ভালোবাসা মন্দবাসা পর্ব-৮+৯+১০

0
738

#ভালোবাসা_মন্দবাসা (পর্বঃ৮,৯,১০)

৮.

ছুটির দিন বলে আজ সবাই বাসায়। রিয়াদ সাহেব আজ অনেক বাজার করে আনলেন। বুয়া খুব বিরক্ত। এতো বাজার সব ঠিক করতে হবে তারপর রান্না। সে নিজে নিজেই কথা বলতে থাকে।
রাহা রান্না ঘরে পানি খেতে এসে দেখে বুয়া নিজের মনে গজগজ করছে। সে ভাবে আজ তো বসেই আছে। আজ রান্না করলে কেমন হয়।
-আজ আমি রান্না করবো। তুমি অন্য কাজগুলো করো।
-না আপা পরে হাত পুড়বেন । স্যারে আমারে বকবো। আপনি যান লেখা পড়া করেন।
-আরে নাহ। কিছু হবে না। তুমি বলোতো তোমার স্যার কি খেতে পছন্দ করে?
-এই ধরেন সরিষা দিয়ে ইলিশ, খিচুড়ী, চিকন করে আলুভাজা। তবে সেই সব আম্মার হাতের রান্না। আমার রান্না তো ভালো হয় না।
-আচ্ছা আজ আমি এগুলোই রাধবো। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো।

দুপুরে খাবার টেবিলে রিয়াদ সাহেব বেশ চমকালেন। সব তার পছন্দের খাবার। আর রান্নাও খুব ভাল হয়েছে।
-তোমার রান্না তো আজ চমৎকার হয়েছে বুয়া। কি বলিস রিহান?
-কি যে বলেন স্যার আমি কি এত ভালো রান্না পারি? রান্না তো আজ আপায় করছে।
-তাই তো বলি । তোমার রান্না এত ভাল হল কি করে?
-তুমি কেন কষ্ট করতে গেলে?
-তেমন কিছু তো করিনি তো চাচা। আপনি আরাম করে খান।
রিহান হঠাৎ উঠে দাড়ালো।
-তোমাদের এই সব ন্যকামি আর সহ্য হচ্ছে না আমার। এভাবে আর কতদিন চলবে?
-কি হয়েছে তোর?
-জানো না, নাকি ভনিতা করছ? আমি চাই না আমার মুখ দিয়ে কদর্য কথা গুলো তোমাকে বলতে। তুমি কি বোঝো না সবাই তোমাকে নিয়ে কি বলে?
-কি বলে ? বল শুনি?
রিহান নিজের ঘরে চলে যায়। রাহাও উঠে পড়ে। কি ভেবেছিল আর কি হয়ে গেল? জীবনটা এত জটিল কেন? ইউনিভার্সিতেও সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। সে কাউকে কিছু বলতে পারে না।
ইউনিভার্সটির হলে সিট পেয়ে গেছে। তবুও কোন মায়ায় সে এখানে আটকে আছে? শুধুই কি যাবার কোনো যায়গা নেই তাই? নাকি রিহানের বাবার মত কোনো পুরুষের ছায়ায় সে থাকতে চেয়েছিল সারা জীবন। কি হবে এর পরিণাম?

পরেরদিন ক্লাস শেষে বাড়ির গেটের কাছে দাড়ালো রাহা। সবুজ মিয়া সব সময় আশেপাশেই থাকে। আজ নেই। সামনের আপার্টমেন্টের দুই তলার বেলকুনিতে দুই মহিলা দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করছে আর হাসছে।
এতটাই মন খারাপ হলো যে সে রাস্তায় ছুটতে শুরু করলো। কোন দিকে যাচ্ছে কি করছে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না তার।
সবুজ মিয়া দোকানে গিয়েছিল ফেরার পথে রাহা আপাকে ছুটে বড় রাস্তার দিকে যেতে দেখলো। কি হয়ছে আপার? কোন বিপদ হয়নি তো? সেও দৌড়ে বাসায় চলে আসলো। বড় সাহেবকে ফোন করে জানাতে হবে। বুয়াকে ফোন করে খবরটা দিতে বলে সে রাস্তায় নামলো আপাকে খুঁজতে।

৯.

রিয়াদ সাহেব ফোন পেয়ে ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসারকে সব কিছু দেখতে বলে গাড়িতে উঠলেন। রাস্তায় এত যানযট কিছুতেই গাড়ি এগুতে পারছে না। তিনি রিহানকে ফোন করলেন কয়েকবার। রিহান ফোন কিছুতেই ধরলো না। তিনি কিছুতেই ধৈর্য ধরতে পারছেন না। এমন অস্থির কেন হচ্ছেন? মেয়েটার প্রতি কি কোন দুর্বলতা আছে তার?
এই বয়সে এ যে পাপ।
এটা ঠিক যে মেয়েটা আসায় বাড়িটা আবার আগের মত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এমন লাগে যেন রেহনুমা ফিরে এসেছে। রিহান যে খুশী নয় তা তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু তার কি বা করার আছে? নাকি অনেক কিছুই করতে পারেন তিনি? যেটা তার মন চাইছে না বলে করতে পারছেন না। ভালোলাগা, ভালোবাসা আর কামনার এক অদ্ভুত দ্বন্দের মাঝে বাস করছেন তিনি।
পুরো রাস্তা রাহার চিন্তায় তার দম আটকে আসতে চাইলো। বাসায় নেমেই সবুজ মিয়াকে খুঁজলেন। সে নিচে নেই। বুয়া গেট খুলে দিলো।
-সবুজ মিয়া কই বুয়া?
-সবুজ তো হেই তহন গ্যাছে আর ফেরত আসে নাই।
-রিহান কি বাসায় আছে?
-নাহ ভাইজানও তো আসে নাই।
-আচ্ছা তুমি দরজা লাগিয়ে দাও। আমি দেখি থানায় যাই।
তিনি গাড়িতে উঠতেই রিহানের ফোনটা এলো।
-তুমি কোথায় রিহান?
-বাবা তুমি ইউনাইটেড হসপিটালে চলে এসো।
-হাসপাতালে কেন?
-রাহা এক্সিডেন্ট করছে বাবা। আমরা ইমারজেন্সিতে। তুমি আসো।
তার শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে কেন? বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নাই তো? রিহান তবুও পাশে আছে জেনে একটু নিশ্চন্ত হবার চেষ্টা করলেন। ড্রাইভারকে জোরে গাড়ি চালাতে বললেন। আজ যেন রাস্তা শেষ হতেই চায় না। ইমার্জেন্সির সামনে গাড়ি থামতেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন। করিডোরে রিহান, সবুজ মিয়ার সাথে রাহার বাবা মাও দাড়িয়ে।
তিনি থমকে দাড়ালেন। রিহানকে কাছে ডেকে কি হয়েছে জানতে চাইলেন?
-বাবা ও তো দৌড়ে গিয়ে একটা প্রাইভেট কারের সামনে পড়েছিল। ধাক্কা খেয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ে। মাথায় আঘাত লেগেছে আর কিছু ফ্রাকচার হয়েছে। জ্ঞান নেই কোনো। ভাগ্য ভাল সবুজ মিয়া ছিল। সে পাশের একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেছে আর আমাকে ফোন করেছে। পরে আমি এসে এ্যামবিউলেন্স নিয়ে এখানে এনেছি।
-আর রাহার বাবা মা?
-আমি ফোন করেছি বাবা। তুমি এমন ঘামছো কেন? তুমি আসো এখানে এসে বসো।
-নাহ আমি ঠিক আছি। তুমি যাও দেখো ডাক্তারদের সাথে কথা বলা যায় কিনা?
বলেই তিনি ধপ বসে পড়লেন। বুকের মধ্যে আরো একজনকে হারানোর ব্যাথা যেন তার সব শক্তি নি:শেষ করে দিচ্ছে। তাকে বসে পড়তে দেখে আবরার সাহেব এগিয়ে আসলেন। তার পাশে বসে তার হাত ধরলেন।
-আমাকে মাফ করে দেন ভাই। আমি আপনার সাথে আর আমার মেয়েটার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি।
কাঁদতে শুরু করলেন আবরার সাহেব। তিনি কিছু বললেন না। চুপ করে বসে থাকলেন। তিনি কিছু অনুভব করতে পারছেন না। সব শূণ‍্য মনে হচ্ছে।

১০.

রাহার জ্ঞান ফিরেছে আজ দুই দিন পরে। হাত ভেঙ্গেছে দুই জায়গায় আর পাঁজরের হাড়ও ভেঙ্গেছে। মাথায় চোট তো আছেই। কাউকেই চিনতে পারছে না। ডাক্তার অবশ্য বলেছে এটা সাময়িক। বড় রকম শক পেলে এমনটা হয় বলেছেন। তবে কতদিনে সারবে তা বলেনি।
রিয়াদ সাহেব প্রতিদিন আসেন হাসপাতালে। রাহার মা প্রায় সব সময় থাকেন। আজ যখন রিয়াদ সাহেব হাসপাতালের জন্য রওনা হলেন তখন রাস্তায় এক পিচ্চি দোলনচাঁপা নিয়ে ঘুরছিল। তিনি ফুলগুলো কিনে নিলেন।

রাহা ঘুমিয়ে ছিল বলে তিনি বেশীক্ষন বসলেন না। ফুলগুলো সাইড টেবিলে রেখে আসলেন। বাহিরে আসতেই আবরার সাহেবের সাথে দেখা হয়ে গেল।
-সালাম ভাই, কেমন আছেন। আপনি যা করতেছেন আমার মেয়ের জন্য। এই ঋণ শোধ করবো কি করে?
তিনি কিছু না বলে হাসলেন একটু।
-আপনাকে জরুরী কথা বলার ছিল। আসলে এত খরচ করে এই হাসপাতালে মেয়ের চিকিৎসা করা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। ডাক্তার বললো আমরা ওকে এখন বাসায় নিতে পারি। মাঝে মাঝে এসে চেকআপ করিয়ে যেতে হবে।
রিয়াদ সাহেব কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন। তার কি বা করার আছে?
-আপনাদের মেয়ে অবশ্যই আপনাদের অধিকার বেশী। আমার মনে হয় আরও কয়েকদিন এখানে থাকলেই ভালো।
-আপনাকে তো সব বললাম ভাই। আমাদের সমস্যাটা একটু বোঝার চেষ্টা করেন।
-আপনাদের যদি সমস্যা না থাকে তবে ওর চিকিৎসার খরচ আমি দেব। চিন্তা করবেন না। আর ডাক্তারের সাথে আমি কথা বলবেো। আজ আসি।

পরের দিন হাসপাতালে এসে তিনি যা শুনলেন তাতে তার মেজাজ পুরা বিগড়ে গেল। আবরার সাহেব রাহাকে নিয়ে গেছেন। তিনি সবার সাথে খুব চিৎকার চেচামেচী করলেন। কেন তাকে না জানিয়ে রোগীকে ছেড়ে দেয়া হলো।
-স্যার ওনারা তো রোগীর বাবা মা। আমরা কি করতে পারি?
-ভর্তি তো আমরা করেছি নাকি? একবার ফোন করে জানাবার প্রয়োজন মনে করলেন না?
-সরি স্যার, আমাদের আসলেই ভুল হয়ে গেছে।
-সরি বললেই হবে নাকি। আপনারা রোগীর কথা একবারও ভাবলেন না?
-স্যার রোগী তো অনেক স্টেবল। আর ওনারা তো বলেছেন ডাক্তারকে দেখিয়ে যাবেন।

এদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তিনি বাসায় ফিরে আসলেন। রাহা না থাকায় বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগছে। গেস্ট রুমের দরজায় গিয়ে দাড়ালেন। ঘরে সব রাহার জিনিস। তিনি বুয়াকে সব গুছিয়ে ব্যাগে ভর্তি বললেন। ড্রাইভার কে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন।

টেবিলের ওপরে চোখ আটকে গেল। একটা ডায়েরী। তিনি সেটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে এলেন।

চলবে….

এমি