#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৪
ভোরে একটু ঘুম ঘুম এলো। কিন্তু বেশিক্ষণ আর ঘুমোতে পারলাম না। কি করে জানি চাচা আজ জলদি উঠৈ গেল। অতঃপর তার ডাকে ঘুম থেকে উঠে ঘর দোর সব ঝাড়ু দিলাম। চাচা গোয়াল ঘর থেকে গরু কে বের করে বাইরে আনল। অতঃপর তাদের খেতে দিল। আমি সবার জন্য ভাত রান্না করলাম আর গতকালের তরকারি গরম করলাম। ইলিশ মাছ দিয়ে ফুলকপি রান্না করেছিলাম আর ডাল। শীতের দিনে একটা বিশেষত্ব হলো বাসি তরকারি খেতে বেশ ভালো লাগে। কার কাছে কেমন লাগে জানি না তবে আমার কাছে বেশ লাগে।
ফুলি কে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে অতঃপর সবাই মিলে একসাথে খেলাম। চাচা একজন কে এনেছেন যাকে ঘরে রাখা হবে। গরু গুলো আর ঘর দেখাশোনার জন্য। অতঃপর সবাই বের হলাম আমরা!
আমরা এখান থেকে সোজা এতিম খানায় গেলাম। আহিয়ান’রা নাকি সেখানেই যাবে। আমাদের যেতে যেতে অনেক বেলা গড়িয়ে গেল। আমাদের বাড়ি থেকে এতিমখানা অনেক দূরে তবে ভাইয়া দের বাড়ি থেকে তা অনেকাই কাছে। অনেকটা কাছে বলতে শুধু দু’মিনিটের পথ। আসলে ভাইয়ারা তাদের আগে বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো দুজন থাকবে বলে ছোট ঘর নিয়েছে কিন্তু না তারা আরো বড় ঘর নিয়েছে। এতো বড় ঘর নেবার পরও আমার মা বাবা কে তাঁদের ঘরে ঠাঁই দিতে পারলো না তারা!
এতিমখানায় এসে দেখি আহিয়ানরা চলে এসেছে। কাজ ও শুরু হয়ে গেছে। বাবুর্চি রা রান্না শুরু করে দিয়েছে। নাহান আর আনাফ ভাইয়া সেখানে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে রাখছে। যাতে এখানে তারা না আসে। আহিয়ান আর আকাশ ভাইয়া কে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো অন্যকোথায় গেছে তারা। চাচা এসেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। ফুলি বাচ্চাদের সাথে খেলছে। এতিমখানাটা অনেক বড় আর সুন্দর। চারদিক গাছপালায় ঘেরা। বাচ্চাদের জন্য দোলনা আছে এখানে। আমি ঘুরতে ঘুরতে এতিমখানার পেছন দিকে এলাম। দেখি সেখানে ছোট্ট ভীড় হয়ে আছে। সেই ভীড়ের মাঝে আহিয়ান আর আকাশ ভাইয়া। তারা সব বাচ্চাদের বেলুন দিচ্ছে। বাচ্চারা একেকজন বলুন পেয়ে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।
আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাহিনী দেখছি। আকাশ ভাইয়া আমাকে দেখে বলে উঠে,
“নিহা!
আহিয়ান আমাকে না দেখেই বেলুন হাতে নিয়ে বলে,
“ভূতনির আবার কি হলো!
তার এই কথায় সব বাচ্চারা পেছনে ফিরে আমার দিকে তাকাল। আহিয়ান বেলুন হাতে নিয়ে চুপ হয়ে আছে।একটা বাচ্চা আমার হাত ধরে বলল,
“তুমি ভূতনি!
এই কথায় আকাশ ভাইয়া ফিক করে হেসে দিল। আহিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো তিনি জানতেন না আমি এখানে। বাচ্চা গুলো আমাকে ঘেরাও করে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
“তুমি কি সত্যিই ভূত।
আহিয়ান বলে,
“ওটা ভূত না ভূতনি!
“এই আপনি কি বলছেন এসব।
“যা সত্যি তাই বলছি। ভূতনি কে ভূতনি বলবো না তো কি বলবো।
আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে । বাচ্চারা সব হেসে উঠলো। অতঃপর আমি রেগে চলে এলাম সেখান থেকে। দোলনায় এসে বসে পড়লাম কিছুক্ষণ বাদেই ফুলি কিছু বাচ্চাদের নিয়ে এলো খেলা করার জন্য। আমরা সবাই মিলে জোট করলাম কানামাছি খেলবো। সবাই বুদ্ধি খাটিয়ে আমাকে চোর বানালো। মনে হচ্ছে কেউ চোর হতে রাজি হয় নি তাই ফুলি ইচ্ছে করেই আমার কাছে এসেছে। যাই হোক আমি ওদের সাথে খেলতে লাগলাম।
খেলতে খেলতে একসময় একজনের সাথে ধাক্কা খেলাম। আমি প্রথমে ভাবলাম কোন বাচ্চা তাই তাকে ধরলাম। ধরার পর বুঝলাম এটা বাচ্চা না চোখের কাপড় সরিয়ে দেখি আহিয়ান দাঁড়ানো। তাকে দেখেই দ্রুত পিছিয়ে গেলাম। আহিয়ান কিছু না বলে চলে গেল। সবাই হেসে উঠলো। আমি নিজের মাথায় নিজেই বাড়ি মারলাম।
সারাদিন ওদের সাথেই খেলাধুলা করেই কেটে গেল। অতঃপর দুপুরে দোয়া পড়ানোর পর বাচ্চাদের খেতে বসানো হলো। আহিয়ান সব বাচ্চাদের খাবার দিচ্ছে। বাচ্চাও অনেকজন। চাচা আমাকে খাবার দিয়ে বলল সবাইকে খাবার দিতে। আমিও সব বাচ্চাদের খাবার দিতে লাগলাম। কিছু কিছু বাচ্চা খাবার নেবার জন্য ভূতনি ভূতনি বলে ডাকতে লাগল। তাদের দেখাদেখি ফুলিও ভূতনি আপু ভূতনি আপু বলে ডাকতে লাগল। মেজাজ খারাপ করে আহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখি সে হাসছিল। মেজাজ গেলো আরো বিগড়ে।
.
বিকালে সকল বাচ্চাদের কিছু উপহার দেওয়া হলো। বাচ্চারা উপহার পেয়ে লাফালাফি করছিল। এর মাঝেই আমার মা এসে উপস্থিত! মা কে দেখে আহিয়ান ওরা সবাই কথা বলতে লাগল। মা কে দেখে খুব বিচলিত মনে হলো। আশেপাশে যেন কাউকে খুঁজছে। আমি এলাম মা’র কাছে। মা আমাকে দেখে আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরলেন। যা আন্দাজ করেছিলাম তাই! কিছু একটা তো হয়েছে। আমি মা কে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হয়েছে মা তোমাকে এমন লাগছে কেন?
“তোর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হইয়া গেছে। ।
“কি বলছো এসব। ঔষধ খায়নি ঠিক মতো।
“খাইছে তো।
“তাহলে আবার অসুস্থ হলো কিভাবে?
“কিছুই বুঝপার পারতাছি না। তোর ভাইয়া ডাক্তার ডাকতে গেছে। তোর ভাবী কইলো তুই এহানে তাই আমি…
এতটুকু কথা শোনার পর আমি ছুটে এলাম ভাইয়ার বাড়িতে। আমার ছুটে আসা দেখে চাচা আর আকাশ দুজনেই এলো আমার সাথে।
ভাবীদের বাসায় আসার পর খুব বড়সর একটা চমক খেলাম। খালেদ এখানে! তাকে দেখেই আমি স্থির হয়ে গেলাম। খালেদ সাথে করে ডাক্তার নিয়ে এসেছিল, অতঃপর ডাক্তার কে নিয়েই সে চলে গেল। তবে সে অস্বাভাবিক ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তার চাহনি আমার মোটেও ভালো লাগে নি।
বাবার সাথে দেখা করলাম। একদিন না দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সন্ধ্যা অবদি বসে রইলাম তার কাছে। এখন অনেকটা হলেও সে সুস্থ। আকাশ ভাইয়া কিছুক্ষণ ছিলেন অতঃপর সেও চলে গেল। চাচাও গেলেন তার সাথে।
রাতের বেলায় চাচা চাইলেন বাবা কে নিয়ে যেন আমরা বাড়িতে ফিরে আসি কিন্তু ভাইয়া আর ভাবী কোন ভাবেই ছাড়তে রাজি হলেন না। তাদের এক কথা বাবা অসুস্থ তাই সুস্থ না হওয়া অবদি এইখানেই থাকবেন। বাবা অসুস্থ বলে আমাকেও তাদের বাড়িতে থাকতে হলো। ফুলি রয়ে গেল এতিমখানায় বাচ্চাদের সাথে।
আমাকে থাকতে দেওয়া হলো এক রুমে, ভাইয়া আর ভাবী অন্যরুমে, মা আর বাবা একরুমে আর চাচা থাকার ব্যবস্থা করলেন বাড়ির দাওয়ায়। বাবা একটু ঘুমানোর পর’ই আমি এসে বসলাম ঘরে। রাতে কিছু খায় নি চাচা খেতে বার বার বারন করে গেছে। আমি ঘরে ভিতর তবুও কেন জানি আহিয়ানের গলার স্বর পাচ্ছি বলে মনে হলো। আমি উঠে জানালার কাছে যেতেই দেখি ওদের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। হয়তো আহিয়ান গাড়ির কাছেই। আকাশে ধোঁয়া উড়ছে আহিয়ান সিগারেট খাচ্ছে। চাচা’র কাছে শুনেছি আজ’ই রাতের ট্রেনে তারা ফিরে যাবে।
আমি দরজা আটকে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। চোখ কখন লেগে গেলো বুঝতে পারি নি। হঠাৎ ঘুমের ঘোরেই খুব বাজে গন্ধ নাকে আসতে লাগল। কেউ হয়তো নেশা জাতীয় কিছু খেয়ে আমার কাছে এসেছে এমন লাগছে আমার কাছে। সে হয়তো আমার অনেক কাছে যার কারনে তার মুখের ভারী নিঃশ্বাস আমার উপর পড়ছে। ঘুমের মাঝেই অস্বস্তি লাগছিল। মূহুর্তে’ই চোখ খুলে তাকালাম। সামনে তাকাতেই আমি ভয়ে চমকে উঠলাম। সে আমার মুখ চেপে ধরলো। এটা আর কেউ না খালেদ ছিল। আমি কুফির আলোয় বেশ তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমি তার হাত থেকে মুখ ছোটানোর চেষ্টা করছি কিন্তু সে ততোই জোরে আমারে ধরে রেখেছে। তার শক্তির সাথে পেরে উঠছি না আমি। খালেদ হেসে বলতে লাগল,
“কি ভাবছিলি আমার থেকে পালাইয়া গেলে বাইচা যাবি! তুই জানোস না তোর লইগা আমি আমি কতো কথা হুনছি। আমার মান সম্মান সব গেছে তোর লইগা। বিয়ে ছাইড়া পালাইয়া গেছিল তুই, আজ দেখমু কেমনে পালাইস!
বলেই আমার পিঠে হাত রাখল। আমি যত সম্ভব শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিলাম। নেশাগ্রস্ত থাকায় একটু হেলতে দুলতে শুরু করল সে। আমি জোরে চিৎকার করতে লাগলাম,
“বাঁচাও! বাঁচাও আমাকে বাঁচাও। মা, বাবা, চাচা , ভাইয়া বাঁচাও..
বলতে বলতে খালেদ আবারো আমার মুখ চেপে ধরলো। আমি অনেক কষ্টে মুখ থেকে হাত সরানোর পর পালিয়ে যেতে ধরলাম। সে আমার চুলের মুঠি ধরে বলল,
“পালাবি তুই! আবার পালাবি!
বলেই আমাকে খুব জোরে চড় মারল। ওর চড় খেয়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। তবুও চিৎকার করতে লাগলাম। খালেদ আমাকে আবার উঠিয়ে জোরাজুরি করতে লাগলো। খুব ধস্তাধস্তি হলো, ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে দিলাম আমি। যেন আওয়াজ পেয়ে কেউ ছুটে আসে। আমার সাথে পেরে না উঠে সে আবারো আমাকে চড় মেরে বিছানায় ফেললো। আমি ততোক্ষণে দুর্বল হয়ে গেলাম। মাথা ঘুরতে লাগলো আমার। ঠোঁটের কোন থেকে রক্ত ও পড়ছে। আমি সামনে ফিরতেই দেখি সে শার্টের বোতাম খুলে আমার দিকে আগাচ্ছে। মুখে খুব বিচ্ছিরি এক প্রকার হাসি। তখন আমি বাইরে থেকে চাচা, মা আরো কয়েকজনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম, তারা দরজা ধাক্কাচ্ছে। তার আওয়াজে সাহস কিছুটা হলেও বাড়ল আমার।
সে আমার দিকে আগাতেই আমি দ্রুত সেখান থেকে উঠে দরজা কাছে যেতেই পেছন থেকে সে আমার ঘাড়ে হাত ধরে আমাকে টান দিল। আমি সেখান থেকে ছুটে যেতেই ঘাড়ের দিক থেকে জামার কিছু অংশ ছিঁড়ে গেল। আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। এর মাঝেই দরজা ভেঙে গেল। আর আহিয়ান সহ সবাই এলো ঘরে। তাদের থেকে আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল!
#চলবে….
#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৫ ( #বোর্নাস_পার্ট )
ভর সভায় দাঁড়িয়ে আছি আমি স্থির ভাবে। শরীরে একটা উড়না দিয়ে ঢাকা। এখনো সেই জামা’টাই পড়ে আছি। নিজেকে কেমন শক্ত পাথর বলে মনে হচ্ছে! গ্রামের সকল মানুষ উপস্থিত এই সভায়। সবাই তাদের নিজেদের কথা বলতেই ব্যস্ত। মা আমার পাশেই আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কান্না কাটি করছে। চাচা আমার থেকে একটু দূরে আছে। আমার ভাইয়া আর ভাবী খালেদের সাথে দাঁড়ানো। এতেই বোঝা যায় আমার সাথে যা হয়েছে এতে তারাই দায়ী। বাবা কড়া ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল তাই তার ঘুম এখনো ভাঙে নি। আর আমার ঘর থেকে মা বাবা’র ঘরটা দূরেই ছিল। আমার ঘরের সাথে ঘরে ছিল ভাইয়া আর ভাবী আর এই ঘটনার পর তারাই দেরি করে এসেছে যেখানে তাদের আগে আশা উচিত।
মূহুর্তে’ই মনে পড়ছে তখনকার সেই হিংস্র পরিস্থিতি’র কথা। আমাকে ওরকম অবস্থায় দেখে আহিয়ান মাথা নিচু করে ফেলল। আমি দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। মা ঘরে এসেই তার গায়ের আঁচল দিয়ে আমাকে ঢাকল। আমি মা কে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আহিয়ান বিছনা পড়ে সেই মনুষ্যত্ব হীন মানুষ টা কে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। মারছিলো তাকে! শুধু সে না আমার চাচা আর আকাশ ভাইয়াও। পুরো গ্রামে তখন’ই জানাজানি হয়ে গেল। পাশেই এতিমখানা থাকায় সেখানকার লোকজন ছুটে এলো।
গ্রামের কিছু লোক আর ভাইয়া মিলে তাদের আটকালো। তাকে আমার ভাইয়া বলতেও ঘৃণা লাগছে আমার। ভাই হয়ে নিজের বোনের এমন সর্বনাশ কিভাবে করল সে। হ্যাঁ আমি তার সৎ বোন তাই বলে কি একবারও বিবেক বাধা দিলো না তাকে। এতো বছর তাদের সাথেই তো ছিলাম তবুও কি একটু মায়া লাগলো না আমার প্রতি।
গ্রামের লোকেরা মিলে বিচার করার জন্য চেয়ারম্যান কে ডেকে নিয়ে এসেছে। তার সাথে এসেছে আরো অনেকজন। আমি শুধু’ই স্থির ছিলাম চোখ দিয়ে কোন অশ্রু বের হচ্ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল প্রাণ হীন একটা দেহ। আমার ঠিক সামনে বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে আহিয়ান, আকাশ, নাহান আর আনাফ ভাইয়া।
গ্রামের এক মুরব্বি খালেদ কে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি স্বীকার করছো তুমি এই মেয়েকে ধর্ষণ করতে চেয়েছো।
খালেদ হয়তো না বলবে আর সব দোষ চাপাবে আমার উপর। আমাকে পুরো গ্রামের মানুষের কাছে ছোট্ট করবে, অপমান করবে। বলবে টাকার জন্য আমি এমনটা করেছি। কিন্তু না তা না। খালেদ এইসব না বলে স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠে,
“হ্যাঁ আমি নিহারে ধর্ষণ করতে চাইছি। আমাগো বিয়ার হবার কথা ছিল। বিয়ার দিন ওই পালাইয়া গেছিল তাই রাগে আমি এমনটা করেছি।
লোকটি অবাক স্বরে বলে,
“তার মানে তুমি নিজের দোষ স্বীকার করছো।
“হো করতাছি। তার লগে আরেকটা কথাও কইতাছি। আমি এহনো বিয়া করতে চাই নিহা রে। আপনারা সবাই জানেন আমার পরিস্থিতি কেমন। নিহা সুখেই থাকবো, ওর কোন কষ্ট হইবো না।
খালেদের কথায় আমি সহ উপস্থিত সবাই অবাক। এমন একটা কথা কিভাবে বরতে পারে সে। সেই লোকটা রেগে বলে উঠে,
“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে এইসব কথা কিভাবে বলছো। আমি এখন’ই তোমাকে পুলিশে দিতে পারি এটা তুমি জানো।
“হ জানি। আমার জেল হইবো ফাঁসি হইবো। সব জানি আমি। কিন্তু আপনারা কহনো এইঠা ভাবছেন নিহা’র কি হইবো। ওরে আর কহনো কেউ বিয়া করবো কি না। একদিন হুনবেন গলায় ফাঁসি দিয়া মইরা গেছে।
খালেদের কথায় সবাই চুপ। তবে কথাটা তো সত্য। সবাই তো আর লড়াই করতে পারে না। কেউ কেউ লোকলজ্জার ভয়ে আত্নহত্যা’ই পথ’ই বেঁচে নেয়। আমি কি তার ব্যতীক্রম হতাম। হয়তো বা হতাম! এর মাঝেই চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আমাকে আর মা কে একটা ঘরে ডাকেন সে। চাচাও যায় আমাদের সাথে। চেয়ারম্যান আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আমি যতটুকু জানি তুমি পড়ালেখা জানা মেয়ে। শিক্ষিত মেয়ে! নিজের ভালোটা তাহলে বুঝবে তুমি। খালেদের প্রস্তাব কিন্তু খারাপ না। তুমি কি কিছু বলতে চাও।
তার কথায় আমি মাথা উঁচু করে তার মুখের দিকে তাকালাম। কেন জানি তার চেহারায় মাঝে খালেদের হিংস্র চেহারাটা ভেসে উঠছিল। মনে হচ্ছিল তারা সবাই খালেদের সাথে মিশে আছে। চেয়ারম্যান এর কথা শুনে চাচা খুব ক্ষেপে যান। তার সোজা কথা তিনি এই বিয়েতে রাজি না। কোনমতে না!
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তুই কি চাস মা!
আমি মা’র মুখের দিকে তাকাই। কাঁদতে কাঁদতে বেহাল দশা বানিয়েছে মুখটার। তার কথার অর্থ আমি বেশ বুঝতে পারছি। মা’র এমন কথায় চাচা রেগে বলেন,
“কি কইতাছো তুমি এসব ভাবি, নিহা’র গার্ডিয়ান আমরা। আমরা যা কমু তাই হইবো। তুমি আবার নিহা রে কি সব জিগাও!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,
“এই বিয়েতে রাজি আমি।
আমার কথায় পুরো পরিবেশ থমকে যায়। চাচা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেন,
“কি বললি তুই।
চেয়ারম্যান সাহেব উত্তেজিত হয়ে বলে,
“তুমি ঠিক বলছো তো নিহা।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াই। আমার হ্যাঁ তে তার চোখে মুখে এক ধরনের হাসির রেখা। মনে হচ্ছে খালেদের থেকে সেই বেশি খুশি। মোটা অংকের টাকা পাবে হয়তো।
আমার হ্যাঁ শুনে চাচা রেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। কেউই বুঝলো না আমায়। আমি যদি এখন খালেদ কে বিয়ে না করি তাহলে তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেত। সমস্যা সেখানে না সমস্যা হলো তারপর! তারপর’ই আমার মা আর বাবা’র প্রতি অমানবিক নির্যাতন হতো। যেহেতু আমাকে গ্রামে পেতো না সেহেতু তারা’ই ছিল একমাত্র যাদের অত্যাচার করে সে নিজের জ্বালা জুড়াত। আর পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেও বেরিয়ে আসতে বেশিদিন লাগতো না সেটা চেয়ারম্যান সাহেবের আচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমার এই অনুমান টা সবাই বুঝল না।
চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে নিয়ে আবারো সভায় এলেন। অতঃপর জোরে চেঁচিয়ে বলেন,
“নিহার সাথে আমার কথা হয়েছে আর আমরা একটা সিদ্ধান্তে এসেছি।
মুরব্বি বলে উঠে,
“কি সিদ্ধান্ত? নিহা কি বিয়েতে রাজি!
“সেটা নিহা নিজের মুখেই বলবে। নিহা বলো তুমি কি বিয়েতে রাজি!
আমার গলা কাঁপছিল। গলার স্বর ভারী হয়ে যাচ্ছিল। চোখের কোনে অশ্রু কণা এসে জমচ্ছিল। তবুও একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমি বলে উঠি,
“হ্যাঁ আমি রাজি!
মূহুর্তে’ই আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। দৌড়ে আমি ঘরে চলে এলাম। হয়তো আমার এই কথায় সবাই অনেক অবাক। আহিয়ান, আকাশ, নাহান আর আনাফ ভাইয়া হয়তো হতবাক হয়ে গেছিলেন। শুধু খুশি হয়েছিলেন খালেদ আর আমার ভাইয়া ভাবী। আমাকে ধর্ষণ না করলে কি হবে দাগ তো খালেদ লাগিয়ে দিয়েছিল। কেন জানি মনে হচ্ছে সে এটাই চেয়েছিল। আমি নিজের মুখে বিয়েতে হ্যাঁ বলি। অপমান’র প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।
.
কাঁদতে কাঁদতে চোখের অশ্রু একসময় শুকিয়ে গেল। ফুলি আমার পাশে বসে এতোক্ষণ কথা বলছিল এখন সেও চুপ। ভেবেছিলাম বিয়েটা আজ রাতেই হবে কিন্তু না। খালেদ নাকি বেশ আয়োজন করে বিয়ে করবে। বরযাত্রী নিয়ে সানাই বাজিয়ে আসবে বিয়েতে। তাই বিয়েটা হবে কাল। কি অদ্ভুত!
ঘরের এক কোনে বসে আছি নিশ্চুপ হয়ে। মা আর ভাবী একটু আগেই আমাকে গোসল করিয়েছে। চুলের পানি এখনো শুকায় নি। নতুন জামা আমার গায়ে তাতে কি! কলঙ্ক তো লেগে গেলো। এই কলঙ্ক আর উঠবার নয়। আচ্ছা আহিয়ান, আকাশ ভাইয়া এখনো কি আছে। না তা কি করে হয়, ফুলি বলেছে তারা চলে গেছে। হয়তো আমার এমন অবস্থা দেখে তারা সকলেই হতবাক আর হতাশ। তবে এই হতাশা কয়েকদিনের!
গভীর কালো অন্ধকার রাত। এর চেয়েও অন্ধকার হয়ে আছে আমার জীবন। কিন্তু সূর্য উঠলেই এই আঁধার কেটে আলো ছড়িয়ে যাবে চারদিক। আলোকিত হবে পুরো দুনিয়া শুধু অন্ধকার থেকে যাবে আমার জীবনটাই!
হঠাৎ ঘরে কালো ছায়া পড়ল। আমি স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম ছায়া টার দিকে। কে আসবে হয়তো মা নাহলে ভাবী। একজন বলবে শোকের কথা আর অন্য জন বলবে তাচ্ছিল্যের কথা। হায়রে দুনিয়া!
কিন্তু এই ছায়া টা শুধু দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলছে না। আমি মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি একজন । অন্ধকারে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। আমার পায়ের কাছে একটা হারিকেন জ্বলছে। এছাড়া আর কিছু নেই।
ফুলি বলে উঠে,
“মালিক সাহেব আফনে!
আমি ভাবতে লাগলাম এই “মালিক সাহেব” কে। মূহুর্তে’ই মনে পড়ল ফুলি আহিয়ান কে মালিক সাহেব বলে ডাকে। তাহলে কি আহিয়ান এসেছে।
ছায়াটা আরো দু পা ঘরে আগালো। এবার পরিষ্কার মুখ দেখা যাচ্ছে এটা আহিয়ান! সে দৃঢ় ভাবে বলল,
“ফুলি তুমি বাইরে যাও তোমার আপুর সাথে আমার কথা আছে!
ফুলি বাধ্য মেয়ের মতো উঠে চলে গেলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আহিয়ান দরজা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। তাতে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত না। দুজনেই মুখোমুখি আমরা! আহিয়ান আমার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া কড়া গলায় বলে উঠে,
“কি করলে এটা তুমি!
আমি শান্ত ভাবে মাথা নিচু করে উওর দেই,
“কি করেছি।
“তুমি জানো না কি করেছো তুমি? এতোটা অসহায় কিভাবে ভাবতো পারো নিজেকে।
“আমি যে কতোটা অসহায় আপনি বোধহয় তা জানেন না আহিয়ান।
“বিয়ে করলে তোমার অসহায়ত্ব কেটে যাবে।
“কেটে যাবে না তবে কমবে অবশ্যই!
“পাগল হয়ে গেছো।
আমি হেসে বলি,
“আপনি আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতেন আমি ঠিক কতোটা পাগল হয়ে গেছি।
“তোমার চাচা’র কথা টা শুনলে ভালো হতো।
“হয়তো। তবে এই কলঙ্ক কখনো আমার নাম থেকে মুছতো না। বোঝা হয়ে থেকে যেতাম মা বাবা’র উপর। কখনো বিয়ে হতো না আমার।
“বিয়েটাই কি একটা মানুষের জীবনে সব!
“সব না তবে অনেক কিছু। জীবন চলার পথ টা অনেক কঠিন আহিয়ান। আর আমার জন্য তা দ্বিগুন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পথ চলার জন্য কারো হাত চাই আমার, চাই কারো পাশে থাকা।
“সেই মানুষটা কি খালেদ।
“জানি না। তবুও ভাগ্য ভালো যে ধর্ষণ করলো সে নিজেই বিয়ে করতে চাইলো। অনেকের ক্ষেত্রে তো তা হয় না।
“তোমার মনে হয় না খালেদ ইচ্ছে করেই এসব করেছে।
“জানি সেটা। আমাকে ধর্ষণ করার পেছনে তার উদ্দেশ্য এটাই ছিল। ভেবেছে সবার কাছে আমার বদনাম করিয়ে আমাকে বিয়ে করবে।
“তবু বিয়ে করতে চাইছো।
“আমার ভাগ্য এটা!
আহিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুট করে আমার হাত ধরে টেনে বলে,
“চলো!
“কোথায়?
“বিয়ে করতে?
ভ্রু কুঁচকে বলি,
“মানে! আমার বিয়ে তো কাল সকালে।
“না তোমার বিয়ে এখন হবে আর আমার সাথে!
আমি উনার কথায় হতবাক হয়ে যাই। কথা বন্ধ হয়ে গেছে আমার। মূহুর্তে’ই আবার রাগ উঠে গেল। এক ঝাটকায় উনার হাত ছাড়িয়ে বলি,
“পাগল হয়েছেন আপনি। কি বলছেন এসব।
“যা শুনেছ তাই বলেছি।
“না আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।
“কেন?
আমি রেগে বলে উঠি,
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার? কি বলছেন এসব। কি পেয়েছেন আপনারা সবাই আমাকে। যার যখন মন চাইবে তখন সেভাবে আমাকে ব্যবহার করবেন।
“নিহা তুমি চলো আমার সাথে।
“না যাবো না আমি আপনার সাথে।
“এককথা বার বার বলার অভ্যাস আমার নেই।
“আমি যাবো না মানে যাবো না। বের হয়ে যান আপনি এখান থেকে
আহিয়ান আবারো হাত ধরে টান দিলে আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে আমাকে কোনমতে ছাড়ছে না। উপায় না ভেবে একটা চড় বসিয়ে দেই আহিয়ানের গালে। আহিয়ান মূহুর্তে’ই থমকে যায়। ছেড়ে দেয় আমার হাত।
আহিয়ানকে চড় মারার পর আমি নিজেও থমকে যাই। আহিয়ান পুরোই রেগে আছে। আমি আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। আহিয়ান সামনে আগাতে আগাতে বলে,
“তুমি বিয়ে করবে কি না বলো।
আমি পিছনে এক পা আগাতেই দেওয়ালে পিঠ ঢেকে যায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,
“না আমি এই বিয়ে করবো না।
“তুমি কি চাও আমি তোমার সাথে কিছু করি।
বলতে বলতে আহিয়ান আমার অনেক কাছে চলে এসেছে। আহিয়ান কে এভাবে দেখে ভয় পেয়ে যাই আমি। বলে উঠি,
“কককি করবেন আপনি।
আহিয়ান কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু না কিছু একটা করবে। ভয়ে আমার শরীর শিউরে উঠছে। হঠাৎ দেখলাম আহিয়ান হাত বাড়াচ্ছে আমার উপর। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। আহিয়ান হাত টা আমার উড়নায় রাখতেই আমি ওর হাত ধরে ফেলি। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল আমার। আমি ঠিক বুঝতে পারছি আহিয়ান কি করতে চলেছে আমার সাথে। আমি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠি,
“আমি রাজি!
#চলবে….
#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৬
“আমি রাজি!
আহিয়ান মূহুর্তে’ই তার হাত সরিয়ে নেই। অতঃপর আমার হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে। বাইরে এসে দেখি ফুলি একা একা দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে সে আমাদের কাছে আসে। আহিয়ান ফুলি কে বলে,
“তুমি ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আর শোন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে নিহা কোথায় বলবে আমার সাথে গেছে ঠিক আছে।
ফুলিও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। হয়তো এটা দেখে যে আমি কাঁদছি। আহিয়ান হেসে ওর মাথায় হাত রেখে। অতঃপর পকেট থেকে চকলেট বের করে ওর হাতে দেয়। ফুলি চকলেট নিয়ে আমাকে বলে,
“তুমি কাদতাছো ক্যান।
কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আর হয়ে উঠে না। এর আগেই আহিয়ান আমাকে নিয়ে গাড়ির কাছে চলে যায়। অতঃপর গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আমি নিঃশব্দে কেঁদে যাই কিন্তু সেই কান্না’র কোন প্রভাব আহিয়ানের উপর পড়ে না।
কিছুক্ষণ পর’ই আমরা এসে হাজির হই আহিয়ান দের বাসায়। আহিয়ান গাড়ি থেকে নেমে আবারো হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যায়। বাড়ির সব কাজের লোকরা তখনও জেগে ছিল। দাড়োয়ান আমাকে দেখে অনেক অবাক হলো। হয়তো এর মধ্যেই সবার কানে কথা চলে এসেছে। এটা তো হবার’ই কথা কারন এটা গ্রাম। গ্রামে মুহুর্তে’র মধ্যেই সব কিছু ছড়িয়ে যায়।
ঘরের কাজের লোকদের ও একই চেহারা। সবাই আমাদের দেখে অবাক। আমাকে নিয়ে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে আহিয়ান কাউকে ফোন করল। আমি চোখের পানি মুছে সামনে তাকাতেই দেখি সবাই কেমন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চাহনি দেখে নিজেকে আরো ছোট ছোট মনে হচ্ছে। আহিয়ান কথা বলা শেষ করে সবাই কে চলে যেতে বলে। সবাই চলে যায়।
খানিকক্ষণ’র মধ্যেই আকাশ ভাইয়া চলে আসে। তার পিছু পিছু আরেকটা লোক আসে। সে খুব পরিপাটি ভাবে এসেছে। হাতেও কিছু একটা আছে। আকাশ ভাইয়া একবার আমার দিকে তাকায়। অতঃপর চোখ সরিয়ে আবারো আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“উকিল সাহেব এসে পড়েছে। সব কাগজ পত্র দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু তোদের সাইন লাগবে।
আহিয়ান বলে উঠে,
“নিহা’র সব কাগজ পত্র!
“হ্যাঁ সব এনেছি ওদের বাসা থেকে। চাচা বাসায় ছিল, মন খুব খারাপ তার।
“নাহান..
“ওদের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি। চাচাও এসে পড়বে!
“সব বলেছিস!
“হ্যাঁ বলেছি!
বলতে বলতে চাচাও চলে এলো। আমি তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে অভিমানের চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এমন ভাবে তাকে দেখে তার কাছে যাওয়ার সাহস হলো না আমার। আহিয়ান চাচা’র কাছে গিয়ে বলল,
“বিয়েতে মেয়ে পক্ষের সাক্ষী হিসেবে তোমাকে লাগবে চাচা। তুমি কি থাকবে।
“হ থাকমু!
চাচা’র কথায় আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কাঁদতে লাগলাম। আহিয়ান সেই লোককে বলল কাগজ পত্র বের করতে। এখন বুঝলাম লোকটা একজন উকিল। অতঃপর সে কিছু কাগজ পত্র বের করল। তাতে কিছু লেখালেখি করল। তার কাগজ টা আহিয়ান কে দিয়ে বলল,
“পাত্রী কে সাইন করতে বলুন।
আহিয়ান একটা কলম নিয়ে আমার কাছে এসে বলল,
“সাইন করো।
আমি অশ্রু ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। একটা কথাই শুধু মনে মনে বলতে লাগলাম,
“কেন করছেন আমার সাথে এমনটা। আমাকে কষ্ট দিতে কি সবার এতো ভালো লাগে। শুধু’ই কি কষ্ট আমার এই জীবনে।
আহিয়ান শান্ত গলায় বলল,
“সাইন করো।
আমি কান্না বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা হাতে কলমটা ধরলাম। আহিয়ান বলল,
“এখানে সাইন করো।
আমার পুরো হাত কাঁপছিল। আহিয়ান আমার হাতটা ধরে কাগজে কলম ঠেকিয়ে বলল,
“সাইন করো ফার্স্ট!
উনার ধমকানিতে আমি লাফিয়ে উঠলাম। অতঃপর সাইন করলাম। আহিয়ানও কাগজটা নিয়ে সাইন করার পর উকিল কে কাগজ টা দিল। সে কাগজটা নিয়ে বলল,
“এখন থেকে আপনারা আইনগত স্বামী – স্ত্রী! যারা সাক্ষী তারাও সাইন করুন!
এসব শোনার পর’ই আমি ছুটে চলে আসলাম ঘর থেকে। বাইরের সিঁড়িতে বসে কাঁদতে লাগলাম। কেন ঠকাচ্ছে সবাই আমাকে। আহিয়ান কেন বিয়ে করল আমায়। ওর সাথে আমার ভবিষ্যৎ কি? কোন নিশ্চিত আছে কি। খালেদ জানলে কি হবে? ভাইয়া আর ভাবী কি ছেড়ে দিবে তাদের। সবকিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার।
খানিকবাদেই আহিয়ান আসল সেখানে। আমি হাঁটার শব্দ পেয়েই বুঝলাম সে এসেছে। উনি আমার পাশে বসল। অতঃপর বসে একটা সিগারেট ধরল। চুপচাপ সেটা খেতে লাগল। সিগারেট’র গন্ধ বরাবরই আমার কাছে বিরক্ত লাগে কিন্তু আজ সেই নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। হঠাৎ একটা পানির বোতল ধরল আহিয়ান আমার সামনে। বলল,
“নাও পানি খেয়ে নাও। কাঁদতে কাঁদতে শরীরের সব পানি চলে গেছে। পানি খেয়ে সেই খাটতি পূরন কর।
আমি মুখ ঘুমিয়ে নিলাম তার কাছ থেকে। আহিয়ান পানির বোতল টা পাশে রেখে বলল,
“ঠিক ২ ঘন্টা পর আমাদের ট্রেন আছে। এখন রাত ১ টা বাজে মানে ৩ টায় ট্রেন। তুমি এখানে থাকো আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর চলে আসবো। তোমারে চাচা এখানে থাকবে তোমার সাথে।
বলেই সে উঠে গেল। আমি স্থির হয়ে বসে রইলাম সেখানে। একে একে সবাই বের হলো শুধু চাচা রয়ে গেল। চাচা এসে আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত রাখল। আমি তার দিকে ফিরে বলি,
“চাচা তুমি কি রাগ আমার উপর
“কি যে কস না মা। তোর উপর রাখ করে থাকতে পারি আমি।
আমি আর কিছু না বলে চাচা’র ঘাড়ে মাথা রাখলাম। বসে রইলাম স্থির ভাবে। হঠাৎ করেই পানির পিপাসা পেল। আমি হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে বোতল টা নিতে গিয়ে নরম কিছু আমার হাতে এলো। আমি তাকিয়ে দেখি একটা রুমাল। আমি সেই রুমাল টার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ ও কি চোখ মোছার জন্য রুমাল রেখে গেলো সে? এটা কেমন কথা আমাকে কাদাবেও সে আবার সেই কান্না মুছতে রুমাল ও সে দেবে। আমি রুমাল টা হাতে মুঠ করে নিলাম। অতঃপর পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলাম।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে গাড়ির আওয়াজ আসলো। এর মানে আহিয়ান আর আকাশ ভাইয়া চলে এলো। আহিয়ান এসেই আমাকে উঠতে বলল। অতঃপর আমাকে নিয়ে এলো আমাদের বাসায়। মানে চাচা’র বাড়িতে। আমি বাড়ি ঢুকতেই দেখি মা দাওয়ায় বসে আছে। মা কে দেখে আমি তার কাছে ছুটে যাই। জরিয়ে ধরি তাকে। অতঃপর কাঁদতে থাকি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু খায়। আমি জিজ্ঞেস করি,
“বাবা কোথাও?
মা ঘরের দিকে ইশারা করলেন। আমি ঘরে এসে দেখি বাবা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। হয়তো তার ঘুম এখনো ভাঙে নি। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে নিয়ে এসেছে। আমি বাবা’র হাতটা ধরে কাঁদতে লাগলাম। অতঃপর তার মাথায় একটা চুমু খেলাম। বাড়ির বাইরে থেকে তখন আহিয়ানের গলা পেলাম। সে বলছে,
” নিহা ট্রেনের সময় হয়ে গেছে আমাদের যেতে হবে।
অতঃপর আমি চোখের পানি মুছে আমার ব্যাগটা কাঁধে নিলাম। বের হয়ে গেলাম ঘর থেকে। শেষবারের মতো আবারো সবার সাথে দেখা করলাম কিন্তু কথা বলতে পারলাম না। আহিয়ান আমার হাত ধরে গাড়িতে বসাল। আমাদের সাথে আকাশ ভাইয়া ও উঠল। আহিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিল।
.
স্টেশনে এসে পৌঁছাতে ভালোই সময় লাগলো। ভেবেছিলাম আমরা তিন জন’ই একসাথে ফিরব। কিন্তু না তা হলো না। আকাশ ভাইয়া গাড়ি নিয়ে চলে গেল। তাহলে কি সে পড়ে আসবে।
আমি আর আহিয়ান সিটে বসলাম। আর কিছুক্ষণ’র মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। আহিয়ান বাইরে গিয়ে একটা পানির বোতল আর কিছু খাবার আনলো। যদিও ক্ষিদে ছিল তবুও রাগে আমি কিছু খেলাম না। ট্রেন ছেড়ে দিলো।
ট্রেন চলতে দ্রুত গতিতে। আমার ঠিক সামনে বসে আছে আহিয়ান। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি আর সে আমার দিকে। হঠাৎ আহিয়ান আমাকে ডেকে বলল,
“নিহা!
আমি তার দিকে তাকালাম। আহিয়ান বলল,
“তুমি কি আর কিছুদিন দাদু’র বাড়িতে থাকবে।
তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে শুধু তার দিকে তাকালাম। আহিয়ান আবারো বলল,
“আসলে বাড়ির কেউই জানে না আমি বিয়ে করেছে। ব্যাপারটা এতো সহজে কেউ মেনে নিবে না তা না। তবে পরিস্থিতি টা স্বাভাবিক করতে আমার আপু কে দরকার।কিন্তু সে এখন কিছু কাজে দেশের বাইরে গেছে। আপু না আসলে আমি আম্মু কে বোঝাতে পারবো না। আপু পারবে তাকে বোঝাতে। শুধু ততোদিনের জন্য। পারবে না।
আমি কিছু না বলে আবারো বাইরে তাকালাম। আমার কিছুই যায় আসে না কি হয় আর কি না হয়। আহিয়ান আবারো ডেকে বলে,
“কথা বলছো না যে!
“কি বলবো?
“আমি যা বললাম তাতে তোমার মত দাও। যদি তুমি না চাও তাহলে আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।
“আমি আপনার সাথেই থাকতে চাই না।
আমার কথায় আহিয়ান আমার দিকে একবার তাকাল। অতঃপর মাথা নিচু করে নিল। আমি বাইরের দিকে তাকিয়েই বলে উঠি,
“কেন বিয়ে করলেন এই মেয়েকে।
“মানে?
“আমি তো অবুঝের মতো কোন কথা বলি নি। একজন ধর্ষিতা আমি। তাই নয় কি?
“বার বার এই সব কথা বলা বন্ধ করো তো।
“বন্ধ করলেই কি সত্যি পাল্টে যাবে।
“যদি তুমি সত্যি বলতে তবে তো সত্যি পালটাতো। তুমি বলছো মিথ্যে এটা আবার পাল্টানোর কি আছে।
আমি উনার দিকে তাকালাম উনি ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,
“তুমি ধর্ষিতা নও এটা কি তুমি অস্বীকার করো।
“সমাজ কি তা অস্বীকার করবে। সবার কাছেই তো আমি একজন ধর্ষিতা। আপনি দেখেনি! দেখেছেন তো আমি কিভাবে ছিলাম!
“যদি তুমি ধর্ষিতা হতে তাহলে আমি যেভাবে দেখেছি সেভাবে থাকতে না তুমি। মানুষের দেখার মাঝে ভুল থাকে কিন্তু আমি যা দেখেছি তাতে কোন ভুল নেই। আমি দেখেছি তোমাকে লড়াই করতে, তুমি বার বার চেষ্টা করছিলে তার থেকে বাঁচতে। সে তোমাকে ছুঁয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তাই নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো।
আমি বাইরের দিকেই তাকিয়ে রইলাম। উনার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না আমার। কেন তা জানি না কিন্তু উনি আমার সাথে যা করেছে তা মোটেও ঠিক করে নি।
আমি বলে উঠি,
“আচ্ছা আপনার কি মনে হয় খালেদ আমাকে বিয়ে করলে সুখী হতাম না আমি।
“যে ছেলে পুরো গ্রামের সামনে তোমাকে অপমান করে, সেই ছেলে কি তোমায় সুখে রাখতো।
“আপনি জানেন সে এটা কেন করেছে?
“অনুমান করছি! বিয়ে ছেড়ে তুমি পালিয়ে যাওয়ায় অনেক অপমানিত হয়েছে সে। তাই তোমাকে গ্রামের সবার সামনে অপমান করে ছোট করলো। এছাড়াও ওর রেকর্ড কিছুই ভালো না। তুমি ভালো থাকতে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু একটা কথা কি জানো। যখন বিচার হচ্ছিল মনে হচ্ছিল এসব আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল সে। সবটাই তার বানানো। ইচ্ছে করেই এসব করা যাতে তুমি বাধ্য হও বিয়ে হতে এমনটা মনে হয় না তোমার
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,
“হয়! কিন্তু আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন খালেদ যা করেছিলো আপনি তা করেন নি।
উনি চমকে তাকালেন আমার দিকে আমি জানি সেটা। আমি হেসে উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠি,
“সবাই শুধু আমার সু্যোগ নিতে চায় আহিয়ান!
“তোমার মনে হয় সেই তালিকায় আমিও আছি।
“আজকের ঘটনার পর এটা মনে না করার কোন কারন কি আছে?
আহিয়ান কিছু বললো না চুপ হয়ে গেল। হয়তো রেগে গেছে। আমি আবারো বাইরে তাকালাম। মনে হলো উনি উঠে চলে গেছে। কোথায় গেছে? এইখানেই গেছে আমি জানি। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে শুরু করবে। আর কি? কিন্তু উনি আমার যা করেছে তা কি ঠিক। কি হবে কাল সকালে। খালেদ যখন আসবে একগাদা বরযাত্রী নিয়ে আর জানবে আমি নেই তখন!
রেগে উঠে চলে গেল। আমার কথাটা হজম করতে পারলেন না তিনি। তো! আমারও অভিমান আছে। কখনো মানবো না আমি এই বিয়েকে। পারি না মেনে নিতে। আমাকে জোড় করেছিলেন উনি। সেটা কি করে ভুলে যাবো আমি!
.
প্রায় অনেকক্ষণ পর আবার এলেন তিনি। এসেই বসে পড়লেন। যা ভেবেছিলাম তাই! সিগারেট খেয়েছেন উনি সেটার গন্ধ আসছে তার গা থেকে। বাতাসের সাথে তা মিশে আমার কাছে আসছে।
দেখতে দেখতে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন আমি জেগেই রইলাম। একবার তাকিয়ে দেখি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। তার ঘুমন্ত চেহারা দেখলাম এই প্রথমবার। আগের বারও তাকে ঘুমোতে দেখে নি। দেখবো কিভাবে? আমি তো নিজেই ঘুমিয়ে ছিলাম। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোর হয়ে গেল। কিন্তু তিনি উঠলেন না। আমিও উঠালাম না।
.
ট্রেন থেমে গেল উনি এখনো ঘুমাচ্ছে। এতো ঘুম উনার চোখে! কিন্তু এখন যে আমাদের নামতে হবে। উনাকে ডাকতে যেয়েও ডাকলাম না। ক্ষোভ ছিল উনার প্রতি। না ডেকেই ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলাম। এবারকার গন্তব্য ছিল উনার মুখ আর না দেখার! উনার সাথে কোনমতে আর সম্পর্ক না রাখার!
#চলবে….