#ভালোবাসা_মন্দবাসা (পর্বঃ ৩,৪,৫)
৩.
বৃষ্টি সহনীয় অবস্থাতে আসা মাত্র তারা বাসা থেকে বাহির হল। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় পানি জমে গেছে আর তার উপর প্রচন্ড যানযট। রিহান যখন বন্যা কে নামিয়ে রাহাকে ওর বাড়ি পৌছে দিতে গেল তখন রাত প্রায় এগারোটা।
রাহা ভয়ে অস্থির। আজ বাবা তাকে যে কি করবেন? আল্লাহ ভালো জানেন। যদিও বাসায় ফোন করে জানিয়েছিল। কিন্তু বাবা এসব বুঝবে? হয়তো কিছুই বুঝবেন না।
এদিকে আবরার সাহেব মানে রাহার বাবা তো রেগেই আগুন। পারলে রাহার মাকে তখনই খুন করে ফেলেন।
-কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে? রাস্তার মেয়েদের শুধু এই সময় বাইরে পাওয়া যায়। এটা আমার বাড়ি কোন মগের মুল্লুক না। যে তোমরা যা খুশি তাই করবে।
সায়লা স্বামীর ভয়ে রান্নাঘরে বসে আছেন। স্বামীর চিৎকারে বাইরে এলেন। স্বামীকে অনেক করে বেঝানোর চেষ্টা করলেন, যে বৃষ্টির জন্য আটকে গেছে। রাস্তায় যানযটের জন্য দেরি হচ্ছে। কিন্তু তিনি কোনো কথাই শুনলেন না।
রাহাকে দরজার কাছে পৌছে দিয়ে রিহান বেরিয়ে আসলো। রাহা বাড়িতে ঢুকতেই তার বাবা তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। দুই গালে এলোপাথাডি চড় মেরে আবরার সাহেব আবার চিৎকার শুরু করলেন।
-যেখানে গিয়েছিলে সেখানে চলে যাও। তোমার মত মেয়ের আমার বাসায় কোন জায়গা নেই।
রাহা কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। মা পাশেই দাড়িয়ে। কই কিছু বলছে না তো। সে তো এমন কোনো অপরাধ করেনি। তার মাথা কাজ করছে না। কোন কিছু না ভেবে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। নিচে নেমে রিহানকে পেল না। কোথায় যাবে সে এত রাতে? পায়ের ব্যাথায় দাড়িয়ে থাকতে পারছে না। রিহানকে ফোন করেই কাঁদতে শুরু করলো। কোনো রকমে তার কথাগুলো বললো। রিহান গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে এসে তাকে তুললো। তারপর নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। কিন্তু সে বাবাকে কি বলবে? বাবা কি রাহাকে রাখতে দেবে বাসায়? কি যে করবে ? এত রাতে মেয়েটাকে রাখবেই বা কোথায়?
রিহান চট করে রাহার দিকে একবার তাকাল। ওর বাড়িতেও যে বাবা তাকে রাখবেন না এটা কি বলবে? দেখাই যাক বাবা কি বলেন। এমনিতেই বেচারী কাহিল। তার উপর পায়ের ব্যাথা। বাসায় ঢুকতেই দেখলো বাবা বসার ঘরে পায়চারী করছে। তাকে দেখেই স্থির হয়ে দাড়ালেন।
-এত দেরী কেন? দেশের অবস্থা যে ভালো না তা তো জানই।
বলেই তার চোখ পড়ল রাহার উপর। তিনি চুপ করে গেলেন। রিহান হড়বড়িয়ে সব কথা বলে ফেলল। তিনি চুপচাপ সব শুনলেন।
-আচ্ছা আজ বিশ্রাম করো, কাল সকালে তোমাকে আমি দিয়ে আসব।
বুয়াকে ডেকে রাহাকে গেস্টরুমে পাঠালেন। আর বুয়াকে রাতে ওই ঘরেই থাকতে বললেন।
নিজের ঘরে এসে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। মেয়েটাকে কি বাড়িতে দিয়ে আসা উচিৎ ছিল? ছেলের বান্ধবীকে বাসায় রাখলে তো কত লোকে কত রকম গল্প তৈরী করবে। তিনি উঠে এলেন। সবাই শুয়ে পড়েছে। ডাকা কি ঠিক হবে? যাক যা হবার হবে। কাল সকালে দেখবেন কি করা যায়।
৪.
তার বাবা কি রিহানের বাবার মত হতে পারতো না? কত সুন্দর আচার আচরণ। দেখেই শ্রদ্ধা জাগে। মেয়ে বলে তাকে কখনই ভালবাসেননি বাবা। শুধু তাকেই না তাঁর মাকেও পদে পদে হেনস্থা হতে হয় তাদের বাসায়। মেয়েদের প্রাপ্য সন্মানটুকু কখনও বাবা দেন না কাউকে। শুধু বাবা কেন তার দাদু বাড়ির লোকজন সবাই এক রকম। তাদের কাছে তার ছেলেরাই সব।
কিন্তু কাল যদি বাবা তাকে বাড়িতে ঢুকতে না দেয় তবে সে কোথায় যাবে? আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে তার বুক ভেঁঙ্গে কান্না আসে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সকালে নাস্তা সেরে রিয়াদ সাহেব রাহাকে ডাকলেন বাড়ি পৌছে দেবার জন্য। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একরাতেই মেয়েটার চেহারা কেমন ম্লান হয়ে গেছে। গাড়িতে বসে রাহার কাছে ঠিকানা নিয়ে ড্রাইভারকে সেই ঠিকানায় যেতে বললেন। বেশী সকাল বলে রাস্তায় তেমন ভীড় নেই। রাহাকে নামিয়ে তিনি অফিসে যাবেন। গন্তব্য পৌঁছাতে বেশী সময় লাগলো না।
-তুমি একাই যেতে পারবে নাকি আমাকে আসতে হবে?
-চাচা আপনি প্লিজ আমার সাথে একটু আসেন। বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলেন। আমার খুব ভয় করছে। আমাকে হয়তো আজ মেরেই ফেলবে।
কথাটা বলতে বলতে সে কেদে ফেলল।
-তা করবে কেন? সাময়িক ভাবে রাগের মাথায় আমরা অনেকেই অনেক কিছু করি। কিন্তু রাগ তো আর সব সময় থাকে না। চলো আমি যাচ্ছি। তুমি শান্ত হও। কান্না কোরোনা।
ড্রাইভারকে গাড়ি পার্ক করতে বলে তিনি লিফ্টে উঠলেন। বাসায় বেল বাজিয়ে রাহা রিয়াদ সাহেবের পেছনে গিয়ে দাড়ালো।
সায়লা এলে দরজা খুললো। তাদের দেখে দরজা ছেড়ে দাড়ালো।
-এত সকালে কে এসেছে?
কথাটা জিজ্ঞেস করতে করতে আবরার সাহেব বসার ঘরে এলেন।
-কি চাই তোমার এখানে? ফুর্তি করা শেষ। এখন এখানে এসেছো।
-বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি মাফ করে দাও।
-ভুল? সেটা তো বাসা থেকে বাহির হবার আগে বোঝা উচিত ছিল। এখন যেখানে রাত কাটিয়েছো সেখানে যাও।
রাহার মা কিছু একটা বলতে চাইলে তিনি খেকিয়ে উঠলেন।
-মেয়ের সাথে তুমিও যাও। দুই জনে ব্যবসা জমবে ভাল।
রিয়াদ সাহেবের প্রচন্ড রাগ হলো। এ কেমন মানুষ। নিজের মেয়ে, স্ত্রী কে এভাবে বাইরের মানুষের সামনে অপমান করছেন। তবে নিজের রাগটা তিনি চেপে গেলেন। এখন রাগারাগি করলে হিতে বিপরীত হবে।
-ভাই একটা কথা শোনেন। বাচ্চা মানুষ ভুল করে ফেলেছে। মাফ করে দেন।
-ওহ্ আপনি বুঝি তার উকিল। রাতটা কার সাথে কাটিয়েছে তবে? আপনি নাকি আপনার ছেলে?
-মুখ সামলে কথা বলেন। ভদ্র ভাবে কথা বলছি বলে দুর্বল মনে করছেন নাকি?
-আপনার মত লেকের সাথে মুখ সামলাতে হবে নাকি। নিয়ে যান ওই মেয়েকে। যে মেয়ে রাত দুপুরে পর পুরুষের সাথে বাড়ি ছাড়ে তার জায়গা আমার এখানে হবে না।
রিয়াদ সাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। অপমানে আর কান ঝাঁঝাঁ করছে।
ভেতরে শুনতে পেলেন রাহার কান্না আর তার বাবার অশ্রাব্য গালিগালাজ। তিনি আবার ঘরে ঢুকে রাহাকে ডাকলেন।
-চলো তুমি আমার সাথে।
রাহা কাঁদতেই থাকে। সে কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না?
আবরার সাহেব ঠেলে তাদের বাসার বাইরে বের করে দিলেন। রাহার মনে হলো এর চেয়ে মরে যাওয়া তার জন্য সহজ। লজ্জায় অপমানে তার মাথা ঘুরতে থাকে। একা এলেই ভাল ছিল। রিহানের বাবার ও তো কম অপমান হলোনা আজ। এ মুখ কিভাবে দেখাবে সে?
রিয়াদ সাহেব তার হাত ধরে টেনে এনে গাড়িতে বসালেন। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন আবার। রাহাকে বাসায় রেখে তিনি অফিসের কাজে গেলেন।
৫.
মেয়েটার কথা চিন্তা করে তার সারাদিন কাজে তেমন মন বসলো না। মেয়েটার আত্মীয় স্বজন কারো বাসায় রেখে আসতে হবে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে বাসার জন্য বাজার করতে গিয়ে মনে পড়লো রাহা এক কাপড়ে বাসা থেকে এসেছে। তিনি বাজার গাড়িতে রেখে আড়ংএ গিয়ে দুটো সালওয়ার কামিজ কিনে ফেললেন। সাথে আরও কিছু দরকারী জিনিস।
বাসায় পৌছে বুয়ার হাতে ব্যাগগুলে দিয়ে তিনি নিজের ঘরে ঢুকলেন। ফ্রেশ হয়ে চা নিয়ে টিভির সামনে বসতেই রিহান এসে পাশে বসলো।
-বাবা আপনি তো রাহাকে নিয়ে এসেছেন। এখন কি করবেন? বুয়া, ড্রাইভার, দারোয়ান এদের কল্যানে তো কদিনের মধ্যে পাড়ায় গল্পের অভাব হবে না। সবাইকে মুখ দেখাবেন কি করে?
-কি বলছো রিহান? ও তো তোমার ফ্রেন্ড। ওই অবস্থায় আমি কি ওকে ফেলে আসতাম? আর গতকাল তো তুমি ওকে নিয়ে এসেছিলে। আমি তো ওকে চিনতামও না।
-ঠিক আছে আমিই এনেছিলাম কিন্তু এখন কি করবেন?
-তুমি ওকে জিজ্ঞেস কর ওর কেনো আত্মিয়ের বাসায় যেতে চায় কিনা? তাহলে সেখানেই দিয়ে আসবো। আর ওকে খেয়ে নিতে বল। ডাক্তার তো ঔষধও দিয়েছিলেন। দেখো সেগুলো খেয়েছে কিনা।
-আচ্ছা আমি দেখছি।
রিহান গেস্ট রুমের দরজায় এসে নক করলো। কিন্তু কেনো সাড়া পেলো না। রুমে ঢুকে দেখে রাহা কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে। ডেকেও সাড়া না পেয়ে মাথার কাছে হাত দিতেই চমকে ওঠলো সে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
চিৎকার দিয়ে বুয়াকে ডাকলো রিহান।
-তুমি বলেনি কেন ওর জ্বর?
-জ্বর? বুয়া আকাশ থেকে পড়ে। আমি কেমনে কইতাম? হেই কি আমারে কইছেনি?
সারাদিন কিছু খায়ও নাই। শুইয়া আছে। আমি ভাবছি মন খারাপ।
-হয়েছে যাও এখন বালতিতে করে পানি আনো। আমি বাবাকে ডাকছি।
চিল্লাচিল্লি শুনে এমনিতেই রিয়াদ সাহেব উঠে এসেছিলেন। মাথায় হাত দিয়ে রিহানকে থার্মোমিটার আনতে বললেন।
বুয়াকে মাথায় পানি ঢালতে বলে তিনি নিচে নামলেন ডাক্তার আনার জন্য। এখন কাউকে না পেলে হাসপাতালের নিতে হবে।
চলবে….
এমি