#ভালোবাসা_তারপর
#পর্ব:১৬
#তামান্না_শাহরিন_শশী
কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত।
অনুমতি ব্যাতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
দড়জার ওপাশে দাড়িয়ে থাকা লোকটা কে দেখে থেমে যায় রোদসী। মুখ থেকে ছিটকে বের হলো,
“আপনি?”
আর কিছু বলার আগেই রোদসীর পা টালমাটাল লাগলো। দরজায় দাঁড়ানো ব্যাক্তিও রোদসী এমন অভিব্যক্তি দেখে অবাক হয়। কিন্তু রোদসী আর কিছুই বলতে পারে না। তার মাথা ঘোরাতে শুরু হয়। কিছু বলার আগেই ধপ করে নিচে পড়ে যায়।
দরজায় দাড়ানো ব্যাক্তি এবার অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে রোদসীকে দেখে। তারপর এসে রোদসীর পালস চেইক করে আশেপাশে কাউকে খোঁজ করে তবে কাউকে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে শব্দ কে কল করে।
এই সময় সাঈফের কল পেয়ে বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে যায়। শব্দ উচ্ছ্বাসের সাথে কথা বলছি বলতে ভুল হবে এতো দিনের পুরণো বন্ধুকে পেয়ে আড্ডা বসিয়েছিলো তাই অসময়ে সাঈফের কল পেয়ে বিরক্ত বোধ করে। উচ্ছ্বাস শব্দের এমন অভিভক্ত দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে?”
শব্দ জানায় তার কলিগ কল করেছে। উচ্ছ্বাস হেসে জবাব করে,
“কল টা রিসিভ কর দেখ কোনো সমস্যা হলো কিনা।
শব্দ প্রতিত্তোর না করে কল রিসিভ করে সালাম দেয়। তবে সাঈফ সালামের উত্তর না দিয়েই আগে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কোথায়?”
এমন প্রশ্নে বিরক্ত লাগলো শব্দের। ডিউটির টাইমে সে কোথায় থাকবে? বাসায়? হসপিটালেই তো থাকার কথা। একটা ডক্টর হয়ে আরেক জনকে এমন প্রশ্ন কোন মাথা থেকে করে তবুও নিজেকে সামলে বলে,
ডিউটি আছি ড.সাঈফ। হসপিটালে।
এবার সাঈফ গলা চওড়া করে বলে,
” তাবাসসুম যে অসুস্থ তাকে একা বাসায় রেখে গেলেন কিরে। সে জ্ঞান হারিয়েছে। তাকে আমি পাশের হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি আপনি তারাতারি আসুন।”
এবার শব্দকে বিচলিত দেখালো। এই খবর শুনে সে দাঁড়িয়ে গেলো। উচ্ছ্বাস চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে?”
শব্দ ”আসছি” বলে কল কেটে উচ্ছ্বাসকে জানায়,
“আই হেভ টু গো। আমার বোন অসুস্থ হয়ে গেছে। তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
উচ্ছ্বাস তাকে তারাতারি যাওয়ার জন্য তাড়া দেয় আর শব্দও হুড়মুড় করে বেড়িয়ে পড়ে। কবিনের বাহিরে ঊষা দাড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ শব্দকে এমন তারাহুরো করে বেড়োতে দেখে অবাক হয়ে শব্দকে দেখে। তবে এদিকে শব্দের কোনো খেয়াল নেই। তার মনে একটাই প্রশ্ন হঠাৎ রোদসীর আবার হলো কি?
——–
“এখানে মিসেস তাবাসসুমের বাড়ির লোক কে আছেন?”
নার্সের কথায় শব্দ এবং সাঈফ দুজনেই এগিয়ে যায়। শব্দ জানায় সে রোদসীর ভাই হয়। নার্স শব্দ কে বলে রোদসীকে গাইনী বিভাগে নিয়ে যেতে এবং ফাইলে কিছু কাগজ আছে সেগুলো টেস্ট করাতে। সাঈফ কিছুই না বুঝে বারকয়েক শব্দ এবং নার্সের দিকে তাকায়। শব্দ নার্সকে সম্মতি জানিয়ে রোদসীর কেবিনে যেয়ে তাকে ধরে গাইনী বিভাগে নিয়ে যায়। এবং ডাক্তারদের খথা সব সব টেস্ট করায়। তাদের কিছু সময় ওয়েটিং রুমে ওয়েট করতে বলা হয়। এদিকে রোদসীর মনও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিছু সময় পর নার্স এসে শব্দ আর রোদসীকে ডেকে নিয়ে যায়। সাঈফ জানায় সে বাহিরেই ওয়েট করছে। কি হয়েছে শব্দ এসে যেনো তাকে জানায় শব্দও সম্মতি জানিয়ে রোদসীকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে যায়।
কবিনে যেয়ে বসে রোদসীর আর শব্দ উৎসুক মুখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে। ডক্টর রিপোর্ট উল্টেপাল্টে দেখে রোদসীর মুখের দিকে তাকায়। তারপর শব্দ কে জিজ্ঞেস করে,
“কে হয় আপনার?”
“আমার বোন।”
“হুম। ভেরি ব্যাড নিজে ডক্টর হয়েও আপনার বোন দুর্বল তবে একটা গুড নিউজ আছে।”
তারপর রোদসীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা নির্মল হাসি দিয়ে বলে,
“কনগ্রেচুলেশন মিসেস মাহাদী। আপনি মা হতে চলেছেন।”
রোদসী এবং শব্দ দুজনেই স্তব্ধ নয়নে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ডক্টর এবার শব্দের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তারাতারি সবাইকে মিষ্টি মুখ করান ডক্টর সাহেব মামা হতে চলেছেন।”
দুজনের মুখেই চমকের ছাপ। তারপর নিজেদের সামলে রোদসী কিছুটা মিনমিনিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ডক্টর ক’মাস হয়েছে?”
শব্দের মুখের দিকে তাকায়। শব্দও ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে। ডক্টর এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানায়,
“আনুমানিক ১৩ সপ্তাহ হবে।”
রোদসী এবার নড়েচড়ে বসে। মানে হলো তিন অথবা সাড়ে’তিন মাস। রোদসীও পালিয়েছে তিন মাস সময়ই হলো। তারপর ডক্টর খাবার চার্ট এবং সব ধরনের নিয়মকানুন বুঝিয়ে দিলো এবং তা মানতে বলে। রোদসী এবং শব্দ কেবিন থেকে বের হলেই সাঈফ এসেই শব্দকে জিজ্ঞেস করে রোদসীর কি হয়েছে। শব্দ কোনো কথা না বলে হাতের রিপোর্ট এগিয়ে দেয় সাঈফের দিকে। সাঈফ পুরো রিপোর্ট এ চোক বুলিয়ে একবার রোদসী এবং শব্দের দিকে তাকায় পরে আবারো রিপোর্ট ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। পড়া শেষ করে অবিশ্বাস্য চোখে রোদসী এবং শব্দের পানে তাকায়। শরীর কেমন আসড় হয়ে এলো মনে হলো কন্ঠনালি কেউ চেপে ধরে রেখেছে এমন মনে হচ্ছে তবুও সাঈফ নিজেকে জোড় করে কোনো মতে মুখে থেকে কথা বরে করে জিজ্ঞেস করে শব্দ কে,
“এটা কি সত্যি?”
শব্দ শুধু মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বোঝায়। তারপর রোদসীকে ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। আর সাঈফ ওখানেই স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রয় দুই ভাইবোনের দিকে। আসড় হয়ে যাওয়া পা নিয়ে আগায় রোদসীদের দিকে। তাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে সাঈফ নিজের বাসায় চলে যায়। কিন্তু হসপিটাল থেকে বাড়ির এসে দিয়ে যাওয়ার এই সময় গুলোতে কোনো কথা সাঈফের মুখ থেকে বের হয় নি। কেমন যেনো রোবট ভঙ্গিতে সব করে গেছে। তার কাছে এখনো সবকিছুই অবিশ্বাস্যই ঠেকছে। তাবাসসুম কি তাহলে বিবাহিত? নাকি? নাহ! কিসব ভাবছে সাঈফ। বাসায় আসার পর থেকে প্রায় তিন-চারদিন পর্যন্ত এমন স্তম্ভিত হয়ে থাকে সাঈফ। হসপিটাল থেকে সে কিছুদিন ছুটি নেয়। নিজেকে সামলানোর জন্য।
———-
“বৃষ্টি তুই বাসায় যেয়ে একটু রেস্ট নে। আর কত এমন এখানে বসে থাকবি। বাসায় যা। আমি চাচীমার কাছে আছি। আর ভাইয়াও আসছে তো৷”
বৃষ্টি ঊষার পানে চায়। তারপর বৃষ্টি উঠে দাড়ায়।বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই আবিদ এসে হাজির হয়। তারপর ঊষার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“বৃষ্টি কোথায় যাচ্ছে?”
ঊষা জানায়,
“ওকে বাসায় পাঠাচ্ছি। আপনিও ওর সাথে যান। তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো।”
আবিদ মাথা নাড়িয়ে বৃষ্টির হাত ধরে চলে যায়। ঊষা একটা লম্বা শ্বাস টেনে একটা বেঞ্চে বসে। জীবনটা দিনদিন কেমন গোলমেলে ঠেকছে। এত এত সমস্যা কি থেকে কি হচ্ছে কিছুই মাথায় আসছে না ঊষার মাথায়। এর মধ্যে এক সিস্টার এসে জানায়,
“বিপাশা বেগমের বাড়ির লোক কে আছেন? তাকে এখনই ড. মুনীব শব্দ ডেকেছে।”
ঊষা উঠে শব্দের কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।
“ডা. আসবো?”
শব্দ তাকিয়ে দেখে ঊষা হালকা দরজা খুলে তাকিয়ে আছে। ঊষাকে দেখে কেনো জানি তাবাসসুমের কথা মনে পড়লো তাই সে মুচকি হাসলো। আর তার গালের টোলটা কেমন দৃশ্যমান হলো। তারপর ঊষাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলো। সেদিকে ঊষার মন নেই। সে আটকে গেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে কোনো অদ্ভুত সুন্দর জিনিস দেখে ফেলেছে। ঊষাকে ভিতরে আসতে না দেখে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ঊষাকে নাম ধরে ডাকে।
“এই যে মিস ঊষা কোথায় হারালেন?”
এবার ঊষা বাস্তবে ফিরে এলো তবে সামান্য লজ্জাও পেলে তার এমন কান্ডে। সে মাথা নিচু করে এসে শব্দের সমানে বসে। শব্দ এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে ঊষাকে পর্যপেক্ষণ করে মুখ খোলে,
“দেখুন মিস.ঊষা। যে অসুস্থ সে অসুস্থ। তার কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। কি হতে চলেছে তাও বলা যাচ্ছে না। এখন তার চিন্তায় আপনার ছোটো বোন এবং আপনি এভাবে হসপিটালে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আপনাদের বাসায় দুই ভাই আছে। তারা এসব দেখাশোনা করলেই হবে। আপনি বাড়ি থেকে বৃষ্টির দেখাশুনা করেন।”
একসাথে এতগুলো কথা বলে থামে তারপর ঊষাকে জিজ্ঞেস করে, লাঞ্চ করেছে কিনা? ঊষাও মাথা নাড়িয়ে জানায়,
“এখনো করা হয় নি। মাত্রই বৃষ্টিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছে।”
শব্দ কিছুক্ষণ কিছু ভেবে তারপর বলে আপনি আমার সাথে জয়েন করতে পারেন। আর হ্যাঁ আর একটা কথা বলা হয় নি। আমি আপনার ভাইয়ের বন্ধু। উমম উচ্ছ্বাসের বন্ধু। ঊষা অবাক হয়ে শব্দের দিকে তাকায়! তারপর বলে ও আচ্ছা। কিছুক্ষণ বাদের একজন লোক এসে তাদের খাবার দিয়ে যায়। তারপর তারা খেতে শুরু করে। খাওয়ার মাঝে মাঝেই আঁড়চোখে শব্দের দিকে তাকাচ্ছে ঊষা। না, যতটা রুড ভেবেছিলো ততটা রুড শব্দ না। তারপর হঠাৎ সেইদিন তাড়াহুড়োয় বের হয়ে যাওয়া কথা মনে পড়লেই। কিছুটা সাহস নিয়ে শব্দকে জিজ্ঞেস করে,
” সেদিন কি হয়েছিলো যে আপনি ওতো দ্রুত বেড়িয়ে গেলেন?”
শব্দ ঊষার মুখের দিকে তাকায় তারপর বলে “খেয়ে বলছি।”
তারপর খেয়ে একটা চকলেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“আমি মামা হচ্ছি। এই খবর তো আর খালি মুখে দেয়া যায় না তাই। এটাই নিন। বোনের জন্য কিনেছিলাম ভালোই হলো আপনাকেও দিলাম।”
ঊষা লোকটাকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। একটা লোক কতটা পরিপাটি এবং গুছিয়ে সব করতে পারে।
চলবে…..
#ভালোবাসা_তারপর
#পর্ব:১৭
#তামান্না_শাহরিন_শশী
কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত।
অনুমতি ব্যাতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সাঈফের মনে হচ্ছে তার আশেপাশের সব থমকে আছে। অনেক চিন্তাভাবনা করার পর শব্দকে কল দেয়। আজকে শব্দের অফ ডে। সন্ধ্যায় হঠাৎ সাঈফের কল পেয়ে চিন্তিত হয়। রোদসী প্রেগন্যান্ট জানার পর সে আর কোনো যোগাযোগ করেনি। এখন আবার হঠাৎ কল দিয়েছি। তাই কোনো কিছু চিন্তা না করেই কল রিসিভ করে তারপর জানায় সাঈফ শব্দের সাথে একান্তে দেখা এবং কথা বলতে চায়। হঠাৎ এমন আবদারে শব্দের খটকা লাগলেও তা পাত্তা না দিয়ে বলে বাসায় আসতে। তাতে সাঈফ রাজি হয় না। সে বাহিরে দেখা করতে চায়। তাই শব্দও বলে আচ্ছা ঠিকানা পাঠান আমি আসছি।
প্রায় সাতটা নাগাত শব্দ সাঈফের দেয়া ঠিকানার একটি রেস্টুরেন্টে পৌঁছায়। সেখানে আগে থেকেই সাঈফ বসে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। শব্দ কে দেখা মাত্রই সাঈফ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকে পাশের চেয়ারে বসতে বলে। শব্দের কাছে বাহিরে দেখা করার কারণটা ঠিক বুঝে এলো না। শব্দ বসা মাত্রই সাঈফ উসখুস করতে লাগলো। তা দেখে শব্দ জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”
“না মানে, আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।”
“আচ্ছা। তা বলুন।”
“তাবাসসুমের ব্যাপারে।”
এবার শব্দ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে। সাঈফের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারএভাবে তাকানো দেখে সাঈফ মনে মনে ঘাবড়ে গেলোও তা শব্দকে বুঝতে না দিয়ে সাহস নিয়ে বলে,
“আমি তাবাসসুমের ব্যপারে সব জানতে চাই। সব মানে সব।”
শব্দ সাঈফের দিকেই তাকিয়ে তার মতিগতও বোঝার চেষ্টা করছিলো। ছেলেটা মন্দ নয়। রোদসীকে প্রথম থেকেই পছন্দ করে তা শব্দ আগে থেকেই আচঁ করতে পেড়েছে। তা তার ব্যপারে জিজ্ঞেস করার জন্য এভাবে বাহিরে ডেকে আনলো সেই জিনিসটা শব্দের পছন্দ হলো না। তবুও তা মুখে প্রকাশ না করতে সরল গলায় জানতে চায়,
“কি জানতে চান?”
সাঈফ একটু নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে,
“তাবাসসুম কি বিবাহিত? তাহলে ওর স্বামী কোথায়? আর আপনার কাছেই কেন ও থাকে?”
শব্দ সাঈফের মুখভঙ্গিতে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো। সব জানার পর ঠিক কোন রিয়েক্ট করবে সাঈফ তা দেখার বিষয়। তবুও শব্দ সময় নিয়ে বলতে শুরু করে,
-“তাবাসসুম আমার আপন বোন না। আর না আমার রক্তের কোনে সম্পর্ক আছে। আমি ওকে প্রথম দেখি আমি চট্টগ্রামে যাচ্ছিলাম একটা কাজে।”
এটুকু বলে শব্দ থেমে সাঈফের মুখপানে চায়। সাঈফ কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে তাবাসসুমের সাথে শব্দের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
” তারপর?”
শব্দ আবারো বলতে শুরু করে।
-তাবাসসুম কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছিলো। এবং সে ভুলে আমার সিটে বসে পড়েছিলো। আমি যখন তাকে ডাকি তখন সে আমার দিকে তাকায়। ঠিক ওইখানেই ওইখানেই আমি আমার মৃত্যুবোনকে দেখলাম মনে হলো। আপনি নিশ্চিয়ই শুনেছেন আমার বোন কে কেউ রেপ করে মেরে ফেলেছিলো। একবছর আগে। শ্রেয়া ছাড়া পৃথিবীতে আমার কেউ ছিলো না। তবুও আমি এতো কিছু করার পরও সঠিক বিচার পেলাম না। হার মেনে নিলাম। তাবাসসুমের কথা বলার ধরন, তাকানো, আর বিশেষ করে তাবাসসুমের থুতনির তিলটা আমার বোনে কথা মনে করিয়ে দেয়। তারপর বাকি অর্ধেক জার্নিটা করলাম। আমি তখনও বুঝিনি তাবাসসুম কোনো আতঙ্কে ছিলো। কিন্তু প্রথম তাকানোর ধরণ দেখে আমার কিছুটা খটকা লাগলে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করি সে জানায় জানে না। এর জন্য তারসাথে সহজ হবার জন্য আমি আমার ব্যবহারের বাহিরেও তারসাথে কথা বলার চেষ্টা চালাই কিন্তু এতে সে আরো বিরক্ত সাথে ভয় পায় তাই আমিও আর কথা বলার চেষ্টা করিনি। মাঝ রাস্তায় ও কিছুটা অদ্ভুত বিহেভিয়ার করে সেন্সলেস হয় আমি পালস চেইক করে বুঝলাম অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারনে তার জ্ঞান হারিয়েছে। আমি ডাকাডাকি না করে তাকে আমি আমার বাসায় নিয়ে যাই। তারপর টানা তিনদিন অসুস্থ ছিলো। সেবা যত্ন করে সুস্থ হবার পর সে আমাকে তারব্যাপারে খুলে বলে এবং জানায় সে বিবাহিত। তার স্বামীর ব্যাপারেও জানায় সব ঠিক থাকলেও তার স্বামী তাকে অনেক টর্চার করতো। সন্দেহ করতো। হুটহাট রেগে যেতো। যা ওর কাছে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। বিয়ের কিছুসময় তার স্বামী ঠিক ছিলো তাদের সম্পর্কও ঠিক ছিলো কিন্তু এমন হুটাহাট পাগলামি, রাগারাগি, চেচামেচি, মারধোর এসবের কারণে তাবাসসুম পালিয়ে যায় এবং আশ্রয় পায় আমার কাছে। আমিও অবাক হয়ে শুনেছি। সে এখনো ভয় পায় বাহিরে বের হতে তার কাছে মনে হয় তার স্বামী তাকে খুঁজে পেলে আরো ভয়ংকর কান্ড ঘটাবে। তাই সেআমার কাছে থাকার এই তিন মাস বাড়ির বাহিরে পর্যন্ত পা রাখে নি। ওইদিন প্রথম হসপিটালে গিয়েছিলো। তাও সে কি আতঙ্ক। আর এখন তো তাবাসসুম প্রেগনেন্ট এখন যা দেখছেন সব আপনার সামনেই।
একসাথে এতো কথা বলে শব্দ থামে তারপর সাঈফের দিকে তাকিয়ে দেখে সাঈফ স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ তারপর কিছু না বলে উঠে সে চলে যায়। শব্দ দীর্ঘশ্বাঃশ ছেড়ে। চেয়ারে নিজের শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণ বাদে শব্দের ফোনটা আবারো যান্ত্রিক আওয়াজে বেজে ওঠে। তিতিবিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে রোদসী কল করেছে। আলস হাতে কলটা রিসিভ করে কানে ধরে। রোদসী জানায়, তার আচার খেতে ইচ্ছে করছে সে যেনো বাহির থেকে আসার সময় আচার নিয়ে আসে আর ফুচকা পেলে যেনো তাও নিয়ে আসে। শব্দ শুধু আচ্ছা বলে কল কেটে দেয়। কোনো কথা না বলে এমন কল কাটায় রোদসী বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে কিছুসময় ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আমারো টিভি দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
———-
শব্দ বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরলো। রোদসী তাকে জিজ্ঞেস করলো কোথায় গেয়েছিলো। শব্দ প্রতিত্তোরে কিছু না জানিয়ে হাতে থাকা খাবার গুলো দিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। আর রোদসী বোকার মতো শব্দের প্রস্থান দেখে। তারপর ভাবে এর আবার কি হলো। তারপর রোদসীর চোখ যায় নিজের হাতের দিকে সে আর কিছু চিন্তা করেই ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে খাবার গুলো একে একে বের করে খেতে লাগলো।
——
এদিকে সাঈফের স্তব্ধতার রেশ বোধ হয় কমছেই না। এক সপ্তাহে আগে জানতে পারে তাবাসসুম প্রেগন্যান্ট এখন এতো কিছু জানার পর তার অবাকের রেশ কমছেই না। এতো বড় অতীত। সাঈফের সারারাত চোখে একফোঁটাও ঘুম ধরা দিলো না। আর সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। যা সে তাবাসসুমকে কালকে সকালেই বলবে। এসব ভেবেই মনকে শান্ত করলো। তারপর ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলো।
——-
সকাল সকাল এক প্রেশেন্টের অবস্থা খারাপ হওয়ার দরুন আজকে সকালকেই শব্দকে বের হতে হলো হসপিটালের উদ্দেশ্য তাই বাসায় এখন রোদসী আর মিলি খালাই ছিলো। মিলিখালা বসে বসে রোদসীর চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছিলো আর বাচ্চাদের ব্যাপারে এটা ওটা বলছিলো যা শুনে রোদসী খিলখিল শব্দ হেসে উঠছে। মিলিখালাও রোদসীর সাথে তাল মিলিয়েই হাসছে। হঠাৎ ডোর বেল বেজে ওঠায় তাদের কথা বার্তায় ভাটা পড়ে। রোদসী মিলি খালার দিকে তাকালে সে বলে,
“দারাও আমি দেখে আসছি কে এসেছে।”
রোদসীও মাথা নাড়িয়ে তাকে যেতে অনুমতি দেয়। মিলি খালা দরজা খোলার সাথে সাথেই সাঈফ হুড়মুড়িয়ে বাসায় ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে মিলিখালাকে প্রশ্ন করে,
“তাবাসসুম কোথায়?”
মিলিখালার এই ছেলেকে একদমই পছন্দ নয়। নিতান্তই শব্দের কলিগ না হলে মুখের ওপর বলে দিতো এই ছেলে তুমি আর এই বাসার আশেপাশে আসবে না। তবুও নিজেকে সামলে সে উত্তর দেয়,
“সে তার নিজের রুমে। আসেন আমার সাথে।”
এটা বলেই মিলিখালা হাটা দেয়। সাঈফও মিলি খালার পিছন পিছন যেতে থাকে। মিলিখালা রোদসীর রুমে সামনে দাড়িয়ে বলে,
“আপনি একটু দাড়ান। আমি তাকে বলে আসছি আপনি এসেছেন।”
সাঈফও ভদ্রলোকের মতো রোদসীর রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে মিলিখালা এসে জানায়,
“আপনাকে ড্রইংরুমে বসতে বলছে। সে আসছে।”
সাঈফ হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে যেয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে। রোদসীও এর মধ্যে গুটিগুটি পায়ে হেটে এসে সাঈফের বিপরীত পাশের সোফায় বসে। সাঈফ কিছুসময় উসুখুস করে যা রোদসীর নজর এড়ায় না। রোদসী ভাবে লোকটার কিছুদিন হদিশ পাওয়া গেলো না এখন আবার কোথায় থেকে হাজির হলো। তার ভাবনার মাঝে আবারও কলিংবেল বেজে ওঠে। রোদসী মিলিখালাকে বলে গেট খুলে দিতে। শব্দ এসেছে। সে ড্রইং রুমে কে কে আছে তা না দেখেই গটগট পায়ে নিজের রুমে দিকে যেতে নিলেই রোদসীর ডাক শোনে শব্দ,
ভাইয়া, তোমার কলিগ এসেছে।
শব্দ এবার পিছন ফিরে চায়। সাঈফ কে দেখে
বসে সাঈফের মুখের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝায় চেষ্টা করে রোদসীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঈশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? রোদসীও মাথা নাড়িয়ে জানায় সে জানে না।
সাঈফ দুইজনের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করে,
“তাবাসসুম তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। জানি না বলাটা ঠিক হবে কিনা তবে। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি তোমার অতীত সম্পর্কে ড.শব্দ থেকে জেনেছি।”
সাঈফ এটুকু বলে থামে। রোদসী শব্দের দিকে তাকালে সে চোখের পলক ফেলে বোঝায় শান্ত থাকতে। সব শব্দই সাঈফকে বলেছে। রোদসী আবারো সাঈফের দিকে তাকায়। সাঈফ আবারো বলতে শুরু করে,
“বিশ্বাস করো তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আমি যখন তেমাকে প্রথম দেখেছি তখন থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগতো। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কিন্তু আমি তোমাকে এভাবেই মেনে নেব। আর তোমার স্বামী, ওর সাথেও ডিভোর্স করিয়ে নিবো। কোনো সমস্যা হবে না। তোমার অনাগত সন্তানেরও একটা পরিচয় দরকার। তুমি একজন মেয়ে হয়ে এভাবে সন্তান বড় করতে পারবে না৷ আমি অনেক ভেবে চিন্তে তোমার অনাগত সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাই। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। যদি তোমার কোনো দ্বিমত না থাকে তাহলে আজকেই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।”
রোদসী অবাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে স্তব্ধ নয়নে সাঈফের দিকে তাকিয়ে আছে। শব্দও ভাবেনি এভাবে সাঈফ রোদসীকে এপ্রোচ করবে। শব্দ রোদসীর দিকে তাকায়। রোদসী এখনো বড়বড় নেত্রে সাঈফের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদসীর মুখটা কেমন রক্তশূণ্য দেখালো তা দেখে হাস বাড়িয়ে শব্দ রোদসীর হাত ধরলো। রোদসীর ভাবনা থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর শক্তমুখে জবাব করে,
“একথা আপনি আজকে বলেছেন। ভুল করেও আর কখনো মুখে আনবেন না। আমি কখনো বলছি আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি না? বা ডিভোর্স দিবো এমন কিছু মাথায়ও আনি নি কখনো তাহলে আপনার সাহস হয় কি করে আমার কাছে এই ধরণের প্রস্তাব রাখার? আপনার সাহস দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারছি না ড. সাঈফ। আপনাকে আমি আমার ভাইয়ের কলিগ ছাড়া আর কিছু ভাবিই নি তাহলে আপনার এসব কথা বলার সাহস এলো কি করে। আজকে প্রথম বলেছেন। এটাই শেষ। এর পরে আর কখনো এই ব্যাপার মাথায়ও আনবেন না।
রোদসী উত্তেজিত হয়ে উত্তর করে হাঁপিয়ে উঠে। বসে পরে। চোখ বুঝে দুটো শুকনো ঢোক গিলে চোখ শব্দের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাইয়া আমাকে একটু আমার রুমে দিয়ে আসবে। দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছি না।”
শব্দ কোনে কথা না বলে রোদসীকে ধরে নিজের রুমে দিয়ে আসে। তারপর শব্দ এসে সাঈফের মুখোমুখি বসে। সাঈফের মুখাবয়ব পড়তে চেষ্টা করলো। সাঈফের মুখটা থমথমে হয়ে আছে। শব্দ সময় নিয়ে বলে,
“আমি দুঃখিত। তবে আপনার এভাবে প্রস্তাব রাখা ঠিক হয় নি। তাবাসসুম তার স্বামীকে ভয় পায় ঠিকি কিন্তু ভালোও বাসে। দেখেন নি যখন ডিভোর্সের কথা বললেন কেমন খেপে গেলো। আশা করি আপনি কষ্ট পাননি। আমি চাই এই টপিকটা এখানেই শেষ হোক। তবে আপনাকে আমরা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পাশে চাই।”
এটুকু বলে শব্দ থামে। তারপর সাঈফের মুখভঙ্গি দেখে তার মনে কি চলছে তা বোঝার চেষ্টা করে। সাঈফ কিছু সময় নিয়ে বলে,
আমিই নিজেই দুঃখিত। আমহ বুঝিনি। ব্যপারটা এমন হবে। তাহলে এই প্রস্তাবটা রাখতাম না। তবে অবশ্যই আমাকে আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সব সময়ই পাবেন। এখন উঠি। আমার যেতে হবে।
এই বলে সাঈফ আর বসে না। সরাসরি মেইন গেট দিয়ে বেড়িয়ে চলে যায়। শব্দ তাকিয়ে সাঈফের প্রস্থান দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। রোদসী কি চাইছে বা কি হচ্ছে। সাঈফের এমন কর্মকাণ্ড নিয়েও বেশ চিন্তা হচ্ছে।
চলবে……
ভুলত্রুটি ক্ষমা মার্জনীয়।