ভালোবাসা একটা বাজি পর্ব-০৬

0
364

#ভালোবাসা_একটা_বাজি (৬)

আরিয়ানের মাথায় ঢুকছেনা। এরা এখনে কি করছে। আরিয়ান ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে-

-” আপনারা এখানে কি আমায় খুঁজতে এসেছেন? দেখুন হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি তাই এত কষ্ট করে আমায় খুজতে গেলেন কেন?

মিহিও নেমে আসে ততক্ষনে। ভদ্র লোকটি তখন বলে-

-” আরে না ইয়ং ম্যান তোমায় খুঁজতে আসিনি‌। এটা তো আমাদের বাড়ি তাই এসেছি। তুমি এখানে কি করছো?

আরিয়ান আর মিহির মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। এটা ওনাদের বাড়ি কি বলছে এসব? পাগল নাকি এনারা? মিহি বলে-

-” দেখুন আংকেল আন্টি আপনাদের কোথাও ভূল হচ্ছে। এটা আমার বাবা শফিক তাজওয়ার এর বাড়ি। আর এখন আমাদের বাড়ি।

মহিলাটি মৃদু হেসে বলে-

-” আমাদের তো আগে ঢুকতে দাও ভিতরে। এভাবেই দাড় করিয়ে রাখবে?

মিহি জিভ কেটে বলে-

-” সরি আন্টি আপনারা এসে ভিতরে বসুন। রাহেলা কই তুমি? মেহমানদের জন্য নাস্তা নিয়ে এসো। আর মাহি বাবুকে দিয়ে যাও এদিকে।

রাহেলা হলো মিহির সার্ভেন্ট এর নাম। সে মাহিকে নিয়ে আসলেই আরিয়ান তাকে কোলে নেয়। সবাই সোফায় বসে। আরিয়ান ঠান্ডা মাথায় বলে-

-” এবার বলুন আন্টি আপনারা কাকে খুঁজতে এসেছেন? এটা আপনাদের বাড়ি হলো কিভাবে?

ভদ্র লোকটি তখন বলে-

-” দেখো তোমরা কারা আমি ঠিক চিনতে পারছিনা। তবে আমি হলাম শহিদ তাজওয়ার আর উনি ( পাশের মহিলাটিকে দেখিয়ে) শায়েলা রহমান আমার ওয়াইফ। এই বাড়িটা আমাদের একার নয়। আমি এ বাড়ির বড় ছেলে আর শফিক হলো আমার ছোট ভাই। শফিকের বউ সাদিয়া। আজ থেকে বহুবছর আগে এ বাড়ি ছেড়ে আমরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো আমার রোগ নির্ণয় করা। আমি হার্টের প্রেশেন্ট ছিলাম। হার্টে রিং বসানো জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু এদেশের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসার ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই চিকিৎসা করানোর জন্য একমাত্র ছেলে আরিয়ান কে রেখে যাই নিজের ছোট ভাইয়ের কাছে। তাদের তখন সন্তান ছিলো না। অতি আনন্দের সাথে আমার ছোট ভাই ও তার বউ গ্রহন করে নেয় আমার সন্তানকে। কিন্তু এইযে শায়লা ওকে কিছুতেই বুঝাতে পারছিলাম না। ওর এক কথা ছেলেকে রেখে কেন যাবো? ছেলেকে নিয়েই যাবো। কিন্তু ভাই আর সাদিয়া অনেক বুঝিয়ে রাজি করায় শায়লাকে। তখন আরিয়ান এক বছরের শিশু। যাওয়ার দিন এয়ারপোর্টে কতো পাগলামি করেছে শায়লা। কতক্ষন আরিয়ানের কাছে আসে তো কতক্ষন বসে বসে কাঁদে। এরপর চলে গেলাম। যাওয়ার সময় বড় কষ্ট হচ্ছিল। নিজের সন্তান কে রেখে দুরে থাকা অনেক কষ্টের। বিদেশে প্রতিটা দিন দুর্বিষহ লাগতো। ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেই আমি। এতে শায়লা অনেক রাগ করেছিলো। ছেলেকে রেখে এখানে কেনো থাকবো? আমি বলেছিলাম ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে। আমাদের পড়ে ভালো জব হয়ে গেলো। প্রতিমাসে টাকা পাঠাতাম ভাইয়ের কাছে ছেলের জন্য। কিন্তু একটিবারো ছেলেকে দেখায়নি সে‌। শুনেছিলাম আরিয়ান নাকি তাকে বাবা ডাকতো। তারপর তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। আমার ছেলেকেই দেখাচ্ছে না। নিজের ছেলে নিজের ছেলে করছে। কিন্তু টাকা পাঠাতাম ব্যাংকে প্রতিমাসে। ভাইয়ের বা ছেলের আর কোন খোঁজ পাইনি। নিজেকে বুঝিয়েছিলাম ছেলে ভালো আছে। হঠাৎই সবাইকে দেখার ইচ্ছা জাগলো। নিজের ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। ছুটে এলাম বাংলাদেশে। কিন্তু পথিমধ্যে এক্সি’ডেন্টের শিকা’র হই। এরপর তুমি হাসপাতালে নিলে। সুস্থ হয়ে চলে এলাম নিজের বাড়িতে। তো শফিক কই আর আমার আরিয়ান সাদিয়া ওরা কই?

শহিদ সাহেবের কথাগুলো তে শায়লা ছাড়া আরিয়ান আর মিহি স্তব্ধ হয়ে আছে। মিহির মনে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে আরিয়ান তাহলে তার আপন ভাই নয়। তবুও ছোটবেলা থেকে তাকে এভাবে আগলে রেখে বড় করেছে। কতো যে এই ভাইয়াকে জ্বালিয়েছে। রাতে আইসক্রিম ফুসকা খাওয়ার জন্য। প্রেগনেন্সির দিনগুলো আরিয়ান তাঁর সমস্ত কথা শুনেছে। আজ আরিয়ান কষ্ট পাচ্ছ নিজের ও কষ্ট হচ্ছে খুব। এই ভাইটার কষ্ট তার সহ্য‌ হয়না। বাবা মা থাকতেও আদর‌ পেলো না। ছোটবেলা থেকেই কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বড় হলো। মেয়েদের ঘৃণা করে কত কত মেয়ের হৃদয় ভাঙলো। আর তার হৃদয়টা তো আজ ভীষণভাবে ভেঙে গেছে। আরিয়ান মূর্তির ন্যায় আজ বাকহীন। কি বলবে বা কি করা উচিত কিছুই তার মস্তিষ্কে নেই। শুধু মনে হচ্ছে ছোটবেলা থেকে তাহলে যাদের মা-বাবা ডেকে এসেছে তারা তার মা-বাবা নয় চাচা চাচী। আর মিহিও তার আপন বোন নয়। সামনের মানুষ দুটোই তার জন্মদাতা, জন্মদাত্রী! কথাটা মানতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা জীবনটা এমন কেন হলো? জীবনটাকে নাটকের চেয়েও নাটকীয় মনে হচ্ছে। সব কিছু মিথ্যা দ্বারা বেষ্টিত। এতো নাটকীয় না হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? না পেলো বাবা-মায়ের ভালোবাসা। ছোটবেলা থেকে মা বলে ডেকে আসা মানুষটিও হারিয়ে গেলো। বাবা ডাকা মানুষ টা ফাঁকিই দিলো। এতএত তেতো সত্যের মাঝে নিজেকে বড় মিথ্যা লাগছে। নিছক তুচ্ছ কিছু ঘটনাও আজকে মনে গভীর থেকে গভীরতর ক্ষতের সৃষ্টি করছে। এই নাটকীয়তার শেষ কোথায়? সামনের মানুষ গুলো উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখেও হাজারো প্রশ্নের মেলা। আরিয়ানের হুশ হয় নিজেকে সামলে অতি কষ্টে বলে-

-” আপনারা বসুন।

আরিয়ান মাহিকে কোলে নিয়ে মিহির হাত টেনে নিয়ে উপরে উঠে পড়ে। রাহেলা নাস্তা নিয়ে দেয় শহিদ আর শায়লাকে। তারা কিছুই বুঝতে পারছেনা ছেলেটার হলো কি? কথা উত্তর না দিয়েই গেলো। তার ছেলেটাও হয়তো এত বড় হয়ে গেছে। আরিয়ান মিহিকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে। মাহিকে দোলনায় শুইয়ে দেয়। আরিয়ানের চোখ লাল হয়ে গেছে। হয়তো কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। মিহি অনেক কষ্টে বলে-

-” ভাইয়া তুই এতিম না রে। আমিই এতিম দেখ না তোর মা-বাবা সব আছে ভাইয়া সব আছে। তুই কিন্তু আমার ভাই।

-” মিহি বোন শান্ত হ তুই। আমি এখানে আর থাকতে পারছিনা। তুই ওনাদের বাবা-মায়ের সম্পর্কে কিছূই বলবি না। যা বলার আমিই বলবো। ওনাদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি ঘুরতে গিয়েছে। আমি যাচ্ছি ওনাদের নিয়ে থাক তুই।

আরিয়ান মিহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তারাতাড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। শহিদ কে উদ্দেশ্য করে বলে-

-” আমিই আরিয়ান।

তারপর আর দাঁড়ায়নি। গিয়ে নিজের বাইক স্টার্ট করে সে। শহিদ আর শায়লা বাকহীন হয়ে গেছে। এটাই তাদের ছেলে। সেই ছোট ছেলেটা? শায়লা হুহু করে ওঠে। শহিদ নির্বাক তাকিয়ে আছে।

রাত দশটা। আরিয়ান গিয়ে বাইক থামায় আরাফাদের বাড়ির সামনে। কিছুই ভালো লাগছেনা। কেন জানি মনে হচ্ছে আরাফা মন ভালো করে দিতে পারবে। মনের এসব অযৌকিক্ত কথাটাকেই আজ ভীষণভাবে পাত্তা দিতে ইচ্ছে হলো। আরাফাদের বাড়ির দেয়াল বেশি উঁচু নয়। আরিয়ান বাড়ির দেয়াল টপকে ভিতরে ঢোকে। আরাফার রুমে লাইট জ্বলছে। আরিয়ান আরাফার অবয়ব দেখে ওর রুম চিনতে পারে। আশেপাশে খুঁজতেই একটা মই পেয়ে যায়। ভাগ্য ভালো। মইটা আরাফার বেলকনিতে লাগিয়ে উঠে পড়ে। বেলকনি শব্দ পেয়ে আরাফা ভয় পায়। কারন তার বাবা আর বোন ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন চোর আসলে কি করবে সে। ফলের ছু”ড়িটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে এগিয়ে যায় সে। আরিয়ান হাত ঝাড়ছে। দেয়াল টপকাতে গিয়ে হাত কেটে গেছে।
বেলকনির লাইট জ্বলে ওঠে। আরিয়ান সামনে তাকাতেই আরাফাকে দেখে। আরাফা যেই চিৎকার দিবে তখনি তার মুখ চেপে ধরে আরিয়ান। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে-

-” হুসসসস ডোন্ট টক।

আরাফা কেঁপে ওঠে আরিয়ানের কথায়। এতো কাছে একটা ছেলে কখনোই আসেনি। হার্ট দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে। এই ছেলেকে এখন পি’টিয়ে উগান্ডা পাঠানো উচিত। কতবড় সাহস আমার ঘরে এসে আমাকেই বলে ডোন্ট টক। একবার ছাড় আমায় তোকে দেখাচ্ছি লু”চু”গি”ড়ি করতে এসেছিস এই রাতে আমার বাসায়।

#চলবে
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)