#ভালোবাসার_ভিন্ন_রুপ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৬
রোদের ঘুম ভাঙলো দুপুর ২ টায়। মাথা ব্যাথাটা নেই এখন। হঠাৎ মনে পরলো সব। পাশে তাকাতেই দেখলো আদ্রিয়ান নেই। মিষ্টি খেয়েছে কি না? গোসল করলো না ভাবতেই বেড থেকে নামলো। নিচে যেতেই দেখলো শাশুড়ী এসে পড়েছে। রোদ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
— মামনি মামা এখন কেমন আছেন?
— ভালো আছে এখন। কাল হয়তো রিলিজ করে দিবে।
— তুমি কখন এলে? খেয়েছো?
— একটু আগেই এলাম। তোর নাকি শরীর খারাপ লাগছে?
— একটু মাথা ব্যাথা ছিলো। এখন ঠিক আছি।
— খেয়ে নিবি আয়।
— মিষ্টিকে দেখে আসি।
বলে রোদ যেতে নিলেই আদ্রিয়ান মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বাসায় ডুকলো। রোদ ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় গিয়েছিলেন এই দুপুরে?
মিষ্টি বাবার কোল থেকে নেমে মায়ের দিকে এসে ছোট্ট হাতের মুঠো খুলে মাকে বড়ই দিলো। রোদ জিজ্ঞেস করতেই আদ্রিয়ান বললো,
— বাসার পেছনের গাছে হয়েছে। তোমার মেয়ে তোমার জন্য নিয়ে এলো।
— আজব না গোসল না খাওয়া। ওকে নিয়ে ভর দুপুরে আপনি বাসার পেছনে কেন গিয়েছিলেন।
বলে আর আদ্রিয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিষ্টিকে কোলে তুলে নিয়ে উপরে চলে গেল। আদ্রিয়ান বেচারা বউয়ের কথায় মুখটা ভোতা করে দিলো। ওর মা ওর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। আদ্রিয়ান মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— হাসো কেন?
— কই হাসি? আমি তো দেখি আমার আদ্রিয়ানকে যে কিনা কিছু দিন আগেও নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরতো।
আদ্রিয়ানও হেসে এক হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— সরি আম্মু। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।
— বোকা ছেলে আমার। তুই যে আগের মতো হচ্ছিস এই বেশি।
মায়ের কপালে চুমু খেয়ে আদ্রিয়ান উপরে চলে গেল। কাউচের উপর রোদের মেডিক্যাল ফাইল দেখে চমকে গেল আদ্রিয়ান। কাল তাড়াহুরায় ভুলে গিয়েছিলো। আল্লাহ বাঁচালো রোদ দেখি নি। মিষ্টির খিলখিল হাসিতে মুখরিত হচ্ছে পুরো রুম। আদ্রিয়ান উকি দিলো ওয়াসরুমে। মিষ্টি একটা বোলে বসে আছে আর রোদ ওকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। মিষ্টি ও হেসে হেসে মাকে পানি ছিটালো। রোদ একটু রাগ দেখিয়ে নিজে আরো বেশি করে পানি ছিটিয়ে দিলো। দুজনে ভিজে চুপচুপা হয়ে গেল। আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে দুজনকে দেখতে লাগলো। এই দৃশ্য দেখাও যে কপালে ছিলো তা জানতো না আদ্রিয়ান। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো আদ্রিয়ান। হঠাৎ নিজের উপর পানি পরাতে চমকে তাকালো আদ্রিয়ান। মিষ্টি হেসে আবারও দু-হাত ভরে পানি নিয়ে বাবাকে ছিটয়ে দিলো। আদ্রিয়ান আটকাতে চাইলে রোদ এক মগ ভর্তি পানি আদ্রিয়ানের উপর ঢেলে দিলো। আদ্রিয়ানের মাথা সহ কাঁধের কিছু অংশ ভিজে গেল। এবার আর থামায় কে আদ্রিয়ানকে? তিনজন পানি ছিটাছিটি করে পুরো দমে ভিজে চুপচুপ হয়ে গেল। রোদ হাঁপিয়ে উঠলো। এই বাবা-মেয়ের এনার্জি আছে বলতে হবে। রোদ কোন মতে থামিয়ে মিষ্টিকে গোসল করিয়ে মুছিয়ে দিলো। এরমধ্যেও আদ্রিয়ান শান্তি দিলো কই? একবার রোদের মাথায় তো একবার মুখে পানি ঢালতে লাগলো। মিষ্টিকে রুমে পাঠিয়ে রোদ কোন মতে পা টিপে টিপে যেয়ে ওকে ড্রেস পড়িয়ে দিয়ে নিজের একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াসরুমে ডুকলো। আদ্রিয়ান ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। রোদ বেরুতে বললেই হেঁচকা টানে নিজের বুকে ফেললো রোদকে। দরজা লক করে দিয়ে রোদকে চেপে ধরলো নিজের সাথে।
রোদ চিল্লায়ে উঠতেই আদ্রিয়ান ওর চিল্লাচিল্লি একদম বন্ধ করে দিলো। কিছুক্ষন পর ছাড়তেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
— বের হন।
— কেন? ( কপাল কুচকে)
— প্লিজ আমি গোসল করব। ক্ষুধা লেগেছে। মিষ্টিকেও খাওয়াতে হবে।
— আসো আমি আদর দেই দেখবে পেট ভরে গিয়েছে।
রোদ কটমট করে বললো,
— এই আপনি তো এমন ছিলেন না। কেমন ছিঃ মার্কা কথাবার্তা বলেন ইদানীং।
আদ্রিয়ান একহাতে রোদকে ধরে অন্য হাত দিয়ে ওর রেগে লাল হয়ে যাওয়া নাকে টোকা দিলো। কানে মুখ দিয়ে বললো,
— আমি তো আগের থেকেই এমন বউ। বুড়ো বয়সে বউ পেয়েছি তার সাথেই তো এমন কথা বলবো নাকি?
— উপ্ফু। ছাড়ুন।
— বউ ইদানীং এতো রেগে যাও কেন?
বলতে বলতে রোদের গলায় ছোট ছোট আদরে ভরিয়ে তুললো আদ্রিয়ান। রোদ শ্বাঃস থমকে উত্তর দিলো,
— জানিনা।
আদ্রিয়ান নেশালো কন্ঠে বললো,
— হুম।
রোদ মুচরামুরচি করতে নিলেই জোরে এক কামড় খেল ঘারে। হাত দিয়ে ডলতে ডলতে সরে গেল রোদ। চোখের কোনে পানি জমা হলো। আদ্রিয়ান ওকে টেনে এনে আবার চুমু খেল। ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো গোসল করে টাওয়াল জড়িয়ে বেরিয়ে গেল। রোদ আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এই লোক একটা সরিও বললো না।
দরজা লক করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো রোদ। ফর্সা গলা ও ঘাড়ে ছোট ছোট লাল কিছুটা কালচে দাগে ভরা যার সম্পূর্ণ ক্রেডিট যায় আদ্রিয়ানকে। আদরের নাম করে করে এসব করে এই লোক। নিজের ফর্সা গলা ঘার ঢাকতে ইদানীং তাকে কলার দেয়া ড্রেস পড়তে হয়। সবসময় ঢেকে রাখতে হয় নিজেকে। আল্লাহ মালুম এখনই এই অবস্থা না জানি নিজের ভালোবাসা স্বীকার করলে কি হবে?
গোসল সেড়ে বেরুতেই দেখলো বাপ মেয়ে ফুল রেডি। রোদ মাথায় টাওয়াল পেচিয়ে রাখাটা খুলতেই আদ্রিয়ান নিজে তা মুছে দিলো। ক্রিম এনে ওর গলায় লাগিয়ে দিলো। মিষ্টির অগচড়ে ঠোঁটে আলত চুমু খেয়ে বললো,
— চলো। ক্ষুধা লেগেছে।
— হুম।
বলে দুজন নিচে নামলো। খেতে বসে শুনলো জারাকে দেখতে আসবে এরমধ্যে। ওর বাবার ফ্রেন্ডের ছেলে তাই ফুপি নিজের শাশুড় বাড়ী যাবেন। রোদ শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।আদ্রিয়ানের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলো যাতে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু ওর আশায় এক ড্রাম ময়লা পানি ঢেলে দিলো ওর আপন শশুড়। মানে সহ্য হয় এসব? শশুড় বোনকে বললেন,
— আপা জারা তো আমার ও মেয়ে। এ বাসায়ই নাহয় দেখতে আসুক।
— ওর বাবা রাজি হবে না।
— আমি দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলি। আশা করি দুলাভাই না করবেন না।
— ঠিক আছে। আমারও সুবিধা হবে। ওখানে একা হাতে সামলাতে কষ্ট হয়ে যেত।
রোদ চুপসানো মুখ করে মিষ্টির খাওয়া শেষ করলো। নিজেও খেয়ে নিলো। আদ্রিয়ানের বেশ মজা লাগলো রোদের এমন মুখ দেখে। রুমে ডুকে রোদ ফোন করলো মাকে। রিসিভ হতেই রোদ উৎসাহের সাথে বললো,
— আম্মু!
— হ্যাঁ রোদ বল মা। কি করছিস?
— খেলাম মাত্র। আপু কি করে? রুদ্র কোথায়? আর ভাইয়া কি কিছু বলেছে?
— আরে আস্তে। জাইফা ঘুম। রুদ্র কোচিং এ গেল মাত্র। রাদও রুমে আছে। আর কিছু?
— আর কিছু না।
— আমার মায়ের কি মন খারাপ?
চোখটা জ্বলে উঠলো রোদের। বাসার কথা মনে পরছে। লোভ হচ্ছে যাওয়ার। কিন্তু কি একটা অবস্থা আজ ও নিজের বাসার যাওয়ার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হয়। একা গেলে মনে হয় পিছুটানের কথা। একটা ছোট মেয়ে আছে তার। তাকে ছাড়া আর নিজের স্বামী নামক আদ্রিয়ান ছাড়া ও নিজেকে কল্পনা করতে পারে না। ভাবতেই বুক চিড়ে কান্না এলো রোদের।
— কিরে রোদ? কি হলো? কথা বলছিস না কেন?
রোদ কোনমতে বললো,
— আম্মু..
— এই তুই কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে? রোদ? মা আমার আম্মুকে বল।
— আম্মু আই মিস ইউ। আম্মু রুদ্র আর ভাইয়াকে মিস করছি। আচ্ছা আম্মু শুনো আপুর খেয়াল রেখো কিন্তু। বাংলা সিনেমার শাশুড়ী হয়ে যেও না।
আল্লাহ আম্মু আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি তো আগে থেকেই শাশুড়ী হয়ে গিয়েছিলে।
রোদের মা আর কিছু শুনুক আর না শুনুক চার লাইন কথায় মেয়ের মুখের চার বার আম্মু ডাকটা ঠিকই শুনলো। মাতৃহৃদয়ের কিছু অংশ যেন শান্ত হলো। ছেলেদুটো একসাথে যতবার না ডাকে রোদ তার চেয়ে বেশি ডাকতো একা। বাসাটা খালি মনে হয় ইদানীং। মেয়েটাকে যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে তা তিনি কোন দিন ও ভাবতে পারেন নি।
হঠাৎ করে কেউ কোলে মুখ গুজে শুয়াতে তাকিয়ে দেখলো রাদ। মায়ের কোমড় জড়িয়ে সোফায় টান টান হয়ে কোলে মুখ গুজে শুয়ে রইলো। উনি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। রাদ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো,
— রোদ?
— হুম।
রাদ মায়ের কাছে থেকে ফোন নিয়ে বললো,
— কি করিস পিচ্চি?
— আমি পিচ্চি না। আমার ১৯ বছর বয়স আর একটা সাড়ে তিন বছরের মেয়েও আছে।
— ওমা তাই নাকি বুড়ী।
রোদ ঐ পাশ থেকে চিল্লায়ে বললো,
— আম্মু তোমার ছেলেকে কিছু বলো।
— ঐ দিলি তো বয়রা বানিয়ে।
রাদের মা হাসলো ছেলে মেয়েদের কান্ড দেখে। আরোকিছুক্ষন কথা বলে কল কাটলো রাদ। কেটে আবারও মায়ের কোলে মুখ গুজে রইলো। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— কি হয়েছে বাবা? কি ভাবছিস?
ফুপিয়ে উঠলো রাদ। অবাক হলেন মিসেস রহমান। তার রাগী, শক্ত রাদও আজ কতদিন না দিন না মাস পর কাঁদলো। রোদের জন্য লাস্ট কাঁদতে দেখেছিলো। ছেলেকে আদর করে আদুরে গলায় বললেন,
— আমার কঠিন রাদকে কে কাঁদালো?
— আম্মু..
— হ্যাঁ বাবা বল। আম্মু শুনছিতো।
— নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে শান্ত পাচ্ছি না মা। বুকে জ্বলছে। আমি কল্পনা করতে পারছি না। ওর জায়গায় যদি আমার রোদ..
আমার জন্য হলো মা এমন। আমার ই দোষ। কিন্তু আমি কি করতাম বলো? আমি ওকে কত করে বুঝিয়েছিলাম। শেষে রেগেও বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু কি হলো আম্মু। মেয়েটা ভেঙে পড়েছে মা। প্রকাশ করতে পারছে না। তবুও আমাকেই ভালোবেসেই যাচ্ছে। আমি কিভাবে এর প্রতিদান দিবো আম্মু। ও এখনও পাগলের মতো ভালোবাসে আমায়।
আর বলতে পারলো না। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— আমার রাদ তো এত দূর্বল না।তাহলে?
— আমি বুঝতে পারছি না কি করবো?
— ওর সাথে সহজ হ রাদ। একটা মেয়ের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সে বিলীন করেছে তোকে ভালোবাসতে যেয়ে। ওর প্রতি যত্ন নে। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। এতে তুই নিজেকে কেনো দোষ দিচ্ছিস? সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।
মায়েদের কথায়ই একপ্রকার জাদু থাকে। মানষিক শান্তির ঔষধ থাকে যা মুহূর্তের মধ্যে সব অশান্ত সন্তানদের শান্ত করে দেয়।
রাদ মায়ের কপালে চুমু খেয়ে উঠতে উঠতে বললো,
— রুদ্র আসলে দেখা করতে বলো তো।
— আচ্ছা।
__________
রোদের সব কথাই শুনছিলো আদ্রিয়ান। আর সবকয়টা মেয়েদের মতো রোদ বিয়ের পর নিজের বাসায় যেতে পারে নি। আদ্রিয়ান ভয় পেত যদি রোদ ফিরতে না চায়? যদি নিজের অক্ষমতা জেনে যায়? ভাবতে ভাবতে রুমে ডুকলো আদ্রিয়ান। রোদ তাকাতেই সুন্দর করে একটা হাসি দিলো।
রোদ ওর দিকে তাকিয়েই বললো,
— হাসছেন কেন?
— যার এত সুন্দর বউ সে হাসবে না তো কে হাসবো?
বলতে বলতে রোদের গা ঘেঁষে পেছনে বসলো। হাতে নেয়া চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়াতে লাগলো। রোদ কথায় কথায় বললো,
— আমি একটা নিউ হেয়ার কাট দেখেছি। কাল পরশু যেয়ে কেটে আসবো। মেডিক্যাল থেকে চলে যাব।
হাত থামিয়ে দিলো আদ্রিয়ান। চুলের ভাজে আটকা পড়লো চিরুনি। একটু টান লাগাতে রোদ “উহ” শব্দ করলো। আদ্রিয়ান রাগী কন্ঠে বললো,
— কোন চুল কাটা হবে না।
বলেই আবার আচড়াতে লাগলো। রোদ ভ্রু কুচকে বললো,
— কেন হবে না। একশত বার হবে। কালই যাব।
— এ ব্যাপারে আর কোন কথা হবে না।
বলে বেনুনি করে দিলো চুলে। রোদ নিজের জেদ বজায় রেখে বললো,
— হ্যাঁ এ ব্যাপারে কোন কথা হবে না সোজা চুল কাটা কাটি হবে।
— রোদ না বলেছি।
— আপনি জানেন কয় বছর ধরে চুল কাটা হয় না আমার। শুধু নিচের দিকে সমান করতে দিতো আম্মু তাও বছরে তিন বার। তাইতো এবার কাটবো। নিউ হেয়ার কাট।
আদ্রিয়ান মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনলো। পেছনে থেকেই জড়িয়ে ধরে বললো,
— নিউ কাটের তো কোন দরকার নেই তুমি এমনই সুন্দর রোদ।
— কিন্তু আমি কাটব।
বারবার বলার পরও রোদের ত্যারামি সহ্য হচ্ছে না আদ্রিয়ানের। শক্ত হাতে ওকে চেপে ধরলো। রাগী কন্ঠে বললো,
— এই না বলেছি না। কাটবি না মানে কাটবি না।
রোদের মেজাজ নিমিষেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কি হবে কাটলে?আদ্রিয়ানের হাত আলগা হতেই সরে গেল রোদ। উঠে যেয়ে একটা বই নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। আদ্রিয়ান দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। এই আছে জীবনে? বউ রাগ করবে আর ও ভাঙাবে। মেয়েটা বুঝে না কেন আদ্রিয়ানের যে ওর চুলগুলো অনেক পছন্দের?
অনেকক্ষণ পরে ব্যালকনিতে গেল আদ্রিয়ান। পা উঠিয়ে বসে বসে পড়ছে রোদ। পাশে বসলেও তেমন পাত্তা দিলো না রোদ। আপাতত সে হৃদপিণ্ডের সংবহন পড়তে ব্যাস্ত। আদ্রিয়ান ওর দিকে ঘেঁষে বসলো। রোদের কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো। কেউ কাউকে কিছু বললো না। অনুভব যেখানে অনুভূতি প্রকাশ করে মুখ হতে উচ্চারিত ধ্বনি নিছক শব্দ।
বেশ কিছুক্ষন নীরবতা পালন করে আদ্রিয়ান বললো,
— বউ?
— হু।
–রাগ করেছো?
— করলেই কারো কি?
— শুনো না।
বলে ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। কপাল চুমু খেয়ে বললো,
— তোমার চুল গুলো আমার পছন্দের রোদ। কেটো না প্লিজ।
— ধমকানোর পর এই অনুরোধ করার কোন দরকার নেই। কাটবো না।
— রেগে আছো?
— জানিনা।
আদ্রিয়ান রোদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে একটু বেশিই ভালোবাসে আদ্রিয়ান। ওকে জড়িয়ে ধরে সময় নিয়ে ঠোঁটে চুমু খেল।
______________
রাদ রুমে ডুকে দেখলো জাইফা এখনও ঘুম। মেডিসিন এ ঘুমের ঔষধ ও ছিলো তাই এই ঘুম। রাদের ফোন বাজতেই তা রিসিভ করলো রাদ। পুলিশ স্টেশন থেকে এসেছে। ওপাশ থেকে পুলিশ জানালো,
— এর আগেও রাফি নামক এই ছেলের নামে অসংখ্য কেস রয়েছে। ওর সাথের গুলোকেও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিবার প্রমানের অভাবে বেঁচে যেত কিন্তু এবার পুলিশ হাতে নাতে ধরায় আর বাঁচার সুযোগ নেই।
রাদ কথা শেষ করে কল কাটলো। জাইফার পাশে যেয়ে বসলো। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই যেন মেয়েটার প্রতি টান অনুভব হচ্ছে। হয়তো বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে জড়ানোর জন্য। জাইফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো রাদ। কাল যদি ঠিক সময়ে না পৌঁছাতে পারতো এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু হয়ে যেত।
#চলবে….
#ভালোবাসার_ভিন্ন_রুপ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৬(বর্ধিতাংশ)
জাইফার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার অনেক পরে। উঠতেই যেন মনে পরলো কি হয়েছে তার সাথে। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেছে প্রাপ্তির হাসি। সাথে মনে পরলো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মুহূর্তের মধ্যে মনে পরলো সে খুব বাজে ভাবে ঠকিয়েছে রাদকে। এমন সময় রাদ রুমে ডুকলো। লাইট অন করতেই দেখলো জাইফা বসে একমনে কিছু ভাবছে। রাদ এগিয়ে গিয়ে বসলো ওর পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— খারাপ লাগছে?
— না।
— উঠো তো দেখি। ফ্রেশ হও। নিচে যাবে আসো। তোমার একমাত্র দেবড় বসে আছে তোমাকে দেখার জন্য।
— রুদ্র?
— হুম।
জাইফাকে উঠতে সাহায্য করলো রাদ। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই রাদ ওর মুখ মুছিয়ে দিলো। জাইফা নিজের চুল বেঁধে নিলো। গায়ে ওরনা পেচিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাদ ওর হাত ধরে আসস্ত করলো। দুজন নিচে নামতেই দেখলো এক গাদা পোলাপান নিচে। সবগুলোই রাদের কাজিন। এগুলোকে খবর দিয়েছে রুদ্র। তার ভাই বিয়ে করেছে বলে কথা। জাইফা এত মানুষ দেখে বিব্রত বোধ করলো। রাদ ওর হাত শক্ত করে ধরে বললো,
— সব কাজিন। চলো।
ওরা আসতেই হোই হুল্লোড় লেগে গেল। সে কি কান্ড একেকজনের। সবাই খোঁচাচ্ছে রাদকে। দিশা আফসোস করে বললো,
— ভাইয়া। কি হলো বলো তো। তোমার দুই ভাই বোন কি শুরু করলা। হুট করেই বিয়ে করে নিলা?
তিশা জাইফার পাশে বসে বললো,
— আমার কিন্তু ভাবীকে অনেক পছন্দ হয়েছে।
জাইফা হালকা হাসলো।চাচি এসে বললো,
— কিরে রাদ পছন্দ ছিলো বললেই হতো আমরা কি না করতাম। যাক রাগ করি নি বউ মাকে আমাদের পছন্দ হ’য়েছে।
বলেই মোটা দুটো চুড়ি পড়িয়ে দিলো। কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— সুখে থেকো মা। তোমার চাচা শশুর কাল আসবে।
সবাই মিলে সে কত কথা শুরু করলো। এরমধ্যেই রাদের মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে বললো,
— সবগুলো খেতে আয়। সন্ধ্যা হয়েছে কখন।
বলে নিজে এক প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে জাইফার সামনে বসে ওর মুখের সামনে ধরলো। জাইফা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এমন ও পরিবার হয়? সবার কত মিল অথচ জাইফার মা সবসময় শুধু নিজের ভাইদের টান টানে। রাদের মা হেসে বললো,
— কিরে মা কি ভাবিস? খেয়ে নে। এই বাদর গুলোর পাল্লায় পড়লে আর খাওয়া হবে না।
বলে খাওয়াতে লাগলেন। যে রুদ্র সবাইকে ডেকে আনলো সে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। রাদ খেয়াল করে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কিরে পুরো গ্যাং উঠিয়ে বাড়ি আনলি তুই আর এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
রুদ্র টলমলে চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে। দুই ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য ১২ বছর হলেও মিল অনেক। তিন ভাই বোন জান একেকজনের। রুদ্র রাদের এক কাঁধ জড়িয়ে ধরলো । রাদের মনটাও খারাপ হয়ে গেল। দুই জনই জানে কেন এমন লাগছে বলতে হয় নি। রাদ রুদ্রকে বললো,
— দাঁড়া কল দেই।
রুদ্র লাফিয়ে উঠলো। ঝটপট বললো,
— তাড়াতাড়ি দাও। মিষ্টিকেও আনতে বইলো।
— আগে তো রাজি হোক। গাঁধা।
রাদ আদ্রিয়ানকে কল দিয়ে বললো যাতে রোদকে নিয়ে আসে। আদ্রিয়ান বললো,
— ওর তো শরীর ভালো না রাদ। দুপুরেও মাথা ব্যাথা ছিলো।
— কি? এখন কেমন আছে?
— আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু জার্নি করলে যদি আবার বেড়ে যায়।
— হুম। রুদ্রর মন খারাপ ছিলো তাই বললাম। কাল নাহয় ওকে নিয়ে আসবেন।
— চেষ্টা করবো।
— আল্লাহ হাফেজ।
বলে কল কাটলো রাদ। রুদ্রর মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। রাদ ওকে সান্তনা দিলো যে কাল আসবে।
____________
আদ্রিয়ানর পাশে চোখ ভর্তি পানি নিয়ে বসে আছে রোদ। সব শুনেছে ও। আদ্রিয়ান রোদকে দেখেই চমকালো। সব যে শুনে নিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। আদ্রিয়ান ভাবলো রোদ হয়তো কিছু বলবে কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে রোদ কিছুই বললো না চুপ করে উঠে চলে গেল। আদ্রিয়ান অবাক হয়ে গেল। হুট করে ডেকে বসলো,
— রোদ?
আদ্রিয়ানকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে রোদ জবাব দিলো,
— জ্বি।
আদ্রিয়ান কি বলবে ভেবে পেল না। রোদ নিজেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু বলবেন?
আদ্রিয়ান নিজেকে সামলে নিলো। রোদের আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল ডুবিয়ে বললো,
— রেগে আছো?
— না।
— মিথ্যা বলেছো?
— না।
— কিছু বলার নেই?
— আছে তো অনেক কিছু।
— জিজ্ঞেস করো?
আদ্রিয়ানকে অবাক করে দিয়ে রোদ ওর বুকে মুখ গুজে দিলো। আদ্রিয়ান ও জড়িয়ে ধরলো। রোদ বারবার ওর বুকে নাক, মুখ ঘষে দিলো। কেমন যেন শান্তি লাগে এই জায়গাটায়। আদ্রিয়ান ওর মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
— এবার বলো?
— উহু।
— তোমাকে চুপচাপ মানায় না রোদ। বলো আমাকে।
— জানি না তো কি বলবো। ভালোলাগে না ভাবতে। বারবার আম্মু,রুদ্র, ভাইয়া আর আব্বুর কথা মনে পড়ে। আমার বাসা,আমার ঘর, আমার পরিবার সব কেমন দূরে চলে যাচ্ছে। নিজের বাসায় যেতে পারি না আমি। যেখানে জীবনে এক রাত আম্মু ছাড়া ছিলাম না সেখানে দিব্যি মাস কাটিয়ে দিচ্ছি তাকে ছাড়া। রুদ্র ছাড়া, ভাইয়া ছাড়া কীভাবে থাকি আল্লাহ জানে। আমার ভাবতে দম বন্ধ লাগে। দেখুন ওরাও কেমন আমাকে আমার বাসায় যাওয়ার জন্য আপনার অনুমতি নেয়। হুট করেই পাল্টে গেছে সব।
আদ্রিয়ান এতক্ষণ শ্বাস আটকে সব শুনলো। ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হলো তার হৃদয়। বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি এখানে ভালো নেই রোদ?
রোদ আবারও মুখ ঘষলো। জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে বললো,
— উহুম। আপনি আছেন,ছোট্ট মিষ্টি আছে, পুরো পরিবার আছে। সবাই কত আদর করে। আপনাদের ছাড়া ইদানীং নিজেকে ভাবতে পারি না।
আদ্রিয়ান ওর মাথায় চুমু খেল। মেয়েটাকে কি বেশি কষ্ট দিয়ে দিলো? রোদকে বললো,।
— কাল যাবো ঠিক আছে।
……….
রোদ কিছু না বলাতে আদ্রিয়ান ও কিছু বললো না। রোদ নিজেই ছেড়ে দিলো আদ্রিয়ানকে। বই নিয়ে পড়তে বসলো। আদ্রিয়ান ওর গালে চুমু খেয়ে বললো,
— একটু বাইরে যাচ্ছি। কিছু আনবো?
— না। তাড়াতাড়ি আসবেন।
— আচ্ছা।
বলে চলে গেল আদ্রিয়ান। রোদও পড়ায় মনোযোগ দিলো। চাপ ইদানীং বেড়ে গিয়েছে পড়ার।
টানা ৩ ঘন্টা পড়ে কোমড় সোজা করে দাঁড়ালো রোদ। ঘাড়টা এদিক ওদিক করলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই মাথায় হাত। এশার আজান দিয়েছে ১ ঘন্টা আগে। তাড়াতাড়ি নিচে নামলো মিষ্টিকে খায়িয়ে ঘুম পাড়াতে হবে। এই মেয়েও দিন দিন পাজি হচ্ছে। সুযোগ পেলেই খাবার আর ঘুমে ফাঁকি দিবে। নিচে নামতো দেখলো বাসার সবাই একসঙ্গে বসে কিছু আলোচনা করছে। উপস্থিত নেই শুধু আদ্রিয়ান। জারবা অন্য পাশে আলিফ আর মিষ্টির সাথে কি করছে আল্লাহ জানে। শুধু ওদের হাসির আওয়াজ আসছে। রোদ বড়দের ওখানে না গিয়ে সোজা মিষ্টির ওদিক গেল। মিষ্টিকে আর আলিফকে নিয়ে বসালো টেবিলে। জারবা ও বসে বসে রোদের সাথে গল্প জুড়ে দিলো। রোদ মিষ্টি আর আলিফ দুজনকেই খায়িয়ে দিলো।
দূর থেকে জারা দেখে একটু হাসলো। কি হতো রোদের জায়গায় ও থাকতে? আদ্রিয়ান কেন ওকে ফিরিয়ে দিলো? জারা কখনো খারাপ চায় না আদ্রিয়ান আর মিষ্টির। মন থেকে ভালোবাসে সে আদ্রিয়ানকে। তাই তো রাজি হয়ে গেল বিয়ে করতে। যাতে সবাই ভালো থাকে কিন্তু মনটা মানতে চায় না। একবার সে শেষ সুযোগ নিয়েই ছাড়বে।
রোদ কখনো আদ্রিয়ানকে সম্পূর্ণ সুখ দিতে পারবে না। জারা শেষ চেষ্টা নিশ্চয়ই করবে।
__________
রাত প্রায় ১২ টা। আদ্রিয়ান এখনো আসে নি। রোদ দুবার কল দিলেই বললো, “আসছি”। কিন্তু আসার নাম গন্ধ নেই। বেডে হেলান দিয়ে পড়ছে রোদ। পাশে মিষ্টি ঘুম। এমন সময় আদ্রিয়ান রুমে ডুকে সোজা ওয়াসরুমে ডুকে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে সোজা রোদের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো। নিজের কপাল নিজেই টিপে বললো,
— বউ মাথা ব্যাথা করছে?
রোদ আলগোছে নিজের বই অফ করে পাশে রাখলো। হাত ডুবিয়ে দিলো আদ্রিয়ানের চুলের ভাজে। আলত করে টেনে টেনে দিলো। আরাম পেয়ে চোখ বুজে রইলো আদ্রিয়ান। প্রায় ১ ঘন্টার মতো ঘুমালো আদ্রিয়ান। নিশ্চিত অনেক ক্লান্ত। রোদ আস্তে করে ওর কপালে চুমু খেল। ফট করে চোখ খুললো আদ্রিয়ান। রোদ তড়িৎ বেগে সরে গেল। চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি না ঘুমাচ্ছেন?
আদ্রিয়ান আয়েশ করে কোলে মুখ গুজে শুয়ে বললো,
— ঘুমাইলেই সুযোগ নাও আমার৷
— আজব সুযোগ কেন নিব? আপনি কি বাইরের কেউ?
— নাতো। আমি তো তোমার একমাত্র জামাই।
— উঠুন। ১ টা বাজে। ক্ষুধা লেগেছে আমার।
এক লাফে উঠলো আদ্রিয়ান। রাগী কন্ঠে বললো,
— এই মেয়ে তুমি খাও নি এখনো?
— না। জামাই এর অপেক্ষা করছিলাম।
আর কি রেগে থাকা যায়? যায় না। তাই তো আদ্রিয়ান ও হেসে ওকে নিয়ে নিচে গেল। দুজন খেয়ে নিলো একসাথে। ভালোবাসা অব্যাক্ততার মধ্যে ও আছে এক অন্য সুখ।
#চলবে…..