ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব-২৪+২৫

0
216

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২৪

আম্মু এই আম্মু কথা বলতেছো না কেন৷ চোখ খোলো আম্মু। আম্মু তুমি কি রাগ করে আছো আম্মু। এই আম্মু আমি আর কোন অন্যায় করব না আম্মু। তুমি যা বলবা সব শুনব। আর রাত করে বাসায় ফিরব না আম্মু। তোমারে ছাড়া আর এক বেলাও খাবার খাব না প্রমিজ আম্মু। একটা বার ফিরে এসো না আম্মু প্লিজ।

করুণ কন্ঠে আর্তনাদ করছিল হসপিটালের করিডোরে বসে। র’ক্তে মাখানো মায়ের মুখশ্রীতে হাত বেলাচ্ছে আর পা’গলের মতো চুমু খাচ্ছে। আশপাশে থাকা ড. নার্সরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে আর্তনাদ দেখছে। একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন তায়েফ সাইয়িদ। আশপাশের মানুষ জন সান্ত্বনা না দিয়ে ভিডিও করছে। সিঙ্গার তুরাগ সাইয়্যিদ তার মায়ের মৃ’ত দেহের সামনে বসে আর্তনাদ করছে এরকম ভিডিও ব্লগ হিসেবে ছাড়বে না তা কি করে হয়। এখন মানুষ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসার আগে ব্যাস্ত থাকে কখন ছবি তুলবে কখন ভিডিও করবে তা নিয়ে৷

মাকে ছেড়ে উঠে দাড়ায় তুরাগ। পাশাপাশি তিনটা লা’শ শোয়ানো। দ্বিতীয় লা’শটার মুখের দিকে তাকায়। মোহনার থেতলানো মুখ দেখে আতকে ওঠে তুরাগ। আর দেখার সাহস হয় না। কাপড় টেনে ঢেকে দেয় মুখ। পরের জন ছিল ড্রাইভার। সবাইকে পাশ উঠে পা’গলের মতো দৌড়ে আবার অপারেশন থিয়েটার এর সামনে যায়। মাস্ক খুলতে খুলতে ড. বেরুচ্ছে সেখান থেকে। হামলে পড়ে তুরাগ ড. এর উপর।

– ড. পেসেন্ট এর কি অবস্থা। ও সুস্থ আছে তো ড.।

-……..

– কথা বলছেন না কেন ড.। কি হয়েছে বলুন না।

– আ’ম স্যরি মি. সাইয়্যিদ।

ড. এর মুখে স্যরি শব্দটা শুনে মাথা ফাকা হয়ে গেল তুরাগ এর। ওদিকে মায়ের লা’শ পড়ে আছে। এদিকে মিথিলার ক্ষীণ আশা জেগে ছিল। ড. এর মুখে স্যরি শব্দ শুনে সেই আশাটুকুও যেন নিভে গেল। হাটু৷ ভেঙে সেখানেই বসে পড়ল তুরাগ। তখন কাধে হাত রাখল ড.। আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকালো তুরাগ।

– সে মা’রা যায় নি। তবে-

বসা থেকে এক লাফে উঠে দাড়ায় তুরাগ৷ ব্যাস্ত কন্ঠে জানতে চায়

– কি বললেন ড.। তবে কি, কি হয়েছে বলুন না

– আসলে

– ড. প্লিজ।

– তিনি কোমায় চলে গেছেন। এটা থেকে তিনি কবে আবার সুস্থ লাইফে ফিরে আসতে পারবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর বয়স্ক যেই নারী ছিল তিনিও গুরুতর আহত৷ তবে তিনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন আশা করা যায়।

ড. চলে যায় সেখান থেকে। সেখানেই হাটুগেরে বসে পড়ে তুরাগ৷ চিতকার করে কাধতে থাকে। মানুষ বলে ছেলেদের নাকি কাদতে নেই। কে বলেছে। ছেলেদের ও মন বলে কিছু আছে। তাদের ও কষ্ট হয়। এরকম একটা মুহুর্তে নিজেকে কি করে সামলাবে তুরাগ। গলা ফাটিয়ে চিতকার করে কাদছিল সেখানে বসেই। তুরাগ এর বাবাও বাকহারা হয়ে আছেন। তিনি কোন কথাই বলছেন না। তুরফাকে এখনো জানান নি। এরকম একটা কথা তো মেয়েটাকে বলার সাহস নেই তার। কয়দিন আগেই এসে গেল। এখন হুট করে বাসায় আসতে বললেই মেয়েটা বুঝে যাবে। এত দূরের পথ। কি করে আসবে মেয়েটা একা একা।

হঠাৎ পেছন থেকে কাধে কেউ হাত রাখায় গোটানো হাতের শার্টে নিজের চোখ মুছে পেছনে মুখ ঘুরায় তুরাগ। পেছনে কালাম মেল্লা, প্রান্তসহ আর বাকি সবাইকে দেখে উঠে দাড়ায় তুরাগ। কালাম মোল্লা বুকে টেনে নেয় তুরাগকে। সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে।

– ভাই আপনার মাথার ব্যাথা

– আমি ঠিক আছি। একটা খবর দেয়ার ছিল। যদিও এই মুহুর্তটায় কি বলব তোমাকে।

– আমরা হেরে গেছি ভাই।

কালাম মোল্লা মাথা নেড়ে না বোঝায়। কান্না থামে তুরাগ এর। জড়িয়ে ধরে আবারও কালাম মেল্লাকে। এরকম একটা পরিস্থিতি না হলে আজকের দিনটা হতে পারত অন্যরকম একটা খুশির দিন। এই নির্বাচন এর জন্য কত কষ্ট করেছে। আজ দেখো দলের সবাই উদযাপন বাদ দিয়ে তুরাগকে সান্ত্বনা দিতে হসপিটালে ছুটে এসেছে। প্রান্ত এগিয়ে আসে সামনে। বুকে জড়িয়ে ধরে তুরাগকে।

– প্রান্ত এরকমটা কেন হলো আমার সাথে। আমি মনে হয় বড় কোন পাপ করেছি। যার কারণে আমাকে এত বড় শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমি তো মাকেও কষ্ট দিয়েছি। মা কি আমাকে ক্ষমা করবে প্রান্ত। কি করব এখন আমি।

– শান্ত হ ভাই। আন্টি তোকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে। সন্তানরা কতো ভুল করে। কিন্তু মা বাবারা কি সেই ভুল ধরে বসে থাকে বল। মা বাবারা কখনো সন্তান এর উপর রাগ করে থাকতে পারে না। তুই এখন আন্টির জন্য দোয়া কর। উপরওয়ালা যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।

– —-

– দেখ ভাই ভোটের ফলাফল শোনার পরেই এখানে চলে এসেছে। কথা বলবি না তার সাথে।

– আহা প্রান্ত কি করছো। ওর সিচুয়েশনটা বোঝো। কাদুক। কাধতে দাও। কান্না করলে মন হালকা হয়৷

– তুরাগ তুরফাকে বলবি না।

– আমি বলতে পারব না। তুই একটু ওরে আনার ব্যাবস্থা কর না।

– হুম।

কালাম মোল্লা জিগেস করেন

– আচ্ছা তখন হসপিটাল থেকে বের হওয়ার পর কি হয়েছিল বলোতো। ফোন দিয়ে পেলাম না যে।

ফ্লাসব্যাক –

দুপুরে হসপিটাল থেকে রে’গে বেরিয়ে গেলেও বাহিরে এসে মাথায় কাজ করল যে না এই মুহুর্তে নিজেকে শান্ত করা জরুরি। নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালালেন। ভাই অসুস্থ এখন যদি সেও ঝামেলা করে তাহলে এদিক দেখবে কে। তাই চলে এলো কেন্দ্রে। সারাদিন এ কেন্দ্র থেকে ও কেন্দ্রসা দৌড়াদৌড়ি করে পাচটার দিকে ফ্রি হলো। এরপর ভোট গননার পালা। তুরাগ ভেবেছিল এখন একটু বসে নিবে। সেই মুহুর্তেই পকেটে থাকা ফোনটা বাজখাই শব্দে বে’ঝে ওঠে। এই মুহুর্তে ফোন আসায় বিরক্ত হলেও ফোন বের করে ফোন রিসিভ করলো। ওপর পাশ থেকে জানালো যে হসপিটাল থেকে ফোন করেছে। হসপিটাল থেকে ফোন শুনেই বসা থেকে উঠে দাড়ায় তুরাগ৷ মিথিলা হসপিটালে তাই মনে করেছিল মিথিলার কিছু হয়েছে। কিন্তু হসপিটাল থেকে জানালো তাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। সবার অবস্থা গুরুতর৷ সেই মুহুর্তে সেই অবস্থায় ছুটে বেরিয়ে আসে তুরাগ। প্রান্ত সাথে আসতে চাচ্ছিল। কিন্তু তুরাগ না করে দেয়। এখানে থাকতে বলে। দিগ বিদিক শুন্য হয়ে ছুটে এসেছিল হসপিটালে। এখানে আসতে আসতে হসপিটাল এর সামনে বসেই শুনতে পায় একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট এ নাকি তিনজনই স্পট ডে’ড। দুজন এখনো আছে তবে গুরুতর আহত। সব মানুষজন ঠেলেঠুলে দৌড়ে হসপিটাল এর ভেতরে আাসে তুরাগ। সামনেই বাবাকে বসে থাাকতে দেখে। গিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে। জবাব দেয় না তিনি। এক ধ্যানে স্ট্রেচারে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা লা’শের দিকে তাকিয়ে আছে তিনি। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তুরাগ। ধীর গতিতে পা ফেলে সেখানে যায় তুরাগ। কাপা কাপা হাতে মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে যখন মায়ের মুখখানা দেখে তখনি মা বলে জোরে এক চিতকার দেয়। এরকম একটা সিচুয়েশনে পা’গলপ্রায় অবস্থা তুরাগ এর।

ফ্লাসব্যাক শেষ

তুরাগ এই মুহুর্তে একদম দুর্বল হয়ে গেছে। একদিকে মায়ের চলে যাওয়া। ভালোবাসার মানুষটা কোমায়। মোহনা মেয়েটাকেও ছোট বোনের মতো ভালোবাসত৷ তার নিথর দেহটাও হসপিটালের করিডোরে পড়ে আছে। কি করবে না করবে কিছুই বুজতে পারতেছে না। প্রান্তরা সহ বাকি সবাই মিলে হসপিটালের ফরমালিটিজ গুলো সম্পন্ন করে নিয়ে আসে তাদের। মিথিলা আর মিথিলার মা হসপিটালেই রইল।

মোহনার ভাগ্যটা কত অদ্ভুত তাই না। এতদিন যাবত নিজের বড় বোনের সেবা করে গেল। কোথায় বড় বোনকে নিয়ে সব সময় চিন্তা করত কি হবে না হবে তা নিয়ে। আজ সব চিন্তাকে অবসর দিয়ে নিজেই চিরবিদায় নিল। শেষ সময়টাতে তার কোন আপনজন তাকে একনজর দেখার সুযোগ পেল না। এরকম ভয়’ঙ্ক’র ভাগ্য কারো না হোক৷




নুরনাহার চলে যাওয়ার আজ পাঁচ দিন গত হয়েছে। তুরাগদের সমস্ত পরিবার যেন এখনো নিশ্চুপ হয়ে আছে। তুরফা এসেছিল পরদিন সকালে। কিন্তু মেয়েটা ইন্ট্রেভার্ট স্বভাবের। নিজের অনুভুতি গুলো যে কারো সামনে প্রকাশ করবে তাও পারে না। সেও তার বাবার মতো বাকহারা হয়ে চুপচাপ হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে ঘুমড়ে ম’রছে কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করছে না। তহমিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে আমার মা তো আমাকে একবারও বলল না মামিমা। তাহলে তো জীবনেও মাকে ছেড়ে যেতাম না। আমাকে না বলে গেল কেন মা। আমি কাকে মা বলে ডাকব মামিমা।

মায়ের দাফন শেষ হওয়ার পর আবার হসপিটাল এসেছিল তুরাগ। পা’গল পা’গল অবস্থা হয়ে গেছে। এখন আর বাসায় ফেরেনা। খাওয়া দাওয়াও ঠিকঠাক করে না। কেউ বাসায় নিতে চাইলেও বলে

– আমি বাসায় কার কাছে যাবো। কি করব গিয়ে। আমি মা বলে কাকে ডাকব। যাবো না আমি ও বাসায়। কোনদিন যাবো না। কেউ জোড় করেও নিতে পারে না। সবাই এসে দেখে যায়। তহমিনা এসে খাবার খাওয়াইয়া যায়।

তরুর দাদি থেমে থেমে মেয়ের জন্য কান্না করেই যাচ্ছেন। একজন মায়ের সামনে তার সন্তান এর চলে যাওয়া দেখাটা কতটা কষ্টের তা কেবল একজন মা ই জানে যে তার সন্তান হারিয়েছে।

যেই সংসার নুরনাহার সামলাতো আজ তা তহমিনা দেখতেছে। কিন্তু কতদিন। তাকেও তো ফিরে যেতে হবে। এসব ফেলে কীভাবে যাবে সে।

মিথিলার মা এখনো হসপিটালে ভর্তি। তাকে এখনো মোহনার কথা বলা হয় নি। তিনি নিজেই তো অসুস্থ। তারউপর তার দুই মেয়ের আজ এমন দশা। এত শক তিনি নিতে পারবেন না। তাকে কীভাবে বলবে এটাই ভেবে পাচ্ছে না কেউ।

#চলবে

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২৫

ওই তুরাগ এর বাচ্চা আজকেও বাসায় আসে নাই আম্মু?

তরুর মুখে এরকম কথা শুনে চোখ মুখ কুচকে মেয়ের দিকে তাকালেন তহমিনা। দেখলেন তার মেয়ে ভীষণ রেগে আছে। তরুর রেগে যাওয়ার কারণ খুজে পেল না তহমিনা। তবুও ধমকের সুরে বললেন

– এসব কি কথা তরু। তুরাগ তোমার কত বড় সে খেয়াল কি হারিয়েছো। বড়দের এভাবে বলতে হয় না জানো না তুমি।

– রাগ হচ্ছে আম্মু আমার। আচ্ছা তুরাগ ভাই কি পাগল হয়ে গেছে। সে মিথিলা আপুকে ভালোবাসে সেটা কি ঠিক আছে। কিন্তু বাসায় যে তার একটা ছোট বোন আছে সে খেয়াল কি নেই। তার কি উচিত ছিল না এই মুহুর্তে বাবা বোনের পাশে থাকার।

উপর থেকে নিচে নামতে নামতে সব কথাই তায়েফ সাইয়িদ এর কর্নকুহরে প্রবেশ করল। মুখ গম্ভীর করে দাড়িয়ে আছেন তিনি। তখনি তহমিনার নজর পড়ল তার উপরে। তরুর কথা গুলো যে মোটেও ভুল নয়। তুরাগ এর এই অতিরিক্ত বাড়াবাড়িটা তারও পছন্দ নয়। কিন্তু তায়েফ সাহেব তরুর মুখে এগুলো শুনুক সেটা চাইলো না তহমিনা। তরুর মুখ তখন উল্টোদিকে ঘোরানো। ও এখনো তায়েফ সাহেবকে দেখেন নি। তহমিনা আড়ালে মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। ইশারায় বোঝালেন থামার জন্য। তরু আরো উল্টো রিয়াকশন করে। বলে ওঠে

– তুমি আমাকে থামতে বলছো কেন। আমি ভুল কি বলেছি বলো। তুরফা আপুকে দেখেছো তুমি। মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। ফুপাও তো কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আর তোমার ভাগিনা এখনো গার্লফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড করে। সেখানে তো নার্সরা আছেই। মাঝে মাঝে কি বাসায় আসা যায় না। আর তোমরাই বা এখন কতজনকে নিয়ে টেনশন করবা বলো তো।

তহমিনা যে এই মুহুর্তে বিবর্তকর পরিস্থিতিতে পড়েছে তা খেয়াল করল তায়েফ সাইয়িদ। তিনি তহমিনার উদ্দেশ্য বললেন

– আরে তহমিনা তুমি মেয়েটার সাথে এমন করতেছো কেন। ও তো ভুল কিছু বলে নি। যে ছেলে মা বেচে থাকতেই তার গুরুত্ব বোঝেনি এখন আর কি বুঝবে। এই মেয়েকে তো ওর মার শুরু থেকেই পছন্দ ছিল না। কিন্তু ওর জেদের কাছে হেরে গিয়ে এই মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলো। ওকে নিষেধ করেছি পলিটিক্স এ জড়াতে। শুনল না আমার কথা। আমার বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতিতে জড়ালো। কি হলো শেষ পর্যন্ত। আমাদের সংসারটা এলোমেলো হয়ে হয়ে গেল।

– থাক না ভাইজান। বাদ দেন ওর কথা। সময় গেলে ধীরে ধীরে বুঝবে সব।

– নাহ তহমিনা তুমি বুঝতেছো না। এখন আমার সংসারটা কে দেখবে বলো। নুরিতো আমাকে একা ফেলে চলে গেলো। তুরফাকেও তো যেতে হবে। আর ওই মেয়ে কবে সুস্থ হবে তার কোন গ্যারান্টি তো ডক্টরও দিতে পারছে না। যে মেয়ের জন্য আমাদের ফ্যামিলিটা ধ্বংস হলো সেই মেয়েকে তো আমি জীবনেও আমার বাড়ির পুত্রবধু করে আনব না।

– কেন আনবে না বাবা। মেয়েটার জীবনটা কি তোমার ছেলের জন্য নষ্ট হয় নাই। ওদের তো পুরো ফ্যামিলি শেষ হয়ে গেল।

সবাই পেছনে ঘুরে দেখলো সেখানে তুরফা দাড়িয়ে আছে। কিন্তু এই মুহুর্তে তুরফার কথা গুলো শুনেও মেজাজ খারাপ হলো তায়েফ সাইয়িদ এর। তিনি রেগে গেলেন মেয়ের উপর। বললেন

– তুরফা আমার উপর কথা বলো না। ওই মেয়ে যদি সুস্থ ও হয় তবুও ওকে আমি ওই বাসার বউ করব না৷ ও একটা কুফা মেয়ে। ও তুরাগ এর জীবনে আসার পরেই সব এলোমেলো হয়ে গেছে।

– তাহলে তো তোমার ছেলেও সেটাই বাবা৷ তোমার ছেলে মিথির জীবনে আসার পরেই ওর জীবন, ওদের ফ্যামিলি এলোমেলো হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে ওদের। এখন ওর দায়িত্ব ভাইয়াই নিবে।

– তোমরা দু ভাই বোন যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলছো তবে আমাকে আর কি দরকার। আমার মনে হচ্ছে আমাকে তোমাদের লাইফে এখন আর কোন দরকার নেই। বড় হয়ে গেছো তোমরা। তুমি আর তোমার ভাই যা মন চায় করো। আমাকে আর জানাতে আসবে না৷ তোমরা যদি ঠিক করেই থাকো ওই মেয়েকে বউ করবে তাহলে সেদিন আমি নুরির কাছে চলে যাবো। তোমরা আমার লা’শের উপর দিয়ে উল্লাস করে বউ এনো।

নাস্তার প্লেট ঠেলে দিয়ে দুম করে উঠে দাড়ালেন তায়েফ সাহেব। হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন বাড়ির বাহিরে।

বাবার এরকম কথা শুনে বুক ফেটে কান্না আসল তুরফার। যেই বাবা কোনদিন বকা তো দূর টুশব্দও করে নি। সেই বাবা আজ এতগুলো কথা শোনালো। আবার হুমকি ও দিয়ে গেল।

যে বাবা কোনদিন বকা না দেয় সে যদি হুট করে একটু ধমক ও দেয় তখন কিন্তু ভীষণ কষ্ট লাগে। আর তুরফার বাবা তো আজ অনেক কথা শোনালো। তুরফা সেখানে মেঝেতেই বসে পড়ে। এতক্ষণ নিরব দর্শক হয়ে সবটা অবলোকন করছিলেন তহমিনা আর তরু। এখন মেঝেতে বসে তুরফাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে দেখে দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন

– কাদিস না মা শান্ত হ। তোর বাবা মন থেকে এসব বলেনি।

– কিন্তু এমন কেন বলল মামি

– আপা চলে যাওয়ায় তোরা কষ্ট পাচ্ছিস। ওই মানুষটা কি পাচ্ছে না বল। আটাশ বছরের পথ চলা একসাথে। আটাশ বছরের সঙ্গীকে হারিয়ে এখন তার মাথা কি ঠিক আছে বল। তোর মামার কাছে শুনেছি শুরুর দিকে তোর বাবা নাকি তোর মা বলতে পা’গল ছিল। সেই মানুষকে হারিয়ে এখন তোর বাবাও দিকবিদিকশুন্য তাই না।

– কিন্তু ভাই কি করছে মামি। মিথিলাই বা কি দোষ করেছে। এখানে ও তো সবথেকে বেশি সাফার করতেছে।

– তুই এখন বসে দোষ খুজছিস পাগলি মেয়ে। শোন এটা কারো দোষ নয়। এটা হচ্ছে নিয়তি। এরকম একটা দূর্ঘটনা নিয়তিতে ছিল বলেই হয়েছে। তবে তোর বাবা এখন মনে করছে যদি মিথিলাকে নিয়ে হাসপাতালে না যেত তাহলে এমন দূর্ঘটনা হতো না। এই মুহুর্তে তার কাছে সব থেকে দোষী মিথিলাকে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি মিথিলার দোষ দিচ্ছি না৷ ওই যে বললাম নিয়তি। তবে এই মুহুর্তে তুরাগ এর উচিত ছিল না তোদের পাশে থাকা।

– এখন আমি কি করব মামি। আমার মাথা কাজ করতেছে না।

তাদের দুইজনের কথার মধ্যেই কোথা থেকে যেন তরু এসে ধপ করে সোফার মধ্যে বসে পড়ল। তুরফা তহমিনা দুজনের দৃষ্টিই তখন তরুতে নিবদ্ধ। তরু করুন চোখে তহমিনার দিকে তাকিয়ে আছে।

– আম্মু

মেয়ের এমন করুন কন্ঠ শুনে হকচকাল তহমিনা। এই মেয়ের কিছুক্ষন পর পর কি হয় কে জানে। ব্যাস্ত কন্ঠে সুধাল

– কি হয়েছে?

– আমি কি ভুল করে ফেলেছি আম্মু।

– তুই আবার কি ভুল করলি।

– সকালে যে জোরে জোরে কথা গুলো বলে ফেললাম। না হলে তো ফুপাও শুনত না আর এত কথাও হতো না।

তহমিনাকে উত্তর দিতে না দিয়ে তুরফাই বলে উঠল

– তুমি ভুল করোনি তরু। এটা কারো না কারো বলার দরকার ছিল। দেখোনা ফ্যামিলি টার কি বিশৃঙ্খল অবস্থা। এটা তো ঠিক করা জরুরি। এখন ভাই আর বাবার মধ্যে আবার মনোমালিন্য হবে। আমার মনে হয় ভাইয়ের একবার বাসায় আসা উচিত। নয়ত পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।

– কিন্তু তুরফা আপু তোমার ঘাড়ত্যাড়া ভাই কি আসবে।

– আমি যাবো আজ হসপিটালে। মিথিলাকে আর আন্টিকেও দেখে আসব। আর ভাইয়াকে সাথে করে নিয়ে আসব।

– তাহলে আমিও যাই তোমার সাথে।

– যাবে তুমি?

– হুম।

– আচ্ছা। তাহলে একটু পরেই বের হবো আমরা। মামি তুমি যাবে আমাদের সাথে?

– আমি তো রাতেও গিয়ে আসলাম। শুনল না তো আমার কথা। দেখ তোরা গিয়ে। যদি আসে।





ভাইয়া তুমি সি’গা’রেট খাচ্ছো?

গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে সি’গারেট এর ধোঁয়া ওড়াচ্ছিল তুরাগ। ছোট বোন এর কন্ঠ শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে হাত থেকে ফেলে দিল আধ খাওয়া সিগারেটা। মুখ থেকে ধোঁয়া সরানোর ব্যার্থ চেষ্টা চালালো কিয়তক্ষন। এটা দেখে মুচকি হাসলো তুরফা। তার ভাই যে আড়ালে সিগারেট খায় এটা অজানা নয় ওর। তবে ওর সামনে কখনোই না। এই যে এখনও ওকে দেখে লুকাতে ব্যাস্ত।

নিরবতা কাটিয়ে তুরাগ ই বলল

– তুই এখানে কেন এসেছিস।

– আমার বুঝি আমার ভাইকে দেখতে মন চায় না। আমার ভাইয়ের আমাদের দেখতে মন নাই চাইতে পারে। কিন্তু আমাদের তো তাকে দেখতে মন চায়।

বোনের কন্ঠে তীব্র অভিমান লক্ষ্য করল তুরাগ। এতক্ষণে বোধহয় হুশ হলো তুরাগ এর। আসলেই ওর মাথা থেকে বোনের কথা বেড়িয়ে গিয়েছিল। এই মুহুর্তে কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিল তুরাগ৷

– আচ্ছা ভাইয়া আমরা যদি বলি মিথিলাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না তাহলে কি মায়ের মতো আমাদের ও দূরে সরিয়ে দেবে তুমি?

তুরফার কথায় আতকে ওঠে তুরাগ। তুরফার এরকম কথার মানে খুজে পায় না। তুরফা তো সব সময় চাইতো মিথিলা তুরাগ এর বউ হয়ে আসুক। তাহলে এই মুহুর্তে এমন কথা বলছে কেন। কাপা কাপা কন্ঠে জানতে চাইলো

– এসব কি কথা বলছিস পিচ্চি।

– আমি মোটেও পিচ্চি না। আমি যেটা বললাম তার উত্তর দাও।

– আমি মিথিলাকে ভালোবাসি।

– আচ্ছা। তাহলে তুমি তোমার মিথিলাকে নিয়েই থাকো৷ আমি বা আমার বাবা কাউকে তুমি দেখতে আসবে না।

– পাগলামি কেন করছিস বোন আমার। ওকে তো তুইও পছন্দ করিস।

– হুম করি। সব সময়ই করব। কিন্তু সেটা তোমার বউ হিসেবে নয়।

তরু তুরফার কানে কানে বলল

– এভাবে কেন বলছো তুরফা আপু। এভাবে বললে তুরাগ ভাই কখনোই বাসায় যাবে না। ফুপার সাথে কথা বলা উচিত এখন তার।

তুরফা তরুর কথা গুলো শুনে আরো জোরে জোরে বলল – ভাইয়া যদি আজ বাসায় না যায় তাহলে সমস্যা নেই। আমিই নাহয় ভুলে যাবো আমার একটা ভাই আছে। যে ভাই খারাপ সময় আমার পাশে থাকে না সেই ভাইয়ের জন্য আমি তো আর আমার বাবাকে হারাতে পারব না। মায়ের পরে এই বাবাই আছে আমার সব থেকে আপন।

তুরফার প্রত্যেকটা কথা মনে হচ্ছে কানে এসে বাড়ি খাচ্ছে। আতকে ওঠে তুরাগ। তুরফা তো এরকম কথা বলার মেয়ে নয়। কি হলো হঠাৎ ওর।

#চলবে