ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব-২২+২৩

0
267

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২২

তহমিনাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে তরু। ছাড়াছাড়ির কোন নাম নেই। না খাওয়া দাওয়ায় মন আছে। নিজেও খাচ্ছে না মা কেও খেতে দিচ্ছে না। ফুফু ফুফা সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ও মাকে ছাড়বে না। সবাই বোঝালো না খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু ওর বাবা বাসায় না আসা অবধি ও খাবে না। সেইখানে বসে যে ভয় পেয়েছে তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। এমনিতে যথেষ্ট স্ট্রং। তবে এরকম রক্তারক্তি কান্ড এর আগে কখনো চোখের সামনে দেখেনি। ওর মা বারবার জানতে চাইছে কি হয়েছে তারও জবাব দিচ্ছে না। ভোর রাতের দিকে যখন নুরুল ইসলাম মেয়েকে বাসায় রেখে গেছেন বলে গেছেন ওর খেয়ালরাখতে। বাকি কথা তিনি বাসায় এসে বলবেন।তহমিনা বেগমকেও তিনি ফোন দিয়ে দিয়েছিলেন। সকাল হতে হতেই তিনিও হাজির হয়েছেন ননদের বাসায়। এর আগে কারো সাথে কথা না বললেও মা আসতেই মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর এখনো সেভাবেই রয়েছে। নুরনাহার খাবার রেখে গেলে তহমিনা চেষ্টা করেছেন মেয়েকে খাওয়ানোর। কিন্তু বারবার বলতেছে – বাবা আসলে খাবে। এরপর আর জোর করেনি কেউ। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। সেসময় কলিং বেল এর আওয়াজ কানে আসতেই দৌড়ে দরজা খুলতে যায় তরু। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ নড়ছিল ও না। আর এখন দিব্যি দরজা খুলতে চলে গেছে। দরজা খুলতেই নজরে এলো নুরুল ইসলাম৷ তরু ঘুরে ঘুরে বাবার চারপাশ থেকে দেখতে লাগল। আবার বাবার ড্রেস গুলো টেনে টেনে দেখছিল। তহমিনা এসে টেনে মেয়েকে সরালেন।

– কি হলো কি তরু। পাগল হয়ে গেলে নাকি।

– আম্মু আমি তো দেখছিলাম বাবা ঠিক আছে কিনা৷

– ঠিক থাকবে না কেন। তার আবার কি হবে।

– আম্মু আজ না বাবার চোখের সামনে আবির সু’ই’সাইড করার চেষ্টা করেছিল। নিজের হাতের শিরা নিজে কে’টে ফেলেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। বাবা যখন হাত ধরতে গেছে ওমনি বাবার দিকে ছু’রি তাক করে বলেছিল কাছে আসলে ছু’রি চালিয়ে দিবে। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম। এজন্যই তো দেখছি বাবা ঠিক আছে কিনা।

– কি হয়েছে কি একটু বলো তো। মেয়েটা সকাল থেকে কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

– ভেতরে চলো সব বলতেছি।

🌼 তরু আর মোহনা যখন ভার্সিটির বাহিরে তুরাগ এর জন্য অপেক্ষা করতে ছিল তখন মোহনার ফোনে একটা ফোন আসে। ফোনটা আর কেউ না বরং তুরাগ করেছিল। ফোন করার পরে মোহনা সেই ফোন সহ ব্যাগটা তরুর হাতে দিয়ে আইসক্রিম খাবে বলে ভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে যায়। রাস্তার পাশে তরুকে দাড় করিয়ে রেখে অপজিট সাইডে যায় আইসক্রিম আনার জন্য। তখন গাড়িতে বসে কেউ তরুর মুখে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে। যার প্রভাবে ক্ষনিক সময়ের জন্য হুশ হারা হয় ও। প্লান মাফিক আবির এর লোকেরা ওকে তুলে নিয়ে যায়। পেছনে তুরাগ ফলো করে তাদেরকে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন এক প্রকার ধস্তাধস্তিতে ফোনসহ ব্যাগটা গাড়ির ভেতরেই পড়ে। যে ফোনটা তুরাগ এর সাথে কলে কানেক্টেড ছিল। সেই ফোন ট্রেস করে আমরাও ফোর্স নিয়ে চলে যাই সেখানে। আমরা চারদিক ঘেরাও করার পরেই আবির এর সামনে যাই। আবিরকে ধরার আগে ওর অন্যন্য গার্ডসদের এরেস্ট করি। যখন আবির এসব জানতে পারে ও চাচ্ছিল না পুলিশ এর হাতে ধরা দিতে। এসব ক্রিমিনালরা মূলত এরকমই হয়। নিজে ম’রে যাবে তবু গ্যাং লিডার এর নাম প্রকাশ করবে না। আবির ও সেই প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ওর পকেটেই ছিল নাইফ। যা দিয়ে নিজের হাতের শিরা নিজে কে’টে ফেলে সুই’ সাইড এর প্রচেষ্টা চালায়। তখন হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। তোমার আলগুছে মেয়ের সামনেই এসব হয়েছিল। তুমি তো জানোই ও এসব রক্ত সহ্য করতে পারে না। এজন্যই ভয়ে এমন গুটিয়ে গেছে। মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিল। তুরাগ ছিল সেখানে। ও কোলে তুলে তরুকে বের করেছিল সেখান থেকে। তুরাগ এর গাড়িতেই নিয়ে এসেছে ওকে। আমাকে আর দেখতে পায়নি বলে ও ভেবেছিল হয়ত আবির আমার ক্ষতি করেছে। এজন্যই এত ভয়ে ছিল।আসার এরকম চেক করছিল তাও এই ভয়েই।

তহমিনা বেগম আগলে নেন মেয়েকে। তারপর জানতে চান

– আবির এখন কোথায়? জেলে নিশ্চয়ই।

– চিকিৎসাধীন আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আর বাকিরা জেলে। তবে ওদের গ্যাং লিডারকে এখনো ধরা যায়নি।

কথার মাঝখানে নুরনাহার বললেন

– হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে নুরু। তোর বউ মেয়ে এখনো না খেয়ে আছে। তোর সাথে খাবে বলে।

– খাব না আমি।

তরুর কথায় সবাই মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। নুরুল ইসলাম উঠে আসে নিজের জায়গা থেকে। তরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে

– কেন খাবে না মামনি। বাবা চলে এসেছি তো।

– ছি: বাবা। তুমি নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে এভাবে বাজি ধরতে পারলে। যদি আজ আমার কিছু হয়ে যেত।

– তুরাগ তো তোমাদের পেছন পেছনই ছিল। ওর দলের লোকেরা ছিল ওর সাথে। ওই আবির এর বাচ্চা তোমার কিছু করতে পারত বলো।

– বাবা তুমি কি আমারে বাচ্চা ভাবো। যা বলবা তাই বিশ্বাস করব।

– রাগ করে না সোনা। আবিরকে আমরা বেশ অনেক দিন যাবত অবজারভেশনে রেখেছিলাম। কিন্তু ও ভীষণ ধূর্ত। নিজেকে সামলে চলেছে এতদিন৷ ওর ফোন কল ট্রেস করে তোমার বিষয়টা জানা গেছে। এজন্যই তোমার মাধ্যমে ওকে ধরার চেষ্টা করেছি। যদিও অনেক রিস্কি ছিল বিষয়টা তবুও। আমার মা তো অনেক ম্যাচিওর। রাগ করে না মা। তুমি কি চাও না দেশের একজন শত্রুর ধ্বংস হোক। ও কত খারাপ লোক ছিল জানো? জীবন্ত মানুষকে অজ্ঞান করে তাদের শরীরের বিভিন্ন অর্গান কে’টে নিত। সেগুলো বিদেশে বহু মুল্যে বিক্রি করত। একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কষ্ট দিত। কত মানুষকে মে’রেছে। ওকে না ধরলে তো এরকম আরো বহু মানুষ মা’রা যেত। তুমি কি সেটা চাও বলো।

– ওফফ বাবা থামো। বুঝেছি আমি।

– তবে আমার কথা আছে এখানে ( তহমিনা)

এবার সবার নজর পড়ে তহমিনার উপরে। নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে

– তুমি আবার কি বলতে চাও।

– আমি আমার মেয়েকে এখানে আর এক মুহুর্তের জন্য ও রেখে যাবো না। এখানে যেসব হচ্ছে। কোনদিন না জানি আমার মেয়েটাকেই হারিয়ে ফেলি। আমি আর রিস্ক নিতে চাই না।

নুরনাহার বলল

– কিন্তু ভাবি মা যদি কিছু বলে।

– দেখেন আপা এরকম অনেক সহ্য করেছি। এখন আপনাদের মায়ের জন্য আমি আমার মেয়েটাকে তো রিস্কি লাইফ দিতে পারি না। আপনার মা যদি রাজি না থাকে প্রয়োজনে আমি আমার বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকব আমার মেয়েকে নিয়ে।

– কিন্তু ওর ভার্সিটি?

– এই পড়ালেখা পড়ালেখা করে এত কিছু। ওর পড়ার দরকার নেই ভালো ভার্সিটিতে। প্রয়োজনে ওকে ট্রান্সফার করে নিয়ে যাবো।

নুরুল ইসলাম স্ত্রীর পাশে বসলেন। শান্ত করার চেষ্টা করলেন স্ত্রীকে। এখন ক্ষেপে আছে। এই মুহুর্তে কিছু বলা মানে শুধু শুধু সংসারে ঝামেলা টেনে আনা। নারী জাতির রা’গ, ঘৃণা ভয়ঙ্কর জিনিস। তারা যখন ভালোবাসে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে। আবার যদি ঘৃণা করে তখন একদম মন থেকে ঘৃণা করে। আর রে’গে গেলে তো ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলার সামর্থ্য রাখে। নুরুল ইসলাম স্ত্রীকে বললেন

– আচ্ছা তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে যেও সমস্যা নেই। এখন খেতে চলো।

– আমি কাল সকালের বাসেই চলে যাবো।

– আচ্ছা বাবা যেও। আমি নিজে গিয়ে তুলে দিয়ে আসব এখন চলো।





টাকার লোভ মানুষকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। আমাদের জীবনে চলার পথে টাকার দরকার আছে অবশ্যই। তবে সেটা অবৈধ পন্থায় নয়। লোভ মানুষকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দেয় না। যেমনটা হয়েছে আবির এর, তার বাবার আর তাদের সাথে থাকা লোকগুলোর। এখন তারা পুলিশ এর আঘাত গুলো মুখ বুঝে সহ্য করতে রাজি তবুও গ্যাং লিডার এর নাম বলতে নারাজ। কারণ তার নাম প্রকাশ করলে হয়ত যে নাম প্রকাশ করবে তার জীবন পাখি খাচাছাড়া হবে। এসব পথে আসলে যেমন অবৈধ পন্হায় বেশি টাকা উপার্জন করা যায় তেমনি জীবন থাকে সর্বধা ঝুকির মধ্যে৷ পুলিশ কনস্টেবল গুলো মে’রে মে’রে ক্লান্ত৷ তবু এদের মুখ খোলার নাম নেই। সমস্যা নেই রিমান্ডে নিলে ঠিকই মুখ খুলবে। কতদিন আর সহ্য করা যাবে এসব।

অপরাধীদের অবস্থা “জলে কুমির ডাঙায় বাঘ” এর ন্যায়। মুখ খুললেও জীবন বিপন্ন হবে। আর না খুললে রিমান্ডে নেয়া হবে।

যেসব মানুষ গুলোকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদেরকে নিজ নিজ গৃহে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিবার এর মানুষ এর সে কি খুশি। খুশি যেন উপচে পড়ছে।





তরু তরুর মায়ের সাথে বাড়িতে চলে এসেছে বেশ কয়েকদিন হতে চলল। তবুও মনটা যেন ঢাকাতেই পড়ে আছে। বারবার সবার কথা মনে পড়ছে। মোহনার সাথে কথা হয় ফোনে। প্রতিদিন ক্লাসে কি পড়ায় সেসব বিষয় ও জেনে নেয়। নোটগুলোর পিক পাঠায় মোহনা। সেগুলো রেগুলার খাতায় তোলে। তরু জানে তুরাগ মিথিলাকে অনেক ভালোবাসে। তবুও অষ্টাদশী কন্যার প্রথম বারের মতো কারো জন্য মনে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল তাকি এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়। প্রথম বার মায়ের ইচ্ছেতে বিয়েতে রাজি হলেও তখন নিজেকে কেমন অনুভুতি শুন্য লাগছিল। এবার কারো জন্য অনুভূতি জাগ্রত হলো। তা প্রকাশ পাবার আগেই মাটিচাপা দিতে হয়েছে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর মনে মনে ঠিক করলো মোহনার থেকেই জিজ্ঞেস করবে – মিথিপু তুরাগ ভাই কেমন আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন নোট নেয়ার জন্য ফোন দিলে তখন জানতে চায় তুরাগ এর ব্যাপারে।

– আচ্ছা মোহনা মিথিপু কেমন আছে? তুরাগ ভাইয়ার সাথে সব ঠিকঠাক হয়েছে।

– মোটামুটি। তবে ভাইয়া তো এখন ভীষণ ব্যাস্ত। সময় দিতেই পারে না কাউকে।

– কেন। কিসের ব্যাস্ত এত।

– আরে তুমি জানো না ভাইয়াদের নির্বাচন এর আর মাত্র বারো দিন বাকি আছে। যদিও তারা নমিনেশন পায় নি৷ তবুও আমার মনে হচ্ছে তারাই জয়ী হবে।

– তরু এসব ব্যাপারে আর কথা বাড়ায় না। ও এসব বিষয় এত কিছু বোঝে না। তাই বলে জয়ী হলেই ভালো। এরপর তো বিয়ে খেতে চলে আসব কি বলো।

ফোন রেখে দেয় তরু। তবে মন কেন যেন মানতে চাচ্ছে না৷ আর মাত্র বারো দিন বাকি। এরপরই সে অন্য কারো। হলেও কিছু করার নেই। কি বা করতে পারবে ও। যেখানে তুরাগ এর সবটা জুড়ে মিথিলার বাস

#চলবে

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২৩

বারোটা দিন যেন চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন খুব তাড়াতাড়িই দিনগুলো চলে গেল। আর মাত্র একটা রাত বাকি আছে নির্বাচন এর। কালাম মোল্লা তার নিজ বাড়িতেই সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তুরাগ, প্রান্ত এরা দুজন মিলে তাকে নিষেধ করল ঝামেলা করতে। তিনি একা মানুষ। বিয়ে করেন নি এখনো, মা ও বেচে নেই তাই এসব ঝামেলা কে করবে। তুরাগ এর বাসায় কাজ করার জন্য অনেক জনই আছে। তুরাগ ওর মা কে তিনবেলার খাবার রান্না করতে বলল। চল্লিশ পয়তাল্লিশ জনের খাবার তৈরি করা মুখের কথা নয়। সবাই সকাল থেকে খেটে খেটে ক্লান্ত প্রায়। এখানো দলের ছেলেপুলেরা আসছে। তাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছে নুরনাহার আর মিথিলার মা। মোহনাও কিচেনে কিছু একটা করছে। সুফিয়া আবার রান্না বসিয়েছে।

মিথিলা একা একা রুমে আছে। ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো। কিন্তু একা একা তো যেতে পারবে না। তাই কয়েকনার মা মা বলে ডাক দিল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। মোহনাকে ডাকল। সেও শুনল না। সাহস করলো একা একাই যাবে। খাটের পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে হুইল চেয়ার টেনে আনল। মোহনা বলতে গেলে সব সময়ই মিথিলার পাশে পাশে থাকে। মিথিলা তো একা একা হুইল চেয়ারে বসতে পারে না। কমোডেও তুলে বসিয়ে দিতে হয়। কিন্তু কতকাল আর অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে মনে চায়। একজন প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন এতটাও সহজ নয়। একটা সময় পরিবার এর মানুষ ও বিরক্ত মনে করে। যদিও মুখে প্রকাশ করে না কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হয়। মিথিলার যে এমনটা হয়নি তা না। মোহনা ওকে যথেষ্ট ভালোবাসলেও মাঝে মাঝে ডাকলে জোরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা বলে। মিথিলা বোঝে যে মোহনা বিরক্ত। কিন্তু তবুও নিরুপায় হয়ে ডাকতেই হয়।

আজ কষ্ট করে একা একাই যাওয়ার চেষ্টা করে। হাতে ভর দিয়ে দিয়ে খাট থেকে হুইল চেয়ারে বসে। অনেক কষ্টের পরে সফল ও হয়। যাওয়ার সময় যেতে পারে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে বের হবার সময়। এবার আর সফল হয় না হুইল চেয়ার উঠে বসতে। হুইল চেয়ার এক সাইডে বাকা হয়ে যায়। খুব জোড়ে টাইলস এর উপরে যায়। হুইল চেয়ার উল্টে গায়ের ওপর পড়ে। নিচে পড়ার সময় হাত উল্টোভাবে পড়েছে। মনে হচ্ছে হাত ভেঙে গেছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। সহ্য করতে পারে না মিথিলা। গলা ফাটিয়ে চিতকার দেয়। চিতকারে মনে হচ্ছে পুরো বাড়ি কেপে উঠল। তুরাগ খেতে বসেছিল কেবল। খাবার ছেড়ে উঠে হাত না ধুয়েই দৌড় লাগায় দোতলার উদ্দেশ্য। সবাইই এল প্রকার দৌড়ে উপরে আসে। কিন্তু রুমে এসে দেখে মিথিলা রুমে নেই। তাহলে গেল কোথায় মেয়েটা। নুরনাহার খেয়াল করে ওয়াশরুম এর ডোর ভেতর থেকে লক করা। সেখান থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে। অনেক ডাকার পরেও দরজা খুলতে পারে না মিথিলা। তুরাগ সবাইকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে ভেঙে ফেলে দরজা। ভেতরে ঢুকে দেখে হুইল চেয়ারটা মিথিলার গায়ের উপরে পড়ে আছে। সেটাকে টেনে তুলে আগে। দুহাতে পাজাকোলে তুলে নেয় তুরাগ। মিথিলার কান্না তখনো থামেনি। তায়েফ সাহেব ও তখন বাসায় ছিলেন। তিনি গিয়ে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি বের করলেন। তুরাগ মিথিলাকে নিয়ে পেছনে বসল। মিথিলার মা আর মোহনাও গেল সাথে। নুরনাহার বাড়ির সবটা সামলে পড়ে আসবেন তাই তিনি আসেন না।






রাত তখন বেশি হওয়ায় সব গুলো টেস্ট তখন করাতে পারে নি। ডাক্তার আরো অনেক গুলো টেস্ট করিয়ে নিতে বলেছে। তায়েফ সাইয়িদ এর অফিস খোলা রয়েছে। তার সেখানে যেতেই হবে। এখন হসপিটালে মিথিলাকে টেস্ট করদনোর জন্য কে থাকবে। আজ নির্বাচন। তুরাগকে তো সেখানেই থাকতে হবে। তায়েফ সাহেব আদেশ করে গেল তুরাগ যেন মিথিলাকে টেস্ট করানোর জন্য নিয়ে যায়। আজ যদি ও মিথিলাকে একা রেখে চলে যায় তাহলে বিয়ে ক্যান সেল। যদি বিপদের সময়েই পাশে থাকতে না পারে তাহলে আর থাকার দরকার নেই। ঘরে ঢোকাও বন্ধ। এমনিতেও এই রাজনীতিতে আসা নিয়ে বাপ ছেলের যুদ্ধ লেগেই আছে। এখন আবার পেয়েছে সুযোগ।

তুরাগ পড়ে যায় মহা মুশকিলে। নির্বাচন কেন্দ্রে না যেতে পারলেও ঝামেলা। সেখানে কি হয় না হয় কে জানে। এই বাবাকে নিয়েও আর পারা গেল না। তায়েফ সাহেব এরকম কথা ইচ্ছে করেই বলেছেন। কারণ তিনি হচ্ছেন শান্ত স্বভাবের মানুষ। কোন রকম ঝামেলায় তিনি জড়াতে চান না। তিনি চান তার ছেলেও যেন এসব থেকে দূরে থাকে। তার অবাধ্য ছেলেকে তিনি কখনোই কথা শোনাতে পারেনি। নিজের ইচ্ছে মতোই করেছে। এই রাজনীতিতে যোগ দেয়াটাও নিজের জেদ এর বশেই করা। তাই আজ সুযোগ বুঝে মিথিলাকে এর মধ্যে টেনেছেন৷ মিথিলার জন্য তার ছেলে কতটা পাগল এটা সবাই ই জানে। তাই তো এই ট্রিকস খাটালেন। কাজেও লাগল তার ট্রিকস। তুরাগ প্রান্তকে ফোন করে জানালো দুপুরের আগে ও আসতে পারবে না। ততক্ষণ যেন ওদিক সামলে রাখে। প্রান্ত প্রথমে জোর করছিল তুরাগকে নেয়ার জন্য। তুরাগ সাথে থাকা মানেই একটা ভরসা। কিন্তু এখন যখন তুরাগ একবার বলেছে দুপুরের দিকে আসবে তাহলে তখনই আসবে। একে জোড় করে লাভ নেই। তুরাগ আসবে না শুনে কালাম মোল্লার মুখখানাও ফ্যাকাসে আকার ধারণ করল। এই ছেলেটা তার পাশে থাকলে তার শক্তি মনে হয় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।



সাড়ে বারোটার মতো বাঝে। ল্যাব থেকে রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে বের হচ্ছে তুরাগ। এগুলো নুরনাহার এর কাছে দিয়ে তুরাগ কেন্দ্রে যাবে। নুরনাহার ই রিপোর্ট গুলো ডাক্তারকে দেখিয়ে ঔষধ গুলো নিতে পারবে। এগুলো ভাবতে ভাবতেই হাটছিল তুরাগ। এমন সময় ফোন বেঝে ওঠে। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে। ফোনস্ক্রিন এ প্রান্ত নামটা তখন জ্বলজ্বল করছে। কাল বিলম্ব না করে ফোন রিসিভ করে তুরাগ। অপর পাশ থেকে প্রান্তর হাপিয়ে যাওয়া কন্ঠে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়া অনুমান করতে পারে। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ ড্রাম পেটাচ্ছে। উপরওয়ালাকে স্মরণ করে তুরাগ। দোয়া করে যেন খারাপ কিছু না হয়। ততক্ষণেও ওপাশ থেকে প্রান্তর কোন কথা শোনা যায় না। ঘাবড়ায় তুরাগ। আস্তে আস্তে ডাকে প্রান্তকে। প্রান্ত কিছু বলতে পারছে না। জোড়ে শ্বাস টানতে টানতে শুধু বলে

– ভাই হসপিটালেই থাকেন। আসতেছি ওখানে। ঝামেলা হয়ে গেছে।

– কি হয়েছে। এই প্রান্ত। প্রান্ত।

-……..

– কথা বলছিস না কেন।

– কালাম ভাই এর মাথায় কো’প লাগছে। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে ভাই।

কেদে ফেলে প্রান্ত।

হাত কাপতে থাকে তুরাগ এর। হাত থেকে ফোনটূ পড়ে যায়। ও তো এরকম কিছুরই ভয় পাচ্ছিল। ভয়টা তাহলে সত্যিই হলো। রাগে শরীর কাপতেছে এখন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এতো কড়া পাহাড়া থাকার পরেও এরকম কিছু হতে পারে। কল্পনাতীত বিষয়। এরকম কাজ কে করতে পারে তা বুঝতে একটুও সময় লাগে না তুরাগ এর। ফোনটা ফ্লোর থেকে তোলে। সুইচড অফ হয়ে গেছে। পাওয়ার বাটনে প্রেস করে ধরে রাখে কিছি সময়। ফোন ওপেন হয়। রিসেন্ট কল লিস্ট থেকে প্রান্তর নাম্বার টা নিয়ে আবার ডায়াল করে সেই নাম্বারে। রিং হতে হতে কে’টে যায় ফোন। আবারও ফোন দেয়। এবারও রিসিভ হয় না। মা’রামা’রি তাহলে গুরুতরই হয়েছে। এবার কন্টাক্ট লিস্ট থেকে ইমননএর নাম্বার বের করে। ডায়াল করে সেই নাম্বারে। রিং হওয়ার কয়েক সেকেন্ড এর মাথায়ই রিসিভ হয় ফোন। আর কোন কথা বলেই সরাসরি জিজ্ঞেস করে

– কে করেছে?

– ভাই শান্ত হন।

– আমি জানতে চাচ্ছি কে করেছে।

– চৌধুরীর লোকেরা৷

– পরপর দুইবার হইয়াও খায়েশ মেটে নাই ওনার। যেই দেখছে জনগন এদিকে ঝুকছে অমনি এখন গায়ে আঘাত করার প্লান করছে।

ইমন তুরাগকে শান্ত হতে বলে। বোঝায় যে আগে কালাম মোল্লা ঠিক হোক। এরপর তিনি যা বলবেন তাই হবে।

তুরাগ আর কিছু না বলে ফোন কে’টে দেয়। রিপোর্ট গুলো নিয়ে দৌড়ে মিথিলার কেবিন এর দিকে যায়। নুরনাহার এর হাতে রিপোর্ট গুলো দিয়ে দৌড়ে আবার চলে আসে। নুরনাহার রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলের যাওয়ার দিকে। তিনি তুরাগকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন৷ কিন্তু সেটা আর বলা হলো না। ডাকও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তুরাগ বলছে এসে কথা বলব। এখন সময় নেই। প্রতিটা টিভি চ্যানেল এ একই নিউজ ঘুরতেছে। নির্বাচন কেন্দ্রে মা’রামা’রির ফলে গুরুতর আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি মেয়র পদপ্রার্থী কালাম মোল্লা। তুরাগ এর এখন রাগে মাথার রগ মনে হচ্ছে ছিড়ে যাচ্ছে। টিভি গুলা ভেঙে ফেলতে মন চাচ্ছে। আফসোস হচ্ছে সকাল বেলায়ই কেন গেল না সেজন্য। ভোট এখনো চলতেছে। কে জয়ী হবে বলা মুশকিল। সিটি হসপিটালেই আনা হয়েছে কালাম সাহেবকে। তুরাগ হাজির হয় সেখানে। ততক্ষণে মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেছে তার। তার সাথে কথা বলতে আসে তুরাগ।

– ভাই স্যরি।

– আরো পাশে আয় বেটা। স্যরি কেন বলছিস।

– আপনার বিপদের সময় আপনার পাশে থাকতে পারলাম না।

– যা হওয়ার তা হয়েছে। এখন দেখ কেন্দ্রের কি অবস্থা। আমিও একটু পর যাবো দেখি কি না কি হয়।

– শান্ত হন ভাই। জনগন আপনার পক্ষে আছে। চিন্তা করবেন না। কিন্তু এই কাজটা কে করল ভাই। একবার নাম কন। ওরে মাটির তলে পুইতা ফালামু একবারে।

কালাম মোল্লা পিঠে হাত রাখেন তুরাগ এর। তুরাগকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন তিনি। তুরাগ ও যে তাকে কম শ্রদ্বা করে না এটা তো জানা কথাই। তিনি তুরাগকে বলেন

– শান্ত হ ভাই। শোন এই জগতে টিকে থাকা এত সহজ না। মেজাজ গরম করে কিছু করা ঠিক না। রগচটা মানুষ নেতা হতে পারে না।

– ভাই কেডায় করছে আপনি নামটা বলেন। ওটে কিছু বলব না। খালি নামটা শুনি।

– রাশেদ চৌধুরীর ছোট ভাই।

– ওয় এত বড় সাহস কেমনে পাইলো ভাই। ওরে তো আমি ছাড়ব না।

– শান্ত হ।

কে শোনে কার কথা। মেজাজ গরম হয়ে গেছে তুরাগ এর। হনহন করে বেড়িয়ে যায় হসপিটাল থেকে।



ডক্টর এসে রিপোর্ট গুলো দেখে গেছে। হাতের দুটো হাড়ের একটা আরেকটার উপর উঠে গেছে। কিছুটা ফাটল ও ধরেছে। ব্যান্ডেজ করে দিশেছে তার। এছাড়া আর কোন ইন্টার্নাল ইনজুরি হয় নি৷ তাই চাইলে আজকেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবে মিথিলাকে।

ড. যেহেতু পারমিশন দিয়ে দিয়েছে তাহলে এখানে কষ্ট করে থেকে কী লাভ। এর থেকে বাসায় নিয়ে গেলে এক্সট্রা কেয়ার করার সুযোগ পাবে। তাই নুরনাহার ঠিক করে এখনই বাসায় চলে যাবে। ড্রাইভারকে আগেই ফোন দিয়েছিল। তিনি নিচে এসে অপেক্ষা করতেছে। নুরনাহার, মিথিলা, মোহনা, ওদের মা আর ড্রাইভার সহ পাচজন ছিল গাড়িতে।

গাড়ির মধ্যে সবাই মুলত আজকের নির্বাচন নিয়েই আলোচনা করতে ছিল। এমন সময় ড্রাইভার হঠাৎ করে ব্রেক কষায় সামনের দিকে ঝুকে যায় সবাই। মাথা তুলে সামনে যা দেখে তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। মালবাহী একটা বড় ট্রাক রং রুটে খুব স্পিডে চালিয়ে আসতেছে। সামনে গাড়ি দেখেও স্পিড না কমিয়ে বরং আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গাড়ির ভেতরে থাকা পাচজনই নিজের চোখের সামনে নিজেদের ভয়ঙ্কর ভবিষ্যত ভেসে ওঠে। মুহুর্তের মাঝেই রাস্তা থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে গাড়ি। কি ভয়ানক অবস্থা সেখানে।

#চলবে