ভালোবাসা হাত বাড়ালো পর্ব-৯+১০

0
1

#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৯

আরোহীকে আজ নীল নিজেই কলেজে দিয়ে গেছে, বান্ধবীদের সঙ্গে বিয়ের পর কলেজের প্রথম দিনটা ভালোই কেটেছে। পারিবারিকভাবে বিয়েটা হওয়ায় বান্ধবীদের বিয়েতে দাওয়াত দেয়া হয়নি তাই ওদের ট্রিট দেওয়ার জন্যে নীল টাকা দিয়ে দিয়েছিল। এমন ছোটো ছোটো অনেক বিষয়েই নীল খেয়াল রাখে, বিষয়টা আরোহীর বেশ ভালো লাগে। আজ একটা প্রয়োজনে ক্লাস শেষে বান্ধবীদের সঙ্গে মার্কেটে গেছিলো আরোহী। সেখানে একটা টি শার্ট ভীষন পছন্দ হয় ওর। আরোহীর মনে হয় নীলকে শার্টটায় মানাবে, তাই ওটা কিনে আনে। আজকে ডিনার টাইমের আগেই বাসায় এসেছে নীল, ফ্রেশ হয়ে আসতেই ওর সামনে একটা ব্যাগ ধরে আরোহী বলে…

— এটা আপনার জন্যে

তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে খানকিটা অবাক হয়ে তাকালো নীল!

— কি আছে এতে?

— বলতে পারেন একটা ছোট্ট গিফট!

— হঠাৎ গিফট কেনো?

— আসলে আমার এক বান্ধবী ওদের হাসবেন্ডের জন্যে জন্মদিনের গিফট কিনতে আমাদের মার্কেটে নিয়ে গেছিলো, সেখানে আমার এটা দেখে পছন্দ হলো। আমি তো ঠিক জানিনা আপনার পছন্দ কেমন, বাট আই হোপ আপনার মন্দ লাগবেনা

বউয়ের কাছ থেকে এমন সারপ্রাইজ গিফট পেতে কোন স্বামীরই না ভালো লাগে? নীল তোয়ালেটা মাথায় রেখেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে একগাল হেসে বললো…

– বাহ! যেখানে আমার তোমাকে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট দেওয়ার কথা সেখানে তুমি আমায় প্রিন্স ট্রিটমেন্ট দিচ্ছো? আই অ্যাম ফিলিং সো লাকি। থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।

— খুলে দেখে নিন না, যদি রং বা ডিজাইন ভালো না লাগে তাহলে দুদিনের মধ্যে বদলে আনা যাবে

— গিফট কেউ কখনও বদলে আনেনা আর তুমি যখন এনেছো তখন খুলে দেখার প্রয়োজন নেই। ভালোই হবে। আচ্ছা, তোমার ইন্টারভিউয়ের ডেট কবে কিছু তো আর বললে না

— আমি ঠিক করেছি আগে মা বাবাকে বিষয়টা জানাবো। ওনাদের কোনো আপত্তি আছে কিনা সেটা একবার জেনে নেওয়া উচিত

— আমি আগেও বলেছি তোমার আমার মা বাবাকে বলতে হবেনা। তারা কিছুই বলবেনা

— না নীল, তবুও! ওনারা গুরুজন আর ওনাদের না জানিয়েই এভাবে আমি নিজে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। ওনাদের একবার শুধু চাকরির বিষয়টা বলতে চাই

— ফাইন! তুমি যখন মা বাবাকে জানানোর জন্য এত আগ্রহী তবে বলেই যেও

নীল অনেকবার বুঝিয়েছে কিন্তু আরোহী নাছোড়বান্দা, বাড়িতে না জানিয়ে কিছুই করবেনা যদিও আরোহী কেনো বাড়িতে জানানোর জন্য এতটা উতলা হচ্ছে সেটা নীল জানেনা। রওশন বেগমের আচরণ ও কথাবার্তায় আরোহীর বারবার খটকা লাগছে যে উনি হয়তো চাকরি করতে দেবেন না তাই ইন্টারভিউতে যাওয়ার আগে আরোহী বাড়িতে সবার মতামত নিয়ে জবের বিষয়টা নিশ্চিত করতে চায়। ডিনার টেবিলে সবার উপস্থিতিতে নীল বললো…

— মা, বাবা। আরোহী তোমাদের কিছু বলতে চায়

মীর সাহেব তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলেন…

— কি হয়েছে আরোহী? কোনো সমস্যা?

— না বাবা, আসলে আমি একটা চাকরির জন্যে এপ্লাই করেছিলাম আর এক্সামেও টিকেছিলাম। এখন সেখান থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্যে ডেকেছে। মনে হচ্ছে চাকরিটা হয়েই যাবে। আমি এই চাকরিটা করতে চাই

— এটা তো ভালো কথা, আপত্তির কি আছে! তোমার ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই করবে

যদিও মীর সাহেব সম্মতি জানালেন কিন্তু বাধ সাধলেন রওশন বেগম!

— আমার আপত্তি আছে!

রওশন বেগমের দিকে সকলে অবাক চোখে তাকালো, কিন্তু আরোহী বিশেষ অবাক হয়নি কারণ ওর মনে এই সন্দেহটাই ছিলো!

— আরোহী, আমার মনে হয় না তোমার চাকরি করার প্রয়োজন আছে। তুমি বরং মনোযোগ দিয়ে পড়াটা কমপ্লিট করো

মায়ের কথা শুনে নীল ভরকে গেলো!

— মা, এটা তুমি কি বলছো? তুমি নিজেও তো একসময় জব করতে, কতজনকে ইন্সপায়ার করেছো তুমি জব করার জন্যে আর নিজের ছেলের বউকেই এখন জবের জন্যে মানা করছো?

— আমাদের সময়ের ব্যাপারটা আলাদা ছিলো নীল, একে তো তখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা স্বচ্ছল ছিলো না আর চাকরিটা আমি বিয়ের আগে থেকেই করছিলাম তাই আর ছাড়া হয়নি। আমরা এখন আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি, বাড়ির বউয়ের কোনো প্রয়োজন হলে সেটা মেটাতে তো সমস্যা নেই আমাদের

পাশ থেকে নিলাশা বলে উঠলো…

— মা, জব কি মানুষ শুধু টাকার জন্যে করে? নিজস্ব একটা পরিচয় তৈরির ব্যাপারও তো আছে তাইনা? এটা তো তুমিই আমাদের ছোটবেলায় শিখিয়েছো। আরোহী যদি চায় তবে করুক না জবটা

— আমাদের বংশের কোনো ছেলের বৌয়েরা কিন্তু এখন চাকরি করেনা তাহলে আমাদের বউয়ের কেনো করতে হবে? প্রয়োজন তো নেই

রওশন বেগমের কথা শুনে সকলে চমকে যাচ্ছে, একসময় যিনি নিজেই জবের বিষয়ে এত আগ্রহী ছিলেন সেই উনিই এখন এমন কথা বলছেন? আরোহী চুপ করে বসে ছিলো, নীল একনজর নিজের স্ত্রীর দিকে দেখে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের কথার ধরন আজ মোটেও ভালো লাগেনি ওর…

— মা! তুমি হঠাৎ এভাবে কেনো কথা বলছো যেনো আরোহী দোষের কিছু করতে চাইছে? আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো জবের বিষয়টা শুনলে খুশি হবে কিন্তু এভাবে রিয়েক্ট করবে ভাবিনি

— জানিস নীল, আমিও কোনোদিন ভাবিনি যে আমার ছেলে আমার অবাধ্য হবে। আসলে এমন অনেককিছুই জীবনে হয় যা আমাদের ভাবনার বাইরে থাকে

মা কোন বিষয়ে অবাধ্য হওয়ার কথা বলছে সেটা নীল ভালোভাবেই বুঝেছে, রওশন বেগম না আবার রেগে আরোহীকে কিছু বলে দেয় তাই মীর সাহেব স্ত্রীকে থামালেন

— আহহা! থামবে তুমি! ওরা কেউই ছোটো বাচ্চা না, নিজেদের ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয়েছে ওদের। এখনো কি আমাদের মর্জিমতো চলবে!

মীর সাহেবের কথা শুনে খাওয়া দ্রুত শেষ করে উঠে চলে গেলেন রওশন বেগম, খাবার টেবিলের পরিবেশটা হঠাৎই থমথমে হয়ে গেলো। এসব দেখে আরোহীর অনেক খারাপ লাগলো, মন খারাপ হয়ে গেলো মেয়েটার এবং নীল সেটা লক্ষ্য করেছে। মেয়েটাকে আর কোনরকম কষ্ট পেতে দেখতে মোটেও রাজি নয় নীল, মায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে পরে কথা বলবে বলে মনস্থির করলো নীল। সবার খাওয়া শেষে আরোহী সব গোছাতে শুরু করলো, নীল তখন ড্রইংরুমে বসা। একটু পরে নিলাশাকেও ওখানে এসে বসতে দেখেই নীল ভ্রু কুঁচকে তাকালো…

— আমার বউ একা একা সব গোচ্ছাচ্ছে আর তুই এখানে এসে আরাম করে বসলি কেনো? যা ওকে হেল্প কর!

— বাব্বাহ! বউয়ের এত্ত চিন্তা! হেল্প করতে গেছিলাম আমি কিন্তু তোর বউই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে, বললো তেমন কিছু করার নেই তাই আমিও চলে এলাম। তবে যাই বল, তোর বউ অনেক শান্ত। ভবিষ্যতেও মনে হয় না ওর এই অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আসবে। এমন মেয়ে পেলে তো ছেলেদের জীবন ধন্য হয়ে যাবে

— কার পছন্দ দেখতে হবেনা? আরোহীকে কেউ অপছন্দ করতেই পারবেনা

— কিন্তু নীল, আমার মনে হয় মা আরোহীকে তেমন একটা পছন্দ করেনা। আজ তোর মনে হলো না যে মা হঠাৎই কেমন রেগে গেলো? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে মায়ের রাগের কারণ বুঝলাম না

বিয়েতে জোর করে রাজি করানোর কারণেই আরোহীর প্রতি বিদ্বেষ জমেছে মায়ের মনে, এমনটাই মনে হচ্ছে নীলের তাই বোনের কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে বললো…

— আমি সবই বুঝেছি, কিন্তু মা যে আরোহীর ওপর এভাবে রাগ দেখাবে ভাবিনি। যাই হোক, আরোহী জন করবে। আমি পরে কথা বলে নেবো মায়ের সঙ্গে

— তুই চাইলে আমিও কথা বলতে পারি

— না আপু, আমিই বলবো। আরোহী প্রথমবার আমার কাছে একটা জিনিষ চেয়েছে, তাও দামী কিছু না শুধু জব করার অনুমতিটুকু চেয়েছে আর সেটা ও অবশ্যই পাবে। আমার তরফ থেকে যেকোনো বিষয়ে ফুল সাপোর্ট পাবে ও

আরোহীর প্রতি নীলের এতো টান, এতো বিশ্বাস দেখে নিলাশার যেনো মনটা ভরে গেলো। অবশ্য ছোটো থেকেই নীল যেভাবে বড় হয়েছে তাতে নিলাশার বিশ্বাস ছিলো যে ভবিষ্যতে ভাই তার অবশ্যই ভালো স্বামী হবে। দু ভাইবোন মিলে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলো, রান্নাঘরের কাজ শেষে দু ভাইবোনের আড্ডার মাঝে আর কাবাবে হাড্ডি হতে চায়নি আরোহী তাই চুপচাপ ঘরে চলে গেছিলো।

— আমরা গল্প করছিলাম দেখোনি?

— দেখেছিলাম, কিন্তু আপনাদের ভাইবোনের আড্ডায় আমার যোগ দেওয়াটা ভালো দেখাতো না তাই চলে এসেছি

— তুমি মন খারাপ করো না আরোহী, মায়ের সঙ্গে আমি কথা বলবো

— ইটস ওকে নীল! জব করাটা আমার জন্যে জরুরি নয়। আমি চাইনা মা আমার ওপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হোক আর আমার জন্যে আপনাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা তৈরি করবেন না প্লিজ

— কোনো ঝামেলা হবেনা, তুমি এসব নিয়ে না ভেবে নিজেকে জবের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত করো। তুমি অবশ্যই ইন্টারভিউ দেবে

আরোহী এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো, নীলের সঙ্গে আবার এই নিয়ে ওর মায়ের কোনো ঝামেলা তৈরি হবেনা তো!
__________________________________

আই. সি. ইউ থেকে এক পেসেন্টকে চেক করে সবে কেবিনে এলো নীল, দুদিন আগে লোকটার একটা সার্জারি করেছিলো নীল কিন্তু বয়স্ক রোগী হওয়ায় এখনও আই. সি. ইউতেই অ্যাডমিট রাখতে হয়েছে। রোগীর ফাইলটা বের করে আরেকবার চেক করে নিলো নীল, এরই মাঝে ওর কলিগ রানা এসে হাজির। নীল সচারাচর যেমন রঙের শার্ট পরে আজ তার থেকে কিছুটা আলাদা রঙের শার্ট পড়েছে দেখেই রানা বলে উঠলো…

— নাইস শার্ট!

ফাইল দেখতে দেখতেই মৃদু হেসে নীল জবাব দিলো…

— ওহ থ্যাংকস! তোর ভাবী গিফট করেছে

— ইশ! আজ একটা বউ নেই বলে কেউ এমন শার্ট গিফট করেনা রে। নাহ, এ বছর মনে হচ্ছে একটা বিয়ে করতেই হবে

— করে নে সমস্যা কি! আর তোর যদি ঘটক প্রয়োজন হয় তবে আমাকে বলিস, আমি মেয়ে খুজে দেবো

দুজন মিলে কিছুক্ষণ ঠাট্টা করলো এরই মাঝে রানার হঠাৎ মনে হলো আসল কথাই তো বলা হয়নি!

— ওহ হ্যাঁ, আসল কথা তো বলতেই ভুলে গেলাম।আই হ্যাভ অ্যা ব্যাড নিউজ ফর ইউ! মাত্র খবর পেলাম যে আমাদের শহরের রেপুটেড এক বিজনেসম্যানের হার্ট সার্জারি হবে আমাদের হসপিটালে। সেখানে ডাক্তার হিসেবে প্রথমে তোকে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছিল কিন্তু এখন আবার শুনলাম সেটা ডা. আরিয়ান করবে।

— সমস্যা কি, করুক না। তাছাড়া আমি আরেকজন পেশেন্টের কেস নেওয়ার কথা ভাবছি। এমনিতেও ওই বিজনেসম্যানের কেস হ্যান্ডেল করতে পারতাম না

— কিন্তু তুই ওর থেকে বেশি স্কিলড, একবার বোর্ডে কথা বলে দেখবি নাকি? সার্জারিটা তুই নিতে পারতি

— সব গুরুতর কেস যদি আমিই নিয়ে নেই তাহলে ডা. আরিয়ানের কি হবে? করুক না সার্জারি, খ্যাতি বাড়বে ওর আর এটাই তো শুরু থেকে ও চায়

আরিয়ান নীলের অপনেন্ট, সেই মেডিকেল কলেজ থেকেই ওদের দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে আসছে আর তা এখনও চলছে। সেই ক্লাসরুম হোক বা এই হসপিটাল, আরিয়ান সবসময় নীলকে হারানোর সুযোগ খুঁজে যায়। অনেক বড় বড় কেসও আরিয়ান নীলের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে যদিও সবগুলোতে সফল হতে পারেনি। মেডিকেল কলেজ অব্দি ঠিক ছিলো কিন্তু হসপিটালে রোগীদের নিয়ে প্রতিযোগিতার বিষয়টা বড্ড ছেলেমানুষী মনে হয় নীলের তাই আরিয়ানকে নিজের প্রতিযোগী ভাবা বন্ধ করে রোগীদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে নীল

চলবে…

#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১০

হসপিটালের ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার নেওয়ার সময় হঠাৎই নীলের দেখা হয়ে যায় নিজের কলিগ আরিয়ানের সঙ্গে! নীল যদিও আরিয়ানকে শুধু একজন কলিগ ভাবে কিন্তু আরিয়ান সবসময়ই নীলকে একজন প্রতিপক্ষ মনে করে। নীল খাবার নিয়ে যাচ্ছিল তখনই আরিয়ান ওর পথ আটকে দাঁড়ায়…

— হেই, ডা. ইশতিয়াক! আজকাল তো হসপিটাল শেষে আপনার দেখাই পাওয়া যায়না, বিয়ে করে নিলেন অথচ নিজের কম্পিটিটরকে ইনভাইটও করলেন না। কষ্ট পেয়েছি কিন্তু

— এতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কষ্ট পেলে চলবে নাকি এখন? যাই হোক, শুনলাম এবার বেশ নামি একজনের সার্জারি করতে যাচ্ছেন কনগ্রাচুলেশন!

আরিয়ান বেশ প্রাউড ফিল করলো!

— খবর পৌঁছে গেছে তাহলে আপনার কানে? ঠিকই শুনেছেন। কষ্ট পাবেন না, এতদিন তো অনেক কেস নিজেই হ্যান্ডেল করলেন এবার না হয় কিছুদিন রেস্ট করুন

— ইয়াহ শিওর! বাট আই হোপ, লাস্ট ইয়ারের ওই যে এক মহিলা পুলিশের সার্জারি করতে ব্লান্ডার করেছিলেন এবার সেটা করবেন না। সার্জারিতে যাওয়ার আগে ভালোভাবে পেসেন্ট ফাইলটা আরেকবার দেখে নেবেন, আপনি তো গতবার পেসেন্ট ফাইল ভালোমত না দেখেই…

কথাটা শুনে ভীষন রাগ হলো ডা. আরিয়ানের, গত বছর তার দোষেই ওটিতে এক রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে গেছিলো সেই কথাটাই নীল মনে করিয়ে দিলো। আরিয়ান নিজের রাগ সংযত রেখেই বললো…

— নিজেকে খুব পারফেক্ট সার্জন ভাবেন আপনি তাইনা ডা. ইশতিয়াক? আপনি কি ভাবেন, আপনি ব্যতীত আর কেউই পারফেক্ট সার্জারি করতে পারে না?

— কোনো মানুষই পারফেক্ট হয় না, ভুল মানুষ মাত্রই হয় কিন্তু ভুলটা স্বীকার করার ক্ষমতা থাকাও একটা বড় গুণ সেটা নিশ্চয়ই জানেন?

— পড়াশুনা নিয়ে প্রতিযোগিতা করাই যায় কিন্তু ডাক্তার হিসেবে রোগী নিয়ে প্রতিযোগিতা করাটা বোকামি ডা. আরিয়ান। লোকেরা আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসে সুস্থ হওয়ার জন্যে। তারা আমাদের পেসেন্ট, প্রতিযোগিতা করার বস্তু নয়

তখনই আরিয়ানের দরকারি ফোন এলো, ফোনে কথা বলেই নীলের দিকে তাকালো সে…

— ওহ, আই অ্যাম সরি ডা.! এ মুহূর্তে আপনার মোটিভিশনাল স্পিস শোনার সময় আমার নেই। আই হ্যাভ টু গো কিন্তু আপনার আমার সম্পর্কে যে ভুল ধারণা আছে সেটা এবার ভেঙেই যাবে। এই হসপিটালে সো কল্ড পারফেক্ট সার্জন হিসেবে আপনার যে সুনাম আছে সেটা আর থাকবেনা।

— ইয়াহ শিওর! বেস্ট অফ লাক

বরাবরই আরিয়ানের মাঝে নীলকে হারানোর জন্যে একটা জেদ কাজ করে, যদিও নীল কখনো নিজেকে আরিয়ানের এই তুচ্ছ প্রতিযোগিতায় সামিল করেনি কিন্তু কর্মজীবনে না চাইতেও প্রতিযোগী তৈরি হয়েই যায়!
_________________________________

নীলের বোন আজ নিজের বাড়ি ফিরবে, রাতে ফ্লাইট। নীল বোনকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাবে, আরোহীও সঙ্গে যেতে চাইলো। তো নীল ও আরোহী মিলে নীলাশাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এলো, রাত নয়টার ফ্লাইট। হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। নীল লক্ষ্য করলো আরোহী বেশ মন দিয়ে এদিক ওদিক দেখছে…

— এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?

— বরাবরই ছবিতে দেখে এসেছি কিন্তু আজ প্রথমবার এয়ারপোর্টের ভেতরের পরিবেশ দেখছি। খুব সুন্দর ভেতরটা

— হাতে একটু সময় পেলেই তোমাকে এরোপ্লেনের ভেতরটাও দেখিয়ে দেবো, ডোন্ট ওরি। এখন আসলে ছুটি নেওয়ার মতো সুযোগ পাচ্ছিনা

— এই না না, তার প্রয়োজন নেই। প্লেনে ওঠার সাহস আমার নেই

— আরে কেনো নয়! তেমন ভয়ের কিছু নেই। কখন ফ্লাই শুরু করবে আর ল্যান্ড করবে বুঝতেও পারবেনা! নীল, তুই বরং পারলে আমার বাসায় চলে যাস। আমার বাসায় বেড়িয়েও আসতে পারবি আর আরোহীকে নিয়ে ঘোরাও হয়ে যাবে

— ওকে, আই উইল ট্রাই। আচ্ছা, তোরা বস আমি কফি নিয়ে আসছি

নীল কফি আনতে গেলো, নিলাশা তখন আরোহীকে বললো…

— আরোহী, তোমার সঙ্গে সেভাবে সময়ই কাটাতে পারিনি। আর কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারলে খুব ভালো লাগতো, কিন্তু মেয়েটাকে রেখে এসেছি বলে নাহলে আর কিছুদিন থেকে যেতাম। আর এই নীলও এত তাড়াহুড়ো করে কেউ বিয়ে করে নাকি। একটাই ভাই আমার, তেমন ইনজয়ই করতে পারলাম না

— সরি আপু, আসলে আমিই ঘরোয়া আয়োজন চেয়েছিলাম তাই…

— আরে, তুমি সিরিয়াসলি নিলে নাকি? আমি তো মজা করে বলছিলাম, বিয়েটা যেভাবেই হোক যত কম আয়োজনেই হোক না কেনো আসল বিষয় হলো একসঙ্গে হ্যাপী থাকাটা আর নীল তোমাকে পেয়ে কতটা হ্যাপী সেটা ওকে দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারবে। দেখো আরোহী, আমি জানি নীল তোমাকে সকল খুশী দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে আর বড় বোন হিসেবে ছোটো ভাইয়ের জন্যে শুধু একটাই জিনিস তোমার কাছে চাওয়ার আছে। আমার ভাইকে অনেক অনেক ভালোবাসা দিও, ওর ওপর ভরসা রেখো সবসময় আর আমার মায়ের হয়ে আমি সরি বলছি

— না আপু, আমি মায়ের কথায় কিছু মনে করিনি। উনি যা বলার নিশ্চয়ই ভালোর জন্যেই বলেছেন

— উম্ম, আমি আসলে জানিনা আমার মা ঠিক কি ভেবে তোমাকে চাকরির জন্যে বাঁধা দিচ্ছে তবে তুমি চিন্তা করো না আমার ভাই মাকে মানিয়ে নেবে

দুই ভাইবোনই ভীষন সাপোর্টিভ, তারা আরোহীকে মোটিভেট করছে। প্রায় আধ ঘন্টা মতো ওরা এয়ারপোর্টে ছিলো এরপর নিলাশার টেক অফের সময় হয়ে যায়। ও যাওয়ার পর নীল আরোহীকে নিয়ে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, ড্রাইভ করার ফাঁকে নীল আরোহীকে জিজ্ঞাসা করলো…

— আমার অনুপস্থিতিতে আপু তোমাকে কি কি বললো?

আরোহী মজা করে বললো…

— অনেককিছু বলেছে, আপনার গোপন অনেক তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে

আরোহী মজা নিচ্ছে বুঝে হেসে উঠলো নীল..

— সরি ম্যাডাম, আমার জীবনটা একটা খোলা বইয়ের মতো। লুকানো কোনো রহস্য নেই তাই ফাঁস করবে এমন কোনো বিষয়ও নেই। তবুও তোমার যদি কোনোদিন আমাকে নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ জাগে তবে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করবে

— আপনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনে যা খুশি করুন আমার সমস্যা নেই

— ওহ রিয়েলী? ধরে নাও, আমি যদি তোমাকে লুকিয়ে অ্যাফেয়ার চালাই তাহলে? আমার অনেক সুন্দরী কলিগ আছে এন্ড দে অলসো লাইক মি

আরোহী মৃদু হাসলো…

— আমার মনে হয় না আপনি আমাকে ধোঁ’কা দেবেন

— ওহ রিয়েলী? এতো বিশ্বাস আমার ওপর?

— সুন্দরী কলিগদের কাউকে যদি আপনার মনে ধরতো আর তাদের কাউকেই আপনার বিয়ে করার ইচ্ছে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই আজ আপনার পাশের সিটে তাদের মধ্যে কেউ একজনই থাকতো!

আরোহীর কথাগুলো শুনে নীলের মনমেজাজ একদম ফুরফুরে হয়ে গেলো, এটাই তো চাইছিল নীল যে আরোহী ওর সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করুক। টুকটাক মজা করুক, নিজের মনের কথা বলুক। নীল বুঝেছে যে আরোহী মানসিকভাবে স্বস্তি পেলেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে আর ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সবকিছু করতে তৈরি সে! কিছু সময় বাদে নীল একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো আরোহীকে। ভেতরে এসে বসেই আরোহী জানতে চাইলো…

— আমরা তো বাড়ি ফিরছিলাম তাইনা? তাহলে এখানে কেনো এলাম?

— একটু আগে গাড়িতে তোমার কথা শুনে আমার মন খুশী হয়ে গেছে, আমার মিসেস আমাকে এত ভরসা করে! তাই ভাবলাম তোমাকে একটা ছোট্ট ট্রিট দেই, এমনিতেও ডিনার টাইম হয়ে গেছে

টেবিলের ওপর ছোট্ট গ্লাসে থাকা গোলাপটা দেখেই আরোহীর সন্দেহ হলো, কারণ অন্য কারো টেবিলে এটা নেই…

— আচ্ছা? কিন্তু আমার কেনো মনে যে আপনি আগে থেকেই সবটা অ্যারেঞ্জ করে রেখেছিলেন?

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরোহী, নীলও ভনিতা না করে স্বীকার করেই নিলো..

— অ্যাকচুয়ালি, ইউ আর রাইট! বিয়ের পর থেকেই কাজের চাপে আমি তোমাকে তেমন সময়ই দিতে পারছিনা, তাই ভাবলাম আজকে সময় সুযোগ দুটোই যখন পেয়েছি তাহলে সময়ের সদ্ব্যবহার করা যাক তাই ছোট্ট এই আয়োজন এন্ড দিস ইজ ফর ইউ!

নীল টেবিলের ওপর থাকা গোলাপটা আরোহীকে দিলো, আরোহীও হাসিমুখে সেটা গ্রহণ করলো। একটু পর ওয়েটার খাবার দিয়ে গেলো। দুজনে টুকটাক কথার ফাঁকে খাবার ইনজয় করছিলো। খেতে খেতে একপর্যায়ে নীল আরোহীকে জানালো যে রওশন বেগমের সঙ্গে আরোহীর জবের বিষয়ে কথা বলে নিয়েছে আর রওশন বেগম রাজিও হয়ে গেছে। এটা শুনেই আরোহী খাওয়া থামিয়ে দিলো, হন্তদন্ত হয়ে এত্তোগুলো প্রশ্ন করে বসলো…

— মায়ের সঙ্গে কখন কথা বললেন আপনি? আমায় তো কিছু বললেন না? মাকে কিভাবে রাজি করালেন? আপনি ওনাকে জোড় করেননি তো? দেখুন, চাকরি করাটা আমার জন্যে জরুরি নয় কিন্তু…

— হেই রিল্যাক্স! দম আটকে ফেলবে নাকি? আর সব প্রশ্ন একসঙ্গে করলে আমি উত্তর কিভাবে দেবো?

নীল এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো, কিন্তু আরোহী খেলো না। ও শোনার অপেক্ষায় আছে যে নীল ও তার মায়ের মধ্যে ঠিক কি কথা হয়েছে!

— বলুন না কি বলেছেন আপনি মাকে রাজি করানোর জন্যে?

— তুমি এত প্যানিক কেনো করছো যেনো খুব দোষের কিছু করতে যাচ্ছো?

— আমি মাকে অসন্তুষ্ট করতে চাইনা, নীল!
— অন্যের জন্যে নিজের ইচ্ছা স্বপ্ন কোনোদিন স্যাক্রিফাইস করবে না তুমি, কারো কথা ভাবার দরকার নেই। অন্যকে খুশী করতে গিয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়াটা সবচেয়ে বড় বোকামি

— কিন্তু মা চায় না যখন আমি কিভাবে ওনাকে অসন্তুষ্ট করে কাজে যাব? হ্যাঁ আমি পরিবারের আর্থিক সমস্যা মেটানোর জন্যে আর আমার ভাইয়ের ওপর থেকে চাপ কিছুটা কমানোর জন্য চাকরি করতে চাইছি, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি আপনার স্ত্রী আর আপনার মা বাবা কি চায় সেটা দেখাও আমার দায়িত্ব!

— নো, এটা তোমার ভুল ধারণা। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে আরোহী যেটা তোমার ইচ্ছা সেটা হাসিল করার চেষ্টা করবে। কে কি ভাবলো সেটা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। না আমার জন্যে না আমার পরিবারের জন্য, কারো জন্যেই নিজের চাওয়া অপূরণ রাখবেনা

— কিন্তু…

— অন্য কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই তোমার, কারো মন রক্ষার জন্যে কিছু করতে হবেনা। তুমি সেটাই করবে যেটা তোমার মন চাইবে আর তোমার যেকোনো সিদ্ধান্তে আমার সাপোর্ট থাকবে

আরোহী নিজের পরিবারে আর্থিক সাহায্য করতে চায় বিধায় চাকরি করাটা ওর জন্যে জরুরি আবার শাশুড়ির কথাও মাথায় ঘুরছে। কিন্তু নীল ওকে জব করার জন্য বলছে। ভীষণ দোটানায় পড়লো মেয়েটা, ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে ওদিকে রওশন বেগম তো আজ সারাদিন মন খারাপ করে ছিলেন। ছেলের তার বউয়ের এতো তরফদারী করছে বিষয়টা রওশন বেগমের মোটেই পছন্দ হচ্ছেনা

— আমার ছেলেটা এমন হয়ে যাবে আমি কল্পনাও করিনি, তুমি জানো আরোহীর জবের অনুমতি নেওয়ার জন্যে জন্যে নীল একপ্রকার আমাকে জোর করেছে। জোর করে রাজি করিয়েছে আমাকে। না জানি মেয়েটা আমার ছেলেকে কি করেছে

— তুমি জেদ না করলে নীলও এমন করতো না।

— আমি জেদ করছি?

— তাছাড়া আর কি? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করছো তুমি। দেখো, আমি জানি আরোহীকে তুমি পছন্দ করো না কিন্তু আমাদের ছেলের খুশির কথা তো ভাবো। খেয়াল করে দেখেছো নীল কতটা কেয়ার করে আরোহীর?

— সবই দেখছি আমি আর এটাও দেখছি যে ছেলে আমার কিভাবে আমার থেকে দূর হয়ে যাচ্ছে।

— অহেতুক ভাবনা তোমার, নীল আমাদের থেকে দূরে যাচ্ছেনা বরং স্বামী হিসেবে নিজের স্ত্রীর পাশে থাকছে। আমাদের এটা দেখে খুশি হওয়া উচিত যে আমরা ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিয়েছি। কিভাবে স্ত্রীকে সাপোর্ট করতে হয় সেটা ও শিখেছে। এই ইতিবাচক দিকগুলো না ভেবে তুমি উল্টোপাল্টা জিনিস ভাবছো!

স্ত্রীর এই অদ্ভুত আচরণে মীর সাহেবও বিরক্ত হচ্ছেন, উনি নীলের মাকে প্রথমে ভালোভাবেই বুঝিয়েছেন কিন্তু লাভ হয়নি উল্টে রওশন বেগমের মনে আরোহীর জন্যে আরো বেশি বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি হচ্ছে

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]