#ভালোবাসা_মন্দবাসা (পর্বঃ ১,২)
এমি
১.
আজ রিয়াদ সাহেবের স্ত্রী রেহনুমার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। বড় অবেলায় তাকে ছেড়ে চলে গেছেন তার স্ত্রী। সকাল থেকেই বাসায় আত্নীয় স্বজনদের আনাগোনা। বাদ যোহর মিলাদ পড়ানো হবে। আর তিনি কিছু এতিমখানায় দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানুষজনের ভীড় তিনি তেমন একটা পছন্দ করেন না। তবুও আজকে সব কিছুর দেখাশোনা তাকেই করতে হচ্ছে। জীবনটা যেভাবে যাবে বলে ভেবেছিলেন হয়েছে ঠিক তার উল্টা। সৃষ্টিকর্তা তার অদৃষ্টে কি লিখে রেখেছেন তা তিনিই জানেন। তিনি এখন অনেকটা তীর হারানো সমুদ্রে ছোট্ট নৌকা নিয়ে এলোমেলো ভাবে ঘুরছেন।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার নিজের বাড়ি। খুব কষ্ট করে তিনি আর রেহনুমা তাদের স্বপ্নের বাড়ি বানানো শুরু করেছিলেন। রেহনুমা সেই বাড়ির শেষ দেখে যেতে পারেনি। বাড়ির গ্যারেজে বাবুর্চী রান্না করছে। তিনি পাশেই চেয়ার পেতে বসে তদারকি করছেন। বাসার দারোয়ান দুরে দাঁড়িয়ে। তিনি হাত ইশারায় তাকে ডাকলেন। দারোয়ান ছুটে আসল।
-রিহান কোথায় বলোতো সবুজ মিয়া? সকাল থেকে দেখছি না?
সবুজ মিয়া ভয়ে ভয়ে বলে,
-ভাইজান তো ছাদে, তার বন্ধুরা আসছে, ডাক দিমু?
রিয়াদ সাহেব খুব বিরক্ত হলেন। আজকের দিনেও আড্ডা। রাগটাকে গিলে ফেলতে হলো। চারপাশে অনেক লোকজন। সিনক্রিয়েট করতে চান না কোনোভাবেই।
-ডাকার দরকার নেই। তুমি যাও নিজের কাজ কর।
তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। রেহনুমা বেঁচে থাকলে ছেলেটা নিশ্চই এমন হোতো না। ছাদের দিকে রওনা হলেন। ছাদের দরজার কাছে থমকে দাঁড়ালেন। অযাচিত নন তো তিনি? দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখলেন তিনি যা ভেবেছিলেন তা নয়, সব বন্ধুরা মিলে ডেকরেটরের লোকদের সাহায্য করছে। দেখেই তার মনটা ভাল হয়ে গেল। মনে মনে নিজেকে ধমকালেন। সব কিছুতেই ভুল ভেবে নেবার স্বভাবটা বদলাতে হবে তাকে। কাউকে কিছু না বলেই নিচে নামলেন। আবার আগের জায়গায় এসে বসলেন।
রেহনুমাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ বর্ষে পড়েন। রেহনুমা তখন উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ে। পালিয়ে বিয়ে করার পর কত বিপত্তি। দুজনের পরিবারের কেউ মানতে চায় না। কত কষ্টের সব দিন। তারপর তার সরকারি ব্যংকে চাকুরী হল। কষ্টের দিন শেষ করে তারা সুখের মুখ দেখলেন। ততদিনে অবশ্য দুজনের বাড়িতেই মেনে নিয়েছে।
তারা তাদের সংসার শুরু করেছিলেন এক বেডরুমের ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায়। তার দুবছর পরই রেহনুমার কোল আলো করে এল রিহান। দিনগুলো যে কিভাবে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। রেহনুমাকে ছাড়াও তিনটা বছর পার করলেন। সময় যেন কাটতেই চায় না। রিহানটাও যেন কেমন হয়ে গেছে। তার সাথে দুরত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে। বড় একা লাগে তার। কি করে কাটবে তার বাকিটা জীবন।
কিন্তু তার মধ্য চল্লিশের জীবনে নতুন চমক যে অপেক্ষা করছে তা কি তিনি জানতেন নাকি ধারনা করতে পেরেছিলেন!!!
২.
গোসল শেষে বেরিয়ে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো রাহা।
ওর মা কাজ ফেলে ছুটে আসলেন।
-কি হয়েছে রে? চিৎকার করছিস কেন?
-মা তোমাকে তো বলেছিলাম আমার সাদা জামা আয়রন করে রাখতে। রিহানের মার মৃত্যুবার্ষিকী। আজ সবাই যাব। আমার তো এখন দেরি হয়ে যাবে। বন্যা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এখন কি করি?
-তুই যা চুল ঠিক কর। ক্রিম লাগা মুখে। আমি জরিনাকে বলছি তাড়াতাড়ি আয়রন করে দেবে।
তবুও বাড়ি থেকে বের হতে দেরি হয়ে যায়। বন্যা রাগে গজগজ করতে থাকে। ওরা একটা রিক্সা ঠিক করে রিহানের বাসার দিকে রওনা হয়। আজই প্রথম রিহানের বাসায় যাচ্ছে রাহা। রিহানের মা বেঁচে থাকতে অবশ্য রিহান সবাইকে দাওয়াত করেছিল কিন্তু বাসায় অন্য একটা অনুষ্ঠান থাকায় আসতে পারেনি তখন সে।
দুই বান্ধবী মিলে গল্পে এত মশগুল ছিল যে রিহানের বাড়ি প্রায় পার হয়ে যাচ্ছিল। বন্যা হঠাৎ করেই বলে উঠল, রিক্সাওয়ালা ভাই রাখেন এখানে। রিক্সাওয়ালা এমন হার্ড ব্রেক করলো, রাহা হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল। দুই হাতের কনুই ছড়ে গেল আর ডান পাও মচকে গেল। দাঁড়াতে গিয়ে বুঝলো ব্যাথায় পা ফেলতে পারছে না। সে রাস্তায় বসে পড়ল। বন্যা তার পাশে এসে বসলো।
এদিকে সবুজ মিয়া রিক্সাওয়ালাকে ধমক দিতে লাগল। যোহরের নামাজ শেষে রিয়াদ সাহেব বাসায় ফিরছিলেন । দূর থেকে দেখলেন বাসার সামনে কি যেন ঝামেলা হয়েছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কাছে এসে দেখেন দুইটা মেয়ে রাস্তায় বসে। একজন ব্যাথায় কান্না করছে। তিনি কাছে দাঁড়াতেই সবুজ মিয়া বলল,
-ছোট স্যার এর বান্ধবী।
তিনি হাত ধরে রাহাকে তুললেন। বন্যার কাঁধে ভর দিতে বললেন। বাসায় নিয়ে এসে গেস্টরুমে দুইজনকে বসিয়ে, ডাক্তারকে ফোন করতে গেলেন। সবুজ মিয়াকে রিহানকে ডাকতে পাঠালেন। গেস্ট রুমে ফিরে এলেন ফার্স্ট এইড কিট সাথে নিয়ে। এতক্ষনে মেয়ে দুটোর দিকে ভালো করে তাকাবার সময় পেলেন। রাহার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি খানিকটা চমকালেন। এ যেন সেই কিশোরী রেহনুমা। ফার্স্ট এইড কিটটা বন্যার হাতে দিয়ে ধীর পায়ে তিনি নিজের ঘরে চলে এলেন।
ঘরে বসেই শুনলেন রিহান আর ওর বন্ধুরা চেচামেচি করছে। আত্মীয় স্বজনরা সবাই আছে। কলিং বেলের শব্দ হল, তিনি ভাবছেন মনে হয় ডাক্তার এসেছে। তিনি কি যাবেন একবার দেখতে? গেস্টরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই, ডাক্তার তার দিকে ফিরলো।
– মনে হয় তেমন কিছু হয়নি তবে হাটতে কদিন সমস্যা হবে আর রেস্ট নিলেই ভাল হয়ে যাবে। ব্যাথার ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি। খাবার পর খেতে হবে।
ডাক্তারের বিদায় করে তিনি সবুজ মিয়া কে ঔষধ আনতে পাঠালেন। আর বুয়া কে ডেকে বললেন আপদের খাবার ঘরেই দাও। আর রিহান তুমি বন্ধুদের খাবার ব্যবস্থা করো। রিহান চুপচাপ সবাইকে নিয়ে ছাদে চলে এল। সে জানে আজ বাবার মন অনেক খারাপ থাকে। কাউকে বুঝতে দেন না এই যা।
বিকালের দিকে আকাশ মেঘে ঢেকে গেল। বৈশাখ মাসে এই এক সমস্যা বলা নেই কওয়া নেই ঝড় শুরু। মেহমান মোটামুটি সবাই চলে গেছে। রিয়াদ সাহেব বসার ঘরে আসতেই দেখলেন বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে। বারান্দায় এসে দেখেন দুই বান্ধবী চুপচাপ বৃষ্টি দেখছে। তাকে দেখেই তারা একটু সিটিয়ে গেল।
-কি ব্যাপার তোমরা যাও নি এখনও? আর এই বৃষ্টিতে যাবেই বা কি করে? বাসায় জানিয়ছো?
মেয়ে দুইটা এক সাথে মাথা নাড়লো। রাহা খুব আস্তে করে বললো,
-রিহান পৌছে দেবে বলেছে চাচা। আপনি চিন্তা করবেন না।
তিনি কিছু না বলেই পেছনে ফিরলেন, কি মনে করে আবার বললেন,
-এই বাড়িতে বৃষ্টি দেখার আলাদা একটা জায়গা আছে জানো? আসো তোমাদের দেখাই। ওহ্ তোমার পায়ের এখন কি অবস্থা? হাটতে পারছো তো?
-এখন একটু কম, তবে কষ্ট হচ্ছে পা ফেলতে।
-তাহলে এখানেই বস আমি চেয়ার দিতে বলি।
-সমস্যা নেই চাচা আমি বন্যার কাঁধে ভর দিয়ে যাচ্ছি।
-তবে আস।
তার বেডরুমের পাশেই বেশ বড় একটা ছাদ বারান্দা। একপাশে কাঁচ ঘেরা বসার জায়গা। মাথার উপর রঙ্গিন টিন। পুরো জায়গা জুড়ে অসংখ্য পাতাবাহার, অর্কিড আরা নানা জাতের ফুলের গাছ। সব মিলিয়ে একটা স্বপ্নের মত। রাহা মুগ্ধ হয়ে গেল। রিয়াদ সাহেব তাদের রেখে নিচে নামলেন। অনেক কাজ বাকি। সব পরিস্কার করাতে হবে। যে বৃষ্টি ডেকরেটর এর লোকজন মনেহয় না কোন কাজ আজ করতে পারবে। বাবুর্চি কে বিদায় করতে হবে। রান্নার জায়গায় এসে দেখলেন কেউ নেই। সবুজ মিয়া আবার কোথায় গেল? বৃষ্টিও এমন বেড়েছে।
চলবে…
এমি