ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব-২৮+২৯

0
280

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২৮

দেখুন তুরাগ ভাই ফ্যামিলির সবাই যখন চাচ্ছে আপনি বিয়ে করুন তখন বিয়েটাতো আপনাকে করতেই হবে। আপনি চাইলেও উপেক্ষা করতে পারবেন না। যদি উপেক্ষা করতে চান ও তবে আপনার ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যেতে হবে। আর ফুপা এমনিতেও খুব রে’গে আছে। এই মুহুর্তে আপনি যদি তার বিরুদ্ধে যান সে আপনার উপর আরো রে’গে যাবে এবং ভীষণ কষ্ট ও পাবেন তিনি। তাকে কষ্ট দেয়াটাও আপনার ঠিক হবে না। এখন যদি আপনি ফুপার কথা ভেবেও রাজি হন তাহলেও আপনাকে বিয়ে করতে হবে। আর মিথিপুর অবস্থা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। তিনি যদি কোমা থেকে ফিরেও আসেন পুরোপুরি সুস্থ হবেন কিনা সন্দেহ আছে। এখন যদি আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করেন সে হয়ত মিথিপুকে মেনে নিবে না। মিথিপুর যত্ন করাটা সে স্বাভাবিক ভাবে নিবে না। সেই জায়গায় যদি আমাকে বউ হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে বিষয়টা অন্যরকম হবে। যেমন আমি মিথিলা আপুর যত্ন নিব। দায়িত্ব নিব তার মায়েরও।

একদমে কথাগুলো বলে থামল তরু। তুরাগ রেলিং এর উপর দুই হাতে ভর করে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। মনযোগ সহকারে শুনল তরুর কথাগুলো। তরু কথাগুলো শেষ করে উত্তর এর আশায় তুরাগ এর মুখপানে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় তুরাগ এর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। সে নিরব রইল কিছু সময়। ভাবল কিছু একটা। এরপর তরুর দিকে ঘুরে সোজা হয়ে দাড়ালো। হাতগুলো আড়াআড়ি ভাবে বুকের সাথে বেধে দাড়ালো। তাকালো তরুর চোখপানে। তরু তখনো এক নজরে তুরাগ এর দিকেই তাকানো ছিলো। তুরাগ তরুর দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিল তরু। তুরাগ কিছু একটা বলবে সেটা শোনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শান্ত কন্ঠে তুরাগ উল্টো প্রশ্ন করলো

– ভালোবাসো আমায়?

তুরাগ এর মুখ থেকে এরকম প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল তরু। তরু ভেবেছিল তুরাগ হয়ত বলবে আমি বিয়ে করব না। কিন্তু তরুর চিন্তা ভাবনা উল্টো করে দিয়ে এ কেমন প্রশ্ন করল। জিভ দিয়ে ঠোট ভেজালো। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলবে এর আগেই ফের তুরাগ এর গলার আওয়াজ

– মিথ্যা বলবে না।

যা বলতে চাচ্ছিল তা গলা অবধি এসেই আটকে গেল তরুর। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে গেল

– না বাসিনা।

– তবে?

– কি?

– আমাকে ভালোবাসো না তাহলে আমাকে বিয়ে করে আমার ভালোবাসার মানুষকে কেয়ার করবে আবার তার মায়ের যত্ন নিবে বিষয়টা একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

– আমি স্যাক্রিফাইস করতে চাইলে আপনার আপত্তি থাকার কারণ কি?

– আমি মিথির জায়গা কখনো কাউকে দিতে ওাটব না মিস তরুলতা। এই মুহুর্তে যা বলেছো তা ভুলে যাও।

– আমি মিথিপুর জায়গা কখনো চাইনি। আমি নিজের ভুলের জন্য গিল্টি ফিলিং থেকে রিলিজ পেতে চাচ্ছি। এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য আমিও কিছুটা দায়ী। তাদের এখানে আসার পেছনে আমারও অবধান ছিল। নিজেকে অপরাধী লাগছে। তাদের সেবা করে ভুলের মাশুল দিতে চাচ্ছি। বাকিটা আপনার ইচ্ছে। আমি জোর করতে পারি না আপনাকে।

চোখ ছোট ছোট করে তরুর দিকে তাকায় তুরাগ। এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো। কেউ নাকি নিজের লাইফ নিজে এভাবে নষ্ট করতে চায়। একটু আগেই বলল আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হবে এখন আবার বলছে জোর করব না। আসলে চাইছে টা কি ও।

– তুমি আসলে চাইছো টা কি শুনি?

– আমি তো জানালাম আপনাকে। নিজের ভেতরে প্রচন্ড অপরাধ বোধ কাজ করছে। কি করব না করব মাথায় কিছুই আসছে। মনে হলো তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছি। তাই জানালাম আপনাকে। এমনিতে আপনার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই হুহ। আপনার মেয়ে ফ্যানরা আপনার গা ঘেষে থাকতেই পারে কিন্তু এরকম মানুষের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

কথা বলে না তুরাগ। এই মেয়েকে তো ম্যাচিউর ভেবেছিল। এতো হাফ মেন্টাল। এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে। অন্য দিকে ঘুরে মুখে নেয় সিগারেট। তুরাগ এর কথা বলার অনীহা নজর এড়ায় না তরুর। এখন নিজের মাথায়ই নিজের চাপড়াতে মন চাচ্ছে। কি দরকার ছিল এই লোকের সামনে ছেচড়ামি করার। এক পা দুপা করে ছাদের দরজার দিকে পেছাতে থাকে তরু। পিছন দিকে হেটেই ছাদের দরজা অবধি এসেছে। দরজা ক্রস করে যেই ঘুরছে সিড়িতে পা রাখার জন্য অমনি অন্ধকার থেকে এক জোড়া হাত তরুর বাম হাতে চেপে ধরে। ঘাবড়ায় তরু। এই মুহুর্তে কে আসতে পারে ছাঁদে। ভয়ে কাপা কাপা কন্ঠে জানতে চায়

– ক ক কে? কে?

– নিজের মাকেও ভুলে গেছো পাজি মেয়ে।

– ও ও আম্মু৷ তুমি এখানে কেন।

– দয়াশীল মানবী হয়ে গেছো তুমি। মায়ের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া শিখে গিয়েছো। রুমে চলো।

রুমে চলো কথাটা তরুর ভেতর অবধি নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। ছোট বেলা থেকেই জানে তহমিনা যেমন নরম মনের মানুষ তেমন প্রয়োজনে সেরকমই কঠোর। কিন্তু এই মুহুর্তে তহমিনা ছাদে কেন এসেছে এটাই মাথায় ঢুকছে না তরুর৷

তরুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে তহমিনা। এক প্রকার টানতে টানতেই সিড়ি থেকে নামিয়েছে তরুকে। তরু কোন কথা না বলে মায়ের পিছনে পিছনে যাচ্ছে।

নিচতলায় গেস্ট রুমেই থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে তহমিনাদের। তরুকে টানতে টানতে সেখানেই নিয়ে গেল। রুমের মধ্যে নিয়ে হাত ছেড়ে দিল। দরজাটা এক প্রকার জোড়ে ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিল। সিটকিনিটা উপরে তুলে দিয়ে আবারো তরুর হাত ধরে টেনে এনে খাটের পাশে বসাল। মোবাইল স্ক্রল করে কোনো একটা নিউজ দেখায় মত্ত ছিলেন নুরুল ইসলাম। হঠাৎ করে তহমিনার এরকম রনচন্ডী রুপ দেখে হাত থেকে ফোন রেখে দিলেন তিনি। ব্যাস্ত হলেন কি হয়েছে তা জানার জন্য। কি হয়েছে জানার জন্য তহমিনাকে প্রশ্ন করতেই ফোস করে শ্বাস ছাড়লেন তহমিনা। তরুর হাত এখনো তার হাতের মুঠোয়। তরু মাথা নিচু করে বসে আছে। নুরুল ইসলাম একবার স্ত্রী তো একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন।

– আপনার মেয়ে তো দিল দরদি হয়ে গেছে। সে বিষয়ে কোনো খেয়াল আছে আপনার?

তহমিনারর তেড়া কথায় কিছুটা ভড়কালো নুরুল ইসলাম। আসল ঘটনা জানার জন্য মন উসখুস করছে। তাই শান্ত স্বরে আবার প্রশ্ন করলেন

– কি করেছে ও?

– মিথিলার ফ্যামিলি এখানে আসুক সেটা তরুও চাইত প্রথম দিকে। এখন এই দূর্ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করছে। তাই সে তুরাগের কাছে গিয়েছিল কথা বলার জন্য। সে তুরাগের নামে মাত্র স্ত্রী হয়ে থাকবে। আর তুরাগ এর পাগলামির সাথে সাথে ও পাগলামি করবে।

– তুমি কীভাবে জানলে?

– তুরফার পা কে’টে গেল পরে তো নিচে নিয়ে আসল ও। তুরফাকে রুমে বসিয়ে দিয়ে আমাকে ব্যান্ডেজ করে দিতে বলে আপনার মেয়ে আবার তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে তাই আমিও গিয়েছিলাম ছাদে। ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। নয়ত জানতেই পারতাম না।

নুরুল ইসলাম কোন কথা শুনে চিন্তা ভাবনা না করেই ফট করে মেজাজ গরম করার মানুষ না। এই মুহুর্তে ও সেই গুনটা বজায় রাখলেন তিনি। তহমিনার মতো রে’গে জাননি মেয়ের উপরে। বরং শান্ত কন্ঠে জানতে চাইলেন

– মামনি তুমি কি তুরাগকে পছন্দ করো?

বাবার এরকম প্রশ্নের জবাবে কি উত্তর দিবে জানা নেই তরুর। তাই জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো। নুরুল ইসলাম ধূর্ত মানুষ। তাকে সব কিছু মুখে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তিনি মেয়েকে আবারো প্রশ্ন করলেন

– তোমার কি মনে হয় তুমি হ্যাপি থাকবে তুরাগ এর সাথে?

– আমি জানি না বাবা। তবে মিথিলা আপু অনেক ভালো একটা মেয়ে। সে তো এখানে আসতে চায় নি। এখানে তার কোনো দোষ নেই। তুরাগ ভাই অপরাধী। তার সাথে আমিও সমান অপরাধী। শাস্তি সে একা কেন পাবে তাই আমি এমন কথা বলেছি। আর কিছু না বাবা।

তহমিনার ভীষণ রাগ হচ্ছে মেয়ের প্রতি। মন চাচ্ছে গাল বরাবর ঠাটিয়ে একটা চ’ড় দিতে। জীবন কি ছেলেখেলা মনে হয় নাকি এই মেয়ের। তবে নুরুল ইসলাম যখন শান্ত হয়ে বসে আছে তার সামনে মেয়ের গায়ে হাত তোলাটা সমীচীন মনে হলো না। তাই দাতে দাত চেপে বলল

– আপনি কালকেই বাসের টিকেট কা’টবেন। আমি আর এখানে থাকব না। তরুকে নিয়ে চলে যাবো। আপনি আপনার মাকে নিয়ে কবে আসবেন তা আপনি জানেন।

নুরুল ইসলাম তহমিনার কথার জবাব না দিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্য বললেন

– তুমি রুমে যাও। তোমাকে এত বেশি চিন্তা করতে হবে না। তোমার বাবা মা এখনো আছে।

তরু আর কোন কথা না বলে খুব সাবধানে বেড ছেড়ে উঠে দাড়ালো। পা টিপে টিপে বেড়িয়ে গেল রুম ছেড়ে।

রুম থেকে বের হবার সময় পেছন থেকে তহমিনা ডেকে বললেন

– তোকে যেন আর তুরাগ এর আশ পাশেও না দেখি। ব্যাগ গুছিয়ে রাখবি। কালকেই ফিরব আমরা। ফাইনাল।

তরু কিছু না বলে মনে মনে আওড়ালো

– সবাই স্বার্থপর আম্মু। এতদিন আপার ছেলে মেয়েকে দেখা শোনার জন্য এখানে রয়ে গেলে। যেই নিজের স্বার্থে টান পড়ল অমনি চলে যাবে এখান থেকে।



সারারাত ঠিক ঠাক ঘুম হলো না তুরাগের। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই রাত ফুরিয়ে গেল। চোখে একটু ঘুম ঘুম আসছিল তখনি কানে ভেসে এলো আজানের মিষ্টি মধুর সুর। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল তুরাগ। উঠে ফ্রেশ হয়ে একবারে অজু শেষ করে বের হলো। ততক্ষণে আজান শেষ হয়েছে। ঠিক করল মসজিদে যাবে। তবে অনেক দিন ভোরে মসজিদে যাওয়া হয় না। তাই মন খচখচ করতে লাগল। হুট করে একদিন গেলে সেটা কেমন লাগবে এটা ভেবে যাব কি যাব না করতে করতে জামায়াত এর সময় শুরু হয়ে গেল। অবশেষে জায়নামাজ বিছিয়ে রুমেই নামাজের প্রস্তুতি নিল। নামাজ শেষ করে দুহাত তুলল উপরওয়ালার নিকট দোয়া প্রার্থনা করতে। নিজেকে এরকম পরিস্থিতি থেকে থেকে যেন উপরওয়ালা রক্ষা করেন।

নামাজ শেষ করে হাটতে বের হলো। বেশ অনেক সময় বাহিরেই কা’টল। বাসায় ফিরে দেখতে পেল ততক্ষণে সকালের নাস্তার জন্য সবাই টেবিলে উপস্থিত হয়েছে। সবাই যার যার মতো চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবার দিকে একবার একবার তাকিয়ে দেখল। দুটো চেয়ার ফাঁকা পরে আছে। তরু নেই খাবার টেবিলে। আর নানুও নেই। তরু আসেনি কেন সেটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস হয়ে উঠল না। তাই নুরুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো

– নানু কোথায় মামা?

খাবার রেখে একবার তুরাগ এর দিকে তাকালেন নুরুল ইসলাম। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন

– তোমার নানুর কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন তুমি নিজে গিয়ে জানো।

এরকম করে কথা বলার কোন মানে হয়। তার সাথে আর কথা না বলে তুরফাকে জিজ্ঞেস করলো

– এই তুরফা কি হয়েছে রে?

– নানু খাওয়া বন্ধ করেছে। তার কথায় তোমরা রাজি হওনি তাই। যতক্ষণ না শুনবে তার কথা সে খাবে না।

এরকম একটা সিরিয়াস মোমেন্টেও হাসি আসল তুরাগ এর। যদিও তার নানুর এরকম কাজে সে সন্তুষ্ট নয়। তবে তার নানু তার মতোই। না খেয়ে ধর্মঘট পালন শুরু করেছে এটা ভেবে হাসি আসল।

তুরাগ আর কাউকে কিছু না বলে নানুর রুমে গেল। সে খাটের উপর পা বিছিয়ে বসে খোলা জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তুরাগ বাহির থেকে অনুমতি চাইলো ভেতরে আসার। তারামন বিবি কথা না বলে অন্য দিকে মুখ ঘোরালো৷ তুরাগ তা দেখে মনে মনে বলে

” যেভাবেই হোক এই বুড়িরে আগে ঠিক করতে হবে। যদি কোন মতে না খেয়ে দেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে না সবাই আমাকেই চেপে ধরে। কাল যে কি হবে। সবাই এরকম কেন শুরু করছে”

#চলবে

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২৯

দেখো তোমার ইচ্ছেটাই বোধহয় পূরণ হলো। সেই বউ হয়ে এলে আমাদের বাসার। তবে এই সম্পর্ক কখনো পূর্নতা পাবে না। এটা শুধু কাগজের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এটা যেন বাহিরের কেউ ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। আমার মনে এক জনের বসবাস। আর সেটা আজীবন থাকবে। তাই ভূল করেও আমার উপরে স্ত্রীর অধিকার ফলাতে আসবে না। রাত অনেক হয়েছে হাত মুখে পানি দিয়ে এসে শুয়ে পড়ো।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল তুরাগ। মাথার ওপর টেনে দেওয়া শাড়ীর আচলটা টান দিয়ে ফেলে দিলো তরু। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল দম আটকে ছিল। তাই জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিল কয়েকবার। এরপর শান্ত হয়ে গুটিশুটি দিয়ে বসল বিছানার মাঝ বরাবর। এরপর চোখ বোলালো রুমের চারদিকে। এটা নাকি বাসর ঘর। এ ঘরে না আছে কোন ফুলের ছোয়া না আছে মরিচ বাতির সাজ৷ ঘরের মাঝে টিমটিম করে একটা নীল রঙের ডিমলাইট জ্বলতেছে। সেই আলোতেই রুমটা কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করল তরু। মুখের কোনে দেখা গেল তাচ্ছিল্য মূূলক হাসি। এটা কাউকে উপহাস করে নয়। বরং এরকম একটা বাসর ঘর দেখে। প্রতিটা মেয়েরই নিজের বিয়ে নিয়ে কিছু সপ্ন থাকে। যার কোনটাই সত্যি হলো না তরুর ক্ষেত্রে। দুইদিন আগে তুরাগকে বলা কথাগুলো মনে করে একদফা হাসল তরু। তখন তো খুব জোর দিয়ে তুরাগকে বলেছিল আমি আপনার স্ত্রী হতে নয় বরং মিথিপুর দায়িত্ব পালন করতে চাই। আর সেই কাগজের সম্পর্কটা সত্যি হয়ে যাওয়ার পরে এখন তুরাগের বলা তিক্ত কথাগুলো কেমন গায়ে কা’টার মতো লাগছে। নিজেকে এই মুহুর্তে সব থেকে বোকা মনে হচ্ছে। নিজের স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসুক এটা কোন মেয়েই চাইবে না আর ও কিনা সেধে সেধে সেই প্রস্তাব দিয়েছিল। রুমে জ্বলতে থাকা লাইটের আবছা আলোয় নিজের গায়ে জরানো শাড়ীটার দিকে তাকালো। নীল রঙের একটা শাড়ী। তবে নীল রঙের আলোর সাথে মিশে এখন আর শাড়ীর নিজস্ব রঙ বোঝা যাচ্ছে না। বিয়ের দিনেও গায়ে জড়িয়েছে ফুপির শাড়ী। তুরাগ চাইলেই কিন্তু একটা নতুন লাল বেনারসি কিনে দিতে পারত কিন্তু তা করেনি। বরঙ মায়ের আলমারি খুজে এই শাড়ীটা বের করে দিয়ে এসেছিল। এসব হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আওয়াজ কানে আসতেই মাথা তুলে সেদিকে তাকালো তরু। উদোম গায়ে শুধু একটা ট্রাউজার পরে বেরিয়ে আসছে তুরাগ। গলায় একটা টাওয়াল ঝোলানো। ফর্সা শরীরে পানির বিন্দু গুলো চিকচিক করছে। তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো তরু।

– এখনো খাটের মধ্যে বসে আছো। এতক্ষণে চেঞ্জ করতে পারতে না শাড়ীটা।

তুরাগের কথার প্রতিউত্তর না করে খাট থেকে নেমে দাড়ালো তরু। এ বাসায় আসার সময় যে ব্যাগে জামাকাপড় নিয়ে এসেছিল সেই ব্যাগটা এই রুমে দিয়ে গিয়েছে সুফিয়া খালা। তরু অন্য দিকে মুখ করেই হেটে হেটে সেই ব্যাগের কাছে গেল। ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের থ্রিপিস খুজে বের করল৷ সেটা নিয়ে তৎক্ষনাৎ ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল।

প্রায় মিনিট দশেক পরে ফ্রেশ হয়ে বের হলো তরু। কালো রঙের কাজ করা জামা। সাথে প্লাজু। ওড়নাটা গলায় ঝুলানো। একদম সিম্পল রুপ। ওয়াশরুম এর দরজায় থাকতেই তরুর দিকে নজর গেলো তুরাগের। কিয়ৎক্ষন সেদিকে তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ করে শুতে গেলে নাক গিয়ে লাগল সোফার সাথে। নাক চেপে ধরে উঠে বসল তুরাগ। নিজের মাথায় নিজেই চাপড়ালো। কারণ ও যে সোফায় শোয়া ছিল তা প্রায় ভুলেই বসেছিল আর সে কারণেই তো ঘুরতে নাকে ঘষা লাগল ফোমের সাথে। তুরাগ এর এই অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দিলো তরু। চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকালো তুরাগ। সেই চোখের দিকে নজর যেতেই তৎক্ষনাৎ হাসি থেমে গেলো তরুর। তুরাগ যে রেগে আছে তা ওর মাথায়ই ছিল না। কিছু না বলে পা টিপে টিপে গিয়ে সোফার সামনে দাড়ালো। তুরাগ এর উদ্দেশ্য বলল

– এটা আপনার বাসা। বেড ও আপনার৷ আপনি চাইলে বেড এ শুতে পারেন। আমি সোফায় শুতে পারব। সমস্যা হবে না।

– আ ইউ শিওর?

– হুম।

তুরাগ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নেমে গিয়ে শুয়ে পড়ল বেডে। সেদিকে পলকহীন কিছু সময় তাকিয়ে রইল তরু। মনে মনে হয়ত আশা করেছিল তুরাগ বলবে ” আমি সোফায় শুই তুমি বরং বেড এ শো”। তা না বলে তরুর এক বলাতেই নিজে গিয়ে বেডে শুয়ে পড়ল। এখন তরু কি করবে। নিজের বোকামির জন্য আবারো মাথা চাপড়াতে মন চাচ্ছে। এই বেটাতো একটা নিরামিষ, এক নারীতে আসক্ত পুরুষ মানুষ। সে কেন তরুর কথা ভাববে। এটা কেন আগে মাথায় এলো না। তাহলে কখনোই তাকে বলত না বেডে শোয়ার জন্য। নিজেকেই নিজে মনে মনে গালমন্দ করে সোফায় শোয়ার প্রস্তুতি নিলো তরু। সোফার হাতলে মাথা রেখে চুলগুলো ছেড়ে দিল। চুলগুলো গড়িয়ে ফ্লোর অবধি পৌছালো। যা থেকে তখনো পানি ঝড়ছে। সেই পানিতে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই তরুর। সে মগ্ন হলো জীবনের হিসাব মিলানোতে। এই দুইদিন কি ঝড়ঝাপটা গেল তাদের উপর। জীবনের মোড় কীভাবে ঘুরে আজ এঔ পরিস্থিতিতে এলো তা ভাবতেই মগ্ন হলো।

” ফ্লাসব্যাক”

তারামন বিবিকে কোন ভাবেই মানানো যায় নি। তিনি তার কথায় অটল। এদের বিয়ে না দেয়া অবধি তিনি পানি অবধি ছুয়ে দেখবেন না। জেদমএট বশবর্তী হয়ে অসুস্থ হলেন তবুও হার মানবেন না। শ্বাশুড়ির এমন অবস্থা দেখে ভড়কালেন তহমিনা। এরকম করার কোন কারণ খুজে পেলনা। সেই শুরু থেকেই এই ফ্যামিলির এক এক জনের মন বুঝতে পারেন নি তহমিনা। মায়ের অসুস্থতায় নরম হলেন নুরুল ইসলাম। তার উপরে কথা বলেও তেমন সুবিধা করতে পারে না তহমিনা। স্বামীর উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করেও লাভ হয় নি। তিনি তার মায়ের কথাই রাখবেন। এদিকে তুরাগকে মানানো ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। তবে তা সম্ভব হয়েছে মিথিলার মায়ের জন্য। গত পরশুদিন বিকেলের দিকে তায়েফ সাইয়িদ এর সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা কা’টাকা’টি হচ্ছিল সেই মুহুর্তে তুরফা আর তহমিনার কাঁধে ভর করে বাসায় প্রবেশ করেছিলেন মিথিলার আম্মা। এক সময় তিনি চাইতেন যার জন্য তার মেয়ের এমন অবস্থা হয়েছে সে যেন তার মেয়ের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু ওই মুহূর্তে মিথিলার আম্মার ছিল পুরো ভিন্ন রুপ। তিনি যেন তুরাগকে সহ্যই করতে পারছিলেন না। তিনি কা’টকা’ট গলায় জানিয়েছেন মিথিলা যদি সুস্থ হয়ও তিনি বেঁচে থাকতে তুরাগ এর সাথে কোন দিনও বিয়ে সম্ভব নয়। তুরাগ যদি এরকম কথা আর মুখেও তোলে তাহলে তিনি এখান থেকে চলে যাবেনই সাথে মিথিলাকেও অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। কারণ এই ভালোবাসা নামক অভিশাপ পুরো পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে। এই একটা মাত্র কারণে আজ মোহনা আমাদের মাঝে নেই। তিনি এই বিষয়টা আর একটুও সামনে আগাতে দিবেন না। তুরাগ এর চোখের পানি তাকে টলাতে পারেনি। দুই মেয়ে স্বামী সব হারিয়ে তিনি তখন কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছেন।

তার কঠোরতা, ফ্যামিলি প্রেশার বাবার চাওয়া, নানুর অসুস্থতা সব মিলিয়ে অবশেষে তুরাগ হার মানে। কতদিন আর যু’দ্ধ চালিয়ে যাবে সবার সাথে। অসুস্থ নানুর হাত ধরে বলে এসেছিল তরুকে দেখে রাখবে। এরপর শুধু পরিবার এর মানুষ জনের সামনেই কাজি এসে বিয়েটা সম্পন্ন করেছিল। তহমিনা বেগম পুরো নিশ্চুপ হয়ে আছেন। তিনি এসব একটা বারের জন্যও তরুর সামনে আসেন নি। না কোন আগ্রহ ছিল এই বিয়েতে। তা নিয়ে এক প্রকার মন খারাপ ছিল। তার উপর সবার অগোচরে তুরাগ যা বলার তাতো বললই।

#ফ্লাসব্যাক এন্ড

জীবনের নতুন মোড়টা হুট করেই হয়ে গেল। এখন ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তা জানা নেই কারোই। সবাইতো আশা করে আছে যে একবার বিয়েটা যখন হয়েছে তখন সব কিছু আস্তে আস্তে নিশ্চয়ই ঠিক হবে। কিন্তু আদৌ কি কিছু ঠিক হবে। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ভেতর থেকে।

তরু মুখ ঘুরিয়ে তুরাগ এর দিকে ফিরলো। তুরাগ ওর দিকে মুখ করেই শোয়া ছিল। তরু তাকাতেই চোখাচোখি হলো। তরুকে জিজ্ঞেস করলো

– ঘুমাচ্ছো না কেন?

– আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন?

– ঘুম আসছে না।

– আচ্ছা আমরা কি ভুল করলাম? মিথিলা আপু যদি ফিরে আসে তবে সে যদি আমাদের ভুল বোঝে।

– কি হবে সামনে জানি না আমি।

– সে আসলে কি আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন?

জবাব দিলো না তুরাগ। কিছু সময় দুজনই নিরব রইল। চোখের কোনে পানি জমল তরুর। সব কিছু আসলে এতটা সহজ ও নয়। কোন নারীই তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে পারে না। তবুও মিথিলা নিজেকে মিথ্যা সান্তনা দেয় যে “”তুই তো সব জানতি তরু। তবুও তো বিয়েতে মত দিয়েছিস। এখন কেন কষ্ট পাচ্ছিস””।

– ঘুমিয়ে পড়েছো?

তুরাগ এর কন্ঠ কানে আসতেই হাতের উল্টোপিঠে চোখের কোনে জমে থাকা পানিটুকু মুছে ফেলল।

#চলবে