#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৩
নীলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার জন্যে বর্তমানে আরোহী নিজেকে পূর্বের তুলনায় অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে, সুযোগ পেলে নীলের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর একটা সুযোগও হাতছাড়া করেনা। নীল যেহেতু আরোহীকে কিছু জানায়নি তাই আরোহীও নীলকে কখনো বলেনি যে তানভীর ওকে সব বলে দিয়েছে। পড়াশুনা, চাকরি, সংসার সব মিলিয়ে আরোহী বর্তমানে এমন একটা স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছে যা ও বরাবর চেয়েছিলো। রওশন বেগম যদিও আরোহীকে এখনও পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি তবে পূর্বের তুলনায় উনি কিছুটা শান্ত হয়েছেন। এরই মধ্যে দেখতে দেখতে আশফেরর বিয়ের দিন চলে এসেছে, বরযাত্রীতে নীল ও নীলের বাবা এসেছেন। বরকে বরণ করা শেষে ভেতরে যাওয়ার পর মেয়েপক্ষের সঙ্গে পরিচয়পর্ব হলো, আরোহী ওর ভাইয়ের সঙ্গে স্টেজে ছিলো তখন লক্ষ্য করলো মেয়েপক্ষের কয়েকজন মেয়ে নীলের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে আবার লাইন ধরে কতগুলো মেয়ে ছবি তুলে নিয়ে গেলো। নীলও বেশ হেসে কথা বলছে, এসব দেখে আরোহীর বেশ রাগ হলো। আরোহী স্টেজ থেকে আসতেই যাচ্ছিলো তখন আশফের বললো..
— কোথায় যাচ্ছিস? বস, ছবি তুলবি না?
— আসছি ভাইয়া, তোমরা তুলতে থাকো
আরোহী স্টেজ থেকে নেমে এসে নীলের পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়েগুলোর দিকে চোখ গরম করে তাকালো, আরোহীর তাকানো দেখেই মেয়েগুলো দ্রুত সরে গেলো। নীল পেছনে ফিরে আরোহীকে দেখে বললো…
— ফটোশ্যুট হয়ে গেলো?
— না, বাকি আছে এখনও কিন্তু আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি আমি, কি এতো কথা বলছিলেন শুনি আর অচেনা মেয়েদের সঙ্গে এতো আলাপের কি আছে?
— আরে, মেয়ের বাড়ির আত্মীয় ওরা! আর আমি বরের বোনজামাই, কথা বলবো না?
— কথা বলতে বারণ করিনি, কিন্তু ছবি তোলার অনুমতি দেবেন? কতগুলো ছবি তুলে নিয়ে গেলো মেয়েগুলো
— মেয়েগুলোর কথা শুনে যা বুঝলাম তোমার মা সবার কাছে নিজের ডাক্তার জামাইয়ের গল্প করেছেন তাই ওরা আমার সঙ্গে ছবি তুলতে এতো আগ্রহী ছিলো। না করাটা খারাপ দেখায় তো
— ওহ! আচ্ছা বাদ দিন, আপনার সঙ্গে আমার সেভাবে কখনো ছবি তোলা হয়নি। আজ সময় সুযোগ দুটোই আছে, আসুন কিছু ছবি তুলে নেই
নীলকে নিয়ে আরোহী অনেকগুলো ছবি তুললো, মেয়েটা কেমন মুখ গোমড়া করে আছে। ছবি তোলা শেষে নীল মুচকি হেসে আরোহীকে টেনে নিয়ে একটু সাইডে এলো যেখানে মানুষ কম।
— আপনি আমায় এখানে নিয়ে এলেন কেনো? ওখানে সবাই আমাদের খুঁজবে তো
— আর ইউ জেলাস?
— জেলাস হওয়ার কি আছে!
আরোহী অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, নীল আরোহীর থুতনি ধরে মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বাঁকা হাসলো…
— অনেককিছুই আছে, তোমার এই অবস্থা দেখে তো এখন আমার চিন্তা হচ্ছে। হসপিটালে রোজ কতো পেসেন্ট, ইন্টার্ন আমার দিকে নজর দেয় জানো! এখন সবার থেকে কিভাবে নিজের হাজবেন্ডকে রক্ষা করবে?
— ওসব তো আর আমার চোখের সামনে হচ্ছেনা, আমার চোখের সামনে যখন হবে তখন অবশ্যই আমি আপনাকে রক্ষা করবো। সবাইকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেবো আপনি আমার হাসবেন্ড
নীল লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো, এইদিন দেখার জন্যে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে। অবশেষে আরোহী ওকে এতটা নিজের ভাবতে শুরু করেছে! নীল নিজের উৎসাহ সামাল দিতে না পেরে ওখানেই আরোহীর ঠোঁটে চু’মু দিয়ে দিলো। নীলের এমন কান্ডে আরোহী থ হয়ে গেলো…
— নীল?
— তুমি জানো তোমার এই রূপ দেখার জন্যে আমি কতদিন অপেক্ষা করেছি? তুমি আমাকে নিয়ে ভাববে, জেলাস ফিল করবে। আই অ্যাম সো সো হ্যাপি!
নীল দ্বিতীয় দফা চু’মু দেওয়ার জন্যে উদ্যত হতেই আরোহী বাঁধা দিলো, এদিক ওদিক দেখে বললো…
— নীল! ভ্যেনুভর্তি মানুষ, কেউ দেখে ফেললে!
— দেখলেই বা কি? খুব বেশি হলে অবাক হবে, লজ্জা পেয়ে চলে যাবে। আমরা কি করছি সেটা দেখার জন্যে কেউই দাড়িয়ে থাকবে না। সো, ডোন্ট ওরি!
— এটা আমাদের বাসা না, কতো বাইরের মানুষ আছে। আপনার না হলেও আমার লজ্জা লাগবে বুঝেছেন? এদিক ওদিক মেয়েদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে গিয়ে একটু কাজ করুন
আরোহীর কোমর জড়িয়ে ধরলো নীল…
— কাজই তো করছি, বউকে সময় দেওয়াটাই একজন বিবাহিত পুরুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ
নীলের স্পর্শ বরাবরই আরোহীকে দুর্বল করে দেয়, কিন্তু এখানে যে দুর্বল হলে চলবে না! তার ওপর নীলও এমনি এমনি ছাড়বে না বুঝে আরোহীই দ্বিতীয় চু’মু দিয়ে নীলের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনলো! স্তেজের কাছে আসতেই এক আন্টির সঙ্গে দেখা আরোহীর, উনি আরোহীদের প্রতিবেশী। বরযাত্রীতে এসেছেন। ভদ্রমহিলা আরোহীকে দেখেই বলে উঠলেন…
— এইতো আরোহী, কোথায় ছিলি! তোকেই তো খুঁজছিলাম। বাড়িতেও এখন তেমন আসিস না, দেখাও হয় না আমাদের
— আসলে এখন ব্যস্ততা এতো বেড়ে গেছে, বাড়িতে যাওয়ার সময় হয় না। কেমন আছেন আপনি?
— আমি তো ভালোই আছি। তুইও তো খুব ভালো আছিস মনে হচ্ছে। তোর বর কোথায় রে? এসেছে?
— হ্যাঁ এসেছে, ওদিকে আছে
— ওহ আচ্ছা। যাই বলিস আরোহী, তোর সোনায় বাঁধানো কপাল বলতে হবে, এখানে মানুষের একবার বিয়ে হচ্ছেনা আর তোর দুইবার বিয়ে হয়ে গেলো আর এবার তো ডাক্তার বর পেয়েছিস
ভদ্রমহিলা ভেবেছিলেন আরোহী বুঝি কোনো উত্তর দিতে পারবে না কিন্তু তাকে অবাক করে আরোহী মৃদু হেসে উত্তর দিলো…
— ঠিকই বলেছেন অ্যান্টি, আল্লাহর রহমত আছে বলতে হবে নাহলে আমার কঠিন সময়ে নীলের মতো কেউ জীবনে এসে আমার জীবনটা এমন রঙিন করে তুলবে সে তো কল্পনার বাইরে তাইনা?
ভদ্র মহিলা থ খেয়ে আর একটা কথা বললেন না। আগে এই ধরনের কথা শুনে রাগ হলেও এখন আর তেমন কিছু হয় না, নীল জীবনে আসার পর থেকেই নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবে আরোহী তাই এই কথাগুলোও এখন ইতিবাচকভাবে গ্রহন করতে শিখেছে ও।বিয়ে পড়ানো শেষে খাবার পর্বের কিছু সময় আগে নীলের হাসপাতাল থেকে ফোন আসে, কথা শেষ করেই নীল আরোহীকে ডাকে…
— আপনি এখনও দাড়িয়ে আছেন কেনো? চলুন সবাই খেতে বসবে, বাবাও আপনাকে খুঁজছে
— আরোহী, আমাকে আর্জেন্টলি হাসপাতালে যেতে হবে। একজন ইমারজেন্সি পেসেন্ট এসেছে, সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
— ঠিক আছে কিন্তু আপনি না খেয়েই চলে যাবেন?
— অতো সময় নেই এখন। তুমি বিয়ে ইনজয় করো আর তোমার মা আর আমার বাবাকে বলে দিও যে আমি যাচ্ছি, হাতে সময় নেই তাহলে আমিই বলে যেতাম
— সমস্যা নেই, আপনি যান। সাবধানে যাবেন
সেদিন হসপিটালে এক রোগী গুরুতর অবস্থায় এসেছিলো, পরিবারের ভাষ্যমতে হঠাৎই হার্ট এ্যাটাক হয়েছে কিন্তু রোগীর সার্বিক অবস্থা যাচাই করার পর নীলের এমন মনে হয়নি। রোগীর সমস্যা আগে থেকেই ছিলো আর ওই মুহূর্তে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিলো। তাই নীল নিজের টিমকে রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য নিজের পরিকল্পনা জানায় এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোয়। রাতে রোগীর অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেও সকালে অবস্থার অবনতি হয় এবং রোগী মা’রা যান। সঙ্গে সঙ্গে রোগীর বাড়ির লোকেরা অভিযোগ তোলে যে নীল ঠিকঠাক চিকিৎসা করেনি তাই এমন হয়েছে। এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়, রোগীর পরিবারের লোক পুলিশও ডাকে এবং হসপিটালের বিরুদ্ধে কেস করে। বিষয়টা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় এবং হাসপাতাল কতৃপক্ষ বাধ্য হয়ে মিটিং বসায়। এবার আদৌ কি নীলের পরিকল্পনা সফল না হওয়ায় রোগীর মৃ’ত্যু হয়েছে না অন্য কারণ ছিলো সেটা নিয়ে গবেষণা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। গত এক সপ্তাহ ধরে এইসব নিয়েই ঝামেলা হচ্ছে, আজকেও নীলকে হাসপাতালে ডেকেছিলো। মিটিং শেষে রুম থেকে বেরোতেই দরজার বাইরে আরিয়ানকে অপেক্ষারত অবস্থায় দেখে নীল হেসে বললো…
— মনে হচ্ছে, এবার আপনার প্রতিযোগিতা শেষ হবে ডা. আরিয়ান!
— এতো সহজেই না। আপনি আমাকে সবসময় ভালোমন্দের পাঠ পড়ান, ক্লাসমেট হওয়ার পরেও আপনি আমাকে একজন স্টুডেন্টের মত ট্রিট করেন। এত্তো জ্ঞান দেন।তাই আপনার দোষে রোগীর মৃ’ত্যু হয়েছে এটা আমার বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। ডোন্ট ওরি, এতো সহজে আমাদের শত্রুতা শেষ হবেনা।
বরাবরই নীলকে নিজের শত্রু ভেবে এসেছে আরিয়ান কিন্তু নীল কখনো কোনো রোগীর ক্ষতি করবে এটা শত্রু হয়েও ওর বিশ্বাস হয়নি। সরাসরি না হলেও বিভিন্ন কথার মাধ্যমে নীলকে সাহস দিয়েছে আরিয়ান। দুর্দিনে নিজের অপনেন্টের সাপোর্ট পেয়ে নীলও আরিয়ানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। হাসপাতালের ঝামেলা শেষে বাড়ি ফিরেই আরোহীকে চিন্তিত অবস্থায় পেলো…
— কি হলো ওখানে?
— বোর্ড বসেছিলো, আলোচনা হলো। এটা নিয়ে তদন্ত হবে। সত্য মিথ্যা যাচাই হলে এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তার আগে অব্দি আমি হসপিটালে জয়েন করতে পারবো না
— চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে
— আমি নিজের চিন্তা করি না আরোহী, প্রমাণ হয়েই যাবে আমার দোষ ছিলো না কিন্তু রোগীকে মে’রে ফেলার দায় আমার ওপর দেওয়া হচ্ছে সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। আর কিছুদিন আগে থেকে ট্রিটমেন্ট শুরু করলে হয়তো পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না
আরোহী নীলকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলো, গত এক সপ্তাহ ধরে চিন্তায় ছেলেটার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। আরোহীর ওকে এভাবে দেখে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, একটু পরে নীল বললো…
— তুমি কিছুদিন ধরে পড়তে বসছো না কেনো? তোমার না সামনে পরীক্ষা?
— পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছি না, অফিসে যেতেও ইচ্ছে করেনা। ওখানে গিয়েও কাজে মন দিতে পারিনা। আপনার ওখান থেকে কি সিদ্ধান্ত আসবে ভেবেই চিন্তা হচ্ছে। মনে হয় না আমি পরীক্ষা দিয়ে পাস করবো
— বোকা মেয়ে, তুমি কেনো এসব নিয়ে দুঃচিন্তা করছো? যা হবার হয়ে গেছে আর কয়েকদিনের একটা প্রোসেস এটা। সব প্রমাণ দেখেশুনে মিটিং শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এগুলো তোমার ভাবনার বিষয় নয়, তুমি কেনো আমার জন্যে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ন কর্মে অংশ নেবে না? এক্সাম না দিলে বছর গ্যাপ যাবে
— আমার জীবনে এখন আপনার চেয়ে গুরুত্তপূর্ণ আর কিছু নেই নীল, আপনি আমার চোখের সামনে এমন চিন্তিত দিনরাত কাটাচ্ছেন। আমার ভালো লাগছেনা! আপনার ডাক্তারির লাইসেন্সের কোনো ক্ষতি হবেনা তো?
— আমার জন্যে যে আপনার মনে এতো চিন্তা জানা ছিলো না তো, আমার লাইসেন্স চলে গেলে হয়ে গেলে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছো নাকি?
— আমি কোনোদিন কোনো মূল্যেই আপনাকে ছাড়বো না
আরোহী শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নীলকে, মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। নীল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, নীল নিজের দুর্বল দিকটা আরোহীর থেকে যতটা সম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করছে কারণ আরোহীর জীবনে ওই যে এখন শক্তির একমাত্র ভরকেন্দ্র!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]