#ভালোবাসা_মন্দবাসা(পর্বঃ৬,৭)
৬.
রাহার জ্বর আজ বেশ কম। খাটে হেলান দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সে।
রিয়াদ সাহেব ঘরে ঢুকলেন এমন সময়। দুদিন অফিসে যান নাই। আজকে যেতেই হবে।
-আমি অফিসে যাচ্ছি। বুয়া, দারোয়ান সবাইকে বলে যাচ্ছি কিছু লাগলেই জানাবে। আর শরীর খারাপ লাগলে আমাকে অথবা রিহানকে ফোন কোরো। নাম্বার লিখে রেখেছি ল্যান্ডফোনের পাশে।
-সমস্যা নেই চাচা। আমি আজ ভাল আছি।
-মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলেও বলতে পার। তুমি অসুস্থ সেটাও তো জানানো হয়নি।
– নাহ চাচা আমি জানাতে চাই না।
-ঠিক আছে রেস্ট নাও। আমি আসি।
রিয়াদ সাহেব চলে যেতেই সে ভাবতে বসলো, এখানেই বা কতদিন? তার নিজের পথ নিজে খুঁজে নিতে হবে। ওই বাড়িতে আর ফেরত যাওয়া যাবে না। কোনো মেয়েদের হস্টেল পেলে সেখানেই উঠবে। কিন্তু টাকা সেটা পাবে কি করে? বাবা যখন বাসায় থাকবে না তখন গিয়ে তার জিনিসপত্র সব নিয়ে আসবে। তার কিছু জমানো টাকা আছে সেগুলো কাজে লাগবে। কয়েকটা টিউশনি যোগাড় করতে হবে। কিন্তু একা একা এই শহরটায় সে বাকি জীবনটা কাটাবে কিভাবে? এসব চিন্তা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়লো।
বুয়ার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো রাহার।
-আপা বড় সাহেবের ফোন? আপনি কথা কইবেন?
আস্ত আস্তে পা ফেলে সে বসার ঘরে আসে। ফোনের পাশের সোফাটায় বসে।
-হ্যালো
-সব ঠিক আছে রাহা?
-জ্বি।
-তাহলে ফোন ধরতে এত সময় নিলে?
-ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
-আচ্ছা। বিশ্রাম করো তবে। দুপুরে খাবার পর মনে করে ঔষধগুলো খেয়ে নেবে। বই পড়তে চাইলে আমার ঘরে বুকসেল্ফে আছে কিছু গল্পের বই। তোমার চাচীর বই সব। পড়তে পারো, সময় কাটবে। মাথা ব্যাথা থাকলে দরকার নেই।
-আচ্ছা চাচা। আমি সব ঠিকমত করবো।
-ঠিক আছে রাখি তাহলে।
ফোন রেখে সে রিয়াদ সাহেবের ঘরে এসে ঢোকে। কি ক্ষতি হত তার বাবা যদি এমন হত? একটু বোঝার চেষ্টা করতো তাদের। বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে তার মন ভাল হয়ে যায়। কয়েকটা বই নিয়ে সে নিজের ঘরে এসে বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে।
কত যত্ন করে রেখেছেন সব কিছু। কত ভালবাসতেন চাচীকে। এমন একটা মানুষকে জীবন সঙ্গী হিসাবে পাওয়াও তো ভাগ্যের ব্যাপার।
তবে তিনি নিঃসঙ্গও বটে। কথা বলার লোকও তো নেই। রিহান কেমন দূরে দূরে থাকে। একটা বইয়ের ভেতর থেকে কিছু একটা পড়লো। মেঝে থেকে তুলে দেখলো চাচা এর চাচীর অনেক পুরোনো একটা ছবি। কি হাস্যজ্বল মুখ। সে ঠিক করলো এই ছবিটা সে নিজের কাছে রেখে দেবে। এমন একটা হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে একটা জীবন পার করা যায়। রিহানের মাও বুঝি তাই করেছেন।
আচ্ছা সে কি একটু বেশী বেশী ভাবছে এই লোকটাকে? প্রেমে পড়ে গেল নাকি? বারান্দায় গিয়ে দাড়ায় সে। নতুন কোন ভুলে জড়িয়ে যাচ্ছে না তো আবার?
৭.
নিজের বাড়ি থেকে একেবারে বাহির হয়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার। মা আর ছোট ভাইটাও খুব কাঁদছিল। কিন্তু কিভাবে সে থাকবে। মা তার কাছে জমানো টাকা যা ছিলো দিয়ে দিলেন। অল্প কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আর কাপড় নিয়ে সে চলে আসলো। রিক্সা থেকে নামতেই সবুজ মিয়া এসে ব্যাগটা নিয়ে নিল। এই বাড়িতেই বা কতদিন? বাসায় ঢুকেই রিহানকে দেখতে পেল সোফায় বসে আছে।
-কিরে এই বাসাই দেখি তোর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেল।
রিহানের খোঁচা দেয়া কথাটা শুনে তার চোখে পানি চলে আসলো। কিন্তু কোথায় যাবে সে। নানার বাড়ী তো গ্রামে। আর চাচা, ফুপুদের বাসায় মনে হয় না তাকে ঢুকতে দেবে। চোখের পানি চট করে মুছে নিল সে।
-খুব শীঘ্রই চলে যাব। চিন্তা করিস না।
-সেটাই ভাল। অযথা অন্যের ঘাড়ে বসে থাকবি কতদিন?
-তুই না আমার ভাল বন্ধু?
-বন্ধু বলেই কি তোর সব দায়িত্ব নিতে হবে নাকি?
-আমাকে কয়েকটা দিন সময় দে রিহান। বলছি তো চলে যাব।
রিহান রাহার সামনে থেকে চলে আসে। সে তো এমন নির্দয় নয়। কিন্তু তার যার সাথে সম্পর্ক সে তো রাহাকে কোনো ভাবেই আর সহ্য করতে পারছে না। রাহা আর তাকে নিয়ে উল্টা পাল্টা সন্দেহ। সে যতই বোঝানোর চেষ্টা করছে যে রাহা আর সে খুব ভাল বন্ধু এর বেশী কিছু নয়। ততই ভুল বোঝাবুঝি বেশী হতে থাকে। জীবন যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে দিন দিন।
নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। বাবাও জানি কি? রেখে চলে আসতো। তা না সাথে করে নিয়ে চলে এসেছেন। আবার আদর যত্নও করছেন। ধুর কিছু ভাল লাগে না।
ফোন বাজতেই সে দেখে তৃণার ফোন। উহ্ আবার শুরু করবে এখন। না ধরলেও সমস্যা।
-হ্যালো
-কি করো ময়না পাখি।
-তেমন কিছু না। বসে ছিলাম।
-ওই মেয়ে গেছে?
-নাহ। যাবে বলেছে।
-বলেছে আর তুমিও হাত গুটিয়ে বসে আছ?
-তো কি করবো তৃণা? বের করে দিবো ?
– হ্যা তাই দিবা। কেন তোমার বউ লাগে নাকি?
-এই সব বলা বন্ধ করো। যাবে বলেছে যখন তখন নিশ্চই যাবে। কেন এমন করছো?
-যেই মেয়েকে তার বাবা বাসায় ঢুকতে দেয় না সে কেমন বুঝি তো। সমস্যা নিশ্চই কিছু ছিল।
-কি বলছো তুমি? ওকে তো আমি অনেক আগে থেকে চিনি। আর সেদিন ও তো আমাদের বাসাতেই ছিল নাকি? আর আমি তো ওকে এনেছিলাম।
-তাহলে এক কাজ কর। তুমি ওকে বিয়ে করো আর তা না হলে তোমার বাবার সাথে বিয়ে দাও। তোমার ছোট মা হয়ে যাবে।
-তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। রাখো এখন।
বলেই সে ফোন রেখে দেয়। কি সমস্যায় যে পড়লো? বাবাকে বলে আজ একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
রাতে খাবার টেবিলে রিয়াদ সাহেব আর রিহান খেতে বসেছেন। রাহাকে না দেখে তিনি বুয়াকে বললেন তাকে ডাকতে।
-কি দরকার বাবা? ও না হয় পরে খাবে।
-এটা কেমন কথা রিহান। ও তো মেহমান তাইনা। আর মেয়েটা এমনিতেই মন খারাপ করে থাকে। ওর সাথে ভাল ব্যবহার করবার চেষ্টা করো।
-কিসের মেহমান? বাড়ি থেকে সব নিয়ে হাজির হয়েছে। সহজে যাবে বলে মনে হয় না।
-তো কি হয়েছে? আজ না গেলেও ওর বাসার সাথে সমস্যা মিটলেই চলে যাবে। এত অস্থির হচ্ছ কেন?
রাহা আসছে না দেখে তিনি বুয়াকে আবার ডাকলেন।
-কি হলো বুয়া আপাকে ডাকলে না?
-আপা পরে খাইবো? মন খারাপ মনে হইলো।
তিনি খাবার রেখে উঠে পড়লেন। হাত ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে গেলেন। সারাদিন পর বাসায় ফিরে এমন অস্বস্তিকর পরিবেশ ভাল লাগে না। মাথাটা ধরেছে । বুয়াকে ডেকে চা দিতে বললেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালালেন একটা। মেয়েটাকে নিয়ে ভাল সমস্যায় পড়া গেল। সিগারেট ফেলে ঘরে আসতেই রাহা চা নিয়ে ঢুকলো। সাইড টেবিলে চা রেখে সে দাড়িয়ে রইলো।
-কিছু বলবে তুমি?
-আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিন প্লিজ। আমি চলে যাব।
-কি হয়েছে বলোতো? আমি তো তোমাকে যেতে বলিনি।
-আমি জানি আমি আপনাদের বিপদে ফেলেছি। সত্যি বলছি আমার অন্য কোনো যাবার জায়গা থাকলে আমি চলে যেতাম।
-শোনো তুমি যতদিন ইচ্ছা থাকো। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
রাহা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
তিনি উঠে এসে মাথায় হাত রাখলেন। রেহনুমার কান্নাটাও কি এমন ছিলো? সে যেন ফিরে এসেছে।
-রাতে খেয়েছো?
সে মাথা নাড়িয়ে না বলে।
তিনি রাহার হাত ধরে খাবার ঘরে নিয়ে আসলেন। চেয়ারে বসতে বলে খাবার প্লেটে নিয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেন গরম দিলেন। খাবার নিয়ে তার সামনে দিয়ে বসলেন।
-শেনো তুমি এখানেই থাকবে। এটা আমার বাড়ি। যে যাই বলুক তোমার তা শোনার দরকার নেই।
-আমি হস্টেল খোঁজা শুরু করেছি। পরিচিত কয়েকজনকে বলেছি। পেলেই চলে যাব।
-এই মেয়ে আমি যা বলেছি তাই হবে। তুমি এখানেই থাকবে। তুমি আমার দায়িত্ব। বুঝেছো। যদি কখনও তোমার বাবা নিতে আসেন তবেই যাবে।
-কিন্তু চাচা আমি চাই না আমার জন্য আপনার আর রিহানের সম্পর্ক নষ্ট হোক।
-এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি এক কাজ করো ইউনিভার্সিটি যাওয়া শুরু কর। তাহলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন চুপ করে সবটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি যাই।
চলবে…
এমি