ভালোবাসি তাই পর্ব-০৭

0
564

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম -৭

সাদকে বসিয়ে রেখে আরো একটা প্লেট নিয়ে ভাত বাড়লো আশা। ভাজা ডিমটা থেকে বেশ অর্ধেকটা ডিম নিয়ে আর একপাশে অল্প আলুভর্তা দিয়ে সাদের সামনে দিলো। সাদ আশার দিকে বাকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো
“আমি ডিম ভাজা চাইনি, আমি যাস্ট তোমার স্পেশাল ভর্তার লোভে বসেছি।
আশা কিছু বলবে তার আগেই সাদ ডিমটা আশার প্লেটে রেখে দিলো। আশা কিছু বলতে যেয়েও আর বলতে পারলোনা। হাত ধুয়ে খাওয়া শুরু করলো ওরা। খাওয়ার পুরোটা সময় জুরে কেউ কারো সাথে কোনোরকম কথা বললোনা।
আশা একবার তাকালোও না পর্যন্ত সাদের দিকে। ওর কেমন যেনো একটু অস্বস্তি লাগছে।

খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে সাদের দিকে তাকাতেই সে চমকে গেলো। সাদের ঠোঁট আর চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে, গাল দুটোতেও লাল আভা দেখা যাচ্ছে। আশা তারাহুরো করে এক গ্লাস পানি নিয়ে সাদের সামনে ধরলো। গ্লাসটা ছিনিয়ে নিলো সাদ। ঢকঢক করে গ্লাসের পুরোটা পানি একটানে খেয়ে নিলো সে। আশা করুণভাবে তাকালো সাদের দিকে। কাচুমাচু করে অপরাধীর গলায় বললো
“আমার আপনাকে এইসব দেওয়া উচিৎ হয়নি। আমার বুঝা উচিত ছিলো, আপনি এইসব খেয়ে অভ্যস্ত না।
সাদ ঝালে ফুপাতে ফুপাতে বললো
“উফ, নিজেকে দোষারোপ করাটা বন্ধ করো তো কিউটি, আমিতো নিজের ইচ্ছেতেই এটা খেয়েছি। আর হ্যাঁ, দারুণ টেস্ট ছিলো ভর্তাটা। সাধারণ আলুভর্তার চেয়ে একটু ভিন্ন। মরিচগুলোও কেমন যেনো, শুকনোও না, কাঁচাও না। কিভাবে করলে এটা?
“জেনে কি করবেন?
“প্লিজ বলো, মাঝে মাঝে আমিও এটা করে খাবো।
“এটা খেয়ে আপনার যে কি অবস্থা হলো, তা তো নিজের চোখেই দেখলাম।
“ঝাল কম দিবো। তুমি রেসিপিটা বলো তো তারাতাড়ি।

আশা মুচকি হাসলো। সাদের নজর এড়ালো না সেটা। সে বললো
“বাই দ্যা ওয়ে, তোমার হাসিটাও অনেক কিউট, তোমারই মতো। সাদের কথায় সামান্য লজ্জা পেলো আশা। সেটা বুঝতে পেরে সাদ বললো
“ওকে বাদ দাও! রেসিপি বলো, হারি আপ।
আশা বললো
“আলুটা ভালো করে ধুয়ে পরিমাণমতো পানি দিয়ে সেদ্ধ করবেন প্রথমে। এ ভর্তায় কাঁচামরিচ ব্যবহার করবেন আর কাঁচামরিচ গুলো অবশ্যই ধুয়ে আলুর সাথেই সেদ্ধ বসাবেন। আলু সেদ্ধ হয়ে গেলেও নামানো যাবেনা। পানিটা চুলোতেই রেখেই শুকাতে হবে। পানি পুরোটা শুকিয়ে গেলে অল্প তাপে আলুগুলো হাড়িতে রেখেই চুলোয় বসিয়ে রাখবেন। যখন আলুটা হালকা হালকা পুড়ে আসবে, মানে আলুটাকে সামান্য পুড়তে হবে। আলু সামান্য পুড়ে এলে সেটা নামিয়ে নিবেন। এরপর আর কিছুই না, আলু সেদ্ধ আর মরিচ সেদ্ধ গুলো পেয়াজকুচি, আর সরিষার তেলের সাথে মাখিয়ে নিবেন, ব্যস।

সাদের চোখেমুখে এখনো প্রচন্ড ঝাল স্পষ্ট। তবুও তার ঠোঁটের কোনে হাসি। আশা বিছানা ছেড়ে নেমে রেকের কাছে গেলো। রেকটা খুলে কিছু একটা খুজতে লাগলো । পেছন থেকে সাদ প্রশ্ন করলো
“কি খুজছো কিউটি?
আশা মুচকি হেসে বললো
“একটু ওয়েট করুন, দেখতেই পাবেন।
সাদ আর কথা বাড়ালো না। আশা একটা প্লাস্টিকের বয়াম হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো সাদের দিকে। বয়ামটা খুলে সেখান থেকে কয়েক টুকরো খেজুর গুড় হাতে নিয়ে সেগুলো বাড়িয়ে দিলো সাদের দিকে। সাদ টুকরো গুলো হাতে নিতে নিতে বললো
“ওয়াও! খেজুর গুড়।
আশা বয়ামটা টেবিলের উপর রেখে বিছানায় বসলো। শান্ত গলায় বললো
“হুম। আমি এটা খেতে খুব পছন্দ করি, তাই ভাইয়া কিনে দিয়ে গেছিলো।

সাদ খেজুর গুড়ে কামড় বসাতে বসাতে বললো
“ছোটবেলায় আমিও এটা অনেক খেয়েছি এটা। কানাডা যাবার পর থেকে আর খাওয়া হয় না। তোমাকে অনেক অনেক থ্যাংকস কিউটি, এতোবছর পর সেই পুরোনো পছন্দ টা নতুন করে জাগিয়ে তুলার জন্য। সাদের কথায় আশা হাসলো।

সাদ খাচ্ছে। এমন সময় নীলা হুড়মুড় করে ছুটে এলো আশার রুমে। ওর চোখেমুখে আতংক। নীলাকে এরুপে দেখে আশা উদ্ধিগ্ন গলায় বললো
“কি হয়েছে নীলা, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
“আশা, জলদি একটু আসো আমাদের রুমে। নিয়াশা যেনো কেমন করছে।

‘নিয়াশা যেনো কেমন করছে’ কথাটা কানে আসতেই হাতে থাকা গুড়ের টুকরোগুলো বিছানায় ফেলেই উঠে দাঁড়ালো সাদ। বিচলিত হয়ে বললো
“বিউটির কি হয়েছে?
নীলার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সাদ তরিঘরি করে ছুটে গেলো নিয়াশার রুমে। নীলা আর আশা হতভম্ভের মতো তাকিয়ে রইলো সাদের যাবার দিকে। বিছানায় ফেলে যাওয়া গুড়ের টুকরো গুলোর দিকেও একনজর তাকালো সে। এরপর একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে নীলাকে বললো
“কি হয়েছে নিয়াশার? বিকেলে তো দেখলাম ভালোই।
“সন্ধ্যা থেকেই বলছিলো পেটটা ব্যাথা করছে। এরমাঝে দু একবার বমিও করেছে। এখন ব্যাথাটা বেড়েছে, ব্যাথার চোটে কাতরাচ্ছে খুব।

আশা শান্ত গলায় বললো
“চলো দেখি কি হয়েছে।
আশা দরজার ছিটকিনি টা লাগিয়ে ওদের রুমের দিকে গেলো। দরজার সামনেই গিয়েই দাঁড়িয়ে গেলো ওরা। ভেতরে সাদ বসে আছে, আর ওর এক হাতের বাহুতে নিয়াশার মাথাটা খুব যত্নসহকারে রাখা। অন্য হাতে সে নিয়াশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আশা কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
নীলা আশার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো
“ভেতরে যাবেনা আশা?
আশা হেসে বললো
“এখানে বোধহয় আমার যাওয়াটা ঠিক হবেনা নীলা।
কথটা বলে সেখানে আর একদন্ড না দাড়িয়ে চলে এলো নিজের রুমে। ওর পিছন পিছন নীলাও ছুটে এলো। আশা অবাক হয়ে বললো
“তুমি চলে এলে কেন?
“তুমি যে কারণে চলে এসেছো।

আশা বিস্ময়ে বললো
“মানে?
“আমারও মনে হলো এখন ভেতরে যাওয়াটা ঠিক হবেনা।
“ওহ!
আশা আর নীলা একসাথে বসে গল্প করতে লাগলো। গল্প করতে করতে অনেক সময় পার হয়ে গেলো। আরো কিছুটা সময় পর নিয়াশা হনহন করে এলো আশার রুমে। পিছন পিছন সাদও এসেছে। নিয়াশা অভিমান ভরা গলায় অভিযোগের সুরে বললো
“কিরে নীলু, তোরে পাঠাইছিলাম আশাকে নেওয়ার জন্য, আর তুই নিজেই হারাই গেলি? আর আশা, তুইও বা কেমনে আমার কাছে না গিয়ে পারলি। আমি খুব কষ্ট পাইছি তোদের ব্যাবহারে।

আশা শান্ত গলায় বললো
“এখন কেমন লাগছে তোমার?
নিয়াশা সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভালো, তবে উনি যদি না যেতো, তাহলে খালি রুমে পরে মনে হয় আমি আজ মরেই যেতাম। তোরা তো আমার খবর ও নিতিস না, যা বুঝলাম। তোরা দুইটাই বেইমান।
নীলা বললো
“আহ নিয়াশা, এতো চিল্লাপাল্লা করিস না তো। আমরা দুইজনই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সাদ ভাইয়া তোর সেবাযত্ন করছে। তাই তোদের প্রাইভেসির চিন্তা করে ফেরত আসছি।

নিলার কথায় লাজুক হাসি হাসলো নিয়াশা। তবে সাদের কপালে ভাজ পরলো। সে ভ্রু বাকিয়ে বললো
“আমাদের প্রাইভেসি মানে? কিসের প্রাইভেসি?
আশা হেসে বললো
“সে কিছুনা। আপনি বসুন।
সাদ বসলোনা। সে গম্ভীর কন্ঠে বললো
“আমার এখন রেস্ট নেওয়া দরকার, গুড নাইট। কথাটা বলেই সে যাওয়ার পথে পা বাড়ালো। দু পা এগিয়ে গিয়ে আবারও পিছিয়ে এলো সে। নিয়াশার দিকে তাকিয়ে বললো
“নিজের খেয়াল রেখো বিউটি, আর কোনো প্রব্লেম হলে আমাকে কিন্তু অবশ্যই ডাকবে।
সাদের কথায় নিয়াশা মাথা নাড়িয়ে বললো
“হু।

সাদ চলে যাবার সাথে সাথেই সজোরে হেসে দিলো নীলা। আশা সে হাসির মানেটা বুঝতে পেরে নিশ্চুপভাবে বসে রইলো। নিয়াশা সামান্য রাগী গলায় বললো
“হাসছিস কেন এভাবে, সমস্যা কি?
নীলা আগের মতোই হাসতে হাসতে বললো
“হাসছি তোর মজনুর কান্ড দেখে। তোর প্রতি তার এতো কেয়ারিং, এতো মোহাব্বত। তাও বলে কিসের প্রাইভেসি। যেনো আমরা কিচ্ছু বুঝিনা। এবার নিয়াশাও চাপা হাসি হাসলো। কিন্তু আশা চুপচাপ। কেন যেনো এইসব কথাবার্তা ওর কানে বেজায় বিষাদে ঠেকছে।

আশাকে এমন ভাবে চুপচাপ থাকতে দেখে নিয়াশা বললো
“কিরে, কি হইছে তোর?
“নাহ, কিছু না। কি হয়েছিলো তোমার? শুনলাম বমিও করেছো!
“কি জানি, আমিও ঠিক বুঝলাম না। হয়তো এসিডিটির প্রবলেম। এখন কিছুটা ঠিক আছি। তবে পেট ব্যাথা আর বমি হওয়ার কারণে শরীর কিছুটা দুর্বল লাগছে। আমি বরং গিয়ে ঘুমাই। তুইও ঘুমিয়ে যা আশা। নিয়াশার কথায় আশা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

রাতের শেষ ভাগের দিকে হটাৎ ঘুম ভেংগে গেলো আশার। মাথাটাও ব্যাথা করছে খুব, অস্থিরতা কাজ করছে মনে। সেই যে ঘুম ভাংলো, আর ঘুমের ছিটেফোঁটাও আসছে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাতরাচ্ছে সে।
এমন সময় হটাৎ ফোনের মেসেজ টোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ টা ওপেন করতেই প্রচন্ড অবাক হলো সে। আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। সেখানে লেখা, ” কি লেডি, আমার কথা ভাবছো, নাকি আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখছো? আমি পারছিনা থাকতে তোমায় ছাড়া, আমি পারছিনা কাটাতে তোমার মায়া। তুমি কি জানো, স্বপেও জ্বালাতন করে তোমার ওই অপরুপ ছায়া!!

মেসেজের লাইনগুলো পড়া শেষ হলেও বিস্ফোরিত চোখে সে এক নজরে মেসেজের দিকে তাকিয়ে আছে এখনো পর্যন্ত। লেডি শব্দটা দেখামাত্রই সে বুঝে গেছে মেসেজটা কে পাঠিয়েছে। কিন্তু ছেলেটা নাম্বার পেলো কোথায় সেটাই মাথায় আসছেনা কিছুতেই। ছেলেটা কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে, নাকি এটা নিছক আবেগ টাইমপাস করার ধান্ধা? যদি সত্যি সত্যিই সে আমাকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে কি করা উচিৎ আমার? আমাকেও কি ওকে ভালোবাসতে হবে? নাকি সরাসরি বলে দেবো আমাকে যেনো আর ডিস্টার্ব না করে?

কথাগুলো ভেবে মনে মনে আবারও হতাশ হলো আশা। ভাবলো, ‘মানা করলেই বা কি হবে, সে কি আমার মানা মানবে?’ সেদিনও তো মানা করলাম। এইসব হাজার হাজার চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগলো আশার মাথায়। আরো কিছুটা সময় চিন্তাভাবনায় মশগুল থেকে অবশেষে কোনো এক সময় ঘুমের দেশে আবারও পাড়ি দিলো সে।

সকালে ওরা তিনজনই রেডি হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। রওনা দিবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। সাদ সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। ব্রাশটা হাতে নিয়ে সোজা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। আশা আর নীলা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নিয়াশার জন্য। সাদ ব্রাশ করতে করতে বলল
“কিউটি, কোথায় যাচ্ছো?.
আশা ক্ষীন কন্ঠে বললো
“এই বেলা বই হাতে আর কোথায় বা যাবো। যাওয়ার যায়গা তো সেই ভার্সিটিই।

সাদ হাসতে হাসতে বললো
“তা ঠিক। তবে দাড়িয়ে আছো কেন?
“নিয়াশার জন্য।
কথাটা শুনে মুহুর্তেই সাদের মুখের অবয়ব চেঞ্জ হয়ে গেলো। সে খানিক ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললো
“বিউটিও যাবে আজ! কিন্তু সে তো অসুস্থ। এ শরীর নিয়ে যাওয়ার কি খুব দরকার?
আশা মৃদু হেসে বললো
“সেটা আপনার বিউটিকেই বলুন। এমন সময় নিয়াশাও বেরিয়ে এলো রুম থেকে। সাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো
“এতো চিন্তা করবেন না তো। আমি এখন ঠিক আছি। রাতেই তো ব্যথা কমে গেছে পুরোপুরি। সাদ কপাল কুচকে বললো
“কিন্তু তোমার শরীর এখনো দুর্বল, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। নিয়াশা ওর সাথে তাল মিলিয়ে বললো
“হুম, তাতো একটু দুর্বলই। কিন্তু বাসায় সারাদিন একা একা বসে থাকতেও ভালো লাগবেনা।

সাদ এগিয়ে এলো নিয়াশার দিকে। তীক্ষ্ণ গলায় বললো
“ঠিক আছে, বিকেলে আমি তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাবো। তাও এই দুর্বল শরীর নিয়ে ভার্সিটি যেও না যেনো।

চলবে….