ভালোবাসি তাই পর্ব-০৩

0
619

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩

লুৎফুন্নাহারের কথায় মলিন চোখে তাকালো আশা। লুৎফুন্নাহার সামান্য হেসে স্বাভাবিকভাবে উঠে দাড়ালো। তিনি আরেকটা চেয়ার টেনে আশার সামনে এসে বসলো। আশা তাকিয়ে আছে আন্টির দিকে। আন্টি বললো
“তোমার বাবার মতো আমার হাজবেন্ডও দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে।
আশা কিছু বললোনা। চুপচাপ শুধু শুনলো। আন্টি আবারও বললেন
“তোমার আঙ্কেলের সাথে আমার সংসার জীবন কেটেছে মাত্র নয় বছর। এ নয় বছরে আমি তিন সন্তানের মা হয়েছি। এতোটুকু বলে আন্টি থামলেন। আশা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে কথাগুলো। আন্টি আবারও বললেন
“আমার বড় ছেলে সাঈম, বিয়ে করেছে প্রায় দুই বছরের মতো হলো। ওর একটা ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে। কিছুদিন পরই এক বছর পূর্ণ হবে আমার নাতনির। মেয়ে আর বউকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে আমার ছেলে। ফ্ল্যাটটা ওর শশুড়ের দেওয়া।

আন্টি কয়েক সেকেন্ড থেমে আবারও বললেন
“আমার মেঝো মেয়ে সাইমা। রিলেশন করে বিয়ে করেছে এক বিজনেস ম্যানের ছেলেকে। ওদেরও একটা মেয়ে আছে তিন বছরের।
আশা এবার কথার মাঝে বাধ সেধে বললো
“আপু তো ছোট, তাহলে উনার বাচ্চা আপনার বড় ছেলের মেয়ের চেয়েও বড় কিভাবে হলো আন্টি?
আন্টি অমায়িক হেসে বললেন
“আমার ছেলের আগে মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
“ওহ।
“আমার মেয়েও তার হাজবেন্ডের সাথে ওদের নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকে। মেয়ে আর সংসার নিয়ে সুখেই আছে ওরা। আর বাকি রইলো আমার ছোট ছেলে সাদাত। আমরা সবাই আদর করে ওকে সাদ বলে ডাকি। ওর বয়স যখন দশ বছর তখন ওর উচ্চ শিক্ষার কথা ভেবে ওকে ওর মামা কানাডা নিয়ে যায়। ওর মামা, মানে আমার ছোট ভাইয়া ওখানকার নাগরিক। ফ্যামিলি নিয়েই থাকে ওখানে। আমার ছেলে যতদিন লেখাপড়া করেছিলো, ততদিন আমার ভাইয়ের বাসাতেই ছিলো।

আমি সামান্য খরচ পাঠাতাম এখান থেকে। ওর লেখাপড়া শেষ হয়েছে বছর খানেক আগে। এখন সেখানেই একটা ভালো জব করে। তাই এখন আর মামার বাসায় থাকেনা। আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। তিন চার বছর পর পর আসে, কিছুদিন থেকে আবারও চলে যায়।
আন্টি এবার থামলেন। আশা শান্ত গলায় বললো
“আঙ্কেলের কি হিয়েছিলো আন্টি?
আন্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এরপর আশার দিকে তাকিয়ে বললেন
“তেমন কিছুই না, ভালো, সুস্থ মানুষ ছিলেন। বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন দাওয়াত খেতে। সেখানেই স্ট্রোক করে বসেন হটাৎ। হসপিটাল পর্যন্ত নেওয়া যায় নি। এর আগেই…
এতোটুকু বলে আর কিছু বলতে পারলেন না আন্টি। কন্ঠ ভারী হয়ে এসেছে উনার। চোখদুটো বন্ধ করে বসে রইলেন তিনি। আশা খুব করে বুঝতে পারলো কথাগুলো বলতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পরেছেন তিনি।

কিন্তু ওর কৌতূহলী মনের কৌতূহল মিটলো না। কৌতূহল মেটাতে সে আবারও প্রশ্ন করলো
“তাহলে আপনি কিভাবে এতোটা দূর এলেন আন্টি? একা একা কিভাবে আপনার ছেলে মেয়েদের এতো বড় করলেন? আন্টি মুচকি হেসে বললেন
“তোমার তো দেখছি খুব আগ্রহ। তবে আগ্রহ থাকা ভালো।
আশা কিছুটা লজ্জাবোধ করলো আন্টির কথায়। আন্টি বললেন
“আমি এখন যে জবটা করি, সেটা তোমার আঙ্কেলের ছিলো। উনার মৃত্যুর পর সেখানকার কর্তৃপক্ষরা আমার দিক বিবেচনা করে আমাকে এই জবটা দিয়েছেন। অবশ্য এর পিছনে আমার বড় মামার অনেকটা অবদান আছে। উনিও এয়ার লাইন্সে জব করতেন। উনার বিশেষ চেষ্টাতেই এ জবটা পেয়েছিলাম আমি। যদিও তখন জব করার মতো মানসিকতা আমার ছিলোনা। এতোটুকু বলে আন্টি থেমে গেলেন।

শান্ত গলায় বললেন
“এখন তোমার রুমে যাও আশা, ঘুমাও গিয়ে। অনেক রাত হয়েছে। জার্নি করে এসেছো, আমারও অফিস আছে সকালে। আশা এক পলক দেয়াল ঘরিটার দিকে তাকালো, ১১:৫৫ বাজে। কথা বলতে বলতে কখন যে এতোটা রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি সে। আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো আশা। রাতটা কোনোরকমে পার করলো আশা। পুরোটা রাত ভয়ে ভয়ে পার করেছে সে। একেতো নতুন যায়গা, তার উপর সে একা। সামনের রুমটাও তালাবদ্ধ। আন্টি আর সে ছাড়া আর কেউ নেই বাসাতে। ভয়ের চোটে সারারাত এক মিনিটের জন্যও লাইটটা অফ করেনি আশা।

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাংলো ওর। ঘুম থেকে উঠেই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো আগে। এতোক্ষণে খিদে পেয়ে গেছে খুব। রান্না করে খাওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার। কিন্তু এতোটা সময় কি পেট মানবে? আশা ব্যাগ থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে নিচের দিকে যেতে লাগলো। এখানে আসার সময় দেখেছিলো আশা, বাসার সামনেই দু/চারটে মুদির দোকান রয়েছে। দোকানে গিয়ে সে একটা রুটি আর কলা কিনে নিয়ে আবারও ফেরত এলো বাসায়। রুমে ঢুকে কিনে আনা রুটি কলাটা খেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে সে। আহ, এবার শান্তি লাগছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সেটা অফ। সেই যে ভাইয়া ফোন অফ করে চার্জে বসিয়ে দিয়ে গেছিলো আর অন করা হয়নি। এতোক্ষণে আশার মাথায় এলো, ” ভাইয়া ঠিকমতো বাড়ি গিয়ে পৌছেছে তো?

তরিঘরি করে ফোনটা অন করলো আশা। ভাইয়ার নাম্বার মুখস্থই আছে। ডায়াল প্যাডে নাম্বারটা তুলে কল করল সাথে সাথে। রিং হওয়া মাত্রই ওপাশ থেকে কলটা কেটে দেওয়া হলো। এতে আরো বেশি দুশ্চিন্তায় পরে গেলো আশা। ভাইয়া কোনো বিপদে পড়ে নি তো? এইসব কথা চিন্তা করার ফাঁকেই ফোনটা বেজে উঠলো হটাৎ। তারাহুরো করে কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে একটা মধুর কন্ঠস্বর আশার কানে এলো।
“আশামনি!
আশা বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো
“ভাইয়া!
“হুম।
“চিনলে কি করে আমার নাম্বার?
আশার প্রশ্নে ফোনের ওপাশ থেকে হেসে উঠলো আদিব। আশা অবাক হয়ে বললো
“হাসছো কেন?
আদিব হাসিমুখে বললো
“হাসবো না তো কি করবো বল। হাসার মতো কথা বললে হাসি তো পাবেই।

আশার কপালে সামান্য ভাজ পরলো। কপাল ভাজ করা অবস্থাতেই বললো
“আমি এতো হাসার মতো কি বললাম ভাইয়া? আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি আমার নাম্বারটা চিনলে কি করে।
“সেটাই তো। তোর নাম্বার আমি চিনবো না তো কে চিনবে? আমিই তো তোকে নাম্বারটা দিয়ে এসেছি তাইনা, তো নাম্বারটা আমার ফোনে সেভ না করেই কি তোকে দিয়েছি?
আদিবের বলা কথা শুনে আশা ছোট্ট করে বললো
“ওহ। কি করছিস ভাইয়া?
“কিছুই না।
“কখন গিয়ে পৌছেছিস?
“আর বলিস না, বাড়ি পর্যন্ত আসতে আসতে রাত দুটো বেজেছে। সেই সাথে আমার পায়েরও বারোটা বেজেছে।

আশা আঁতকে উঠলো। উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
“কেন?
আমাদের স্টেশন পর্যন্ত যেতে কোনো অসুবিধে হয়নি, ঠিকঠাকই এসেছি। বিপত্তি হয়েছে পরে। আশা উদ্ধিগ্ন হয়ে বললো
“কি হয়েছে এরপর?
“কি আর হবে, অটো, রিক্সা কিছুই পাইনি। যেগুলো পেয়েছি সেগুলো এতো রাত করে আমাদের ওদিকটায় যাবে না। তার উপর নেমেছিলো বৃষ্টি। তো আর কি করা, বাড়ি তো যেতেই হবে। অবশেষে ধরলাম হাটা।
“হেটে গিয়েছিস বাড়ি পর্যন্ত?
“হুম। পনেরো মিনিটের রাস্তা পুরো এক ঘন্টা লেগেছে যেতে।
আশা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো
“মা কোথায়?
“মা তো বাড়িতে। আমি অন্য যায়গায় এসেছি।
“কখন যাবি বাড়িতে?
“মায়ের সাথে কথা বলবি?
“হুম।
“শোন, তোর হোয়াটসঅ্যাপ চালু করা আছে। আমিই চালু করে এসেছিলাম।। ডাটা টা অন রাখিস। আমিই কিছুক্ষণ পর কল করবো।
“আচ্ছা।
” কিছু খেয়েছিস?
“হুম রুটি কলা।
“রান্না করবিনা?
” রাধবো। কিছুক্ষণ পর।
“আচ্ছা, আমি এখন রাখছি আশামনি।
আশা সায় দিলো। এরই মাঝে টুট টুট শব্দ করে কেটে গেলো ফোনটা।

কলটা কাটার পর কিছুটা সময় মোবাইল হাতে নিয়েই বসে রইল সে। ভালো লাগছেনা ওর, মনটা খুবই খারাপ। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বাড়ি চলে যাক। যে লেখাপড়ার জন্য নিজের আপন মানুষদের ছেড়ে চলে আসতে হয়, কাছের মানুষদের ছেড়ে অনেক দূরে থাকতে হয়, সে লেখাপড়া দিয়ে কি হবে? কথাগুলো ভেবেই চোখদুটো ভিজে গেলো আশার। কতক্ষণ এভাবে ছিলো সে জানেনা। এক পর্যায়ে চোখদুটো মুছে উঠে দাড়ালো। রান্না করতে হবে, রুটি কলা খেয়ে তো আর সারা বেলা পার হবেনা। রেকটার সামনেই বাজারের ব্যাগটা রাখা। আশা বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিলো। ফ্লোরে পা বিছিয়ে বসে ব্যাগ থেকে কাঁচাবাজার গুলো বের করতে লাগলো এক এক করে। গতকাল ভাইয়া যেভাবে এনে দিয়ে গেছিলো এখনো ঠিক সেভাবেই রয়েছে। ব্যাগের ভেতর নানা ধরনের সব্জি রয়েছে। সাথে দুই হালি ডিম। এখন ঝামেলায় যেতে পারবেনা আশা। তাই দুটো ডিম বের করে নিলো। অমলেট করবে আর ভাত রান্না করবে।

রান্নাঘরে যাবার আগ মুহুর্তে কারো গলায় আওয়াজ পেলো আশা। এ আওয়াজ আন্টির নয়, কারণ উনি সকালেই অফিস চলে গিয়েছেন। বাকি রুমটাতেও আপাতত কেউ নেই। তাহলে কে কথা বলেছে? এতো হাসাহাসি কারা করছে? ওর কৌতুহলী মনের কৌতূহল মেটাতে ডিমের বাটিটা এক পাশে রেখে বাইরে বেরিয়ে গেলো আশা। তখনই দেখতে পেলো সামনের রুমটার সামনে দুটো মেয়ে দাড়ালো। একজন দরজার লক খুলছে আর বাকিজন ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়ে দুটির মধ্যে একজন প্রচন্ডরকম সুন্দরী। বেশ লম্বাও বটে। সাথের মেয়েটা ঈষৎ শ্যামবর্ণ। দরজাটা খোলা হলে মেয়েদুটো হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে পরলো। আশা বুঝতে পারলো, এরাই সেই দুটি মেয়ে, যাদের কথা আন্টি বলেছিলো।

আশা আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে চলে গেলো। ডিমের বাটিটা হাতে নিয়ে সে ঢুকলো রান্নাঘরে। এক চুলোয় ভাতের হাড়িটা বসিয়ে দিয়ে অন্য চুলায় সে ডিম ভাজতে লাগলো। ডিম ভাজা হয়ে গেলে সেটা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই কারো গায়ের সাথে ধাক্কা লাগলো আশার। তৎক্ষনাৎ ভাজা ডিমের কিছুটা ধাক্কার চোটে নিচে পরে গেলো। আশা অসহায়ের মতো তাকালো সামনে থাকা মানুষটির দিকে। সেই সুন্দরী মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে আশার সামনে। আশা হন্তদন্ত হয়ে বললো
“স্যরি, আমি আপনাকে দেখতে পাই নি।
সামনে থাকা মেয়েটি আশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এরপর আপাদমস্তক আশাকে দেখে বললো
“স্যরি বলার দরকার নেই, বরং স্যরিটা আমারই বলা উচিৎ ছিলো। আমার অসাবধানতার কারণেই তো তোমার ভাজা ডিমটা নিচে পরে গেলো। কিন্তু তুমি কে? তোমাকে তো চিনলাম না!

আশা নিজের রুমে ইশারা করে দেখিয়ে বললো
“আমি গতকাল ওই রুমটায় উঠেছি।
“ওহ স্টুডেন্ট?
“জি।
“আমিও স্টুডেন্ট।
আশা মুচকি হেসে বললো
“আমি জানি।
মেয়েটি বিস্ময় ভরা কন্ঠে প্রশ্ন করলো
“কিভাবে?
আশা মৃদু হেসে বললো
“আন্টি বলেছিলো।
“ওহ! যাক ভালোই হলো। আরেকটা সঙ্গী পেলাম। এমনিতেও আমার সাথে আমার অন্য এক ফ্রেন্ড থাকে, এখন থেকে আরো একটা ফ্রেন্ড হল। কি বলো!
“জি! মুচকি হেসে বললো আশা।
মেয়েটি আশার হাত ধরে বললো
“চলো তোমার রুমে যাই।
আশা তাতে সায় দিলো। মেয়েটিকে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে হাটের বাটিটা রেকে রেখে মেয়েটির দিকে তাকালো। বিনয়ের সাথে বিছানাটা দেখিয়ে বললো
“এখানে বসুন আপনি।

চলবে……