ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব-২০+২১

0
245

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২০

সারাদিন নীরবাচ্ছন্ন হয়ে থাকা পরিবেশটা এখন মানুষের কোলাহলে হই হই করছে৷ তায়েফ সাইয়িদ বাসা থেকো বেরিয়ে যাওয়ার পর নুরনাহার একা বাসায় থাকত। একা একা বোরিং হয়ে যেত। আর সেই বাসাটাই এখন কিনা মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ। যেন পূর্ন একটা ফ্যামিলি মনে হচ্ছে তাদের।

মিথিলা এ বাসায় আসতে রাজি হওয়াতেই মুলত খুশির বন্যা নেমেছে। সব থেকে বেশি খুশি তো তুরাগ হয়েছে। যেভাবেই রাজি হোক না কেন হয়েছে যে এই বেশি।

দিন তার আপন গতিতে চলে যাচ্ছে। তুরফার ভার্সিটির ছুটি শেষ হওয়ায় তুরফাকে চলে যেতে হয়েছে। তুরাগ আবারও তার শখের প্রফেশনটায় একটু একটু করে জয়েন করার চেষ্টা করতেছে। এখন কারো ইনভাইটেশন ফিরায় না৷ কোনখানে কনসার্ট হলে সেখানে এটেন্ড করে। বাসায় বসে সে লাইভ প্রোগ্রাম দেখে মিথিলা, তরু এমনকি বাসার সবাই। তুরাগ এর গান সর্বধাই সবার পছন্দের তালিকায় শীর্ষ স্থান দখল করে ছিল।

সবার লাইফ মোটামুটি হাসি খুশিই চলছিল। মোহনা আর তরু ব্যাচমেট হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ওদের সেম ভার্সিটিতেই ভর্তি করে দিবে। যাতে দুজন সব সময় এক সাথেই থাকতে পারে। তরু আর মোহানার ফ্রেন্ডশিপটাও জমজমাট।

সেদিন নুরনাহার এর কথা মতো তুরাগই তরু আর মোহনাকে ভার্সিটিতে এডমিট করিয়ে গিয়েছে। সেখানে অবশ্য দুজনকে কাজিন বলেই পরিচয় দিয়ে এসেছে।

প্রথম দিন তুরাগ নিজেই মোহনা আর তরুকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। গেট থেকে দুজন আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে পা বাড়াচ্ছে। তখন দূর থেকে ছেলেদের শিস বাজানোর শব্দ কানে এলো। মোহনা খপ করে হাত চেপে ধরল তরুর। তরু যে ভয় পায় নি এমনটা নয়। তবুও স্ট্রং থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফার্স্ট ডে তে র্যাগিং এর বহু কাহিনি শুনেছে। ভয় মূলত এখানেই। ওরা শিস বাজানো ছেলেগুলোর দিকে পাত্তা না দিয়ে আবারও পা বাড়ায় ক্লাসরুমের দিকে। তখনি দুটো ছেলে এসে হাত আড়াআড়ি করে দাড়ায় ওদের সামনে। মোহনা দুপা পিছিয়ে যায়। তখনো তরুর হাত ধরা। তরু আবার পেছন থেকে টেনে ওকে সামনে আনে। ফিসফিস করে বলে ভয় পাস না এদের সামনে৷ এরপর তরুই জানতে চায়

– কি চাই।

– বাহ। প্রথম দিনেই এত তেজ। ভালো লাগল। তবে এত তেজ থাকা ভালো না মেয়েদের বুঝলি।

– সেটা বলতে বাধ্য নই। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। সরুন সামনে থেকে।

– ভার্সিটিতে এসেই সিনিয়রদের সাথে তিড়িং বিড়িং করো না মেয়ে খুব বড় বিপদে পড়ে যাবে।

ছেলে গুলোর ধমকানি শুনে ভয় পাচ্ছে মোহনা। ছেলেগুলো বলল ওদের ভাই নাকি ডাকছে তার ওখানে।

মোহনা বলে তরু চলো যাই। নয়ত ওরা যদি সিনক্রিয়েট করে। মোহনার কথায়ই সামনের দিকে পা বাড়ালো তরু।

একটা ছেলে বাইকের উপর বসে সানগ্লাসটা হাতে নিয়ে সেটা ঘুরাচ্ছে। দূর থেকে দেখেই কেমন অভদ্র টাইপ মনে হলো তরুর। আরেকটু সামনে যেতেই চেহারা স্পষ্ট হলো। এই ছেলেকে তো চিনে তরু৷ একবার না বেশ কয়েকবার দেখেছে ওকে। এমনকি ওদের বিয়ের দিনও দেখেছে। এ তো ড. আবির আহমেদ এর ছোট ভাই। একে দেখেই মাথার শিরা দপদপ করে জ্বলে ওঠে তরুর। এর ভাই যেমন খারাপ এ ছেলেও তো বখাটে। এদের বাবার আসলে বাবা হওয়ারই কোন যোগ্যতা নেই। একটা ছেলেকেও মনুষত্য শেখাতে পারলেন না। পড়ালেখা শিখলে আর পাঠ্য বইয়ে মুখ গুজে থাকলেই মনুষ্যত্ব্য অর্জিত হয় না। এটা একটা আলাদা গুন। যেগুলো মানুষ পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শেখে। অবশ্য এদের বাবা নিজেই তো অবৈধ পন্হায় উপার্জন করেন।

এসব ভাবতে ভাবতেই সেই ছেলেগুলোর সামনে চলে আসে তরু আর মোহনা। এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে সানগ্লাস ঘুরাতে থাকলেও তরুর দিকে চোখ পড়ার পর সানগ্লাস ঘোরানো অফ হয়ে যায়। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তরুরা গিয়ে দাড়াতেই পাশ থেকে একটা ছেলে বলে ওঠে

– এটা আদিব ভাই। সালাম দেও তাকে।

মোহনা মিনমিনে কন্ঠে সালাম দেয়। আদিব সালাম এর জবাব না দিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে

– কি ব্যাপার আপনি সালাম দিবেন না ভাবি?

আদিব এর মুখে ভাবি ডাক শুনে শরীর জ্বলে উঠল তরুর। এই ছেলে ওকে জ্বালানোর জন্যই ভাবি বলছে। আদিব এর মুখে ভাবি ডাক শুনে পাশে দাড়ানো ছেলেগুলো চোখ বড়বড় তাকালো। তারা তো আর জানে না গ্রামে কি হয়েছিল।

– আমি কারো ভাবি নই। কোন খারাপ লোকের বউ হওয়ার ইচ্ছে ও নেই আমার।

– ওপসস ভাবি কি যে বলন না। বিয়ে না করে কি এমনি এমনি বেডে যাবেন নাকি। অবশ্য আপনার তো আগেও এক্সপেরিয়েন্স আছে। এখন চাইলে আমাদের ও একটু সুযোগ দিতে পারেন।

মেজাজ খারাপ হয় তরুর। এই ছেলেকে দূর থেকে দেখেই খারাপ মনে হয়েছিল তরুর।তবে ওর ধারণার থেকেও বেশি খারাপ এই ছেলে। র্যাগিং এর বিষয়টা মানলেও এরকম একটা নোংরা প্রস্তাব সহ্য হলো না তরুর। মোহনার হাত থেকে হাত টেনে ছাড়িয়ে নিল। আদিব এর৷ সামনে গিয়ে গায়ের জোর দিয়ে এক চড় দিল। সাথে সাথে গালে হাত চলে গেল আদিব এর। অন্য হাত দিয়ে কব্জি চেপে ধরল তরুর। দাতে দাত চেপে বলল

– নিজ ইচ্ছায় যখন যাও তখন দোষ হয় না৷ গ্রামে থেকে সুবিধা হচ্ছিল না তাই এখানে এসে নিছো। বুঝি না আমরা তাই না। তোর এই তেজ তো আমি দেখে নিব। একদিন এর জন্য হলেও তোরে আমার করব দেখিস।

হাত টানাটানি করে। ছাড়াতে পারে না। কিন্তু মুখে থুথু ছিটায় তরু। আর বলে

– তোর তো পরিবার এর শিক্ষার অভাব আছে। আর বললি না আমি নিজ ইচ্ছায় গেছি। ওগুলা তোর জা*নো*** ভাইর ইডিট করা ছিল। ছাড় বলতেছি।

মুখে থুথু দেয়ার সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিল তরুকে। তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেল তরু। মোহনা দৌড়ে গিয়ে তুলল তরুকে। তরু আবার উঠে যাচ্ছিল আদিবকে আঘাত করার জন্য। কিন্তু মোহনা হাত টেনে নিয়ে আসে সেখান থেকে।

– আনলি কেন আমাকে

– ওদের সাথে ঝামেলা করো না। দেখলে না পরা খারাপ।

তরু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়। রাগ কমানোর চেষ্টা করতেছে। নিজেকে উপরে উপরে যথেষ্ট স্ট্রং রাখার চেষ্টা করে তরু তবুও একটা চাপা ক্ষোভ তাদের উপর রয়েই গেছে যাদের জন্য আজ আম্মুকে ছেড়ে এত দূরের একটা শহরে এসে থাকতে হচ্ছে।

মোহনা তরুকে টেনে নিয়ে ফাস্ট ইয়ার এর ক্লাসের দিকে এগোয়। তরুকে আর মোহনাকে ঢুকতে দেখে কয়েকটা মেয়ে এগিয়ে আসে৷ কেউ নাম জিজ্ঞেস করতেছে। আবার কেউ বলতেছে – তোমার তো অনেক সাহস৷ তুমি ওই আদিবকে চড় মেরেছো। জানো ও অনেক বাজে। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলে। প্রচন্ড উগ্র টাইপের। যাচ্ছে তাই করে। মারধর ওর নিত্যদিনের স্বভাব। র বিরুদ্বে কোউ মুখ খুললে তাকেও ছাড়ে না ও। এসব কথা এখন ভালো লাগছে না তরুর। তাই কথা ঘুরাতে ও সবার কাছে পরিচয় জানতে চায়। তরু আর মোহনার সাথে আরো তিনটা মেয়ের ফ্রেন্ডশিপ হয়ে যায়। সাফা, ইভা আর সাহারা। তারা একসাইড জুড়ে বসে।




নিয়ম করে দুবার মিথিলার ঘরে গিয়ে মিথিলাকে দেখে আসে তুরাগ। যদিও মিথিলা বিরক্ত হয়। ও তুরাগকে খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলছে যে তুরাগ তোমার আর আমার সাথে আগে যা হয়েছে তুমি ভুলে যাও। উপরওয়ালা চায় নি আমি একটা সুন্দর জীবন পাই। এজন্যই তো এমনটা হলো৷ কিন্তু তুমি কেন তোমার জীবন নষ্ট করবে।

কিন্তু তুরাগ বেচারা। সে তো নাছোড়বান্দা। সে বিয়ে করলে মিথিলাকেই করবে। ছেলের ত্যাড়ামি স্বভাব সম্পর্কে এতদিনে মোটামুটি ভালোই অভিজ্ঞতা আছে তায়েফ সাইয়িদ আর নুরনাহার এর। তাই এখন তারাও চান যাতে মিথিলার সাথেই বিয়েটা হয়।

মিথিলার মায়ের অবশ্য এতে আপত্তি নেই। তার সাথে কথা হয়েছে আগে তুরাগ দের সিটি করপোরেশন এর নির্বাচন এর ঝামেলা শেষ হবে। এরপরেই নাহয় বিয়েটা হবে। এই কথাটা জানার পর তুরাগ এর সবথেকে কাছের বন্ধু প্রান্ত সেও বলেছিল

– এটা তোর কেমন ডিসিশন তুরাগ। একটা পা ছাড়া মেয়েকে বিয়ে করে তুই কি করবি বল। তোর জীবনের সব আনন্দই তো মাটি।

সেদিন তুরাগ রাগ না করে বরং প্রান্তর পিঠ চাপড়ে বলেছিল

– শোন প্রান্ত। মানুষের মনের শান্তি হচ্ছে সব থেকে বড় শান্তি। এর থেকে বেশি চাই না আমি। মিথিলার সাথে থাকলে আমি মানষিক শান্তি পাই। সেটা আর কোথায় পাবো বল।

তুরাগ এর কথার জবাবে সেদিন প্রান্ত উত্তর না দিয়ে শুধু একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। মনে মনে অনেক কিছুই বলে যা তুরাগ এর কান অবধি আর আসে না৷ প্রান্ত চায় ও না তুরাগ শুনুক৷ মন যা চাইছে তা ই করুক।




কিছু সমস্যার কারণে নবীন বরণের ডেট টা কিছুটা পেছানো হয়েছিল। কিন্তু একদম অনুষ্ঠান করবে না এটা তো হয় না৷ তাই কতৃপক্ষ নবীন বরণের আয়োজন করে ক্লাস শুরুর পাচ থেকে ছয়দিন পরে।

এই কয়দিনে পাচজনের মধ্যে একটা ভালো বন্ডিং ও সৃস্টি হয়। ঠিক করে সবাই এক রকম শাড়ী পরেই ওরিয়েন্টেশন এ যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পরেরদিন সবাই ওরিয়েন্টেশন এ একরকম শাড়ী পড়েই আসে। অনুষ্ঠান তখন মাঝামাঝি পর্যায়ে। স্টেজে নৃত্য পরিবেশন চলতেছে৷ সে সময় সাফা বলে কি

– তরু দোস্ত ওঠ না আমরা একটু ওদিকে যাই৷ তোর জিজু আসবে ওখানে। দেখতে চেয়েছিলি না তাকে৷ তরু মোহনাকে ডাকে। মোহনা বলে না এই গানটা আমার অনেক পছন্দের। এই নৃত্য মিস করা যাবে না তুই যা। তরু তো বোকার মতো সাফার সাথে চলে যায়। সাফা ওকে নিয়ে যেতে যেতে একদম ভার্সিটির পেছন সাইডে নিয়ে চলে আসে। তখন প্রায় দুপুর টাইম চলতেছে। এই তপ্ত রোদে সেদিকে তেমন একটা মানুষ জন ছিল না৷ খুব নীরব পরিবেশ৷ ভার্সিটির পেছন সাইডটায় আবার অনেক গাছপালাও রয়েছে। যার কারণে সেদিকটা কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ও। তরু বলে

– সাফা আমরা ওদিকে কেন যাচ্ছি ।

– ভাইয়া ওখানেই যেতে বলেছে।

তরু বুঝে উঠে না যে সামনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করতেছে। ভার্সিটি থেকে অনেকটা দূরে আসার পর দেখতে পায় সেখানে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে আদিব দাড়িয়ে আছে। তরুকে দেখে অমনি খপ করে ওর হাত চেপে ধরে। ভীষণ ব্যাথা পায় তরু। চোখ দিয়ে পানি বের হওয়ার উপক্রম। তরু সাফার দিকে তাকায়। সাফা এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। তরুর চোখে চোখ পড়তেই কানে হাত দিয়ে স্যরি বোঝায়। চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে যায় তরুর। এজন্যই হয়ত কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে হয় না। বন্ধু বানানোর সময়ও ভেবে চিন্তে বানাতে হয়। তরুর এটা ভেবেই কান্না আসে যে একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়েকে এভাবে বিপদে ঠেলে দিতে পারে।

#চলবে

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২১

তরু উঠে আসার প্রায় মিনিট দুয়েক এর মাঝেই নৃত্য শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই মোহনাও উঠে তরুকে খুজতে আসছিল। ক্যাম্পাস এ না দেখে ক্যাম্পাস এর পেছন সাইডে উকি দেয়। সেখানে দেখে সাফা একা একা ফিরে আসতেছে। মোহনা দৌড়ে সাফার কাছে যায়। মোহনাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল সাফা। মোহনা জানতে চায় তরু কোথায়। সাফা উত্তর দেয় আমি জানি না খুজে নাও গিয়ে। মোহনা সাফার হাত চেপে ধরে শক্ত করে৷

– বল বলছি তরু কোথায়?

– আমি সত্যি জানি না। ব্যাথা লাগছে ছাড়ো আমায়।

– তুই ওকে নিয়ে ভার্সিটির পেছন দিকে গেছিস তাইলে তুই একা কেন আসতেছিস? ভালোয় ভালোয় বল তরু কোথায়। যদি ওর কিছু হয় না ভাইয়া তোকে জ্যান্ত কবর দিয়া দিবে।

– কে তোমার ভাইয়া। সময় নষ্ট না করে তরুকে খোজো যাও।

সাফার হাত ছেড়ে দেয় মোহনা। ওরও মনে হয় শুধু শুধু এই মেয়ের পেছনে সময় নষ্ট না করে দেখা উচিত তরু কোথায়। মোহনা ছুটে যায় ভার্সিটির পেছন দিকে। ওর মনে হচ্ছে ওর কানে তরুর চিতকার শুনতে পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করে চিতকার এর আওয়াজ কোথা থেকে আসছে। শব্দ শুনে সেদিকে দৌড়ে যায় মেহনা। যা ভেবেছিল তাই। তরু ঠিক বিপদে পড়েছে। তরুকে আগেই বলছিল কারো সাথে ঝামেলা না করতে। আদিব এর এক হাত তরুর দুহাত শক্ত করে ধরে আছে আর এক হাত কোমড়ে আকড়ে তরুকে কাছে টানার চেষ্টা করতেছে। তরুর ছটফটানিতে বারবার আদিব এর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তরু। মোহনা পাশে পড়ে থাকা একটা লাঠি তুলে নেয়। পেছন থেকে গিয়ে জোরে আঘাত করে আদিব এর মাথায়। প্রচন্ড আঘাত লাগায় তরুর হাত ছেড়ে মাথায় হাত দেয় আদিব৷ সেই সুযোগে মোহনা তরুর হাত ধরে আদিব এর থেকে টেনে দূরে সরিয়ে আনে। ছিটকে নিচে পড়ে তরু। মোহনা আবার টেনে তোলে ওকে৷ ফিসফিস করে তরুর কানে বলে

– এদিকে এই সময় কেউ আসবে না। এই জা*নো*য়ার এর হাত থেকে বাচতে চাইলে আমার হাত ধরে দৌড় লাগা।

বেশ কাজে লাগে কথাটি। এবার মোহনার হাত টেনেই তরু দৌড়াতে থাকে। একবারে ক্যাম্পাস এর বাহিরে চলে আসছে ওরা। হাটুতে ভর করে নিচে ঝুকে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে দুজনই। শ্বাস নেয়ার গতি কমে আসলে মোহনা জিজ্ঞেস করে এখন কি করবি।

– রিক্সা ডাক বাসায় যাব।





সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে বেশ অনেক সময় হলো। সারাদিন দৌড় যাপ এর পর এখন একটু রেস্ট নেয়ার প্রয়োজন। আগে তো আর বাসায় ফিরত না। এখন সময় পেলেই বাসায় চলে আসে। তাই আজও চলে আসল। কিন্তু বাহির থেকে দেখতে পেল পুরো বাড়ি অন্ধকার। শুধু কর্নার এর দিকের দুইটা রুমে বাতি জ্বলতেছে। এত তাড়াতাড়ি তো সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা না। তাই অবাক হলো তুরাগ। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে দেখতে পেল মিথিলার রুমের বাতি জ্বলতেছে। আগে সেদিকেই পা বাড়াল তুরাগ। বাহির এ দাড়িয়ে দরজায় নক করল। ভেতর থেকে জবাব আসে

– কে?

– আমি। ভেতরে আসলাম।

– হুম।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই মিথিলাকে জিজ্ঞেস করে

– এই মিথু বাসার সবাই গেছে কোথায় বলতে পারো।

– সবাই বাসায়ই আছে।তুমি একটু আমাকে হুইল চেয়ারটায় বসতে সাহায্য করো না। আমি একটু তরুর রুমে যাবো।

– হঠাৎ তরুর রুমে কেন। তরুর সাথে কথা থাকলে বলো আমি ওকেই ডেকে দেই।

– না ওকে ডাকতে হবে না। সবাই ওর রুমেই আছে। তুমি ও চলো দেখে আসি মেয়েটার কি অবস্থা।

– কি হয়েছে আবার অসুস্থ নাকি ও।

– না৷ ওর সাথে আজ খারাপ কিছু হতে যাচ্ছিল। মেয়েটা সেই দুপুর থেকে কান্নাকাটি করতেছে। ভয় পেয়েছে মনে হয় প্রচুর।

– কি হয়েছে খুলে বলোতো আমাকে।

মিথিলার মুখ থেকে সবটা শুনে রাগে শরীর রি রি করে ওঠে। মনে চায় এখনি ওই ছেলের হাত ভেঙে গুড়ো করে দিতে। কত বড় অসভ্য ছেলে। ভার্সিটিতে পড়ালেখা করতে আসে আবার নিজের ভার্সিটির মেয়েদের সম্মানে হাত দেয়। কিছু একটা ভাবে তুরাগ৷ রাগে সামনে থাকা টি টেবিল এ জোড়ে আঘাত করে। উঠে যায় মিথিলার পাশ থেকে। পাশের রুমের দরজা খোলাই ছিল। একবার উকি দেয় সেই রুমে। নুরনাহার এর কোলের মধ্যে মাথা রেখে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে আছে তরু। চোখ ফুলে গেছে কান্না করতে করতে। রুমের ভেতরে আর ঢোকে না তুরাগ। বাসায় এসেছিল রেস্ট নিতে। তা আর হলো কই। মাথা গরম করে বেড়িয়ে গেল বাসা থেকে। বাসা থেকে বের হতে হতে ফোন দিল প্রান্তকে। বলল দলের কিছু ছেলেপুলেদের একসাথে করতে। আর আদিব এর ঠিকানা খুজে বের করতে।

তুরাগ এর কন্ঠ শুনে প্রান্ত বুঝতে পারল বেশ রেগে আছে। তাই বলল

– মাথা ঠান্ডা কর ভাই। কি হয়েছে বল।

মাথা ঠান্ডা করার কথা শুনে জোড়ে ধমক দিল তুরাগ। বলল

– আমার বাড়ির মেয়েদের সম্মানে হাত দিছে ওই কু*** বা**। ওরে খুজে বের কর।

প্রান্তের নিজেরও মেজাজ খারাপ হলো। তুরাগকে শান্ত করার চেষ্টা না করে দলের ছেলেদের খবর নিল।




বন্ধুদের সাথে ক্যারম খেলায় ব্যাস্ত ছিল আদিব। হাসি ঠাট্টা করছিল আর ক্যারম খেলতেছিল। হঠাৎ করে কেউ একজন খুব জোরে ক্যারম বোর্ড এর মাঝ বরাবর আঘাত করে। মাঝখান থেকে ভেঙে যায় বোর্ড। আদিব ছাড়া বাকি তিনজন ভয়ে ভয়ে তাকায় কে আঘাত করল দেখার জন্য। হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাড়িয়ে আছে কেউ একজন। কিন্তু মুখে মাস্ক পড়া তাই চিনতে পারল না ওরা। ওরা সেখান থেকে একটু দূরে সরে দাড়াল। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া মানুষ কি কখনো সোজা হয়। যেমন আদিব। ও উঠে যায় মাস্ক পড়া ব্যাক্তিকে মারতে। আদিব গিয়ে পান্জাবির কলার ধরে। সাথে সাথে এক বিকট চিতকার দেয় আদিব। সেখানে থাকা বাকি তিনজন ভয়ে ভয়ে তাকায় দেখার জন্য যে কি হয়েছে। দেখে যে হাত চেপে ধরে বসে পড়েছে আদিব। ওদের আর বুঝতে বাকি নেই যে, যে হাত দিয়ে কলার ধরেছিল সে হাত ভেঙে গেছে। ওরা আর সামনে না আগিয়ে ভয়ে দৌড় লাগায় সেখান থেকে কয়েক মুহুর্তের মাঝে ছোট খাট একটা ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে যায় সেই রুম এর ভিতর যেখানে বসে ক্যারম খেলছিল আদিবরা। আদিব এর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ছে, ঠোট কে’টে গেছে। ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাথায় গগন বিদারি চিতকার করছে।

ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সবাইকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় তুরাগ। আশপাশে লোকজন জড়ো হয়েছে তবে আদিব এর কাছে এগোনোর সাহস কারো নেই। এতদিন এই এলাকায় যাচ্ছে তাই করে বেরিয়েছে ও। ওর যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ ছিল মহল্লার মেয়ে গুলো। আজ এর এমন পরিস্থিতি দেখে অনেকেই মনে মনে সন্তুষ্ট। তবুও নিজেদের স্বাভাবিক করে দাড়িয়ে আছে সেখানে। তুরাগরা বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় কয়েক মুহুর্ত পরেই সেখানে একটা কালো রং এর গাড়ি এসে থামে। সেটা থেকে এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে আসে ড. আবির। তাড়াহুড়োয় কি করবে মাথায় আসে না। ভাইয়ের শরীর থেকে শার্ট খুলে সেটা দিয়েই ভাঙা হাত গলার সাথে ঝুলায়। ড্রাইভার এর সহায়তায় গাড়িতে তোলে আদিব কে। ব্যাক সিটে শোয়ায়। হসপিটাল এ নিয়ে আসে আদিবকে। যন্ত্রনায় জ্ঞান হারিয়েছে আদিব।

হসপিটালে এনে রক্তগুলো মুছিয়ে দিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করে ড্রেস চেন্জ করে দিয়েছে আদিব এর। কেবিন এর সামনে পায়চারি করতেছে আবির। অপেক্ষা ভাইয়ের জ্ঞান ফেরার।



তিনদিন যাবত ভার্সিটি বন্ধ করে দিয়েছে তরু আর মোহনা। তরু এখানো ভয় পেয়ে আছে। সে কোন ভাবেই যাবে না ভার্সিটিতে। যদিও পরেরদিন সকালেই নিউজ এ দেখেছে আদিব এর অবস্থা। কিন্তু যারা মে’রেছে সবাই হেলমেট পড়া ছিল। তাই কারো চেহারা দেখা সম্ভব হয় নি। তবুও তরু শিওর এটা যে তুরাগ ভাই ই করেছে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি তরু। এখন আদিব কয়েকদিন এ আর ভার্সিটিতে আসতে পারবে না। তাই ভার্সিটিতে তো যাওয়াই যায়। তাও মন সায় দিচ্ছে না। সবাই অনেক বোঝানোর পরে রাজি হলো যাওয়ার জন্য। মিথিলা বারবার করে মোহনাকে বলে দিল তরুর হাত যেন না ছাড়ে। মিথিলা ওর ফোনটা মোহনাকে দিয়ে দিল। যেন যেকোনো প্রয়োজনে ফোন দিতে পারে। তুরাগ নিজেই ওদের নিয়ে বের হলো। একদম গেট অবধি পৌছে দিয়ে গেল। বলল ক্লাস শেষ হলে যেন ফোন দেয়। তাহলে আবার এসে নিয়ে যাবে। তরুরা ভার্সিটিতে পৌছানো মাত্রই কেউ একজন ফোন দিয়ে ড. আবির আহমেদ কে নিউজটা জানালো। তিনি ফোনে বুঝিয়ে দিলেন কি কি করতে হবে। তিনি এত দিন অপেক্ষা করে ছিলেন কবে বের হবে বাসা থেকে। বাসা থেকো তুলে আনা সম্ভব না। তারউপর তাকে নিজেকেই তো পুলিশ অবজারবেশন এ রাখছে। তাই খোলামেলা ভাবে কিছু করা সম্ভব না। তবে আজ এই মেয়ের শেষ দিন।




অন্ধকার একটা রুমের মাঝ বরাবর কম পাওয়ারি একটা লাইট জ্বলতেছে। সেখানেই বসা তরু। তবে ও একা নয়। আরো ছ থেকে সাতজন মানুষ সেখানে আছে। সবার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সবাই জানে তাদের জীবনের অন্তিম সময় আসন্ন। সেই ভয়েই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। ওরা যে একটা চক্রের ফাদে আটকা পড়ে আছে। একটা লোক এগিয়ে এলো তরুর দিকে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল

– আচ্ছা তোমাকে দেখে তো বেশ বুদ্ধিমতি মেয়ে মনে হচ্ছে তাহলে তুমি কীভাবে এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিলে।

– কি বলছেন। আর আপনাদের কেন এভাবে আটকে রেখেছে।

– সে কি তুমি এখনো বুজতেছো না কেন আটকে রেখেছে এভাবে।

আমি বলছি।

গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকায় তরু। মাথা তুলে তাকায় সেদিকে। তবে এখানে আবিরকে কোনভাবেই আশা করে নি। আবিরকে দেখে উঠে দাড়ায় তরু।

– ওহ এটা তাহলে আপনি। কেন তুলে এনেছেন আমাকে।

এক পা দুপা করে সামনের দিকে আগায় আবির৷ তরু এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায়। এই মুহুর্তে আবির ঠিক কি চাচ্ছে তা কল্পনার বাহিরে তরুর। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তরু। এই দুইটা মাসের মধ্যে জীবন পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে ওর। এখন সামনে কি হতে যাচ্ছে তা বলা মুশকিল। আবির জোরে জোরে পা ফেলে ধরে ফেলে তরুকে। তরুর পেছনে হাত দিয়ে হিজাব এর উপর থেকেই চুল এর গোড়াসহ টেনে ধরে। তরুর মনে হচ্ছে চুলগুলো বুঝি সব ছিড়ে যাচ্ছে।

– তোর বাপ ভাই সবাই মিলে উঠে পড়ে আমার উপর লেগেছে। আমি শান্তিতে বিজনেস করছিলাম ভালো লাগল না তোর বাপের। আমার ভাইটার এত সুন্দর জীবন যাপন সহ্য হলো না তোর নাগর এর। বিয়ে ভাঙতেই আবার এখানে নতুন নাগর জুটিয়েছিস। বাহ ভালোই। কিন্তু এবার তোর কি হবে বল তো। আমার ভাইটা ওখানে ব্যাথায় ছটফটাচ্ছে। আমি কেমনে সহ্য করি বলো।

” অন্যের সন্তান, ভাই, বোন যখন ব্যাথায় ছটফটায় তখন তারা কীভাবে সহ্য করে বলতো। তুই নিজ হাতে এত এত নিষ্পাপ জীবন ধ্বংস করিস তখনতো কষ্ট লাগে না। এখন নিজের ভাইয়ের বেলায় এত কষ্ট কিসের ক্রিমিনাল আবির আহমেদ”

অন্ধকার এর কারণে চেহারা ঠিক বুজতে পারল না তবে এটা বুঝতে পারল এখানে একজন দুজন নয় বেশ অনেক জন লোক দাড়িয়ে আছে। তাদের এগিয়ে আসা পায়ের শব্দে এতটুকু বুঝতে পারল এরা পুলিশ ফোর্স। তাদের সু এর আওয়াজ শুনে এটা স্পষ্ট।

– আ আ আ আপনারা? এখানে।

– এখানে আসার জন্যই তো এত ড্রামা আবির আহমেদ। আপনি খুব চালাক মানুষ। খুব তাড়াতাড়ি রঙ বদলে ফেলেন। আপনাকে ধরা এতটা সহজ কাজ ছিল না। তাই তো ফাদ পাততে হলো আপনার জন্য।

আবির এর বুঝতে বাকি থাকে নেই যে তরুকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে এরা। কিন্তু এই অবধি পৌছালো কি করে সেটাই মাথায় আসছে না।

#চলবে