#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৫
দুদিন আগে নীলের হসপিটাল থেকে সিদ্ধান্ত জানানো হয়, সকাল থেকেই বাড়ির সকলে চিন্তিত যদিও নীল বেশ ইতিবাচক আছে এই ব্যাপারে। আত্মবিশ্বাসের ফলে নীল মোটেও ভেঙে পড়েনি, যা হবে দেখা যাবে। দুপুরে হাসপাতালে মিটিং ডাকা হয়, দীর্ঘ আলাপের পর প্রমাণিত হয় যে সেদিন ওই রোগীর মৃ’ত্যুতে নীলের কোনো হাত ছিলো না। নীল এখন থেকে হসপিটালে আবারো পূর্বের ন্যায় কাজে ফিরতে পারবে। এ খবরে শুধু নীল নয় বরং ওর কলিগরাও যেনো স্বস্তি পেল। মিটিং শেষ হতেই নীল প্রথমে বাড়িতে ও পরে আরোহীকে ফোন করে খবরটা জানালো। গত দুটো সপ্তাহের চিন্তার অবশেষে অবসান ঘটলো! আরোহীর ইচ্ছে হচ্ছিলো এ মুহূর্তে গিয়ে নীলকে জড়িয়ে ধরতে, অফিসে ওর মনই টিকছিল না কিন্তু কি আর করার? কাজের জায়গা থেকে তো আর মন চাইলেই চলে যাওয়া যাবেনা। অপেক্ষায় ছিলো কখন ছুটি হবে। সেদিন বিকেলে ছুটি হতেই আরোহী দ্রুত বাড়ি ফিরেই নীলকে জড়িয়ে ধরেছিল। কিছুদিন যাবত নীল কাজে ফিরেছে, সবকিছু আবারো স্বাভাবিক পর্যায়ে চলছে। দু সপ্তাহ হসপিটাল থেকে দূরে থাকাটা যেনো এক বছরসম মনে হচ্ছিল নীলের। অবশেষে কাজে ফিরতে পেরে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে! এরই মাঝে আরোহী নীলের জন্যে ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করলো। আজ নীলের বাড়ি ফিরতে প্রায় এগারোটা বেজে গেছিলো, ভীষণ ক্লান্ত ছিলো। রুমে বাইরে দাড়িয়ে দেখলো লাইট বন্ধ, ভেবেছিল আরোহী হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু রুমের ভেতরে পা রাখতেই আরোহী বলে উঠলো…
— লাইট জ্বালাবেন না!
— কেনো?
— আপনার জামাকাপড় এই নিন, আর গিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনার জন্যে সারপ্রাইজ আছে
নীলের হাত থেকে জিনিসপত্র নিয়ে ওকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো আরোহী, একটু পরে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়েই নীল দেখলো পুরো ঘরে হালকা নীল রঙের আলো জ্বলছে আর পাশেই ছোটো একটি টেবিলে আরোহী মোম জ্বালাচ্ছে, টেবিলের ওপর খাবার রাখা। কিছুটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের সেট আপ।
— আরেহ! এসব কিসের…
মোমবাতির আলোয় আরোহীকে দেখে নীল স্তব্ধ হয়ে গেলো। ম্যাজেন্ডা রঙের টিস্যু শাড়ি পড়েছে মেয়েটা। চুলগুলো খোলা, অসম্ভব সুন্দরী লাগছে তাকে। মোম জ্বালানো শেষে আরোহী চুলগুলো সামনে রেখে নীলের কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো…
— কেমন লাগছে?
আরোহীর চোখের ওপর থেকে চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে মুচকি হাসলো নীল…
— ইউ আর লুকিং ড্যাম গর্জিয়াস! এই রাত বিরাতে হঠাৎ এতো আয়োজনের কারণটা কি জানতে পারি?
— এতদিনের এতো দুঃচিন্তা শেষে পুনরায় কর্মক্ষেত্রে ফেরার সুবাদে আপনাকে অভিনন্দন জানানোর জন্যেই আমার এই ছোট্ট আয়োজন
— এটা ছোটো আয়োজন নয়, অফিস থেকে ফিরলে কখন আর এসবই বা কখন করলে?
নীলের গলা জড়িয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে আরোহী বললো…
— আমার সময়েই ফিরেছি আর চট করে সব করে ফেলেছি, অতো সময় লাগেনি। কেমন লাগলো আমার এই আয়োজন?
— টায়ার্ড হয়ে ফিরে যে এমন একটা সারপ্রাইজ পাবো ভাবিনি, খুব সুন্দর হয়েছে আর খুব খিদেও পেয়েছে
— দেরি কিসের? বসুন না। সব তো আপনার জন্যেই
আরোহী নীলের জন্যে চেয়ার টানতে যাচ্ছিলো, তখনই নীল হুট করে আরোহীকে কোলে তুলে নিলো…
— ওসব খাবার খেয়ে না হয় পেট ভরবে কিন্তু আমার মন তো ভরবে না! আই ওয়ান্ট সামথিং এলস!
নীলের ইশারা বুঝে ওই অবস্থাতেই লজ্জা পেয়ে নীলের ঘাড়ে মুখ গুজলো আরোহী, এতদিন নীলের থেকে দূরে দূরে থাকলেও আজ আর তার কাছে আসতে আপত্তি নেই। সম্পর্কে বিশ্বাস, ভালোবাসা যখন আছে তার পূর্ণতা দেওয়াটাও জরুরি!
______________________________
সময় স্রোতের মতো চলে যায়, দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর একসঙ্গে কাটিয়ে ফেলেছে নীল ও আরোহী। এই তিন বছরের ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ফসলস্বরুপ আর কিছুদিন বাদেই তাদের সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখবে। বর্তমানে প্রেগনেন্সির সাড়ে আটমাস চলছে, শুরু থেকেই মেয়েটার শরীর অনেক দুর্বল। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া না করতে পারায় শরীরের দুর্বলতা কাটছেই না। এ অবস্থায় অফিস করতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিলো বলে নীল বলেছিলো বেশি কষ্ট হলে জবটা ছেড়ে দিতে কিন্তু এতো কষ্টে পাওয়া চাকরিটা ছাড়তে মন চাইছিলো না আরোহীর। নিজের জবের প্রতি মায়া পড়ে গেছিলো কিন্তু এখন এমন অবস্থা যে শরীর আর টানছে না তাই প্রেগনেন্সির পাঁচমাসে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলো। সেই তখন থেকেই নীল ও বাড়ির সকলের আদর রুপী শাসনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে আরোহী। আরোহী খেতে পারেনা বলে রওশন বেগম বৌমার জন্যে দুবেলা করে নতুন নতুন আইটেম তৈরি করে দেন যাতে মেয়েটা একটু খেতে পারে। প্রেগনেন্সিতে আরোহীর একটি বড় সমস্যা হলো মাঝে মাঝেই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, যদিও ডাক্তার বলেছে এটা স্বাভাবিক কিন্তু এখন নীল এই নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। প্রত্যন্ত গ্রামে নীলের হসপিটাল থেকে একটি হেলথ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে আছে, সেখানে যোগ দিতে যাবে কাল। তিনদিন থাকতে হবে। এই শেষ সময় আরোহীকে রেখে যেতেও চিন্তা হচ্ছে ওর, আবার না গিয়েও উপায় নেই। একবার যাবেনা বলে ঠিক করেছিলো পরে আরোহীর জোরাজুরিতে যেতে রাজি হয়েছে। নীল ব্যাগপ্যাক করছে, আরোহী বারান্দায় হাঁটছিলো। এরই মাঝে আবারো ওর নিঃশ্বাসের সমস্যা হলো, নীল দ্রুত চেয়ার টেনে ওকে বসালো, ব্রিথিং এক্সারসাইজ করিয়ে পানি খাইয়ে দিলো…
— কষ্ট হচ্ছে?
আরোহী ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলে পেটে হাত বুলিয়ে বললো…
— একটা ছোট্ট প্রাণকে পৃথিবীতে সুস্থভাবে আনার কাজ করছি, একটু কষ্ট তো হবেই তাইনা? মাঝে মাঝে ওই একটু নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয় আর কি
— বেশি সমস্যা হলে ডাক্তার দেখিয়ে আসি চলো?
— এই না কিছুদিন আগে দেখিয়ে এলাম?
— কিন্তু নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে বলছো যে?
— ওসব একটু আধটু তো হবেই, ডাক্তার কি বলেছে শোনোনি এর আগে। এমন অনেকের হয়। আমার নিজের চিন্তা নেই, বেবির গ্রোথ ভালো আছে। কোনো সমস্যা নেই এটাই আসল। এখন শুধু শুধু হসপিটালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই
— ঠিক আছে, কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে মাকে বলবে আর বেশি সমস্যা হলে আমাকে কল করবে। তোমার তো আবার সমস্যা লুকিয়ে রাখার অভ্যাস, এমনকিছু যদি করো তাহলে কিন্তু খবর আছে তোমার
— আচ্ছা বাবা, খুব সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবো। শুধু সমস্যা হলেই কেনো, মাঝরাতে ঘুম না এলেও কল করবো। সারারাত জ্বালাবো তখন বুঝবে
— যখন ইচ্ছে তখন কল করবে, আপনার জন্যে আমি চব্বিশ ঘণ্টাই ফ্রি!
প্রেগনেন্সির শেষ পর্যায়ে এসে আরোহীর প্রচুর মুড সুইংস হচ্ছে, মেয়েটার মন এই ভালো থাকে আবার এই খারাপ হয়ে যায়। রওশন বেগমও এ অবস্থায় আরোহীর যথাসম্ভব যত্ন করছেন, আরোহীর মা অনেকবার মেয়েকে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আরোহী যায়নি, এ অবস্থায় বাপের বাড়ির থেকে এ বাড়িতে থাকাটাই উত্তম সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে ওর। পরেরদিন সকালেই নীল চলে যায়, হসপিটালের সব ডিপার্টমেন্ট থেকে একজন করে ডাক্তার যাচ্ছে ফ্রি হেলথ চেকাপ দিতে। নীল যাওয়ার পর সারাদিন রওশন বেগম আরোহীর খাওয়া দাওয়ার বিশেষ খেয়াল রেখেছেন। এই তিন বছরে আরোহীর প্রতি রওশন বেগমের মনোভাবে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে প্রেগনেন্ট হবার পর নিজের নাতি/নাতনির সুবাদে হলেও আরোহীর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে শুরু করেছেন! শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে সারাদিন ভালোভাবে কাটালেও রাতে নীলকে ভীষণভাবে মিস করে মেয়েটা, নীলের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা হয় তবুও আরোহীর মন খারাপ। তিনদিন কেটে গেছে, কালকে নীল ফিরবে। আরো একটা রাতের অপেক্ষা, আরোহীর কিছুতেই ঘুম আসছে না তাই ভাবলো একটু টিভি দেখা যাক। তখনই নীলের ফোন এলো…
— ঘুমিয়ে গেছো?
— না! টিভি দেখছি।
— ঠিক আছে, আরেকটু টিভি দেখে ঘুমিয়ে পড়ো। বেশি রাত জেগো না
আরোহীর কানে গাড়ির হর্নসহ রাস্তার অন্য যানবাহনের আওয়াজ এলো…
— গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, কোথায় তুমি?
— রাস্তায় আছি, বাড়ি ফিরছি!
অবাক হলো আরোহী…
— আজকে? তোমার না কাল ফেরার কথা ছিলো?
— এখানকার কাজ তো আজ শেষ, কাল হাসপাতালের গাড়ি করে সকলের একসঙ্গে ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু আমি আজকেই ফিরছি বাসে!
— এতো তাড়াহুড়োর কি ছিল? সকলকে সঙ্গেই ফিরতে পারতে
— তোমার ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে আসছে, এ অবস্থায় আমি যতটা সময় সম্ভব তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। আমার সন্তানের জন্মের সময় তোমার পাশে থাকতে চাই আমি
নীলের ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে ছিলো মেয়েটা, অবশেষে অপেক্ষার অবসান হচ্ছে ভেবেই মন ভালো হয়ে গেলো মেয়েটার। তখনই ফোনের ওপরপাশ থেকে বিকট একটা আওয়াজ আসলো যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। আরোহী কিছু বুঝে উঠতে পারলো না কি হচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যেই ফোনটাও কেটে গেলো! আরোহী ধীরে ধীরে উঠে বসে নীলকে আরো কয়েকবার ফোনে ট্রাই করলো কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। প্রায় দশ – বারোবার ফোন করার পরেও যখন ফোন বন্ধ পেলো তখন হাত পা কাঁপতে শুরু করলো আরোহীর। মনের মধ্যে যতো রাজ্যের খারাপ চিন্তা এসে ভর করতে শুরু করলো, নীলের কোনো বিপদ হলো না তো? মিনিট পনেরো পর টিভিতে নিউজ হচ্ছে, হেডলাইনে লিখা উঠছে যে একটি বাসের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। নীলও তো বাসেই আসছিল! এই খবর দেখামাত্র আরোহীর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো, ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো মেয়েটা। নিঃশ্বাস আটকে আসছে মেয়েটার, চোখদুটো পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠেছে। অতীতের সেই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার ঘটবে না তো?
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]
#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৬
ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ায় চাপ পেয়ে ব্যথা পায় আরোহী, কিন্তু এ যন্ত্রণার এখন যেনো টেরই পাচ্ছেনা ও। ফ্লোরে বসেই চিৎকার করে কান্না করে উঠতেই নীলের মা বাবা ছুটে আসেন। আরোহীকে ফ্লোরে বসে দেখেই দ্রুত এগিয়ে এসে ওকে টেনে তোলেন…
— কি হয়েছে আরোহী, পড়ে গেছো নাকি?
— মা, নীলের অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেছে মা!
আরোহীর কথা শুনে নীলের মা বাবা উভয়েরই বুক ধক করে উঠল, রওশন বেগম পুনরায় প্রশ্ন করলেন…
— অ্যাকসিডেন্ট মানে? ক..কি বলছো?
— আমার সঙ্গে ও কথা বলছিল মা, ত..তখনই..মা প্লিজ খোঁজ নিয়ে দেখুন ও কোথায় আছে। আমি ওর কাছে যেতে চাই এখুনি
আরোহী অস্থির হয়ে উঠেছে, ঠিকমতো কথাও বেরোচ্ছে না ওর মুখ থেকে। ওর এই অবস্থা দেখে রওশন বেগম অসহায় চোখে নীলের বাবার দিকে তাকালেন…
— অ্যাই, আরোহী এসব কি বলছে? তুমি তাড়াতাড়ি একটু খোজ নিয়ে দেখো তো
মীর সাহেবও দেরি না করে দ্রুত খোঁজ নিলেন।নীলের অ্যাক্সিডেন্টের সংবাদ পাওয়া মাত্রই সকলে হাসপাতালে ছুটলো, রাতের বাস হওয়ায় যাত্রী কম ছিলো এবং ড্রাইভার বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর জন্যেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আহত সকলকে কাছেরই এক হাসপাতালে নেওয়া হয়, আরোহী নিজের শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ওখানে যায়। ডাক্তার জানায় নীলের মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছে এবং হাতেও ফ্র্যাকচার হয়েছে। চিকিৎসা শুরু হয়েছে কিন্তু মাথায় চোট পেয়েছে বলে ২৪ ঘন্টা না পার হওয়া অব্দি কিছু বলা যাচ্ছে না। ছেলের সার্বিক অবস্থা শুনে রওশন বেগম ভীষণ ভেঙে পড়লেন, মীর সাহেব ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছেন যাতে চিকিৎসার কোনো ত্রুটি না থাকে। সকলের কথাবার্তা শুনে পেট চেপে ধরে পাশের একটি চেয়ারে বসে পড়লো আরোহী। নীল মাথায় চোট পেয়েছে শুনেই আরোহী আরো ভেঙে পড়লো, ফুপিয়ে কান্না করতে করতে হিচকি উঠে গেছে মেয়েটার। বারবার ওর মাথায় একটাই কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, শুভর মতো নীলেরও কিছু হয়ে যাবেনা তো? ডাক্তারের সঙ্গে কথা শেষে মীর সাহেব রওশন বেগমের সঙ্গে কিছু বিষয়ে আলাপ করছিলেন তখনই আরোহী কান্না করতে করতে বলে উঠলো…
— আমার জন্যে হয়েছে এসব, আমি বলেছিলাম বলেই ও তাড়াহুড়ো করে এই রাতের বেলা ফিরতে গেছিলো। আগামীকাল সকালে ফিরলে এটা হতো না, নীল সুস্থ থাকতো। আমার জন্যে আজ ওর এই অবস্থা
রওশন বেগম নিজেও ভেঙে পড়েছেন তবুও তিনি আরোহীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, আরোহীর পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন…
— তোমার জন্যে কিছু হয়নি আরোহী, এটা একটা দুর্ঘটনা মা। তুমি নিজেকে শক্ত রাখো, এ অবস্থায় এতো ভেঙে পড়লে চলবে বলো?
— মা, আজ ও ফেরত আসার প্ল্যান না করলে এমন কিছুই তো হতো না। আজ যদি নীলের কিছু হয়ে যায় আমি নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করবো!
— নীলের কিছু হবেনা আরোহী, তুমি শান্ত হও
— আমি নীলের সঙ্গে দেখা করতে চাই বাবা!
— এখন ডাক্তার কাউকেই ভেতরে যেতে দেবেনা মা, ভেতরে ওর চিকিৎসা চলছে তো। আমরা গেলে বিরক্ত হবেন ওনারা
— আমি দুর থেকে একবার শুধু দেখবো, প্লিজ বাবা। ওকে না দেখা অব্দি আমার ভেতরে শান্তি লাগবেনা বাবা, প্লিজ একবার!
আরোহী অনুনয় করলো, মেয়েটার অবস্থা চোখে যাচ্ছেনা। মীর সাহেব বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন…
— অবশ্যই দেখা করবে আরোহী, আমরা সবাই দেখা করবো। কিন্তু ওর আগে জ্ঞান ফিরুক।ডাক্তার বলেছে ওর জ্ঞান না ফেরা অব্দি ভেতরে যাওয়া যাবেনা
আরোহীকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলেন দুজনে কিন্তু মেয়েটার মন যে মানছে না, এদিকে ওর এই অবস্থা দেখে রওশন বেগমও নিজেকে শক্ত রাখতে পারছেন না। আহত আরো রোগীদের পরিবারের লোকজনও এসেছে, হাসপাতালে এক থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিলো। এ খবর পাওয়ার পর আরোহীর ভাইও আসে, নীলের অবস্থা শুনে চিন্তা সকলেরই হচ্ছে কিন্তু এখন আরোহীকে নিয়ে সকলকে বেশি চিন্তিত। প্রেগনেন্সির এই শেষ সময়ে এসে মেয়েটাকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে কে জানতো! চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন নীলের জ্ঞান ফেরেনি তখন আরোহীর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। অতিরিক্ত কান্নাকাটি ও চিন্তায় ওর পানি ভেঙে যায়। এ অবস্থায় জরুরি সিজার করা হয়। ফুটফুটে একটা মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় আরোহী, মেয়েটার মুখ দেখার পর নিজের কান্না ধরে রাখতে পারেনি মেয়েটা। নীলের ভীষণ ইচ্ছে ছিলো মেয়ের, জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তে প্রতিটা স্ত্রী চায় তার স্বামী পাশে থাকুক। আরোহীকেও নীল কথা দিয়েছিলো সঙ্গে থাকবে কিন্তু ভাগ্য যে এমন এক নিষ্ঠুর খেল খেলবে তা তো কারোরই জানা ছিলো না! ছেলে হবে না মেয়ে সেটা জানা ছিল না ওদের, নীল দুটো নাম ঠিক করেছিলো আরোহীর নামের সঙ্গে মিল রেখে। নীলের পছন্দ অনুযায়ীই ওদের মেয়ের নাম রাখা হলো আনহা!
_______________________________
মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ায় কোমায় চলে গেছে নীল, বিগত তিনমাস যাবত সে কোমায়। তবে ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়েছেন যে ওর জ্ঞান ফিরবে, সেদিন থেকে নাওয়া খাওয়া ভুলে নীলের মা বাবা ও আরোহী সকলেই পর্যায়ক্রমে হাসপাতালে থাকা শুরু করেছে। ডেলিভারির পর থেকেই আরোহী নীলের কাছে দৌড়াদৌড়ি করছে, ছোট্ট মেয়ের যত্ন করা আর নীলের কাছে থাকতে গিয়ে একপ্রকার নিজেকেই অবহেলা করছে আরোহী। এতো বছরেও আরোহীর প্রতি রওশন বেগমের যে ভালোবাসা জন্মায়নি তা এই তিনমাসে জন্মেছে। এই কয়েকমাসে রওশন বেগম দেখেছেন আরোহীর জীবনে নীল ঠিক কতটা গুরুত্ব রাখে। নিজের ওইটুকু সন্তানের প্রতিও আরোহীর তরফা খেয়াল নেই যতটা নীলের প্রতি আছে। রোজ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে খবরাখবর রাখছে আরোহী, এ মুহূর্তে নীলের জ্ঞান ফেরা ছাড়া আর কোনো বিষয়ের চিন্তা নেই ওর! দুপুরবেলা…রওশন বেগম ছিলেন নীলের কেবিনে। একটু পরে আরোহী ওর মেয়েকে নিয়ে এলো, ছোট্ট মেয়েটাকে শাশুড়ির কোলে দিয়ে বললো…
— আমি ওকে খাইয়ে দিয়েছি মা, কয়েক ঘন্টা আর বিরক্ত করবে না
— ও এমনিতেও তেমন বিরক্ত করেনা। অনেক শান্ত কিন্তু আরোহী, এভাবে থাকলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে মা আর এখন তো তুমি একা নও। বাচ্চাটার খেয়ালও তো রাখতে হবে তোমাকে তাইনা?
আরোহী নীলের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো…
— আমি ঠিক আছি মা, নীলের জন্যে আমাকে যে ঠিক থাকতেই হবে। আমার বিশ্বাস শীঘ্রই ওর জ্ঞান ফিরবে
— হ্যাঁ আরোহী, এতগুলো মানুষের দোয়া বিফলে যাবেনা। তুমি নীলের কাছে বসো, আমি ওকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি
রওশন বেগম নাতনিকে কলে নিয়ে বাইরে গেলেন, আরোহী টুল টেনে নীলের কাছে বসলো। ছোটো একটা বাটিতে পানি ও পাতলা একটা ভেজা কাপড় নিলো। আরোহী রোজ দুপুরে এসে নীলের হাত পা মুছে দেয়, ওর সঙ্গে কথা বলে কারণ ডাক্তারের ভাষ্যমতে নীলের জ্ঞান নেই কিন্তু ওর বডি রেসপন্স করে এবং অন্যদের কথাও ও শুনতে পায় তাই আরোহী রোজ নীলের সঙ্গে অনেক কথা বলে, বিশেষ করে ওর মেয়ের নানান কথা নীলকে জানায়। আরোহী চায় যতটা সময় নীল ওর মেয়ের সঙ্গে কাটাতে পারছেনা সেইসব মুহূর্তের কথা ও জানুক। নীলের সঙ্গে কথার এক পর্যায়ে আরোহী বললো…
— আর কত শুয়ে থাকবে বলোতো? শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগেনা? তুমি জানো তোমার মেয়েকে ফিডিং করাতে গিয়ে একটু বসে থাকলেই আমার কোমড় ধরে যায় সেখানে তুমি নাকি তিনমাস ধরে এভাবে শুয়ে আছো? আর কতদিন এভাবে থাকবে বলো?
হাত পা মোছানোর পর সবকিছু সাইডে রেখে আরোহী নীলের হাত ধরে বসলো…
— আমাদের মেয়ের তিনমাস বয়স হয় গেছে জানো? কিছুদিন পর হামাগুড়ি দিতে শিখবে, বসতে শিখবে। আমি একা একাই ওকে বড় হতে দেখবো? আমাদের কি কথা হয়েছিলো বলোতো? আমরা দুজনের মিলে একসঙ্গে ওকে বড় হতে দেখবো তাইনা?
বরাবরের ন্যায় আজও নীলের তরফ থেকে কোনো উত্তর এলো না, গত তিনমাস ধরে আশায় বুক বেঁধে আছে আরোহী। এই বুঝি নীল চোখ তুলে তাকাবে। নীলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরেই আরোহীর চোখদুটো ভিজে এলো…
— কতদিন তোমার সঙ্গে কথা বলি না, তোমার গলার আওয়াজ শুনি না। আমি আর পারছি না, প্লিজ তুমি আমাকে এভাবে শাস্তি দিও না
নীলের সঙ্গে যতটা সময় সম্ভব কাটায় আরোহী, সেইসময় নিজেকে শক্ত রাখার পুরো চেষ্টা করে কিন্তু নিজের প্রিয় মানুষকে এই অবস্থায় দেখে কেউ কি ঠিক থাকতে পারে? কিছুদিন পর…সকালে আরোহী ওর মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় রোদে বসেছিলো, রওশন বেগম তখন এক গ্লাস দুধ এনে আরোহীকে খাওয়ান। একটু পর মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে গা গরম মনে হলো।
— মা, ওর গা গরম লাগছেনা?
রওশন বেগম নাতনির গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন…
— ছোটো বাচ্চাদের গা এমনিতে তো একটু গরম থাকে কিন্তু ওর তো মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে
মেয়ের জ্বর হয়েছে শুনে চিন্তা বাড়লো আরোহীর, মেয়ের হাতগুলো আলতো করে ছুঁয়ে চিন্তিত হয়ে বললো…
— গত রাতে মেয়েটা আমার ঘুমায়নি, আমিও ভালোমত খেয়াল করিনি। মেয়েটার ঠিকঠাক যত্ন করতে পারছি না আমি!
— এতো চিন্তার কিছু নেই, ছোটো বাচ্চা তো জ্বর আসে অনেকসময়। আমি না হয় বিকেলে গিয়ে ওকে ডাক্তার দেখিয়ে আনবো
— না মা, আমিই নিয়ে যাবো। আমি ফোন করে সিরিয়াল দিয়ে রাখছি
বিকেলে মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যায় আরোহী, টিকার রিয়েকশণে মেয়ের স্বাভাবিক জ্বর হয়েছে শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলো। ডাক্তার দেখানো শেষে বাইরে বেরোতেই আরোহীর ফোন এলো, নীলের কেবিনের নার্স ফোন করেছে। আরোহীর বুকটা ধুক করে উঠলো, নার্স হঠাৎ ফোন কেনো করছে? কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েকে এক কোলে নিয়ে আরেক হাতে কল রিসিভ করে অপরপাশে নার্সের কথা শোনা মাত্রই আরোহীর পুরো শরীর যেনো অবশ হয়ে এলো!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]