#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৫
আশা হকচকিয়ে গেলো ছেলেটির মুখে এমন কথা শুনে। পরক্ষণেই নিজেকে একটু সামলে ছেলেটির দিকে বাকা দৃষ্টিতে তাকায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির ঠোঁটের কোনে এখনো বাকা হাসি ঝুলে আছে। আশা আর কিছু বললো না। ছেলেটিকে পাস কাটিয়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগলো হনহন করে। ছেলেটি এখনো স্থির দাঁড়িয়ে থেকে হাসছে। আশা ছুটে যাবার এক পর্যায়ে পিছন ফিরে তাকালো, ছেলেটি ওর পিছু পিছু আসছে কিনা সেটা দেখার জন্য। যখন দেখলো ছেলেটি নিজ যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তখন স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে আবার সমান তালে সামনে হাঁটতে লাগলো। ছেলেটা এবার জোরে বলে উঠলো
“পালিয়ে কোথায় যাবে লেডি? আমিতো তোমায় ধাওয়া করবোনা, এমনিতেই তুমি আমার সামনে এসে পড়বে। আসা যাওয়া তো তোমাকে এ রাস্তাতেই করতে হবে।
কথাটা বলে আবারও বাকাভাবে হাসলো ছেলেটা।আশা সে কথার কর্ণপাত করলো না, তীরের ফলার মতো তীব্র গতিতে সে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
এভাবে কতোটা সময় সে হেঁটেছে তার জানা নেই। একটা সময় বাসার সামনে চলে আসে আশা। বাসার সামনে একটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা অবাক হলো আশা, আন্টির কোনো গাড়ি নেই। আর নিচতলায় যারা ভাড়া আছেন তারা এতোটাও সামর্থ্যবান নয়। এছাড়া সচরাচর এ বাসার সামনে কোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও নি আশা। এইসব ভাবতে ভাবতেই বাসার ভিতরে ঢুকে সে। সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই সর্বপ্রথম চোখে পরে আন্টির রুম। সে খেয়াল করলো আন্টির রুমের সামনে অনেকগুলো জুতা। আর রুমের ভেতর থেকেও অনেকগুলো গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। আশা ভাবলো, বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা আন্টির রুমে আসা গেস্টদেরই হবে। আশা ওর ব্যাগের সাইড পকেট থেকে রুমের চাবিটা বের করতে করতে রুমের সামনে গেলো।
চাবিটা হাতে নিয়ে দরজায় ঝুলে থাকা তালাটার দিকে হাত বাড়াতেই থমকে গেলো আশা।
একি, তালা কোথায়! রুমে তো তালা লাগানো নেই। আশা কপালে ভাজ এনে আশেপাশে তাকালো। দেখলো কিছুটা দুরেই ওর রুমের তালাটা ভাঙ্গা অবস্থায় পরে আছে। মেজাজটাই বিগড়ে গেলো হটাৎ। কে এমন মজা করলো? আর এটা কি ধরণেরই বা মজা?
এতোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আবছা আলোয় আশা খেয়াল করলো দরজাটা ভিড়ানো। আশা রেগে কটমট করতে করতে খুব জোরে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ঢুকেই থ মেরে গেলো সে। একটা ছেলে ওর বিছানায় শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে পরম নিশ্চিন্তে নিজেরই রুমে সে ঘুমিয়ে আছে। ভালো করে মুখটাও দেখা যাচ্ছেনা। এভাবে একটা ছেলেকে নিজের রুমে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভয় কাজ করলো মনে। কে হতে পারে ছেলেটা, চোর টোর নয়তো?
আশা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ভয়মিশ্রিত গলায় বললো
“কে! কে আপনি?
কোনো উত্তর এলোনা।। আশা তারাতাড়ি করে সুইচবোর্ডের কাছে এগিয়ে গেলো। লাইটের সুইচটা তারাতাড়ি করে টেপলো সে। কিন্তু কপাল খারাপ, বিদ্যুৎ নেই। আশা আবারও ভয়ার্ত গলায় বললো
“কে আপনি? কথা বলছেন না কেন?
এতোক্ষণে ছেলেটা কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম ঘুম গলায় বললো
“প্লিজ আম্মু, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
আশা হতচকিত হলো ছেলেটির কথায়। সামান্য রেগে গিয়ে বললো
“আম্মু মানে, কে আপনার আম্মু? আপনিই বা কে? উঠুন বলছি। কথাটা বলে মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো আশা। হাতে থাকা ব্যাগটা দিয়ে ধুম করে ছেলেটির গায়ে বসিয়ে দিলো সে। ছেলেটি ধরমর করে উঠে বসলো বিছানায়।
ঘুম মিশ্রিত চোখে আশার দিকে তাকালো। সামান্য অবাক হয়ে বললো
“হু আর ইউ?
আশা পালটা প্রশ্ন করে বললো
“কে আপনি?
ছেলেটি হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো
“আমি কে মানে, এ বাসাটা তো আমারই।
আশা অবাক হলো, এ কি বলে ছেলে! আশার মাথায় বার বার ঘুরতে লাগলো, এটা কোনো চোরই হবে। কারণ চোরেরাই সাধারণত পরের জিনিসকে নিজের জিনিস বলে দাবি করে। তার মানে, এই ছেলে নিশ্চিত কোনো চোর।
ভাবনাটা মনে উদয় হতেই প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার করলো আশা।
“আন্টি চোর…
চোর কথাটা কানে আসতেই ছেলেটি দিকদিশা হারিয়ে হুরমুর করে বিছানা থেকে নামলো।
আশা এখনো চিৎকার করেই যাচ্ছে। ছেলেটি তারাতাড়ি করে আশার মুখটা নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো
“এই মেয়ে, করছোটা কি? থামো বলছি।
আশা এখনো ছেলেটির হাতের মুঠোয় বন্দি। সে দুহাতে অনেক কষ্ট করে নিজেকে ছেলেটির হাতের বাধন থেকে সরালো। এতোক্ষণে সে হাপিয়ে উঠেছে।
ছেলেটি এবার আশার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালো। মৃদু গলায় বললো
“আমি কোনো চোর নয়, চোর চোর করে চেচাচ্ছো কেন?
“চোর না হলে আপনি আমার রুমে কি করছেন?
“তোমার রুম! বিস্মিত গলায় বললো ছেলেটি। এরপর আবারও বললো
“কিন্তু আমিতো জানি এই বাসার পুরোটায় আমাদের।
“আপনাদের বাসা মানে? মজা করছেন? এটা আন্টির বাসা।
আশার কথা শেষ হওয়া মাত্রই বিদ্যুৎ চলে আসলো। আশার নজর গেলো ছেলেটার দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক দেখলো সে। যথেষ্ট লম্বাসহ বেশ সুদর্শন দেখতে ছেলেটা।
আচ্ছা, চোরেরা কি কখনো এতো সুন্দর হয়? ভাবতে লাগলো আশা। এসব ভাবার এক ফাঁকেই পাশের রুম থেকে দৌড়ে এলো আন্টি। হন্তদন্ত হয়ে তিনি বললেন
“চোর কোথায় আশা? এই সন্ধ্যেতে আবার চোর এলো কোত্থেকে?
আশা সামনে থাকা ছেলেটির দিকে আঙ্গুল তাক করে বললো
“এই যে চোর।
আন্টি বিস্ফোরিত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে খানিক অবাক হয়ে বিস্ময় ভরা গলায় বললেন
“তুই চোর? আসতে না আসতেই কি চুরি করে বসলি মেয়েটার রুম থেকে? তোর তো এ অভ্যাস ছিলো না রে সাদ!!
আন্টির মুখে সাদ নামটা শুনে বিষম খেলো আশা। মানে, এটা আন্টির সেই ছেলে যে বিদেশ থাকে?
সাদাত মুখ বাকিয়ে মাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। বললো
“আম্মু, শেষে তুমিও আমাকে চোর বলছো।
সাদাতের কথায় মা হেসে বললো
“মজা করছিলাম বাবা, এই রুমে এমন কিছু নেই যেটা তোর লাগবে। আর লাগলেও তুই যে চুরি করার মতো ঘৃণিত কাজটা করবিনা সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেনা। কিন্তু তুই এখানে কি করছিস?
“ঘুমাচ্ছিলাম।
“এখানে? কিভাবে ঢুকলি রুমে?
“সিম্পল, তালা ভেঙ্গে।
মা ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো
“ওদিকে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে দেখা করার জন্য, আর তুই এখানে আরেক জনের রুমের তালা ভেঙ্গে ঘুমাচ্ছিস? এখন তো মনে হচ্ছে আশা তোকে চোর বলে ঠিকই করেছে।
সাদ আশার দিকে আড়চোখে তাকালো। একনজর দেখে আবারও মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো
” কি করবো আম্মু, ঘুম পাচ্ছিলো খুব। ওখানে কি ওরা আমাকে ঘুমাতে দিতো বলো। অনেক খুজে ঘুমাবার মতো এ রুমটাই পেয়েছি।
“পাগল ছেলে, আয় রুমে আয়। সবাই বসে আছে তোর জন্য।
আশা বোকার মতো তাকিয়ে থেকে মা ছেলের কথা শুনছে। আন্টি চলে যাবার পর সাদাতও চলে যেতে নিয়েও আবার ঘুরে দাড়ালো। আরেক ঝলক আশাকে দেখে মৃদু গলায় বললো
“বাই দ্যা ওয়ে, ইউ আর সো কিউট।
আশা কপাল বাকালো, সাদ মুচকি হেসে চলে গেলো নিজের ঘরে।
সাদ চলে যাবার পরপরই আশার মাথায় খেলে উঠল কথাটা। কি বলে গেলেন উনি? পরক্ষণেই মাথা থেকে এইসব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো সে।
পড়া শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় পরের দিন অনেক বেলা হয়ে যাওয়ার পরও ঘুম ভাঙ্গেনি আশার। প্রায় নয়টার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আশার। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠে দরজাটা খুলে দিয়ে আবারও শুয়ে পরে সে। পেছন থেকে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে নিয়াশা। বিছানার এক প্রান্তে বসে খুব খুশি মনে বলে
“ওই আশা, ঘুমিয়ে গেলি নাকি আবার। উঠ কথা আছে।
আশা ঘুম ঘুম গলায় বললো
“উমমম!! কি বলবে বলো?
“আরে, উঠে বস না আগে। তুই তো এতো ঘুমাস না কখনো, আজ কি গাঞ্জা খেয়ে ঘুমিয়েছিলি নাকি?
আশা এবার উঠে বসলো। ধীরে সুস্থে শান্ত গলায় বললো
“গাঞ্জা খাইনি, পড়েছিলাম অনেক রাত অব্দি। আর আজ তো অফ ডে, তাই কোনো তারাহুরো নেই। এবার কি বলবে বলো…
নিয়াশা সামান্য লাজুক হাসি হাসলো। বললো
“আমি তো মরে গেলাম রে আশা। আশা মুচকি হেসে বললো
“তাই, ব্যাপার কি?
নিয়াশা একটু নড়েচড়ে বসলো। হাসিটা ঠোঁটের কোনে টেনে বললো
“ব্যাপারখানা খুব জটিল রে বনু, কেউ যে আমার মন কেড়ে নিয়েছে।
“সেটাই তো জানতে চাইছি। কে সে?
” নাম জানিনা, চিনিও না। আজ সকালে বাসাতে ফিরেই ছেলেটাকে দেখলাম। কি লম্বা! আর দারুণ হ্যান্ডসাম। আমিতো ওকে দেখেই ফেসে গেছি। যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট। একদমে কথাগুলো বললো নিয়াশা।
আশা খুব মনোযোগ সহকারে শুনলো ওর কথাগুলো। এরপর গম্ভীরমুখে বললো
“হুম বুঝলাম। ব্যাপারখানা জটিল। তবে তুমি যে ছেলেটাকে দেখে ফিদা হয়ে গেছো, সে আর অন্য কেউ না, আন্টির ছোট ছেলে সাদাত।
নিয়াশা অবাক হয়ে বললো
“সত্যি? তার মানে এখন থেকে সে এ বাসাতেই থাকবে?
আশা খেয়াল করলো নিয়াশা আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে আছে। সে বলল
“সেটা আমি জানিনা।
“ওঁকে, তোর জানতে হবেনা। যা জানার আমিই জেনে নিবো।
নিয়াশা উঠে চলে গেলো, আশা সামান্য হাসলো নিয়াশার এমন পাগলামো দেখে। এরপর সেখান থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেলো।
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, এখনো রান্না হয়নি। সকালে হোটেল থেকে নাস্তা আনিয়ে খেয়েছে আশা। কিন্তু দুপুরে কি রান্না হবে সেটাই চিন্তার বিষয়। এসব ভাবার এক ফাঁকে টেবিলের উপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে ” ভাইয়া” নামটা জ্বলজ্বল করছে। রিসিভ করে ফোনটা কানে ঠেকাতেই সেই মধুমাখা ডাকটি ভেসে আসলো
“আশামনি।
আহ” ভাইয়ার মুখে আশামনি ডাকটা শুনলে কেন জানি মনটা শীতলতায় জুড়িয়ে যায়। আশা বললো
“ভালো আছিস ভাইয়া।
আদিব পালটা প্রশ্ন করে বললো
“আগে বল আমার আশামনি কেমন আছে?
আশা মুচকি হেসে বললো
“খুব ভালো আছি ভাইয়া। কি করিস এখন?
“বসে আছি দোকানে।
“তুই কি করছিলি?
“কিছুই না, আমিও বসে আছি।
“মা ভালো আছে?
“হুম ভালোই আছে। গতকাল না কথা বললি মায়ের সাথে?
“হুম, তাতে কি?
আদিব হাসলো বোনের কথায়।
আরো কিছুটা সময় দুই ভাইবোনের মধ্যে কথাবার্তা চললো। ফোন রাখার পর আর দেরি করলো না আশা। বোরকাটা পরে ছুটলো বাজারের দিকে।
বাজার থেকে চিংড়ি মাছ আর একটা কচি লাউ কিনে এনে ফিরে আসার পথে হটাৎ কানে এলো সেই ভয়ংকর ডাকটা-
“হেই লেডি।
আশা খানিক থমকে গেলো। কিন্তু পিছু ফিরলো না। কন্ঠটা কার সেটা বুঝতে পেরেই আরো দ্রুত বেগে হাটা শুরু করলো সে। এতোক্ষণে সেই ছেলেটা বাইকটা নিয়ে আশার পাশে চলে এসেছে।। কিন্তু একবারাও আশা ছেলেটার দিকে তাকাচ্ছেনা, সে প্রাণপণে হেঁটে যাচ্ছে।
ছেলেটি রহস্যময় হাসি হেসে বললো
“কতো পালাবে লেডি, সেইতো বেলা শেষে আমার কাছে এসেই ধরা দিতে হবে।
আশা এবার দাঁড়ালো। ছেলেটির দিকে এক পলক তাকিয়ে শান্তভাবে গম্ভীরমুখে বললো
“কে আপনি? কি চান?
“তোমাকে চাই।
আশা বিরক্তি নিয়ে বললো
“সেন্স হারিয়ে ফেলেছেন আপনি। নিজের সেন্সে আসুন আগে। আমাকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন প্লিজ।
আশা আবারও হাঁটা শুরু করলো। পেছন থেকে ছেলেটি বললো
“যত ইচ্ছে পালানোর চেষ্টা করে যাও। কিন্তু জেনে রাখো, আমার কাছ থেকে পালানো তোমার কপালে লেখা নেই।
চলবে….