#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-২৪
আশা মুচকি হাসলো, অসহায় চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললো
“কেন এমনটা করলে তুমি? এটার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো? আমি তোমায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম। আর সেই তুমিই কিনা…..
নীলা হঠাৎ ঘাবড়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো
“কিক কি বাজে বকছিস আশা, তোর বোধহয় মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
“আমার মাথা একদম ঠিক আছে নীলা।
নীলা ভয়ার্ত চোখে তাকালো আশার দিকে। এই বুঝি সে ধরা খেয়ে গেলো। তবুও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য আবারও বললো
“আমি কেন রানার সাথে কথা বলতে যাবো বল, তুই তো আমার বোনের মতো। তোর ক্ষতি কিভাবে আমি চাইতে পারি? কে না কে আমার বিরুদ্ধে তোকে ক্ষেপিয়েছে, আর সেটা নিয়ে তুইও পরে আছিস। আশা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীলার দিকে। নীলা আবারও বললো
“হইতো এটা নিয়াশার কাজ, ওর সাথেই তো তোর ঝামেলা ছিলো বল, ভার্সিটির পুরো স্টুডেন্টদের সামনে তোকে হুমকিও দিয়েছিলো ভুলে গেছিস। তুই বরং ওকে গিয়ে ধর, শুধু শুধু আমার সাথে এইসব বলিস না। আমি এগুলোর সাথেও নেই, পাছেও নেই।
এবার আশা একটু শব্দ করে হেসে বললো
“কেন বার বার মিথ্যে বলছো বলো। সেদিন ছাদে যখন রানার সাথে ফোনে কথা বলছিলে তখন কিন্তু আমি সবটা শুনেছি।
নীলা আবারও ঘাবড়ে গেলো। ওর পুরো শরীর ঘামছে, চোখেমুখে স্পষ্ট ভয় ফুটে উঠেছে। কিছু বলার মতো কথা হয়তো মনে মনে খুজে চলেছে, কিন্তু আর কিইবা বলবে সে? কিছু যে খুজে পাচ্ছেনা। আশা এবার কিছু বলতে যাবে এই আগেই নিয়াশা প্রবেশ করলো রুমে। ওর চোখমুখও শক্ত হয়ে আছে। সে নীলার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় প্রশ্ন করলো
“এটা কি সত্যি?
নীলা ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো নিয়াশার দিকে। বললো
“কোনটা?
নিয়াশা এবার ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। ওর ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে ওরই কাছের বন্ধুটির মন এতটা কুৎসিত। সে আবারও তাকালো নীলার দিকে। নরম গলায় বললো
“আমি তো তোকে আমার ভালো বন্ধুই জানতাম, আর তুই কিনা নিজের দোষ চাপাতে আশাকে বলছিস আমাকে ধরার জন্য?
আশা অবাক হয়ে বললো
“তুমি শুনেছো কথাগুলো?
“হ্যাঁ, সবটাই শুনেছি।। ওয়াশরুমে যেতে গিয়েও যেতে পারিনি, তার আগেই তোদের কথা আমার কান অব্দি পৌঁছে গেছিলো, আমি ফিরে এসেছিলাম কি হয়েছে শোনার জন্য। কিন্তু ভাবতে পারিনি, এত জঘন্য কিছু শুনবো।
নীলা মাথা নিচু করে বসে আছে। আশা আবারও বললো
“তোমার কি এমন ক্ষতি করেছিলাম আমি? আমি তোমাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করতাম, নিয়াশার চেয়েও বেশি। আমিতো ভাবতাম রানাকে বোধহয় নিয়াশাই সব তথ্য দিচ্ছে, কিন্তু ভাবতেও পারিনি তুমিই রানার সাথে হাত মিলিয়েছো। আমার এখন নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে, কারণ আমি এতদিন একজন নির্দোষ মানু্ষকেই ভুল বুঝে আসছিলাম। নিয়াশা এবার নিরীহ গলায় বললো
“আমাকে ভুল বুঝার পেছনে তোর কিছু না কিছু কারণ আছে। আমি তোকে সবার সামনে হুমকি দিয়েছিলাম, বাসায়ও প্রায়শই ঝামেলা করতাম। কিন্তু নীলা, সে কেন তোর সাথে এমন করলো?
আশা ধীরস্থির ভাবে বললো
“সেটাই তো জানতে চাইছি আমিও। আমার জানামতে ওর সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা ছিলো না। তাহলে কেন এমনটা করলো?
নীলা এবার রেগে রেগে। সামান্য তেজ নিয়ে ঝাঝালো গলায় বললো
“তো আর কি করতাম আমি?
আশা আর নিয়াশা দুজনই অবাক হয়ে তাকালো নীলার দিকে। নীলার সারা শরীর কাঁপছে রাগে, এত কিসের রাগ? মাথার আসছেনা আশার। নীলা বলতে লাগলো
“সেই প্রথম দিন থেকেই সাদকে ভালো লাগতো, একসময় ভালোও বেসে ফেললাম।
“সাদকে তুইও ভালোবাসতিস? কই, কখনও তো বলিস নি!! অবাক হয়ে বললো নিয়াশা।
“হ্যাঁ বাসতাম, মনে প্রাণেই ভালোবাসতাম। কিন্তু তোর মতো ঢোল পেটাতে পারতাম না।
নীলা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবারও বললো
“তখন খুব রাগ হতো যখন দেখতাম সাদ আমাকে নয়, তোদেরকে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছে। তোদের কত সুন্দর নাম করে ডাকতো, অথচ আমার সাথে কোনো কথাই বলতো না। আনি তোদের মতো সুন্দরী নয় তাই। আমার রাগ আশার প্রতি ছিলোনা, ছিলো তোর প্রতি। কারণ সাদ তোকেই বেশি গুরুত্ব দিতো।
“কিন্তু তোকে দেখে তো বুঝা যেতো না তুই রেগে আছিস কিনা!! প্রশ্ন করলো নিয়াশা। নীলা বললো
“না, আমি রাগটা দেখাতাম না। নিজের মধ্যেই পুষতাম। তবে উপরে উপরে তোকে সাপোর্ট দেওয়ার অভিনয় করলেও মাঝে মাঝে তোকে অনুৎসাহিত করতাম, যেনো সাদকে ভালো না বাসিস। এও বলতাম তুই বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে চাইছিস, তুই লোভ করছিস। কিন্তু তাতেও তোর মন সাদের থেকে সরে নি।
নিয়াশা এবার দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। এতক্ষণ আশা ওর কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো। এবার মুখ খুললো সে। প্রশ্ন করলো
“মানছি নিয়াশার প্রতি একটা রাগ তোমার ছিলো, কিন্তু সেই রাগটা আমার উপর কেন এলো জানতে পারি? আমিতো কখনো সাদকে ভালোবাসার কথা বলিনি, কিংবা ওর সাথে কোথাও ঘুরতেও যায়নি। তাহলে আমাকে কেন এতো ঘৃণা করো তুমি?
নীলা দম নিয়ে বললো
“তুই ভালোবাসার কথা না বললে কি হবে, সাদ তো ঠিকই বলেছে।
আশা কিঞ্চিৎ ভ্রু বাকিয়ে বললো
“মানে?
“ভার্সিটির সকলের সামনে সাদ তোকে ওর গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিয়েছে। সেদিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না, খুব রাগ হচ্ছিলো। আর সেদিনই তোকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। যখন দেখলাম রানা তোর উপর অনেক ক্ষেপে গেছে, এক গাদা লোকের সামনে নিয়াশাও তোকে হুমকি দিয়েছে, তখনই ডিসাইড করলাম এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। রানার সাথে পার্সোনাল ভাবে যোগাযোগ করলাম, ওকে তোর ব্যাপারে সমস্ত ইনফরমেশন দিতাম। আমি জানতাম, আমার ব্যাপারে তোর বিন্দুমাত্র সন্দেহ হবেনা, যদি কাউকে সন্দেহ করিস তাহলে সেটা নিয়াশাকেই করবি। তাই আমার মনে ন্যুনতম বিচলিত বোধও হতোনা।
আশা হতাশ গলায় বললো
“আমার প্রতি তোমার এতো ঘৃণা?
নীলা রাগ ঝেড়ে বললো
“হ্যাঁ ঘৃণা করি তোকে, প্রচুর ঘৃণা করি। তোর কারণে সাদ শহর ছেড়ে তোদের বাড়ি গিয়ে থেকেছে গোটা তিন চারটে দিন। তোদের মধ্যে যদি কিছু নাই থাকতো তাহলে কি সে যেতো তোদের বাড়ি? জানিস তুই, এই কটা দিন ওকে না দেখে আমার কতটা কষ্ট হয়েছে?
আশা বিস্ময় নিয়ে বললো
“আমি জানতাম না সে যাবে। হটাৎ করেই সে গিয়েছে, আমিও অবাক হয়েছিলাম।
নীলা চাপ আক্রোশে হেসে বলল
“অভিনয় কম কর, তোকে আমার চেনা হয়ে গেছে। উপরে থাকিস একরকম আর ভেতরে অন্যরকম। দোমুখো সাপ একটা…
আশার ভেতরে হটাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো। বিনা কারণেও এতো অভিযোগ তার প্রতি? সে নীলাকে আবারও নিরিহ গলায় বললো
“আমার রুমে তাহলে ময়লা…
কথাটা শেষ করার আগেই নীলা বলে উঠলো
“ওই সব আমি করেছি, রানার কথায়। তোর রুমের একটা ডুব্লিকেট চাবি বানিয়ে রেখেছিলাম, সেটা দিয়েই তোর রুমে ঢুকেছিলাম। আর তোর নতুন ফোন নাম্বারও আমিই ওকে দিয়েছি। ইনফ্যাক্ট, আগামীকাল যে তুই বাড়ি যাবি সেটাও আমিই রানাকে বলেছি। আশা অবাক হয়ে বললো
“আমি আগামীকাল বাড়ি যাবো সেটা তুমি কি করে জানলে?
নীলা কুৎসিত ভাবে হেসে বললো
“তুই যখন তোর ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলি, তখনই শুনেছি আমি।
আশা হতাশায় বসে রইলো ওখানেই। মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরোচ্ছেনা। নিয়াশা এবার দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললো
“আমি ওকে হুমকি দিয়েছিলাম ঠিকই, রেগেও ছিলাম। কিন্তু সেটা শুধুই আমার মুখের কথা ছিলো। আমি কখনোই চাইতাম না আশার কোনো ক্ষতি হোক। সেদিন যখন রানা ওকে থাপ্পড় দিলো, তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো, ইচ্ছে হয়েছিলো ওকে টেনে নিজের সাথে করে নিয়ে আসি। কিন্তু ওই যে রাগ, ইগো… সেই কারণেই ওকে ফেলে চলে এসেছিলাম। বিশ্বাস কর নীলা, আমার অনেক খারাপ লেগেছিলো। সাদ যখন ওর কাছে যেত, ইনফ্যাক্ট গভীর রাতেও ওকে আশার রুমে যেতে দেখেছি। যদিও কোনো বাজে চিন্তাধারা নিয়ে যায় নি, কিন্তু গিয়েছে তো। আশার প্রতি রাগ হয়েছে তখন, তাও ওর ক্ষতি করার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আর তুই, তুইতো সবকিছু ছাপিয়ে গেলি…
নীলা নির্বাক। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে।
আশা এবার উঠে পরলো। নীলার উপর ওর খুব রাগ হচ্ছে, কিন্তু ইচ্ছে করছেনা সেই রাগের রেশ টেনে লম্বা করতে। ইচ্ছে করছেনা তাকে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে। সে নিয়াশার দিকে তাকালো… অস্ফুটে বললো
“আগামীকাল সকালে আমি বাড়ি চলে যাবো নিয়াশা। জানিনা, আর ফিরবো কিনা। এতকিছুর পরেও এই শহরে ফিরে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। তোমরা ভালো থেকো, আমার জন্য তোমরা দুজন এতোদিনের বন্ধুত্ব নষ্ট করো না। নিয়াশা অবাক হয়ে বলল
“তুই কেন শহর ছেড়ে চলে যাবি, কেন একজন খারাপ মানুষের খারাপ আচরণের জন্য নিজের লেখাপড়া নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করবি। কারো যদি বেশি সমস্যা হয়ে থাকে, যদি কেউ অন্যের ভালোটা সহ্য করতে না পারে তাহলে সে চলে যাক জাহান্নামে। আমরা কেউই বাধা দিবো না।
নিয়াশার মুখ থেকে এ কথা শোনার পর নীলা অদ্ভুতভাবে তাকালো ওর দিকে। ঠোঁট জোড়া কাপছে তার। কিছু হয়তো বলতে চাইছে। আশা নীলার দিকে তাকিয়ে বললো
“আমি অন্যের সুখে ঈর্ষান্বিত হই না, আমি নিজের স্বার্থে কারো ক্ষতিও কামনা করতে পারি না। বরং আমি চাই, আমার কষ্ট হলেও সেই কষ্টের বিনিময়ে কেউ সুখী হোক। এটাই আমার ফ্যামিলির শিক্ষা।
আশা আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। দ্রুতপায়ে চলে এলো সেখান থেকে। রুমে এসে ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়। খুব কষ্ট হচ্ছে আজ। এতটাও এক্সপেক্ট করেনি সে।
পরের দিন খুব ভোরে বেরিয়ে পরে আশা। এত সকালে স্টেশনে যাবার মত কোনো সিএনজি কিংবা রিক্সার দেখা সে পাচ্ছেনা। ব্যাগটা কোনোমতে টেনে টেনে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো আশা। সামনে বড় রাস্তার একটা মোড় আছে, কোথাও কিছু না পেলেও সেখানে হয়তো কিছুর দেখা পেতে পারে সেই আশায়। আশা যখন মোড়ের কাছাকাছি গিয়ে পৌছুলো তখন দেখতে পেলো মোড় ঘেঁষে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, যাদেরকে এর আগে সে রানার সাথে দেখেছিলো। ছেলেগুলো সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে। আশার ভেতরে হঠাৎ ভয় কাজ করতে লাগলো, সে নিশ্চিত ছেলেগুলোকে এখানে রানাই পাঠিয়েছে। গতরাতে সে বলেছিলো, সে যেনো বাড়ি যাবার নামও না নেয়। আশা এবার চিন্তায় পরে গেলো, ছেলেগুলো কি তাকে ধরে নিয়ে যাবে? নাকি রাস্তায় অসভ্যতা করবে? এবার কি করা উচিৎ তার? একবার যদি ওরা আশাকে দেখে নেয়, তাহলে নিশ্চিত কোনো কোনো ঝামেলা করবেই।
আশা সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ভয়ে ভয়ে এক পা দুপা করে পিছিয়ে যেতে লাগলো। আর যাইহোক, এদের সামনে যাওয়া যাবেনা।।
আশা যখন কয়েক পা পিছনে গেলো ঠিক তখনই সে গিয়ে ঠেকলো কারো গায়ে। এক মুহূর্তের জন্য তার দম বন্ধ হয়ে গেলো। শেষ রক্ষেটা বুঝি আর হলো না।
চলবে…..
#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-২৫
আশা যখন কয়েক পা পিছনে গেলো ঠিক তখনই সে গিয়ে ঠেকলো কারো গায়ে। এক মুহূর্তের জন্য তার দম বন্ধ হয়ে গেলো। শেষ রক্ষেটা বুঝি আর হলো না।
আশা ভয়ার্ত চোখে পেছন ফিরে তাকালো। অতঃপর ধরে প্রাণ এলো, এটা রানা কিংবা তার কোনো লোক নয়। একজন সিএনজি ওয়ালা। কিছুক্ষণ আগেও উনি এখানে ছিলেন না। এইমাত্রই এখানে এসেছেন, অতঃপর সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছেন। লোকটি আশাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বললে
“কি ম্যাডাম, রাস্তাঘাটে একটু দেইখা চললে ক্ষতি কি? আর উলটো হয়ে হাঁটতেছেন কেন?
আশা জোরপূর্বক হেসে বললো
“না, মানে…
এরপর হঠাৎ কি যেনো ভেবে উৎফুল্ল গলায় বলে উঠল
“আপনি স্টেশনে যাবেন?
“কোন স্টেশন, তেজগাঁও নাকি?
আশা যেখানে আছে সেখান থেকে তেজগাঁও স্টেশন টা কাছে। প্রত্যেকবার সে তেজগাঁও দিয়েই যাতায়াত করে, কিন্তু এইমুহূর্তে সে সেখানে যাবে না। যদি রানা ওর খোঁজে ওখানে গিয়েও পৌছায়..!!
আশা মুচকি হেসে বললো
“নাহ, কমলাপুর রেলস্টেশনে..
লোকটি কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো
“যামু, কিন্তু ভাড়া বেশি দেওন লাগবো।
আশার চোখেমুখে খুশির ঝলকানো দেখা গেলো। ভাড়া বেশি লাগলে লাগুক, যাবার মত একটা বাহন যে পাওয়া গেছে এটাই অনেক। সে চটপট সিএনজি তে উঠে বসলো। কিছুক্ষণ আগে ছেলেগুলো যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান দিয়েই স্টেশনের রাস্তা। তবে আশা অবাক হলো ভীষণ, কারণ ওই রাস্তাটা যখন সিএনজি পার হচ্ছিলো তখন ছেলেগুলো ওখানে ছিলো না।
পুরোটা রাস্তা নির্বিঘ্নে পার হলো আশা..। বাড়ি গিয়ে পৌছুতে পৌছুতে দুপুর হলো। যখন বাড়ির ভেতরে গিয়ে সে প্রবেশ করলো, অজানা এক আনন্দে মনটা ভরে গেলো। এ বাড়িটা ছেড়ে সে কিভাবে দূরে পরে থাকে। আশা প্রফুল্লচিত্তে রুমে গিয়ে ঢুকলো। আদিব সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। আশা চুপি চুপি ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ওর চোখদুটো চেপে ধরলো। আদিব মুচকি হেসে বললো
“আশামনি..
আশা চোখে ছেড়ে দিয়ে ওর সামনে গিয়ে বসে সামান্য মুখ ভার করে বসে বললো
“তুই কিভাবে বুঝলি এটা আমি?
“আমার বোনের স্পর্শ আমি চিনবো না তো কে চিনবে শুনি!
আশা হাসলো। ব্যাগটা কাধ থেকে নামিয়ে সোফার এক কোনায় রেখে বললো
“এই টাইমে বাড়িতে কি করছিস, দোকানে যাস নি?
আদিব হেসে বললো
“গিয়েছিলাম, কিন্তু চলে এসেছি।
“মা কোথায়?
“রুমেই আছে।
“আর ভাবী?
“রান্না করছে।
“এই টাইমে রান্না?
“হুম। ওর কি এক আত্মীয় নাকি আসবে আজ।
“আমাদের বাড়ি আসবে?
“হুম।
“কে আসবে?
“ওকেই গিয়ে জিজ্ঞাসা কর।
“ওহ, আচ্ছা থাক। আমি মায়ের সাথে আর ভাবীর সাথে দেখা করে আসি।
আদিব মাথা নেড়ে সায় জানালো।
আশা এক দৌড়ে মায়ের রুমের দিকে চলে গেলো। মা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে তসবিহ জপছেন। আশা মুচকি হেসে মাকে ডাকলো
“মা…
দিলারা ধীরে ধীরে চোখ মেলে সামনের দিকে তাকালো। একমাত্র মেয়েকে চোখের সামনে দেখে উনি খুশির হাসি হাসলেন। মেয়েকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
“কেমন আছিস রে মা?
“ভালো আছি, তুমি ভালো আছো তো মা?
“আছি আলহামদুলিল্লাহ। রাস্তায় একা আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো আবার?
আশা মুচকি হেসে বললো
“কোনো সমস্যা হয়নি।
দিলারা হাসলেন। আশা দুহাতে জরিয়ে ধরলো মাকে। কতদিন পর মায়ের স্পর্শ সে পাচ্ছে।।
মায়ের সাথে কিছুটা সময় পার করে সে চলে গেলো রান্নাঘরে। মৃদুলা একমনে রান্না করছে, আশাকে দেখতে পেয়ে মুখে হাসি টেনে সে বললো
“চলে এসেছো?
“হ্যাঁ। ভালো আছো ভাবী?
মৃদুলা হেসে বললো
“অনেক ভালো আছি।
“তোমার নাকি কোন আত্মীয় আসবে?
মৃদুলা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো
“আমার এক দূরসম্পর্কের বোন আছে, ওর বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। ওর শশুরবাড়ির লোকজন ঢাকার স্থানীয়। তো ওর এক দেবর আছে, সে নাকি বায়না করেছে গ্রাম ঘুরে দেখার। এখন তার তো বাবা মা কেউ নেই, কোনো ভাইবোনও নেই। একাই ছিলো সে। গতরাতে আমার কাছে ফোন করে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করলো, তাই আমি তোমার ভাইয়ের সাথে আলাপ করে বলে দিলাম এখানে এসে বেড়িয়ে যাবার জন্য। যতই হোক, বোন বলে কথা..
মৃদুলা আবারও রান্নায় মন দিলো, আশা মুচকি হেসে বললো
“ভালো করেছো ভাবী, গ্রামের সৌন্দর্য সবাই উপভোগ করতে চায়। ওরা এলে আমাদেরও ভালো লাগবে, সময়টা কাটবে ভালো।
আশা কিছুটা সময় ওখানেই মৃদুলার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এক সময় মৃদুলা বললো
“এতটা রাস্তা জার্নি করে এসেছো, গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও, আমি তোমায় খাবার দিচ্ছি।
আশা হাসিমুখে সায় জানিয়ে চলে এলো সেখান থেকে।
বিকেলের দিকে মেহমানরা বাড়ির গেইটের সামনে এসে একটা সিএনজি থেকে নামলো। মৃদুলা আর আদিব হাসিমুখে এগিয়ে গেলো তাদের রিসিভ করতে। পেছন পেছন আশাও গেলো। সে যথারীতি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। সিএনজি থেকে একজন সুন্দরী দেখতে মেয়ে নামলো, সে ভাবীর চাইতে বয়সে কিছুটা বড় হবে। উনিই নিশ্চয়ই ভাবীর সেই বোন হবে, ঠিক সেটাই হলো। ভাবী গিয়ে উনাকে স্বপ্না আপু বলে জড়িয়ে ধরলো। পেছন থেকে আরেকজন নেমে এলো৷ ভদ্রলোকটিও দেখতে বেশ চমৎকার। উনি তার বর হবে হয়তো। আদিব উনার সাথে হ্যান্ডশেক করে কুশল বিনিময় করছে। আশা এবার মুচকি হেসে এগিয়ে যেতে লাগলো তাদের দিকে। কয়েক পা এগোতেই হঠাৎ সে থমকে গেলো। কারণ সিএনজি থেকে আরেকটা মানুষ নেমেছে।
আশা নিজ জায়গায় জমে গেলো হঠাৎ। এ লোক এখানে কেন এসেছেন?
দেখতে দেখতে ছেলেটা সবার সাথে কুশল বিনিময় করে এক পর্যায়ে আশার দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোনে বাকা হাসি টেনে চোখের ইশারায় বুঝালো, “আমার কাছ থেকে পালানো এতটাও সহজ নয়।
আশা আতংক নিয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এমন সময় মৃদুলা ওকে ডাকলো।
“আশা, এদিকে এসো।
আশা চমকে তাকালো মৃদুলার দিকে।। আদিব হেসে বলল
“আয় আশামনি।
আশা ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। মৃদুলা আশাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো
“এ আমার একমাত্র ননদী।
মেয়েটি বললো
“ওমা, কি সুন্দর তোর ননদ।
আশা জোরপূর্বক হেসে বললো
“ভালো আছেন?
স্বপ্না নামের মেয়েটি কথার জবাব না দিয়ে হাসিমুখে বললো
“উনি আমার হাজবেন্ড।
আশা মুচকি হেসে উনার সাথে কুশল বিনিময় করলো। এরপর মেয়েটি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হেসে বললো
“আর এ আমার এরকম দেবর.. রানা।
আশা ভ্রু বাকিয়ে আরেকবার তাকালো রানার দিকে।
রানা ঠোঁট বাকালো সকলের অলক্ষে..
আশা অবাক হলো, এ রানা আর ঢাকায় দেখে আসা রানার মধ্যে দিনরাত তফাৎ। ঢাকায় যে রানাকে সে চিনতো সে ছিলো পুরোই গুন্ডা, দেখলেই বুঝা যেতো বখাটেদের লিটার সে। কিন্তু এখানে সে কত পরিবর্তন। না আছে কানে টপ, না আছে গলায় চেন, হাতে ব্রেসলেট, আর না আছে চুলের সেই বিদখুটে স্টাইল। একদম ভদ্রসভ্য ছেলে, কিন্তু ভেতরটা আগের মতই রয়েছে যেটা ওর ঠোঁটের বাকা হাসি দেখলেই বুঝা যায়।
আশার গা জ্বলে যাচ্ছে, ইচ্ছে করছে এক্ষুনি একে এখান থেকে তারিয়ে দেক, সবাইকে বলে দেক এর কুৎসিত রুপটার কথা।
কিন্তু প্রচন্ড ইচ্ছে থাকলেও সে এইসব বলতে পারছেনা, কারণ উনারা তার ভাবীর মেহমান। এদের অসম্মান করা মানে ভাবীকে অসম্মান করা।
যথারীতি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো সকলেই। আশা আগেই চলে এসেছিলো। রুমে ঢুকে সবাইকে বসতে দিয়ে একটু নাস্তার ব্যবস্থা করায় মন দিলো মৃদুলা। আশাকেও ডাকলো সে, একহাতে সামলাতে কিছুটা হিমশিম খাচ্ছে সে। আদিব ওদের পাশে বসে কথাবার্তা বলছে, দিলারাও আছেন এখানে। আশাকে কয়েকবার ডাকার পর সে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে এসেছে সে, মুখটা গোমড়া হয়ে আছে। আদিব খেয়াল করলো সেটা। সে উনাদের কাছ থেকে বিনয়ের সাথে উঠে গিয়ে আশার কাছে গেলো। চুপি চুপি বললো
“কি হয়েছে আশামনি? তোকে এমন দেখাচ্ছে যে!
আশা আদিবের দিকে তাকালো। ইচ্ছে করলো সবটা বলে দিক। কিন্তু পরক্ষনেই মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো
“কিছুনা ভাইয়া, জার্নি করে এসেছি তো তাই শরীরটা ক্লান্ত লাগছিলো।
আদিব বললো
“তাহলে তুই তোর রুমে চলে যা। এখানে থাকার কোনো প্রয়োজন তোর নেই।
আশা হেসে চলে যেতেই চাচ্ছিলো ঠিক এমন সময় মৃদুলা ডেকে বললো
“একটু এখানে আসো তো আশা…
আশা হতাশ চোখে তাকালো সেদিকে। এরপর একবার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। আদিব পেছন থেকে বললো
“ওর শরীরটা ভালো নেই, ওর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কি করা লাগবে আমায় বলো, আমি করে দিচ্ছি।
মৃদুলা অবাক হয়ে তাকালো। বললো
“এমা, কিছুক্ষণ আগেই তো দেখলাম ভালো, এরইমধ্যে কি হয়ে গেলো।
আশা হেসে বললো
“তেমন কিছুনা ভাবী, এমনিতেই ভালো লাগছেনা।
“ওহ, তাহলে যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও।
আশা যাবার আগে একবার রানার দিকে তাকালো। রানা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, চোখেমুখে একটা লুলুপ দৃষ্টি কাজ করছে৷ আশা ঘৃণার সাথে চোখ সরিয়ে নিলো, হনহন করে চলে গেলো সেখান থেকে।
সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলে সকলে মিলে আড্ডায় বসে। মৃদুলা আর স্বপ্না একপাশে বসেছে। অন্যপাশে আদিব, স্বপ্নার হাজবেন্ড আর রানা। সকলেই খোশগল্পে মশগুল।। আড্ডা আর কথাবার্তার এক পর্যায়ে রানা বললো
“আমাদের বিয়ানকে যে দেখছি না, উনি কি আমাদের দেখে বিরক্ত হচ্ছেন নাকি?
মৃদুলা চাপা হেসে বললো
“কি যে বলো, বিরক্ত হবে কেন। আসলে সেও আজই বাড়ি এসেছে ঢাকা থেকে। তাই বোধহয় ক্লান্ত আছে।
“আমরাও তো আজই এলাম, কই আমরা তো এতটাও ক্লান্তি বোধ করছিনা।
আদিব হেসে বললো
“আসলে সবার শরীরের কন্ডিশন তো আর একরকম না।।
স্বপ্না মুচকি হেসে বলল
“হয়তো।
কয়েক মিনিট বাদে রানা সকলের মধ্যে থেকে উঠে চলে গেলো।
সে আস্তে আস্তে গিয়ে দাড়ালো আশার রুমের সামনে। দরজাটা ভিড়ানো। রানা আশপাশটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে ফট করে ঢুকে পরলো আশার রুমে। কোনো কথাবার্তা ছাড়ায় ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কুৎসিত হাসি হেসে তাকালো আশার দিকে। আশা ঘুমিয়ে আছে, ঘরে কেউ ঢুকেছে কিনা সেটা আর বোধগম্য নয়। রানা বিশ্রীভাবে আশাকে পরখ করলো কয়েকবার। এরপর এগিয়ে যেতে লাগলো ওর দিকে। আশা তখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রানা একদম আশার কাছাকাছি গিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে দাড়ালো। এরপর বিদ্রুপের হাসি হেসে বললো
“একবার যখন প্রতিজ্ঞা করেছি প্রতিশোধ নিবো, সেটা তো করেই ছাড়বো। তোর জীবনটা নরক না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
রানা ওর ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা আশার কপালে রাখলো। ঘুমের মধ্যে আশা নড়েচড়ে উঠলো সামান্য। রানা ওর আঙুল কপাল বেয়ে নিচের দিকে নামাতে লাগলো। এক পর্যায়ে আঙুল গিয়ে ঠেকলো ওর ঠোঁটের ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে। রানা আবারও বিশ্রীভাবে হেসে এগিয়ে যেতে লাগলো আশার ঠোঁটের দিকে….
চলবে…