#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#শেষ_পর্ব
বহু প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে, নীলের জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার জানিয়েছেন নীলের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। তবুও নিশ্চয়তার জন্যে তিনি কয়েকটা টেস্ট করার পরামর্শ দিয়েছেন। এতো মাস পর নীলকে সজ্ঞানে দেখে পরিবারের সকলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছে, রওশন বেগম তো ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবে জ্ঞান ফিরেছে বলে ডাক্তার এখনই নীলকে বেশি কথা বলার জন্যে বারণ করেছেন। নীলের মা বাবা কিছুক্ষণ ছেলের সঙ্গে থাকার পর আরোহী আসে, মেয়ে ওর কোলেই ছিলো। মেয়ে কোলে অবস্থায় আরোহীকে দেখামাত্রই নীলের চোখদুটো হঠাৎই ছলছল করে উঠলো। সেদিন মেয়ের সঙ্গে বাবার পরিচয় করিয়েছে এবং নীলের সঙ্গে অনেক কথা বলেছে আরোহী, কথা বলার শক্তি পাচ্ছিল না নীল তবে মনোযোগ দিয়ে নিজের প্রিয়তমার সকল কথাই শুনেছে। নীলের জ্ঞান ফেরার পর যেনো আরোহী নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। হাসপাতালে আরো কিছুদিন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকার পর বাড়ি ফেরে নীল, পুরোটা সময় আরোহী নীলকে চোখে চোখে রাখছে। কখন কি দরকার সবকিছুর খেয়াল রাখছে, রওশন বেগমও ওকে সাহায্য করেছেন। সকলের যত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে নীল। আনহার বয়স এখন ছয়মাস, এতদিন শান্ত থাকলেও মেয়েটা এখন অনেক কান্নাকাটি করে। ঘুমাতে চায়না। রাতের বেলা মেয়েকে নিয়ে আরোহীর প্রায় পুরো রাত জেগে থাকতে হয়। রাতে…আরোহী মেয়েকে এক কোলে নিজেই ঘুমানোর জন্যে বিছানা ঠিক করছিলো দেখে নীল বললো…
— তুমি অনেকক্ষণ ধরে কোলে নিয়ে ঘুরছ, ওকে বসিয়ে বা শুইয়ে দিয়ে কাজ করো
— কোল থেকে নামালেনই কেঁদে উঠবে, তখন তোমার মেয়ের কান্না থামানো মুশকিল হয়ে যায়। আমার অভ্যাস আছে ওকে কোলে নিয়ে কাজ করার
— ওকে আমার কোলে দাও, আমি কিছুক্ষণ রাখি
বাবার কোলে যেতেই ঢুকরে কেঁদে উঠলো আনহা, সঙ্গে সঙ্গে আরোহী আবার নিজের কোলে নিয়ে মেয়েকে শান্ত করলো। নীলের কোলে এলেই মেয়েটা প্রতিবার কান্না করে, এতে বেচারার মন খারাপ হয়ে গেছে
— আমার কোলে নেওয়া কি ঠিক হয়না? আমার কোলে এলেই দেখি কান্না করে, বাবা বা মায়ের কাছেও তো ভালোই থাকে
— আরে না না, মা বাবার কাছে গেলেও কান্না করে। এতো দুষ্টু হয়েছে না, মাকে একটু শান্তিতে দেখলেই ওনার কান্না শুরু হয়ে যায়। তুমি কিছুদিন আদর করলেই দেখবে ওর তোমার অভ্যাস হয়ে যাবে সমস্যা নেই
অনেক কষ্টে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও কখন ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি আরোহী, ওরা ঘুমিয়ে পড়ার পর নীলের মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেংগে যায়। মা – মেয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে, নীল কাত হয়ে ওদের দিকে ফিরে শুয়ে মেয়ের গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। আরোহীরও হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেলো, নীলকে জাগ্রত দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে জিজ্ঞাসা করলো…
— তুমি জেগে আছো যে? খারাপ লাগছে?
— উহু! তোমাদের দেখছিলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় বাচ্চাদের কি সুন্দর লাগে তাইনা? আর আমার মেয়েটা তো পুরো পুতুলের মতো
— হুমম! সারাদিন মায়ের কাছেই থাকতে চায় কিন্তু দেখতে পুরো তোমার মতো হয়েছে
— হুমম, একজন বাবার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় কোনটা জানো? মেয়ে যখন তার বাবার আদল পায়!
কতো মোহব্বতের সহিত নীল ওর মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে, আরোহী এই দৃশ্য মনভরে দেখছিলো। নীল আরোহীর হাতে হাত রাখলো…
— সরি আরোহী, আমি আমার কথা রকাহত পারিনি। আমি তোমার কঠিন সময়ে তোমার সঙ্গে থাকতে পারিনি
— উহু! কে বলেছে তুমি সঙ্গে ছিলে না? তুমি আমার সঙ্গেই ছিলে, তুমি আমায় মনের জোর দিয়েছো নাহলে এতগুলো দিন আমি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারতাম না। কিন্তু এতো সাহস আমার মধ্যে নেই নীল, একবার পেরেছি তারমানে এই না বারবার পারবো। আমার জন্যে হলেও তুমি এখন থেকে নিজের কথা আগে ভাববে। আমাকে রেখে আর কোথাও যাবেনা
নীল প্রতিউত্তরে কিছু বললো না, বরং আরোহীর মাথাটা নিজের কাছে এগিয়ে এনে আলতো করে চু’মু দিলো
________________________________
সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে প্রায় দুই বছর পর নিজের কর্মক্ষেত্রে ফেরে নীল, হাতের কব্জিতে ফ্র্যাকচার হওয়ার পর থেকে গুরুতর সার্জারি হাতে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তবুও হাসপাতালে তার সুনাম কমেনি, ডা. আরিয়ানের পদোন্নতি হয়ে সে এখন হাসপাতালের সবচেয়ে নামকরা সার্জন। নীলের সঙ্গে যে প্রতিযোগিতা চলছিলো তা প্রায় শেষই হয়ে গেছে বলা যায়। কলিগদের অনুরোধে আজ মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো নীল, সকলের সঙ্গে আনহা ভালোভাবেই মিশেছে। বাবাকেও বিশেষ বিরক্ত করেনি। ডা. আরিয়ান নীলের মেয়েকে দেখে বললেন…
— আপনার মেয়ে তো দেখি বড় হয়ে গেছে
— ও তো এখনও ছোটোই, তবে যতোই বড় হয়ে যাক আমার কাছে আনহা ছোটোই থাকবে
তখনই ওদের আরেক কলিগ মজার ছলে বললেন…
— ডা. আরিয়ান আপনার ছেলে তো বড় তাইনা? তাহলে ভবিষ্যতে আপনারা দুজন একে অপরকে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন
আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে দ্বিমত পোষন করলো…
— কি যে বলেন না, হাসপাতালেই আমাদের মিল হয় না সেখানে আমরা কিনা সম্পর্ক করবো? অসম্ভব!
— আপনার আমাকে নিয়ে সমস্যা, আমার আপনাকে নিয়ে নয় ডা. আরিয়ান। চাইলে এই বিষয়টা ভেবে দেখাই যেতে পারে। আমার মেয়ে যদি পরিচিত কারো ঘরে যায় তবে আমিই চিন্তামুক্ত থাকবো
— আপনার আমার সঙ্গে সম্পর্ক করতে আপত্তি নেই?
— না!
আরিয়ান অবাক হলো বটে, এতকিছুর পরেও নীল কতো সহজেই ওকে সকল বিষয়ে মেনে নেয়। নীলকে দেখে অনকেকিচু শিখছে আরিয়ান। দুপুরে এসে মেয়েকে নিয়ে গেছিলো আরোহী। রাতে…ডিনার শেষে নীল একটু শুয়েছিলো তখন আরোহী এসে পাশে বসলো…
— আনহা কি বিরক্ত করেছিলো আজকে?
— না, উল্টে আজকে আমাদের মেয়ের বিয়ের পাকা কথা বলা হয়ে গেছে। আমাদের আর ওর বিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা
আরোহী হাসলো… — মানে! কি বলো? এখুনি বিয়ে?
— হ্যাঁ, সবাই মিলে আমাকে সাজেশন দিলো কার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে ভালো হবে। কিন্তু আমার প্রিন্সেস কোথায়?
— বাবা মায়ের ঘরে আছে, দাদা দাদির প্রতি আনহার যে কত দরদ সেটা না দেখলে বুঝবেনা। ওকে আনতে গেছিলাম আমি কিন্তু এলো না
— ভালো হয়েছে, এবার তুমি একটু বিশ্রাম করো। সারাদিন তো ওকে নিয়েই ব্যস্ত থাকো
নীলের মা বাবাই বেশিরভাগ সময় নাতনিকে রাখেন, এতে ফাঁকা সময় পেলে নীলও আরোহীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পায়। রাতে…নীল বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছিল হঠাৎই আরোহী ওকে ডেকে তুললো, ঘুমঘুম চোখে উঠে বসলো নীল…
— কি হয়েছে?
আরোহী নীলকে টেনে বারান্দায় নিয়ে গেলো, বারান্দার লাইট জ্বেলে দরজা আটকে দিলো যাতে মেয়ের ঘুম না ভাঙ্গে। এরপর ছোট্ট একটা কেক নীলের সামনে ধরে বললো…
— শুভ জন্মদিন নীল!
নীল বিশেষ অবাক হলো না কারণ বিয়ের পর থেকে প্রতিবছরই আরোহী নীলের জন্মদিন পালন করে আসছে…
— এবারও তোমার মনে ছিলো? আমি তো ভুলেই গেছিলাম
— তোমার সঙ্গে জড়িত প্রতিটা দিন আমার জন্যে ভীষণ স্পেশাল নীল! নাও, এবার কেকটা কাটো
— থ্যাংক ইউ!
কেক কেটে ওরা একে অপরকে খাইয়ে দিলো, এরপর উপহারের পালা। নীল জিজ্ঞাসা করলো…
— কোনো গিফট দেবেনা?
— গিফট লাগবে?
— উম্ম, না হলেও চলবে। তুমি আমাকে গিফট হিসেবে আনহাকে দিয়েছো এটাই অনেক!
আরোহী কিছুক্ষণ নিরব থেকে তারপর হেসে বললো…
— বার্থডে বয়ের জন্যে গিফট থাকবেনা এটা হয় নাকি? আছে তো!
এরপর ছোটো একটা বক্স এনে আরোহী নীলের হাতে দিলো, বক্সটা খুলে ভেতরে নিউবর্ন বেবিদের একজোড়া জুতা দেখেই নীলের আর বোঝা বাকি নেই আরোহী ওকে কি উপহার দিয়েছে। নীল যেনো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো, আরোহীকে জড়িয়ে ধরলো…
— রিয়েলি?
— হুমম! নয় সপ্তাহ চলছে! আসলে আমি আগেই জেনেছিলাম কিন্তু সমানেই তোমার জন্মদিন ছিলো বলে এইদিনটার অপেক্ষায় ছিলাম
নীল কিছু বললো না, এ মুহূর্তে ইচ্ছে হচ্ছে আরোহীকে বুকের মাঝে পুরে ফেলতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো। প্রথম প্রেগনেন্সির সময় আরোহীকে দেওয়া যে কথা নীল রাখতে পারেনি সেটা এবার রাখবেই বলে পণ করেছে। নীলকে জীবনে পাওয়ার পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্ত সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে আরোহী, একটি মেয়ের জীবনে মা বাবার পরে সবচেয়ে বেশি যে মানুষটাকে প্রয়োজন হয় সে স্বামী আর নীলের মত কাউকে স্বামী হিসেবে পেয়ে নিজের জীবন স্বার্থক তার। প্রথম জীবনসঙ্গীকে হারানোর পর আরোহী নিজের জীবন নিয়ে হাল ছেড়েই দিয়েছিলো কিন্তু নীলের কেউ একজন এসে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেবে, জীবনটাকে এভাবে রঙিন করে তুলবে কে জানতো? পেয়ে হারিয়ে যাওয়া মানেই সব শেষ? না… হতে পারে সেই না পাওয়ার পরেই এমনকিছু পাওয়া যাবে যা আপনার জন্যে সেরা, আপনার জন্যে শ্রেষ্ঠ!
____ সমাপ্ত ____
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]