাউকে জড়াচ্ছি না। শুধু শুধু আমাকে অপবাদ দিবেন না। আমি এতোটা গাধা না। কিন্তু গাধামো টা করে ফেলেছি ভূলবশত। আপনার জন্যই করেছি। না আপনি আমার প্রতি কেয়ার দেখাতেন না আমি আপনার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়তাম। বিয়ের সময় আব্বুর সাথে কি কন্ট্রাক করেছেন তিন বছর দূরে থাকবেন নাকি চার বছর দূরে থাকবেন আমাকে বলেছিলেন সেসব কথা? নাকি আপনি এটা অস্বীকার করবেন আপনার প্রতি আমি আগে থেকেই দূর্বল সেটা আপনার অজানা? আমার অপরাধ কোনটা? আমি সত্যটা মুখের উপর বলি সেটা? কসম করে বলছি আপনার জন্য কেনো আমার আগে থেকে সফট কর্ণার সৃষ্টি হয়েছিলো আমি জানি না। আমার এতে কোনো হাত নেই। যখন বিয়েটা হলো তখন আমি এটাকেই আগলে ধরতে চেয়েছিলাম। বাঙালি মেয়েদের দুর্বলতা ঠিক এই জায়গায়। কিন্তু যখন বুঝলাম আমার উপর বিরক্ত হয়ে দূরে সরে গেলেন তখন আমি আমার ভূলটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু একটা উত্তর আমি আপনার থেকে চাই । আপনি কেনো আমাকে একা ছাড়েন নি? সব সময় আমার পাশে ছায়া হয়ে থেকেছেন অথচ সামনে আসেন নি। মিথ্যা বলতে চাইবেন না। আপনি একশ হাত দূরে থাকলেও আমি আপনার উপস্থিতি বুঝতে পারি। যদিও সেই উত্তর আমার জানা। আপনি বলবেন দায়িত্ব থেকে এটা করেছেন। শুধু দায়িত্ববোধ থাকলে লোক লাগিয়ে দিতেন নিজে আসতেন না। সেসব যাই হোক। আমি অনেক জালিয়েছি আপনাকে। আপনার সম্মান নষ্ট হয় এমন কাজ করেছি। সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনার আর কোনো প্রব্লেম হোক আমি চাইনা। আপনার কাছে আমি আমার মানসিক শান্তি ভিক্ষা চাইছি। দম বন্ধ লাগে। মরে যাই আমি।প্লিজ মুক্তি দিন আমায়। আপনার কোনো সম্পত্তি আমি নিবো না প্রমিজ আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। ‘
তৃতীয় থাপ্পড় টা এই সময় ঠিক বাম গালে পড়ে। ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। লাবিবা চোখ কুঁচকে শক্ত হাতে দেওয়া ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করে। ডিভোর্সের কথা শুনে তানভীরের মেজাজ সপ্তম আকাশে।
‘ ডিভোর্স নিয়ে কি করবি তুই? তোর বাপের ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে করবি? কান খোলে শোনে রাখ। তোকে ডিভোর্স দিবো না আমি। কোনো মুক্তি নেই তোর। তোর এইসব অবাধ্যপনা ছুটাবো আমি। ‘
রক্ত জমা ঠোঁটে তাচ্ছিল্য হাসে লাবিবা ।
‘ ভালোবাসলে মানুষ ছেচড়া হয়ে যায় তাইনা? ছিহ! কত ছেচড়া আমি!’
চারপাশে তাকিয়ে ড্রীম লাইটের মৃদু লাল আলোয় ভালো ভাবে দেখে ঘরটা ।
— আপনার রুম বুঝি? নাকি গেষ্ট রুমে নিয়ে এসেছেন আমায়? ভাগ্যিস অবাধ্যপনা করেছিলাম! আপনি যে মানুষ! আবাধ্যপনা না করলে বুঝি আপনার অন্দরমহলে ঢুকার ভাগ্য টাও আমার হতো না। আমার দুর্ভাগ্য! অসময়ে লক্ষ্যে পৌঁছে আমার মন একটুও আনন্দিত না।
লাবিবার কষ্ট ভরা কন্ঠ ছুঁয়ে দিতে সক্ষম হয় তানভীরকে। ভূল তার ও কম নয়। আমরা যখন একটা জিনিস খুব করে চাই তখন প্রতিনিয়ত ছটফট করি। সময়ের সাথে সাথে যখন বুঝে যাই এ আমার হবার নয় তখন না চাইতেও একটা বিতৃষ্ণা চলে আসে কারণ তখন মস্তিষ্ক সেটাই বারবার রিকভার করে। একদিন হুটহাট পেয়ে গেলেও ততোটা তৃপ্তি আসেনা যতটা তার পাওয়ার প্রবল ইচ্ছার সময় পেলে হতো। তানভীর নিজের কথা ভেবে দূরে সরে এসেছে। লাবিবাকেও সময় দিতে চেয়েছে। অথচ এই সিদ্ধান্ত লাবিবার মনে উল্টো প্রভাব ফেলতে পারে সে কথা মাথায় আসেনি। রাগটা ক্রমশ কমে আসে। কিন্তু তানভীর ও ভাঙবে না। কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে কাঁচের ফুলের জারটা এক লাথিতে ভেঙে যায়। চমকে উঠে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় লাবিবা।
দরজার সামনে সোহানা অনেকক্ষন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছিলো। সাউন্ড প্রুফ রুম! ভেতরে কি হচ্ছে তার ধারণাও ছিলো না। ছেলেকে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি করে রুমে ঢুকে ফ্লোরে ভাঙা কাঁচের মেলা চোখে পড়ে। লাবিবাকে জড়িয়ে ধরতেই তাঁকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। মাঝে মাঝে কেঁপে কেপেও উঠে। কি হয়েছে? কেনো এতো রাগ? কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না।
রাত করে বাড়ি ফিরে এই ঘটনা শুনে ইসমাইল অস্থির হয়ে যায়। পারে না তখনই খান বাড়িতে আসতে। তানভীরের সাথে যে কথাই থাক এমপি সাহেবের কান অব্দি দেওয়া যাবে না। বেয়াই বাড়ি এতো রাতে ব্যপারটা খুবই খারাপ দেখায়। কিন্তু সেখানে তার মেয়ে আছে। ভালোয় ভালোয় আনলে সেটা অন্য কথা। কিন্তু রাগের মাথায় আনাতে সে একটুও ভরসা পাচ্ছে না। ফোনের উপর ফোন করেই যাচ্ছে। ফিরোজ তাকে আস্বস্ত করে তার মেয়ে ঠিক আছে। তার কাছেই আছে।
জবেদা ঝাড়ু দিচ্ছে মেঝেটা। বড় পানির জার! কাঁচা ফুলগুলো রাখা হয়। সেই জারটা ভেঙে টুকরো টুকরো। খাটের নিচেও ছড়িয়ে গেছে দু একটা। সেগুলো বের করতে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে জবেদা। মেঝেতে পানি ছড়িয়ে গেছে। জবেদার শাড়ির পাড় ও ভিজে গেলো কিছুটা। লাবিবা কোণায় বসে দেখছিলো চুপচাপ। চাঁপা গলায় ডাকলো, ‘ শোনো। ‘ জবেদা হাসি মুখে উত্তর করলো,
‘ জী ভাবী। ‘
‘ তুমি কে?’
‘ আমি হলাম এই বাড়ির সবার হেল্পিং হ্যান্ড। জবেদা। ‘
‘ জবেদা আপা। এটা কার রুম?’
‘ আপনার আর ছোট ভাইজানের রুম। সুন্দর গোছগাছ করা না? আমিই গুছায়ে রাখি প্রতিদিন। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
‘ রুম পরিস্কার করে গেলাম। আপনি বিছানায় গিয়ে বসেন ভাবী। ‘
‘ তুমি যাও। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
তামিম এসে বেশ বকাঝকা করে তানভীর কে। নিতু ইসলাম ও হাজির হয়। সোহানাও ছাড় দেয়না। ফিরোজ খান ছেলেকে কোনো প্রশ্ন করে না। তবে উত্তরের আশায় বসে। যদিও তিনি ভালো করেই জানেন উত্তর দিবেনা। দেওয়া উচিত ও না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার সমস্যা নিজেদেরকেই মিটিয়ে নিতে হয়। গার্ডিয়ান অব্দি পৌঁছানোর প্রয়োজন নেই। যত বেশি এটা নিয়ে আলোচনা হবে ততো বেশি ঘেটে ঘ হবে। তিনি কিছু মনে না করলেও বাকি রা খুব রেগে আছে। প্রশ্নের ঝুড়ি থামবেনা বুঝতে পেরে তিনি মুখ খুলেন।
— তানভীর। ঝামেলার সৃষ্টি করেছো গোপনে গোপনে। মিমাংসাও করবে গোপনে গোপনে।
— জী পাপা।
— সোহানা বউমাকে খায়িয়েছো?
— খেতে চায়না। তবুও জোর করাতে একটু খেলো।
— তানভীর সকালে যেনো আমি কোনো ঝামেলা না দেখি। সবাই যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
নিতু ইসলাম বাগড়া দেয়।
— তানভীর। তুমি লাবিবার কাছে যাবে না। ওর ভয় কমুক তারপর যাবে। এখন যাওয়া ঠিক হবে না।
— কথা বলে আসি খালামনি।
— সকালে বলো। তামিমের রুমে গিয়ে ঘুমাও।
— জরুরী কথা আছে খালামনি। শেষ করে আসি।
— এখন না যাওয়াই ভালো তানভীর।
ফিরোজ খান ডাকেন,– মিতু।
— জি দুলাভাই।
— ভয় পাওয়া ভালো। কিন্তু ভয়টা লালন করা ভালো না। ওকে যেতে দাও।
— জি দুলাভাই।
— তানভীর যাও বউমার কাছে যাও।
— জি পাপা।
— শোনো । তুমি যা করেছো ঠিক করোনি। গায়ে হাত তোলে তো একদমি ঠিক করনি। নেক্সট টাইম যেনো আমি না দেখি।
— জি পাপা।
— মিউচুয়াল হয়ে যাও। না হলে বোঝাও। না বুঝলে কান ধরো,সরি বলো। পা ধরে ক্ষমা চাও। পা ধরতে লজ্জা করো না। বউয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইলে কখনো সম্মান যায়না বরং বাড়ে। কারণ এই কাজটা সবাই করতে পারে না।
চলবে___