ভালোবাসার ভিন্ন রুপ সারপ্রাইজ পর্ব-০১

0
124

#ভালোবাসার_ভিন্ন_রুপ
#সাইয়্যারা_খান
( সারপ্রাইজ পর্ব)

কেটে গেল রোদ আদ্রিয়ানের বিয়ের ৩ টি বছর। আদ্র এখন দেড় বছরের। সারাক্ষণ আআ উউ ইই আওয়াজ করতেই থাকে। আদ্রিয়ানকে দেখলেই বা বা বা অথবা পা পা পা আওয়াজ করবে। রোদ যে ওর মা তা ওর মা তা শুধু স্বার্থের জন্যই। ক্ষুধা লাগলেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে। এছাড়াও মাকে মনে পড়লেই তার মাকে দরকার। একবার যদি বাবাকে পায় তার আর দিন দুনিয়ায় হুস থাকে না। ঝাঁপ দিয়ে বাবার বুকে যাবে।
মিষ্টিকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। রোদ যেহেতু আগে থেকেই ওকে শিখাতো তাই মিষ্টি অনেকটা এগিয়ে। এখন থেকেই তার ইচ্ছে মায়ের মতো ডক্টর হবে যদিও তার মা এখনও ডক্টর হয় নি।
আদ্রিয়ান ইদানীং অনেক ব্যাস্ত। নিজের কাজের পাশাপাশি এখন বাবার বিজনেস ও দেখতে হচ্ছে। বাবা কিছুটা অসুস্থ এখন। আরিয়ানও হেল্প করছে। কিছু করার নেই। হাজার ম্যানেজার থাকুক এতবড় বিজনেস তো আর ফেলা রাখা যায় না মালিক ছাড়া। দুই ভাই মিলে কিছুটা করে সময় দিচ্ছে ওখানে।

রোদের জীবন এখন কেমন চলছে রোদ নিজেও জানে না। সংসার, বাচ্চা, স্বামী আর পড়াশোনা ব্যাস জীবন শেষ। এর বাইরের দুনিয়াও আজ কয়েক মাস ধরে অজানা। রোদের বয়সের মেয়েদের এখনও বিয়ে হয় নি অথচ রোদ দিব্যি স্বামী, সংসার, বাচ্চাদের সামলাচ্ছে। যে কেউ ওর অবস্থা দেখলে ভাববে এই মেয়ে হয়তো নাহলেও ১০ থেকে ১২ বছর ধরে হয়তো সংসার করছে। বিয়ের ৩ বছরেই নাজেহাল অবস্থা রোদের।

আদ্রকে বুকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো রোদ। কেঁদে অস্থির এই ছেলে। ওর সমস্যা হলো মা কেন খাওয়ালো। ও এখন খেত না। রোদ ওর কান্না থামাতে চেষ্টা করতে লাগলো। আদ্র নিজের সামনের উপরে নিচে মিলিয়ে তিনটা দাঁত দিয়ে দিলো মায়ের কাঁধে কামড়। ব্যাথায় মুখ খিঁচে রাখলো রোদ। বাচ্চাদের মাড়ীর আর ছোট দাঁতের কামড়ে অনেক ব্যাথা। মায়ের ব্যাথিত মুখ দেখেই খারাপ লাগলো বোধ হয় আদ্রর। নিজের ছোট ছোট আঙুল ছুঁয়ে দিলো মায়ের মুখে সাথে আমমা আআমা আওয়াজ করতে লাগলো। মুখ গোল করে আবার চোখা করতে লাগলো।
রোদ হেসে চুমু খেল তাতে। আদ্র লালা ভরিয়ে দিলো মায়ের গালে। রোদ হেসে চুমু খেয়ে বললো,

— ওরে আমার বাবা, মাকে আর কত আদর করবেন হুম? মা ব্যাথা পাই নি তো।

শুনে মনে হয় খুশি হলো আদ্র। খুশির ঠেলায় বমি করে দিলো মায়ের বুকে। রোদ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। ছেলের পোশাক পাল্টে মুখ, হাত, পা হালকা গরম পানি দিয়ে মুছে দিলো। খাটের মাঝ খানে শুয়িয়ে দুপাশে বালিশ দিয়ে ড্রেস নিয়ে ওয়াসরুমে ডুকলো। পুরো চেঞ্জ করতে হবে। একদম বুকে বমি করেছে এই ছেলে। দুষ্ট আদ্র থেমে নেই। সে এখন হামাগুড়ি দিতে পারে। নিজের কেরামতি দেখাতে ডিগবাজি দিয়ে বালিশ নামক বাংলাদেশ বর্ডার পাড় করলো সে। একদম খাটের কিনারে চলে গেল। আর একটু শুধু এদিক ওদিক হলেই পড়ে যাবে আদ্র।
আদ্রিয়ান মাত্রই বাসায় আসলো। সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ডুকতেই বুকে যেন শ্বাস আটকে গেল। হাতের ব্যাগ ফেলে দৌড়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো ছেলেকে। একটুর জন্য, শুধুমাত্র একটুর জন্য কি হয়ে যেত ভাবতে পারলো না আদ্রিয়ান। আদ্র বাবার কাঁধে লালা দিয়ে ভরে তুললো।ছেলের মুখটা তুলে অজস্র চুমু খেল। আদ্র বাবাকে দেখেই খুশিতে “বা বা বা ” আওয়াজ করতে লাগলো। আবারও মুখ দিয়ে লালা পরতেই আদ্রিয়ান তা হাত দিয়ে মুছে চুমু খেল।

রোদ বের হয়েই দেখলো আদ্রিয়ান এসেছে। কিছু বলার আগেই ধমকে উঠলো আদ্রিয়ান। কেঁপে উঠল রোদ। নাকের পাটা ফুলে উঠলো। ঠোঁট তিরতির করে কাঁপতে লাগলো। চোখ জ্বলতে লাগলো ওর কিন্তু কাঁদলো না রোদ। কার সামনে কাঁদবে ও? আদ্রিয়ানের সামনে? যেই মানুষটার জীবন ইদানীং রোদের ভূমিকা কি তাই বুঝতে পারে না রোদ। আদ্রিয়ান ধমকে বললো,

— কোথায় ছিলে তুমি? ওকে একা রেখে কিভাবে যাও বুঝি না আমি? এখনই তো বিছানা থেকে পড়ে যেত ও। কি হতো তখন? ড্রেস পড়ে চেঞ্জ করা যেত না?

রোদ কিছু বললো না। চুপচাপ আদ্রিয়ানের ড্রেস বের করে ওয়াসরুমে রাখলো। এই ধমকানি এখন শুধু বুক কাঁপায়, মন কাঁদায় কিন্তু চোখ কাঁদে না। ঐদিনও ধমকালো আদ্রিয়ান কারণ ছিলো রোদ আদ্রকে একটু ধমক দিয়ে বলছিলো, ” আল্লাহ থাম এবার। চুপ থাক। খাচ্ছিস না কেন?” ব্যাস আদ্রিয়ান রোদকে দিলো কয়েকটা রাম ধমক।
আবার ঐ দিন রোদের পরিক্ষা ছিলো সারাদিন ওর শাশুড়ী সামলালেও বিকলে গলা ফাটিয়ে কেঁদে যাচ্ছিলো আদ্র। রোদ বাড়ী ফিরেই বুকে নিয়ে রুমে এলো। ক্লান্ত রোদ কোনমতে ছেলেকে খায়িয়ে ফ্রেশ হতে গিয়েছিলো মিষ্টিকে পাশে বসিয়ে। আলিফ ডাকতেই মিষ্টি যায় ওর সাথে। আদ্রিয়ান রুমে ছেলেকে একা ফ্লোরে খেলতে দেখেই ধমকেছিলো রোদকে। কিছুই বলে নি রোদ। না গাল ফুলিয়ে রেখেছিলো আগের মতো। রাগ ভাঙানোর মানুষ কই?
আগের মতো যেন এখন আর কিছুই নেই। বদলে গেছে সময় বদলে গেছে আদ্রিয়ান, বদলে গেছে রোদের জীবন।

আদ্র গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো। আদ্রিয়ান বুকে নিয়ে থামালেও থামলো না ও। রোদ এগিয়ে এসে অনুরোধের সুরে বললো,

— আমাকে একটু দিবেন? ক্ষুধা লেগেছে ওর। খায়িয়ে দিই?

আদ্রিয়ানের যেন কেমন লাগলো এই কথা। একজন মা হয়ে রোদ কিভাবে নিজের সন্তানকে চাইছে? আদ্রিয়ান আদ্রকে দিলো। রোদ কিছু না বলে ফিডিং করাতে লাগলো। খেতেই শান্ত হলো আদ্র। ঘুমিয়ে যেতেই রোদ ওকে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। এমন সময় মিষ্টি নড়েচড়ে উঠলো। রোদ আবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মিষ্টি আবারও ঘুমিয়ে গেল। রোদ উঠে এসে বললো,

— চেঞ্জ করে আসুন। খাবার নিয়ে আসি আমি।

আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে বললো,

— বসো একটু।

রোদ বসলো। আদ্রিয়ান যেন কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না। আদ্রিয়ানের জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো, “কেমন আছো রোদ তুমি? ” কিন্তু সাহস পেল না করতে হয়তো উত্তর জানা আদ্রিয়ানের। রোদ একটুপর অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,

— খেতে চাইছিল না ও। খাওয়াতেই কেঁদে কেঁটে বমি করে দিয়েছিলো বুকে। ওকে ফ্রেশ করিয়ে দুই দিকে বালিশ দিয়ে চেঞ্জ করতে গিয়েছিলাম। কিভাবে যে কর্ণারে এলো?

থেমে উঠে গেল রোদ। আর কিছু বলার নেই ওর। জীবনে কি হচ্ছে ওর নিজেরও জানা নেই। সব এলেমেলো সব৷ ভালোবাসাতেও যেন মরিচা ধরে গিয়েছে। রোদ মাঝে মধ্যে ভাবে, “ভালোবাসা হলো না পাওয়া স্বপ্নের মতো হাতে পেলেই মূল্য শেষ।” উদাহরণ হিসেবে রোদ নিজেকে দেখে। খাবার নিয়ে রুমে এলো রোদ। আদ্রিয়ানকে সব গুছিয়ে দিয়ে বই নিয়ে বসলো। এই তো আর মাত্র ১ বছর এরপর ইনর্টারনিং তারপরই রোদ হয়ে যাবে ডক্টর রোদ। ভাবতে ডাক দিলো আদ্রিয়ান,

— রোদ?

— জ্বি৷ কিছু লাগবে?

— খেয়েছো?

— হুম।

আদ্রিয়ান কিছু বললো না। কি বলবে ভেবে পেল না। আজ ঠিক কতদিন, ওহ্ দিন না মাস ঠিক মত কথা হয় না রোদের সাথে। ভাবতেই প্লেটে ভাত মেখে রোদের মুখের সামনে ধরলো। রোদ অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

— বললাম তো খেয়েছি।

— হা করো।

রোদ কথা বাড়ালো না। নিজেকে বেহুদা মনে হয় ইদানীং। এই বেহুদা রোদকে খায়িয়ে দিবে ভাবতেই লোভ লাগলো। মুখ খুলে খেয়ে নিলো। আদ্রিয়ান জানে রোদ খায় নি। আদ্রিয়ানকে ছাড়া খায় না ও। খাওয়া শেষ হতেই রোদ সব গুছিয়ে এলো। আদ্রিয়ানের মেডিসিন দিলো। আদ্রিয়ান একহাতে আদ্রকে বুকে নিয়ে পিঠে আলত করে চাপড় দিচ্ছে অন্য হাত মিষ্টির মাথায়। রোদের মনে পরলো নিজের বাবা,মা, ভাইদের কথা। রাদ, রুদ্র এসে এসে দেখে যায়। কতবার অভিমান করে রুদ্র বলে,

— আপি তুমি এবার বাসায় না চললে খাব না আমি, পড়বো না সহ কত কি।

রোদ ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝায়। আজ প্রায় ছয় মাস প্রায় গৃহ বন্দি রোদ। বাড়ী টু ম্যাডিকেল আর ম্যাডিকেল টু বাড়ী। এই জীবন। ধীর পায়ে হেটে আদ্রিয়ান সামনে দাঁড়ালো রোদ। কিছুটা জড়তা কাজ করলো কথা বলতে। ভাবা যায় রোদের ও কিনা আদ্রিয়ানের সাথে জড়তা কাজ করে? রোদ তবুও ডাকলো,

— ঘুমিয়েছেন?

চোখ খুলে তাকিয়ে আদ্রিয়ান বললো,

— না। কিছু বলবে?

— একটু বাসায় যেতাম। দুই দিনই থাকবো। বাচ্চাদের খেয়াল রাখব আমি।

কেমন করে বললো রোদ? ভাবলো আদ্রিয়ান। এ যেন কোন অসহায় কর্মচারী মালিকের কাছে ভয়ে ভয়ে কোন আবদার করছে। আদ্রিয়ান ভাবলো ঠিক কবে ভালোমতো কথা হয়েছে তার রোদের সাথে? এক মাস, দুই মাস ঠিক কতমাস? আচ্ছা বয়সের পার্থক্যের জন্যই কি এমন হলো? রোদ কি সংসার জীবনে ত্যক্ত? এরমধ্যেই আদ্র কাঁদলো। রোদ আবারও ফিডিং করাতে লাগলো। ছেলেটা খাবে আর বমি করবে। আদ্রিয়ান আজ তাকালো রোদের দিকে অনেক মাস পর।এতদিন তাকালেও দেখে নি ভালোমতো। কে বলবে ২২ বছরের যুবতী এই রোদ?
নাদুসনুদুস রোদ এখন শুকিয়ে আছে, গোলগাল মুখটার চাপা ভেঙে আছে, চোখের নিচে কালি পড়ে আছে, গলায় ছোট একটা স্থানে র*ক্ত জমে আছে যা আদ্রের করা জানে আদ্রিয়ান। লম্বা চুল গুলো অগোছালো। চিকন আগা বেরিয়ে আছে, মুখের উজ্জ্বলতা ডেকে গিয়েছে, ঠোঁট গুলো অযত্নে আজ শুষ্ক হয়ে আছে। কলার বোন বেরিয়ে আছে। আগের তুলনায় বেশি কাহিল লাগে ওকে দেখতে।

এ বুঝি রোদ? আদ্রিয়ানের রোদ? এ কি অবস্থা তার রোদের? নিজের বুকে যত্নে ফুটানো ফুলটা আজ অবহেলায় নেতিয়ে আছে আদ্রিয়ানের সামনে।নিজের কাজের পাশাপাশি বাবার বিজনেস সামলাতে আদ্রিয়ান এতটাই ব্যাস্ত যে রোদের দিকে তাকানোর সময়টাও হয় না। বাসায় আসলেও বাচ্চাদের নিয়ে পড়ে থাকে।
এই রোদকে পেতেই একদিন রোদের বাবার পায়ে ধরেছিলো আদ্রিয়ান। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বুক কেঁপে উঠতো এই বুঝি রোদ চলে যায়? কতশত ভালোবাসা এই রোদকে ঘিরে।
আদ্রিয়ান কি বলবে ভেবে পেল না। কি করেছে ও নিজেও জানে না? যে রোদ নিঃস্বার্থ ভাবে আদ্রিয়ানকে সব দিয়েছে সেই রোদই আজ অবহেলিত। কত দিন ভালোবেসে কাছে টানা হয় না? আজ ঠিক কত দিন ঠোঁটে ঠোঁটে কথা হয় না? ঠিক কত দিন বলা হয় নি ওকে যে ভালোবাসি রোদ? আদুরে ভাবে আজ কত দিন ধরে বুকে ডুকে না রোদ? এই ছোট্ট রোদটা আজ যুবতী। যেখানে সাবার জীবন শুরু হয় সেখানে তার রোদের বুঝি শেষ। কিভাবে পারলো আদ্রিয়ান? এই ক্লান্ত রোদকে দেখলেই মনে হচ্ছে হয়তো ছুঁলেই ঝড়ে যাবে।

আদ্রকে রাখতেই আদ্রিয়ান ডাকলো,

— রোদ?

— জ্বি।

— কাছে আসো একটু।

রোদ বারান্দার দরজা অফ করে দিলো। আদ্রকে দোলনায় শুয়ে দিয়ে বললো,

— মিষ্টিকে জারবার রুমে দিয়ে আসুন।

আদ্রিয়ান থ হয়ো গেল। ও তো শুধু চাইছিলো রোদ একটু বুকে আসুক। কত দিন বুকে নেয়া হয় না ওকে। আদ্রিয়ানকে নড়তে না দেখে রোদ বললো,

— তাড়াতাড়ি করুন আবার আদ্র উঠে যাবে।

বলেই নিজের চুলে খোপা বাঁধলো রোদ। আবারও তাড়া দিয়ে বললো,

— কি হলো? জলদি করুন।

আদ্রিয়ানের বুক ধক ধক করছে। এ কোন রোদের জন্ম দিলো ও? লজ্জায় ঘেরা রোদটা কোথায়? কোথায় গেল আদুরে আদুরে কথা বলা সেই রোদ? কোথায় তার ছোট্ট বউটি? বাইশ বছরের রোদ কেমন হয়ে গেল?
রোদ আবারও তাড়া দিতেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলো। রোদ কোন হেলদুল ছাড়া বললো,

— মিষ্টিকে রেখে আসলে ভালো হতো।

— রোদ!

বলে দুবাহু ধরে ঝাকালো আদ্রিয়ান। রোদ কিছু বললো না। আদ্রিয়ান ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেয়ে বললো,

— এই রোদ? এভাবে কেন বলছো? আমি তো শুধু তোমাকে বুকে নিতে চাইছিলাম আর কিছু না।

— ওহ্।

ছোট্ট করে উত্তর দিলো রোদ। আদ্রিয়ান ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— এই রোদ এমন করছো কেন? কথা বলো ঠিক করে। রেগে আছো তুমি?

রোদ আস্তে করে বুক থেকে সরে গেল। উঠে যেতে যেতে বললো,

–বারান্দার দরজা তাহলে খুলে দেই?

আদ্রিয়ান টেনে ওকে বসিয়ে বললো,

— আল্লাহর দোহায় লাগে রোদ এমন করো না। ঠিক মতো কথা বলো।

মৃত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো রোদ,

— কি বলবো? শুনার সময় হবে আপনার?

— কেন হবে না রোদ? অবশ্যই হবে।

রোদ আদ্রিয়ানের গালে নিজের এক হাত দিয়ে বললো,

— কি বলবো আমি বলুন? নিজেকে বেহুদা মনে হয় ইদানীং। অস্তিত্ব আছে কি না নিজের তাও বুঝি না। বিগত ছয় মাসে ছয়বারও তাকিয়েছেন আমার দিকে বলুন?যতবার ডেকেছেন এসেছি। প্রয়োজন মিটিয়েছি আপনার হোক বেডে অথবা অন্য কোথায়। আপনি তো জানেন আপনার বুকে ঘুমানোর বদ অভ্যাস আমার তবুও বিগত ছয় মাসে একবার বুকে নিয়েছেন আমায়? প্রয়োজন শেষ হলেই উঠে যান। আমার সুবিধা অসুবিধা দেখেন একবারও। নিজেকে আপনার জন্য করা বৈধ রাস্তার মেয়ে মনে হয় আমার। ডাকলেই এসে পড়ি।
পড়াশোনা করে কোন কূল পাচ্ছি না আমি তার মধ্যে ছেলেটা ইদানীং সারাক্ষণ কাঁদে।খাওয়াতে ঘন্টা পার হয়ে যায়। মিষ্টির পড়াশোনা সহ এই সংসারের দায়িত্ব। নিজের বাবার বাড়ী যাই না আজ ছয় মাস। কত রাত আপনার অপেক্ষায় না খেয়ে ছিলাম কিন্তু আপনাকে আমি বলতাম খেয়েছি আপনিও বিশ্বাস করতেন। কেন আপনি কি জানেন না রোদ আপনাকে ছাড়া রাতে খায় না?আজ ছয় মাস পর মুখে রাতে খাবার তুলে দিলেন। আজ খেলাম। বিগত ছয় মাস আমি রাতে খাই না আদ্রিয়ান। আর কি বলব আমি? শেষ হয় না তো আমার কথা। ঘুমান আপনি। লাইট অফ করে আসি।

বুক মোচড়ে উঠলো আদ্রিয়ানের।আদ্রিয়ান দম আটকে সব শুনলো। আজ এই প্রথম রোদ ওর নাম মুখে উচ্চারণ করলো। হ্যাঁ “আদ্রিয়ান” বললো রোদ। আর কি বললো, “বৈধ রাস্তার মেয়ে?” আদ্রিয়ান প্রয়োজন মিটায়? বুকে নেয় না? আচ্ছা রোদ আজ ছয় মাস রাতে খায় না? আদ্রিয়ান কি একবারও বুঝলো না? নাকি বুঝার চেষ্টাই করে নি?
কাজের ব্যাস্ততা দিনশেষে বাচ্চারা। রোদকে সময় দেয়া হয় না। না ভালোকরে কথা বলা হয়। রোদ ওর কাছে কাঁদে ও না। কত ধমকায় ছেলেকে নিয়ে। তবুও কাঁদে না রোদ। বুকে মুখ গুজে থাকে না। গলায় মুখ ঘষে আদুরে আবদার করে না।
আদ্রিয়ানের কি বুঝা উচিত ছিলো না রোদ এই প্রথম মা হয়েছে। কিভাবে বাচ্চা পালে আদৌও কি রোদ জানে?

আদ্রিয়ান ঝাপটে ধরলো রোদকে। চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে খামচে ধরলো। একহাত পিঠে জোরে চেপে ধরলো। রোদ ধরলো না। আদ্রিয়ান কেঁদে ডাকলো,

— রোদ?

— জ্বী।

একদম স্বাভাবিক উত্তর। কেঁপে উঠল আদ্রিয়ান। আরেকটু বুকে নিয়ে বললো,

— এই রোদ কাঁদো না কেন? একটু কাঁদো। এই যে এই বুক ভাসিয়ে দাও৷

— কান্না আসে না। ছয় মাসে বালিশগুলো সব পানি শুষে নিয়েছে।

আদ্রিয়ানের গলায় কান্না আটকে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,

–সোনাপাখি আমার বুকে ব্যাথা করছে। দেখো তো একটু রোদ। কেমন যেন লাগছে। কষ্ট হচ্ছে।

ধরফরিয়ে উঠলো রোদ। কিন্তু সরতে পারলো না। আদ্রিয়ান জোরে ধরে আছে। রোদ ছাড়তে বললেও ছাড়লো না। বুকে ডুকাতে চাইছে বারবার। ব্যাথা পাচ্ছে রোদ এত শক্ত করে ধরে আছে। চুল গুলো ছিড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। রোদ তবুও বলতে লাগলো,

— এই আপনি মেডিসিন নেন নি? আমি না দিলাম? ছাড়ুন।

— ছাড়বো না। দেখ না বুকে কি হলো? এত ব্যাথা করছে কেন। উফ রোদ অনেক ব্যাথা করছে সোনাপাখি।

“সোনাপাখি” ডাকটা শুনে জোরে কেঁদে উঠলো রোদ। কত মাস পর এই আদুরে ডাক শুনলো। কেঁদে কেঁদে বললো,

— দয়া করে ছাড়ুন। কিছু হয়ে যাবে। মেডিসিন নিতে হবে। ছাড়ুন একটু প্লিজ।

— রোদ?

— হ্যাঁ হ্যাঁ। শুনছি তো। আল্লাহ আমি কি বললাম? ছাড়ুন না আপনি।

— বুকে ব্যাথা করছে সোনা। দেখনা একটু?

অনেক কষ্টে ছাড়ালো রোদ। তাড়াতাড়ি মেডিসিন খাওয়ালো। মুখে পানি দিলে কিছু পানি মুখ থেকে পড়ে গেল৷ কেমন করে যেন ঠোঁট নাড়ালো আদ্রিয়ান। এমন করলে যে কোন মুহূর্তে স্ট্রোক করবে।
রোদ জোরে কেঁদে উঠলো। আদ্রিয়ানের বুকে হাত দিয়ে ডলতে লাগলো। আদ্রিয়ানের চোখ দিয়ে পানি পরছে। রোদ তা মুছিয়ে দিলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর শান্ত হলো আদ্রিয়ান। বুক ব্যাথা কমেছে একটু এখন। রোদ ওকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে উঠলো। আদ্রিয়ান ও বুকে চেপে ধরলো। রোদ ওভাবেই বললো,

— মাফ করুন আমায়। আমি এমনতেই বলেছি। এখন আপনার কিছু হলে কি করতাম আমি?

রোদের কান্নায় আদ্রও জেগে কেঁদে উঠলো। আদ্রিয়ানের হুস নেই। ও রোদকে বুকে নিয়ে বসে রইলো।আদ্র আবার নিজেই ঘুমিয়ে গেল। আদ্রিয়ান রোদকে বুকে নিয়েই বললো,

— আমায় মাফ করো রোদ। আমি নিজের পাঁজরের হাড়ের খেয়াল রাখতে ব্যার্থ। তাকে এতটা নিচু ফিল করানোর জন্য মাফ করো আমায় সোনা। প্লিজ ছেড়ে যেও না। আমি মরে যাব। আর এমন হবে না।

— এভাবে কেন বলেন? কোথায় যাব আমি ? আপনার ভালোবাসার প্রগাঢ়তা বেশি তাই সামান্য অবহেলা সহ্য হয় নি। যদিও অতিরিক্ত ভালোবাসায় ডুবে থাকতে পারি অবহেলায় ও বেহায়া হয়ে থাকতে পারব।

— ভালোবাসি সোনাপাখি।

বলে সারা মুখ ভর্তি চুমু খেল আদ্রিয়ান। রোদ ও বললো,

— নিজের অস্তিত্ব থেকেও বেশি ভালোবাসি।

নিজেও আদ্রিয়ানের সারা মুখে চুমু খেল। আদ্র আবারও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। রোদ আস্তে করে আদ্রিয়ানকে হেলান দিয়ে শুয়িয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। থামলো না আদ্র। এই ছেলে সারারাত ঘুমায় না। একটু পরপরই কেঁদে উঠে। আদ্রিয়ান এসে কোলে নিয়ে হাঁটতেই ঘুমিয়ে গেল বাবার বুকে। আদ্রিয়ান ছেলেকে চুমু বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। লাইট অফ করে রোদের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। পরপরই গলায় চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরলো। রোদও আদুড়ে বিড়ালের মতো বুকে মুখ গুজে রাখলো। আদ্রিয়ান ওকে কোলে তুলে বিছানায় গেল। লাইট অফ করে একপাশে বুকে নিলো রোদকে আরেকপাশে বুকে মিষ্টি ঠিক বুকের মাঝখানে আদ্র তার পিঠে রোদের হাত। দৃশ্যটা দেখা গেলে হয়তো বুঝা যেত কতটা শান্তি, ভালোবাসা, আবেগ আর অনুশোচনা মিশানো এটাতে।

ভালোবাসা মানুষের জীবনে ভিন্ন ভিন্ন রুপে ধরা দিবে। প্রতি ঋতুতে নিজের রুপ বদলাবে। ভালোবাসার ভিন্ন রুপ রয়েছে। প্রতিটা রুপকেই গ্রহণ করতে হবে। যার ভালোবাসায় এক সময় সিক্ত হবে তার থেকে আঘাত পেলে ছেড়ে যাওয়া কোন সমাধান নয়। গ্রহণ করতে হবে এই ভিন্ন রুপকে। এটাই তো রোদ-আদ্রিয়ানের ভালোবাসার ভিন্ন রুপ।

[ সারপ্রাইজ নিয়ে এলাম। যতটুকু সময় ফাঁক ফোকর পেয়েছি লিখে ফেলেছি। আপনাদের এত্তো এত্তো ভালোবাসায় সিক্ত আমি। তাই এটা আপনাদের জন্য। ভালোবাসা অবিরাম]