#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫১
রাতে মা আর বাবা অনেক রাত করে ফিরলেন যার কারনে আর দেখা হলো না। অতঃপর সকালে সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে সবার সাথে দেখা। আপু আর ইয়ান দুজনেই আছে আমাদের সাথে। খাবার শেষে আমরা ভার্সিটির জন্য রওনা হতে যাবো এর আগেই মা আমাকে ডাকলেন। আমি তার সাথে কথা বলতে গেলাম। অতঃপর তিনি আমাকে আহিয়ানের নানু সাথে দেখা করতে বলেন। তার নানু নাকি দেখতে চায় আমাকে। অনেকটা বয়স হয়েছে উনার। তাই মা আর বাবা চান আমরা তাদের সাথে গিয়ে দেখা করি। মা আমাকে এতোটুকু জানানোর পর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যাবো কি না। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে চলে এলাম!
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইরে এসে দেখি উনি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম উনাকে দেখার পর আমার অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। আমি চোখ বন্ধ করেই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতেই গত রাতের ঘটনা মনে পড়ল। অস্থিরতার কারনে পড়ে যেতে নিলে দরজা আঁকড়ে ধরলাম। উনি পিছনে ফিরে বলেন,
“আরে ভূতনি! ঠিক আছো তো!
বলেই উনি কাছে আসতে নিলেন। আমি সাথে সাথেই চোখ বড় বড় করে মাথা নাড়লাম। অতঃপর উনার পাশ কাটিয়ে দ্রুত গিয়ে গাড়িতে বসলাম। উনি এসে আমার পাশে ড্রাইভিং সিটে বসলেন। গাড়ির সামনে থাকা আয়নাটা বাঁকা করে আমার দিকে দিলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে সেখানে তাকিয়ে দেখি উনি তাকিয়ে আছেন। চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম।
কিছুক্ষণ পর উনি বলে উঠেন,
“মা কে কি বললে?
“কোন ব্যাপারে?
“নানু বাড়িদের যাবার ব্যাপারে। এভাবে তুমি কমফোর্টেবল ফিল না করলে যাবো না।
“আমি আনকমফোর্টেবল এটা আপনাকে কে বলল।
” তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে!
বলেই গাড়ির আয়নাতে আমাকে দেখলেন। আমার ও চোখ গেল তাতে। আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেললাম!
.
ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই ইতি আমাকে ছাড়ছে না। গতকাল এমন কি হলো সেটা তার জানা চাই। জ্বালিয়ে মারছে আমাকে। আমি ওকে বলছি, তেমন কিছু হয় নি। উনি আবারো নিতির সাথে কথা বলছিলেন বলেই আমি চলে এলাম।
ইতি আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তাই বলে ওতো রাতে তুই আমাদের না বলে এভাবে চলে আসবি। জানিস পুরো বাড়িতে শুধু তোকে খুঁজেই যাচ্ছিলাম। কাল আমার এনগেজমেন্ট ছিল। জানতি না তুই!
“সরি ইতি। সত্যি অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে
ইতি কিছু বলতে যাবে এর আগেই সামনে থেকে কেউ বলে উঠে,
“ভুল করা তো তোমার অভ্যাস নিহা!
আমি আর ইতি সামনে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি নিতি, টিনা আর আনিকা। নিতি আবারো বলে উঠে,
“ভুল করেই বিয়ে টা করে ফেললে তুমি আর সবকিছু উলোট পালোট করে দিলে।
নিতির কথা শুনে বেশ রাগ হলো আমার। তবুও আমি তাদের কিছু না বলে এড়িয়ে চলতে চাইলাম। হঠাৎ করেই নিতি বলে উঠে,
“আরে পালিয়ে যাচ্ছো নাকি।
ইতি বলে উঠে,
“পালাবে কেন? শুধু তোমাদের মতো নিচু মানুষের সাথে কথা বলে রুচি নষ্ট করতে চাই না তাই চলে যাচ্ছি।
টিনা চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“ইতি! মুখ সামলে কথা বলো।
“আমার মুখ আমার ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা কথা বলবো।
“তোমাকে তো আমি!
বলেই ইতির কাছে তেড়ে আসতে নিলে নিতি আর আনিকা ওকে আটকে দিল। আনিকা বলে উঠে,
“সময় ভালো না টিনা, চুপ থাক। বাড়াবাড়ি করিস না।
ওদের কথায় ইতি মুখ ভেংচি দিল। আমি ইতির হাত ধরে চলে যেতে নিলাম। তখন’ই নিতি আবারো আমাকে ডাক দিল। আমি ওর দিকে দাঁড়িয়ে আছি। ওর আর আমার দূরত্ব অনেক। নিতি হেঁটে এগিয়ে আসতে লাগল। আমিও আগালাম। দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। নিতি’র চোখের দিকে তাকাতেই গতরাতের ঘটনা ভেসে উঠছে।
নিতি বাঁকা হেসে বলে উঠে,
“আমার ধারনা গত রাতের ঘটনা দেখেছিলে তুমি।
“কি বলতে চাও।
নিতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“দেখো নিহা, আমি এতোটুকু আন্দাজ করতে পারি তোমার আর আহির মাঝে কিছুই হয় নি আর না হবে। কারন তোমাদের মাঝে কিছুই নেই। গতকাল আহি নিজে এসেছিল আমার কাছে।
আমি হেসে বলি,
“তোমার কাছে কেন আসলো, কিভাবে আসলো, আসার পর কি হলো সব’ই জানি আমি। আহিয়ান নিজেই আমাকে সব বলেছে। কিন্তু তোমার একটা ভুল ধারণা আমি ভাঙিয়ে দিচ্ছি। আহিয়ান আর আমার মাঝে যে কিছুই হয় নি এটা ভুল। এমনকি গতকাল রাতেও… আচ্ছা বাদ দাও। তোমার মতো মেয়েরা যে কতো নিচে নামতে পারো সেটা আমার জানা হয়ে গেছে। আগেও বলেছি এখনো বলছি আমার স্বামী থেকে দূরে থাকো। বাই দ্যা ওয়ে, তোমাকে একটা ইন্টারেস্টিং খবর দেই!
বলেই নিতির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলি,
“আমি আর আহিয়ান হানিমুনে যাচ্ছি। ( বলেই ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর মুখের রং উড়ে গেছে। আমি হেসে বলি ) তুমি না আমার বান্ধবী, কনগ্রেস করবে না।
নিতি রেগে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পারছে না এখন’ই আমাকে খেয়ে ফেলতে। সে আমার দিকে এগিয়ে কিছু বলার আগেই ইতি বলে উঠে
“আহি ভাইয়া !
আহিয়ানের নাম শুনে নিতি সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। দুজনেই মুখ ফিরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি আহিয়ান দাঁড়ানো। আহিয়ান কে দেখেই নিতি আমার থেকে সরে যায়। অতঃপর তারা তিন জন’ই আহিয়ানের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ভিতুদের মতো তাদের চলে যাওয়া দেখে আমি জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। আহিয়ান অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
উনি হাটতে হাঁটতে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
“এমন ভাবে হাসছো কেন?
“জব্দ করেছি, মোক্ষম জব্দ!
“কেন এসেছিল ওরা?
“কাঁটা গায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার জন্য। উল্টো আমি মরিচ লাগিয়ে দিয়েছি!
বলেই হাসতে হাসতে ইতি কে নিয়ে উনার পাশ দিয়ে চলে এলাম!
.
বাসায় এসে শুনি আগামীকাল’ই যেতে হবে, নানু তার নাত বউ কে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। নানুদের বাড়ি হলো সিলেটে। আমরা গাড়ি দিয়েই যাবো। খুব ইচ্ছে ছিল ইয়ান কে নেবার। কিন্তু মা দিতে চাইলো না। মা বলেন,
“তোমরা দুজন চলে গেলে আমার পুরো বাড়ি খালি থাকবে, এখানে ইয়ান না থাকলে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে মা!
মায়ের কথায় আমি হাসি মুখে চলে আসি সেখান থেকে। সত্যি’ই বলেছে এতো বড় একটা বাড়িতে তারা দুজন তো মনমরা হয়েই থাকবে। এর চেয়ে ইয়ান থাক না এখানে। সে থাকলেই তো বাড়িটা একটু হইচই থাকবে মা আর বাবা’র ও ভালো লাগবে।
রাতেই ব্যাগ প্যাক করে রেখেছিলাম। অতঃপর ভোরে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। আজ উনি আমার আগেই তৈরি হয়ে নিচে চলে গেছে। আমি ঝটপট তৈরি হয়ে নিচে এলাম। সবার সাথে দেখা করলাম। বাবা গম্ভীর স্বরেই বলেন,
“সাবধানে যেও!
আমিও মাথা নাড়লাম। কিন্তু আমাদের ইয়ান বাবু কে এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠায় কার সাধ্যি। সে যে এখন ঘুমে বিভোর। আমি ঘুমের মাঝেই তার কপালে একটু চুমূ খেলাম। এই ছোট্ট বাচ্চা টা এখন আমার চোখের মনি। গতকাল রাতেও আমার বিছানার উপর লাফিয়ে লাফিয়ে বলে গেছিল ভোরে তাড়াতাড়ি উঠে আমাদের সাথে যাবে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আমাদের না দেখতে পেয়েও বেশ কাঁদবে বলে মনে হচ্ছে! ইশ কতোদিন ওর মুখে ভূতনি আম্মু ডাকটা শুনতে পারবো না। কিন্তু ভূতনি ডাকটা উনি পূরন করে দেবে। আচ্ছা যদি ওখানে সবার সামনে এই নামে ডাকে তখন! শুনেছি উনার মামা মামী, আর খালা খালু নিয়ে নাকি বিশাল পরিবার। এদের মাঝে এই নামে ডাকলে আমার মান সম্মান থাকবে তো!
আমি আপুর সাথে কথা বলছিলাম। এর মাঝেই উনার ফোন এলো। উনি ফোনে কথা বলতে বলতে বাইরে চলে গেলেন। অতঃপর আমি বাইরে এসে দেখি উনি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখটা কেমন গম্ভীর! তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে আমার উপর। উনার চাহনিতে নিজেকে কেমন জানি অপরাধী অপরাধী বলে মনে হলো।
আমি চুপচাপ এসে গাড়িতে বসলাম। আমার পিছু পিছু মা বাবা ও এলেন। উনি গাড়িতে বসে ড্রাইভ করতে শুরু করলেন।
অনেকক্ষণ যাবত ড্রাইভ করছেন। এতো ভোরে রাস্তা সচরাচর ফাঁকাই থাকে। উনি দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। আমি বসে বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। কিন্তু মাঝে মাঝেই খেয়াল করছি উনি গাড়ির আয়নার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছেন। আমি একটু হালকা কেশে বলে উঠি,
“আমি কি কিছু করেছি নাকি!
উনি সামনের দিকে তাকিয়ে,
“তোমার কি মনে হয়।
“কিছুই মনে হচ্ছে না। কারন আমি কিছু করে নি।
“তাহলে জিজ্ঞেস কেন করছো?
“আপনি কেন বার বার এভাবে তাকাচ্ছেন তাই।
হঠাৎ করেই এর মাঝে উনার ফোনে কল এলো। ফোনটা সামনেই রাখা ছিল। উনি ফোনটা কেটে আমার দিকে তাকালেন। এর মাঝেই মেসেজ আসার টুং টুং শব্দ হলো। আমি বলে উঠি,
“কি হয়েছে বলুন তো!
“তুমি হতে কি বাকি রেখেছো বলো
“কি করেছি সেটা বলুন।
“দিনে এতো অকাজ করো যে হিসাব ও রাখো না।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আহিয়ান সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি আর আমি হানিমুনে যাচ্ছি!
“কিহহ! কি বলছেন এসব।
“আমি কোথাও বললাম? এসব তো তুমি বললে
“এই কি বললেন আপনি, আমি! আমি বলেছি এসব।
“না হলে কে? আমি বলেছি। আকাশ ফোন করে বলছে তুমি ইতি কে বলেছ আমি তাকে কেন বলে নি। এরপর থেকেই আমার ফোনে আকাশ, নাহান আর আনাফ মিলে ঝড় তুলে দিচ্ছে।
আমি বেকুব’র মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি। সেটা তো গতকাল নিতি কে বলেছি। ইতি’র কান যে এতো খাড়া সেটা তো জানতাম না। বেয়াদব মেয়ে এসব শুনে ফেলল!
উনি আমাকে কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার আগে ফোনটাও বন্ধ করে দিয়েছেন। এদিকে আমি নিজের ফোন টা ব্যাগ থেকে বের করে চমকে উঠলাম। ফোনটা সাইলেন্ট ছিল বলে ইতির এতো মেসেজ খেয়াল করি নি। সেদিন ফোন আছাড় মারার পরও এটা ঠিক আছে। শুধু ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছিল। এর এভাবেও আমার মনে হয় না আমি জোরে আছাড় মেরেছিলাম! যাই হোক ইতির মেসেজ গুলো বলার কোন মানে হয় নাই। শুধুই আজাইরা কথা লেখা তাতে। আমি ফোনটা জায়গা মতো রেখে দিয়ে সিটে আরাম করে বসলাম। কেমন জানি ঘুমঘুম পাচ্ছে আমার। এর মাঝেই উনি গান ছাড়লেন। গান বাজছে,
“তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি ভেঙ্গেচুরে শতবার
রয়েছো তুমি বহুদূরে আমাকে রেখে ছলনায়…
.
নানু বাড়ি আসার পর থেকেই বাড়িতে যেন একটা হইচই লেগে গেছে। তাদের বাড়িটা অবশ্য অনেক বড় আর সাজানো গোছানো। তাদের বাড়িটাও পুরোনো বাড়ির মতো কিন্তু বাড়িতে ঢোকার পর আমি হতবাক হয়ে গেছি। আমার কোন ধারনা ছিল না বাড়িতে এতো মানুষ থাকবে। আহিয়ানের ৩ মামা! ৩ জন’ই বিবাহিত আর তিন জনের’ই ছেলে মেয়ে আছে। এটা স্বাভাবিক থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ছেলেমেদের ছেলেমেয়ে মানেই যেন বিশাল কিছু। হ্যাঁ ৩ মামার মোট ছেলেমেয়ে ৫ জন। মেয়ে দুটি অবিবাহিত আর তারা আমার থেকে ছোট। তবে তিন ছেলেই বিবাহিত। সেই তিন ছেলের মাঝে দুই ছেলের দুই মেয়ে বাকি এক ছেলের যময দুই ছেলে। এতো বড় পরিবার এযুগে খুব কম’ই দেখা যায়। আর মাঝে আহিয়ানের একজন খালা এসেছে। তার খালা এই একজন’ই। তার একটা ছেলে আছে সেই ছেলে আমার বয়সী। তবে খালামনি নাকি খুলনা থাকেন। তিনি সেখান থেকেই এখানে এসেছে। আর তাদের সবার মাঝে মাথায় ঘোমটা দিয়ে এক কোনে বসে আছি আমি।
আমার ধারনা ছিল নানু হয়তো অনেকটা বুড়ো হবেন। আসলে এতো ছেলেমেয়ে দেখেই আমার সেই ধারনা হয়েছিল। কিন্তু না নানু কে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। উনার চেহারায় বয়সের ছাপ এলেও উনার সৌন্দর্য কমেনি। এখনো বেশ সুন্দরী তিনি। শুধু তাই নয় তার শরীরেও বয়সের কোন ছাপ নেই। এতোক্ষণ আমাকে দেখে যারা এতো এতো কথা বলছিল তারা সবাই এখন চুপ। তার মানে এরা সবাই নানু কে বেশ মানে। তার পরনে একটা বাঙালি শাড়ি। পুরোন দিনের মতো শাড়ির আঁচলে একটা চাবি’র গোছা। নিজেকে পুরোন বাংলা ছবির একটা পার্ট বলে মনে হচ্ছে। যেখানে বাড়ির কর্তি এসে বউ মা কে দেখে আর বউ ও বেশ সুন্দর ভাবেই গুছিয়ে বসে থাকে।
নানু কে দেখে আমার পাশ থেকে আহিয়ান উঠে তার কাছে গেলেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে উনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। নানু আহিয়ানের মাথায় হাত রেখে হেসে হেসে বলল,
“এতোদিন পর এই বুড়ির কথা মনে পড়ল লা তোর!
“আরে বুড়ি তোমার কথা তো প্রতিদিনই মনে পরে কিন্তু আসতে পারি না।
“কেন আসতে পারিস না কেন।
“তোমার মেয়ে আসতে দেয় না। তোমার তো এখানে মানুষের অভাব নেই কিন্তু আমার বাড়িতে অভাব আছে।
নানু হেসে উনার কান ধরে বলে,
“ভালোই কথা বলতে শিখেছিস। তা তোর বউ কোথায়?
উনি চোখের ইশারায় আমাকে যেতে বলেন। আমি নানুর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে একটা সালাম দিলাম। নানু ছোট ছোট চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার হাত ধরে বলেন,
“মেয়ের গায়ের রঙ যে একটু ময়লা আহিয়ান। তোর মতো ফর্সা মেয়ে পেলি না তুই!
আমার মনটা হুট করেই যেন নানুর কথা শুনে খারাপ হয়ে গেল। আমি চোখ নামিয়ে পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছি। আহিয়ান হেসে বলে,
“এই যুগে গায়ের রঙ নিয়ে কথা বলছো বুড়ি। আর শোন আমার তো ইচ্ছে ছিল তোমার মতো মেয়ে বিয়ে করার কিন্তু তোমার মতো মেয়ে নাহ একটাই ছিল আর তা আমার নানা নিয়ে গেছে এখন আমি এমন মেয়ে কিভাবে পাবো বলো।
“ভালোই কথা ঘুরাতে পারিস। তা তোর বউ রান্না বান্না জানে।
“জানবেনা কেন? অনেক ভালো রান্না জানে। বিশ্বাস না হলে আজকের রান্না তাকে দিয়ে করাও।
উনার কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। মারার প্ল্যান করছে নাকি। এতো মানুষের রান্না আমি করবো। নানু বলে উঠে,
“পাগল হলি নাকি, তোর নানু তার নতুন নাতবউ কে দিয়ে রান্না করাবে। আমার ঘরে কি মানুষের অভাব নাকি। নে তোরা হাত মুখ ধুয়ে বস। আমি নাস্তা পাঠাচ্ছি!
আর তোরাও সব বের হ এখান থেকে। আঠার মতো লেগে আছিস কেন? ওদের এখন বিশ্রাম নিতে দে!
অতঃপর নানু চলে গেলেন। নানুর পিছনে পিছনে পুরো বড়যাত্রীও তার পিছন পিছন গেল। আমি একটা হাঁফ ছেড়ে বিছানায় বসলাম। হঠাৎ আহিয়ান আমাকে গুঁতো মেরে বলেন,
“এভাবে এখানে বসে থেকো না। নানু কি বলেছে শুনেছ তো, হাত মুখ ধুয়ে নাও। দেখলে তো কতোটা রাগী তিনি।
আমি মাথা নেড়ে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলাম। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম। এর মাঝেই একজন এসে নাস্তা রেখে গেছেন। আমি বের হতেই উনি ফ্রেস হয়ে এসে বসলেন। আমি চায়ের কাপ আর বিস্কুট নিয়ে বসলাম। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। উনি এসে বলেন,
“আমাকে ছাড়াই শুরু করে দিলে ভূতনি!
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে খাওয়াতে মনোযোগ দিলাম। উনি পাশে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,
“নানুর কথায় কিছু মনে করেছ!
“কোন কথা?
“এড়িয়ে যাচ্ছো।
“না এড়ানোর কিছু নেই। উনি যা বলেছেন তা সত্য, আর সত্য কখনো পাল্টানো যায় না।
“ঠিক বলেছ সত্য কখনো পাল্টানো যায় না। তুমি আমার বিবাহিতা ভূতনি বউ! আর এই সত্য কখনো পাল্টাবে না। তোমার গায়ের রঙের জন্য ও না!
বলেই আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। উনার হাসি দেখে মুচকি হাসি দিলাম আমি।
#চলবে….
#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫২
দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসলাম। তাদের খাবার টেবিল টা বেশ বড়। বাচ্চারা নিজের হাতেই খাচ্ছে। তাদের বয়স এতোটাও কম না। ভালোই বয়স। খাবার দাবারের দেখা হলো নানা’র সাথে। নানুর কথায় যতোটা শাসন পেয়েছিলাম নানার কথায় ততোটাই আহ্লাদী আহ্লাদী বলে মনে হলো।
বিকালে আমি আর আহিয়ান বের হলাম হাঁটতে। তাদের বাড়ির আশপাশ পুরোটাই গাছ পালা দিয়ে ভরপুর। এর মাঝেই বাড়ির পিছনের দিকে একটা কুয়া আছে। তবে কুয়ার মুখটা টিনের চাল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। পুরো বাড়িটাই এখন শান্ত! বাড়ির আশপাশে অবশ্য কিছু পাহাড়াদার আছে।
অতঃপর আমরা উঠলাম বাড়ির ছাদে। সেখানে মেয়েরা বসে মাথায় তেল দিচ্ছে আর এক পাশে আচারের বোয়াম রোদে দেওয়া আছে। উনি এসেই আচারের দিকে চলে গেলেন। সেখানে আগে থেকে কিছু বাচ্চারা বসে ছিল। হয়তো তারাও আচার খাবে। উনি গিয়েই একটা আচারের বোয়াম নিয়ে ফেলেন। বাচ্চাগুলো জোরে জোরে বলে,
“এগুলো ধরো না বড় মা এসে বকা দেবেন।
উনি আশপাশ তাকিয়ে বলেন,
“বুড়ি আছে এখানে।
একজন মাথা নেড়ে না জানায়। উনি বলে উঠেন,
“তাহলে আর কি? আমি আচার খেয়েছি এটা বুড়িকে কে বলবে!
বাচ্চাগুলো গুলো মুখ টিপে হাসতে থাকে। এপাশ থেকে উনার মামাতো বোন বলে উঠে,
“ভাইয়া আমি বলে দেবো কিন্তু!
আরেকজন বলে উঠে,
“ভাইয়া আমিও দেখেছি!
উনি সবার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“সবাইকে শপিং করতে নিয়ে যাবো!
উনার বোনেরা হাসতে শুরু করে দেয়। দুই ভাবী তার দুই ননদের মাথায় তেল দিচ্ছিল। তারাও হেসে দিল। উনি এক কোনে নিচে বসে সবাইকে আচারের ভাগ দিয়ে আচার খেতে ব্যস্ত। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি সবাইকে। এর মাঝেই বড় ভাবী এলেন। উনার হাতে তেলের বাটি। উনি এসেই আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেন,
“নিহা বসো তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেই!
“না ভাবী, আপনি বসুন।
“আমি দিয়েছি, তুমি বসো!
অতঃপর আমি বসলাম , উনি আমার মাথায় তেল দিচ্ছেন। আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,
“তোমার বুড়ি ছাদে এলো বলে, এসে যদি দেখে আচারের এই অবস্থা করছো তখন দেখো।
উনি আচারের বোয়াম নিয়ে সামনে আসতে আসতে বলেন,
“কে বলবে এই কথা। সবাইকে ঘুস দেওয়া হয়ে গেছে।
“তোমার বউ কে দিয়েছ!
আমি কপাল কুঁচকে উনার দিকে তাকালাম। বড় ভাবী আমার চুলে তেল দিতে দিতে বলেন,
“নিহার চুলের গোছা খুব ভালো।
হঠাৎ উনি বলে উঠেন,
“ভূতনি তো তাই এই অবস্থা!
উনার এই নাম শুনে সবাই অনেকক্ষন যাবত নিরবতা পালন করল। আমি দাঁতের সাথে দাঁত চেপে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার সামনে বসে বলেন,
“ভূতনি আচারের তেল তোমার মাথায় দিয়ে দেই।
বড় ভাবী বলে উঠে,
“এটা কি বললে তুমি আহি।
“আরে ভাবী এটা ওর ডাক নাম আমি দিয়েছি সুন্দর না বলো।
বড় ভাবী কিছু না বলে মুখ টিপে হাসলেন। তার হাসির শব্দ আমার কান অবদি এলো। উনার বোন বলে উঠে,
“তুমি কি আচারের তেল ভাবীর মাথায় দিয়ে মুখ বন্ধ করাতে চাইছো!
উনি দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়েন। তখনই আমি সামনে তাকিয়ে হেসে বলি,
“ঘুস পরে দেবেন আগে পিছনে তো দেখুন।
আমার কথায় সবাই পেছনে ফিরল। তাকিয়ে দেখে নানু ছাদের দরজার বাইরে তাকিয়ে আছে। আহিয়ান আচারের বোয়াম রেখে সেখান থেকে সরে গেল। নানু বলে উঠেন,
“আমার আচার গুলো এভাবে নষ্ট করছিস তুই
আহিয়ান দূরে যেতে যেতে বলল,
“আরে বুড়ি কি বলো, আচার তো ভালোই ছিল আর এখনো আছে।
“তবে রে দাঁড়া!
বলেই নানু আগাতে লাগলেন। আহিয়ান কে আর পায় কে? উনি পুরো ছাদ ঘুরিয়ে বের হয়ে গেলেন। উনার পিছনে পিছনে সব পিচ্চি বাহিনী গুলোও দৌড়। নানু বিড় বিড় করতে করতে আচারের বোয়াম টা নিয়ে আবারো রোদে দিলেন। অতঃপর আহিয়ান কে ধরতে নিচে চলে গেলেন। তাদের এসব কাহিনী দেখে হাসতে হাসতে আমরা ব্যস্ত!
ভাবী আমার মাথায় তেল দিচ্ছিল আর কিছু অবাঞ্ছিত কথা বলতে লাগল। যা শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগছিল না। দুজন বিবাহিতা নারীর মাঝে যেমন কথা হয় তেমন’ই কথা কিন্তু তবুও আমার এতে কোন আগ্রহ ছিল না। একসময় বাচ্চার কথা অবদি বলে দিলেন ভাবী। আমি যথাসম্ভব তার কথা এড়িয়ে যাচ্ছি। এসব শুনে আমার কোন লাভ নেই। এটা কখনো হবার নয়!
.
সন্ধ্যার সময় আহিয়ান ফিরে এলো। সেই তখন তাড়া খেয়ে পালিয়েছিলেন এখন এলেন। তার সাথে সেই পিচ্চি বাহিনীরা দল বেঁধে এসেছে। সবার শরীরে ধুলো লেগে আছে। শুনলাম তারা নাকি মাঠে খেলছিল তাই এই হাল।
ঘরে এসে গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বিছানার পাশে বসলেন উনি। আমি সবে মায়ের সাথে কথা বলে ফোনটা রাখলাম। হঠাৎ করেই দরজার বাইরে আওয়াজ আসলো। আমি দরজা খুলে দেখি উনার মামাতো বোন দাড়িয়ে আছে। দুই বোনের নাম তিন্নি আর তিথি। বড় হলো তিন্নি। তিন্নি কে দেখে হেসে বলি,
“আসো ভিতরে আসো।
“না ভাবী, আমি বসতে আসি নি তোমাদের নিতে এসেছি। সবাই ছাদে গেছে এখন গল্প হবে।আমি তোমাদের নিতে এসেছি!
“আচ্ছা আসছি!
তিন্নি চলে গেল। অতঃপর আমরা দুজন গেলাম ছাদে। রাতের আকাশের নিচে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। বড় ভাবী আর মেঝো ভাবী সবাইকে চা দিচ্ছেন। তিথি এসে আমাকে আর আহিয়ান কে নিয়ে তাদের সাথে বসাল। নানা আর নানু দুজনেই চলে এলেন। চাঁদের আলোয় মাঝখানে হারিকেন নিয়ে ভূতের গল্প বলা শুরু হলো। এমন অভিজ্ঞতা আমার ছিল , যখন আমি ছোট ছিলাম তখন আমরাও কয়েকজন মিলে এভাবেই রাতের বেলা বসতাম। গল্প করতাম সবাই, আজ আবারো সেই দিনের কথা মনে পড়ল আমার!
.
নানুর বাসায় এসেছি আজ অনেকদিন’ই হলো। সবার আমাকে ভালো লাগলেও নানু’র যে আমাকে দেখে খানিকটা খারাপ লেখেছে তা আমি বেশ বুঝেছি। কিন্তু তার মন ভালো করার কোন উপায় পাচ্ছিলাম না আমি। কিভাবে তাকে খুশি করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেদিন আহিয়ান আর ভাইয়ারা সবাই গেছেন মাছ ধরতে। দূরেই বেশ বড় একটা দিঘি আছে সেখানে সব ভাইয়েরা ছিপ ফেলে মাছ ধরবে। পিচ্চি বাহিনী আর আমরা বাকি মেয়েরা ছাদে বসে গল্প করছি। ভালোই লাগে এখানে সবার সাথে থাকতে। এখন বুঝতে পেরেছি কিভাবে তারা এতোজন একসাথে থাকে। নানু খুব যত্নে সবাইকে একসাথে করে রেখেছে। সবাই সবার সাথে বেশ খুশি। খুব ভালো ভাব আছে সবার সবার সাথে।
হঠাৎ করেই লাল ফ্রক পড়া একটা ছোট মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে তিথির কাছে বলল,
“ফুপি ফুপি তেঁতুল খাবো!
“আমি এখন তেঁতুল পাবো কোথায়?
“ওই যে ওখানে তেঁতুল গাছে অনেক তেঁতুল ধরেছে, তেঁতুল গুলো পাকাও। চলো না আমরা গিয়ে সেগুলো পাড়ি।
“মার খেতে চাস নাকি নানুর কাছে। নানু জানলে না অনেক বকে দেবে ভালো লাগবে।
আমি বলে উঠি,
“কেন বকা দেবে, আচ্ছা এই গাছ তো এই বাগানের, নাহ।
“হ্যাঁ গাছ আমাদের, কিন্তু নানু কোনমতে আমাদের খেতে দেবে না।
“কেন দিবে না।
“এগুলো দিয়ে সে আচার বানাবে আর সেই আচার তোমাদের সাথে করে দেবে মানে খালার কাছে পাঠাবে। আমাদের অনেক আগেই বলে দিয়েছে এই তেঁতুল যেন আমরা কেউ না পারি। এখন যদি পাড়তে যাই তাহলে বাড়িতে গুরুচন্ডালী কান্ড ঘটবে।
মেয়েটার চোখের কোনে অশ্রু এসে ঠেকল। ভারী ভারী গলায় বলল,
“আমি তেঁতুল খাবো।
“আহ, জ্বালাতন করিস না তো। তোকে এখন কে তেঁতুল পেরে দেবে বল। তোর ভাইরা এখন গেছে তোর বাবা’র সাথে মাছ ধরতে। আমরা কি কোন মেয়ে গাছে চড়তে পারি বল যে তোকে তেঁতুল পেরে খাওয়াবো।
কথা বলতে বলতে মেয়েটার চোখের অশ্রুর গাল গড়িয়ে পরল। মেয়েটা দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দরী। তার এই সুন্দর চেহারার বিশেষত্ব ছিল তার চোখের পাপড়ি। পাপড়ি গুলো বেশ ঘন ঘন। তার টানা টানা চোখে চোখ গুলো একটা ফুটন্ত ফুলের মতো লাগছিল। সেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ায় আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি হেসে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলি,
“তুমি তেঁতুল খাবে।
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। আমি বলে উঠি,
“চলো আমরা পেড়ে খাবো।
তিন্নি বলে উঠে,
“কি বলো ভাবী, বাড়িতে কোন ছেলেমানুষ নেই যে।
“ছেলেরাই কি শুধু গাছে চড়তে জানে নাকি।
“মানে!
“আহ চলো না!
“চললেই হবে না, পাহাড়াদার দেখছো। গাছে চড়তে দেখলে নানু কে গিয়ে বলে দেবে।
“এগুলো কে সরাবো কি করে?
তিথি বলে উঠি,
“ওদের আমি দেখে নিচ্ছি, তোমরা বলো তেঁতুলের ভাগ আমাকে একটু বেশি দিবে কি না।
তিন্নি খোঁচা মেরে বলে,
“শুরুতে না না কে বলছিল শুনি!
“আরে সেটা তো গাছে চড়ার মতো কেউ ছিল না বলে। কিন্তু এখন তো ভাবী আছে।
তিন্নি আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বলে,
“ভাবী তুমি চড়তে পারবে তো।
তিন্নি দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসি দিলাম!
.
সবাই দাঁড়িয়ে আছি বাগানের গাছের পিছনে, মিশন হচ্ছে তেঁতুল চুরি করা। এজন্য ওই পাহাড়াদার টাকে সরাতে হবে। পাহাড়াদার টাও পাহাড়ের মতোই। বিশাল তার দেহ। শরীরে একটা সাদা রঙের গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা। কোমরে বাধা গামছা। এদিকে অনেকক্ষণ হলো তিথি গেছে তাকে এখান থেকে সরাতে। আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি সে কি করে। সে কিছু একটা বলার পর পাহাড়াদার চলে গেল।
তিথি মুখ টিপে হাসতে হাসতে আমাদের কাছে আসলো। তিন্নি বলে উঠে,
“কি বললি রে যে খোচ্চর লোকটা চলে গেল।
“বলেছি নানু তাকে ডেকেছে, বলেছে জলদি যেতে।
আমি বলে উঠি,
“হায় হায় কি বলো, নানু যদি বলে আমরা ডাকে নি। তখন তো হবে আরেক গন্ডগোল।
“আরে কোন গন্ডগোল হবে না। নানু দু টো ঝাড়ি দিয়ে বলবে, “মুখপুড়ো তোকে কে বলল আমি ডেকেছি, রেখে এলি তো আমার বাগানটাকে। কিছু যদি চুরি হয় তাহলে তোর একদিন তো আমার একদিন।” নানুর এসব কথা শুনে পাহাড়াদার ভয়ে তটস্থ। সে মাথা নেড়ে আবারো এখানে ততোক্ষণে আমাদের কাজ হয়ে যাবে। এখন তুমি কথা না বলে গাছে চড়ো দেখি।
তিন্নি বলে উঠে,
“শাড়ি পড়েই কি চড়বে, পারবে তো!
ছোট মেয়েটা বলে উঠে,
“আন্টি তুমি পড়ে যেও না তাহলে কিন্তু অনেক ব্যাথা পাবে।
আমি ওর গালে হাত রেখে বলি,
“না সোনা পড়বো না, তুমি শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকো আমি তেঁতুল পেরে তোমার হাতে দেবো।
আমার কথায় মেয়েটা হেসে মাথা নাড়াল। তার হাসিটা মারাত্মক। কারো মন খারাপ থাকলে তার হাসি দেখে মন ভালো হতে বাধ্য!
শাড়িল আঁচলটা কোমরে গুঁজে গাছে উঠতে লাগলাম। ব্যাপারটা কঠিন ছিল না। আমি এর আগেও অনেক উঠেছি। গাছটা বেশ পুরোনো। আমি গাছের একটা ডালে বসে তেঁতুল পেরে নিচে ফেলছি আর তারা ধরছে। হঠাৎ করেই কারো আসার শব্দ পেলাম। তবে একজন না অনেকজন। তারা কথা বলতে বলতে আসছে। আমরা সবাই ভয়ে চুপ। না জানি নানু আসছে। ইশ্ আমাকে এখানে দেখলে কি হবে, আগে তো আমাকে পছন্দ করতেন না তবুও ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতেন এখন তো আর কথাই বলবেন না।
আমি দ্রুত নামতে যাবো এর আগেই আহিয়ানের ভাইয়ের ছেলে দৌড়ে আসল। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই বসে রইলাম। তবে ভয় কাটল কারণ এটা নানু এসেছে আহিয়ান না। বলতে বলতে তারা চলেও এলো। তিথি ওদের চোখ দিয়ে ইশারা করে না বলছি যাতে আমি এখানে আছি এটা না বলে।
আহিয়ান একটা কাতলা মাছ ধরেছে আর সেটাই তাদের দেখাচ্ছে। আর তারাও মাথা নেড়ে হেসেও যাচ্ছে। উনি বলছেন,
“দেখলি কতো বড় মাছ ধরেছি!
তিন্নি বলে উঠে,
“হ্যাঁ মাছটা অনেক বড়।
“হুম জানি জানি। তা ভূতনি কোথায় দেখতে পাচ্ছি না যে। আর তোরা এখানে কেন?
তিথি বলে উঠে,
“এমনেই এসেছে ঘুরতে!
উনি বলেন,
“আর ভূতনি!
“ভাবী!
“হ্যাঁ ভূতনি, কোথায় সে?
“জানি না তো।
“জানি না মানে।
এর মাঝে ভাইয়া বলে উঠে,
“কেন আসার সময় তো দেখলাম তোদের সাথেই ছাদে ছিল। এখন কোথায় জানিস না!
ওরা সবাই চুপ হয়ে আছে। এদিকে টেনশনে আমি গাছের ডালে বসেই তেঁতুল খাচ্ছি। তেঁতুল গুলো ভালোই মিষ্টি লাগছে তবে টক ও লাগছে। এর মাঝেই সেই ছোট ছেলেটা উপরে তাকাল। তার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ সেই ছেলেটা চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“ভূতততততত! মামা ভূত! তেঁতুল গাছে ভূত!
ছেলেটার চেঁচামেচি তে সবাই উপরে তাকাল। আমাকে দেখেই সবার মুখ শুকনো হয়ে গেল। ছেলেটা দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির কাছে গেল। আমি মাথা নিচু করে তেঁতুল খাচ্ছি। সবকিছু শান্ত, ইশ কি লজ্জা! সবার সামনে ঘরের বউ গাছে চড়ে আছে।
হুট করেই আহিয়ান জোরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,
“আরে এটা ভূত না তো, ভূতনি!
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি তার দিকে। আহিয়ানের হাসি দেখে সবাই হেসে উঠে। ভাইয়া তিথির দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোরা তেঁতুল চুরি করতে এসেছিস।
“আসলে ভাইয়া মানে…
ছোট ভাইয়া বলে উঠে,
“আর কাউকে পেলি না, শেষমেশ নিহা কে উঠালি গাছে।
মেঝো ভাইয়া বলে উঠে,
“নানু জানে!
তিন্নি বলে উঠে,
“আল্লাহ’র দোহাই লাগে ভাইয়া নানু রে কিছু কইয়ো না।তাহলে আজ আমরা শেষ।
আহিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে হেসে বলে,
“আমি তো বলবো ভূতনি গাছে উঠেছি তেঁতুল চুরি করতে।
তিথি বলে উঠে,
“ভাইয়া মানা করছি তো।
আহিয়ান ঠোঁটে দাঁত কামড়ে বলে,
“ভূতনি আজ তো তুমি শেষ।
আমি রেগে একটা তেঁতুল ছুড়ে মারি তার দিকে। উনি সরে গেলে তেঁতুল টা তার গা ঘেঁষে নিচে পড়ে। উনি সেটা উঠিয়ে কামড় দিয়ে বলে,
“আহ টেস্টি তো খেতে।
তিন্নি বলে উঠে,
“ভাইয়া এখন কিন্তু তুমি কিছু বলতে পারবে না। চুরির ভাগ তুমিও খেয়েছ তাই তুমিও এই চুরির সাথে যুক্ত!
আহিয়ান মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
“আমি গেলাম বলতে। আজ নানু তোদের সবাইকে গাছের সাথে বেঁধে রাখবে দেখে নিস!
তিথি বলে উঠে,
“ভাইয়া না!
পিছনে ঘুরে আমাকে বলে,
“ভূতনি তুমি কি বলো!
আমি একটা মুখ ভেংচি দিয়ে বলি,
“কি হচ্ছে টা কি, আমি কি নামবো না গাছ থেকে।
“তো নামো না কে মানা করেছে, নামলেই তো গাছের সাথে বেঁধে রেখে দেবো। তারপর নানু কে গিয়ে ডাক দেবো।
আমি কিছু বলতে যাবো এর আগেই পেছন থেকে নানুর গলা পেলাম। নানু বলে উঠে,
“কাকে বেঁধে রাখবি লা গাছের সাথে।
নানুর গলার আওয়াজ পেয়ে আমরা রীতিমতো থমকে গেলাম। আহিয়ান এতোক্ষণ যে বলছিল নানুর কাছে যাবে উনিও চুপ। বোঝাই গেল উনি শুধু ভয় দেখাচ্ছিলেন। আহিয়ান বলে উঠে,
“নানু মানে!
এর মাঝেই সেই ছেলেটা নানুর হাত ধরে গাছের নিচে নিয়ে আসল। নানু বলছে,
“কোথাম ভূত রে, তুই কোথায় দেখলি ভূত!
বলতে বলতে নানু উপরে তাকালেন। আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলাম। এর মাঝেই নানার গলার আওয়াজ পেলাম। তিনি বলে উঠেন,
“নিহা!
আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি নানা, নানু , ভাবী তারা সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি কি করবো না ভেবে চুপচাপ বসে আছি। চারদিক নিস্তব্ধ! বোঝাই যাচ্ছে ঝড় আসতে চলেছে। বুঝতে পারছি নানু বেশ ক্ষেপেছে। কে জানে কি করবে এখন! অতঃপর হুট করেই…
#চলবে….