#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০২
রাতের বেলা বারান্দায় দাড়িয়ে বাড়ির সামনের স্কুলটির জনমানবহীন মাঠটার দিকে রিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে আরোহী, ওর মস্তিষ্কে নীলের বলা প্রতিটা কথা কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে। মাত্র আধ ঘন্টার আলাপ ছিলো ওদের দুজনের তবুও যেনো এক গভীর প্রভাব ফেলে গেছে আরোহীর মনে, ভাবতে বাধ্য হচ্ছে ও নীলকে নিয়ে। আচ্ছা, লোকটা সত্যিই কি তাহলে সবার থেকে একটু আলাদা? আরোহীর খালা আর মা ওর রুমে বসে আলাপ করছে, তাদের আলোচনার বিষয় এখন “নীল”। তখনই হুট করে রুমে এসে আরোহী ওর খালাকে জিজ্ঞাসা করে…
— খালামণি, মি. নীলের খোজ কোত্থেকে পেয়েছিলে তুমি? কোত্থেকে ওনাকে আমার জন্যে জোগাড় করে আনলে বলোতো?
— নীল কে রে?
খালার কথায় মা ও নীল নামটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আরোহী বুঝলো লোকটার নীল নামের সাথে বাইরের মানুষ পরিচিত না!
— যে ছেলেটা আমাকে দেখতে এসেছিলো তার কথা বলছি
— ওহ তাই বল, আরে বিয়ে শাদীর ব্যাপার তো কতভাবে খবর এসে যায়। তোর খালুর সাথে কিভাবে যেনো পরিচয় আছে ছেলের বাবার, সেখান থেকেই তোর কথা বলেছিলাম আর কি। তখন আগ্রহ দেখিয়েছে, আমিই তোর খালুকে বলে তোর ছবি ছেলের কাছে দিয়েছিলাম
— ছেলেটাকে আমার সম্পর্কে তোমরা সব জানিয়েছিলে?
— আরে না না, এর আগে চারটা ছেলে তোর অতীত সম্পর্কে সব জেনে কিভাবে চলে গেছিলো মনে নেই? এরপর আর এই ভুল করবো না!
খালার কথা শুনে আরোহী অবাক হয়ে গেলো কারণ আলাপের সময় ছেলেটা বলেছিলো যে ওর বিষয়ে সব জানে!
— হ্যা রে আরু, ছেলেটার সাথে তো কথা বললি অনেকক্ষন, কি বুঝলি? তোর ওকে পছন্দ হয়েছে তো? আমাদের সাথে কিন্তু ছেলেটা মোটামুটি কথাবার্তা বলেই গেছে
— হ্যা, ছেলেটা তো রাজি ওর কথাতেই বোঝা গেলো। এবার জলদি একটা দিনক্ষণ দেখে বিয়েটা হয়ে গেলে মেয়েটার একটা গতি হবে, আর তোদের চিন্তাও দুর হবে
— চিন্তা দুর হবে বললেই তো হয় না আপা। আরুর বিয়েটা হলে মোটামুটি চিন্তামুক্ত হতে পারবো আর কি নাহলে এতদিন যা হলো। এই বয়সে মেয়েটার এই অবস্থা। আরু, তুই বরং ছেলেটার সঙ্গে কথাবার্তা..
— এত্তো তাড়াহুড়ো কেনো করছো তোমরা মা? আমায় বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চাইছো? আমি বুঝি খুব সমস্যা ফেলে দিয়েছি তোমাদের?
কান্নাভেজা কণ্ঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো আরোহী, আজ যেনো মনে হচ্ছে নিজের অজান্তেই মা বাবার কাছেও বোঝা হয়ে গেছে বোঝা হয়ে গেছে আরোহী
— আমি সেভাবে বলিনি রে মা, তুই আমাকে ভুল…
মায়ের পুরো কথা না শুনেই ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে আসে আরোহী। আজ মায়ের কথায় শুনেও যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ওর কাছে এখন মনে হয় সবাই ওকে দয়া করছে, ওর থেকে কখন পিছু ছাড়াতে পারবে সেই অপেক্ষায় আছে। ড্রইং রুমে বসে খেলা দেখছিলো নীল ও নিহান, নিহান নীলের চাচাতো ভাই। নীলের বাবারা দুই ভাই, দুজনেই একই বাড়িতে একসাথে থাকে। সেই সুবাদে খেলা দেখার সময়টাও নীল ও নিহান একসঙ্গেই উপভোগ করে, আজও তাই করছিলো। একটু বাদে নীলের মা দু কাপ চা এনে দুজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বসলেন সোফায়…
— কিরে নীল! তুই না বললি ফেরার সময় যাবি, ঠিকানা দিয়েছিলাম তোকে। গেছিলি?
মায়ের কথা শুনে আরোহীর কথা মনে পড়লো নীলের, কিসের খেলা দেখা? অমনি টিভি বন্ধ করে দিয়ে মায়ের সাথে কথায় মত্ত হয়ে উঠলো ও…
— হ্যা গেছিলাম। ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাও বলেছি। আমার মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে। আজ হসপিটাল থেকে শেষে ফেরার পথে তার বাড়িতে গিয়ে পাকা কথাও সেরে এসেছি। এবার শুধু তোমরা গিয়ে বিয়ের ডেট ফিক্স করবে
নীলের কথায় অবাক হয়ে যায় নিহান, বড় ভাইয়ের স্বভাবের সাথে ভালোভাবেই পরিচিত ও, নিজের চোখেই দেখেছে মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে কেমন আনইজি ফিল করে রায়ান, সেখানে এক মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েই পাকা কথা বলে এসেছে?
— কি বলিস রে ভাইয়া? মেয়ে তোর এত্তো পছন্দ হয়েছে যে সোজা পাকা কথা সেরে এলি? তুই আমার নীল ভাইই তো নাকি অন্য কেউ? বহুরূপী?
— কেনো? বিয়ে করবো আমি তাহলে পাকা কথা আমি বলে এলে সমস্যা কোথায়? এমন তো না মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি!
— ওয়াও, আই লাইক ইওর স্পিরিট!! ভাইয়া, মনে হচ্ছে হবু ভাবির সাথে বেশ ভালো সময় কাটিয়ে এসেছিস আজকে
— এই তোরা দুজনে একটু থাম তো। নীল, কি বললি তুই? মেয়ের বাড়ি গিয়ে তুই পাকা কথা বলে এলি? তোকে তোর বাবা মেয়ে দেখতে পাঠিয়েছিল, পাকা কথা বলতে নয়
— তোমাদের কাজটাই তো আমি সহজ করে দিয়ে এসেছি মা। তোমরা আবার সবাই গিয়ে সেই একই কথা তুলবে, একই আলোচনা করবে তাই ভাবলাম মেয়ে দেখা আর পাকা কথা বলা দুটোই আমি করে আসি
— এতো পাকামো কে করতে বলেছে তোকে হ্যা? তবে ভালো হয়েছে তোর মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে, তোর বাবার আর আমার তো খুব ভালো লেগেছে মেয়েটাকে!
তাদের আলাপের মাঝেই নীলের বাবা মীর সাহেব এসে জিজ্ঞাসা করলেন…
— আমার বন্ধু ফোন করে বললো তুই নাকি তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে রেস্টুরেন্টে যাসনি? মেয়েটা কতক্ষণ তোর অপেক্ষায় বসেছিলো
মীর সাহেবের কথা শুনে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে নীলের দিকে তাকালো, নীলের মা রওশন বেগম বললেন…
— কি বলছো? নীল তো মাত্রই বললো ও মেয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছে আর মেয়েকে ওর পছন্দ হয়েছে
— মেয়ের সঙ্গে তো ও দেখাই করেনি আবার পছন্দ কিভাবে হবে?
এই নিয়ে মা বাবার মধ্যে তর্ক লেগে যাচ্ছিলো দেখে নীল তাদের থামালো…
— রিল্যাক্স গাইজ! এতো কনফিউশনের কিছু নেই। বাবা, আমি মেয়ে দেখে এসেছি কিন্তু সে তোমার ঠিক করা মেয়ে নয়
— তুই তোর বাবার ঠিক করা মেয়েকে দেখতে যাসনি মানে? কাকে দেখে এসেছিস আর কার সঙ্গেই বা বিয়ের পাকা করার কথা বললি?
— মা, সে আমার পছন্দের মেয়ে!
— ভাইয়া! তোর পছন্দের মেয়ে আছে?
— হ্যাঁ, এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?
ব্যাস, ছেলের পছন্দের মেয়ে আছে শুনে নীলের মা বাবা উভয়েই প্রশ্নের বাণ ছো’ড়া শুরু করলো। প্রশ্ন করার এই লাইনে পিছিয়ে নেই নিহানও, জেঠা ও জেঠির সাথে মিলে সেও ভাইকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। সকলের প্রশ্ন শুনতে শুনতেই সোফা উঠে দাঁড়ালো নীল, বুঝলো এখানে আরেকটু থাকলে ও বোধহয় পা’গলই হয়ে যাবে!
— তুই উঠছিস কেনো? বস এখানে, মেয়েটার সম্পর্কে সব বল, আরে তুই কাওকে পছন্দ করিস সেটা আগে কেনো আমাদের বলিসনি?
— তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেবো কিন্তু এখন আমি অনেক টায়ার্ড! আপাতত আমি আরোহীর বাসার ঠিকানা আর ওর ছবি তোমাকে সেন্ড করে দিয়েছি বাবা, সবাই মিলে আরাম করে বসে দেখো। আই অ্যাম শিওর আমার পছন্দ তোমাদের পছন্দ হবেই। আর হ্যাঁ ঠিকানাটা চিনে রাখো, আমি যখন বলবো তখন গিয়ে বিয়ের ডেট ফিক্স করে এসো
ছেলের কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারছেন না নীলের মা বাবা, ছেলে তাদের কার সঙ্গে দেখা করলো আর হুট করে কাকেই বা বিয়ে করতে চাইছে ভেবে পাচ্ছেনা কারণ তাদের জানামতে নীলের পছন্দ কেউই নেই! ওদিকে…সকালবেলা আরোহীর খালু এসেছে ওদের বাসায় ওর খালাকে নিতে। রান্নায় ব্যস্ত আরোহীর মা ও খালা সেসময় আরোহীই খালুকে খাবার এনে দিলো। খালু খেতে বলেছিলো তখনই আরোহীর খালাতো বোন রুমি নাস্তার টেবিলে বসে নিজের বাবাকে বললো….
— আব্বু, জানো তো আপুর সঙ্গে যার বিয়ের কথা চলছে আমার তাকে অনেক পছন্দ হয়েছে। তুমিও আমার জন্যে অমন লম্বা আর চশমাওয়ালা ছেলে খুঁজে আনো না
খেতে খেতে চোখ তুলে তাকালেন আরোহীর খালু, ভ্রু কুঁচকে বললেন…
— লম্বা? চশমা! কিন্তু ও তো অতো লম্বা না, হাইট এই আরোহীর থেকে একটু বেশি হবে
— কি বলছো বাবা! আপুর তুলনায় তো সে ভালোই লম্বা
— আরে নাহ! আরোহীর থেকে একটু লম্বা সে আর ও তো চশমা পড়েনা, নাকি এখন আবার চশমা পড়তে শুরু করেছে?
— উফফ বাবা, তুমি কি যে উল্টোপাল্টা বলছো। আমার কাছে ছবি আছে, দেখাচ্ছি এখুনি। ছেলেটা ভালোই লম্বা আর চশমাও পড়ে!
রুমি নিজের ফোনটা এনে বাবাকে ছবি দেখাতেই…
— এটা কার ছবি দেখাচ্ছিস? এ তো ওই ছেলে না
খালুর কথা শুনে সকলে চমকে উঠলো, বিশেষ করে আরোহী! গতকাল নীলের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই ওর মনটা কেমন খচখচ করছিলো, লোকটার কথায় কি অদ্ভুত মায়া ছিলো যেনো সে কথায় মানুষকে ভোলানোর কোনো মায়া জানে। পূর্বে যে চার ছেলের সঙ্গে দেখা করেছিলো তাদের কেউই আরোহীর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে আগ্রহী ছিলো না কিন্তু নীলের বেলায় সবই ছিলো উল্টো। আরোহী আগ্রহী ছিলো না উল্টে নীলই আগ্রহ দেখাচ্ছিলো। এ কথা শুনে আরোহীর মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন…
— হায় আল্লাহ! কি বলছেন আপনি ভাইজান! তাহলে আরোহীকে কে এসে দেখে গেলো? ওর সঙ্গে তো অনেকক্ষণ কথা বলে গেছে আর আমাদের সঙ্গেও! ছেলেটার আচরণ তো বেশ ভালো ছিলো
আরোহীর খালা জিজ্ঞাসা করলেন…
— তোমার কোনো ভুল হচ্ছেনা তো?
— আমার কিসের ভুল হবে? কিন্তু ওই ছেলেটা কে ছিলো? তোমাদের কাউকে কিছু বলেনি?
উপস্থিত সকলেই এখন এই আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে তাহলে গতকাল কে এসেছিলো আরোহীর সঙ্গে দেখা করতে? একটা অচেনা ছেলে বাড়িতে এসে বাড়ির মেয়েকে দেখে চলে গেলো, চিন্তার বিষয় বটে! আরোহী কিছু বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে, ছেলেটা কি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলো? এসব ভাবতে ভাবতে রীতিমত হাত পা কাঁপতে শুরু করলো মেয়েটার, বিনা নিমন্ত্রণে আসা এক অচেনা ছেলের সঙ্গে এতক্ষন একলা বসে কথা বলেছে ও??
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন..!!]
#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#বোনাস_পর্ব
দীর্ঘসময়ের আলোচনা শেষে বোঝা গেলো যে আরোহীর খালু যে ছেলেকে ঠিক করেছিলেন আর যে ছেলের ছবি এই বাড়িতে পাঠানো হয়েছে দুজন আলাদা, এ বাড়িতে অন্য ছেলে মানে নীলের ছবি পাঠানো হয়েছে আর নীলই এসে আরোহীকে দেখে গেছে। এমন একটা ঘটনা কিভাবে ঘটলো কেউই বুঝতে পারছে না। আরোহীর খালু তখন ছেলেটাকে ফোন করে অনেক গালমন্দ করলো, উনি ভেবেছিলেন ছেলেটা হয়তো বিয়ে করতে চায়না তাই ইচ্ছে করেই এভাবে আরেকজনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আরোহীর খালু এতো রেগে ছিলো যে ছেলেটা কিছু বলার সুযোগই পায়নি, এদিকে আরোহীর মায়ের মাথায় হাত পড়ে গেছে। চিন্তায় প্রেশার হাই হওয়ার অবস্থা। আফসোসের স্বরে তিনি বললেন…
— আমার মেয়েটা এমন পোড়া কপাল নিয়ে কেনো জন্মালো বুঝিনা, যখনই ভাবি এবার বুঝি সব ঝামেলা মিটবে তখনই এসে নতুন ঝমেলা উদয় হয়
আরোহীর মা মেয়েকে দোষ দিয়ে আরো অনেকগুলো কথা বললো, পাশেই আরোহী দাড়িয়ে আছে। গত দু বছর যাবত মায়ের এসব কথা শুনতে শুনতে মন যেনো পাথর হয়ে গেছে মেয়েটার, আর সহ্য করতে না পেরে ও বলে উঠলো…
— মা, প্লিজ! তুমি এমনভাবে কেনো বলছো যেনো আমি এসব ইচ্ছে করে করছি? সব আমার দোষ?
— দোষ তো বটেই, তোর ভাগ্যের দোষ না থাকলে কি অমন ভালো ছেলেটা ওভাবে দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে যায়? এরপর কতগুলো ছেলে তোকে রিজেক্ট করলো আর এখন আবার এই নতুন ঘটনা ঘটলো। ভাগ্য খারাপ না থাকলে কি এসব হয়?
— আমি আগেই বলেছিলাম তোমাদের, আমাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা বন্ধ করো কিন্তু তোমরা জেদ চেপে বসে আছো। আমার ভাগ্যের যখন দোষ তাহলে আমার এই মন্দ ভাগ্যের ভাগীদার আরেকজনকে পুরুষকে কেনো করতে চাইছো? বাদ দাও এসব, ছেড়ে দাও আমাকে আমার মতো
কিছুটা রাগ করেই নিজের ঘরে চলে আসে আরোহী। মায়ের এসব কথা যেনো প্রতিটা সময় মেয়েটার বুকে তীরের মতো বিঁধে, ভাগ্যের ওপর কি কারো হাত থাকে? তাও যে প্রতিবার কেনো ওর মা এভাবে বলে জানা নেই আরোহীর। হয়তো মেয়ে তার জন্যে বোঝা হয়ে গেছে, সেটা সরাসরি বলতে না পারলে বিভিন্ন আচরণে প্রকাশ করে। আরোহীর বড় ভাই চাকরি করে, বাড়িতে ভালো অঙ্কের টাকাও পাঠায়। ছেলের প্রতি ওর মায়ের ভীষণ টান কিন্তু বিধবা মেয়েকে সহ্য করতে পারেন না। আমাদের সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মেয়ে মানেই বোঝা সেখানে বিধবা মেয়ে ঘরে থাকা মানে তো গলায় কাটা আটকে থাকার মতো। আরোহী ভেবে পায়না ওর ভবিষ্যৎ জীবনের কি হবে, কিভাবে চলবে। দ্বিতীয় বিয়ে কি আদৌ সুখ্কর হবে? ওদিকে….রুমে বসে এক রোগীর সঙ্গে ভিডিও কোলে কথা বলছিলো নীল, রোগীটির বয়স সবে বড় বছর। বাচ্চা ছেলে কিন্তু হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত, নীল রোগীর বাবার সঙ্গে প্রথমে কথা বলে এরপর রোগীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে বিভিন্ন কথার ছলে বর্তমান শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিয়ে নেয়। নীল একজন হার্ট সার্জন! রোগী ছোটো বাচ্চা হোক বা বৃদ্ধ, যেকোনো রোগীর সমস্যা সে রোগীর মুখ থেকে শোনাই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। গত কয়েক বছরের যে কয়টা সার্জারি নীল করেছে তার প্রায় বেশিরভাগই সফল হয়েছে। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ সচেতন সে। এতোদিন সে নিজের পেশা, রোগী, চেম্বার এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলো কিন্তু আরোহীর আগমনের পর নিজের ক্যারিয়ারের বাইরে বেরিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের দিকেও মনোনিবেশ করতে ইচ্ছুক। রোগীর সঙ্গে ভিডিও কল শেষে ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়ালো নীল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট প্রকৃতির দর্শন করে পকেট থেকে ফোনটা বের করে আরোহীর ছবিটা বের করলো। আলাপ করার সময় আরোহীর অজান্তেই একটা ছবি তুলেছিলো নীল, ভীষণ সাদামাটা ছবিটা। ক্যান্ডিড! আরোহী ডানপাশে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছিলো আর সেই সুযোগে নীল ছবি তোলে। ছবিটা জুম করে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো নীল…
— ভেবেছিলাম তোমাকে পাওয়া হয়তো আমার ভাগ্যেই ছিলো না কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আরেকটা সুযোগ করে দিয়েছে, এই সুযোগ আমি কিছুতেই হাতছাড়া করবো না!
ছবিটা দেখতে দেখতেই পুরোনো কিছু স্মৃতি যেনো ভেসে উঠলো নীলের চোখের সামনে, সেগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো ওর ঠিক সেসময় দরজায় টোকা পড়লো। রওশন বেগম শান্তিতে ঘুমাতে পারছিলেন না তাই ছেলের কাছে এসেছেন সেই মেয়ের সম্পর্কে তথ্য নিতে…
— এতো রাতে জেগে আছো কেনো?
— ঘুম আসলে তো ঘুমাবো! অবশ্য মাথায় চিন্তা থাকলে ঘুম আসে নাকি?
— কিসের এতো চিন্তা?
— জানিস তো কি নিয়ে চিন্তায় আছি, তখন তুই পুরো কথা না বলেই উঠে চলে এলি। কোন মেয়ে, কোথায় থাকে, তোর সঙ্গে মানাবে কিনা সেসব তো দেখতে হবে তাইনা?
— তোমার আমার পছন্দের ওপর ভরসা নেই?
— অবশ্যই ভরসা আছে কিন্তু তুই এভাবে হুট করে কাকে পছন্দ করলি সেটা তো বুঝতে পারছি না, দেখ তোর যদি আগে থেকেই কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকতো আমার সমস্যা ছিলো না কিন্তু হঠাৎ এভাবে…আর তোর বাবাও কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা
— আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড মা, তোমাদের চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। চিন্তা করতে হবে না, বৌমা তোমার অবশ্যই পছন্দ হবে। ছবি তো দিয়েছি, দেখোনি? ভালো লাগেনি?
— ভালো লেগেছে, কিন্তু সরাসরি মেয়ের সঙ্গে দেখা করে কথা না বলা অব্দি আমি কিছু নিশ্চিত বলতে পারছি না!
মায়ের ব্যাকুলতা বুঝে হাসলো নীল, সেই জন্ম থেকেই নীলের প্রতি ওর মায়ের চিন্তা একটু বেশিই কারণ বিয়ের অর্ধযুগ পর নীলের জন্ম হয়েছিলো। সেই থেকে ছেলেকে চোখে হারান রওশন বেগম। বাড়ির সবার পরিস্থিতি বেশ বুঝতে পারছে নীল তাই আরোহীর বিষয়টা সামাল দিতে আর খুব একটা সময় নিতে চাইছেনা সে! হসপিটালে… লাঞ্চটাইমে বাইরে গেছিলো নীল, ফিরে দেখলো কেবিনে ওর বন্ধু তানভীর অপেক্ষা করছে। এই তানভীরেরই আরোহীকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিলো, প্রায় এক সপ্তাহ আগে তানভীর নীলকে আরোহীর ছবি দেখিয়ে বলেছিলো ওকে দেখতে যাবে। সে মুহূর্তে আরোহীর ছবি দেখে নীল তানভীরকে জানায় ও যাবে আরোহীকে দেখতে! তানভীর যদিও প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি পরে নীল এমন করতে চাওয়ার কারণ বিস্তারিত সব বলে এবং তানভীরকে রাজি করায়। তানভীরের ফেসবুক আইডি নেই তাই আরোহীর খালাতো বোন যখন ছবি চেয়েছিল তখন নীলের কথামত তানভীর নীলের ছবি পাঠিয়েছিল তাই সকলে ভেবেছিল আরোহীর জন্যে পাত্র হিসেবে নীলকেই ঠিক করা হয়েছে। নীলের এই পরিকল্পনার মধ্যে বেচারা তানভীর ফেঁসে গেছে!
— কি হয়েছে?
তানভীর কিছুটা রাগী গলায় জিজ্ঞাসা করলো…
— ওই আরোহীদের বাড়িতে গিয়ে তুই কি করেছিস বলতো? জানিস ওর খালু আমাকে ফোন করে কতো বকাঝকা করেছে? আমি নাকি বিয়ে করতে চাইনা বলে নিজের বদলে আরেকজনকে পাঠিয়ে দিয়েছি?
— তোকে ফোন করেছিলো? তারমানে তারা জেনে গেছে বিষয়টা
— তা নয় তো কি? এটা কি ধামাচাপা দেওয়ার বিষয় নাকি? দেখ, তোর জন্যে আমাকে কতো কথা শুনতে হয়েছে জানিস? তোর কথায় সায় দিতে গিয়ে এসব হয়েছে
— আই অ্যাম সরি ইয়ার! তবে তুই এত ভাবিস না। আমি সব সলভ করে নেবো আর তোর এসবের জন্যে কোনো ঝামেলা হবেনা, ট্রাস্ট মি!
— বলছিস তো? দেখিস, তোকে সাহায্য করতে গিয়ে যেনো আবার আমার বদনাম না হয়ে যায়! কোনো মেয়ে যদি জেনে যায় তবে আমাকে খারাপ ভেবে আমাকে তো বিয়েই করতে চাইবে না
বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে হাসলো নীল…
— একজনের ভালোবাসা পেতে সাহায্য করছিস তুই, আমি যদি ওকে পেয়ে যাই তবে তোর জন্যে মন ভরে দোয়া করবো। দেখিস, তোর কপাল খুলে যাবে
বেচারা ভীষণ রেগে ছিলো কিন্তু বন্ধুর কথা ভেবে নিজের রাগ সংযত করলো কারণ আরোহীর প্রতি নীলের কতটা টান সেটা ও জানে, অনেক বছর পর বন্ধু তার প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছে আর বন্ধুকে এ বিষয়ে অবশ্যই সাহায্য করতে চায় তানভীর!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]