#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(১০২)
নাকিব বসে আছে লাবিবার সামনে। পাশেই বসা তানভীর। নাকিবের রংপুর যাওয়াটা আর হলোনা। পথের মধ্য থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে।লাবিবা তার সামনে এক গ্লাস পানি রাখলো। নাকিব সঙ্গে সঙ্গে সাবাড় করলো। এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়বে সে কোনদিন ভাবেনি। বাস থামিয়ে যখন দানবের মতো লোক গুলো জিজ্ঞেস করছিলো,
‘ নাকিব হোসেন এখানে কে?’
তখনি তার গলা শুকিয়ে গেছে। তিন ঘণ্টা পর একগ্লাস পানিতে সে ভয় দূর করলো। আজ খুবই কষ্ট হলো তার। কেনো সে দানবীয় মানুষ হতে পারলোনা? হরমোন গুলো কেটে কেটে কেউ হয়তো চুরি করে নিয়েছে। সেজন্য ই তো চ্যাংদুলা করে দেশের অতি সম্মানীয় একজন আমলাকে তুলে নিয়ে এলো। কাদের বোনকে ইগনোর করছে এটা হয়তো অতি সখ্যতায় নাকিব ভুলেই গিয়েছিলো। আজ সম্মান খুইয়ে চুনোপুঁটি লেগে মস্তিষ্ক ঝালাই হয়ে গেলো। তানভীর সরাসরি প্রশ্ন করলো, ‘ ফাহাকে বিয়ে না করতে চাওয়ার কারণ কি?’
নাকিব ঢুক গিললো।
‘ ফাহা তোমার থেকে সব দিক থেকেই এগিয়ে আছে। শুধু বয়সটা কম। পড়াশোনা শেষ হলে সেও একটা ভালো ক্যারিয়ার ডিজার্ব করে। তাহলে প্রব্লেমটা কোথায়?’
নাকিবের মনে হচ্ছে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। প্রথমে দৈত্য মানব দিয়ে চ্যাংদুলা করে নিয়ে এলো তারপর কথার প্যাচে প্রেসার দিচ্ছে কেনো বিয়ে করবেনা? এই মুহূর্তে ফাহাকে বিয়ে না করতে চাওয়াই তার একমাত্র অপরাধ। একদম আকাশ সম অপরাধ। লাবিবার নিকট শুনেছিলো তাদের পার্সোনাল মেশিনগান আছে। এই মুহূর্তে কি সাথে আছে? যদি কপালে ঠেকিয়ে বদে ঠুকে দি? তানভীর আবার বললো,
‘ শোনো গায়ের মাপ দাও। তোমার শেরওয়ানি আসছে কিছুক্ষনের মধ্য। তোমার পুরো ফ্যামিলিও আসছে।বিয়ের জন্য প্রিপেয়ার হও। আমার বোনকে রিজেক্ট
করো। সাহস ভালো। ‘
নাকিবের কান্না চলে এলো। যাদের জন্য ফাহাকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে তারাই এখন উল্টাচরণ করছে। প্রচন্ড শকে নাকিব বোবা বনে গিয়েছে। লাবিবা বললো,
‘ তুই কি বিয়ের আগে ফাহার সাথে একান্তে কথা বলতে চাস? ব্যবস্থা করবো? ফাহা খুশি হবে। ‘
রোজী রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘ ফাহার ভীষন জ্বর। গা একদম পুরে যাচ্ছে। কথা বলতেও মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে। ‘
নাকিবের মাথাটা কেমন ঘুরছে। সে তো বোবা হয়েই গেছে। বিয়ে দিচ্ছে জোর পূর্বক তাও এক বোবার সাথে। লাবিবা তৎক্ষণাৎ উঠে গেলো। ফাহাকে দেখতে যাচ্ছে। তানভীর সাবধানী বাণী আওড়ালো, ‘ উমম আস্তে!’
নাকিবকে খইরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করলো,
‘ বাবা তুমি কি সত্যিই বিয়েতে রাজি হয়েছো? সত্যি করে বলো। নাকি জোরপূর্বক বিয়েটা করছো?’
তামিম বললো,’ নাকিবকে আমরা কেউ জোর করিনি মামা। নকিব ভালো ছেলে।সিনিয়র স্যারদের কথা শুনে। ‘
এদিকে নাকিব অনুভূতি শূন্য হয়ে আছে। নাকিবের মা সেই খুশি। নাকিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
‘তুই ম্যামের মেয়েকে বিয়ে করবি আগে কেনো বললিনা বাপ? কি সুন্দর ফর্সা ধবধবা বড় গর্দান লম্বা চুল মেয়েটার। এমন বড়লোকের আদরের মেয়ে! আমি একটুও কাজ করতে দিবোনা। চেয়ারে বসিয়ে রাখবো আর বলবো মা তুমি আমার সামনেই থাকো। আমি তোমাকে দু চোখ ভরে দেখি। ‘
নাকিব মাথা তুলে বসলো। সাথে সাথে চোখা চোখি হলো শ্যামলির সাথে। সাথে সাথে নাকিব রিয়েক্ট করলো, ‘ এই কুত্তার বউ এখানে কেনো এসেছে?’
‘ তোর বিয়ে খেতে আসবেনা? জামাই ও তো এসেছে। ‘
নাকিব বিশ্রি গালি দেয়। হা ভাতে মিসকিন খাবারের গন্ধ পেতে না পেতেই পেট পুরতে চলে এসেছে। ‘
এই মুহূর্তে তার মনটা ফাহার জন্য ভাবছে।
তীব্র জ্বরে ফাহা নুইয়ে পড়েছে। কিছুক্ষন আগেই গা ঘেমে জ্বর ছেড়েছে। রোজী গা মুছিয়ে তাকে তৈরী করিয়ে দিয়েছে। কলাপাতা রঙের অরগাঞ্জা শাড়ির সাথে কুন্দন সেট পড়ে ফাহা বিয়েতে বসেছে। ব্রাইডাল সাজটা তার চেহারার মলিনতা ঢেকে দিয়েছে। নাকিবের মার ফুটফুটে বউ পেয়ে হাসিই থামাতে পারছেনা। শ্যামলীর অমন স্মার্ট জৌলুসপূর্ণ চকচকে চেহারার ফাহাকে নাকিবের পাশে সহ্য হচ্ছেনা। তার ভাবীর কানে ফিসফিস করতেই বউটি বলে উঠে, ‘ আরে আমাদের নতুন বউ ঝিমুয় কেনো? বিয়ের খুশিতে রাতে ঘুমোয়নি নাকি?’
নাকিব সামনে তাকিয়ে ছিলো। শ্যামলী আর তার ভাবীকে একবার দেখেই পাশে তাকায়। ভীষণ সুন্দর এক ব্রাইড বসে আছে তার পাশে। জিদ্দি ধরা বড়লোকের একগুঁয়ে পাগলাটে সফল মিস. ফাহা। একটু পরেই হয়ে যাবে মিসেস ফাহা। নাকিব একটু ঘুরে বসলো। যাতে ফাহাকে আংশিক সামনে তাকিয়েই দেখতে পারে। পূর্ণদৃষ্টিতে ফাহার চোখে তাকায়। চেহারা থেকে জৌলুস ঠিকরে বেরোলেও চোখ দুটো তার অন্তসার। একদম ফাঁকা। নাকিবের ভীষন মায়া হয়। ফাহাকে ধরে আছেন সোহানা। নাকিব হাত বাড়িয়ে কাঁধ আঁকড়ে ধরে। নিজের উপর ভর নেয়। সোহানা মুচকি হেসে ফাহাকে হালকার উপর ধরে রাখে। দায়িত্ব যে নেওয়ার সে নিয়ে নিয়েছে। নাকিব ফাহার হাতটা মুঠোয় নিতেই বুঝে গায়ের তাপমাত্রা। জ্বর ছেড়েছিলো। আবার জ্বর উঠছে মেয়েটার। তানভীর কাজীকে তাড়া দেয় তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়াবার। ফাহা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার নাকিবের দিকে তাকায়। মানুষটার কাছে এসে ঢুকরে কান্না আসছে তার। অসুস্থ শরীর নিয়ে আল্লাহর রহমতে তিন কবুল পড়ে তাঁদের বিয়েটা হয়ে যায়।
বিয়ে বাড়ির সল্প আয়োজন বললেও রান্না করা হয়েছে সত্তর জন মানুষের জন্য। দুই পরিবারের আত্নীয় স্বজন মিলিয়ে ষাট জনের মতো। বাড়তি দশ জনের রান্না। এদিকে তানভীর রুমে রুমে খোঁজে বেড়াচ্ছে তার রাণীকে। বিয়ের এতো কাজ কেউ বসে নেই। তানভীর ভুলেই গিয়েছিলো লাবিবাকে কোথাও বসিয়ে রেখে গিন্নি গিরি দেখাতে বারণ করা। লাবিবাকে পাওয়া গেলো ফাহার ঘরে। তাজা গোলাপে তিনজন মেয়ের সাথে সে ফাহার বাসর ঘর সাজাচ্ছে। সাজানো প্রায় শেষ। ঘরটা নোংরা হয়ে গেছে। ঝাড়ু হাতে দুই বার নাড়িয়েছে তখনি তানভীর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে।লাবিবা কি করবে আরেকটা মেয়ের হাতে টুপ করে ঝাড়ুটা ধরিয়ে দিয়েছে। তাতে কি? তানভীর তো তা দেখেই নিয়েছে। কিছু না বলেই হাত টেনে ফাহার ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে। গেস্ট রুমে এনে লাগেজ থেকে শাড়ি বের করে হাতে দেয়।
‘ চলো গোছল করবে। ‘
‘ আরে সকালেই করেছি। এখন করবোনা কাজ শেষে একেবারে।’
‘ কাজের জন্য মানুষ আছে। তোমাকে কাজ করতে হবেনা। ‘
ব্লাউজ ঘেমে ভিজে আছে। লাবিবার স্বাস্থ্য একটু বেড়েছে। গরীরে প্রচন্ড গরম। একটুতেই হাঁপিয়ে যেনো উঠে। তানভীর ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলো। তার আগে চেক করে নিলো কোনো কিছু কি ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে? ছোট ছোট বিষয়ে নজর তানভীরের। একটুর জন্য অনেক এক্সিডেন্ট হতে পারে। এতো সাধনার বউ তার! এতো অপেক্ষার সন্তান। দুটোই পেতে তার বছরের পর পর অদৃশ্য ধ্যান করতে হয়েছে।
লাবিবা গোছল সেরে বেরিয়ে তানভীরকে পেলো না। বারান্দায় ভেজা কাপড় নেড়ে আসতেই তানভীর ঘরে ঢুকলো। হাতে ভাতের প্লেট। লাবিবার খাওয়া হয়নি আজ এই বেলা অব্দি। সেটা তো ভুলেই গিয়েছিলো। খেলেই কি? বমি হয় প্রচুর। সব ফেলে দেয়। তবুও তানভীর নাছোড় বান্দা। তানভীর ফ্যান ছেড়ে দিলো। বিছানায় লাবিবাকে বসিয়ে একটু একটু করে খাইয়ে দিলো। লাবিবাকে খাওয়াতে তার এক দিঘি সমান ধৈর্য্য নিয়ে বসতে হয়ে। এই এটা খাবোনা, এখন খাবোনা, ভালো লাগছেনা করে করে কানের পোকা খেয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে তো আবার অর্ধেক খেয়েই বমি করে উগলে দেয়। প্রথম তিনমাস প্রচু্র বমি করেছে। এমনো দেখা গিয়েছে মাঝরাত নেই ভোররাত নেই তানভীরকে গোছল করতে হয়েছে। এখন বমির পরিমাণ কমে এসেছে। তানভীর ভুল করেও এখন রাতে গোছল করেনা। নোংরা ড্রেস চেঞ্জ করেই আবার শুয়ে পড়ে। লাবিবা গলায় আদর ঢেলে বলে,
‘ উই য়্যার প্রেগন্যান্ট। না?’
তানভীর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
‘ ইয়েস উই য়্যার প্রেগন্যান্ট। ‘
ভেজা চুল গুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দেয়। লাবিবা বলে, ‘ হেয়ার ড্রায়ার আর ইউজ করবেন না। আমার ইদানিং প্রচুর চুল ঝড়ছে। ‘
‘ ঝড়ুক। আবার বেবি হেয়ার আসবে। ‘
লাবিবাকে বের হতে দেয়না। তাফিফ আর ফারাহ কে এনে কোলে দিয়ে বলে, ‘ বাচ্চাদের নিয়ে থাকো। একেবারে বাসর ঘর ধরার সময় বের হবে। এর আগে না। ‘
‘ লেমন জুস পাঠিয়ে দিবেন ঘন্টা খানেক পর। ‘
‘ আর?’
‘ তারপর বলবো। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
ডিনারের পর ফাহা এবং নাকিবের বাসর ঘর ধরা হয়েছে। নাকিব তো আজ বোবা। আসছে থেকে কনের বাড়ি তিন কবুল ব্যতীত শুনেনি তার মুখের একটা কথা। বাসর ঘরে আদৌ টাকা দিতে চাইবে নাকি দরজায় বসে থাকবে কে জানে? সেজন্যই আটকানো হলো নাকিবের দুজন কাজিনকে। নাকিব বোবা হলেও তারা তো আর বোবা না। ফাহা দুর্বল শরীর নিয়ে শুয়ে আছে গোলাপের বিছানায়। কতো বলে কয়ে মেকাপ উঠাতে পারলেও বিয়ের শাড়ি গহনা চেঞ্জ করাতে পারলোনা। ফাহার মস্তিষ্কে নাকিবের উপর বেজায় রাগ কিন্তু মনে এক ঝাঁক প্রশান্তি। দরজায় বোন ভাবীরা এসে দাঁড়িয়েছে। ফাহা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে । যা ভেবেছিলো তাই। লাবিবা টাকা চাইতেই নাকিব ওয়ালেট বের করে দেখালো। কার্ড ও নাই টাকাও নাই। রোজী বললো, ‘ তোমার নাই তো কি হয়েছে? ভাইয়াদের আছে। ভাইয়ারা ওয়ালেট বের করেন। ‘
‘ আপনাদের বোন জামাই খুবই ক্লান্ত। যা চাওয়া পাওয়া সব কাল করবেন। ‘
‘ তাতো হবেনা। মেইন কোর্স শেষ হলে অযথা টাকা কেনো আমাদের দিবেন? নাকিব ভাই আমার। বউকে যে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলে, ওমা! চোখ ই তো দেখি পড়েনা। ভেতরে ভেতরে কেমন ফিল করছো? মনটা বউ বউ করছেনা?’
নাকিব মনে মনে বললো, ‘ না না না। ‘
‘ তাড়াতাড়ি টাকা ছাড়েন। এতো সুন্দর করে বাসর সাজালাম আমাদের গিফট পাবোনা?’
‘ গিফট পরে নিয়ে নিবেন। আজ ছাড়েন। গিফট টা তোলা থাক। ‘
‘ বাকীর নাম ফাঁকি আমরা ওসবে বিশ্বাস করিনা। ‘
‘ দেখ নাকিব টাকা কই পাবি জানিনা। আমাদের হক আদায় কর। তোর বউ অসুস্থ। তাড়াতাড়ি তার কাছে যা। ‘
নাকিব মনে মনে বললো, ‘ আরে শাকচুন্নী! এতো দরদ তোর। মেরে বউটার যখন জ্বর তুলে দিলো তখন তুই দরদের ভান্ডার খুলতে পারলিনা?’
নাকিবের ভাইয়েরা অনেক তর্কা তর্কি করলো। কেউই গেট ছাড়লোনা। তারা বললো, ‘ বউ তবে আপনাদের সাথেই থাকুক। এই নাকিব চল তোর আরো একটা রাত হোক বউ ছাড়া। ‘
‘ ছি ছি ছি! কিপ্টা কথাকার। এই নাকিব তোর ভাইয়েরা তো হাল ছাড়া বলদ। ঘরে বউ টিকে? তা তো বাপু জানিনা। ‘
দুই ভাই ই রেগে উঠে। নাকিব বিরক্তি নিয়ে কানে কানে বলে,
‘ আফজাল ভাই টাকা বের করো। আর ভালো লাগছেনা। ‘
‘ টাকা কেনো দিবোরে। বাসর ঘরে তোকে এমনিতেই ঢুকাবো। এখনি নিয়ে চলে যাই দেখবি তারাই তোকে টেনে নিয়ে যাবে ছ্যাকা খেয়ে। ‘
নাকিবের মোটেই এসব ভালোলাগছে না। এক প্রকার ঝগড়া বিতন্ডের পর যখন তর্ক কমলো না তখন পড়লো নারী আক্রমন। এক মেয়ে ফট করে নাকিবের ভাইয়ের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওয়ালেট নিয়ে নিলো। পর পর আরো কয়টা হাত লাগলো। সব মিলিয়ে তের হাজার পাঁচশ টাকা পেয়ে প্রশস্ত হাসলো। নাকিব আফসোস করলো। আক্রমন! আক্রমন! সকাল থেকে একটার পর একটা আক্রমন। ভেতরে কি হবে কে জানে? সেখানেও কি আক্রমণ? শালিকারা বললো,
‘ চিচিং ফাঁক। দুলাভাই এইবার বাসর ঘরে ঢুকেন। আপু কিন্তু অসুস্থ। আপনি অভিজ্ঞ মানুষ বেড়াল কিন্তু সাবধানে মারবেন। চেঁচামেচি যেনো না হয়। ‘
বলেই চোখ টিপলো। নাকিব চট করে চোখ ঘুরিয়ে লাবিবার দিকে তাকালো। লাবিবা দিলো চোখ মেরে। নাকিব অবাক! এই বন্ধু তাকে কি বড় বাঁশ দিলো! সে বিরবির করলো, ‘ কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি নয়। আমি পিউর ভার্জিন। বেড়াল কিভাবে মারে আমার জানা কথা নয়। লাস্ট কথাটা সত্যিই সত্য নয়। ‘
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(১০৩)
নাকিব কে দেখে ফাহা উঠে বসেছে। চাহনী তার নিস্তেজ। নাকিব ধ্যান ধরে ফাহার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে তার এই মেয়েকে নিয়ে কতো রকম ভাবনা! নেগেটিভ পজিটিভ ভাবতে ভাবতে নাকিব নিজ মনেই চিৎকার করে উঠলো, ‘ ও মাই গড! ও মাই গড!’
ফাহা থতমত খেয়ে গেলো। জানতে চাইলো,
‘ কি হয়েছে?’
‘ তোমাকে নরম স্বভাবের ভেবেছিলাম। তুমি এতো ডেঞ্জেরাজ কিভাবে হয়ে উঠলে?’
‘ আমি ডেঞ্জেরাজ নই। ‘
নাকিব এগিয়ে এলো।
‘ ফাহা তুমি ঠিক আছো? ‘
ফাহা মাথা নাড়ালো। সে ঠিক নেই। নাকিব এসে তার পাশে বসলো। ফাহাকে আগাগোড়া ভালো করে দেখে কি একটা চিন্তা করতে লাগলো। ফাহা বললো,
‘ আপনার পছন্দ হয়েছে আমার এই বউ সাজ? ঘরে বসেই সেজেছি। পার্লারে যেতে পারিনি। ঝটপট অনলাইনে অর্ডার দিয়ে শাড়ি অর্নামেন্টস আনিয়েছি। অসুস্থতায় ঠিক ঠাক কেনা কাটাও করতে পারিনি। ‘
‘ বুঝলাম। শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে বিয়ে করেই ছাড়লে। ‘
ফাহা অল্প হাসলো। নাকিব মোটেই হাসলোনা। বললো,
‘ দেনমোহরের আশা এখনি ছাড়ো। ত্রিশ লক্ষ টাকা, দুইটা বাড়ি দেনমোহরে উল্লেখ করেছে। আরে আমি কেনো? আমার বাপে দাদায় কোনো দিন ত্রিশ লক্ষ টাকা চোখে দেখেছে? আমিই তো থাকি দাদার বাড়িতে। আমার তো বাড়িই নেই। তোমার ভাইয়েরা তোমাকে ঠকিয়ে দিলো। এইযে আমি মানুষ একাই। আমার কিছুই নাই। চাকরি করি কয়টা টাকা পাই। তিন বেলা ভাত খাই। তুমি চাইলে তোমাকেও তিন বেলা ভাত খাওয়াতে পারবো।এর বেশি কিছু আশা করো না। ‘
‘ এতেই চলবে। আর কিছুই লাগবেনা। ‘
নাকিব বিছানায় সটান শুয়ে পরে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ উর্মিটা অসুস্থ। আমার বিয়েতে আসতে পারলোনা। তোমার হাতটা দাও তো। দেখি সত্যি সত্যি কেটেছো কিনা?’
ফাহা হাত বাড়ায়। সাদা ব্যান্ডেজ করা। হাত ধরতেই নাকিব গরম অনুভব করে। বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ এই তোমার জ্বর কি আজ ঠিক করে নিয়েছে ছাড়বেনা?’
ব্যান্ডেজ খুলে কাটার উপরে আলতো আঙুল স্পর্শ করলো। ‘ হাত কাটার পরেই কি জ্বরটা এলো? নাকি আগে থেকেই?’
ফাহা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তার চোখে জল টলমল। নাকিব বললো, ‘ সত্যি কি তোমাকে মেরেছে?’
ফাহা উত্তর দিলো না।
‘ ঘুমিয়ে পরো ফাহা। তুমিও অসুস্থ। আমারো কেমন জানি লাগছে। সকালে আমাদের কথা হবে। ‘
নাকিবের পাশের বালিশে ফাহা মাথা রাখলো। নাকিব বললো, ‘ চেঞ্জ করে ঘুমাও। এসব কাপড়ে অর্নামেন্টসে তুমি একদমি ঘুমোতে পারবেনা। ‘
‘ আপনি ঘুমান। আমার কথা ভাবতে হবেনা। ‘
গলায় অভিমানের টোন। নাকিব চট করে উঠে বসলো। ফাহাকে টেনে উঠে বসালো। ‘ যাও চেঞ্জ করে সুতি কাপড় পরে আসো। ‘
‘ আপনি করিয়ে দিন। আমি পারবোনা। ‘
‘ আমি কিভাবে? ফাহা তোমার কি একটুও লজ্জা লাগছে না?’
‘ আপনি কি পর পুরুষ তাইযে আমার লজ্জা লাগবে? ‘
ফাহাকে বোঝানো দায়। নাকিব টেনে বিছানা থেকে নামায়। ‘ আমি হেল্প করছি সাথে থেকে। তুমি চেঞ্জ করবে আসো। ‘
ফাহা তাতেই রাজি। শাড়ির পিন আপ একে একে খুইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে নাকিব। ফাহাকে বলে ‘ অরগাঞ্জা কাপড়ের আর কোনো শাড়িই কখনো কিনবেনা। বাপরে বাপ! কতগুলো পিন লাগে!হুম এখন একা একা চেঞ্জ করো। ‘
‘ করিয়ে দিন। আমি পারবোনা। ‘
ফাহার একরোখা কথা। নাকিব রেগে গিয়ে বলে,
‘ এখন কি আমি তোমার ব্লাউজ ও চেঞ্জ করে দিবো ?’
‘ পেডিকোট সহ করবেন। আমি কিছুই পারবো না। ‘
ফাহা নাকিবের দিকে পিঠ করে দাঁড়ায়। নাকিব চোখ বন্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করে নেয়। ফাহার হাই নেক ব্লাউজে দুটো বাটন খুলতেই ফর্সা সুন্দর পিঠ বেরিয়ে আসে। তার উপর কালো মোটা দাগ। কিসের দাগ এসব দেখতে আরো বাটন খুলে নাকিব স্তব্দ হয়ে যায়। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘ ফাহা, এসব কি তোমার পিঠে? কে মারলো তোমাকে এভাবে?’
‘ এডভেঞ্চার করেছি তার চিহ্ন। আমি এখন পাহাড়ের চূড়ায়। ‘
ফাহা মনে মনে হাসলো। সেতো দেখাতে চেয়েছিলো বলেই এরকম নির্লজ্জ হয়েছে। এবার দেখা যাক নাকিব ফাহার সাথে খারাপ ব্যবহার কি করে করে। এটা দেখার পর মুখ থেকেই আনতে পারবেনা কখনো ফাহা তাকে জোর জবরদস্তি করে বিয়ে করেছে। নাকিব ফাহার সাথে আর একটাও কথা বললোনা। তাকে সুতি একটা থ্রি পিচ পড়িয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কাঁধ টেনে বুকে টেনে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো।মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘ ঘুমাও । ‘ ফাহা পরম শান্তিতে একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লো। নাকিবের চোখে ঘুম নেই। সে এই জেদি আহত অসুস্থ নতুন বউ ফাহাকে নিয়ে সাদা গোলাপী নীল হলুদ ভাবনা ভাবতে লাগলো ।
লাবিবার জন্য সব অর্গানিক খাবার আসে গ্ৰাম থেকে। ইসমাইল এবছর ধানের চাষ না করে সব জমিতে সবজি এবং ফলের চাষ করেছে। বাজারের ফর্মালিন যুক্ত খাবার লাবিবাকে দেওয়া হয়না। পুকুর থেকে মাছ তুলে নিয়ে আসা হয় প্রতি সপ্তাহে। গ্ৰামের মানুষের ঘরের হাঁস মুরগী কিনে আনা হয় যাতে কোনো মেডিসিন না প্রয়োগ থাকে। সকাল সকাল ইসমাইল চলে গিয়েছিলো যমুনার ঘাটে। সেখান থেকে তাজা চিংড়ি, বোয়াল মাছ নিয়ে এসেছে। রান্নাঘরে এসব ই কাটছে দুজন মহিলা বটি দিয়ে। লাবিবা নাকে ওড়না চেপে উঁকি দিলো।
‘ খালা এই মাছ কখন কুটা শেষ হবে? গন্ধে আর ড্রয়িং রুমে থাকা যাচ্ছেনা। এরপরে বাইরে বসবেন মাছ কুটতে। ‘
‘ আচ্ছা আম্মাজান। হয়েই গেছে প্রায়। ‘
‘ জবেদা পরিষ্কারের পর স্পে করে দিবে। ‘
সোহানা লাবিবাকে ডেকে ঘরে নিয়ে যায়।
‘ ঘরে বসেই থাকো। ড্রয়িং এ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘
তাফিফ লাবিবার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কাছে আসেনা। তামিম বলে দিয়েছে ছোটমাকে ধরবেনা। জুনিয়র ব্যাথা পাবে। জুনিয়রকে সে কিছুতেই ব্যাথা দিবে না। ফারাহকে সে মন মতো আদর করতে পারেনা। গালে চুমু দিলেই হাউ হাউ করে বাড়ি মাথায় তুলে। সেজন্য সে বিরক্ত ফারার প্রতি। লাবিবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ ছোটমা জুনিয়ল আদল খাবে?’
‘ হে বাবা খাবে। ‘
‘ হামি খাবে?’
‘ হে তুমি জুনিয়রকে হামি খাবে। ‘
‘ নো হাউ হাউ?’
‘ না বাবা একদমি কাঁদবে না। ভাইয়ার আদর পেয়ে খুশি হবে। ‘
‘ ওখে। ‘
স্বাভাবিকের তুলনায় লাবিবার পেট অস্বাভাবিক মাত্রায় বড় হয়েছে। নিজেকে নিয়ে চলা ফেরায় ভীষন কষ্ট পোহাতে হয়। ওজন তার নব্বইয়ের ঘর পাস করেছে। তানভীর সেজন্য বাইরে গিয়ে দুদন্ড শান্তি পায় না। প্রতিদিন কলেজে গিয়ে কাজ শেষ হতেই আবার বাড়ি চলে আসে। লাবিবার যা যা প্রয়োজন সব ইসমাইল ই নিয়ে আসে। আর তানভীর লাবিবার পাশে থাকে। যতক্ষন বাইরে থাকে সোহানা পাশে থাকে। পায়ে পানি এসেছে। হাটা চলার উপর থাকে সকাল বিকাল। রাতে ঘুমটাও তার হারাম। সেজন্য তানভীর ও ঘুমাতে পারেনা। বাচ্চা নড়াচড়ায় কোনো সমস্যা নেই । প্রচুর নড়াচড়া করে। মাঝে মাঝে একেকটা কিক দেয় লাবিবার চোখে জল চলে আসে। তানভীর অসহায়ের মতো দৃষ্টি ফেলে। লাবিবার চোখ মুছিয়ে শান্তনা দেয়। মাথায় বিলি কেটে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। তানভীর যতক্ষন পা টিপে দেয় ততোক্ষন লাবিবা ঘুমোতে পারে। না দিলেই ব্যাথা শুরু হয় চিলিক চিলিক করে। মাঝে মাঝে লাবিবা তানভীরের উপর মেজাজ দেখায়,
‘ এই আপনার বাচ্চাকে বের হতে বলেন। এক্ষুনি বের হতে বলেন। জ্বালিয়ে খেলো আমাকে। আর পারবোনা আমি একে পেটে রাখতে। ‘
‘ আর একটা মাস ওয়েট করো জান। সময়ের আগে কিভাবে পসিবল হবে?’
‘ যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে হবে। দরকার পড়লে এই একমাস আপনার পেটে থাকবে। তাও বলেন একে বের হতে। ‘
তানভীর বরাবরই আজকাল অসহায় ফিল করে। লাবিবার কষ্ট সহ্য হয়না আর। লাবিবার থেকে নিউজটা এখনো লুকানো আছে। একবাচ্চা ভেবে তানভীরকে যা তা করে। যখন শুনবে একজন নয় তার পেটে দুইজন আছে তখন কি কির্তী টা করবে আল্লাহ ই জানে। তানভীর লাবিবার সব দিক ভেবে বেবী সাওয়ারের অনুষ্টান স্কিপ করেছে। তাতে আপত্তি জানায় নাকিব। তার শখ সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দিবে। তানভীর তৎক্ষনাত ক্যামেরা নিয়ে আসতে বলে। অনুষ্ঠান ছাড়াই তাদের বেবী সমেত অনেক ড্রেসে অনেক মডেলে ছবি আছে। লাবিবার গায়ে আবারও শাড়ি ছেড়ে গাউন উঠে এসেছে। ম্যাক্সি তার একদমই অপছন্দের। কেনো জানি নাইট ড্রেস নাইট ড্রেস লাগে। এরমধ্যেই তানভীরের ঢাকায় কাজ পড়ে যায়। ইসমাইল শোনা মাত্রই নাকচ করে।
‘ তোমার পরিবর্তে অন্য কাউকে পাঠাও। আমার মেয়ের যা অবস্থা তুমি ছাড়া সামলাবে কে? যদি কোনো প্রব্লেম হয়ে যায় এর মধ্যে। আমার বয়স হয়েছে। আমি কি এতো পারি? তাছাড়া বাড়ির মেয়েরা পারবেনা জানা কথা। ‘
‘ পাঁচটা দিন সবাই মিলে সিকিউরিটি দিতে পারবেন না? নিচের গেষ্ট রুমে রেখে যাই ওকে। উপরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘
‘ তুমি তাহলে ক্যান্সেল করতে পারবেনা?’
‘ পারলে আমিই আগেই করতাম আব্বু। আপনাকে রিকুয়েস্ট করার প্রয়োজন হতো না। ‘
‘ হুম যাও তাহলে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসবে। পাঁচদিনের কথা বলে যাচ্ছো। ছয়দিনে যেনো না গিয়ে ঠেকে। আমার মেয়ের সমস্যা হলে আমি কিন্তু দিবোনা তারপর আমার মেয়ে। ‘
তানভীর আনমনে হাসে। ব্যাটা শ্বশুড়! কথায় কথায় তার চোটপাট। মনে হয় শ্বশুড়ের মেয়ে বিয়ে করেছে না তার ঘরে ছুড়ি কাঁচি সমেত বড় সড় ডাকাতি করেছে। আজীবন তাকে এই শ্বশুড়ের চোট পাট সয়ে যেতে হবে। তানভীর আরেকটু ঝোল দেয়,
‘ আমাকে না দিয়ে কোথায় রাখবেন আপনার মেয়েকে?’
‘ নেক্সট ভাবা হবে। ‘
তানভীরের ইচ্ছে করলো সামনের চেয়ারটা এক বারিতে ভেঙে ফেলতে। এই কাজ করলে নিশ্চিত তার বেয়াদবের খাতায় নাম উঠবে। তানভীরকে রেগে মেগে বেরিয়ে যেতে দেখে ইসমাইল হাসে। শ্বশুড়দের হতে হয় কড়া। জামাইদের রাখতে হয়ে চোখের ইশারায়। তাহলে মেয়েদের উপর কখনো অত্যাচার করার চিন্তাও দেখাবেনা। যে মেয়েদের গার্ডিয়ান সুতোয় ঢিল দেয় তাদেরকেই গার্ডিয়ান ছাড়া ভেবে ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার, নির্যাতন করা হয়। ইসমাইলের একাংশ মোটেও তার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে চায়না। সেজন্য আগে ভাগেই সাবধান থাকে।
তানভীরকে লাগেজে কাপড় ভরতে দেখে লাবিবা জিজ্ঞেস করে, ‘ কোথায় যাচ্ছেন? ‘
‘ ঢাকা যাচ্ছি পাঁচ দিনের জন্য। ‘
‘ তাহলে আমি কোথায় থাকবো?’
তানভীর লাগেজ ছেড়ে লাবিবার দিকে এগিয়ে এসে দেয়ালে দুহাত চেপে ধরে। লাবিবা ঢুক গিলে। হুটহাট এর এতো রাগের কি হলো?
‘ তোমার আব্বু কি পেয়েছে হ্যা? আমাকে হুমকির উপর রাখে। ভাবে আমি তাকে ভয় করবো উনাকে? এতো সোজা সব? তোমার আমার থেকে মুক্তি নেই। আমি যদি মরেও যাই না? তার আগে তোমাকে আমার দশ ছেলের মা বানিয়ে যাবো। আমার দশ ছেলে মানুষ করতেই তুমি বুড়িয়ে যাবে। তোমার বাপের কথা শুনার সুযোগটাও হবে না। ‘
ঘটনা প্রসঙ্গ লাবিবার মাথার উপর দিয়ে গেলো। তানভীর বেরিয়ে যায় কলেজের উদ্দেশ্য। সেখান থেকে ফিরে রাতে রওনা দিবে। তার আগে বউকে আদর করে যেতে ভুললো না।
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা