#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৩
আরোহীর জন্মের কয়েকমাস পরেই ওর মা বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছিলো, তাই বাবা কি জিনিষ সেসম্পর্কে আরোহীর ধারণা নেই। মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গেই ওর বেড়ে ওঠা, আরোহীর ভাই আশফের বয়সে আট বছরের বড় কিন্তু ছোটবোনকে একদম নিজের মেয়ের মতো আদর করে। বাবার অভাব সম্পূর্ন পূরণ করতে না পারলেও যতটা সম্ভব পূরণের চেষ্টা করে। আরোহীর জন্মের পরপরই বিচ্ছেদ হওয়ায় ওর মা মেয়েকে তেমন পছন্দ করেননা, এমনকি আরোহীর মায়ের বাড়ির মানুষও ছোটো থেকে ওকেই অশুভ মনে করতো। আরোহীর মা তো একপ্রকার ঠিক করেই নিয়েছেন যে এ বাড়িতে যা খারাপ হয় তাতে আরোহীরই দোষ থাকে! ছোটো থেকে অনেকটা মায়ের অবহেলা পেয়েছে মেয়েটা, যদিও ওর ভাই যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে বোনকে আগলে রাখার। দু বছর আগে একটি ভালো ঘরের ছেলের সঙ্গে আরোহীর বিয়ে হয়, ছেলেটা অনেক ভালো ছিলো। আরোহীকে বেশ পছন্দ করতো। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়েছিলো, ছেলেটা অল্পকিছুদিনের মধ্যেই আরোহীকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছিল। আরোহীও ভেবেছিল এবার হয়তো নিজের বলে আকড়ে ধরার একটা সাহারা মিলবে কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিয়ের এক মাসের মাথায়ই এক দুর্ঘটনার শিকার হয় দুজনে। ভাগ্যক্রমে আরোহী বেচেঁ গেলেও ছেলেটা ড্রাইভিং সিটে থাকায় বাঁচতে পারেনি। ঠিক সেদিন থেকে আরোহীর জীবন পূর্বের তুলনায় আরো দ্বিগুণ কালো মেঘে ঢেকে যায়। বোনের চিন্তায় আশফেরও চিন্তিত, আর ছেলের জন্যে আরোহীর মায়ের চিন্তা অনেক বেশি। উনি মূলত ছেলের মাথার চিন্তা দূর করার জন্য আরোহীকে পুনরায় বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছেন কিন্তু কখনো আরোহীর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেননি। আরোহী বর্তমানে অনার্সে পড়ছে, পাশাপাশি দুটো টিউশনি করায় কিন্তু ইদানিং ওর মা প্রায়ই টাকার খোটা দিচ্ছে দেখে আরোহী আরো কয়েকটা টিউশনি খুঁজে বের করেছে। দুপুরে টিউশনির জন্যে বেরোনোর সময় মাকে ডেকে বললো…
— আমার আজ ফিরতে দু ঘন্টা দেরি হবে
— দু ঘন্টা? তাহলে তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তুই তো বিকেলেই ফিরে আসিস, আজ তাহলে কেনো দেরি হবে?
— নতুন দুটো টিউশনি নিয়েছি
— হঠাৎ নতুন টিউশনি কেনো? এ বিষয়ে তো কিছু বলিসনি
— এখানে বলার কি আছে মা? দুটো টিউশনি বেশি করলে টাকাও বেশি আসবে, এমনিতেই তোমাদের ঘাড়ে বসে আছি। টাকা দুটো বেশি জোগাড় করে আনলে অন্তত নিজের খরচটা নিজেই তো চালাতে পারবো
— মুখ ঝেড়ে অতো কথা বলিস না আরোহী, শুধু টাকা কামাই করে নিয়ে আসলেই সমস্যার সমাধান হয়না। তোর কথা ভেবে আমার ছেলেটা এখনও বিয়ের চিন্তা করছেনা সে খেয়াল আছে? আমাদের সংসার টিকলো না, তোর সংসার শুরুর আগেই শেষ। অন্তত আমার ছেলেটাকে তো সংসার করতে দে
— আমি তোমার ছেলেকে বিয়ে করতে মানা করিনি, এটা ওর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তাছাড়া তুমি সবসময় কেনো আমাকেই তোমাদের ডিভোর্সের কথা শোনাও? আমি তো বলিনি তোমাদের আলাদা হতে তাইনা?
— সেজন্যেই তো বলছি, চুপচাপ কোনো একটা ছেলেকে ধরে বিয়েটা করে ফেল যাতে আমার ছেলেটা তোর চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারে
প্রায় প্রতিদিনই আরোহীর দিন শুরু হয় মায়ের কটু কথা শুনেই, আশফের বাড়িতে থাকলে তাও এসব কমই শুনতে হয়। দুপুরবেলা মন খারাপ করেই পড়াতে বেরোলো আরোহী, ওদিকে আশফের আজ বাড়িতে এসেছে। গতরাতে ওর মা ফোন করেছিলো, আরোহীর বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উনি ছেলেকে আসতে বলেছেন। আশফের সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। বিকেলে মায়ের সঙ্গে বসে আরোহীকে দেখতে আসা ছেলেকে নিয়ে আলাপ করছিলো ওর মা, সেসময়ই কলিং বাজলো। আরোহীর মা দরজা খুলতেই নীলকে দেখে খানিকটা রেগে গেলেন বটে! নীল এসেছে, তানভীরকে সঙ্গে নিয়ে আরোহীর বাড়িতে।
— তুমি আবার কেনো এসেছো?
— আমরা কি ভেতরে গিয়ে কথা বলতে পারি?
যদিও সেদিনের ঘটনার পর আরোহীর মায়ের ইচ্ছেই ছিলো না নীলকে ভেতরে আনার কিন্তু বাইরে রেখে কথা বলাটাও তো শোভনীয় নয় তাই ভেতরে আসতে বললেন। আরোহীর মা ভাইয়ের সামনে কথা নীলই শুরু করলো…
— প্রথমেই আমি ক্ষমা চাইছি, যে ঘটনাটা ঘটেছে তাতে আমার বন্ধুর কোনো দোষ নেই। এটা করার জন্যে আমিই ওকে বলেছিলাম, আপনারা তানভীরকে ভুল বুঝবেন না।
— সরি অ্যান্টি! আমি শুধু আমার বন্ধুর জন্যে এটা করেছিলাম। আমার এছাড়া আর কোনো বাজে উদ্দেশ্য ছিলো না
দুজনের কথা শুনে আরোহীর মায়ের মন তো গললোই না, বরং উনি আরো রেগে গেলেন!
— ক্ষমা চাইলেই হয়ে গেলো? অচেনা একটা বাড়িতে এভাবে চলে আসবে? এটা কোন ধরনের সভ্যতা? পুলিশ ডাকিনি সেটা ভেবে শুকরিয়া করো
আরোহীর মা আরো অনেককিছু বললো নীলকে, নীলও চুপচাপ সব শুনছিল কারণ ও বকা শোনার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলো। আশফের সেসময় নীলকে পর্যবেক্ষণ করছিলো, এক পর্যায়ে নিজের মাকে থামিয়ে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা সে জানতে চাইলো…
— আমি সবটাই শুনেছি কিন্তু আপনার এমন করার কারণ কি হতে পারে সেটা ভেবে পাইনি। আমার বোনের ভাষ্যমতে সে আপনাকে চেনেনা, আর আপনিও হঠাৎ আমার বোনের প্রতি এতো আগ্রহ দেখালেন কেনো?
— আসলে তানভীর আমাকে আরোহীর ছবি দেখিয়েছিলো, ওখানে দেখেই আমার ওকে পছন্দ হয়েছিলো। আমার বাড়ি থেকেও আমার জন্যে মেয়ে দেখছে কিন্তু আমার কাউকে পছন্দ হচ্ছেনা, ফর্চুনেটলি আপনার বোনকে দেখে ভালো লেগেছিলো তাই সুযোগের একটু সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করছিলাম। আমার উদ্দেশ্যকে খারাপ ভাববেন না, আমি কিছুদিন পর নিজেই আপনাদের কাছে এসে সবটা ক্লিয়ার করতাম। আশফের আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো…
— আপনার পেশা?
— আমি হার্ট সার্জন!
— ডাক্তার! বেশ উচু পর্যায়ের মানুষ, এমন কর্মক্ষেত্রের মানুষ হয়ে এমন একটা কান্ড করেছেন? ভাবা যায়না!
নীল স্মিত হেসে জবাব দিলো…
— মনের ওপর কিছুর জোর খাটেনা
আরোহীর মায়ের যেনো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা যে ডাক্তার ছেলে আরোহীকে বিয়ে করতে চাইছে! উনি সন্দেহের স্বরে বললেন…
— একজন ডাক্তার হয়ে আমাদের মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহ দেখাচ্ছ? তুমি সত্যিই ডাক্তার! আজকাল তো কতো ভুয়া ডাক্তার বেরিয়েছে, তুমি আবার ডাক্তার সাজার নাটক করছো না তো?
নীল পকেট থেকে নিজের প্রোফেশনাল আইডি কার্ড বের করে দেখিয়ে বললো…
— এরপরেও আপনাদের সন্দেহ থাকলে আমাদের হাসপাতালে গিয়েও খোঁজখবর নিতে পারেন। এরপরেও বিশ্বাস না হলে আমার সার্জারির ভিডিও দেখতে পারেন।
নীলের কথাবার্তা শুনে আর সন্দেহের অবকাশ রইলো না কারোরই!
— আমি জানি আমার এমন একটা কাজ করা ঠিক হয়নি, কিন্তু আমি আগে আরোহীর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাইছিলাম। ছবি ও বাস্তবের মানুষটা দুটোর মধ্যে ঠিক কতটা মিল আছে সেটা দেখার ইচ্ছে ছিলো
আশফের প্রশ্ন করলো…
— মিল পেলেন?
— আমার কল্পনার সঙ্গে আপনার বোনের বাস্তবের মিল খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, কল্পনার চেয়ে বাস্তবেই সে আরো অসাধারণ!
— আপনি কি আমার বোনকে চেনেন?
প্রতিউত্তরে মৃদু হাসলো নীল, আশফের বুঝলো না এর মানে কিন্তু নীলের কথায় ও আরোহীর প্রতি এতো আগ্রহে আশফেরের যেনো মনে হচ্ছে নীল আগে থেকেই আরোহীকে চেনে! নীল মোটামুটি বিয়ের বিষয়ে আরোহীর ভাইকে প্রস্তাব দিলো, কিন্তু আশফের সময় নিলো। আরোহীর সিদ্ধান্ত ব্যতীত কিছু হবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিলো, নীলের এ বিষয়ে আপত্তি নেই। সেও চায় আরোহী স্বেচ্ছায় ওকে গ্রহণ করুক। পুরোটা সময় নীলের চোখ শুধু আরোহীকে খুজছিল কিন্তু আরোহীর মায়ের কথা শুনে বুঝেছিল যে ও বাড়িতে নেই। নীল তা শুনে হতাশ, আরোহীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে ভালো লাগতো। কথাবার্তা শেষে নীল উঠে দাঁড়ালো, আশফেরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো…
— আমরা তাহলে আজ আসি, আশা করি আমাদের দুই পরিবারের আবারো দেখা হবে
এরই মধ্যে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বৈশাখের শুরু এখন! সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। বৃষ্টি দেখে আশফের বললো…
— বৃষ্টি হচ্ছে, এর মধ্যে কিভাবে যাবেন? বসুন কিছুক্ষণ
— সমস্যা নেই, ম্যানেজ করে নেবো আমরা।আমার আবার হসপিটালে যেতে হবে, এখন না বেরোলে দেরি হয়ে যাবে। আমরা আসছি!
— এতো তাড়ার কি আছে নীল? বসি না একটু
— তানভীর! সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চল!
— কিন্তু এতো বৃষ্টিতে…
তানভীরকে টেনে তুলে বেরোতেই যাচ্ছিলো নীল, ঠিক তখনই বাইরে থেকে এলো আরোহী। নীল ও আরোহী দুজনে একদম মুখোমুখি পড়লো, নীলকে এই অসময়ে বাড়িতে দেখে আরোহী অনেকটা চমকেছে বটে! নীলও যেনো কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেনা, একটু আগেই একরাশ হতাশ ঘিরে ধরেছিল ওকে কিন্তু আরোহীকে দেখামাত্রই সব হতাশা যেনো কর্পূরের ন্যায় উবে গেলো।
— বৃষ্টিতে পড়েছিলি নাকি?
— না ভাইয়া, বৃষ্টি বাড়ার আগেই দ্রুত হেঁটে চলে এসেছি
ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আরচোখে নীলকে দেখছিলো আরোহী, তানভীর তখন বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হুট করে নীল বলে উঠলো…
— তানভীর! দেখ, বৃষ্টি বেড়ে গেছে। এর মধ্যে তো তোর বাইকে যাওয়া যাবেনা। আমাদের বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করা দরকার
— জ্বি, এটাই ভালো হবে। বসুন আপনারা
বন্ধুর কান্ড দেখে তানভীর ফিসফিসিয়ে বললো…
— এটা তো আমিও একটু আগে বলছিলাম, তখন তো খুব তাড়া দেখাচ্ছিলি আর যেই ও এলো অমনি ভিজে বিড়াল হয়ে গেলি?
— চুপ থাক!
নীল ঘুরে ভেতরে এসে বসে পড়লো, আরোহীর সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু সেটা বলবে কিভাবে?
— মা, ওনাদের জন্যে একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করো
— আমি করছি ভাইয়া!
আরোহী ওড়না দিয়ে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরে গেলো, পেছন পেছন ওর মা ও গেলো!
— সত্যি করে একটা কথা বলতো, এই ছেলেটাকে তুই আগে থেকে চিনিস তাইনা?
— না মা, আমি ছেলেটাকে চিনিনা। আমিও ওনাকে প্রথমবার দেখেছি
— কিন্তু ছেলেটা যেভাবে কথা বলছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল তোকে খুব চেনে
আশফের জানতো ওর মা রান্নাঘরে গিয়ে আরোহীকে কিছু বলবে তাই পেছন পেছন আশফেরও এসেছে…
— তোকে এতো কৈফিয়ত দিতে হবে না আরোহী, আমার তোর ওপর ভরসা আছে আর মা তুমি কথায় কথায় যেকোনো বিষয়ে ওকে সন্দেহ করাটা বন্ধ করো। খুবই বাজে স্বভাব এটা তোমার
— আমি আবার কি বললাম! ও প্রায় সারাদিনই এখন বাড়ির বাইরে থাকে। কোনো ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে সেটা বলতে সমস্যা কি?
— আহ মা! থামবে তুমি?
মায়ের কথা আপাতত কানে তুললো না আরোহী, দ্রুত চা বানিয়ে নিলো আর ফ্রিজে একটু কেক ছিলো সেটাই ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় অভিমানের স্বরে মাকে বললো…
— আমি জানি আমার ওপর তোমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে অন্তত এমনকিছু বলো না যাতে তারা ভাবে যে তুমি মা হয়ে নিজের মেয়েকে ভরসা করো না
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]
#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৪
চা নাস্তা এনে নীল ও তানভীরকে দিলো আরোহী, যদিও নীলের সামনে বসতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছিলো ওর। বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারলো নীল, চায়ের একটা কাপ নিজের কাছে রেখে ট্রে তানভীরের দিকে এগিয়ে দিলো নীল। তানভীর নীলের ইশারা বুঝে কিছুটা সরে বসে খাবারগুলো খেতে শুরু করলো। আরোহী নীলের দিকে তাকাচ্ছেনা দেখে শান্ত স্বরে ও প্রশ্ন করলো…
— আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
এবার চোখ তুলে তাকালো আরোহী, মেয়েটা যখন সরাসরি চোখের দিকে তাকালো তখনই নীলের বুকটা যেনো ধক করে উঠলো। সেদিন কথা বলার সময় আরোহী নীলের চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি, আজই প্রথম! নীল লক্ষ্য করলো মেয়েটার চোখদুটো মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট!
— ভয় তারাই পায় যাদের হারানোর কিছু থাকে কিন্তু আমার জীবনে আর হারানোর কিছু নেই। আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছিনা তবে আপনার উদ্দেশ্য ঠিক সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছিনা
— আমার উদ্দেশ্য আপনাকে আমি সেদিনই জানিয়ে দিয়েছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই?
— আমার এখনও মনে হচ্ছে আপনি মজা করছেন
— আপনি আমার কথাগুলো গুরুতরভাবে গ্রহণ করছেন না হয়তো, তাই মজা মনে হচ্ছে। বিয়ে জীবনের এমন একটা গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয় যেখানে মজা খাটে না
— আপনি আজ এ বাড়িতে কেনো এসেছেন?
— যে ঘটনা ঘটেছে তারজন্যে আমি দায়ী, আমার জন্যে একটা বড়সড় কনফিউশন তৈরি হয়েছিল তাই ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম
— সেদিন আপনি বলছিলেন আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেন? আমি ভেবেছিলাম আমার খালু বলেছে কিন্তু ঘটনা তো এমনকিছু নয় তাহলে আমার সম্পর্কে আপনি জানলেন কিভাবে?
— তানভীর বলেছে!
তানভীর আরামে কেক খাচ্ছিলো, নীলের কথা শুনে চোখ বড় করে তাকালো…
— আমি আবার কখন…
নীল চোখ গরম করে তাকাতেই তানভীর একগাল হেসে বললো…
— হ.. হ্যাঁ, আমিই বলেছিলাম! খেয়াল ছিলোনা
— কিন্তু আমার খালু তো বললো উনি নাকি আপনাকে আমার সম্পর্কে কিছু জানাননি, তাহলে আপনি কিভাবে জানলেন?
তানভীর কি বলবে বুঝতে না পেরে নীলের দিকে তাকাতেই নীল প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো…
— দেখুন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। আমরা বরং কাজের বিষয়ে আলোচনা করি? আরোহী, আমি সংক্ষিপ্ত আকারে কথা বলতেই ভালোবাসি তাই সহজ ভাষায় বলছি। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই
— কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাইনা
— কেনো?
— কারণ আমার জীবনের সঙ্গে যার জীবন জুড়বে তার জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে আর আমি চাইনা আমার জন্যে কারো জীবন নষ্ট হোক
আরোহী কথাগুলো বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলো না, কারণ নিজের কাছের মানুষদের থেকে সবসময় এমন অপবাদ পেতে পেতে মেয়েটা নিজেও এসবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আরোহীর কথায় তীব্র কষ্ট লুকিয়ে আছে, নীলের খারাপ লাগলো…
— অতীতে একটা দুর্ঘটনা হয়েছে তারজন্যে আপনার এমন ভাবনা? কাম অন আরোহী, আপনি তো পড়াশুনা জানা মেয়ে। এই যুগে এসে এসব কুসংস্কারে কে বিশ্বাস করে?
— আপনি আমার সম্পর্কে বা আমার জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না তাই বলছেন, কিন্তু আমি চাইনা আমার জন্যে আর কোনো অঘটন ঘটুক। আপনাকে তো ভালো ঘরের ছেলে মনে হয় তাহলে কেনো আমার মত অচেনা অজানা এক মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন? আপনি তো ভালো মেয়ে পাবেন!
— আপনার মধ্যে কি দোষ আছে?
— আমি আপনার সম্পর্কে জানিনা তবে আপনাকে বাহ্যিকভাবে দেখে যতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি আমি আপনার জন্যে উপযুক্ত নই
— এ পৃথিবীতে নিজেকে কেউই পারফেক্ট ভাবেনা, আপনার পার্টনারের চোখে আপনি পারফেক্ট হলেই হলো। আপনি যেমন তেমনি আমার পছন্দ, আপনি যদি আমার পছন্দ না হতেন তবে আমি শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে কখনোই এমন একটা কাজ করতাম না আর না আজ আপনাদের বাড়িতে বসে থাকতাম
নীলের প্রতিটা কথা শুনে আরোহীর মনে হচ্ছে যেনো এতবছর আপন মানুষগুলো যে কথার আঘাত দিয়ে আরোহীর মনে নিজের জন্যে যে ঘৃণাবোধ তৈরি করেছে নীল যেনো সেটা কমানোর চেষ্টা করছে। পাশে বসে বসে তানভীর চা নাস্তা খেতে খেতে মনোযোগ দিয়ে দুজনের কথোপকথন শুনছে। সিরিয়াস বার্তালাপ চলছে বটে! আরোহীর আর ভালো লাগছেনা এসব, ও আর কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে গেলো। নীল বুঝলো একদিনে হবেনা, আরোহীকে আস্তে আস্তে আরো সময় দিতে হবে। বৃষ্টি কমার পর আরোহীর বাড়ি থেকে চলে আসে নীল, প্রয়োজনীয় কাজ শেষে বাড়ি ফেরে। হসপিটালের লাঞ্চ ব্রেকে একবার আরোহীর বাড়িতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ওই সময় ওখানে গেলে হাসপাতালে ফিরে কাজে একটুও মনোযোগ দিতে পারতো না। ওয়ার্কিং আওয়ার শেষ করে গিয়েই ভালো হয়েছে। এবার আরোহীর বিষয়টা নিয়ে ভাবার জন্যে পুরো রাত পাওয়া যাবে, ফেরার পথে এসব ভেবে শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো নীল…
___________________________________
ঘুমানোর জন্যে বিছানা ঠিক করছিলো আরোহী, ডিভোর্সের পর আরোহীর নানি তার মেয়েকে থাকার জন্যে একটা ছোটো ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছিলেন। ছোটো তিনতে রুম আছে, সেখানেই থাকে ওরা। আরোহী নিজের কাজে করছিলো ঠিকই, আবার নীলের কথাগুলোও ভাবছিলো। কিন্তু নিজের মনকে ও মানিয়ে নিয়েছে, নীল কেনো কারোরই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হবেনা ও। এরই মাঝে ওর মা রুমে এসে হাজির, আরোহী জানতো ওর মা আসবেই নীলের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে। এসেই টানটান করা বিছানায় বসে বললেন…
— বুঝলি, ছেলেকে তো ভালোই মনে হলো। তোর সঙ্গে অতক্ষণ কথা বললো, তোকে সত্যিই পছন্দ করে মনে হচ্ছে
— আমি তাকে বলে দিয়েছি বিয়ে করবো না
— আমি বলি কি, ছেলেটা যখন আগ্রহ দেখাচ্ছে তুই আর আপত্তি করিস না। হার্টের ডাক্তার, অনেক টাকা কামায়। আমাদেরও তো লাভ হবে এতে
মায়ের কথা শুনে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেনা আরোহী, শেষে কিনা ওর মা নীলের টাকার লোভ করছে?
— মা! এসব কি বলছো তুমি? টাকার লোভ করছো?
— তাতে সমস্যা কি? টাকা তো আছে ছেলেটার, তোকে যদি বিয়ে করে তাহলে নিশ্চয়ই এ বাড়িতেও টাকা দেবে। আমাদের যে টানাটানির সংসার, মেয়ের জামাইয়ের টাকায় আরামমতো চলে যাবে
— আমি আর ভাইয়া দিনরাত পরিশ্রম করে তোমার হাতে টাকা তুলে দিচ্ছি, তোমার সংসার তো চলছে মা তাহলে কেনো অন্যের টাকার লোভ করছো?
— তোর বাপ কি করেছিলো মনে আছে? কোত্থেকে লোন এনে আমার ঘাড়ে ফেলে গেছিলো। সেগুলো শোধ করতে গিয়ে এই ফ্ল্যাট মর্গেজ রাখতে হয়েছিলো, সেই টাকা এখনও কিছু শোধ হওয়া বাকি। তোর ও দু পয়সায় কিছু হয় নাকি? সব তো আমার ছেলের টাকাতেই চলে
— শুধু ভাইয়াই তোমার ছেলে মা? আমি তোমার মেয়ে নই? নাকি বেশি টাকা রোজগার করিনা বলে আমাকে মেয়ে বলে ভাবো না?
— মেয়ে পরের ঘর সাজায় আর ছেলে নিজের ঘরই সাজিয়ে রাখে এটা মনে রাখবি।
মায়ের কথা শুনে প্রচণ্ড কষ্ট হলো আরোহীর, প্রায়ই ওর মা টাকার প্রসঙ্গ তুলে খোটা দেয় যেনো চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা আশফেরের ঘাড়ের বোঝা ও!
— আমার ঘুম পাচ্ছে মা, যাও এখন!
মাকে রীতিমত ঠেলে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকালো আরোহী, সারাদিন মায়ের এসব কথা শুনতে শুনতে অতিষ্ট লাগে মেয়েটার। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব থেকে দূরে কোথাও যেতে পারলে শান্তি লাগতো। ওদিকে…রাতের বেলা হুট করেই নীলের মা বাবার একদফা ঝগড়া হয়েছে। নীলের মা রাগ করে এসে ছেলের ঘরে বসে আছে, নীলও মাকে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি কারণ প্রায়ই ওর মা বাবার ছোটো ছোটো বিষয়ে তর্ক লেগে যায়। নীলের মা বাবা ক্লাসমেট ছিলো, লাভ ম্যারেজ! শুনেছে বিয়ের প্রথম প্রথম তো ঝগড়া হলে হাতাহাতিও হতো, এখন অবশ্য সময়ের সঙ্গে সেসব হয় না। নীল একটা সার্জারির বিষয়ে স্টাডি করছিলো, সেটা রেখে একটু মায়ের মন ভালো করার চেষ্টায় প্রশ্ন করলো…
— আচ্ছা মা, তোমরা কি এখনও বাচ্চা বলোতো। রাগ করে এসে আমার ঘরে বসে আছো? বাবা যদি অন্য কারো সাথে ফ্লার্ট করে তখন?
— করুক গিয়ে! আমার কি!
মায়ের অভিমান কতদূর স্থায়ী হবে তা নীল জানে, তাই আর ওসব নিয়ে কথা না বাড়িয়ে একটু নিজের প্রসঙ্গে আলোচনা করার চেষ্টা করলো…
— তোমার কি মনে হয় বলোতো মা, কেমন মেয়েকে পছন্দ করেছি আমি?
— তুই কি কখনো আমাকে নিজের পছন্দের কথা বলেছিস? আর যাকে পছন্দ করিস তার কথাও তো কিছুই বলছিস না। দেখ, তোর এই লুকোচুরি দেখে কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে
— ভয়ের কি আছে?
— যদি তুই এমন কাউকে পছন্দ করিস যে তোর উপযুক্ত নয় তখন?
— এমন কিছু হবেনা মা, রিল্যাক্স!
মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন কথার অজুহাতে নীল আরোহীর কথা বললো, যদিও সরাসরি বলেনি কিন্তু ওর মা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে বটে! সকালবেলা…আরোহীর মা পাশের বাসায় গেছে কোনো একটা কাজে, নাস্তা টেবিলেই ছিলো।ও খেতে বসলো। রাতে ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বলছে ওর, বিষয়টা লক্ষ্য করে আশফের জিজ্ঞাসা করলো…
— চোখমুখ এমন হয়ে আছে কেনো? রাতে ঘুমাসনি?
— তেমন ভালোভাবে হয়নি
— মা কিছু বলেছে?
যদিও আরোহী অস্বীকার করলো কিন্তু আশফের জানে নিশ্চয়ই ওর মা কিছু বলেছে, খাওয়ার এক পর্যায়ে আশফের একটা কার্ড বের করে আরোহীকে দিলো…
— এটা কি?
— নীলের কার্ড, এখানে ও নিজের ব্যক্তিগত নাম্বারও লিখে দিয়েছে
অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো আরোহী!
— এটা আমায় কেনো দিচ্ছ?
— কারণ নীলকে আমি তোর নাম্বার দিয়েছি
এ কথা শুনে আরো অবাক হলো আরোহী…
— ভাইয়া, তুমি তাকে আমার নাম্বার কেনো দিলে? এমনিতেই লোকটা কথা বাড়ানোর চেষ্টায় আছে, আমি চাইনা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে কিন্তু এবার তো সে ফোন করবে!
— দেখ, আমি জানি তোর ইচ্ছে নেই আর আমি তোকে জোরও করছিনা কিন্তু কথাবার্তা বলতে তো সমস্যা নেই তাইনা? দেখ না আলাপ করে, কিছু যদি হয় তাহলে মন্দ কি?
মায়ের কথায় কষ্ট পেলেও আরোহী সবসময় ভাবতো যে ভাইয়ের সাপোর্ট তো অন্তত আছে কিন্তু আজ ভাইয়ের কথা শুনে আরোহীর আরো কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই কি আশফেরও মায়ের মতো নিজের বোনকে বোঝা ভাবতে শুরু করেছে?
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]