ভালোবাসা হাত বাড়ালো পর্ব-৫+৬

0
36

#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৫

আরোহীর সঙ্গে নীলের এটাই প্রথম দেখা ছিলো না, বরং নীল আরোহীকে আরো দুবছর আগেই দেখে পছন্দ করে নিয়েছিলো। বছর দুয়েক আগে একটি হাসপাতালে কয়েকমাসের জন্যে জয়েন করেছিলো নীল, অনেকটা প্রক্সি ডাক্তার হিসেবে ছিলো বলা যায় কারণ ওই হসপিটালের মেইন হার্ট সার্জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে গেছিলেন। ওখানে থাকা অবস্থায় নীল যে বাড়িতে থাকতো তার সামনের বাড়িটা ছিলো আরোহীর এক আত্মীয়ের বাসা, নীল আরোহীকে প্রথম ওখানেই দেখেছিলো। আরোহীর এলাকার এক ছেলে আরোহীকে ভীষণ উ’ত্যক্ত করছিলো, পরিস্থিতি কিছুটা জটিল পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার পর আরোহীকে ওর মা এক আত্মীয়ের বাড়িতে কয়েকদিন থাকার জন্যে পাঠিয়েছিল। আরোহী সেখানে এক মাস মতো ছিলো, শুরুতে নীল ভেবেছিল হয়তো আরোহী এই বাড়ির মেয়ে কিন্তু একটু আধটু খোঁজ নিয়ে পরে জানতে পারলো এটা আরোহীর আত্মীয়ের বাড়ি। ও বাড়িতে থাকা অবস্থায় আরোহী প্রায়ই বিকেলে নিজের কাজিনদের সঙ্গে বাইরে বের হতো, কিন্তু নীল সেসময় হাসপাতালে থাকতো তাই সরাসরি ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ কখনো পায়নি। সামনাসামনি বাড়ি হওয়ায় হসপিটালে যাওয়ার পথে রাস্তায় মাঝেমাঝে আরোহীকে নজরে পড়তো নীলের কিন্তু ওর সঙ্গে সবসময়ই কেউ না কেউ থাকতো তাই নীল ইচ্ছে করেই কখনো কথা বলার চেষ্টা করতো না। রাতে, প্রায়ই আরোহীকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে দেখতো নীল। ওই একটা মাস দুর থেকে দেখতে দেখতেই আরোহীর প্রতি একটা তীব্র ভালো লাগা জন্মাতে শুরু করলো নীলের। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিলো যে আরোহীর সঙ্গে একদিন কথা বলবে কিন্তু নীল যখন কথা বলতে চাইছিল আরোহী তার আগেই নিজের বাড়ি ফিরে গেছিলো। পরবর্তীতে নীল জানতে পারে যে আরোহীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আরোহীকে আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে ওর মা দ্রুত মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজে ফেলেছিল। পারিবারিক চাপে পড়ে আরোহীও বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। আরোহীর বিয়ের খবর শুনে বেজায় আফসোস হয়েছিলো নীলের, জীবনে প্রথম ভালো লাগা মানুষটাকে কিছু বলার সুযোগই হলো না! অতো চিন্তা ভাবনা না করে নিজের মনের কথাটা প্রকাশ করা উচিত ছিল হয়তো, এই ভাবনায় বহুদিন নীল হতাশ ছিলো। একটা বিবাহিত মেয়ের জীবনে ঝামেলা করার মতো পুরুষ নীল নয় তাই সেসময় আরোহীর ভাবনা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল নীল। বিগত দু বছরে নিজের আত্মীয় ও কলিগসহ বহু মেয়েকে ডেট করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে নীল কারণ জীবনের প্রথম পছন্দের মানুষটির কথা তখনও ওর মাথা থেকে সরেনি। কিন্তু কে জানতো জীবন হারানো জিনিস নিজের করে পাওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ দেবে? নীলের বন্ধু তানভীর একদিন ওকে জানায় যে একটা মেয়ে পছন্দ করা হয়েছে, তানভীর নীলকে মেয়ের ছবি দেখায়। সেদিন আরোহীর ছবি দেখে চমকেছিলো নীল, আরোহীর আবার বিয়ে হচ্ছে? এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আরোহীর বিষয়ে জানার পর নীল একদিকে কষ্ট পেয়েছিল বটে। এ বয়সেই মেয়েটার জীবনে এতকিছু ঘটে গেছে? আরোহীর সঙ্গে দেখা করার তীব্র ইচ্ছা জাগে ওর, এরপর আর কি? তানভীরের সঙ্গে প্ল্যান করে চলে গেলো আরোহীর সঙ্গে দেখা করতে। যে মেয়েটাকে দুর থেকে দেখেই ভালোবাসে ফেলেছিল তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলো নীল কিন্তু আরোহীর অবস্থা দেখে কষ্ট হয়েছে, মেয়েটা যে কি দারুন চিন্তা ও মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে তা ওর প্রতিটি কথায় স্পষ্ট! একবার যে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে দ্বিতীয়বার সেই ভুল করবেন নীল, তাই এবার আর সময় নষ্ট না করে সরাসরি আরোহীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে!
_________________________________

আজ হসপিটাল থেকে ফিরতে অনেকটা রাত হয়েছে নীলের, এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে, আরোহীর সঙ্গে দেখা করে এসেছে তাও সপ্তাহ তিনেক হবে। মেয়েটার এরপর থেকে কোনো পাত্তা নেই, নীল ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো নিজে থেকেই একটা ফোন করবে কিন্তু শেগুড়ে বালি! নীল নিজেই কল করবে বলে ঠিক করলো, রাত হয়েছে বটে তাও নীল কল করে ফেললো, আরোহী তখন পড়ছিল। সারাদিন চারটা টিউশনি করানোর পর পড়ার সময় পায়না তাই রাতেই একটু পড়ে নেয়। অচেনা নাম্বারে ফোন দেখে প্রথমে আরোহী রিসিভ করতে আগ্রহী ছিলো না কিন্তু এতো রাতে ফোন এসেছে, কেউ আবার বিপদে পড়ে ক করলো কিনা ভেবে রিসিভ করে কিছু বলার আগেই নীল বলে উঠলো…

— ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম না তো? ওহ সরি, আমি নীল বলছিলাম। চিনতে পেরেছেন?

নীলের কণ্ঠ কিছু সময় নিরব রইলো আরোহী! লোকটার কথা ভোলার চেষ্টায় ছিলো ও, যদিও ওর মা এ কদিনে প্রতিনিয়ত ওকে নীলের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। যদিও উনি বলছেন মেয়ের ভালোর জন্য এমন চাইছেন কিন্তু আরোহী জানে ওর মায়ের আসলে কোথায় নজর পড়েছে!

— হুমম, আমি জেগেই ছিলাম

নীল ভেবেছিল মেয়েটা বুঝি রাগ করবে কিন্তু বেশ শান্ত স্বরেই উত্তর আসলো আরোহীর তরফ থেকে…

— আমার ফোন পেয়ে যখন অবাক হননি তারমানে আপনার ভাই আপনাকে নিশ্চয়ই জানিয়েছে আমি আপনার নাম্বার নিয়েছি!

— একটা অচেনা মেয়ের অনুমতি ছাড়া তার নাম্বার নেওয়াটা অপ’রাধ সেটা তো জানেন?

— প্রথমত, আপনি অচেনা নন আর আমি নাম্বার আদান প্রদান করেছি। আপনার নাম্বারের বদলে নিজের নাম্বারও তো দিয়েছি, কিন্তু এতদিনেও আপনি একবার ফোন করেননি। বোধহয় আগ্রহী নন আমার ব্যাপারে!

— বুঝতেই যখন পারছেন তাহলে সময় কেনো নষ্ট করছেন? বিয়ের ইচ্ছে থাকলে ভালো মেয়ে খুঁজে বিয়ে করে নিন

— এখন কাউকে খুঁজে বিয়ে করে তাকে ভালোবাসতে অনেক সময় লাগবে, লম্বা একটা প্রোসেস! আমি এটাকে শর্টকার্ট করতে চাইছি

— মানে?

— মানে, মেয়ে তো খোঁজা হয়েই গেছে। এই সময়টুকু তো বাঁচলো

নীল যদিও মজার ছলে কথাগুলো বলেছে কিন্তু আরোহী রেগে গেলো, ওর যেনো মনে হচ্ছে নীল উড়ে এসে জুড়ে বসা এক সমস্যারুপে এসে হাজির হয়েছে…

— আপনার কাছে কি এগুলো মজা মনে হচ্ছে?আপনি আমার জন্যে সমস্যা তৈরি করছেন, প্লিজ এমন করবেন না। আগেও শান্তি ছিলো না আমার কিন্তু আপনি আসার পর থেকে বাসায় দু দণ্ড শান্তিতে বসাও আমার জন্যে দায় হয়ে গেছে

— কি হয়েছে? অ্যানি প্রবলেম?

— প্রবলেম আপনি তৈরি করছেন, কেনো আপনি এসেছিলেন আমার বাড়িতে আর কেনোই বা আমার বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন? আমি তো প্রথম দিনই বলে দিয়েছিলাম আমি বিয়ে করতে চাইনা, আমি শুধু একটু শান্তিতে থাকতে চাই ব্যাস

— কোনো সমস্যা হয়েছে আপনার বাড়িতে?

— আমার ব্যক্তিগত বিষয় না হয় আমি অব্দিই থাক, আপনার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ আমাকে বিয়ে সম্পর্কিত আর কোনো কথা বলবেন না প্লিজ। আমি আর “বিয়ে” নামক সম্পর্কে জড়াতে চাইনা

— আরোহী, লিসেন। আমার জন্যে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে বলো আমায়, আমি হেল্প করবো

আরোহী আর কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিলো, নীল এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো। আরোহীর বাসায় কি ওকে নিয়ে কোনো ঝামেলা হলো? একবার নীল ভেবেছিল আরোহীর বাড়ি গিয়ে বিষয়টা দেখবে, আবার ভাবলো আরোহী এতো রেগে কথা বলার পর ওর বাড়িতে দ্বিতীয়বার যাওয়াটা ভালো দেখাবে না। কি করা উচিৎ এখন? দারুন এক দোটানায় পড়লো নীল!
___________________________________

চাকরির চেষ্টা করছে আরোহী, রোজ মায়ের উল্টোপাল্টা কথা শুনে শুনে তিক্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। চাকরি করে ক্ষমতা হলে বাড়ির বাইরে কোথাও গিয়ে থাকার ইচ্ছে আছে, কিন্তু বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আরোহীর এ চাওয়া পূরণ হবে কিনা জানা নেই! আরোহীর মায়ের সঙ্গে এক ঘটক মহিলার পরিচয় আছে, মহিলাটি প্রায়ই ওদের বাড়িতে আসে। আজকেও এসেছে, ওনার সঙ্গে আরোহীর মা আশফেরের বিষয়ে আলাপ করছিলেন…

— খাসা একটা মেয়ে আছে আমার কাছে, আপনার ছেলেকে বলে দেখবেন নাকি? যদি পছন্দ হয়, বিয়েটা করে ফেলতে পারবে

— কি আর বলবো আমি! ছেলেকে তো অনেকবার বলেছি আমি কিন্তু আরোহীর চিন্তায় চিন্তায় নিজের বিয়েশাদী কথা কানেই তুলতে চায়না

— আপনার ছেলেকে বোঝান, আপনার মেয়ের ভাগ্যে সংসার থাকলে এমনকিছু হতো নাকি? বোনের জন্যে ভাইয়ের জীবন নষ্ট করার তো মানেই হয় না

আরোহীর মা ওই মহিলার সঙ্গে আলাপ করছিলেন, আরোহী মা মূলত মেয়েরই দোষ দিচ্ছিলেন। পাশের ঘর থেকে মায়ের সব কথা শুনেছে আরোহী, জানেনা এসব কবে বন্ধ হবে। কেনো সবার ওকে নিয়ে এতো সমস্যা জানা নেই। আদৌ কি এসব থেকে কোনোদিন রেহাই পাওয়া ভেবে পায়না মেয়েটা! দিনদিন মানসিকভাবে যেনো অসুস্থ হয়ে পড়ছে আরোহী, জীবন বড় তিক্ত লাগে ওর। কয়েকবার সুই*ইড করার চেষ্টা করেও পিছিয়ে এসেছে, কি করবে ওর জানা নেই। ওদিকে…মায়ের জোরাজুরিতে আজ আরোহীর বিষয়ে সব কথা বলেছে নীল। মেয়ের ছবি দেখে মীর সাহেব ও রওশন বেগমের পছন্দ হলেও পুরোটা শোনার পর ওনারা কিছুটা নিরব রইলেন।

— কি হলো? তোমরাই তো আরোহীর বিষয়ে সব শুনতে চাইছিলে, এখন এমন চুপ করে গেলে কেনো?

রওশন বেগম কিছুটা হতাশ কণ্ঠে বললেন…

— মেয়েটার আগে বিয়ে হয়েছিলো?

— ওর হাসবেন্ড থাকা অবস্থায় তো বিয়ে করতে চাইছিনা

— আমি সেটা বলছি না নীল, মেয়েটা বিধবা? তুই এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করবি? লোকে কি বলবে? তুই আর মেয়ে পেলি না?

— মা, ওকে আমি দু বছর ধরে পছন্দ করি আর পছন্দ করাটা মনের ব্যাপার।

— তাই বলে…তাছাড়া তুই বললি মেয়েটার ফ্যামিলিও মধ্যবিত্ত! তাতে আমার সমস্যা নেই কিন্তু মেয়েটা কি তোর সঙ্গে যায়? তুই ওকে ভুলে যা বাবা

— সরি মা, আমি এটা করতে পারবো না

— জেদ কেনো করছিস? অ্যাই! তুমি কিছু বলো না, বোঝাও ওকে। দুনিয়ায় মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি?

নীলের মা ওর বাবাকে বললো ছেলেকে বোঝাতে কিন্তু মীর সাহেব নিরব ছিলেন, উনি ছেলের দিকে দেখছিলেন। মীর সাহেব জানে তার ছেলে যখন এই মেয়েকে পছন্দ করেছে ওকে আর ফেরানো যাবেনা!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]

#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৬

আজ রাতে ভাইয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে আরোহী…

— আজকে বাড়িতে ওই ঘটক অ্যান্টি এসেছিলো ভাইয়া, একটা মেয়ের কথা বলছে। মেয়েটা নাকি বেশ ভালো আর তোর সঙ্গেও খুব মানাবে। চাকরিও করে, একবার মেয়েটাকে দেখে নাও

— মা বলেছে নাকি তোকে আমাকে এসব কথা বলার জন্যে?

— মা কেনো বলতে যাবে? আমার নিজের কি বোধ নেই? তোমার বয়সী সকলে বিয়ে করে বাচ্চার বাবা হয়ে গেছে আর তুমি এখনও বিয়ে ছাড়া পড়ে আছো। তুমি এবার বিয়ে করে নাও ভাইয়া, আর কতদিন একলা থাকবে?

আশফের হাসলো…

— বিয়ে মানে তো ঝামেলা, আর কয়েকটা দিন ঝামেলামুক্ত থাকতে চাই। আর কয়েকটা বছর যাক তাছাড়া কাজের অনেক চাপ এখন। বিয়ে করলে বাড়তি একটা ঝামেলা হবে

ভাইয়ের বিয়ের প্রতি অনাগ্রহের কারণ আরোহীর অজানা নয়, কিছু সময় নিরব থেকে আরোহী হঠাৎ বলে উঠলো…

— আমার বিয়ে হলে কি তুমি বিয়ে করবে ভাইয়া?

— তুই হঠাৎ এসব কথা কেনো বলছিস?

— কিছুনা, এমনি জানতে ইচ্ছে হলো। আমার জন্যেই তো তুমি এখনও করছো না। আমার বিয়ে হলে তুমিও বিয়ে করবে তো?

— অ্যাই আরোহী, কে বলেছে তোকে এসব? তোর জন্যে কিছু হচ্ছেনা। আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করছি না, সঠিক সময় এলে করবো। তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা আর মায়ের ওসব কথা কানে তুলিস না। সারাদিন ঘরে বসে বসে মায়ের কাজ নেই, উল্টোপাল্টা কথা বলে

আশফের বোনকে নানানভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, তখনকার মতো আরোহীও ভাইয়ের কথাতেই সায় দিতে লাগলো কিন্তু মনে মনে ও অন্যকিছুই ভাবছে ওদিকে ছেলের পছন্দের মেয়ে সম্পর্কে জানার পর থেকেই রওশন বেগমের মাথা গরম হয়ে আছে। মীর সাহেবকে অনেকবার বলার পরেও ওনার কোনো হেলদোল নেই দেখে রওশন বেগম ভীষণ রেগে গেলেন…

— ছেলে কি বললো জানার পরেও তুমি ওকে কিছু বলছো না কেনো? এমন চুপ থাকলে হবে?

— আহা, তুমি এত অস্থির কেনো হচ্ছো? নীল ছোটো বাচ্চা নয় যে কি করছে জানেনা। ও কিছু ভেবেই মেয়েটাকে পছন্দ করেছে

— কি ভেবে? অমন একটা মেয়েকে নীল বিয়ে করলে আমাদের মান সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা ভাবছো না? আমি বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, একটা কথা কানে তুলছেনা আমার। এবার তুমি ওকে বোঝাও

রওশন বেগম আরোহীকে মানতে নারাজ কিন্তু মীর সাহেব এ বিষয়ে একটা কথাও ছেলেকে বলেননি, ছেলের সিদ্ধান্তে সম্মান করেন উনি। এদিকে…ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর আরোহী বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করলো কি করবে। মূলত ওর চিন্তাতেই ওর ভাই সংসার জীবনে যেতে চাইছেনা কারণ একজন বিধবা বোনকে বাড়িতে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে এটা পছন্দ করবে এমন ভাবী পাওয়া মুশকিল, নেই বললেই চলে। অনেক ভাবনার পর আরোহী একটি সিদ্ধান্ত নিলো! নীলের আজ সার্জারি ছিলো না তবে রোগী ছিলো অনেক। সারাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফেরার পরেই অপ্রত্যাশিত ঘটেছে। আরোহী কল করেছে! যে মেয়েটা পাত্তাই দিচ্ছেনা সে নিজে ফোন করেছে দেখে নীল অবাক হলেও খুশিও হয়েছে। কল রিসিভ করেই মৃদু হেসে বললো…

— আজ আপনি নিজেই কল করেছেন? হঠাৎই নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে

— বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমা চাইছি

— নো, ইটস ফাইন। কিছু বলবেন?

— আমরা কি দেখা করতে পারি?

যে মেয়েটা কথা বলতেই পছন্দ করেনা সে দেখা করতে চাইছে? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। নীল আর পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেনি এ বিষয়ে…

— ইয়াহ শিওর! কিন্তু আগামী দুদিন আমি ব্যস্ত আছি, একটা ক্রিটিক্যাল কেস এসেছে। সময় হবেনা, পরশু দেখা করি? আপনি চাইলে আমার হসপিটালেও আসতে পারেন

— ঠিক আছে, আপনার যখন সময় হবে একটা ফোন করে দেবেন। চলে আসবো।

— আপনি ঠিক আছেন তো আরোহী?

“জ্বি” — শুধু এইটুকু বলেই কল কেটে দিলো মেয়েটা কিন্তু সে যে ঠিক নেই তা নীলের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ব্যস্ততা না থাকলে হয়তো নিজেই চলে যেতো, পারলে এখুনি যেতো! কিন্তু এতো রাতে একটা মেয়ের বাড়িতে যাওয়া ভদ্রতা নয় তাই অপেক্ষায় রইলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে! ২ দিন পর…আরোহী হসপিটালে এলো। মেয়েটাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে, নীল কফি অর্ডার করতে চাইছিল কিন্তু আরোহী মানা করে…

— কেমন আছেন আপনি?

— রোজ ভালো থাকার চেষ্টা করে চলেছি, আলহামদুলিল্লাহ যা আছি মন্দ না তবে আমি আপনার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয়ে কথা বলতে চাই

— বলুন!

বলতে গিয়েও আরোহী বারবার থেমে যাচ্ছিলো, যেনো দ্বিধায় আছে। নীল আশ্বাস দিয়ে বললো…

— আপনি যা বলার নিশ্চিন্তে বলুন…

— আপনি নিশ্চয়ই আমার পরিবার ও আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন, তাও আমি নিজেকে আবারো আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই

নীল অবাক হলো, আরোহী নিজেকে নীলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে? নিজের ভাইয়ের বিষয়টাও বললো, মোটামুটি বিস্তারিতভাবে নিজের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করলো নীলের কাছে…

— এ মুহূর্তে আমি এমন একটা অবস্থায় দাড়িয়ে আছি যে নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকা উপায় নেই আবার সেখানে থেকেও তাদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছি

নীল মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে, আরোহীকে সর্বরকম সাহায্য করার জন্যে প্রস্তুত সে। নীল ভেবেছিল আরোহী হয়তো ওর পারিবারিক কোনো বিষয়ে সাহায্য চাইবে কিন্তু এরই মাঝে আরোহী হঠাৎ বলে উঠলো…

— আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?

নীল চমকে উঠলো, আরোহী নিজে বিয়ের প্রস্তাব রাখছে? এ কিভাবে সম্ভব?

— আর ইউ সিরিয়াস? আই মিন আপনি নিজেই বিয়ের কথা বলছেন?

— আমি আসলে এ মুহূর্তে অসহায় আর আপনি ছাড়া এমন একটা বিষয়ে আমাকে সাহায্য করার কেউই নেই। আপনি ভাববেন না আমি আপনার ওপর বোঝা হয়ে থাকবো, নিজেকে চালানোর জন্য উপার্জনের একটা না একটা উপায় আমি বের করেই নেবো কিন্তু আমি শুধু এখন নিজের বাড়ি থেকে বেরোতে চাইছি। আমার ভাইয়ের জন্যে, ভাইয়াকে সেই ছোটো দেখছি বাবার মত আমাকে আগলে রেখেছে। আমি চাইনা আমার জন্যে ভাইয়ার ভবিষ্যৎ নষ্ট হোক

নীল বুঝলো আরোহী পারিবারিক অশান্তি দুর করার জন্যে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বিশেষ করে ভাইয়ের চিন্তায় নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে মেয়েটা।

— আপনি আমার ভাইকে নিজের পরিবার সম্পর্কে বলেছিলেন, আপনার আর আমার স্ট্যাটাসে অনেক পার্থক্য। আপনার যদি কোনোদিন মনে হয় আমি আপনার উপযুক্ত না তাহলে ডিভোর্স দিলেও সমস্যা নেই কিন্তু এই মুহূর্তে আমার জন্যে বিয়েটা করা খুব প্রয়োজন

আরোহীর কথা শুনে নীলের খুব রাগ হলো, মেয়েটা নিজেকে সর্বক্ষেত্রে এতো নিচু কেনো ভাবে ভেবে পায়না নীল! কিছুটা রেগেই নীল বললো…

— আরোহী, আপনি নিজেকে একটুও ভালোবাসেন না তাইনা? নিজেকে খুবই মূল্যহীন ভাবেন

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আরোহী…

— একটা বিধবা মেয়ে তার বাপের বাড়িতে পড়ে আছে, সমাজের চোখে সেটা খারাপ। দোষ না থাকা সত্ত্বেও সবকিছুতেই আমাকে দোষ দেওয়া হয়। আমি তো মূল্যহীনই। তাই নয় কি?

— নো, ইউ আর ভেরি প্রিসিয়াস! আপনি আমার স্ত্রী হলে আপনাকে সবার থেকে রক্ষা করার কর্তব্য আমার, আমি আপনার সম্পর্কে সব জানি। এমন নয় যে আপনি আমার থেকে নিজের বিষয়ে লুকিয়ে বিয়ে করবেন। তাই কে কি বললো সেসব বিষয়ে পাত্তা আমিও দেবোনা আর আপনি না। গট ইট?

— আমি চাইছিলাম আপনি আমাকে মন থেকে মেনে নিয়ে বিয়ে করতে রাজি হন কিন্তু… ইটস ওকে। আপনি বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন এটাই অনেক। আমার কোনো আপত্তি নেই, আমরা বিয়ে করবো!

— কিন্তু আপনি আগে আপনার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে নিন, ওনারা যদি আপত্তি করেন তবে আমি আপনাকে জোর করবো না

— আমার মা বাবা আপনার সম্পর্কে সব জানে

— ওনারা আপনাকে কিছু বলেনি?

— আপনি আমার পরিবার নিয়ে ভাববেন না, ইন ফ্যাক্ট এখন আপনি সব ভাবনা বাদ দিয়ে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবুন। বাকি বিষয়ে নিয়ে ভাবনার দায়িত্ব আমার

মায়ের আপত্তির বিষয়টা আরোহীকে বললো না নীল, মেয়েটা নিজেই রাজি হচ্ছে বিয়ের জন্যে আর এ মুহূর্তে আরোহীকে বিয়ে করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়না!
___________________________________

বাড়িতে বিয়ের বিষয়ে কথা বলেছে নীল, এরপর থেকেই ওর মা সারাদিন ধরে ছেলেকে বুঝিয়েই যাচ্ছেন কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছেনা। নীল নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। রাতে মীর সাহেব ছেলের ঘরে এলেন, যদিও নীলের মা ওনাকে পাঠিয়েছেন ছেলেকে বোঝানোর উদ্দেশ্য কিন্তু মীর সাহেব এসেছেন অন্য উদ্দেশ্যে। বাবাকে অসময়ে রুমে আসতে দেখেই নীলের বুঝতে দেরি হয়নি কেনো এসেছে…

— তোর মা অনেক রেগে আছে, অভিমান করেছে তোর ওপর

— বাকিদের মতো মা ও এখন ওই একটা বিষয়ই ভাবছে, আরোহীকে নিয়ে তার সমস্যা কোথায় সেটাও আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আরোহীর সঙ্গে কথাবার্তা হলেই মায়ের এই অভিমান দুর হয়ে যাবে এন্ড আই শিওর অ্যাবাউট দ্যাট!

— বিয়েটা তাহলে সত্যিই করছিস

— হুমম, তোমাদের কিন্তু কাজ বটে গেলো বাবা। সত্যিই এবার আরোহীর বাড়িতে যাওয়ার সময় এসে গেছে, তৈরি থেকো আর মাকে একটু বুঝিও

— মায়ের কোনো কথায় কোনোদিন দ্বিমত করিসনি তুই, সেই তুই কিনা একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে মায়ের অবাধ্য হচ্ছিস, মেয়েটাকে খুব ভালোবাসিস নাকি?

বাবার কথায় স্মিত হাসলো নীল…

— ভালোবাসি কিনা জানিনা, বাট আই ওয়ান্ট টু লিভ উইথ হার। আর কোনো মেয়ের প্রতি এমন ভাবনা জাগেনি আমার যেমন আরোহীকে দেখে অনুভব করি

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]