ভালোবাসার রংবদল পর্ব-১৪

0
481

#ভালোবাসার_রংবদল
#পর্বঃ১৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

পুড়ে লালচে হয়ে যাওয়া আমার হাতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্র। কিছুটা সময় পর চুপচাপ বাহিরে চলে গেলেন। আমি বসে বসে রুমটা পর্যবেক্ষণ করছি। পুরো শুভ্র সাদা রঙে সাজানো। বিছানার চাদর,জানালার পর্দা থেকে শুরু করে দেয়ালের রঙ সব কিছুই শুভ্র রঙের। রুমটা ছোট্ট হলেও মন কাড়ার মতো সৌন্দর্য ঘিরে আছে। আচ্ছা এই রুমটা এতো সুন্দর করে সাজানোর পেছনে কি কোনো বিশেষ কারণ আছে!!!

প্রায় দশ মিনিট পর আদ্র হাতে কতো গুলো ব্যাগ নিয়ে রুমে আসলেন। চুপচাপ কোনো কথা না বলে ছোট টেবিলের উপর ব্যাগ গুলো রেখে খাবার বের করলেন। আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন কিন্তু কোনো কথাই বলছেন না। হঠাৎ করে আবার কি হলো ওনার!!

—”এতো তাড়াতাড়ি খাবার কিভাবে নিয়ে আসলেন?”

আদ্র আমাকে খাইয়ে দিতে দিতেই ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলেন-

—”অর্ডার করেছিলাম। এখানে এসেই দিয়ে গেছে।”

আর কিছু বললেন না উনি। আবারও পুরো নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেলো। উনি খাবারের প্লেট রেখে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলেন। আমি কিছুটা নেড়েচেড়ে বলে উঠলাম-

—”আপনি এমন চুপ করে আছেন কেন? কিছু কি হয়েছে?”

আদ্র আমাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বললেন-

—”হুশশ… কোনো কথা না এখন। চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো অনেক রাত হয়েছে।”

আমি আর কিছু বললাম না চুপ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলাম। এই লোকটার কখন কি হয় কিছুই বুঝি না আমি।

————————

ঘুমের মধ্যে হঠাৎ পায়ে কারও স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম আদ্র আমার পায়ের পাশে বসে মলম দিয়ে দিচ্ছে। আমি সাথে সাথেই উঠে বসে পরলাম। আদ্রর কে উদ্দেশ্য করে বললাম-

—”এতো রাতে না ঘুমিয়ে এ-সব কি করছেন আপনি!!”

আদ্র কিছু বললেন না মাথা নিচু করেই বসে আছে। একটু পর আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ওনার পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

—”সেই কখন থেকে আপনি চুপ করে আছেন। কি হয়েছে আপনার বলুন তো!”

আদ্র শীতল কন্ঠে বললেন-

—”আমি কখনো তোকে এভাবে দেখতে চাই নি শুভি। তোর কোনো ক্ষতি হোক এটা আমি কখনো চাইনি। আমাকে মাফ করে দিস শুভি।”

—”আরে কি বলছেন এসব!! এখানে আপনার তো কোনো দোষ নেই। আমার বেখেয়ালির জন্যই তো এমন হয়েছে। আপনি শুধু শুধু নিজেকে কেন দোষী ভাবছেন বলুন তো!!”

উনি কিছু বলছেন না। আমি কথা পাল্টানোর জন্য বললাম-

—”আচ্ছা এই রুমটা এতো সুন্দর করে সাজানো কেন??”

আদ্র আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-

—”সেটা সময় হলেই বলবো এখন না। চল ঘুমাবি এখন।”

———————

ঘুম থেকে উঠে পাশে আদ্রকে দেখতে পেলাম না। ঘড়ির কাঁটা এখন এগারোটা ছুই ছুই। হাতের পায়ের জ্বালা পোড়া এখন নেই বললেই চলে। আমি বিছানা থেকে উঠে রুমের বাহিরে গেলাম। দোতলা বাড়ি বেশ বড়ই দেখা যাচ্ছে। নতুন রঙ করা হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে কিন্তু রাতের অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যায় নি। জানালা দিয়ে বাহিরে চোখ যেতেই দেখলাম জায়গাটা অনেক সুন্দর। গাছপালা অনেক বেশি এখানে আর আশেপাশে অনেক বাড়িও আছে তবে এই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। আমি জানালার কাছে গিয়ে জানালার পাশের দেয়ালে হাত রাখার সাথে সাথেই পেছন থেকে আদ্র চেচিয়ে বলে উঠলেন-

—”শুভ্রতা ওইদিকে যাস না।”

আমি ওনার এমন চেচিয়ে কথা বলা শুনে চমকে পিছনে ফিরে গেলাম। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

—”কেন কি হয়েছে?”

আদ্র আমার কাছে এসে বললেন-

—”তোর হাত দেখ।”

আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হাতের তালুতে দেয়ালের সাদা রঙ লেপ্টে লেগে আছে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার হাতের ছাপ বসে গেছে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার মানে দেয়ালের রঙ আজ করেছে!! এইজন্যই এখনো শুকায়নি!!
আমি আদ্রর দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম-

—”সরি আসলে আমি বুঝতে পারিনি এই রঙ আজ করা হয়েছে। এখন কি হবে?”

আদ্র কিছুটা আফসোসের সাথে বললেন-

—”কি আর করার পিচ্চি বউ বিয়ে করলে এমনই তো হবেই।”

ওনার কথায় আমি গাল ফুলিয়ে বললাম-

—”দেখুন বার বার আমাকে পিচ্চি বলবেন না। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি।”

আদ্র আমার কথায় হাসতে হাসতে বললেন-

—”পিচ্চি বলবো না তো কি বলবো? দেখ কিভাবে অল্পতেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকিস।”

আমি রেগেমেগে জ্বলন্ত চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম-

—”আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন আদ্র। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”

উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন-

—”কেন কি করবি তুই?”

ওনার ভাব দেখে আমার রাগ তরতর করে বেরে গেল। কিছু না ভেবেই ওনার গায়ের কালো টি-শার্টের উপর আমার হাতে লাগানো রঙের ছাপ বসিয়ে দিলাম। ওনার কাছ থেকে দূরে সরে একটা বিজয়ের হাসি বললাম-

—”এখন ঠিক হয়েছে???”

আদ্র কিছু না বলে ওনার গায়ের টি-শার্টটা একটু উচু করে দেখলেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন-

—”বাহহ অনেক সুন্দর হয়েছে রে পিচ্চি। টি-শার্টটা এতোক্ষন খালি খালি লাগছিলো এখন একদম ঠিক আছে। আচ্ছা তুই একটু দাড়া আমি আসছি।”

এই কথা বলেই উনি বাসার বাহিরে চলে গেলেন। আর আমি ওনার কথা শুনে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষন বাদেই আদ্র আসলেন হাতে করে লাল আর নীল রঙ নিয়ে। আমার সামনে এসে লাল রঙের মধ্যে আমার হাত চুবিয়ে দিয়ে বললেন-

—”নে এবার যত ইচ্ছে বাচ্চাদের মতো করে খেলা কর পিচ্চি।”

আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আদ্র আমার হাত নিয়ে দেয়ালের যেখানে আমার হাতের ছাপ বসে ছিলো সেখানে আবারও আমার হাতের ছাপ বসিয়ে দিলেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওনার অদ্ভুত কাজকর্ম দেখে যাচ্ছি। লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে নাকি!! কি সব করছেন এই গুলা!! আমার হাতের কয়েকটা ছাপ বসিয়ে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে এবার ওনার হাত নীল রঙের মধ্যে চুবিয়ে ওনার হাতের ছাপও বসাচ্ছেন আমার হাতের ছাপের সাথেই। আমি এবার বিস্ময়ের সাথে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম-

—”কি করছেন এই সব পাগলের মতো?? দেয়ালটা নষ্ট করছেন কেন শুধু শুধু?”

আদ্র আমাকে দেয়াল থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে এসে বললেন-

—”এবার তাকিয়ে দেখ তো নষ্ট করেছি কি-না!!”

আমি দেয়ালের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুটা সময় তাকিয়ে খেয়াল করলাম দেয়ালটা আগের থেকেও অনেক সুন্দর দেখা যাচ্ছে। আমাদের হাতের ছাপ গুলো এই সাদা দেয়ালের মধ্যে খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। আমি একটা হাসি দিয়ে আদ্রকে বললাম-

—”খুব বেশি সুন্দর হয়েছে।”

——————

দু’দিন কেটে গেল এই বাসায় অথচ এখনো আমি বাসার বাহিরে বা ছাদে পা রাখিনি। আদ্র কড়া গলায় বলে দিয়েছেন-

—”বাহিরে কাজ চলছে এখন অনেক মানুষ তাই কাজ শেষ হওয়ার আগে বাহিরে যেতে পারবি না। আর এই রুম থেকেও প্রয়োজন ছাড়া বের হবি না। আমি এই কয়দিন বাসাতেই থাকবো তোর যা যা দরকার আমাকে বলবি।”

ওনার এমন কড়া হুকুম শুনে আমি এই রুমে বসে বসেই দু’দিন কাটিয়ে দিলাম। আদ্র বেশিরভাগ সময় এই রুমের বাহিরেই থাকে। বাড়ির কাজ খুব দ্রুত শেষ করতে চান উনি তাই কর্মীদের কাজে হেল্প করতেই সারাদিন উনি ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু সময় মতো এসে তিন বেলা আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে যায়। এটা কখনো মিস যায় না। আর আমি সারাদিন দীপ্তর সাথে ফোনে বকবক করি। মাঝে মাঝে আব্বু আর দিদুমনির সাথে ও কথা বলি। দীপ্তর কাছ থেকে শুনেছি আদ্রর আম্মু ওইদিনের পর আমাকে নিয়ে আর কোনো কথা বলেনি। এমন কি আমরা চলে আসার পরে-ও নাকি কিছু বলেননি।

রাত প্রায় নয়টা বাজে রুমে একা একা বসে দীপ্তর সাথে ফোনে কথা বলছি। তখনই হুট করে আদ্র রুমে এসে তাড়া দিয়ে বললেন-

—”শুভি তাড়াতাড়ি বাহিরে চল। ফোন রাখ পরে কথা বলিস দীপ্তির সাথে। আমার সাথে চল এখন।”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে টেনে রুম থেকে বাহিরে নিয়ে গেলেন। পুরো বাড়ি আসবাবপত্র দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। রান্নাঘর, ডাইনিং সব কিছুই একদম পরিপূর্ণ লাগছে। আদ্র আমার হাত ধরে দোতালায় একটা বড় বেড রুমে নিয়ে গেলেন। আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন-

—”দেখ তো শুভি কেমন হয়েছে? বারান্দাটা দেখ অনেক বড় করে দিয়েছে আর ফুল গাছ এনেছি।”

আমি মুগ্ধ হয়ে সব কিছু দেখছি। আসলেই আদ্র খুব সুন্দর করে বাড়িটা সাজিয়েছেন।

পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখে আবারও সেই ছোট্ট রুমটায় আসলাম। রুমের দরজার সামনে এসেই আমি থেমে গেলাম। দরজার পাশের দেয়ালে একটা নেমপ্লেটে “অনুভূতির ঘর” লেখা। আমি বিস্মিত হয়ে আদ্রকে জিজ্ঞেস করলাম-

—”এটা লেখা কেন এখানে??”

আদ্র আমাকে শান্ত গলায় বললেন-

—”যখন আমাদের অনেক মন খারাপ থাকবে বা অনেক বেশি খুশি থাকবো তখনই আমরা এই রুমে আসবো। আর এই রুমে থেকেই আমরা একে অপরের সাথে সব মন খারাপ আর ভালো লাগা ভাগাভাগি করে নিবো। তাই এই রুমের নাম দিয়েছি ‘অনুভূতির ঘর’। আর একটা কথা খুব ভালো করে মাথায়া ঢুকিয়ে নে শুভ্রতা। আজকের পর থেকে যদি কখনো আমার কাছে কিছু লুকিয়েছিস তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। মনে রাখিস কথাটা।”

আদ্রর এমন হুমকি শুনে আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললাম-

—”আচ্ছা মনে থাকবে আর কখনো এমন ভুল করবো না।”

———————

এখানে একা একা আমাদের দিন খুব ভালোই যাচ্ছে। আজ দু’দিন ধরে আদ্র অফিসে যায় আর আমি বাসায় একা থাকি। একটা কাজের মেয়ে আছে তবে সব সময় চুপচাপই থাকে। আদ্র বলেছেন কাল থেকে আমাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবেন। আদ্র আমার প্রতিটা জিনিসের খেয়াল রাখে। আমি না বলতেই সব বুঝে যায়।
আমি বাসায় একা থাকি এই জন্য উনি সব আমাকে কল দিয়েই রাখে। কাজ করলেও কানে ব্লুটুথ লাগে রাখেন। আর যখন কাজ না থাকে তখন এটা ওটা কথা বলেন। উনি নিজেও ফোন কেটেন না আর আমাকেও কাটতে দেন না। ওনার এক কথা আমি পিচ্চি মানুষ বাসায় একা একা ভয় পাবো। আর যদি বেখেয়ালিতে কিছু একটা হয়ে যায়!! ওনার এমন কথা শুনে অনেক রাগারাগি করেছিলাম কিন্তু লাভ হয়নি। আমাকে নিয়ে উনি এখন বড্ড বেশিই চিন্তা করেন।

চলবে…