ভালোবাসি তাই পর্ব-০৪

0
602

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৪

হাতের বাটিটা রেকে রাখার পর মেয়েটির পাশে এসে বসলো আশা। মেয়েটির কথাবার্তার ধরণ একটু অন্যরকম। স্পষ্ট ভাষায় খানিক জোরে কথা বলে মেয়েটি। আশাকে স্পষ্ট গলায় মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো
“কোন ইয়ার তুমি?
” সবেমাত্র ভর্তি হলাম, ফার্স্ট ইয়ার।
মেয়েটি তৎক্ষনাৎ আফসোসের সাথে বললো
“ওহ! সো স্যাড।
আশা বিস্ময় নিয়ে বললো
“কি হলো?
“আমি তোমার এক বছরের সিনিয়র হয়ে গেলাম যে। আমি সেকেন্ড ইয়ার।
আশা মুচকি হেসে বললো
“তাতে কি, এক বছরের ডিস্টেন্স তেমন কিছুই না।।
“তা ঠিক, তবে আমাক যেনো আবারও আপু টাপু ডাকতে যেও না, নাম ধরে ডাকবা। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার নাম কি?
“আশামনি।
মেয়েটি মুচকি হেসে বললো
“সুন্দর নাম। আমার নাম নিয়াশা, আর আমার সাথে যে মেয়েটা থাকে তার নাম নিলা। ও আমার রুমমেট প্লাস ফ্রেন্ড। আশা ছোট্ট করে বললো
“ওহ!

নিয়াশা এবার উঠে দাঁড়ালো। চারপাশটা ভালো করে দেখে বললো
“বাহ, মাত্র একদিন হলো আসলে, কিন্তু রুমে তো দেখছি প্রায় সবকিছুই করে ফেলেছো।
“আমার কষ্ট হবে ভেবে এগুলো আমার ভাইয়া কিনে এনে দিয়ে গেছে সব।
“ওয়াও! তুমি তো খুব ভাগ্যবতী বোন। আশা মুচকি হাসলো নিয়াশার কথায়। নিয়াশা বললো
“আচ্ছা, আমি এবার রুমে যাই। পরে আসবো আবার। তুমি যেও একবার আমার রুমে।
আশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। দুপুরের খাওয়া শেষ করে লম্বা একটা ঘুম দিলো আশা। খুব ক্লান্তি লাগছিলো, ক্লান্তির চোটে ঘুম এসে চোখে হানা দিয়েছে। যখন ঘুম ভাংলো তখন বিকেল ৪:৫০ বাজে। বিছানা থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে ওয়াশরুমে গেলো আশা। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছে নিজের রুমে আর থাকলোনা। নিয়াশাদের রুমে গেলো। রুমে ঢুকেই ওর চোখ ছানাবড়া।

এ কোথায় থাকে ওরা? খাট, চকি বলতে কিছুই নেই। মেঝেতে বিছানা পাতা। এক পাশে দু তিনটে পাতিল, দুটো প্লেট আর গুটি কয়েক প্রয়োজনীয় জিনিস। দেওয়ালের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত এক লম্বা রশি বাধা। তাতে একটার উপর একটা কাপড় চাপা দিয়ে রাখা। কর্ণারে দুটো বড় ব্যাগ আর একটা বইয়ের টেবিল। একটা চেয়ার পর্যন্ত নেই। আশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিয়াশা কিছুটা জোরে চেচিয়ে বললো
“ওই মিস আশা, কি দেখো এভাবে?
আশা হেসে বললো
“নাহ, তেমন কিছু না।
আশা এগিয়ে গিয়ে বসলো তাদের পাশে। শ্যাম বর্ণের নীলা নামের মেয়েটি শুয়ে ছিলো এতোক্ষণ। আশাকে দেখে উঠে বসলো সে। সামান্য হেসে বললো
“হায় আশা, আমি নীলা।
আশা মৃদু হেসে বললো
“হায়।
নীলা বললো
” নিয়াশার কাছ থেকে শুনেছি আমি তোমার কথা। আমি গিয়েছিলাম, তুমি ঘুমিয়ে ছিলে তাই আর ডাকিনি।
“ওহ। আসলে ক্লান্ত লাগছিলো খুব।
নিয়াশা বললো
“তো ভার্সিটি যাচ্ছো কবে থেকে?
“আগামীকাল থেকেই যাব। এ জন্যই এসেছি তোমাদের কাছে। আমাকে তোমাদের সাথে করে নিয়ে যেও তো। নিয়াশা চট করে বললো
“তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে সমস্যা হলো অন্য যায়গায়।

সমস্যার কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠলো আশা। ঘাবড়ে গিয়ে বললো
“কি সমস্যা?
নিয়াশা লক্ষ্য করলো আশার চোখেমুখে আতংক। স্পষ্ট ভীতি কাজ করছে তার চোখেমুখে। তৎক্ষনাৎ সে জোরে হেসে উঠলো। আশা বোকার মতো তাকিয়ে রইলো সে হাসির দিকে। নিয়াশা হাসতে হাসতে বললো
“আরে বোকা মেয়ে, আমি ভার্সিটির কোনো সমস্যার কথা বলছিনা।
“তাহলে?
“এই যে তুমি আমার জুনিয়র, তাও আমি তোমাকে তুমি করে বলছি, যেখানে আমি নিজের ক্লাসমেটকেও তুমি করে ডাকিনা।
” এটা সমস্যা? বোকার মতো প্রশ্ন করলো আশা।
“হুম।
“তাহলে কি ডাকবা?
“তুই করে ডাকবো, মাইন্ড করবিনা তো? আর মাইন্ড করলেও কিছু করার নেই। আমার মুখ দিয়ে তুমি টা আসেনা।
আশা হেসে বলল
” ওহ এই কথা। এটা কোনো সমস্যাই না। তোমার যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই ডেকো আমাকে৷ আমি মোটেও মাইন্ড করবো না।
আশার কথা শেষ হলে তিনজনই সমস্বরে হেসে উঠে উঠলো। এরপর অনেক্ষণ যাবৎ গল্পগুজব করলো একসাথে বসে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের মধ্যে খুব ভাব জমে গেলো। খুব সহজেই ওদের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলো আশা।

পরেরদিন সকালের খাওয়া সেড়ে নিজেকে পরিপাটি করে তৈরি করে নিলো আশা। আজ তার প্রথম ক্লাস। সাইড ব্যাগে একটা খাতা, একটা কলম আর একটা পাতলা বই ঢুকিয়ে নেয় কোনোরকম। যদিও প্রথম দিনে কোনো ক্লাস হবে কিনা সে জানেনা। আর ক্লাস হলেও বা কি বিষয়ে হবে সেটাও জানা নেই। সবকিছু ঠিকঠাক হলে রুমটাকে তালাবদ্ধ করে নিয়াশার রুমের দিকে পা বাড়ায় আশা। ওদের সাথে সে যাবে। কিন্তু ওদের রুমের সামনে গিয়েই থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলো আশা। এ কি এলাহি কান্ড। নিয়াশা আর নীলাকে দেখে মনে হচ্ছে, ওরা ভার্সিটিতে নয়, বরং কোনো বিয়ে বাড়িতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা বিস্ময়কর গলায় বললো
“তোমরা ভার্সিটিতেই যাবে তো?
নিয়াশা হেসে বললো
“কেন, কোনো সন্দেহ আছে?
আশা মুচকি হেসে বললো
“নাহ তো।

নিয়াশা আর নীলার সাজগোছ কমপ্লিট হলে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ওরা। একটা ভালো লাগা কাজ করছে ওর মনে। সেই সাথে কিছুটা ভয়ও বিরাজ করছে। কিন্তু সমস্ত ভয়কে একপাশে রেখে অবশেষে গিয়ে পৌছুলো ওর স্বপ্নের রাজ্যে। এখানে সে এর আগেই এসেছে ভাইয়ার সাথে। কিন্তু আজ মনের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে।
ক্যাম্পাসে ঢুকেই নিয়াশা বললো
“তোকে তোর ক্লাসরুমে দিয়ে আসব? কোন ডিপার্টমেন্ট তোর?
আশা হেসে বললো
“ম্যানেজমেন্ট। তবে আমাকে দিয়ে আসার দরকার নেই। আমি চিনি আমার ক্লাসরুম, ভাইয়ার সাথে এসেছিলাম যে। তোমরা বরং আমার ফোন নাম্বারটা নাও। বাসায় যাবার সময় আমাকে নিয়ে যেও। নিয়াশা আশার কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে চলে গেলো নিজের ক্লাসে।

ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। বাসায় এসে প্রথমেই বাথরুমে ঢুকেছে আশা। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে সকালে রান্না করে রেখে যাওয়া ভাত তরকারি খেয়ে নিলো পেট ভরে। খাওয়া শেষে কিছুটা সময় বিশ্রামের উদ্দেশ্যে শুয়ে পরলো বিছানায়। বিশ্রাম নেওয়ার এক ফাঁকে কখন যে চোখটা লেগে গেছে বুঝতে পারেনি আশা। যখন ঘুম ভাংলো তখন সময় দেখে চোখ ছানাবড়া। তারাহুরো করে সে উঠে গেলো বিছানা থেকে। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে কিছুটা পানি ছিটিয়ে সে রুমে ফিরে এলো। রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিতেই সে দেখতে পেলো নীলা আর নিয়াশা রান্না করছে। আশা উৎসুক কন্ঠে বললো
“কি রান্না করো?
“ডাল আর আলু সেদ্ধ, ভর্তা করবো। তুই রাধবিনা?
“হুম, তরকারি রান্না করাই আছে। শুধু ভাত রান্না করা লাগবে। কথাটা বলেই রুমে চলে এলো আশা। ভাতের হাড়িতে চাল নিয়ে ভালো করে ধুয়ে বসিয়ে দিলো চুলোয়।

ভাতটা চুলোয় বসিয়ে দিয়ে আশা ফিরে আসে রুমে। মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে বসে পরলো বই নিয়ে। এমন সময় ফোনের রিংটোন টা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখে একটা মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠলো আশার মুখে। ভাইয়া ভিডিও তে কল করেছে। কলটা রিসিভ করতেই ভাইয়ার হাসিমুখটা ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। হাসি হাসি মুখে আদিব বললো
“আশামনি! কি করিস?
আশা সামান্য হেসে বললো
” কিছু করিনা ভাইয়া। কি করিস তুই?
“আমি বাড়ি আসলাম মাত্র।
আদিবের কথায় সামান্য অবাক হলো আশা। বিস্ময়ে বললো
“এতো তারাতারি দোকান বন্ধ করে চলে এসেছিস আজ!!
“হু, ভালো লাগছেনা আজ।
“কেন? অসুখ বাধিয়েছিস নাকি?

আদিব হেসে বললো
“আরে পাগলী, আমি ঠিক আছি। কোনো অসুখ টসুখ হয়নি। এমনিতেই ভালো লাগছিলোনা।
“ওহ, মা কোথায়?.
“রান্না করে। কথা বলবি?
“হুম।

বেশ কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা হলো আশার। এর মধ্যে ভাতও ফুটতে শুরু করেছে। অবশেষে মা ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলটা কেটে দিলো আশা। এখন অনেকটা ভালো লাগছে আশার। মুডটাও ভালো হয়ে গেছে। ভাত নিয়ে রুমে ফেরার সময় বাড়িওয়ালা আন্টিকে দেখতে পেলো সে। হাসিমুখে বললো
“অফিস থেকে কখন এলেন আন্টি?
আন্টি অমায়িক কন্ঠে বললেন
“এইতো, কিছুক্ষণ হলো। কি রান্না করলে?
“ভাত রেধেছি আন্টি, আর সকালের তরকারি রান্না ছিলো সেটা গরম করেছি।
আরো দুই একটা কথা বিনিময় করে রুমে চলে এলো আশা। ভাতের হাড়িটা রেকে রেখে আবারও পড়ায় মন দেয় সে।

এর মাঝে কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন। অনবরত ভাবে দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে। আশাও নিজেকে সকলের সাথে মানানসই করে নিয়েছে সকলের সাথে। ভার্সিটিতেও ওর অনেক বন্ধু হয়ে উঠেছে। তবে আশার কথাবার্তা যথেষ্ট শীতল, নম্র প্রকৃতির মেয়ে ও। তাই বন্ধুতের সাথে সে বিশেষ একটা লিমিট রেখেই চলাফেরা করে। আজও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আশা। রান্নাবান্না সেড়ে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির জন্য তৈরি হয়। এরই মধ্যে নিয়াশা আসে ওর রুমে। নিয়াশাকে দেখে আশা কপালে কিছুটা ভাজ এনে বলে
“তুমি রেডি হওনি দেখছি, যাবেনা আজ?
“নাহ রে, আজ যেতে ইচ্ছে করছেনা। তুই চলে যা।
“ওহ! নীলা যাবেনা?
নিয়াশা তীক্ষ্ণ গলায় বললো
“আমি ছাড়া ও কখনো গিয়েছে আজ পর্যন্ত। পরগাছা কোথাকার।

আশা হাসলো নিয়াশার কথায়। এরপর হাসি থামিয়ে বললো
“আচ্ছা, তাহলে আজ আমি একাই যাই নাহয়। খেয়াল রেখো নিজের।
নিয়াশা ভ্রু বাকিয়ে বললো
“বাহ রে, তোর কথায় মনে হচ্ছে তুই আমার অভিভাবক আর আমি তোর বাচ্চাকাচ্চা। যেভাবে খেয়াল রাখার কথা বলছিস। আশা আবারও হেসে বললো
“তোমার সাথে কথায় আমি পারবোনা গো। আমি বরং গেলাম।
“হ্যা যা, তবে আমাদের কথা চিন্তা না করে নিজের খেয়াল রাখিস।
আশা মুচকি হেসে সায় জানালো।

ক্লাস শেষ হলে প্রতিদিনের মতো আজও বাসার উদ্দেশ্য রওনা করলো আশা। অন্যদিনের চেয়ে আজকের পরিবেশটা একটু অন্যরকম। আকাশটা মেঘে ঢাকা, মনে হচ্ছে যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে।আশা সেই কখন থেকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, রিক্সার খোঁজ করছে সে। তবে কেন জানি আজ কোনো রিক্সার দেখা সে পাচ্ছে না। এক পর্যায়ে হাঁটতে শুরু করলো সে। এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। আর কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হবে নির্ঘাত । শেষে আরেক বিপদ হবে। আশা আপনমনেই হাঁটতে লাগলো। আশেপাশে আরো অনেকেই হাঁটছে। আশার নজর সামনে। আচমকায় একটা মোটর বাইক এসে থামলো আশার সামনে। এতে কিছুটা হতচকিত হলো আশা। সামান্য বিরক্তি নিয়ে সামনে বাইকে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো সে। ঝাঝ দেখিয়ে বললো
“কোনো সেন্স নেই আপনার? এভাবে কেউ এসে ব্রেক কষে? এখন যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো তাহলে কি তার দায়ভার আপনি নিতেন?

সামনে বাইকে বসা ছেলেটা হা করে তাকিয়ে আছে আশার মুখের দিকে। এতোক্ষণে সে বললো
“কোনো দুর্ঘটনায় ঘটতো না লেডি। আমি ইচ্ছে করেই তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি৷
“মানে?
“ছেলেটা বাইক থেকে নামলো। গুন্ডা টাইপের একটা ছেলে। হাতে কিসের একটা সুতো বাধা, গলায় লম্বা একটা চেইন, এক কানে টপ রয়েছে। ছেলেটাকে বাইক থেকে নামতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো আশা। একে তো দিনের অবস্থা ভালো না, তার উপর আজ সে সম্পুর্নই একা। আশা কিছুটা পিছিয়ে গেলো। ছেলেটা একটা রহস্যময় হাসি হেসে বললো
“এভাবে পিছিও না সুন্দরী, বুকে লাগে ভীষণ।

আশার প্রচন্ড রাগ লাগছে, ভয়ও করছে কিছুটা। রাগ আর ভয় মিশ্রিত গলায় আশা বললো
“কে আপনি?
ছেলেটি হাসলো আবারও। আশার একদম কাছাকাছি এসে মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো
“তোমার দিলওয়ালা।

চলবে……