ভালোবাসার চেয়েও বেশি পর্ব-২২+২৩

0
2806

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-২২

★ রাত ৯ টা। নূর বিছানায় শুয়ে আছে। চোখের কোন দিয়ে অঝোরে পানি পরছে। আবারো মিথ্যে স্বপ্ন দেখলি তুই। তুই কি ভেবেছিলি আদিত্যের মতো একটা ছেলে তোকে পছন্দ করবে।সবই তোর মিথ্যে স্বপ্ন। প্রতিবারের মতো যা দিনশেষে ভেঙে গেল। আর তুই আবারও বোকা প্রমাণ হলি। আসলেই তুই একটা একনাম্বারের গাধা। সেইজন্যই ওই মেয়েটার কাছে এতগুলো খারাপ কথা শুনতে হলো তোকে।তুই এইটারি যোগ্য। বামুন হয়ে চাদ ধরার সাহস করেছিস। সেই জন্যই আজ মুখ থুবড়ে পড়তে হলো।
নূর এতক্ষণ মনে মনে এসব ভেবে নিজেকেই নিজে বকছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। নূর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আদিত্য ফোন করেছে। আদিত্যের কল দেখে নূরের রাগ উঠে যায়। মনে মনে ভাবে নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকতে আমাকে কেন ফোন করছেন? নূরের আরো কান্না আসে। ও ফোন রিসিভ না করে রেখে দেয়। বাজতে বাজতে একসময় কেটে যায়। একটু পরে আবারও বেজে ওঠে। এভাবে অনেক বার কল আসার পরেও নূর রিসিভ করে না। একটু পরে টুন করে একটা ম্যাসেজ আসে। নূর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আদিত্যের ম্যাসেজ।

” নূর প্লিজ শুধু একবার আমার ফোন উঠাও। কথা বলো আমার সাথে। আমার অনেক টেনশন হচ্ছে। ”

পড়তে পড়তেই আবার আদিত্যের কল আসে। নূর এবার ফোনটাই বন্ধ করে ফেলে। কিছুতেই কথা বলবে না ওই লোকের সাথে। কখনো না।

আদিত্য নূরের ফোন বন্ধ পেয়ে প্রচুর রেগে যায়। নিজের ফোনটা বেডের ওপর ঠাস করে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ঘরের ভেতর পায়চারী করতে থাকে। আর বিড়বিড় করে বলে।
…. কাজটা একদম ঠিক করলে না নূরপাখি। আমাকে এভাবে অশান্তিতে রেখে তুমি ফোনটা বন্ধ করে ফেললে? সাহস অনেক বেড়ে গেছে তোমার। একেতো ক্যাম্পাসে আমার সাথে দেখা না করে ওভাবে চলে গেলে। ফোন দিলাম তাও ধরলে না। এখন আবার ফোনটাও বন্ধ করে দিলে? কাল একবার দেখা হতে দাও। তারপর বুঝাবো আমাকে ইগনোর করার মজা।

———————————–

নূর মন খারাপ করে মাথা নিচু করে চুপচাপ রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। গলির মাথায় আসতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো। আদিত্য প্রতিদিনকার মতো গাড়ি নিয়ে বসে আছে । কিন্তু নূর আজ আদিত্যের গাড়িতে উঠবে না। তাই ও আদিত্যের গাড়ী দেখেও না দেখার ভান করে অন্য দিকে ঘুরে রাস্তার আইলেন দিয়ে হাটা শুরু করে।

নূরের এভাবে চলে যাওয়া দেখে আদিত্যের রাগ আরো বেড়ে যায়। একেতো কাল থেকে এমনিতেই নূরের উপর রেগে আছে। তারউপর এখন আবার ওকে এভাবে ইগনোর করা দেখে আদিত্যের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রাস্তার মধ্যে নাম ধরে ডাকলেও সিনক্রিয়েট হতে পারে। নূরের সমস্যা হতে পারে, তাই আদিত্যও কিছু বললো না।

নূর অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ রাস্তার একপাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। হঠাৎ সাঁই করে এসে নূরের পাশে আদিত্যের গাড়ী ব্রেক করলো।

আচমকা এমন হওয়ায় নূর একটু ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। আদিত্য ফট করে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হয়। নূর কিছু বুঝে উঠার আগেই আদিত্য নূরের এক হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে গাড়ির কাছে এনে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের দরজা খুলে নূরকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দেয়। তারপর আবার দরজা বন্ধ করে নিজে যেয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়।

আদিত্য কোনো কথা না বলে চোখ মুখ শক্ত করে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
নূরের ভয়ে আত্মা বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আদিত্যকে দেখেই বুঝতে পারছে যে আদিত্য প্রচুর রেগে আছে। নূর একটা ঢোক চিপে মনে মনে একটু সাহস যুগিয়ে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
….দে দেদেখু……….

নূরের কথা শেষ হওয়ার আগেই। আদিত্য নূরের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলে উঠলো।
…..জাস্ট সাট আপ। নট এ্যা ওয়ার্ড। চুপচাপ বসে থাকো।নাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

নূর যেটুকু সাহস যুগিয়েছিলো আদিত্যের ধমকে তা বানের জলে ভেসে যায়। ভয়ে মিনি বিড়ালের মতো গুটিশুটি মেরে বসে থাকে।
আদিত্য আবার সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।

—————————————–

এ্যানি নিজের রুমের সবকিছু ভাংচুর করছে। বারবার শুধু কাল আদিত্যের করা অপমান গুলো মনে পরছে এ্যানির। ভাংচুর করছে আর বলছে। তুমি এটা ঠিক করোনি আদি। একদম ঠিক করোনি। ওই দু টাকার মেয়ের জন্য আমাকে এভাবে অপমান করলে? ওই নূরকে তো আমি কিছুতেই ছাড়বো না। কিছুতেই না। তোমাকেতো আমার হতেই হবে। যে করেই হোক।

এ্যানির বাবা মেয়ের রুম থেকে ভাংচুরের শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে মেয়ের রুমে আসে। এ্যানিকে এভাবে ভাংচুর করতে দেখে এ্যানির বাবা এ্যানির হাত ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো।
…..কি হয়েছে মামুনি? এতো রেগে আছো কেন? কেউ কিছু বলেছে? বাপিকে বলো?

এ্যানি ওর বাবার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো ।
…..বাপি আমি আদিত্যকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমার আদিত্যকে চাই। প্লিজ বাপি ওকে আমার করে দেও প্লিজ প্লিজ।

এ্যানির বাবা মুচকি হেসে বললো।
…..বাচ এই কথা? তা এতে এতো রাগারাগির কি আছে? তুই আদিত্যকে ভালোবাসিস এটাতো অনেক ভালো কথা। তুই চিন্তা করিস না। আমি আজই আদিত্যের বাবার সাথে কথা বলবো তোর আর আদিত্যের বিয়ের ব্যাপারে। আদিত্যের বাবা নিশ্চয় আমার কথা ফেলতে পারবে না।

এ্যানি খুশি হয়ে বললো।
……সত্যিই??? বাপি ইউ আর দা বেস্ট। আই লাভ ইউ।

……হুম। এখন নিজের মুড ঠিক করো যাও।

এ্যানির বাবা নিজের রুমে এসে আদিত্যের বাবাকে ফোন দিলো।আদিত্যের বাবা ধরে বললো ।
….কিরে কেমন আছিস? অনেকদিন পরে ফোন দিলি?

……এইতো আছি ভালো। শোন তোকে একটা দরকারে ফোন দিয়েছি।

….হুম বল?

তারপর এ্যানির বাবা সব কথা খুলে বললো। এবং এ্যানি আর আদিত্যের বিয়ের প্রস্তাবও দিলো।আদিত্যের বাবা সব শুনে বললো।
….দেখ আমার ছেলেমেয়েদের খুশীই আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো জিনিস। ওরা যেটাতে খুশী থাকবে আমিও সেটাতেই খুশি। তুই যখন বলছিস আমি আদির সাথে কথা বলে দেখবো। আদি যদি রাজি থাকে তাহলে আমারও কোনো সমস্যা নেই। তবে যদি আদি মানা করে তখন আমিও কিছু করতে পারবো না।

এ্যানির বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
….ঠিক আছে আদিত্যের সাথে কথা বলে দেখ।তারপর কি বলে আমাকে জানাস।

….ঠিক আছে।

————————————

একটা নদীর কিনারায় নির্জন নিরিবিলি জায়গায় এসে আদিত্য গাড়িটা একপাশে করে থামায়। তারপর গাড়ি থেকে বের হয়ে নূরের পাশে এসে দরজা খুলে নূরের হাত ধরে গাড়ি থেকে বের করে গাড়ির সাথে চেপে ধরে দাঁড় করায়। আদিত্য নূরের দুই পাশে নিজের দুই হাত গাড়ির ওপর রেখে নূরকে দুই হাতের মাঝে আটকে ফেলে। তারপর নূরের দিকে হালকা ঝুকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
……হাউ ডেয়ার ইউ? তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে ইগনোর করার? কাল ভার্সিটিতেও আমার সাথে দেখা না করে চলে গেলে। ফোন দিলাম ফোনও ধরলে।আবার এখনো আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলে। সমস্যাটা কি তোমার? তুমি জানো? কাল থেকে কতটা টেনশনে ছিলাম আমি?

নূর বেচারি ভয়ে কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। একটা ঢোক চিপে মনে একটু সাহস যুগিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
….দে দে দেখুন কাল আপনার গা গা গার্লফ্রে…….

নূর আর বলতে পারলো না। তার আগেই আদিত্য একটা রাম ধমক দিয়ে বললো।
….ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু, কল হার মাই গার্লফ্রেন্ড। সি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড। ডিড ইউ হিয়ার মি? সি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড অর এনিথিং ইলস্। সি ইজ নাথিং টু মি।

আদিত্যের কথা শুনে নূর অবাক হয়ে তাকালো আদিত্যের দিকে। উনি কি সত্যিই বলছে? ওই মেয়েটা কি তাহলে উনার গার্লফ্রেন্ড না? তাহলে কি আমি উনাকে ভুল বুঝলাম? কিন্তু ওই মেয়েটা যে বললো????

নূরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য আবার বলে উঠলো।
……কাল যখন ওই এ্যানি তোমাকে এতোগুলো কথা বললো। তখন কেন তুমি ওর মুখের ওপর জবাব না দিয়ে চুপচাপ চলে এলে? তোমাকে আমি বলেছি না? কেউ কিছু বললে আমাকে বলবে? তাহলে কেন আমাকে না বলে চলে গেলে? নাকি আমার ওপর তোমার বিশ্বাস ছিল না? আমার চেয়ে বেশি তোমার ওই এ্যানির কথায় বিশ্বাস ছিল? তাইতো আমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলে না? আমি তোমাকে বলেছিলাম না? এ্যানি শুধু আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে আর কিছুই না। তারপরও তোমার কাছে আমার চেয়ে ওই মেয়েটা কি বললো সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ন মনে হলো? সত্যিই আমি এটা ভেবেই অবাক হচ্ছি যে আমি এতোদিনে তোমার এতটুকু বিশ্বাসও অর্জন করতে পারিনি। কাল তানি এসে সবকিছু না বললে হয়তো আমি জানতামও না। তুমি জানো কাল কতটা টেনশনে ছিলাম আমি?

নূর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মাথা নিচু করে মনে মনে ভাবছে। আমি সত্যিই অনেক বড়ো গাধা। সবকিছু না জেনেই ওনাকে ভুল বুঝে বসে আছি। এসব ভেবে নূরের খুব খরাপ লাগছে। আদিত্যের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না।

নূরের চুপ করে থাকা দেখে আদিত্য আবারও একটা ধমক দিয়ে বললো।
…..চুপ করে আছো কেন? আনসার মি ড্যাম ইট।

নূর আর সহ্য করতে না পেরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে নাক টেনে টেনে অস্পষ্ট স্বরে বললো।
….স স সরি,,,,, আ আসলে কাল আমার খুব খা খাখারাপ লেগেছিল ওনার ক ক কথায় তা তাই…..

আদিত্যের এবার নিজেরি খুব খারাপ লাগছে নূরকে কাঁদতে দেখে। নূরের কান্না যে কিছুতেই ওর সহ্য হয়না। মেয়েটার সাথে মনে হয় একটু বেশিই কঠোর বিহেব করে ফেলেছে ও।নূরের কান্না দেখে আদিত্য কোনো কিছু না ভেবে নিজের দুই হাত দিয়ে নূরের মাথাটা আলতো করে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে উঠলো।
….হুঁশশ শুশশ শুশ। ওঁকে ওঁকে আমি বুঝতে পেরেছি। এখন কান্না বন্ধ করো প্লিজ।

নূরও নিজের অজান্তেই আদিত্যের বুকে মাথা রেখে, বুকের শার্ট হাত দিয়ে খামচে ধরে
কাঁদতে লাগলো।আদিত্যের বুকে মাথা রেখে, নূরের মনে হচ্ছে এটাই যেন পরম সুরক্ষিত আর শান্তির জায়গা।
আদিত্য নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।একটু পরে ধীরে ধীরে নূরের কান্না থেমে আসে।

নূরের হঠাৎ হুঁশ আসে যে ও কোথায়। হুঁশ আসতেই নূর ঝট করে আদিত্যকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে।
……আ আ আমাদের দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। এ এখন যাওয়া উচিত।

আদিত্য নূরের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো।
….হুম ঠিক আছে চলো।

তারপর ওরা দুজন আবার গাড়িতে উঠে রওনা হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। গাড়ির ভেতর নূর লজ্জায় আর কোনো কথা বলেনি আদিত্যের সাথে।
————————————

নূর ক্লাসে যেয়ে তানির পাশে যেয়ে বসে পরলো।
তানি নূরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো।
….তুই ঠিক আছিস? কাল ওভাবে চলে গেলি।জানিস আমার কতো চিন্তা হচ্ছিল?

নূর মুচকি হেসে বললো।
….আমি ঠিক আছি। কাল একটু মন খারাপ ছিল। তবে এখন ঠিক আছি।

তানি একটু উৎসাহিত হয়ে বললো।
….তুই জানিস? কাল তুই চলে যাওয়ার পর এখানে কতো বড়ো সিন হলো? জেইন কসম” একদম সুপার ডুপার বাম্পার হিট সিন। ইশশ তুই মিস করে ফেললি। তুই থাকলে তুইও দেখতে পারতিস। আমিতো আদিত্য ভাইয়ার ফ্যান না পুরা এসি হয়ে গেছি।

নূর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো।
….মানে? কি বলছিস তুই? ঠিক করে বল।

তারপর তানি নূরকে কালকের সব ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে নূর থ হয়ে গেলো। আদিত্য আমার জন্য এসব করেছে? আর আমি কিনা উনার উপর মিথ্যে রাগ করে বসে ছিলাম?
নূরের ভাবনার মাঝেই তানি আবার বললো।
…. কাল ওই এ্যানি ফ্যানি কুত্তার নানির যে হাল হয়ে ছিলো। আমার যা খুশি লাগছিল দেখে, তোকে কি বুঝাবো। আর একটা কথা জানিস? কাল ভাইয়ার কথা শুনে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর হয়ে গেছি যে আদিত্য ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে।

তানির কথা শুনে নূরের মনের ভেতর খুশির বর্ষা শুরু হয়ে গেলো। হাজারো রঙিন প্রজাপতি উড়তে লাগলো। মনে মনে আওরাতে লাগল, উনি আমাকে ভালোবাসে? সত্যিই ভালোবাসে? নূর খুশিতে যেন হাওয়ায় ভাসতে লাগলো।

তানি দুষ্টু হেসে নূরের ঘাড়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো।
….কিরে? কোথায় হারিয়ে গেলি? ভাইয়ার খেয়ালে?হি হি…

নূর লজ্জা পেয়ে বললো।
…ধ্যাৎ এ এ এমন কিছুই না।

একটু পর তানি একটু সিরিয়াস হয়ে বললো।
….আচ্ছা শোন,একটা কথা বলার ছিল।

…..কি? বল?

…..আসলে আবির বললো কাল নাকি আদিত্য ভাইয়ার জন্মদিন। তাই ওরা সবাই মিলে আদিত্য ভাইয়াদের গাজীপুরে যে ফার্মহাউস আছে ওখানে যাবে সেলিব্রেট করতে। আদিত্য ভাইয়ার তেমন ইচ্ছে ছিল না।কিন্তু আবির আর তাসির দুজনে মিলে রাজি করিয়েছে। ওখানে বাইরের কেউ যাবে না শুধু ওরা তিনজন আর আদিত্য ভাইয়ার বোন সানা যাবে। এটা একটা পিকনিকের মতন হবে আর কি।

…..তো? এসব আমাকে বলছিস কেন?

….বলছি কারণ, আবির আমাকেও যেতে বলছে ওর সাথে। কিন্তু আমার একা যেতে কেমন যেন লাগছে তাই বলছিলাম যে তুইও চলনা আমাদের সাথে। আদিত্য ভাইয়ারও অনেক ভালো লাগবে তুই গেলে।

নূর চমকে উঠে বললো।
…আমি? পাগল হয়ে গেছিস তুই? তুই জানিস না আমার বাসার খবর? ছোট মা জানতে পারলে আমার জান কবাজ করে ফেলবে।

…হ্যাঁ জানিতো। তবুও দেখনা তুই যদি একটু কোনো ভাবে একটু ম্যানেজ করতে পারিস। আমরা সকালে যেয়ে আবার সন্ধার আগেই ফিরে আসবো। আর আদিত্য ভাইয়াও নিশ্চয় খুশি হবেন তোকে দেখে।

নূর একটু চিন্তায় পড়ে গেল। মন মনে ওরও ইচ্ছে হচ্ছে আদিত্যের জন্মদিনে ওর পাশে থাকার।কিন্তু ও যে ইচ্ছে করলেও যেতে পারবে না। ছোট মা সেটা কখনও হতে দিবে না। নূর মন খারাপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
————————————

নূর কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে হেঁটে যাচ্ছে আদিত্যর সাথে দেখা করার জন্য। পেছন থেকে দেখতে পেল আদিত্য ব্রেঞ্চের ওপর বসে আছে। তানির বলা সেই কথাটা যে আদিত্য ওকে ভালোবসে।কথাটা মনে পরতেই নূর নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে লাজুক হাসলো । তারপর নিজেকে একটু ঠিক করে আদিত্যের কাছে গেলো। আদিত্যের কাছে আসতেই আদিত্য মুচকি হেসে নূরকে বসতে বললো। নূর চুপচাপ আদিত্যের পাশে বসে পড়লো। আজ কেন যেন ওর খুব লজ্জা লাগছে।

আদিত্য নূরকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হঠাৎ আবির তাসির আর তানি এসে ওখানে হাজির হলো। আদিত্য ওদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো।
….কি ব্যাপার তোরা এখানে কি করছি?

আবির ক্যাবলা হাসি দিয়ে বললো।
…ভাই জাস্ট টু মিনিটস।আমাদের কিছু কথা আছে ভা,,, আই মিন নূরের সাথে। বলেই চলে যাবো।

আদিত্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
… নূরের সাথে কি কথা?

…আরে বলতে দিলেতো বলবো।

আবির নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….আসলে নূর কাল ভাইয়ের জন্মদিন। তাই আমরা প্লান করেছি। কাল আমরা সবাই মিলে আমাদের ফার্মহাউসে যাবো। তাই তোমাকেও বলছি।তুমিও আমাদের সাথে গেলে আমাদের অনেক ভালো লাগতো। তো বলো তুমি আসবে।

নূর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ইচ্ছে থাকা সত্বেও হ্যাঁ বলতে পারছে না ।নিজের ফ্যামিলি প্রবলেমের কথা এদের কিভাবে বুঝাবে?

আদিত্য নূরের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। যদিও নূর আসলে সবচেয়ে বেশি খুশি আদিত্যই হবে। তবুও নূরের ফ্যামিলির কথা ওর ভালো করেই জানা আছে। তাই নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…..তোমার কোনো সমস্যা হলে দরকার নেই। ইটস ওকে।উই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।

নূর কিছু না বলে শুধু একটা ম্লান হাসি দিল।
——————————————

গাড়ির ভেতর বসে আছে নূর। গাড়ি সিগনালে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা একটু খারাপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ওর নজর গেল সামনে থাকা একটা বাইকে। বাইকে একটা ছেলের পেছনে একটা মেয়ে বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা স্বামী স্ত্রী। কারণ মেয়েটা শাড়ি পরা পেছন থেকে ছেলেটার কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে আছে। কোনো একটা কথা নিয়ে দুজন হাসছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা অনেক সুখী।
নূরের কাছে ব্যাপারটা অনেক কিউট লাগছে। ওদের দেখে নূর মুচকি হাসছে।

আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে নূরকে এমন মুচকি হাসতে দেখে আদিত্যের ভ্রু কুঁচকে আসলো। তারপর নূরের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকালো। আদিত্য দেখলো নূর বাইরে একটা বাইকে বসে থাকা দম্পতির দিকে তাকিয়ে আছে। আদিত্য মনে মনে ভাবলো নূরের কি বাইক পছন্দ?
পিছন থেকে আস হর্ণের শব্দে দুজনেরই ধ্যান ভাংলো। আদিত্য সামনে তাকিয়ে দেখলো সিগনাল গ্রিন হয়ে গেছে। তাই ও তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দিল।
তারপর নূরকে নামিয়ে দিয়ে আদিত্য চলে গেলো।

চলবে………..

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি💞💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-২৩

★নূর বাসায় ঢুকে দেখলো ওর সৎ মা রুবিনা বেগম আর রবি কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বসে আছে। সামনে কাপড় চোপড় ভরা দুটো লাগেজ দেখা যাচ্ছে। নূরকে আসতে দেখে রুবিনা বেগম বলে উঠলো।
…..তুই এসে গেসিছ? তাহলে শোন আমি রবিকে নিয়ে আমার বাবার বাড়ি যাচ্ছি। জনি হাসপাতালে ভর্তি। আর বাবাও অনেক অসুস্থ। তাই কিছুদিন ওখানেই থাকবো।

নূর মনে মনে ভাবলো ওই বদমাইশটার আবার কি হলো। যাই হোক ভালোই হয়েছে। সারাজীবন যেন হাসপাতালেই থাকে।
নূরের ভাবনার মাঝেই রুবিনা বেগম আবার বলে উঠলো।
…..রিপা ওর ফ্রেন্ডসদের সাথে টুরে গেছে। তাই বাসায় শুধু তুই থাকবি। বাসার ঠিক ঠাক খেয়াল রাখবি বুজেছিস? আমি নেই দেখে কোনো কাজের ফাঁকি দিবি না কিন্তু বলে দিলাম।

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….জ্বি ছোট মা আমি সবকাজ ঠিক ঠাক করে নিবো। তুমি চিন্তা করোনা।

রুবিনা বেগম নিজের পার্সটা আনার জন্য রুমে গেল। রবি এই ফাঁকে নূরকে বললো।
….জানো আপু? শুনেছি ওই জনিকে কারা যেন সেই মারা মেরেছে। একদম হাত পা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। কতদিন হলো হাসপাতালে ভর্তি আছে। আমারতো সেই খুশি লাগছে। ওই জনিকে আমার একদম পছন্দ না।

রবির কথা শুনে নূরেরও মনে মনে অনেক খুশী লাগছে।
একটু পরে রুবিনা বেগম রবিকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

——————————–

আদিত্যের বাবার রুমের দরজায় এসে নক করলো আদিত্য। বিকালে ওর বাবা ফোন করে বাসায় আসতে বলেছে। কোনো দরকারি কথা আছে নাকি। তাই অফিস শেষ করে আদিত্য চলে এসেছে।
আদিত্যের বাবা ভেতর থেকে বললো।
….দরজা খোলাই আছে ভেতরে এসো।

আদিত্য ভেতরে ঢুকে বেডের ওপর ওর বাবার পাশে যেয়ে বসলো। তারপর ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।
… কেমন আছো বাবা?তোমার শরীর কেমন এখন?

আদিত্যের বাবা মুচকি হেসে বললো।
…আমি ভালো আছি।

….তা কি জেনো বলবে বললে?

আদিত্যের বাবা একটু গম্ভীর হয়ে বললো।
….হ্যা একটা কথা বলার ছিল।

….তো বলো কি বলবে?

আদিত্যের বাবা আদিত্যকে এ্যানির বাবার বলা সব কথা খুলে বলে। তারপর আদিত্যকে জিজ্ঞেস করে।
…তোমার কি মতামত এ ব্যাপারে?

সব শুনে আদিত্যের চরম রাগ হতে লাগলো এ্যানির ওপর। মেয়েটার কোনো লজ্জা নেই নাকি? এতকিছুর পরেও আবার বাবার কাছে বিয়ের কথা বলেছে।
আদিত্য ওর বাবার হাত ধরে নরম স্বরে বললো।
….তুমি আমার বাবা। তুমি যেটা বলবে আমি চোখ বুজে সেটাই করবো। তবে তার আগে তোমাকে একটা কথা জানাতে চাই বাবা। সেটা শোনার পর তুমি যে ফয়সালা করবে আমি সেটাতেই রাজি।

আদিত্যের বাবা বললো।
…..কি কথা? বলো?

……বাবা আমি নূরকে ভালোবাসি। আর ওকে বিয়ে করতে চাই।

আদিত্যের বাবা একটু গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
….আমি যদি নূরকে মেনে না নেই?

আদিত্য অনেক ভয় পেয়ে গেল ওর বাবার কথায়। সত্যিই যদি বাবা রাজি না হয় তাহলে কি করবে ও? নূরকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে ও। এসব ভেবে আদিত্য করুণ চোখে ওর বাবার দিকে তাকালো।

আদিত্যর বাবা হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর বাবার দিকে।
হাসি থামিয়ে আদিত্যের বাবা বললো।
….তুমি কি ভেবেছো আমি জানি না? আমি তোমার বাবা, তোমার মুখ দেখেই সব বলে দিতে পারি। আমিতো সেদিনই সব বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিলাম।

আদিত্য অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো।
….তারমানে নূরকে তুমি মেনে নিয়েছো?

….অবশ্যই। আমারতো মেয়েটাকে খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েট সত্যিই অনেক ভালো।

আদিত্য খুশি হয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে।
….আমি জানতাম বাবা তুমি কখনও আমার কথা ফেলবে না। আই লাভ ইউ বাবা।

পিছন থেকে সানা এসে দুই গালে হাত রেখে খুশি আর উত্তেজিত হয়ে বললো।
…সত্যিই????? ওয়াও ভাইয়া আই এ্যাম সো হ্যাপি। নূর আপু আমার ভাবি হবে? আমার যে কি খুশি লাগছে। বলতে বলতে আদিত্যের পাশে বসে আদিত্যকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আবার বললো।
…..আমিতো এখন থেকেই ওকে ভাবি ডাকবো।ওয়াও কত্ত মজা হবে।

আদিত্য তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো।
….এই না না খবরদার! এখুনি ওকে ভাবি বলবি না। কারণ আমি এখনো ওকে কিছু জানায়নি। তাই এখুনি এসব বলা যাবে না।

সানা ঘাড় ঝাকিয়ে বললো।
…ঠিক আছে ভাইয়া। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই হবে।

আদিত্যের বাবা আদিত্যকে বললো।
….শোন তোমাকে আরেকটা কথা বলার ছিল।

…জ্বি বাবা বলো?

…..আসলে গ্রামে আমাদের জমিজমা নিয়ে একটা ভেজাল হয়েছে। তাই আমাকে একটু গ্রামে যেতে হবে। তোর চাচুকে পাঠাতাম, কিন্তু ও এসব ভালো বুঝবে না তাই আমাকেই যেতে হবে। হয়তো কিছুদিন থাকাও লাগতে পারে।

….কিন্তু বাবা তোমার শরীর মাত্রই ঠিক হয়েছে। গ্রামে গিয়ে যদি আবার অসুস্থ হয়ে পরো?

….আরে নাহ কিছু হবে না। তুই চিন্তা করিস না। ওখানে দেখাশুনা করার জন্য লোক আছে।

…..ঠিক আছে বাবা।তুমি যেটা ভালো মনে করো। কবে যেতে চাচ্ছো?
…..পরশু যাবো।

….ঠিক আছে।
————————————–

সন্ধ্যা ৬ টা
নূর একটু বই নিয়ে বসেছে। হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো। নূর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো তানি কল করেছে। নূর ফোন রিসিভ করে বললো।
…হ্যালো। হ্যাঁ বল।

তানি করুন সুরে বললো।
….ইয়ার নূর তুই কি সত্যিই যাবি না। একটু চেষ্টা করে দেখ না। তুই বললে আমিই নাহয় তোর ছোট মার সাথে কথা বলে দেখতাম। কোনো মিথ্যে বাহানা দেখিয়ে দিতাম।

নূর একটু মুচকি হেসে বললো।
….তার আর দরকার হবে না।

তানি ভ্রু কুঁচকে বললো।
… কেন?

….কারণ ছোট মা বাসায় নেই। সে রবিকে নিয়ে বাবার বাড়ি গেছে। কদিন নাকি ওখানেই থাকবে।

তানি খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো।
….ওয়াট??? ওয়াও এটা তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এখন তো আর কোনো প্রবলেমই নেই। এখন নিশ্চয় তুই যেতে পারবি?

নূর একটু আমতা আমতা করে বললো।
….কি কিন্তু এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

….আরে ঠিক হবে মানে? আলবাত ঠিক হবে।আমি আর কোনো কথা শুনবো না।তুই যাবি মানে যাবি।এন্ড দ্যাটস্ ফাইনাল। একবার ভাব তোকে দেখলে আদিত্য কতো খুশি হবেন।

নূর একটু লাজুক হেসে আস্তে করে বললো।
….ঠিক আছে।

তানি খুশি হয়ে বললো।
…ইয়েস্। আই লাভ জানু। আমার যা খুশি লাগছে। আমরা সবাই একসাথে অনেক মজা করবো। এখন তাহলে রাখি বায়।

…বায়।

—————————————

রাত ১১-৫৯
আদিত্য মাত্রই বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। আজ আর নিজের ফ্লাটে যায়নি। এই বাসায়ই থেকে গেছে। সকালে এখান থেকেই ফার্মহাউসে চলে যাবে। হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো। আদিত্য বিরক্ত হয়ে ভাবলো এতরাতে আবার কে ফোন দিল।আদিত্য ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো নূর কল করেছে। আদিত্য চমকে গিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসলো। এই প্রথম নূর ওকে নিজের থেকে কল করেছে তাও আবার এতরাতে। মেয়েটার কিছু হলো নাতো? কথাটা ভেবেই আদিত্য তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে বললো।
….নূর তুমি ঠিক আছো? কিছু হয়নিতো তোমার?

নূর একটু আমতা আমতা করে বললো।
….আ আআমি ঠিক আছি। কিছু হয়নি।

আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর আবার বললো।
….তাহলে এতরাতে ফোন দিলে যে? কিছু বলবে?

….হ হ হ্যাঁ।

…..কি বলবে?বলো?

নূর চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো।
….হ্যাপি বার্থডে।

আদিত্যের কুঁচকে থাকা ভ্রু জোড়া বিস্ময়ে টান টান হয়ে গেলো। চোখ মুখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। আদিত্য ঠোঁট কামড়ে হেসে ভাবলো মেয়েটা তাহলে ওকে উইশ করার জন্য ফোন দিয়েছে। আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
…..ধন্যবাদ। তা আমাকে উইশ করার জন্য কি এতরাত পর্যন্ত জেগেছিলে? না মানে, তুমি যেই ঘুম কুমারী। এতক্ষণ ঘুমিয়ে তলিয়ে যাওয়ার কথা।

নূর লজ্জায় আর কোনো কথায় বলতে পারছে না। শুধু আঙুল দিয়ে বিছানার চাদর প্যাঁচাচ্ছে। আসলেই তো সে আদিত্যকে উইশ করার জন্যই এতক্ষণ না ঘুমিয়ে বসে আছে।

আদিত্য বললো।
…কথা না বললে তাহলে ফোন রেখে দেই নাকি?

নূর তড়িঘড়ি করে বললো।
…..শু শুশুনুন। একটা কথা বলার ছিল।

…..হুম বলো?

….আ আ আসলে আমি কাল যেতে পারবো।

আদিত্য অবাক হয়ে বললো।
…সরি??? কি বললে তুমি? আবার বলবে প্লিজ।

…আমি কাল আপনাদের সাথে যেতে পারবো।

আদিত্যর মনে হচ্ছে ও স্বপ্ন দেখছে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না। নূর সত্যিই কাল সারাদিন ওর সাথে থাকবে? ওর জন্মদিনে ওর পাশে থাকবে? আদিত্য কিছু একটা ভেবে নূরকে বললো।
…তোমার বাসায় কোনো সমস্যা হবে নাতো?

নূর বললো।
….আসলে বাসায় কেউ নেই। তাই কোনো সমস্যা হবে না।

আদিত্য অনেক খুশী হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো তুমি জানোনা তুমি আমাকে কতবড় গিফট দিলে।এটা আমার জন্মদিনের সেরা গিফট হবে নূরপাখি। হঠাৎ আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো।
….এক মিনিট, তারমানে তুমি এখন বাসায় একা আছো?

নূর আস্তে করে বললো।
…হুম।

….ভয় করছে?

….হুম ভয়তো করছেই।কিন্তু কি করবো কিছু করার নেই।

….ভয় পেয়োনা আমি আছিতো। আমার সাথে কথা বলতে থাকো। দেখবে আর ভয় পাবে না।

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
.. ঠিক আছে।

তারপর দুজন টুকটাক করে নানান কথা বলতে লাগলো। কথা বলতে বলতেই নূর একসময় ঘুমিয়ে পরলো।
নূরের কোনো সারা শব্দ না পেয়ে আদিত্য বুঝতে পারলো নূর ঘুমিয়ে পরেছে। আদিত্য মুচকি হেসে আবারও নূরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে সেও একসময় ঘুমিয়ে পরলো।
————————————-

ভোর ৫-৩০ এর এলার্ম বাজতেই নূর তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে পড়লো। ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল।নামাজ শেষ করে নূর রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রীজ থেকে দুধের প্যাকেট বের করে পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিল দুধ গলার জন্য। ততক্ষণে নূর বাসার সব টুকটাক কাজ সেরে নিলো।
তারপর আবার রান্নাঘরে এসে চুলায় একটা পাতিল বসালো। দুধের প্যাকেট ছিড়ে পাতিলে দুধ ঢাললো। কতক্ষণ পরে দুধ গরম হয়ে আসলে তার ভেতর একমুঠ পোলার চাউল দিয়ে দিল।

সেদিন আদিত্য ওর মায়ের কথা বলার সময় বলেছিল। আদিত্যের মা নাকি প্রতিবার আদিত্যের জন্মদিনে ওর জন্য পায়েস রান্না করে নিজের হাতে খাওয়াতো। সেই কথাটা মনে করে নূরও তাই আদিত্যের জন্য আজ পায়েস রান্না করছে। ওতো আর আদিত্যকে কোনো দামী উপহার দিতে পারবে না। তাই এইটুকুই করার চেষ্টা করছে।

পায়েস রান্না শেষ হলে একটা বক্সে ঢেলে ফ্রীজে রাখলো ঠান্ডা হওয়ার জন্য। তারপর নূর নিজের রুমে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আদিত্য কাল বলেছিল রেডি হয়ে থাকতে। ও এসে নিয়ে যাবে।
———————————

সকাল ৭ টা
আদিত্য ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ বিকট একটা শব্দে আদিত্য ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো আবির আর সানা জোঁকারদের মতো মাথায় কোন ওয়ালা টুপি।হাতে আর গলায় রংবেরঙের জরি আর পালক পেঁচিয়ে রেখেছে। দুজনের হাতে দুটো প্যাঁপু বাঁশি। দুজন বেডের দুইপাশে উঠে প্যাঁপু বাঁশি বাজিয়ে চিল্লিয়ে বলছে।
….হ্যাপি বার্থডে ভাইয়া।

আদিত্য চরম বিরক্ত হয়ে বললো।
…এই থামবি তোরা? কি শুরু করেছিস সকাল সকাল? এভাবে কেউ কাউকে উইশ করে? আরেকটু হলেতো আমার কানের পর্দা ফেটে যেতো। তোরা কি বড়ো হবি না কখনো?

আদিত্যের ধমক শুনে দুজন সুড়সুড় করে বেড থেকে নেমে দাড়ালো। আবির ন্যাকা স্বরে বললো।
….এল্লা কি কস ভাই? আমি আর সানা কাল সারারাত ধরে বসে থেকে। গুগলে সার্চ দিয়ে দিয়ে এমন একটা ট্রেন্ডি স্টাইল বের করলাম উইশ করার। আর তোর পছন্দই হলোনা? এইডা কোনো কথা? আরে তুই কি বুঝবি? এসব লেটেস্ট ট্রেন্ড ব্রো। টপ লেভেলের ব্যাপার স্যাপার। আমার মতো ট্যালেন্টেড লোকেরাই এসব পারে বুঝলি? আর কি বড়ো হবিনা,বড়ো হবিনা লাগিয়ে রেখেছিস? আর কতো বড়ো হবো? এখন কি বড়ো হতে হতে ছাঁদ ভেঙে বেড়িয়ে যাবো নাকি?

আদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
….হইছে? তোদের ট্যালেন্টের প্রদর্শন করা শেষ? এখন কি গ্রান্ড সেলুট দেবো নাকি?

আবির খুশিতে গদগদ হওয়ার ভাব ধরে বললো।
…না না এসবের আবার কি দরকার? এটাতো আমাদের কর্তব্য। তাই নারে সানা?

সানা মাথা ঝাকিয়ে বললো।
..হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।

আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
…তোরা যাবি এখন এখান থেকে?

….হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি যাচ্ছি। আমরা কি এখানে ঘর বাধতে এসেছি নাকি? চল সানা।বলেই আবির সানার হাত ধরে চলে যেতে নেয়। দরজার কাছে যেয়ে আবার ফিরে এসে বললো।
….বায়দা চিপা গলি আমরা বের হবো কখন? আর গাড়ি কোনটা নিবো?

আদিত্য বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো।
…একটু পরেই বের হবো।আর গাড়ি তোদের যেটা ইচ্ছা সেটা নিয়ে যা।আমি গাড়তে যাবো না।

আবির ভ্রু কুঁচকে বললো।
…কেন তুই আবার কিসে যাবি?

…আমি বাইক নিয়ে যাবো।

সানা এক্সাইটেড হয়ে বললো।
…ওয়াও ভাইয়া তাহলে আমিও তোমার সাথে বাইকে যাব।

আদিত্য সানার দিকে তাকিয়ে বললো।
…না তুই গাড়িতে করে যা। আমি নূরকে নিয়ে যাবো।

সানা খুশি হয়ে বললো।
…তার মানে নূর আপুও যাবে? ওয়াও তাহলেতো আরো মজা হবে ইয়েএএ।আমি এখুনি যেয়ে রেডি হচ্ছি। বলেই একছুটে চলে গেলো সানা।

আদিত্য আবিরের দিকে তাকিয়ে দেখলো আবির ওর দিকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
…ওয়াট??এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

আবির দুই হাত উপরে তুলে তালি দিতে দিতে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
….বাহ্ ভাই বাহ্। নিজেকে টম ক্রুজ বানিয়ে আমাদের হিরো আলম বানিয়ে দিলি?

….মানে?

….মানে তুই বাইক নিয়ে স্টাইল মেরে ভাবিকে নিয়ে যাবি। আর আমরা মুরুব্বিদের মতো গাড়ি নিয়ে যাবো? এটা কেমন বিচার?

….তুই এতো ড্রামা কিভাবে করতে পারিস বলতো?

আবির ক্যাবলা হাসি দিয়ে বললো।
….কি করবো ভাই? “সবকো আতি নেহি, মেরি যাতি নেহি”।

…হইছে থাম এখন। আর তোদের ইচ্ছে হলে তোরাও বাইক নিয়ে যা। আমি কি না করেছি নাকি?

আবির খুশি হয়ে বললো।
…দ্যাটস গ্রেট আইডিয়া ব্রো।আমরা তিনজনই বাইক নিয়ে যাবো। হেব্বি হবে। আমি এখুনি তাসিরকে বলছি।

…ঠিক আছে।

—————————–

নূর রেডি হয়ে গলির মাথায় এসে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্যের জন্য । আদিত্য ফোন করে জানিয়েসে ও আসছে। তাই নূর ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ একটা বাইক এসে নূরের সামনে ব্রেক করলো । নূর একটু ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল।

একটু পরে বাইকে থাকা লোকটা মাথার হেলমেট খুলতেই নূর অবাক হয়ে গেল। এটাতো আদিত্য! নূর হা হয়ে তাকিয়ে রইলো আদিত্যের দিকে। আদিত্য একটা ব্লাক কালারের ডেনিম স্কিন টাইট প্যান্ট পরেছে। গায়ে হোয়াইট টিশার্টের ওপর মেরুন কালারের লেদার জ্যাকেট। চোখে ব্লু সানগ্লাস। সব মিলিয়ে আদিত্যকে কোন হলিউডের হিরোদের মতো লাগছে। আদিত্য হেলমেট খুলে চুলগুলো ঝাকিয়ে ঠিক করছে। নূর যেন চোখ ফেরাতেই পারছে না আজ। মনে মনে ভাবছে উনি এতো সুন্দর কেন? একটু কম হলেওতো পারতো।

আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে দেখে নূর ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আদিত্য বাঁকা হেসে বললো।
….সব দেখা কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখবে?

আদিত্যের কথায় নূর থতমত খেয়ে গেল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। তারপর আবার আদিত্যের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো।
….আজ হঠাৎ বাইক?

….এমনি ইচ্ছে হলো তাই। এখন সময় নষ্ট না করে উঠে বসো।

নূর একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো।
….কিন্তু আমি আগে কখনো বাইকে উঠিনি।আমার কেমন যেন ভয় করছে।

…ভয় কিসের? আমার উপর ভরসা নেই তোমার?

নূর মাথা ঝাকালো। মানে হ্যাঁ।

আদিত্য মুচকি হেসে বললো ।
….তাহলে এখন উঠে বসো।

নূর দুই পা একদিকে ঝুলিয়ে আদিত্যের পিছনে উঠে বসলো।
আদিত্যর থেকে একটু ফাঁক রেখেই এক হাত দিয়ে বাইকের পিছনের অংশ শক্ত করে ধরে বসল নূর।

আদিত্য বললো।
…ঠিক করে আমাকে ধরে বসো নাহলে পরে যাবে।

নূর জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে বললো।
…আমি ঠিক আছি। সমস্যা নেই।

আদিত্য আর কিছু না বলে বাইক স্টার্ট দিল ।
বাইক সামনে এগুতেই নূর নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে আদিত্যের পিঠের ওপর ঘেঁষে পড়লো। নূরের হাত যেয়ে পরলো আদিত্যের কমোড়ে আর মুখ যেয়ে পড়লো আদিত্যের ঘাড়ে।

আদিত্য একটু জোরে বললো।
…দেখেছো এইজন্যই বলেছিলাম আমাকে ধরে বসো। নাহলে ব্যালেন্স রাখতে পারবে না। যেহেতু প্রথম বাইকে উঠেছো তাই ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যেতে পারো । তাই বলছি আমাকে ভালো করে ধরে বসো।

নূর কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে আদিত্যকে ধরতে লজ্জাও করছে আবার পরে যাওয়ার ভয়ও করছে। বর্তমানে পরে যাওয়ার ভয়টায় বেশি। তাই নূর আর কিছু না ভেবে আদিত্যের কমড়ে হাত দিয়ে ধরে বসে রইলো।

অনেকক্ষণ পরে বাইক যখন শহর ছেড়ে আসলো তখন বাইরের শো শো বাতাসে নূর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। এখন ওর কাছে অনেক ভালো লাগছে। চোখ বন্ধ করে সময়টা উপভোগ করতে থাকলো।

আয়নায় নূরকে দেখে একটা তৃপ্তির হাসি দিল আদিত্য। নূরকে এভাবে দেখে আদিত্যের অনেক ভালো লাগছে। এটাইতো ও চায়। এই মেয়েটার খুশির জন্য ও সব করতে পারবে।

নূরের নাক আদিত্যের ঘাড়ের কাছে থাকায় আদিত্যের শরীর থেকে একটা মনমাতানো ঘ্রাণ এসে লাগলো নূরের নাকে। কেমন পাগল করা নেশা ধরানো ঘ্রাণ। নূর চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই নিজের নাকটা আরেকটু নিচের দিকে নামিয়ে ভালো আদিত্যের শরীরের ঘ্রাণ নিতে লাগলো। নূর যেন কোনো মোহে হারিয়ে যাচ্ছে।

দুজন এভাবেই দুজনের মোহে হারিয়ে পরিবেশটা উপভোগ করতে করতে যাত্রা করলো।

চলবে……