ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৭৪+৭৫

0
973

#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো

(৭৪)
রোজীর মা বাবা জামাইয়ের ফোন পেয়ে খান বাড়িতে এসেছে। তামিম নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। রোজীর বাবা মাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। সবটা দোষ তাদের উপর ই গড়িয়ে দিয়েছে। তামিমের মতে সন্তান যে হালেই থাকুক না কেনো তাকে দেখেশুনে রাখা বাবা মার দায়িত্ব। মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া যেমন জরুরী সঠিক পথ দেখানোও তেমন জরুরী। এমন বাবা মা না থাকুক যারা মেয়ের সর্বনাশের কথা জেনেও তাকে আটকায় না। সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে না।
রোজীর বাবা মুখ তুলে তাকাতে পারছেন না। মাথা নিচু করে আছেন। রোজীর মা মুখে আঁচল চেপে গুনগুন করে কাঁদছেন। সোহানা ইসলাম চুপচাপ বসে আছেন। অবশ্য এসব নিউজ পাওয়ার পর পর ই রিসোর্ট বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছেন ‌। তার মনে একটা কথাই বারবার ফিরে ফিরে আসছে , ‘ সব আলোই সুখের আলো হয়না। ‘ লাবিবা ঠোঁট ফুলিয়ে বসে একহাতে ফোনে টাইপ করছে। চ্যাট বক্সে আছে তানভীরের সাথে। মূলত এখানে কি হচ্ছে কি না হচ্ছে সব তানভীরকে ইনফর্ম করছে। তানভীর তামিমের ডাক পেয়ে কলেজ থেকে ছুটে গিয়েছে।

কিছুক্ষন বাদে তামিম বাসায় ফিরলো। তীব্র গতিতে রোজীর বাবা মাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু তামিমকে দেখে মাথা নিচু করে রাখা রোজীর বাবা অপরাধী গলায় জানতে চাইলো,
‘ আমার মেয়েটাকে কোথায় রেখে এলে বাবা?’
‘ যেখানে তার থাকার কথা সেখানেই আছে। ‘
গম্ভীর গলায় উত্তরটুকু করেই তামিম উপরে চলে গেলো।
তামিমের রুমের টুং টাং আওয়াজ পেয়ে সোহানা লাবিবাকে কাছে ডাকলো।
‘ উপরে যাও তো মা। দেখো আমার ছেলেটা যেনো নিজেকে আঘাত না করে। ‘
লাবিবা মাথা নাড়িয়ে পা বাড়ালো। সোহানা থায় বসে থাকলো। উঠার কোনো ইচ্ছে দেখা গেলো না।

লাবিবা দরজার সামনে আসতেই দেখে রুমের অবস্থা পুরো খারাপ করে ফেলেছে তামিম। এদিক সেদিক হন্যে হয়ে খুঁজছে। লাবিবা ডাকলো, ‘ ভাই….’
‘ ওহ। ছোট বউ। আসো আমাকে হেল্প করো। ফ্লোরে যে জিনিস গুলো আছে একটু একসাইডে গুছিয়ে রাখো। ‘
লাবিবা গুছাতে লাগলো যত তামিম জিনিস পত্র নতুন করে ততো ছুঁড়তে লাগলো। লাবিবা মনে মনে বললো,
‘ এরা দুই ভাই জিনিস ছুড়া আর পাগলামি সমান সমান।’
তামিম বহু সময় ব্যায় করার পর সফল হলো। খাটের ড্রয়ারে কম্ফোটের নিচ থেকে একটা বক্স বের করলো। বক্স খুলতেই বেরিয়ে এলো কাঙ্খিত জিনিস। তামিম রোজীর বুদ্ধির তারিফ করে তাচ্ছিল্য হাসলো। কেউই হয়তো ভাবতে পারবেনা সমস্ত ঘরে এতো জায়গা রেখে এখানেও কেউ লুকাতে পারে।

লাবিবা দেখেই মুখ চেপে ধরলো। হাত দিতে গেলেই তামিম হাত ধরে ফেললো।
‘ হাত দিও না। ‘
‘ ভাইয়া এগুলোই ড্রাগস? প্রথম দেখলাম। কি নাম?’
‘ ইয়াবা, হিরোইন। ‘
‘ তাঐ মাঐ জানতো? নিষেধ করেনি? এতোদিন তো আমাদের কাউকেও কিছু বলেনি। ‘
‘ এখন এখান থেকে যাও। আমি একটু একা থাকবো। ‘
‘ বক্সটা নিয়ে যাই? সবাইকে দেখাবো?’
তামিম চোখ মুখ খিচে তাকালো।
‘ যেতে বলেছিনা আমি?’
ধমক খেয়ে লাবিবা দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তামিমের জন্য ভীষণ দুঃখ লাগলো। এই অকাজ টাতো সে নিজে করেছিলো। এতো বড় কথা লুকিয়ে রেখেছিলো। যদি জানতো রোজী ড্রাগ এডিক্টেড তাহলে ভুলেও তামিমের সাথে লিংক হতে দিতো না।

তামিম জোর কদমে এসে দরজা লক করে বীভষ্য চিৎকার করলো। নিজেকে দমাতে না পেরে নিজেই নিজের চুল টেনে ধরলো। রিপোর্ট টা এখনো চোখের সামনে ভাসছে। রোজীর কথা মোতাবেক সন্দেহ তালিকায় ছিলো রোজী অন্য কারো জন্য হয়তোবা তার প্রাক্তনের জন্য অসুস্থ। বন্ধু ডাক্তার হান্নান যখন বললো,
‘ মেয়েদের ইয়াবার নেশা শুরু হয় ঘুমের বড়ি থেকে। নানা ধরনের মানসিক যন্ত্রণার কারণে তারা যখন রাতে ঘুমাতে পারে না তখন তারা ঘুমের বড়ির আশ্রয় নেয়। তারপর ধীরে ধীরে ইয়াবার মতো অন্যান্য মাদকেও আসক্ত হয়ে যায়। ইয়াবা খেলে একজন মানুষের খিদে কমে যায়। সে তখন কম খায়। তার পেশীকে ক্ষয় করে ফেলে। মাংসপেশি শুকিয়ে গেলে একটু শুকনা মনে হয়, গাল ভেঙে যায়। হেরোইনের বেলাতেও দ্রুত গতিতে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। কারণ তারা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে পারে না। তাদের খাওয়ার প্রয়োজনও খুব একটা পড়ে না। কারণ হেরোইন বা ফেনসিডিল খেলে ক্ষুধা কেটে যায়। তাদের সাধারণ পুষ্টি চাহিদাও পূরণ হয় না। যার কারণে তাদের শরীরে সব ধরনের ভিটামিনের অভাব দেখা দিতে শুরু করে।
ফেনসিডিল ও হেরোইন খেলে শরীরে ঘুম ঘুম ভাব আসে। তন্দ্রার মতো হয়। একটা জায়গায় বসে তারা ঝিমুতে থাকে। যতদূর মনে হয় ভাবী অনেক দিন থেকে ড্রাগ সেবন করছে । ইয়াবা খেলে শরীরে একটা তাপ তৈরি হয় যা কিডনির ক্ষতি করতে পারে। যেহেতু এটিকে ধোঁয়া হিসেবে নেওয়া হচ্ছে তাই ফুসফুসে পানিও জমে। ভাবীর কিডনি এখনো অক্ষত থাকলেও ফুসফুসে পানি জমেছে। ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস হবার আগেই যে জানতে পেরেছিস আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর। ‘
সেই মুহূর্তে তামিম স্তব্দ হয়ে রোজীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। একজন এডাল্ট বিবেকধারী হয়ে কিভাবে নিজের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে? আর কিভাবেই বা জেনে বুঝে তামিমের জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারে ভাবতে পারছেনা। তামিমের জীবনে কম বড় ঝড় বয়ে যায়নি। সেতো মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়নি। তামিমকে তার পরিবার সামলিয়েছে। তাহলে রোজীর পরিবার কেনো মেয়েকে দেখে রাখলো না। বরং রোজীর প্রথম বিয়ে তারাই দিয়েছে। লোভে পড়ে খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে দিয়েছে। রোজীর আজকের যে অবস্থা সেজন্য একমাত্র তার ফ্যামিলিই দায়ী। রোজীর অবস্থা জানার পরও আবার লোভে পড়ে তামিমের হাতে তুলে দিয়েছে। এরা পেয়েছেটা কি? যেখানে নিজের মেয়ের জীবন অনিশ্চিত তখন সাহস হয় কি করে আরেকজনের দিকে হাত বাড়াতে? রাগের বশে রোজীর বাবাকে তার আসল জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছে। সন্তানের শত্রু যখন নিজের বাবা মা ই হয় তখন সন্তানের মৃত্যু নিশ্চিত।

তামিম নিজেকে সামলে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে। রোজীর মা সোহানা ইসলামের হাত ধরে রোজীর বিষয়ে বলে যাচ্ছে। আর রোজীর বাবা মাথা নাড়িয়ে সায় দিচ্ছে। তাঁদের কথাবার্তা থেমে গেলো তামিম এসে দাঁড়াতেই। রোজীর বাবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে মোটেই তামিম টললো না। বরং প্রস্তাব জানালো, ‘ বাবা, মা। এখন আপনাদের মেয়েকে নিয়ে তো আর সংসার করা যাচ্ছে না। এমনিতেই আপনাদের মতো মিডিল ক্লাস ফ্যামিলিতে বিয়ে করে নিজের মান খুইয়েছি। এখন মাদকাসক্ত বউ ব্যাপারটা লোকজনকে জানিয়ে আর জলটা আর ঘোলা করতে চাইছিনা। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো। মেয়েকে রিহাব থেকে নিয়ে বাসায় চলে যাবেন। ‘
রোজীর মা চিৎকার করে উঠে, ‘ এসব কি বলছো বাবা? আমার মেয়ের দ্বিতীয় সংসার এটা। ‘
‘ কোনো ব্যাপার না। কিছু টাকা দিয়ে দিবো অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিবেন। লোভে পড়েই তো আজ এই অবস্থা। আমার সাথে পাঁচ দিন পর দেখা করবেন। কাবিনের টাকা সহ ডিভোর্স পেপার সাথে নিয়ে যাবেন। এখন আসতে পারেন। ‘
রোজীর মা সোহানার হাত ঝাঁকিয়ে বলে, ‘ বেয়ান আপনি কিছু বলেন। আমার মেয়ে তো আপনার ও মেয়ে। জামাই বাবাজিকে বোঝান।’
সোহানা একটা কথাও বলেনা।
রোজীর বাবা কাঁদতে কাঁদতে তামিমের পা জড়িয়ে ধরে , ‘ এতো বড় সর্বনাশ করোনা বাবা। আমার মেয়েটাকে তোমার পায়ে ঠায় দাও। বড্ড ভালো মেয়ে আমার। ও নিজে থেকে কোনো পাপ করেনি। ওকে আমরাই পাপের দিকে ঠেলে দিয়েছি। ওকে বুঝতে চায় নি। আমরা তো জানতাম না আমার মেয়েটা এতোটা যন্ত্রনায় দিন পার করছে। যখন ড্রাগ সমেত পেলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য ই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি। আমার মেয়েটাকে একটু বুঝো বাবা। এতো বড়ো শাস্তি দিও না। জেনে বুঝে আমরা পাপ করেছি আমাদের তুমি যা বলার বলো আমার মেয়েটাকে ঠায় দাও বাবা। ‘
‘ আমার একটা শর্ত আছে। ‘
‘ তোমার যে কোনো শর্তে আমি রাজি বাবা। শুধু আমার মেয়েটাকে আবার সংসার ছাড়া করো না। ‘
‘ সম্পর্ক শেষ করতে হবে আমার রোজের সাথে। সারাজীবনের মতো। ‘
কথাটা শোনা মাত্রই রোজীর বাবা মার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। রোজীর মা বলে উঠে,
‘ কী বলছো বাবা? মেয়েকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো আমরা?’
‘ যেভাবে মেয়ের প্রথম সংসারের সময় ছিলেন। তখন মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে বছরের পর বছর না দেখে কাটিয়েছেন। আর এখন না হয় আপনার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমি আপনাদের থেকে তাকে সারাজীবনের জন্য দূরে সরিয়ে দিলাম। ‘
রোজীর বাবা মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তামিমের দিকে। তামিম তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো, ‘ ফোনে মিসবিহেভ করার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কি করবো? মাথা ঠিক ছিলো না। বার বার একই ভূল কেনো করেন আপনারা? বড়লোক বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন অনেক পাবেন। ছোট ছেলেরও লাইফ সেট । অথচ মেয়েটাই মরতে বসেছিলো। তারপর যখন এমপির ছেলের প্রস্তাব এলো মেয়ে বিপথ যাত্রী জেনেও লোভ সামলাতে পারলেন না। একবার ভাবলেন না সবটা জানার পর আপনার মেয়ের আদৌ এখানে জায়গাটা হবে কিনা। যার গোড়াতেই মাটি নেই তাকে দিয়ে ফল লাভের আশা ছাড়ুন। অপশন দুটো। হয় মেয়ে সমেত টাকা নিয়ে চলে যান। নাহয় মেয়েকে ভালো রেখে নিজেরা দূরে কেটে পড়ুন। ‘
রোজীর বাবা চোঁখের জল মুছে নিলো। বললো,
‘ তাই হবে বাবা। আমরা আর যোগাযোগ রাখবোনা। মেয়েটাকে একবার দেখতে চাই বাবা। ‘
‘ তার ঠিকানা পাবেন না। আপনার ছেলে আসছে আপনাদের নিতে। ছেলের সাথে চলে যান। আর কখনো এদিক মুখী হবেন না। ‘

চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৭৫)
‘ আমাদের শ্রীমঙ্গল যেতে হবে রেডি হয়ে নাও। ‘
‘ ভাইয়া আপু এই সিচুয়েশনে আর আমরা বেড়াতে যাবো?’
‘ ব্যাপার না। ‘
‘ আপনার কষ্ট হচ্ছে না? ভাইয়ের কষ্টে আপনার একটু ও কষ্ট হচ্ছে না?’
‘ তুমি কষ্ট পাচ্ছো?’
তানভীর লাবিবার দিকে ঘুরে তাকালো। লাবিবা মাথা নিচু করে নিলো। ভীষন ইমোশনাল মেয়েটা। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারেনা।
‘ এসব আমার জন্য নতুন কিছু না। একটা কাজে যাচ্ছি। একদিনেই চলে আসবো। রেডি হয়ে নাও। ‘
‘ মামুনি বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে। ‘
‘ আমি রিনিউ করছি। হাফ আউয়ারের মধ্যে নিচে আসবে। কুইক। ‘
হুকুম দিয়ে তানভীর বেরিয়ে যায়। লাবিবা ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়েও দুবার বসে পরে। তার কিছুই ভালো লাগছে না। রোজীর জন্য মন কেমন করছে। তানভীরের হটাৎ কিসের কাজ পরে গেলো তাও আবার শ্রীমঙ্গলেই? লাবিবা বুঝে উঠতে পারছেনা। হাফ আউয়ার অনেক আগেই শেষ। লাবিবার ফোন বেজে উঠলো। তানভীর রিতীমতো কল দিচ্ছে। লাবিবা ধরলো না। তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নিচে নামলো। গাড়িতে তানভীর বসে আছে। সোহানা ওদের এগিয়ে দিতে এলো। ভীষন স্বাভাবিক লাগছে তাকে। নিত্য দিনের মতোই দামী শাড়ি, জুয়েলারি,মেকআপে আগাগোড়া সুন্দরী একজন মহিলা। বয়সের ছাপ পড়েছে কিন্তু সৌন্দর্য কমেনি। হলপ করে বলা যায় এই নারী যৌবনে নির্দিধায় ছিলেন লাস্যময়ী। বুদ্ধিমতী,ক্ষমতাধারী। নিজের ছায়ায় জড়িয়ে নিতে সদা প্রস্তুত। লাবিবা শ্বাশুড়িকে আদর্শ হিসেবে মানে। লাবিবাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সোহানা হাসে। যে হাসিতে কোনো প্রাণ নেই। লাবিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ সাবধানে থেকো। তানভীরের খেয়াল রেখো। ‘
বলার সময় কন্ঠ যেনো ভেঙে এলো। লাবিবা ঝটপট গাড়িতে উঠে পড়লো। বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করলো না। যেসব ব্যাপারে মানুষ ইমোশনাল হয়ে পড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা এড়িয়ে যাওয়াই উচিত।

কটেজে পৌঁছে লাবিবা ধপ করে বসে পড়লো। বসা থেকে শুয়েও পড়লো। তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। কিচ্ছুটি ইচ্ছা করছে না। মনের উপর জোর দিয়ে এতোদূর পর্যন্ত এসেছে। এতোক্ষন যাবৎ তানভীরের নিরবতা সহ্য করেছে। যে মানুষটার সাথে ব্যবধানে চার হাত দূরত্ব থাকার পরেও তার কাপড়ের একটা অংশ হলেও মুঠোয় রাখে। সে মানুষ টা এতোক্ষন পাশে থাকার পরেও যেনো ছিলোই না। এতোটা নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তানভীর লাগেজ থেকে টি শার্ট আর একটি হাফ কোয়ার্টার প্যান্ট বের করে পড়ে নিলো। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো। ততোক্ষনে অনেক টুকু সময় চলে গেছে। তানভীর টাওয়েলে মাথা মুছতে মুছতে ফোন হাতে নিয়ে রুম ছেড়ে বারান্দায় চলে গেলো। যাবার সময় একবার লাবিবার দিকে চোখ বুলিয়ে গেলো। লাবিবা তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে। কটেজটা পুরোটা কাঠ দিয়ে তৈরী। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে এটা কারো নিজস্ব বাড়ি। পুরো স্ট্রাকচার কাঠ এবং বাঁশ দ্বারা তৈরি হলেও আভিজাত্যে ভরপুর। ঝাড় বাতির বদলে উপরে ঝুলছে শামুক দ্বারা তৈরী ফুলের আকারে তৈরী। লাবিবা এটার নাম দিলো ঝাড়ফুল। তানভীর কথা শেষ করে এসে দেখে লাবিবা আগের মতোই শুয়ে আছে। তানভীর এগিয়ে গিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়ালো। লাবিবা তখন আনমনে ঝুলন্ত শামুক গুনতে ব্যস্ত।
‘ তুমি কি ঠিক করেছো এভাবেই পড়ে থাকবে ? ‘
লাবিবা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তানভীর পুরো হিরো স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে। দু কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ায় হাঁটুর নিচ থেকে ভেজা লোমগুলো ফর্সা পায়ের উপর লেপ্টে আছে। মারাত্মক ভাবে আকর্ষন করে লাবিবাকে। দৃষ্টি সেদিকেই আবদ্ধ হয়ে গেছে। তানভীর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার পায়ে কি দেখার আছে এমন ভাবে ? হুট করেই লাবিবা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো। ‘ হ্যায় ম্যা তো মারযাওয়া ‘ বলে উল্টে ঘুরে গেলো। আর কোনো সাড়া শব্দ নেই। তানভীর বুঝে উঠতে পারলো না। এর আবার কি হলো?
‘ উঠো। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। ‘
‘ উহু উঠবোনা। আপনি এতো সুন্দর কেনো? ‘
‘ প্রশ্ন না করে শুকরিয়া আদায় করো। ‘
‘ কেনো? ‘
‘ আমি সুন্দর বলেই আমার অংশ হিসেবে তুমি সুন্দরী হয়ে জন্মেছো। এবার উঠো। ড্রেসে ধুলো আর জীবাণু লেগে আছে। গাড়িতে জানালা খুলে রাখতে হয়েছে তোমার জন্য। ‘
‘ আরেকটু পরে। এখন না। ‘
‘ তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো তোমার ডাস্ট এলার্জি আছে। আমি তিন পর্যন্ত গুনবো। এরমধ্যে উঠবে নয়তো আমি উঠাবো। ‘
‘ আমি তো চাই আপনি উঠান। ‘
তানভীর বুঝলো এ কথা শোনবে না। লাবিবার হাত ধরে টান দিলো। জোর করেও উঠাতে পারলো না। শেষমেষ কোলে তুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোলো।

লাবিবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে তানভীর লাগেজ খুলে হট পিংক কালারের একটা নেটের শাড়ি আর সিকুয়েন্সের হুয়াইট শাড়ি বের করে রেখেছে। শাড়িটা হাতে নিয়ে লাবিবা মুচকি হাসলো। এই শাড়িটা তাকে তার মামাশ্বশুড় গিফট করেছে বিয়েতে। স্টোনের কারুকাজে ভীষন সুন্দর তবে হালকা ভারী শাড়িটি। লাবিবা এতোদিনে শাড়ি পড়া মোটামুটি শিখে গেছে। তবে কুঁচি ঠিক করে দিতে একজন লাগে। লাবিবা কুঁচি ধরে তানভীরকে ডাকলো। তানভীর নেই।‌ কোথায় গেলো? চেয়ার টেনে বসে লাবিবা কুঁচি ধরে তানভীরের জন্য ওয়েট করতে লাগলো। দরজা খুলে তানভীর দেখলো লাবিবা শাড়ি ধরে ঠোঁট উল্টে বসে আছে। লাবিবা দেখা মাত্রই ডাকলো। তানভীর এগুলো না। বরং দু কদম পিছিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। কাকে যেনো বললো, ‘ এখানেই রাখো। ‘ কি রাখবে? দেখার জন্য লাবিবা কুঁচি সমেত ধরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তানভীরের পাশেই রাখা খাবার ট্রলি। আর একজন লোক বেরিয়ে যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। তানভীর খাবার ট্রলিটা ভেতরে নিয়ে এলো। লাবিবা না বলতেই কুঁচি ধরে সামনে বসে পড়লো। একটা একটা কুঁচি আরেকটার সাথে সমান করতে লাগলো। তানভীর ভীষণ চুপচাপ। লাবিবা জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনার কি কাজে এসেছেন এখানে ?’
‘ আমার বউটার মন ভালো করতে। ‘
‘ আমি বুঝতে পেরেছি। আর কি কাজ?’
‘ বউকে খুশি রাখা। ‘
‘ জায়গাটা ভীষন সুন্দর। আমি সত্যি খুশি হয়েছি। ইচ্ছে করছে এরকম একটা বাড়ি বানিয়ে থেকে যাই। ‘
‘ থেকে যাও। ‘
‘ সম্ভব নাকি?’
‘ তুমি চাইলে সম্ভব। বসো লাঞ্চ করে নাও। ‘

লাবিবা হাত ধুয়ে খেতে বসলো। ভর্তা ভাত আর মুরগীর একটা তরকারী দিয়েছে। লাবিবা মুখে দিয়ে বললো,
‘ উমম, ভীষন টেস্ট। কে রান্নাটা করেছে? তার হাতে চুমু খেতে চাই। ‘
‘ আকাশী খালা। ‘
‘ আপনি চিনেন? ‘
‘ হুম। অনেক বছর থেকে রান্না করছে এখানে। ‘
‘ আপনার এবার নিয়ে কত বার হলো এখানে আসার?’
‘ ছোট থেকেই আসছি। ‘
‘ তাহলে এই রিসোর্টের বয়স কতো?’
‘ টুয়েনটি ফাইভ। ‘
লাবিবা চোখ পিটপিট করলো। মুখের খাবার টা গিলে প্রশ্ন করলো, ‘ এই রিসোর্টের মালিক কি আপনার কোন রিলেটিভস অর পরিচিতদের কেউ ? ‘
তানভীর মুচকি হাসলো। লাবিবা ঝটপট খাবার শেষ করে রুমের বাইরে ছুটে গেলো। তানভীর বাকী খাবারটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে খেতে লাগলো।

রিসোর্টের ভেতরে পুরোটাই ফুলের বাগান। বাইরেরটা চা বাগান। রিসোর্টটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত। সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কয়েক মিটার দূরত্ব রেখে কটেজ গুলো তৈরী করা হয়েছে। পুরো রিসোর্টে এগারোটা কটেজ। লাবিবা ঘুরে ঘুরে দেখলো। রিসিপশনের সাথেই কিচেন রয়েছে। সেখানেই খাবারের অর্ডার দিতে হয়। রিসিপশনের উপরে বড় করে লেখা
‘ সোহানা কটেজ। ‘ লাবিবা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে রিসোর্ট এর গেইটে চলে গেলো। সেখানে আরো বড় বোর্ড বসানো হয়েছে, ‘ SOHANA COTTAGE ‘ .
লাবিবা যেমন অবাক হলো তেমন খুশিতে যেনো মুখ থেকে কথা আসছে না। দৌড়ে রুমে ফিরে এলো। তানভীর বিছানায় শুয়েছে একটু ঘুমোবে বলে। লাবিবার অপেক্ষা তেই ছিলো। দরজা লক করে লাবিবা এক লাফে তানভীরের উপর উঠে এলো। বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তানভীর ঘুরে গিয়ে লাবিবাকে উপর থেকে নিচে নিয়ে এসে বালিশের উপর মাথা রাখলো। ঠোঁটের উপর চুমু দিয়ে বললো,
‘ য়্যা য়্যু সারপ্রাইজড ?’
‘ এতোদিন নিয়ে আসেননি কেনো? কেনো বলেননি আমাদের এরকম একটা জায়গায় রিসোর্ট আছে? ‘
তানভীর হাসলো, ‘ এর থেকেও সুন্দর আরেকটা রিসোর্ট আছে। ‘
‘ কোথায়?’
‘ বান্দরবানে। পাপা তার ত্রিশতম এনিভার্সারিতে মম কে গিফট করেছে। ‘
‘ আই ফিল সামথিং হেয়ার। ‘
‘ এই কটেজে একবার আমরা দীর্ঘ চারমাস ছিলাম। পাপা একটা মামলাতে ফেসে গিয়েছিলো। পাপা চেয়েছিলো একা থাকতে কিন্তু মম পাপাকে ছাড়া কিছুদিনেই মরিয়া হয়ে আমাদের দুজনকে নিয়ে পাপার কাছে চলে আসে। তখন মাত্র চারটা কটেজ ছিলো। মমের এই জায়গাটা বেশ ভালো লেগে যায় সেজন্য পাশের জমি গুলো কিনে রিসোর্ট টা বড় আকারে করা হয়। আমি এই কটেজের প্রত্যেকটা স্থানে মমের ছোঁয়া অনুভব করতে পারি। খান বাড়ি আমার দাদীর শাশুড়ির হাতে তৈরী। আর এই কটেজ আমার মমের হাতে তৈরী। এর প্রত্যেকটা ডিজাইন আমার মমের পছন্দে করা। আগে বেশ আসা হতো। এখনো সময় পেলে একদিনের রিলাক্সের জন্য চলে আসি ফ্রেন্ডসদের নিয়ে। ‘
‘ নিজেদের রিসোর্টে বুকিং কেনো লাগবে?’
‘ রিসিপসনে খোঁজ নিতে পারো। একটা কটেজ ও খালি নেই। সিজনে এমন ও হয় একমাস আগে বুকিং দিয়েও কটেজ পাওয়া যায়না। রোমান্টিক কাপলদের টাইম স্পেন্ড করার জন্য উত্তম জায়গা। সেখানে তো আগে ইনফর্ম করতেই হবে। ‘

তানভীরের ফোনে কল আসে। স্কিনে স্বচ্ছ আকাশ নামটা শো করছে। লাবিবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তানভীর মুচকি হেসে রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দেয়। ওপাশ থেকে আকাশ বলে, ‘ ভাই গুগুল তো বলছে পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। ‘
‘ আংকেল আন্টিকেও আনিস। গার্ডিয়ান ছাড়া আমি আমার শালীকে দিবো না। ‘
‘ সিরিয়াসলি ভাই তুমিও না!’
‘ সাবধানে আয়। ‘

লাবিবা যা বুঝার বুঝে যায়। তানভীর কে বলে
‘ এটাই আপনার কাজ তাইনা? উর্মিলা কোথায়?’
‘ আকাশের সাথেই আছে। ‘
‘ হায় আল্লাহ! ‘
লাবিবার রিয়েকশন দেখে তানভীর লাবিবার কপালে ঠোঁট ছুয়ায়। আদুরে গলায় বলে, ‘ তিনটা দিন খুব মিস করছিলাম আমার এক্সপ্রেশন কুইন বউটাকে। পৃথিবীর যত দুঃখ সব আমার হোক। তোমার কিঞ্চিত সুখেই আমি প্রভাবিত। ‘

রেসপন্স এতো কম কেনো?🤔 যাই হোক ফালতু একটা পর্ব দিলাম। হ্যাপি রিডিং।

চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা