#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৪
বাড়িতে বসে থাকলে নীল চিন্তিত থাকবে তাই আরোহী ভাবলো ওর মেজাজ ভালো করার জন্যে কিছু করা দরকার, নীলকে কিছুটা ব্যস্ত রাখার জন্যে আরোহী আবদার করলো যে পুরো একটা দিন বাইরে কোথাও গিয়ে কাটিয়ে আসবে। রাতে, নীল খুব মনোযোগ দিয়ে কোনো একটা বই পড়ছিল এখনই আরোহী এসে বায়না জুড়ে দিলো…
— নীল, চলুন আমরা কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি?
বইয়ের দিকে তাকিয়েই নীল উত্তর দিলো…
— এখন কোনো ঘুরাঘুরি চলবে না, তোমার এক্সাম চলছে। এমনিতেই তো জবের জন্যে পড়ার সময় পাওনা, অন্তত পরীক্ষার সময় তো ভালোভাবে পড়তে হবে
— পড়ছি তো আমি, আমি তো ব্যস্ত সময় পার করছি কিন্তু আপনি বাড়িতে বসে আছেন তাই ভাবলাম…
এবার বই থেকে চোখ তুলে আরোহীর দিকে তাকালো নীল…
— আরোহী, আমি জানি তুমি কেনো আমায় নিয়ে বাইরে যেতে চাইছো। আমাকে নিয়ে এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই, আই অ্যাম ফাইন। নতুন ভাবী এসেছে তোমার বাড়িতে। পরীক্ষা শেষে গিয়ে ও বাড়িতেও তো একটু ঘুরে এলেও পারো
— হ্যাঁ তো? নতুন ভাবী আমার ভাইয়ের সঙ্গে এখন সময় কাটাবে। আমি ওখানে গিয়ে কাবাবে হাড্ডি কেনো হবো? তাছাড়া এতদিনে আপনার সঙ্গে ভালোমত সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি, এটাকে আমি হাতছাড়া করবো না
— ঠিক আছে, তোমার আবদার পূরণ হবে তবে আজ নয়। আজকে ভালো মেয়ের মতো পড়তে বসবে, এক্সাম শেষ হোক তারপর দেখা যাবে। চলো, আজ তুমি পড়তে আর আমি তোমার সঙ্গে বসে থাকবো যাতে বোর ফিল না করো
আরোহী বাইরে যাওয়ার জন্যে অনেক অনুনয় করেছিলো কিন্তু নীল শুনলে তো! উল্টে নিজে আজ রাতভর বসে থেকে ওকে দিয়ে সব পড়া রিভাইস করিয়েছে। অনেকদিন গ্যাপে পরীক্ষা তাই বিশেষ অসুবিধা নেই, যেদিন পরীক্ষা থাকে সেদিন কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিয়ে নেয়। আরোহীর থার্ড ইয়ারের ফাইনাল চলছে, আজকেই শেষ পরীক্ষা। আরোহী তো পরীক্ষা দিতে চলে গেছে, নীল বাড়িতে। দুদিন পর হাসপাতাল থেকে ডাকবে এবং সিদ্ধান্ত জানাবে। বিকেলে মা বাবার সঙ্গে ড্রইংরুমে বসেছিলো নীল, তখন রওশন বেগম ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন…
— তোর হাসপাতাল থেকে কি বলেছে? এই সমস্যার সুরাহা হতে আর কতদিন লাগবে?
— এইতো পরশু ডাকবে, তবে আমার মনে হয় না খারাপ কোনো খবর আসবে। আশা করছি আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব
— এই দোয়াই তো করছি এখন। এতদিন ধরে এতো মানুষের চিকিৎসা করলো তার প্রতিদান হিসেবে আজ এই পাচ্ছে? মানুষ যে কেনো রোগীর কিছু হলেই আগে ডাক্তারকে দোষ দেয়, চিকিৎসা তারা আগে শুরু করেনি এটা তো তাদের দোষ ছিলো
মীর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন…
— এতো চিন্তা করো না তো। লোকের আর কি, দোষ দিয়ে দিতে পারলেই হলো অথচ একটা কর্মে সৎভাবে নিজের জায়গা তৈরি করা কতটা কঠিন সেটা একমাত্র সেই জানে যে করেছে। শোন নীল, যদি তোর হসপিটালের চাকরি চলে যায় চিন্তা করিস না। আমাদের বিজনেস জয়েন করে নিস
— এমন কিছু হবেনা বাবা, আমি কোনো অপরাধ করিনি যে আমাকে এতবড় শাস্তি দেওয়া হবে
— মন্দ কিছু না হলে তো হলোই, তারপরও বাবা হিসেবে তোকে এই বিষয়টা জানিয়ে রাখা আমার কর্তব্য। হাসপাতালের চাকরি না থাকলেও আমাদের ইনকাম সোর্স আছে
— বাবা, শুধু ইনকামের জন্যে মানুষ ডাক্তার হয় না তাছাড়া নিজের ওপর আর হসপিটাল কতৃপক্ষের ওপর ভরসা আছে আমার। খারাপ কিছু আপাতত ভাবতে চাইনা। যাই হোক, আমি একটু বেরোচ্ছি এখন
— এই সময় কোথায় যাচ্ছিস?
— আরোহীর পরীক্ষা শেষ হবে কিছুক্ষণ পরেই, বাড়িতেই বসে আছি তাই ভাবলাম ওকে নিয়ে আসি। আসছি আমি!
নীল বেরিয়ে গেলো, দিনদিন আরোহীর প্রতি ছেলের টান যেনো বেড়েই চলেছে যাতে রওশন বেগম অনেকটাই অবাক হন। নীল এমন ছিলো না, যে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেই পছন্দ করতো এমনকি ফাঁকা সময় পেলে পরিবারকেও বেশি সময় দিত না সেই ছেলে এতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে?
— এতকিছুর মাঝেও আরোহীর ছোটো ছোটো বিষয়ের কতো খেয়াল রাখে ছেলেটা
মীর সাহেব হেসে বললেন…
— আরোহী সঙ্গে আছে বলেই ছেলেটা আমাদের অনেকটা চিন্তামুক্ত আছে নাহলে তোমার কি মনে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও নীল এতো স্বাভাবিক থাকতে পারতো?
— অতশত আমি জানিনা তবে ছেলে আমার যার সঙ্গে ভালো থাকবে থাকুক, আমার তাতে আপত্তি নেই।
প্রথমেই কাউকে পছন্দ না হলে তাকে মন থেকে মেনে নেওয়াটা খুবই কঠিন, আরোহীর প্রতি রওশন বেগমের এখনও মনোভাব বদল হয়নি তবে ছেলের খুশির জন্যে আরোহীকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ওদিকে…আরোহীর পরীক্ষা শেষ হওয়ার মিনিট পনেরো আগে কলেজে গিয়ে হাজির হলো নীল। কিছুক্ষণ পর পরীক্ষা শেষ হলো, সকল শিক্ষার্থীরা বেরোচ্ছিল।সেই ভিড় ঠেলে মেইন গেইট পেরিয়ে বাইরে বেরোতেই নীলকে দাড়ানো দেখে অবাক হলো আরোহী, এক ছুটে নীলের কাছে এসে ওর হাত ধরে বললো…
— আপনি আসবেন আগে বললেন না কেনো?
— ভাবলাম তোমায় সারপ্রাইজ দেই, এক্সাম কেমন হলো?
— আপনি গতরাতে এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে দিয়ে সব রিভাইস করিয়েছেন, পরীক্ষা ভালো না হয়ে কি আর হলে আছে?
— গুড! তো ম্যাডাম, আজকে তো আপনার পরীক্ষা শেষ। এবার বলুন কি আবদার আছে
— উম্ম! চলুন আগে কিছু খাওয়া দাওয়া করি। এই চার ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে আমার বড্ড খিদে পেয়ে গেছে
— ওকে, কিন্তু তোমার বান্ধবীরা সব কোথায়? তোমার না শুনেছিলাম বান্ধবী আছে? এসেছিলাম যখন দেখা করে যেতাম
— আমার বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করার আপনার এতো ইচ্ছে কেনো শুনি? কোনো দরকার নেই দেখা করার, চলুন! আমাকে নাস্তা করাবেন
আরোহীর কথা শুনে হেসে ফেললো নীল, মেয়েটা ছোটখাটো বিষয়েই ভীষণ জেলাস হয়ে যায় আর ওকে জেলাস দেখতে নীলের অনেক ভালো লাগে। দুজনে মিলে হালকা নাস্তা করলো, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে কিন্তু আরোহী কাশবনে যাওয়ার আবদার করলো। আরোহীর কলেজ থেকে কাশবন কাছাকাছিই, নীল যেহেতু বলেছে আবদার পূরণ করবে তাই আরোহীর কথামত দুজনেই কাশবনে গেলো। যাওয়ার পথে এক ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে বেলিফুলের একটা মালা কিনে আরোহীর হাতে পরিয়ে দেয় নীল। যদিও এখন কাশবনে তেমন কাশফুল নেই তবে দর্শনার্থীর অভাব নেই। আরো অনেক কাপলই এসেছে, আবার অনেকে বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছে। নীল আরোহীর ছবি তুলবে বলে ঠিক করলো, কোথায় কিভাবে ছবি সুন্দর উঠবে সেটাও গাইড করলো আরোহীকে। আরোহী হেসে বললো…
— বাব্বাহ, আপনার তো ছবি তোলার বিষয়ে অনেক জ্ঞান আছে। ফটোগ্রাফার হতে পারতেন
— এখনও ফটোগ্রাফার হতে আপত্তি নেই, তবে সেটা শুধু তোমার জন্যে হতে পারি। তোমার ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার
নীল ভীষণ মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলছে, যেনো সবগুলো ছবি ও বাঁধিয়ে রাখবে। আরোহী নীলকে দেখছিলো, হঠাৎই ওর অতীতে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। অতীতের কথা মনে করলে বর্তমানের এই সুখের দিনগুলো কেমন স্বপ্ন মনে হয় আরোহীর। কি জানি কি হলো, মুহূর্তের মধ্যেই আরোহীর আঁখিজোড়া অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে গেলো। এটা লক্ষ্য করতেই দ্রুত এগিয়ে এসে নীল জিজ্ঞাসা করলো…
— কি হয়েছে?
আরোহী চোখ মুছতে মুছতে বললো…
— ক..কিছুনা, ওই চোখে কি যেনো পড়লো মনে হয়…
— চোখে হাত দিও না, আমাকে দেখতে দাও
নীল আরোহীর চোখ ফু দিয়ে দিচ্ছিলো, হুট করেই আরোহী ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। নীল প্রশ্ন করবে তার আগেই আরোহী বললো…
— এভাবেই কিছুক্ষণ থাকতে দিন
নীল কোনো প্রশ্ন করেনি, আরোহী বরাবরই কিছুটা আবেগী স্বভাবের ছিলো। ছোটো থেকেই চাইতো দুর্বল মুহূর্তে কেউ ওর পাশে থাকুক কিন্তু এমন কেউই ছিলো না। অবশেষে কাউকে পেয়েছে, নীলকে ভবিষ্যতে প্রতিটা সময় এভাবেই পাশে পেতে চায় মেয়েটা। সেদিন পুরো সন্ধ্যা ঘুরাঘুরি করলো ওরা, দুজনে মিলে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছে। কিছু সময়ের জন্যে হলেও সকল দুঃচিন্তা থেকে উভয়েই দূরে ছিলো, চড়াই – উৎরাই প্রতিটি মানুষের জীবনেই থাকে তার মাঝে কিছু সময় সব ভুলে নিজেদের সময় দেওয়ার চেষ্টা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]