#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১০
ততক্ষণে সাদের কপালে ভাজ পরেছে। সেটা নজরে এলো আশার। তাও সে বলতে লাগলো
“আজো ফোন করে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছে। আমি যতই মানা করছি বিরক্ত না করার জন্য, ততই সে বেশি বেশি জ্বালাচ্ছে। সাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশার দিকে। আশার কথা বলা শেষ হলে সাদ বলল
“কেন বিরক্ত করে?
আশা ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো
“কি জানি, বলে তো আমায় নাকি ভালোবাসে।
সাদের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো হটাৎ। কর্কশ কন্ঠে বললো
“ফোন রিসিভ কেন করলে? ছেলেদের নাম্বার দেখলে কথা বলার জন্য মনটা নাচে তাইনা? এরপর থেকে আর কখনও যদি শুনেছি ওই ছেলের কল রিসিভ করেছো, হাত ভেংগে অন্য হাতে ধরিয়ে দেবো বলে রাখলাম।
আশা খেয়াল করলো সাদের চোখেমুখে আগুন ঝড়ছে, মুখ দিয়ে কথার বদলে স্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে। সে বিস্ময় নিয়ে বললো
“আপনি এতো উত্তেজিত কেন হচ্ছেন?
সাদ এবার নিজেকে কন্ট্রোল করলো। মাথা ঠান্ডা হবার পর নিজের করা ব্যাবহারগুলোর কথা মনে পরতেই নিজেই অনুতপ্ত হলো। আশাকে বললো
“আই এম স্যরি কিউটি, আমার হটাৎ কি হয়েছিলো বুঝতে পারিনি। আমি বরং যাচ্ছি, তুমি এবার ঘুমিয়ে পরো। আশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো সে। আশা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এ কোন সাদকে সে দেখছে?
পরের দিন ভার্সিটি যাবার জন্য রেডি হয়ে নিয়াশাদের রুমে গেলো আশা। নীলা রেডি হচ্ছে। কিন্তু নিয়াশা রেডি হওয়া তো অনেক দুরের কথা, উলটো মুখ ভার করে বসে আছে। ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আশা বললো
“কি ব্যাপার নিয়াশা, আজো যাবেনা তুমি?
নিয়াশা কোনো রেসপন্স করলো না। নীলা পাশ থেকে বললো
“ওরে মনে হয় ভুতে ধরছে আশা। সকাল থেকেই এভাবে থ মেরে বসে আছে।
আশা অবাক হলো। সে এগিয়ে গিয়ে নিয়াশার পাশে বসে ওর পিঠে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বললো
“কি হয়েছে তোমার? তুমি কি অসুস্থ?.
এবারেও নিয়াশা নিশ্চুপ। ওর কোনো ভাবাবেগ হলো না। ওর মাথাতে শুধু একটা দৃশ্যই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ গতকাল রাতের দৃশ্য টা। এতো রাতে আশার রুমে সাদের প্রবেশ, কিছুতেই মানতে পারছেনা সে।
ওয়াশরুমে যাবার জন্য সে উঠেছিলো। কিন্তু এই মাঝরাতে সাদ আশার রুমে যাবে ভাবতেও পারেনি সে।
আশা আবারও নিয়াশাকে ডাকলো, মাথায় হাত বুলালো। প্রচন্ড ঘৃণার সাথে সে হাতটা সরিয়ে দিলো নিয়াশা৷ অবাক হলো আশা। এ কেমন ব্যবহার, কেন সে এমন করছে? এরই মধ্যে সাদ হাজির হলো সেখানে। ওর বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে, কোথাও যাবার জন্য বেরিয়েছে সে। নিয়াশাকে এমন গম্ভীরমুখে বসে থাকতে দেখে আশার দিকে তাকিয়ে বললো
“ওর কি হয়েছে কিউটি?
আশা ইশারায় জানান দিলো, ও কিছু জানেনা। সাদ এগিয়ে গেলো নিয়াশার দিকে। সাদের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো নিয়াশা।
সাদ হাসলো। মিষ্টি ছন্দে বললো
‘হে অভিমানী প্রিয়া, একবার দেখো চাহিয়া।
তোমার দোয়ারে এসেছি আজ,
ফিরিয়ে দিলে কি হবেনা লাজ?”
সাদের মুখে এমন ছন্দ শুনে মিটিমিটি হাসছে আশা, নীলাও হাসছে মুচকি মুচকি। অন্যদিকে নিয়াশার কোনো ভাবাবেগ নেই। সে আগের মতোই বসে রয়েছে। ওকে আগের অবস্থাতে বসে থাকতে দেখে সাদ এবার উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ হতাশ গলায় বললো
“ভেবেছিলাম তোমাদের সাথে আজ তোমাদের ভার্সিটি যাবো, দেখবো, ঘুরবো। কিন্তু তা আর হলো না৷ মাই বেড লাক।
সাদের মুখে ভার্সিটি যাবার কথা আর ঘোরাফেরার কথা শুনে মনের মধ্যে কিছুটা খুশির জোয়ার বয়ে গেলো নিয়াশার। সে হটাৎ লাফিয়ে উঠে খানিক চেচিয়ে বললো
“সত্যি? সত্যিই তুমি আমার সাথে ভার্সিটিতে যাব?
সাদ মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। গতরাতের ঘটনাটা কিছু সময়ের জন্য ভুলে গেলো সে। উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
“তুমি যাস্ট পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো, আমি রেডি হয়ে আসছি।
নিয়াশা এক সেট জামা নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। আশা কিছুটা সময় নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। পূর্বের মতো সেই ব্যথাটা আবারও যেনো সে অনুভব করছে। কিছু সময় পর সে মুচকি হেসে বললো
“তাহলে আপনি নিয়াশাকে নিয়ে আসুন। আমি আর নীলা চলে যাই বরং।
কপাল কুচকালো সাদ। গম্ভীরমুখে বললো
“কেনো?
আশা আমতাআমতা করে বললো
“নাহ মানে, আমরা থাকলে আপনাদের দুজনের যদি কোনো অসুবিধে হয়।
সাদ ভ্রু বাকালো। মুখে গাম্ভীর্য এনে বললো
“যেখানে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এক পাও নড়বে না। সবাই একসঙ্গে যাবো। আশা ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে না চাইতেও হ্যাঁ বললো।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা চার জনই ভার্সিটির সামনে গিয়ে পৌছুলো। আশা আর নীলা সামনে হাটছে, অপরদিকে সাদ আর নিয়াশা পিছন পিছন। মুলত আশা ইচ্ছে করেই নীলাকে সাথে নিয়ে আগে আগে থাকার চেষ্টা করছে। আর নিয়াশা, সে যেনো আঠার মতো লেগে আছে সাদের দিকে। কোনোমতেই সাদকে কাছছাড়া করা যাবেনা, এই পণ নিয়েই যেনো বেরিয়েছে। নিয়াশা এখন প্রচন্ড খুশি। সে সাদের মনোরঞ্জন এর জন্য বিভিন্ন ধরনের গল্পগুজব করেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সাদ ওর কথায় হু হু করে যাচ্ছে। কিন্তু ওর নজর তখন অন্যদিকে। রাস্তার এ পাশে ওপাশে চারিদিকটায় চোখ বুলাচ্ছে সে। যেনো কাউকে খুজছে। ওর এমন ভাবভঙ্গি দেখে নিয়াশা খানিক বিস্মিত গলায় বললো
“তুমি কি কিছু খুঁজছো?
সাদ অন্যদিকে চোখ রেখেই বললো
“এখানে খোঁজার মতো কি আছে আমার?
নিয়াশা এক গাল হেসে বললো
“তা ঠিক।
ভার্সিটির ভেতরে পা রাখতেই আশা সাদের কাছে গিয়ে বললো
“আমি আমার ক্লাসরুমে গেলাম। নিয়াশা আর আপনি বরং আমাদের ভার্সিটিটা ঘুরে দেখুন।
সাদ উদ্ধিগ্ন হয়ে বললো
“তুমি এখনই চলে যাবে?
“হ্যাঁ, আমার ক্লাস শুরু হবে এক্ষুনি। এমনিতেই আজ দেরি হয়ে গেছে।।
“আর কিছুক্ষণ থাকো, একটা ক্লাস নাহয় আজ মিস দিলে। আশা মুচকি হাসলো। অপরদিকে সাদের দিকে কিছুটা অবাক নয়নে তাকালো নিয়াশা । কিছুটা রাগও হচ্ছে ওর। আশা কিছু বলবে তার আগেই নিয়াশা বললো
“আরে না না, ও কেন ক্লাস মিস দিতে যাবে শুধু শুধু। ওর তো আজ একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে তাই না আশা। আশা হাসল। সে বেশ বুঝতে পারলো নিয়াশা চাইছেনা সে ওদের সাথে থাকুক।
আশা মাথা নাড়িয়ে বললো
“একদম তাই। আমি যাচ্ছি।
আশা চলে যাবার পর নীলাও ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাসে চলে গেলো। সাদ নিয়াশার দিকে তাকালো এবার। ক্ষীণ কন্ঠে বললো
“তুমি যাবেনা?
মুহুর্তেই সাদের বাহু চেপে ধরলো নিয়াশা। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো
“আমি কিন্তু আজ তোমার জন্যই ভার্সিটিতে এসেছি। সো আমাকে একদমই ফোর্স করবেনা ক্লাসে যাবার জন্য।
এক এক করে চারটা বিষয়ের উপর ক্লাস করে ক্লাসরুম ত্যাগ করলো আশা। তবে এতোটা সময় সে শান্তিতে ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারেনি। শুধুই অস্থিরতা কাজ করেছে মনের মধ্যে। আর প্রতিটা ঘন্টাই সে ছটফট করেছে প্রচন্ডভাবে। এ অস্থিরতার কারণ সে নিজেও জানেনা। কই অন্যদিন তো এমন অস্থির লাগেনা, এভাবে ছটফটানিও হয় না। তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? ভেবে পায়না আশা। ক্লাস থেকে বেরিয়ে সে সোজা চলে গেলো ক্যাম্পাসের দিকে। সেখানে গিয়ে এদিক ওদিক তাকালো কয়েকবার। কিন্তু কোথাও সাদ, নিয়াশা কিংবা নীলাকে সে দেখতে পেলোনা। একবার ভাবলো, বাসাতে একাই সে চলে যাবে। পরক্ষণে ভাবল, এভানে চলে গেলে সাদ কি ভাববে! ভাববে হয়তো ওকে ইগ্নোর করা হচ্ছে। যা হয়তো সাদের কাছে বেশ বাজেভাবে ঠেকবে।
কিন্তু কোথাও ওদের দেখা না পেয়ে আবারও ক্লাসে ফেরত গেলো সে। ক্লাসরুম ফাঁকা, যে যার মতো চলে গেছে। একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো আশা। সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বার কয়েকবার কল দিলো নিয়াশার ফোনে। বার বার কল বাজতে বাজতে কেটে গেলো, কিন্তু কোনো রেসপন্স এলোনা। নিয়াশার এরুপ আচরণে হাসলো আশা। তখন কি সুকৌশলেই না ওকে সরিয়ে দিয়েছে সে। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়, তার জন্য মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে। এসব ভাবার এক পর্যায়ে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। নিয়াশা কল ব্যাক করেছে ভেবে তারাতাড়ি করে ফোনটা হাতে নিলো সে। কিন্তু ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই মুখটা কালো আঁধারে ছেয়ে গেলো হটাৎ।
আবারও সেই নাম্বারটা থেকে কল এসেছে। রানা নামের ছেলেটা কল করেছে। এক ঝাক বিরক্তি নিয়ে কলটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা সামনের বেঞ্চের উপর রাখলো সে। দৃষ্টি তার বাইরে। ভার্সিটির প্রাঙ্গণে শত শত ছেলেমেয়েরা হাঁটছে, বসে আছে, গল্পগুজব করছে। আশা একমনে সেই দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। ফোন আবারও বাজলো। কিন্তু আশার ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। ফোনের টোনটা যেনো ওর কান অব্দি পৌঁছায় না। ফোন বেজে চলেছে আপন গতিতে। একবার, দুবার, তিনবার….
এভাবে একের পর এক ফোন বেজেই যাচ্ছে। আশার ভালো লাগছেনা। গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে বাইরেটা দেখছে সে। হটাৎ কারো ধাক্কায় ধ্যান ভাংলো আশার। থতমত খেয়ে সামনে থাকা মেয়েটির দিকে সে তাকালো।
“আপনার ফোনটা অনেক সময় ধরে বেজে চলেছে। কি হয়েছে আপনার?
আশা একবার ফোনের দিকে তাকালো। এরপর আবারও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
“আমার কিছু হয়নি। আপনাকে ধন্যবাদ।
মেয়েটি চলে গেলো। ফোনটা এখনো বেজে যাচ্ছে। এবার বেশ বিরক্ত হলো আশা। কোনো চিন্তাভাবনা না করে আবারও কলটা কেটে দিলো সে। এবার ফোনটা সুইচ অফ করে ব্যাগের ভেতর রেখে দিলো। ওই ফালতু লোকটার সাথে বকবক করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কি মনে করে লোকটা নিজেকে? বার বার মানা করার পরেও বিরক্ত করে কোন অধিকারে? কোনো সেন্স নেই কি তার, আজব। আশা রেগে একা একাই বিড়বিড় করতে থাকে।
ভার্সিটির ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে আছে সাদ আর নিয়াশা। সাদ এক মনে বার্গার খাচ্ছে আর ফোন চাপছে। নিয়াশা বার বার সাদকে নিজের দিকে মনোসংযোগ করাতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছে। এতে হতাশ হচ্ছে সে। এক পর্যায়ে মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইলো সে। সাদ বার্গারে কামড় বসাতে গিয়ে খেয়াল করলো নিয়াশা কিচ্ছু খাচ্ছেনা। সে বললো
“খাচ্ছোনা কেন বিউটি?
নিয়াশা মুখ ভার করে বললো
“আমি খেলাম নাকি খেলাম নাকি সেদিকে কি কারো নজর আছে নাকি।
সাদ হাসলো। ফোন চাপতে চাপতে বললো
“হটাৎ এতো অভিমান করার কারণটা কি জানতে পারি?
নিয়াশা এবার ফিরে তাকালো সাদের দিকে। কিছুক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে বললো
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
” বলো। ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো সাদ।
নিয়াশা বিরক্ত হয়ে বললো
“আমার দিকে তাকাও প্লিজ, আমি সিরিয়াস।
সাদ ফোনটা রাখলো টেবিলের উপর। এক হাত দিয়ে মুখে ভর দিয়ে নিয়াশার দিক তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো
“হুম বলো।
নিয়াশা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকালো। এরপর আস্তে আস্তে বললো
“এই যে আমাদের এতো ভালো সম্পর্ক, ভালো বন্ডিং, আমার প্রতি তোমার এতো কেয়ারিং। আমি রাগ করলে তোমার সুরেলা ছন্দে আমার রাগ ভাঙ্গানো, এইসব কি?
সাদ ভ্রু বাকিয়ে বললো
“এইসব কি মানে?
নিয়াশা স্পষ্ট ভাবে বললো
“আমি জানতে চাইছি, এ সম্পর্কের নাম কি?
“আমিতো কালই বললাম, তুমি যা ভাবো তাই।
নিয়াশা উৎফুল্ল হয়ে বললো
“তার মানে আমি যেটা ভেবেছি সেটাই?
“কি ভেবেছো তুমি?
“এই যে আমরা রিলেশনশীপে আছি, আর আমাদের মাঝে যে সম্পর্ক আছে, তার নাম লাভ।
সাদ একবার তাকালো নিয়াশার দিকে। খানিক চুপ থেকে স্বাভাবিক গলায় বললো
“নো বিউটি, এটা রিলেশনশিপ নয়। এটা ফ্রেন্ডশিপ।
চলবে…..
#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১১
নিয়াশা উৎফুল্ল হয়ে বললো
“তার মানে আমি যেটা ভেবেছি সেটাই?
“কি ভেবেছো তুমি?
“এই যে আমরা রিলেশনশীপে আছি, আর আমাদের মাঝে যে সম্পর্ক আছে, তার নাম লাভ।
সাদ একবার তাকালো নিয়াশার দিকে। খানিক চুপ থেকে স্বাভাবিক গলায় বললো
“নো বিউটি, এটা রিলেশনশিপ নয়। এটা ফ্রেন্ডশিপ।
নিয়াশা রেগে গেলো, খানিক কর্কশ গলায় বললো
“একদম মজা করবেনা বললাম। সবসময় ফান ভালো লাগেনা।
“তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি মজা করছি? আমি সত্যিই বলছি বিউটি।
নিয়াশার উচ্ছ্বসিত মুখটা মুহুর্তেই কালো হয়ে গেলো। সে বিস্ময় নিয়ে বললো
“তাহলে আমার প্রতি তোমার এতো যে কেয়ারিং, তারপর আমাকে কোলে শুইয়ে সেবা করা, আমাকে লাল গোলাপ দেওয়া সেগুলো কি?
সাদ খানিক হেসে বললো
“প্রথমত আমি তোমাদের অনেক ভালো ফ্রেন্ড ভাবি, তাই তোমার অসুস্থতায় আমি তোমাকে সেবা করেছি। তোমার যায়গায় আশা কিংবা নীলা হলেও আমি সেটাই করতাম। আর কেয়ারিং এর কথা এখানে আসছে কোত্থেকে, সবটাই তো এক। দ্বিতীয়ত লাল গোলাপের কথা বলছো, সেটা তো তুমি নিজেই বেছে নিয়েছো। আমিতো যাস্ট দামটা দিয়েছি।
কথাগুলো শুনে প্রচন্ড রাগ হলো নিয়াশার। রাগে ফুসতে ফুসতে বললো
“তাহলে মেয়েটি যখন আমাকে ভাবী বলে ডাকলো, তখন প্রতিবাদ কেন করলে না?
সাদ ভ্রু বাকিয়ে বললো
“আজব তো, এভাবে রিয়েক্ট কেন করছো তুমি? আর মেয়েটিকেই বা কি বলবো আমি? কয়েক ঘন্টা নিয়ে বুঝাবো, তুমি আমার প্রেমিকা নও, শুধুই বান্ধবী? তার তাছাড়া মেয়েটি কি ভাবলো না ভাবলো তাতে আমাদের কি এসে যায় বলো।
নিয়াশার চোখদুটো ভিজে গেছে, কিছুক্ষণ সে নিরবে চোখের পানি ফেললো। এরপর অশ্রুসিক্ত কন্ঠে সামান্য ক্ষোভ নিয়ে বললো
“আমাকে যে ভালোবেসে বিউটি বলে ডাকো, তাহলে সেটা কি? সেটাও কি মিথ্যে?
সাদ এবার শব্দ করে হেসে দিলো নিয়াশার কথা শুনে। হাসতে হাসতে বললো
“এ পাগলী মেয়ে বলে কি, আমি তোমাকে বিউটি বলে ডাকি কারণ তুমি আসলেই অনেক সুন্দরী। আর আমি শুধু তোমাকে একা নয়, আশাকেও কিউটি বলে ডাকি। এর সাথে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই।
নিয়াশা আবারও অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো সাদের দিকে। এরপর হুট করে বললো
“কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি। আমাকে বিয়ে করে নাও প্লিজ। আমি তোমায় অনেক ভালো রাখবো, তুমি যা বলবে তাই করবো। তোমার অবাধ্য হবোনা। আমাকেও একটু ভালোবাসো প্লিজ প্লিজ।
কথাগুলো বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠলো নিয়াশা।
সাদ এবার বিপাকে পরলো। কি করবে সে বুঝতে পারছেনা। মৃদু গলায় বললো
“এটা ভার্সিটি বিউটি। এমন কিছু করোনা, যার কারণে তোমাকে আমাকে দুজনকেই না বিপদে পরতে হয়। আর খারাপ লাগলেও আমাকে বলতে হচ্ছে, তুমি এতোদিন যা ভেবে এসেছো এবং এই মুহূর্তে যা যা ভাবছো তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলো। আমার পক্ষে তোমার সাথে বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্কে আগানো সম্ভব না। তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু, আর আমি মনে করি তুমি সেটার সম্মান রাখবে।
নিয়াশা এবার চোখের পানি মুছে ফেললো। কন্ঠে ক্ষোভ নিয়ে বললো
“তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?
আবারও হাসলো সাদ। নিয়াশার মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে বললো
“তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ, তাই এমন উদ্ভব চিন্তা তোমার মাথায় আসছে। মাথাটা ঠান্ডা করো প্লিজ।
নিয়াশা এবার বাকাভাবে হাসলো। হীন কন্ঠে বললো
“প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে তাই তো? ওকে।
নিয়াশা উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। সাদ পিছন পিছন ডাকলো, কিন্তু কোনো লাভ হলোনা।
প্রায় আধঘন্টার মতো ক্লাসরুমে বসে থাকার পর এইবার উঠে দাঁড়ালো আশা। আর ভালো লাগছেনা একা একা বসে থাকতে। এবার বাসায় ফিরবে সে, একাই চলে যাবে। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ভার্সিটি থেকে বেরোবার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে এগুতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ হাটার পর হটাৎ ই থমকে গেলো এক যায়গায়। ওর সামনে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে রানা। কিন্তু অন্যদিনের মতো মুখে কোনো হাসি নেই, বরং ওর চোখমুখে স্পষ্ট রাগ দেখা যাচ্ছে। আশা সেসব পাত্তা না দিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে চাচ্ছিলো, ঠিক সেসময় রানা আবারও ওর পথের সামনে গিয়ে দাড়ালো। আশা বিরক্ত হয়ে বললো
“এটা কি ধরনের অসভ্যতা, কেন বার বার আমার পথ আটকান? কি মনে করেন নিজেকে? ন্যুনতম ভদ্রতা শিখেন নি?
এবার হুংকার করে উঠলো রানা। প্রচন্ড দাপটে চিৎকার করে বলে উঠলো
“কতবার কল করেছি? রিসিভ করো নি কেন?
“আমার ইচ্ছে হয়নি, তাই সিরিভ করিনি। আর তাছাড়া আপনার কল রিসিভ করতে আমি বাধ্য নয়। ঝাঝালো কন্ঠে বললো আশা।
আবার প্রচন্ডভাবে চিৎকার করে উঠলো রানা। ক্ষীপ্ত গলায় বললো
“ফোন অফ করলে কেন? আমি তোমায় ফোন অফ করার পারমিশন দিয়েছিলাম?
“আজব তো! আপনি আমায় পারমিশন দেওয়ার কে? আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই ফোন করেছি, প্রয়োজন হলে সারাজীবন অফ করেই রাখবো। এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মাঝখানে আপনি নাক গলাতে আসবেন না।
এবার প্রচন্ডভাবে রেগে গেলো রানা। রাগে সারা শরীর কাঁপতে লাগলো তার। অকথ্য অসভ্য ভাষায় চিৎকার চেচামেচি করতে লাগলো সে। আশা হতবাক হয়ে গেছে সে-সব ভাষার ধরণ শুনে। ছেলেটার মন মানসিকতা এতটা নোংরা তা কিঞ্চিৎ কল্পনা করতে পারেনি আগে। এতোক্ষণে আশেপাশের সকলেই এসে সেখানে ভীড় জমিয়েছে। সবাই যেনো রং তামাশা দেখছে। আশা ভীষণ অস্বস্তিতে পরে গেলো এবার। জটলার একদিকে নীলা আর নিয়াশাও দাঁড়িয়ে আছে, ওরাও ভীষণ অবাক হচ্ছে ওদের এভাবে দেখে। ছেলেটা যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছে আশাকে। এক পর্যায়ে এতো বড় জটলা দেখে ভীড় ঠেলে সামনের সাড়িয়ে এগিয়ে এলো সাদ। প্রথমে ভীষণ অবাক হলেও পরবর্তীতে সাধারণ দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে তা দেখতে লাগলো নিজেও।
আশা এবার রেগে গিয়ে বললো
“এনাফ! কি ধরনের কথা বলে যাচ্ছেন আপনি? কোন অধিকারে আমায় এভাবে গালাগাল করছেন?
ছেলেটি অকথ্য ভাষায় বললো
“ওই, কথা কম বল। তোর সাহস কি করে হয় আমার মুখে মুখে তর্ক করার? আর একবার তর্ক করবি, এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো।
সাদ এবার দুহাত বেধে রিলাক্স মুডে দাড়ালো। খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে ওদের কথোপকথন। আশা প্রচন্ড ভাবে রেগে গেলো এবার। ভীষণ তেজ নিয়ে বললো
“মুখে লাগাম লাগান। কোন ফ্যামিলিতে বিলং করেন আপনি? কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সে শিক্ষাটা কি আদৌ বাবা মা দিয়েছ, নাকি বাবা মায়ের উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তান আপনি?
আশার মুখে বাবা মায়ের কথা শুনে আবারও রেগে গেলো রানা। রাগের দাপটে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আশার গালে কষিয়ে থাপ্পড় দিলো সে। এবার চমকে গেলো সকলেই, গালে হাত দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো আশা। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি গড়িয়ে পরছে ওর। দৃশ্য টা আর সহ্য হলোনা সাদের। সে এগিয়ে গেলো আশার কাছে। এক পলক রানার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো আশার দিকে। সাদকে দেখে আশার কান্না আগের তুলনায় বেড়ে গেলো এবার। সাদ পরম যত্নে আশার গালে হাত বুলিয়ে দিলো বার কয়েকবার। এরপর পকেট থেকে রুমাল টা বের করে যত্নসহকারে চোখদুটো মুছে দিতে দিতে বললো
“কেঁদো না কিউটি, তোমাকে কান্নায় মানায় না। কাঁদবে তো ওই কুলাঙ্গার টা। আশার কান্না বেড়েই যাচ্ছে সমানে। সাদ বার বার হাত বুলাচ্ছে ওর গালে।
এক পর্যায়ে কর্কশ কন্ঠে রানা বলে উঠলো
“এই তুই কে রে? ওর গায়ে হাত দিচ্ছিস, সাহস তো কম না। মরার পাখা গজিয়েছে নাকি?
রানা মুখে কিছু না বলে জাস্ট আঙ্গুলটা মুখের কাছে নিয়ে চুপ থাকতে বললো রানাকে। রানা রেগে তেড়ে এলো সাদের কাছে। আচমকাই ওর কলার চেপে ধরলো সে। এ পর্যায়ে মাথা গরম হয়ে গেলো সাদের। হাতটা মুঠোবন্দি করে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে প্রচন্ড জোরে রানার নাক বরাবর দিলো এক ঘুষি। ছিটকে দূরে গিয়ে পরলো রানা।। সাদ এবার আশাকে ছেড়ে দিয়ে রানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো
“কি যেনো বলছিলি, আমি কে? শুনে রাখ, আমি ওর বয়ফ্রেন্ড।
সাদের মুখে বয়ফ্রেন্ড কথাটা শুনে প্রচন্ডভাবে চমকিত হলো আশা। মুহুর্তেই যেনো ওর শরীরের প্রত্যেকটি শিরা উপশিরার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, যা ওকে থমকে যেতে বাধ্য করছে। আশার মাথায় শুধু ঘোরপাক খাচ্ছে সাদের বলা শেষ কথাটা, ‘আমি ওর বয়ফ্রেন্ড’।
অন্যদিকে নিয়াশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সাদের দিকে। ও এটা কি বললো? তার মানে আশার জন্যই সাদ আমাকে রিজেক্ট করেছে? মুহূর্তেই ওর চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে তা অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো। নিয়াশাকে এরুপে দেখে মনে মনে সাদের উপর প্রচন্ড রেগে গেলো আশা। সাদ এটা কি করলো? সকলের সামনে এতোবড় মিথ্যেটা কেনই বা বললো বিশেষ করে যেখানে নিয়াশা উপস্থিত আছে।
অন্যদিকে রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে রানার পুরো মুখ। নাকের রক্ত অঝোরে মুখের দিকে বেয়ে পরছে। সেই রক্ত আর ব্যাথা নিয়েই সাদের সামনে কর্কশ ভাষায় হুংকার করে উঠলো রানা
“কি বললি তুই? কি হোস তুই আশার?
সাদ শান্তগলায় বললো
“বয়ফ্রেন্ড, শুনতে পেয়েছিস? যদি এখনো কানে না ঢুকে তাহলে কানের চিকিৎসা করিয়ে তারপর আসিস। বয়রাদের সাথে তর্ক করতে আমার বেশ অসুবিধে হয়।
রানা দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বললো
“আমার কানে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা তোর মাথায়। মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে নে, আশা শুধুই আমার। আমার নাম ওর কপালে লিখা হয়ে গেছে। আর যদি লিখা নাও থাকে, তাহলে আমি জোর করে হলেও ওর কপালে আমার নামটা লিখে দিবো। আমার হাত থেকে ওর কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।
কথাগুলো বলে আশার দিকে একবার তাকালো সে। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগে ফুসতে ফুসতে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো সে।
সাদ পেছন থেকে বললো
“আরে যা যা, কত দেখেছি এমন পাগল। আসছে আমার মাথার চিকিৎসা করতে।
এমন সময় অসংখ্য ছেলেমেয়ের ভীড়ের মধ্যে থেকে একজনের হাত তালির শব্দে পিছন ফিরে তাকালো সাদ। আশাও বিস্ময় নিয়ে তাকালো সেদিকে। নিয়াশা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হাত তালি দিচ্ছে বার বার। সাদ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো। নিয়াশা এগিয়ে আসতে আসতে বললো
“বাহ! তাহলে এই ব্যাপার? এর জন্যই আমাকে ফিরিয়ে দিলে তাইনা? কারণটা তাহলে আশা?
সাদ গম্ভীরমুখে বললো
“এখানে সিনক্রিয়েট করোনা প্লিজ, এটা পাবলিক প্লেস। নিয়াশা আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
এরপর আশার দিকে বাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
“তুই আসলেই একটা জিনিস আশা। ভালোই অভিনয় করতে পারিস তুই। উপরে উপরে বুঝাচ্ছিস সাদের সাথে তোর কিচ্ছুটি নেই, আর ভেতরে ভেতরে এতোকিছু? তুই তো জানতি আমি সাদকে ভালোবাসি, তারপরও এতবড় বেইমানি করলি কিভাবে!!
আমার সাদকে কেড়ে নিলি? কি ভেবেছিস, ওকে কেড়ে নিয়ে তুই সেখে থাকবি? পারবিনা, আমি তোকে সুখে থাকতে দিবোনা, দেখে নিস।
কথাগুলোই একদমে বলে সেখান থেকে হনহন করে চলে গেলো নিয়াশা। বিস্ফোরিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে আশা। কি থেকে কি হয়ে গেলো হটাৎ!! অন্যদিকে কোনো এক গাছের পেছন থেকে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ সবকিছু শুনছিলো রানা। এরপর এক রহস্যময় হাসি হেসে সেও চলে গেলো সেখান থেকে।
চলবে…….