ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৯৬+৯৭

0
1082

#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো

(৯৬)
ভোর রাতে লোক চক্ষুর আড়ালে নতুন কলসি হাতে নতুন বাড়িতে প্রবেশ করলেন সাবিনা। সাবিনার পর পর বাসার ভেতরে ঢুকলো লাবিবা তারপর ইসমাইল। সকাল হতে না হতেই ফোনে কল এলো। মেজো কাকী কল দিয়েছেন। বললো,
‘ আপা,কোথায় আপনারা? বাড়ি গিয়ে দেখি তালা দেওয়া। ‘
‘ আমরা নতুন বাড়িতে চলে এসেছি। ‘ বলেই সাবিনা হাসলো।অঞ্চলের এই নিয়ম। নতুন বাড়িতে চলে আসতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে। নতুন কলসি ভরা পানি নিয়ে। এই নিয়ম কে বানালো,সেটাই লাবিবা ভেবে পায়না।

তানভীর আসলো সন্ধ্যা বেলা। এসে দেখলো পুরো বাড়িতে তার শ্বশুড় গোষ্ঠীর মেলা বসেছে। বাচ্চাদের চেঁচামেচি তে বাড়িটা মেতে আছে। উর্মিলাও এসেছে তার শ্বাশুড়িকে নিয়ে। একা আসতে দিতে চায়নি। এদিকে লাবিবা ফোন দিয়ে দিয়ে উর্মিলাকে আসতে বাধ্য করেছে। তার এতো স্বাদের রাণী মহল, উর্মিলা না দেখলে চলে? লাবিবা উর্মিলা আসার পর জিজ্ঞেস করে,’ আসবি যখন আমার এতো কথা খরচ করালি কেনো?’
‘ আরে একা ছাড়তেই চায়না। আকাশটাও বাসায় নেই।’
‘ কেনো তুই কি ছোট বাচ্চা? হারিয়ে যাবি? যে তোকে ছাড়ছেনা?’
উর্মিলা মুখ টিপে হাসে। লাবিবা ভ্রু নাড়ায়।
‘ কাহিনী কি?’
উর্মিলা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। লাবিবার গলা জড়িয়ে ধরে ব্লাশ করতে থাকে। লাবিবা আকষ্মাৎ এমন আচরণে হতবাক হয়ে যায়। উর্মিলা কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলেই দৌড় দেয়। লাবিবা উর্মিলার লজ্জা পাওয়া দেখে হাসতে থাকে।‌ জোরে জোরে বলে,
‘ আম্মু মিষ্টির ব্যবস্থা করো। আমাদের উর্মি মা হতে চলেছে। ‘
খুশির মাঝে আরেকটা খুশি এসে যোগ হয়। উর্মিলাকে ইসমাইল সাবিনা মেয়ের মতোই দেখে। ড্রয়িংরুমে মিষ্টি বিতরণ শুরু হয়। উর্মিলার শাশুড়ি লাবিবাকে বলে,
‘ তোমার যেনো বিয়ের বয়স কতো হলো?’
‘ এইতো আন্টি পাঁচ বছর হতে চললো। ‘
‘ কি বলো? এখনো বাচ্চা নাওনি? এতো লেট করলে তো পরে বাচ্চা হতেই চাইবেনা। আমার ছেলে,ছেলের বউ লেট করছিলো। আমিতো বাপু বলে দিয়েছি আমাকে নাতি নাতনির মুখ এবার দেখাতেই হবে। তোমাকে শ্বশুড়বাড়ি থেকে কিছু বলেনা? নাকি বাচ্চাই হচ্ছে না?’
লাবিবা হালকা হাসে। বলে, ‘ এখনো ভাবিনি এসব আন্টি। আমার শ্বশুড় বাড়ি থেকেও কোন চাপ নেই। ‘
‘ তাই বলে নিজের টা নিজে ভাববে না?’
‘ কি করবো বলেন? কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। উর্মি তো প্রাইভেট ব্যাংকে ঢুকে গেলো। যখন তখন বাদ পড়তে পারে। আমি কোনো কূল কিনারা পাচ্ছি না। পার্মানেন্ট একটা চাকরি না হলে তো হচ্ছেনা। ‘
‘ তাও ঠিক। বসে থাকার চেয়ে আমি মনে করি কিছু একটায় ঢুকে থাকো‌ । পার্মানেন্ট যখন ব্যবস্থা হবার তখন না হয় হবে। তবে মা!!এর সাথে বাচ্চার কি সম্পর্ক?’
উর্মিলার শাশুড়ি খুবই ভালো মনের একজন মানুষ। তার মনে যখন যা আসে সাথে সাথে বলে দেয়। লাবিবা উনার সাথে ভালোই মেশে। কি সম্পর্ক হয়তো বলতে পারতো,যদি তার ফ্যামিলি সাথে না থাকতো।তার কাকীরা উৎসুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে লাবিবা সম্পূর্ণ বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো।উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ আম্মু কিচেনে কি করছে আমি দেখে আসি। ‘
বাড়ির সন্তানদের কিছু হলে মুরুব্বিদের চিন্তা বেড়ে যায়। উর্মিলার শ্বাশুড়ির কথাগুলো লাবিবার কাকীরা হালকা করে নেয়নি। সত্যিই তো বিষয়টা তারা খতিয়ে দেখেনি। লাবিবা যেভাবে এড়িয়ে গেলো লাবিবাকেও জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে বলে মনে করলো না। সাবিনাকে বললে সাবিনা‌ কোন উত্তর দিতে পারলোনা। রুপালি কে আলাদা করে রিকুয়েস্ট করলো কবিরকে কথাটা বলতে। কবির এবং তানভীর বন্ধু। কবির ই বলতে পারে তানভীরকে বুঝিয়ে। সে তো মা। তার মেয়ে একসময় কতটা মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলো সে জানে। চাকরি বাকরি যদি না হয় মেয়ে কি তার বাচ্চা নেওয়াই বাদ দেবে নাকি? এটা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় বার চায়না এরকম কিছু হোক। কথাটা তিনি ইসমাইলের কানেও দেয় অন্যভাবে।
‘ আজকাল কোমড়ের ব্যাথা বাড়ছে।আর কদিন পর নাতি নাতনি কোলে নিবো কিভাবে?’
ইসমাইল মজা করে বলে, ‘ তুমিতো বুড়িয়ে যাচ্ছো। বুড়ো হলে মানুষের সাইজ ছোট হয়ে যায়। তোমাকে নিতে হবেনা। আমার নাতি নাতনিই একটু বড়ো হয়ে তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরবে। ‘
‘ মেয়েটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। ‘
ডাক্তারের কথা শুনে ইসমাইল সিরিয়াস হয়ে যায়।
‘ কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?’
সাবিনা মনে মনে ইসমাইলকে একটা গালি দেয়। আজকাল মেয়েদের পিরিয়ডের প্রব্লেম দেখা দেয়। লাবিবারো ছিলো। বহু চিকিৎসার পর ঠিক হয়েছে। সেজন্য ইসমাইলকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। পাছে না আবার বাচ্চা হওয়াতে মেয়ের সমস্যা হয়। সাবিনাকে চুপ থাকতে দেখে বলে,’ আমি ডক্টর সাবরিনা চৌধুরীর
এ্যাপয়েন্টমেন নিয়ে রাখছি। মঙ্গলবারেই নিয়ে যাবে তুমি মেয়েকে। ‘
সাবিনা জানে এইবার কাজ হবে। ইসমাইলের সংসারে এসেছে প্রায় ত্রিশ বছর। এই মানুষটার প্রত্যেকটা রগ বে রগ তার চেনা। উপরে উপরে হ্যাঁ তে হ্যাঁ না তে না মেলাবে,নিচ দিয়ে তার কর্তৃত্ব ফলাবে। মেয়েটার জীবন তো আরো এগিয়ে। জামাইটাকেও নখের আগালে রাখে। উপরে দেখায় ভালো মানুষ। পেটে পেটে তার যত প্যাচ। মেয়ের বাপ হয়েছে সে,তার পাওয়ার যদি থাকে একশ পার্সেন্ট দেখায় দুইশ পার্সেন্ট।

রাগ,দুঃখ, জেদ সংমিশ্রণে মিশ্র অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে লাবিবা।‌ একেই বলে যার বিয়ে তার হুস নেই পাড়াপড়শির ঘুম নেই। বাপের বাড়ি, শ্বশুড়বাড়ি এমনকি ফ্রেন্ডের বাড়ি অব্দি একই চর্চা। বাচ্চা কেনো নিচ্ছেনা? ডক্টর দেখাও বাচ্চা নাও। এদিকে যাদের বাচ্চা নেবার কথা তারা কেউই বাচ্চার চিন্তা করছে না। ইসমাইল ডাক্তারের কথা বলতেই লাবিবা রাগে কটমট করে তাকায়। ইসমাইল মেয়ের এমন রিয়েক্ট দেওয়া দেখে ধমক দেয়।‌
‘ চোখ নিচে নামাও। কি সমস্যা?’
সমস্যা কিছুই না। যার ভেতরে জ্বলে সেই জানে আসলে কি সমস্যা। সেই ব্যাক্তি ছাড়া কারো কাছে কোনো সমস্যাই না। কোনো উত্তর না পেয়ে ইসমাইল চিন্তিত হয়ে পড়ে। তানভীরকে জানাতে হবে। নিজের সম্মান টা রেখে যেনো বিষয়টা আলোচনা করতে পারে তা ভাবে। কথাগুলো গুছিয়ে নেয়। তানভীরকে ফোন দিয়ে বলে তার সাথে দেখা করে যেতে। তানভীর সারাদিন কাজ সেরে রাণীমহলে আসে বেশ রাত করে। লাবিবা তখন গভীর ঘুমে। আসতে লেট হবে জানাতে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো ফোনে। লাবিবা ধরেনি। তানভীর ভেবেছে ঘুমিয়ে পড়েছে। এসে দেখে সত্যিই ঘুমে। ফ্রেশ হয়ে লাবিবার পাশে শুয়ে পড়ে। এতোরাতে তার শ্বশুড় জেগে নেই সেটা বেশ বুঝতে পেরেছে। দুহাতে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে জাপটে ধরে লাবিবাকে। লাবিবার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। নড়াচড়া করছে দেখে তানভীর মুখ তোলে। চুল গুলো আঙুলে ঠিক করে চেহারা টুকু ঠিক করে। আদুরে গলায় ডাকে,
‘ জান, আমার রাণী!’
‘হুম’
জবাবটুকু দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তানভীর নিঃশব্দে হাসে। কবিরের সাথে লাঞ্চ পিরিয়ডে আজ তার কথা হয়েছে। লাবিবার যে আগে প্রব্লেম ছিলো সেটা সে জানতো না। বেশিরভাগ এসব প্রব্লেম বিয়ের পর ঠিক হয়ে যায়। লাবিবার প্রব্লেম হয়নি। হলে তানভীর ই আগে জানতো। বউয়ের সবকিছু তার নখদর্পনে। দায়িত্ব, কেয়ারে এক বিন্দু ছাড় নেই । বউয়ের সামান্য ব্যাথা সে সহ্য করতে রাজি নয়। যে মেয়েটা তার জীবনে সুখের কাঠি হয়ে এসেছে তাকে জীবন দিয়ে আগলে রাখবে সে। দুই বাড়ি মানুষের আলোচনাও কানে এসেছে তানভীরের। নিজেদের সেনসেটিভ বিষয়ে প্রত্যেকের ধারণা,আলোচনা তানভীরকে অসস্তিতে ফেলে দিয়েছে। লাবিবার কানে অবশ্যই এসব কথা গিয়েছে। সেজন্যই এতো রাগ! ফোন তোলেনি। তাকে ছাড়া ঘুমিয়েও পড়েছে। খেয়েছে কি?
তানভীর লাবিবাকে ডাকে। লাবিবা তখন গভীর ঘুমে।

সকালে ছাদে ব্রেকফাস্ট হয় সবার। তানভীরের আজই নতুন বাড়ির ছাদে প্রথম ব্রেকফাস্ট। ছোট ছোট চারা গুলো যে লাগিয়েছিলো সেগুলোতে একটা দুটো করে ফুল ধরেছে। খাওয়া শেষে ইসমাইল বললো,
‘ তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ‘
তানভীর জানে কি ব্যাপারে কথা হবে। নড়ে চড়ে বললো, ‘ জ্বি আব্বু। ‘
ইসমাইল বলতে গিয়েও কিছুক্ষন চুপ করে রইলো।‌
এসব ব্যাপারে খোলাখুলি জামাইয়ের সাথে কথা বলতে একটু অস্বস্তিই হয়।
‘ কবিরের সাথে তোমার কথা হয়েছে?’
‘ হয়েছে। ‘
‘ আমার মেয়েটা ডাক্তারের কাছে যেতে চাইছেনা। তুমি নিয়ে যাও সাথে। ‘
‘ আমার মনে হয় প্রয়োজন নেই আব্বু। লাবিবা সুস্থ আছে। ‘
ইসমাইল কথা বলতে গিয়েও বার বার চুপ হয়ে যাচ্ছে। তানভীরের কেনো জানি ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। শ্বশুড়কে সে শ্বশুড় হিসেবে খুব একটা পছন্দ না করলেও মেয়ের বাবা হিসেবে পছন্দ করে। ইসমাইল চিন্তিত মুখে বলে,
‘ তানভীর। আমার মেয়ের সমস্যা নেই আমি জানি। কথাটা কিভাবে উঠেছে তা জানি না। এখন পরিবারের মধ্যে ছড়িয়েছে পরে লোকমহলে ছড়াবে। আমার মেয়ে সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দু হোক আমি চাইনা। সে সাধারণ। সাধারণ ভাবেই তার জীবন এগিয়ে যাক। পড়াশোনা শেষ।।।সময় আছে একটা চাকরি বাকরি হয়ে যাবে। না হলে তোমার বিজনেসে ইনভল্ভ করে দেবে। এদিকে আমাদের ও বয়স হচ্ছে। শরীরে জোর থাকতেই নাতি নাতনি কাঁধে নিয়ে ঘুরতে চাই। নানা হবার বয়স হয়েছে। ‘
তানভীরের দিকে ফিরে বলে, ‘ ডক্টরের কাছে নিয়ে যাও। পরামর্শ নাও। আমার মেয়ে আর নাতি নাতনি যেনো সুস্থ সবল ভাবে দেখতে পাই। আমি জানি আমার সিদ্ধান্তে তুমি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলে । তানভীর আমি আমার মেয়ের ভালো চাই।আজ না বুঝলে যেদিন বাবা হবে দুই চারটা ছেলে মেয়ে বড় করবে তখন বুঝবে।’
‘ আব্বু আমি একবারো আপনার কথার দ্বিমত করিনি। আমি যখন লাবিবাকে বিয়ে করি তখন লাবিবা ছিলো অত্যন্ত নাজুক প্রকৃতির। দেখা দেখি একটা ব্যাপার তার মাঝে কাজ করতো। আবেগে গা ভাসাতো। সময়ের স্রোতেই বলুন বা আমার সংস্পর্শে এসে বলুন এখন তার মাঝে অনেক পরিবর্তন। আপনার এমন নরম স্বভাবে কথা বলা আমার মোটেই ভালো লাগছেনা আব্বু। আপনাকে আমার আদর্শ‌‌ মানি। আপনার মতো একজন কন্যার পিতা হওয়া আমার সপ্ন।’
‘ আমার মেয়ে আমার প্রতি বিরক্ত। ‘
‘ এটা হতেই পারেনা আব্বু। আপনার মেয়ে খুবই বাপভক্ত। ‘
‘ গতকাল প্রথমবার আমি আমার মেয়ের চোখে আমার প্রতি রাগ দেখেছি। চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছে আমার দিকে। আমি তাকে কষ্ট দিয়েছি। ‘
ইসমাইল বেতের চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দেয়। তানভীর চুপ থাকে। লাবিবার সাথে তার সরাসরি কথা বলতে হবে।‌

তানভীর লাবিবাকে বুঝিয়ে বলতে যায়।‌ ভেতরে একটা ছাই চাপা আগুন আছে। ছাই গুলো উড়িয়ে দিয়ে জ্বলতে দিতে হবে। জ্বলতে জ্বলতে একসময় ঠিকই নিভে যাবে। তানভীর লাবিবাকে সামনে বসিয়ে কথাটা পাতলো।‌
‘ আমার মনে হয় আমাদের জুনিয়রকে নিয়ে ভাবা উচিত। তুমি মম আর আমি পাপা। আমাদের দুজনের মাঝে একজন জুনিয়র থাক যে আমাদের নতুন সুখের উৎস হবে। ‘
জ্বল জ্বল চোখে তাকিয়ে বলে লাবিবা হাতের তালু তে চুমু দিলো।
‘ বেবী চাইছেন?’
‘ টিউবলাইট ছেড়ে গেছে!’
তানভীর হাসলো। কিন্তু লাবিবা হাসতে পারলোনা। তানভীরের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তানভীর তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘ আমাদের এবার বেবী প্লেনিং করা উচিত জান। ‘
‘ আমি একদমি এটা নিয়ে ভাবছিনা। ‘
‘ আমি তো ভাবছি। ‘
‘ তাহলে আপনি আপনার ব্যবস্থা করুন। ‘
‘ রাগ করছো কেনো?’
‘ মোটেই রাগ করছিনা। আমার সুবিধা অসুবিধা আমার থেকে বেশি কেউ বুঝবেনা। আপনি যতোই আমার হাজব্যান্ড হোন আমার ব্যাথা আমার ই। আপনার বড় জোড় একটু মন খারাপ হতে পারে এর বেশী কিছু নয়। আমার সময় নেই এসব বেবি টেবি নেওয়ার। ইটস ট্রু ডিফিকাল্ট। আর পাঁচজনের সাথে তাল দিবেন না। আপনাকে এতে মানায় না। ‘
‘ কি চাও?’
‘ আমি বেবী নিতে আগ্ৰহী নই। ‘
‘ তুমি ই একদিন বেবী নেওয়ার জন্য পাগল ছিলে। ‘
‘ বোকামো করেছিলাম। আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম আমার কোনো ব্যাক্তি স্বাধীনতা নেই। আমার ভালো চায় বাক্যটা কেন্দ্র করে আমার জীবনের মনিব অন্যজন। যাদের কথায় আমার দিক পরিবর্তন হয়। আমি তাদের হাতের পুতুল স্বরুপ। তারা না চাইলে আমার জীবনে সূর্য উদয় ও হবে না অস্ত ও যাবেনা। ‘
‘ এরকমটা কখনোই না। তোমার ভীষন ভালোবাসি তুমি জানোনা? তুমার যদি এতোই ইচ্ছে থাকতো তুমি আমার সাথে জেদ করতে পারতে। আমাকে শাস্তি দিতে পারতে। বছরের পর বছর একই জেদ মনে পুষে রেখেছো কেনো?’
‘ বললাম না যার ব্যাথা সেই বুঝে অন্যকেউ না। আমার আগ্ৰহ তখনই মিটে গেছে। আমি চাইনা আমার মতো আমার সন্তানের ও এমন জীবন হোক যে জীবনে সন্তান নিতে হলেও কারো পারমিশন নিয়ে এগোতে হয়। আমি বেবী চাই না শুনছেন আপনি? আমি এখন নিজেকে নিয়ে ভাবছি। অন্যকারো চাওয়া পাওয়া নিয়ে নয়। সরুন সামনে থেকে। ‘
লাবিবা উঠে চলে যেতে চায়। তানভীর হাত টেনে ধরে। তানভীর মাথা তুলে তাকায়। সাদা চোখে লাল রক্ত জমে আছে। লাবিবার একটুও গায়ে লাগে না। তানভীর মিনতি করে।
‘ আমাকে বোঝার চেষ্টা করো জান। জেদের বশে এরকম সিদ্ধান্ত নিও না। তুমি কতোটা কষ্ট পেয়েছো আমি জানি কিন্তু জানতাম না এর গভীরতা কতদূর। তুমি আমাকে বলতে পারতে। আমার সাথে ঝগড়া করতে রাগারাগি করতে আমাকে শাস্তি দিতে কোনভাবে আমাকে জানাওনি জান। ‘
‘ ওমা! আমি এসব কেনো করবো? আপনার সাথে ঝামেলা করলে ক্ষতিটাতো আমারই বেশী হতো। মন খারাপ থাকতো। আপনার কষ্ট দেখে আমারই সহ্য হতোনা। রাত হলে কার বুকে শান্তির ঘুম ঘুমাতাম? যেখানে আমি জানিই আমার চাওয়ার কোনো মূল্যই নেই এখানে। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই বলে এতোটা মাথামোটা আমাকে আমাকে একদমি আপনার ভাবা উচিত হয়নি। তাইনা?’

লাবিবা খিলখিল করে হেসে উঠে। তানভীর স্তব্দ হয়ে রয়। বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায়। অসহায় চোখে লাবিবার দিকে তাকিয়ে রয়।
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৯৭)
সোহানা ইসলামের শরীরটা ঠিক‌ যাচ্ছেনা ক দিন থেকে। চেহারার জৌলুস ধরে রাখলেও বয়স ধরে রাখা যায়না। বয়স ভারী হতেই শরীরে একটা দুটো করে রোগ বাঁধছে। কদিন হলো অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়। পায়ে ব্যাথা অনুভব করে। তামিম ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে ট্রিটমেন্ট করছে। এই মুহূর্তে খবর এলো রোজী দ্বিতীয়বার কনসিভ করেছে। সবাই খুশি হলেও তামিমকে খুশি দেখালোনা।
‘ আবার লোভী লোকগুলোকে বাড়িতে আনতে হবে। ‘
হতাশাগ্ৰস্থ চেহারায় চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। রোজী গাল টিপে হাসে।
‘ যাদের লোভী বলছেন তারাই কিন্তু আমাকে জন্ম দিয়ে বড় করেছেন। আপনার ছেলেটাকেও তো কোলে পিঠে করে সামলে দিলো। নয়তো কি আমি পারতাম?’
‘ নানা নানীর কাজই নাতি বড় করা। কি এমন করেছে যে আমাকে বলছো?’
‘ কিছুই করেনি?’
‘ নানা নানি তো আর আমাকে ডাকবেনা। ‘
‘ বাবা ডাকবে কাকে? ‘
‘ ডক্টর তামিম খানকে। চুপ আর একটা কথাও নয়। ‘
তামিম আড়াল হতেই রোজী শব্দ করে হেসে উঠে। মানুষটার রাগ পড়ে গেছে। কিন্তু সে মানতে নারাজ।

লাবিবাকে ফোনেই খবরটা দিলো রোজী। লাবিবা শুধু বললো, ‘ কনগ্ৰাচুলেশন। ‘
রোজী জানতে চাইলো, ‘ রাগ পড়েনি এখনো?’
‘ কিসের রাগ?’
‘ শোন বাড়ি আয়।‌ ভাইয়া মুখ গোমরা করে থাকে। এসব দেখতে ভালো লাগছেনা। ‘
‘ আমি বলেছি গোমরা করে থাকতে? নিজের সব ইচ্ছাই পূর্ণ হতে হবে? কোন একটা বাদ পড়লেই মুখ গোমড়া? কোথায় আমি তো মুখ গোমড়া করে থাকিনা। অনেক কিছুই অনিচ্ছায় মেনে নিই।একটার পর একটা অশান্তি নিয়ে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরি। আমি তো ঠিকই হাসি খুশি থাকি। তাকেও বলো হাসিখুশি থাকতে। ‘
‘ যার সাথে রাগ তার সাথে দেখা। এখন বাড়ি আয়। তাফিফকে ছেড়ে কিভাবে থাকিস? মন পুড়ে না?’
তাফিফের জন্য লাবিবার মনটা খারাপ হয়ে যায়। রোজী বলে, ‘ তামিম খুঁজছে তোকে। তুইও তো ওদের মা। আবার মা হবি তুই। একেবারে দিয়ে দিবো তোকে এবার যে আসবে। এখন বাসায় আয়। ‘
আগুনে ঘি ঢালার জন্য এই কথাটাই যথেষ্ট ছিলো। লাবিবা রোজীর উপর চিৎকার করে উঠে,
‘ কি ভাবো তোমরা? আমি মা হতে পারবোনা? আমার সমস্যা আছে কে ছড়িয়েছে এসব কথা? আমি মা হবার জন্য যথেষ্ট স্টেবল। কেবল সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার দেবর কে নিঃসন্তান রাখবো। তার নিজের সন্তানের কোনো প্রয়োজন নেই। অন্যের সন্তানকে দেখে তার যেমন তৃষ্ণা মিটে যায় আমিও তেমন ভাইয়ের সন্তান ভাসুরের সন্তানকে বুকে টেনে নিয়েছি। শোনো তাকে বলো এখানে আসতে। আমি তাকে ছাড়া একদমি থাকতে পারছিনা। আর আমার সাথে রাগ না দেখিয়ে ভাইয়ের ছেলে বান্ধুবীর মেয়ে নিয়ে যেনো সন্তুষ্ট থাকে।’

ফোন কেটে দিয়ে খাটে ধপ করে বসে পড়ে লাবিবা। দুহাতে মুখ ঢেকে নিচু স্বরে কেঁদে উঠে।
‘ আমার বান্ধুবীর মেয়ের কথা আসছে কোথা থেকে?’
শোনা মাত্রই লাবিবা হাত সরিয়ে তানভীরকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে। কান্না বন্ধ করে লাবিবা। নড়েচড়ে বসে। দুইদিন পর তানভীর এসেছে। দম যেনো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো লাবিবার। মিউচুয়ালি কয়েকদিন দূরে থাকলেও কথা নেই। কিন্তু মনমালিন্য হবার পর কয়েক ঘণ্টা দূরত্ব থাকলে আত্তা দুক দুক করে। লাবিবা কিছুসময় তাকিয়ে হৃদয় শীতল করে। পরক্ষনেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। উত্তরটা বাঁকা ভাবেই দেয়।
‘ আমি কি আপনার বান্ধবীদের খোঁজ রাখি? মেয়ে হয়েছে শুনেছি সেজন্যই মেয়ের নাম ধরেছি। ‘
তানভীরের সেদিন হসপিটালের কথা মনে পড়ে যায় যখন লাবিবা তার মতে বাচ্চার জন্য পাগলামি করেছিলো। ফের অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে যায়।
‘ তুমি আমাকে সাংঘাতিক ভাবে অপমান করেছিলে রাণী সাহেবা। ‘
লাবিবা উঠে আসে। তানভীরের গলা জড়িয়ে ধরে নিমেষেই মুখটায় দুঃখী ভাব নিয়ে আসে।
‘ সরি। ফ্রেন্ডদের সামনে এতো কড়া একটা কথা আপনাকে বলা উচিত হয়নি। আমি কিন্তু আপনার অপমান ফিরিয়ে আনতে পারি। ফোন করুন তাঁদের আমি বলে দিচ্ছি আমার মাথা বিগড়ে গিয়েছিলো এবং আমি হাতাহাতি জ্ঞান শূন্য হয়ে পাবলিক প্লেসে ঝগড়া করেছি। দোষটা পুরোপুরি আমার ঘাড়ে চলে আসবে। আপনার দোষটা কিভাবে ক্ষমা করবো যে ঘরের কথা পাবলিকলি ক্রাশ করে। আপনি তো ওয়াদাও পালন করতে পারেননি। গভীর ভাবে ক্ষত সৃষ্টি করে দিয়েছেন আমার মাঝে। ‘
‘ ওহ গড! তুমি সেদিনের কথা এতোদিন পরেও টেনে নিয়ে এসছো? তোমার ঘটে যদি কিছু থাকতো তাহলে এমনটা করতে না। আমি ভীষন আপসেট ছিলাম সেদিন । সেজন্য আমার ফ্রেন্ডরা চেপে ধরেছিলো। তারা আমার ফ্রেন্ড বাহিরের কেউ নয়। আমার যাবতীয় বিষয়ে তারা আমাকে হেল্প করে। সেদিন তারা সব শুনে আমাকে বুঝাচ্ছিলো যেনো আমি তোমাকে বলে দিই। এভাবে আর আড়ালে না রাখি। আমিও কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাঁদের কথা বুঝতে পেরেই আমি তোমাকে সত্যটা বলে দিয়েছি যেনো তুমি বেশিদিন কষ্টের বোঝা বয়ে না বেড়াও। আর দিপ্তি তোমাকে ঐভাবে বলেছে যাতে তুমি আমাকে বাধ্য করো আর আমি বাড়ি ফিরে যাই। তোমাকে এবং আমাকে এক করার জন্য ই ঐভাবে বলেছে যা তুমি নির্বোধ বুঝতেও পারোনি। ‘
তানভীরের কথা এই মুহূর্তে লাবিবার ভালো লাগছে না। সে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললো, ‘ দেখুন খান সাহেব দুইটা দিন আপনি আমি ছাড়া ছিলেন। এখন এসেছেন আমার মনটা ভালো রাখুন। আমি বরাবরই আপনার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছি আশা করি আপনিও আমাকে সাপোর্ট করবেন। এই বিষয়ে কোনো কথা শুনতে আমি রাজি না। ‘
‘ তুমি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো? নিজের ক্ষতি করার জন্য বার বার এগিয়ে যাও তুমি। ‘
‘ বাড়িতে তো বাচ্চা আছেই। তাছাড়া আরো একটা বাচ্চা আসছে। আমি তো ছোট মা। আরেকটা মা। তাছাড়া আমার তো এখনো ক্যারিয়ার গড়া হয়নি। এই সময়ে আপনি কেনো বাচ্চা নেবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন? আপনিও কি আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন না?’
তানভীর মাথা দুলালো। নাহ! লাবিবার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তাকে বোঝাতে হবে। ধৈর্য্য ধরে বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। যদি না হয় তারপর জোর করতে হবে।
‘ তুমি যদি সময় চাইতে তাহলে আমি তোমাকে প্রেশার দিতামনা। কিন্তু তুমি যে বাচ্চাই নিবে না এরকম ফালতু একটা ডিসিশন নিয়েছো বলছো এটা আমি মেনে নিবো?’
লাবিবা আড় চোখে তাকায়। টুপ করে নাকের ডগায় চুমু দিয়ে ভাব দেখিয়ে চলে যায়। তানভীরের শরীর জ্বলে যায়। মাথা গরম হয়ে উঠে । দুহাতে চুল টেনে ধরে। মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। ভাবতে থাকে কিভাবে তার বিগড়ে যাওয়া বউকে হাত করবে।

রোজী তাফিফকে কোলে নিয়ে সোহানার কাছে যায়।
‘ মামুনি আমি একটু রাণী মহলে যাই?’
‘ ছোটবউয়ের কাছে?’
‘ হুট করে ফোনটা কেটে দিলো ‌। আমার উপরে রাগ করেছে। ‘
‘ তানভীর কোথায়?’
‘ জানিনা। ‘
‘ তুমি যাও লাবিবা কে নিয়েই ফিরবে। বলবে আমি বেশী অসুস্থ তাহলেই চলে আসবে।’
‘ মিথ্যে বলবো?’
‘ প্রয়োজন হলে বলবে নয়তো বলার দরকার নেই। ‌তানভীর ওকে নিয়ে আসবেনা আমি বুঝে গেছি। আগে দূরে যেতে হতো সেজন্য বউকে যেতে দিতে চাইতো না। এখন তো কাছেই থাকে তাই তার কোনো হেলদোল নেই। তুমি যাও ওকে নিয়ে আসো। ‘
‘ আচ্ছা। ‘

রোজী গাড়ি নেয়না। দশমিনিটের রাস্তা হেঁটেই যায়। পথিমধ্যে তামিম দেখে নেয় রোজীকে। তাফিফকে
কে কোলে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সেও রোজীর সাথে লাবিবার কাছে যায়। লাবিবাকে নিয়ে ফেরার কথা থাকলেও তারা দুজন ই এই বাসায় রাতে থেকে যায়।
তানভীর রাতে লাবিবাকে আবার বোঝাতে যায়। উল্টো লাবিবা তাকে নিয়ে মজা উড়ায়। তানভীর ব্যর্থ। বার বার সে ব্যর্থ। কিন্তু সে হাল ছাড়বেনা। বউকে এবার মাথায় তুলবে। এমন আদর যত্ন করবে যেনো মন গলে পানি হয়ে যায়।

চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা