ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব-৩১+৩২

0
285

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_৩১

[ মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

রাতের নিস্তব্ধতা কে’টে গিয়েছে বেশ কিছু সময় হলো। চারদিকে পাখির কিচির মিচির ডাক শোনা যাচ্ছে। মিষ্টি সুৃমধুর কন্ঠধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল তরুর। ঘুম ভাঙতে নিজেকে নতুন একটা জায়গায় আবিষ্কার করল। তার মাথা বালিশে নেই। সে মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল কোথায় আছে। মাথা তুলেই লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিল। চোখের সামনে ভেসে উঠল তুরাগের লোমস বুক। চোখ বন্ধ করে আবার কিছু সময় পড়ে রইল আগের মতো। চোখ সম্মুখে ভেসে উঠল গত কাল রাতের কিছু দৃশ্য। তুরাগ ড্রাঙ্ক অবস্থায় কাছে টেনে নিয়েছিল। প্রথমে চেয়েছিল বাধা দিতে। পরমুহূর্তে কিছু একটা ভেবে বাধা দিলো না তুরাগকে। স্বামীর আহ্বানে সারা দেয়াটা পাপের নয়। কিন্তু এখন বেশ লজ্জা লাগছে। কাল রাতে তো তুরাগ ড্রাঙ্ক ছিল। কিন্তু এখন। এখন তো সজ্ঞানে থাকবে। এটা ভেবেই লজ্জায় চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো তরু। তখনি কানে ভেসে আসল তুরাগের কন্ঠ। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। মাথা তুলে সেদিকে তাকালো তরু। তুরাগ কি বলছে বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু কথাগুলো অস্পষ্ট। কানটা এগিয়ে নিলো তুরাগের মুখের সামনে। বোঝার চেষ্টা করল তুরাগ কি বলার চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে কথাগুলো স্পষ্ট হলো-

– যেও না মিথিলা। প্লিজ। যেওনা।

অস্পষ্ট স্বরে বলা কথাগুলো বুকের মধ্যে যেন তীরের মতো বিধছে। কিছু সময় আগেও তুরাগকে নিয়ে ভাবা অনুভূতি গুলো ধীরে ধীরে যেন ফিকে রঙ ধারণ করছে। মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিল তরু। বেডশিটটা টেনে নিয়ে তা জড়িয়ে উঠে গেলো তুরাগের পাশ থেকে।

প্রায় ঘন্টাখানিক সময় পড়ে ঘুম ভাঙল তুরাগ এর। বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারল নিজের রুমেই আছে। পুরো শরীর ব্লাঙ্কেটে আবৃত। উঠে বসল তুরাগ। নিজের দিকে নজর যেতেই আতকে উঠল। এক সুতো কাপড় ও নেই। নিজেকে আবার ব্লাঙ্কেটে আবৃত করে নিলো। রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করল তরু কোথাও আছে কিনা। না তরুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ফোস করে শ্বাস ছাড়ল তুরাগ। মনে করার চেষ্টা করতে লাগল কাল কি হয়েছিল। অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ছে। তবে পুরোপুরি কিছুই মনে করতে পারছে না। সব কিছুই আবছা লাগছে। মাথা চেপে ধরল তুরাগ। কোনমতেই সবটা মনে করতে পারছে না। ব্লাঙ্কেট জড়িয়েই চলে গেলো ওয়াশরুমে।

পুরো রুম খুজে কোথাও পেল না তরুকে। বেলকনির দরজাও লাগানো। তার মানে ওখানেও যায়নি। দৌড়ে ছাদে গেল তুরাগ। নাহ ছাদেও নেই। ঘাবড়ে যায় তুরাগ। অবচেতন মন বারবার জানান দিচ্ছে তরু হয়ত চলে গেছে। কাল রাতে হয়ত ভুল কিছু হয়ে গেছে তরুর সাথে। বারবার এটাই মনে হচ্ছে যে তরু এ বাসায় নেই। কি করবে তুরাগ। তরুকে স্ত্রীর অধিকার না দিলেও তরু তার স্ত্রী। তাকে দেখে রাখটাও দায়িত্ব। পা গুলো যেনো অসাড় হয়ে আসছে। নিচে নেমে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছে না। পা টেনে টেনে নামল নিচে। উদ্দেশ্য তুরফার রুম। এখন তরুর কথা জিজ্ঞেস করার মতো তুরফা ছাড়া আর কাউকে নিরাপদ মনে হলো না৷ তুরফার রুমের সামনে এসে দাড়িয়ে রইল কিছু সময়। মনে সাহস জুগিয়ে টোকা দিলো তুরফার দরজায়। কয়েকবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে দরজা খোলার আওয়াজ এলো। তুরাগ মনে মনে গুছিয়ে নিলো কীভাবে তুরফাকে তরুর কথা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তুরাগকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল তরু। তরুকে দেখে ভেতর থেকে সস্তির নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো। কি জিজ্ঞেস করবে খুজে পেল না। সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো

– তুরফা কোথায়?

– আপু ওয়াশরুমে গেছে।

– ওহ আচ্ছা। তুমি রুমে আসো। কথা আছে।

কথা আছে কথা শুনে চমকালো তরু। এখন আবার কি জিজ্ঞেস করবে এই লোক। কাপা কাপা পায়ে হেটে আসে তুরাগ এর পিছু পিছু। তুরাগ রুমে ঢুকে দরজার সামনেই দাড়িয়ে ছিল। তরু রুমে ঢুকতেই দরজার সিটকিনি টেনে দিল। কেপে উঠল তরু। তরু তবুও মনকে শক্ত করলো। কিছু বলবে না মানে না। সে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো রুমের মাঝ বরাবর।

– তরু

চোখ খিচে বন্ধ করে রেখে মনে মনে আল্লাহ নাম জপ করছো তরু। আর খুব করে চাইছে তুরাগ যেন গতকালের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে।

– তরু তাকাও আমার দিকে।

এবার বিনাবাক্য ব্যয়ে তুরাগের দিকে ঘুরে তাকালো তরু।

– আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো তোমাকে

– হুম

– কাল রাতে কি

তুরাগকে কথা শেষ করতে না দিয়েই তরু বলা শুরু করে

– কাল আপনি হয়ত স্যাড ছিলেন। তাই প্রচুর পরিমাণে ড্রিংকস করেছেন। অনেক রাতে বাসায় ফিরেছেন। আমি আপনাকে রুমে এনে শুয়িয়ে দিয়েছি। আর কিছু না।

– সত্যি কি তাই?

– হ্যা হ্যা।

– তবে বেডশিট কেন চেন্জ করেছো?

মেজাজ খারাপ হয় তরুর। এই বেডা এমন খ২০ কেন।

– কি হলো

– আপনি ব’মি করেছিলেন তাই চেন্জ করে দিছি।

– ওহ আচ্ছা। তাহলে ড্রেস?

– বমি করেছেন বলেই।

– লজ্জা শরম কি সব খেয়ে ফেলেছো নাকি।

এই মুহুর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে তরুর। নির্লজ্জ লোক। সেখান থেকে পালানোর পথ খুজে তরু।

– আচ্ছা আমি আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি। বাবাও তো আজ অফিসে যাবে মনে হয়। আমি দেখে আসি।

– হুম।

ব্যাস্ত পায়ে রুম ছাড়ে তরু। তরু বেড়িয়ে যেতেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে তুরাগ। মাথা একদম কাজ করছে না। আবছা আবছা যে মুহুর্ত গুলো মনে পড়ছে সেগুলো একদম বাস্তব মনে হচ্ছে। এদিকে তরু বলছে অন্য কথা। এদিকে হসপিটালের এরকম নিউজ। মাথা পুরো হ্যাং হয়ে আছে। এই মুহুর্তে কি করা উচিত তুরাগের। মনে মনে মিলাতে থাকে অনেক হিসেব। এভাবেই পার হয়ে যায় অনেক সময়। এক প্রকার ভাবনার মাঝেই ডুবে মাঝে তুরাগ। হঠাৎ কারো চিতকারের শব্দ কানে আসতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে তুরাগ। কন্ঠটা তরুর মনে হলো। তুরাগ আবারো কান খাড়া করে রাখে শোনার জন্য। আসলেই কি ঠিক শুনেছে নাকি ভুল। আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও কি হয়েছে দেখার জন্য রুম থেকে বের হয় তুরাগ। রুমের সামনে আসতেই মেরিনা বেগমের রুম থেকে চেচামেচির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। সেদিকে পা বাড়ায় তুরাগ। রুমের সামনে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ। ফ্লোরে পা বিছিয়ে বসে আছে তরু। তুরফা উবু হয়ে সমানে ফু দিয়ে যাচ্ছে তরুর পায়ে। ঠোট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতেছে তরু। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নামছে। এরকম দৃশ্য দেখে খারাপ লাগে তরুর। কিন্তু কি হয়েছে এখানে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না৷ দ্রুত পায়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে তুরাগ। তুরফাকে সরতে বললে বিনাবাক্য ব্যয়ে সরে যায় তুরফা। তরুর পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে পায়ের পাতা লাল হয়ে গেছে।

– পুড়েছে?

– হুম ভাইয়া

– আইস কিউব লাগিয়েছিস?

– না

– গাঁধি। তাড়াতাড়ি আইস কিউব নিয়ে আমার রুমে আয়। পুড়ে গেলে ঠান্ডা কিছু লাগাতে হয় জানিস না।

তুরাগ এর আদেশ মতো তাড়াতাড়ি আইস কিউব আনতে ছুটে যায় তুরফা। নুয়ে পাজাকোলে তুলে নেয় তরুকে। বের হওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াবে সে সময় কিছু তিক্ত কথা পা দুটো থামিয়ে দেয় তুরাগ এর।

– আমার মেয়েটা হসপিটালে ওভাবে পড়ে আছে আর তুমি বউকে নিয়ে ফুর্তি করতেছো। ভালোই। সব পুরুষ মানুষ এক। তুমি কোনদিন আমার মেয়েকে ভালোই বাসোনি। আমার মেয়েটাই বোকা। ওর এখন এসে দেখা উচিত তার প্রিয়তম এখন অন্য মেয়ে নিয়ে ব্যাস্ত।

কথাগুলো শুনে চোখ বন্ধ করে নেয় তুরাগ। জোরে শ্বাস নিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যোত হতেই শার্টের কলার খামচে ধরে তরু। তরুর দিকে তাকাতেই মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে তুরাগ। পা বাড়ায় রুমের দিকে। আগে পায়ের ব্যাবস্থা করতে হবে। মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।

বিছানার উপর চোখ বন্ধ করে বসে আছে তরু। তার সামনেই হাটু মুড়ে বসে পায়ে আইস কিউব লাগিয়ে দিচ্ছে তুরাগ। তার পাশেই দাড়িয়ে আছে তুরফা।

– ওর পা পুড়লো কীভাবে?

গম্ভীর কন্ঠ শুনে কেপে উঠে দুজনই। তুরফা আমতা আমতা করে বলে

– এ এমনি।

– এমনি কীভাবে পুড়ছে? সত্যিটা বল।

– আসলে ভাইয়া ওই আন্টির জন্য গরম স্যুপ করে নিয়ে গেছিল তরু। তিনি কাল থেকে কিছু খাননি। এখনো খাবেন না বলছিলেন। তাই তরু জোর করে। আর তখনি তিনি হাত ঘুরিয়ে স্যুপের বাটি ধরে ধাক্কা দেয়। আর সেটাই পায়ে পড়ছে।

হাত মুঠো করে নেয় তুরাগ।

# চলবে

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_৩২

মানুষ এরকম অকৃতজ্ঞ কীভাবে হয় ভেবে পাচ্ছে না তুরাগ। এই মুহুর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছে মেরিনা বেগমের প্রতি। বসা থেকে উঠে দাড়ায়। ঠিক করে এখনি মেরিনা বেগমের রুমে যাবে। জানতে চাইবে তিনি এরকম কেন করলেন। উল্টো ঘুরে দরজার দিকে হাটা ধরতেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরল তরু। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

– আপনি তাকে কিছু বলবেন না। অনুরোধ রইল।

জবাব দিলো না তুরাগ। তরুই আগ বাড়িয়ে বলল

– দেখুন তার অবস্থা এখন ভালো নয়। দুটো মেয়ে তার। একজন তো নেই৷ আরেকজন বেচে থেকেও নেই। এই জিনিসগুলো তার মস্তিষ্কে ভীষণ ভাবে এফেক্ট ফেলছে। এজন্য এরকম উগ্র আচরণ করেছে। আপনি দয়া করে তাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলবেন না।

– সে অন্য কারো সাথে মিসবিহেভ না করে তোমার সাথেই কেন করল। সে যদি তোমাকে অপছন্দই করে তাহলে সেদিন আমাকে কেন বলেছিল বিয়ে করার জন্য। আমি তো বিয়ে করতে চাইনি। তিনি সেদিন কেন জোর করেছিলেন। আর আজ কেন আমার স্ত্রীর সাথে মিসবিহেভ করবে।

তুরাগের মুখে আমার স্ত্রী কথাটা শুনে যেন একটা ধাক্কা খেল তরু। এতটাও আশা করেনি।

– আমি জানি এর উত্তর।

তুরফার কথায় তুরাগ তরু দুজনই ঘুরে তাকায়। সমস্বরে জানতে চায়

– কেন?

– সেদিন আন্টি হসপিটালে থাকা অবস্থায় বাবা গিয়েছিল হসপিটালে। সে কথা বলেছে আন্টির সাথে। বাবা তাদের সমস্ত দায়িত্ব নিবেন। ভরণপোষণ, চিকিৎসা খরচ। এভরিথিং। এর জন্য বাবার শর্ত তাকে মানতে হবে। আর তা যদি না হয় তবে কোন না কোন ভাবে ভাইয়াকে তাদের থেকো সরিয়ে নিবে।

সেই ভয়ে সেদিন তিনি রাজি হয়েছিলো তোকে বোঝাতে। তবে তিনি মন থেকে চাননি তোর বিয়ে টা৷

তুরফার কথায় চোখ বন্ধ করে ফেলেন তুরাগ। জোরে শ্বাস নেন। আবার দম ফেলতে থাকেন। নিজের রাগকে দমানোর চেষ্টা। এই মুহুর্তে কি এক যাতাকলে পরে গেছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে বাবার প্রতি। নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে। একের পর এক ভুুল কাজ করেই চলেছে। রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় তুরাগ। এই মুহুর্তে নিজেকে মেরুদণ্ডহীন মনে হচ্ছে।



মেরিনা বেগম বাদে সবাই উপস্থিত রয়েছে বসার ঘরে। অপেক্ষা করছে তুরাগের ফেরার। একটা বাজতে চলল তখনও তুরাগের ফেরার নাম নেই। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন তিনি। কিন্তু তুরাগ আসছে না। ফোন দিলে ফোন ও রিসিভ করছে না। চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তায়েফ সাইয়িদ এর। তুরফার পাশে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে তরু। তায়েফ সাইয়িদ উচু কন্ঠে মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন

– বাসায় কি ঝামেলা করে গেছে ও?

প্রথমে ঠিক করল সবটা খুলে বলবে তুরফা।কিন্তু তরু হাত চেপে ধরল। বলতে দিলো না। কিন্তু তায়েফ সাহেবের প্রশ্নে অবশেষে বাধ্য হয়ে বলে দিলো তুরফা। তায়েফ সাহেবের চিন্তা যেন এতে আরো বেড়ে গেলো। তুরাগ এমনিতেই তরুকে পুরোপুরি স্ত্রী হিসেবে মানে না। তার উপর আজ এসব হলো। এখন যদি আর বাসায়ই না ফেরে। বসে থাকতে পারলেন না তিনি। উঠে পায়চারি শুরু করলেন। ফোন করলেন সব পরিচিত জনদের। কিন্তু তুরাগ তাদের কারো সাথেই নেই। এমনিতেও তুরাগ প্রায়শই রাত করে বাড়িতে ফেরে। সেটা সমস্যা নয়। প্রান্ত সাথে থাকে তখন। কিন্তু আজ প্রান্তর সাথে একবারও দেখা হয়নি।

রাত তখন আরো গভীর হয়৷ কিন্তু তুরাগের ফেরার কোনো নাম নেই। তরু জোর করে সবাইকে রুমে পাঠালো। জানালো সে অপেক্ষা করবে তুরাগের জন্য। কেউ যেতে রাজি না হলেও এক প্রকার জোর করেই সবাইকে রুমে পাঠালো তরু। সে বসে অপেক্ষা করতে লাগল তুরাগের জন্য। বসে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখ লেগে আসল। ঘুমিয়ে পড়ল সোফার উপরেই।

তুরাগ যখন বাসায় ফিরল তখন ফজরের আজান শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। অনেক বার চেয়েও কলিং বেল চাপ দেয়ার সাহস হলো না। মনে পড়ে গেলো কয়েক মাস আগের কথা। সেই যে রাত বেশি হলে বেলকনি টপকে ঢুকত। আর মা কখনো বেলকনির দরজা লাগাতেন না। আজও সেই চেষ্টাটাই করল তুরাগ। অনেক দিন আগের মতো অনুভূতি। আজও বেলকনির দরজা চাপানো ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। রুমে এসে চারদিকে চোখ বুলালো তুরাগ। লোথাও কেউ নেই। পুরো রুম ফাঁকা পড়ে আছে। গতকাল সকালে যেমন দেখেছিল ঠিক তেমন। তার মানে তরু আর এই রুমে আসে নি। গেল কোথায় মেয়েটা। রুম থেকে বেড়িয়ে এলো তুরাগ। ভেবেছিল তুরফার রুমে হবে হয়ত। কিন্তু তুরফার রুমে যাওয়ার আগেই দোতলা থেকেই নজর গেল নিচতলায় বসার রুমে। সোফার উপরে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে আছে তরু। ঠান্ডা লাগছে বোধহয় অনেক। আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো তুরাগ। তরুর সামনে হাটুমুড়ে বসল। মেয়েটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চোখের বন্ধ পাতার দিকে তাকালো তুরাগ। চোখের নিচে পানি শুকিয়ে যাওয়ার দাগ রয়ে গেছে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে তুরাগের। এই মেয়েটা কান্না কেন করছিল? তবে কি ওর জন্যই কান্না করছিল মেয়েটা। তুরাগের মনে হচ্ছে সে নিজের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য মেয়েটাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছে। মনস্থির করল সে নিজের ভুলগুলোর শাস্তি এই মেয়েটাকে দিবে না। উঠে দাড়ালো তুরাগ। পাজাকোলে তুলে নিল তরুকে। কোলে তুলে নেয়ার সাথে সাথেই তরুর চোখের পাতাগুলো তিড় তিড় করে কেপে উঠল। তুরাগ ভেবেছিল হয়ত এখনি ঘুম ভেঙে যাবে তরুর। কিন্তু ভাঙল না। চোখ আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। কোলে তুলেই দোতলায় নিয়ে আসল তরুকে। বিছানায় শুয়িয়ে দিল। ব্লাঙ্কেট টেনে দিল গায়ে। তারপর বেড এর এক সাইডে বসল তুরাগ। এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তরুর দিকে। কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে মুখখানা। এই মেয়েটা তাকেই কেন বিয়ে করতে গেল। ওরও তো একটা সুন্দর জীবন হতে পারত। শুধু শুধু নিজ হাতে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে ওর লাইফে এলো। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে আওড়ালো কিছু কথা –

জানো পিচ্চি মেয়ে যেদিন তুমি দুনিয়ায় এসেছিলে না সেদিন প্রথম তোমাকে কোলে আমিই নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কোলে আসার পরেই তুমি কান্না শুরু করে দিলে। সাথে সাথে আম্মু তোমাকে আমার কোল থেকে নিয়ে গেলো। সেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল আমার। তুমি আমাকে পছন্দ করতে না বলেই তুমি কান্না করছো। এটাই মনে হয়েছিল। সে বার চলে আসার প্রায় তিন বছর পর আবার গিয়েছিলাম গ্রামে। তখন তোমার তিন বছর। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে সারা বাড়িময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিলে। বার্বিডলের মতো একটা ড্রেস পড়িয়েছিল মামিমা তোমাকে। তোমাকেও দেখতে একদম বার্বিডলের মতোই লাগছিল। সেটা দেখেই তো তুরফা তোমার নাম দিয়েছিল ছোট্ট পুতুল। তুরফা যখন তোমাকে কোলে নিতে গেল তুমি ঠিকই ওর কোলে উঠলে। কিন্তু তুরফাও তো ছোট ছিল। পরলে দুজনই উল্টে। এরপর যেই আমি তোমাকে তুলতে গেলাম অমনি গলা ফাটিয়ে কাদতে শুরু করলে।

কথা গুলো বলে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল তুরাগ। আবার বলতে শুরু করল

– আজ নিয়তি কোথায় এনে দাড় করিয়েছে দেখো। ছোট বেলায় তোমাকে একটু আদর করতে গেলেই ভ্যা ভ্যা করে কাদতে। আর এখন তুমি আমাকে ভালোবাসো কিন্তু আমি কেন পারছি না বলোতো। বলবে কীভাবে তুমি তো শোনোই নি আমার কথা। আমি তোমাকে তোমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করব না। চেষ্টা করব স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। তবে সময় প্রয়োজন আমার। কষ্ট পেও না। আর কান্নাকা’টি তো মোটেও করবে না।

কথাগুলো শেষ করে আবারো তরুর মুখের দিকে তাকায় তুরাগ। তরুর চোখ এখনো বন্ধ। তবে সামনের ছোট চুলগুলো বারবার মুখের উপর এসে পড়ছে। আর তাতেই চোখ মুখ কুচকে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। বন্ধ চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে এক অবাধ্য ইচ্ছে জেগে উঠল মনে। অবাধ্য ইচ্ছেটা চেপে না রেখে পূরণ করেই ফেলল। বন্ধ চোখের পাতায়ই ঠোট ছোয়ালো তুরাগ। ওমনি ফট করে চোখ খুলল তরু। তুরাগ সজ্ঞানে এসব করল ভাবতেই লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেলো। ওমনি কাত হয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেল। তরুকে জেগে থাকতে দেখে তুরাগ নিজেও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। উঠে যেতে নিলো পাশ থেকে।

– আমাকে কি ভালোবাসা যায়না?

তরুর কথায় পা থেমে গেলো তুরাগের। থম মে’রে সেখানেই দাড়িয়ে গেল। তবে জবাব দিল না কোনো। তরু মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি আটল। কন্ঠ গম্ভীর করে বলল

– আসলে আপনি ভালোবাসলে আমারি লস। আমার বয়ফ্রেন্ড চাকরিটা পেয়ে গেলেই আমি তার কাছে চলে যাবো। তখন তো আবার আপনাকে একাই থাকতে হবে। তাই ভালো না বাসাই ভালো হুহ।

তরুর কথা শুনে চোখ গুলো লাল হয়ে গেল তুরাগের। তরুর দিকে না ঘুরেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। তুরাগের রাগ কেন হচ্ছে নিজেই বুঝছে না। সেখানে আর না দাড়িয়ে গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে।




আমার প্রফিট এর ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার আমি আমার দুই মেয়েকে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আর আমার প্রোপার্টি চার ভাগে ভাগ হবে। তিন ভাগ তিন ছেলে মেয়ে পাবে। আর একভাগ আমার নামেই থাকবে। আমার নামে যেটা থাকবে সেটা আমার মৃ’ত্যুর পরেও আর কোন ওয়ারিশ থাকবে না। সেটা কোনো এতিম খানার নামে চলে যাবে৷ উইল এভাবেই করবে।

ওপর পাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। কিন্তু তায়েফ সাইয়িদ জবাবে বললেন

– আমি এরকমটাই চাই। ব্যাবস্থা করো যত শীগ্রই সম্ভব।

কথাগুলো বলতে বলতে হাটছিলেন তিনি। তার আড়ালে যে কেউ কথাগুলো শুনে কুটিল বুদ্ধি আটতেছে তা ঘুনাক্ষরেও টের পেলেন না তিনি।

#চলবে