ভালোবাসি তাই পর্ব-২৬+২৭

0
484

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-২৬

হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেলো আশার। চোখ মেলেই দেখতে পেলো রানা খুব বিশ্রীভাবে ঝুকে আছে তার দিকে, ইনফ্যাক্ট সে আশার মুখের একদমই কাছে। এমতাবস্থায় প্রচন্ড পরিমাণে ঘাবড়ে গেলো সে। ওকে সজাগ হতে দেখে আবারও সেই বিশ্রী হাসিটা হাসলো রানা, এগিয়ে যেতে লাগলো আগের মতোই। আশার এবার সম্ভিত জ্ঞান ফিরলো, এই মুহূর্তে তাকে রক্ষা করতে হবে। সে শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে রানাকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিলো। ধাক্কার বেগ এতটাই ছিলো যে রানা ছিটকে গিয়ে পরলো মেঝেতে। প্রচন্ড পরিমাণে রেগে গেলো রানা। আশা ধপ করে বিছানায় বসে হাপাতে লাগলো। রানার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রচন্ড আক্রোশে বলে উঠলো
“কেন এসেছেন এখানে? কেনোই বা করছেন আমার সাথে এমনটা? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার?
রানা মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বললো
“গলা নামিয়ে কথা বল। কেন এসেছি জানতে চাস? তোর জীবনটা নরক বানাতে এসেছি।
আশা প্রচন্ড হতাশায় বলে উঠলো
“মানুষ নামের জানোয়ার আপনি।
“এ কথা পূর্বেও অনেকবার বলেছিস, নতুন কিছু থাকলে সেটা বল।
আশার রাগ বেড়েই চলেছে, পারছেনা নিজেকে কন্ট্রোল করতে।

একটা সময় খুব কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোলে এনে শান্ত গলায় বললো
“আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা পেলেন কোথায়? নীলা বলেছে?
রানা এবার কোনো কথা বললোনা। আশা আবারও বললো
“মানলাম নীলাই বলেছে, কিন্তু আপনার ভাবী আমার ভাবীর বোন সেটা কিভাবে জানলেন?
রানা এভার হু হু করে হেসে উঠলো। বললো
“এতো বুদ্ধিমতী তুমি, তাও বুঝো না?
আশা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো রানার দিকে৷ ওর বলা কথাটা আশার কাছে বোধগম্য হচ্ছেনা। রানা আবারও কর্কশ গলায় বললো
“তোর ভাইয়ের বিয়ের অনেক ছবিই আমার ভাবীর কাছে পাঠিয়েছে তোর ভাবী। সেই ছবিতেই তোকে দেখেছি আর জেনেছি তোর ভাবী আমার ভাবীর আত্মীয়।

আশা কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো আবারও। এবার রানা বলে উঠলো
“আল্লাহও আমায় কত ভালোবাসে দেখেছিস? কত যত্ন করে তোর ফ্যামিলির সাথে আমার ফ্যামিলির আত্মীয়তা করে দিছে, আমার কাজটা সহজ করে দিছে।
“ওই কুৎসিত মুখে আল্লাহর নাম মানায় না।
রানা হেসে বললো
“আরো অনেক কিছুইই মানাবে, শুধু দেখে যা আমি কি কি করি। আর হ্যাঁ, প্রস্তুতি নে নরকে যাবার জন্য।
আশা বিস্ময় নিয়ে বললো
“মানে?
রানা এবার আশার কাছাকাছি চলে এলো। অত্যন্ত বিষাদ গলায় বলে উঠলো
“মানেটা নাহয় সময় হলেই জানবি।

রানা চলে গেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে আশা। চোখের কোনে পানি। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে সে। চিন্তায় অস্থির, কি চায় এই সাইকোটা!!
রাতের খাবার রেডি হলে আশাকে ডাকতে আসে মৃদুলা। আশা তখন জানলার গ্রিলে মাথা রেখে চোখ বুঝে বসে ছিলো। মৃদুলা নরম গলায় ওকে ডেকে বললো
“আশা খেতে এসো।
আশা চোখ মেলে তাকালো। ধীরস্থির কন্ঠে বলল
“আমার খিদে নেই ভাবী। তোমরা খেয়ে নাও। মৃদুলা এগিয়ে এসে বসলো আশার পাশে। কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে এক নজরে তাকিয়ে থেকে বললো
“আমার মেহমান আসায় তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?
আশা ক্ষীণ কন্ঠে বললো
“এমনটা কেন বলছো ভাবী?
“ওরা আসার পর থেকেই দেখছি তুমি ওদের সামনে যাচ্ছো না, নিজের রুম থেকে বেরও হচ্ছো না।।
“বলেছিলাম তো ভালো লাগছেনা।

মৃদুলা একটা উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বললো
“আচ্ছা যাইহোক, খাবে চলো।
“আমার খিদে নেই সত্যি।
মৃদুলা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে উঠে পরলো সেখান থেকে। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারও কি মনে করে আশার কাছে ফিরে এলো সে। ঠোঁটে সামান্য হাসি টেনে বললো
“একটা কথা বলবো?
“বলো।
“আমার যে বোনটা এসেছে ওর দেবরটাকে তো
দেখেছো নাকি?
রানার কথা আসতেই চমকে তাকালো আশা৷ সে কি ওদের কাছে আশার নামে কোনো উল্টাপাল্টা কথা বলেছে নাকি? আশা ঘাবড়ে গিয়ে বললো
“কেন, কি হইছে?
“কিচ্ছু হয়নি, আগে বলো ওকে ভালো করে দেখেছো কিনা?
আশা বিস্ময়ের সাথে বললো
“দেখেছি তো। কেন?
“ওকে তোমার কাছে কেমন লেগেছে বলোতো?
আশা ভ্রু বাকিয়ে বললো
“কেমন লেগেছে মানে?
“ভালো লেগেছে নাকি লাগেনি?
“হঠাৎ এই কথার মানে কি ভাবী?

মৃদুলা এবার সামান্য বিরক্তবোধ করলো। সে আবার পা বাড়ালো যাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে বলে গেলো মানেটা তোমার ভাই তোমাকে বলে যাবে, এত প্রশ্ন করো তুমি ওহ!
আশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মৃদুলার যাওয়ার পথে। এ ভাবী রানাকে নিয়ে এটা কি বললো? এ কথার মানে কি?
কিছুক্ষণ পর আবারও মৃদুলা ফিরে এলো আশার রুমে। কিন্তু এবার সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলো আশার পাশেই। আশা চোখের ইশারায় বললো
“কি?
মৃদুলা কয়েক সেকেন্ডের মাথায় বললো
“এ রুমটা তোমায় ছাড়তে হবে।
প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে আশা বলে উঠলো
“ছাড়তে হবে মানে?
মৃদুলা কোনো ভনিতা ছাড়াই বললো
“এ রুমে রানা থাকবে। জানোই তো আমাদের বাড়িতে রুমের সংকট। রানা ছেলে মানুষ, ওর জন্য আলাদা একটা রুমের প্রয়োজন। তাই ওকে এ ঘরেই রাখতে চাইছি।
“কি যা তা বলছো ভাবী? উনি কেন আমার ঘরে থাকবে? আর উনি এখানে থাকলে আমিই বা থাকবো কোথায়?
“তুমি মায়ের সাথে থাকবে, দুটো দিন একটু কষ্ট করে থাকতে পারবেনা?
আশা শক্ত গলায় বলে উঠলো
“অসম্ভব, আমার রুমে আমি যাকেতাকে এলাউ করবো মা। আর তাছাড়া এ বাড়িতে রুম সংকট হলেও এতটাও সংকট না যে আমার রুম ছেড়ে দিয়ে উনাকে দিতে হবে। উনার থাকার মতো রুম এ বাড়িতে আরও আছে
“যাকেতাকে কেন বলছো আশা, সে আমার গেস্ট।
আশা আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে হঠাৎ। মুখ ফসকে বলে ফেললো
“সে তোমার গেস্ট হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য সে এক উটকো ঝামেলা। আর যাইহোক, আমার রুমে আমি কোনো উটকো লোককে যায়গা দিতে পারবো না। আর উনাকে তো, একদমই না।

এ পর্যায়ে প্রচন্ডরকম রেগে গেলো মৃদুলা। তেজ দেখিয়ে বলে উঠলো
“এর কারণটা কি জানতে পারি?
আশা বিছানার দিকে তাকালো। এ সেই বিছানা যে বিছানায় সাদের গায়ের স্পর্শ এখনো লেগে আছে, এই সেই বালিশ, যে বালিশে সাদের মাথার সেই সিল্কি চুলের অদ্ভুত ঘ্রাণ মিশে আছে৷ আশা এ রুমে উপলব্ধি করে সাদকে, যে তার ভালোবাসা। এ বিছানা জুরে সাদের অস্তিত্ব খুজে পায় আশা। সাদকে অনুভব করতে পারে এখান টায়। সে তার ভালোবাসার অস্তিত্বের মধ্যে কি করে এক বখাটেকে যায়গা দিতে পারে?
মৃদুলা এবার বলে উঠলো
“আমার যখন বিয়ে হয়েছিলো, তখন একটা ছেলে এই রুমে থেকেছিলো রাইট? আমি শুনেছি সবটা, সে তোমার বাড়িওয়ালার ছেলে, বিদেশে থাকে। অনেক টাকাওয়ালা। সে যখন থেকেছে তখন কিন্তু তুমি দ্বিমত করো নি। সেটা কি তার টাকার কারণেই? যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে শুনো, রানাও কিন্তু কোনো দিন থেকে কম না, টাকাপয়সার মাঝে সে গড়াগড়ি খায়। নেহাৎ আমার বাড়ি দাওয়াত করে এনেছি, তাই দায়ে পরে তোমার কাছে দুটো রাতের জন্য ঘরটা ভিক্ষে চাইছি। কিন্তু তুমিতো….

আশা অদ্ভুতভাবে মৃদুলার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই সেই মানুষ যে কিনা কয়েকদিন আগেও ভাইয়ার কাছে ধরা খেয়ে ভালো মানুষ রুপে কথা বলেছিলো তার সাথে, আজ স্বার্থের কাছে সেটা ঢাকা পরে গেছে। মৃদুলা রেগে ফুলে আছে। আশা মৃদু হেসে বললো
“সত্যিই ভালো বললে ভাবী, তবে আমি চাইলে এর প্রতিবাদ করতে পারতাম। কারণটাও বলতে পারতাম। কিন্তু বলবো না, বললে আমার নয়, তোমার আত্মীয় হিসেবে মানসম্মানটা তোমারই যাবে৷ মনে মনে পস্তাবে এই ভেবে যে, তোমার এই আত্মীয় কতটা জঘন্য। আর হ্যা, আমি কেমন সেটা আমি জানি। তুমি আমার উপর রেগে যাও নয়তো লঙ্কাকাণ্ড করো, আমি আমার যায়গায় শক্ত। এ রুম আমি কোনোমতেই উনাকে দেবো না। আর বাড়িওয়ালার ছেলেকে রুমে থাকতে দিয়েছিলাম বললে না, বিয়ে বাড়ি মানে আদৌ বুঝো? বিয়ে বাড়িতে কিন্তু তোমার গেস্টদের মতো দুই তিনটে মেহমান থাকেনা, অনেক অনেক মেহমান থাকে। আশার রাগ হচ্ছে খুব, কিন্তু পারছেনা সেটা প্রকাশ করতে। এই রাগ ঝাড়তে পারলে বেশ হালকা লাগতো মনটা।

_______
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসের শো শো শব্দ মনের মধ্যে আলাদা এক শিহরণ জাগিয়েছে। পাশের ডোবা থেকে গুটিকয়েক ব্যাঙ সেই অনেক্ষণ ধরেই ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে। সামান্য দুরেই একটা বাঁশঝাড় আছে, সেখানে কিছুটা সময় আগেও ঝিঝিপোকার ডাক আর জোনাকির দেখা মিলেছিলো। কিন্তু বৃষ্টি নামার কারণে সেইসব উধাও। আশা এখনো জানলার পাশেই বসে আছে। অন্য সময় হলে মনোমুগ্ধের মতো উপভোগ করতো সময়টা। কিন্তু আজ সেই মানসিকতা নেই। সাদের অনুপস্থিতি তাকে ভীষণভাবে মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে, মনের আয়নাটায় আজ বার বার সাদের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে আফসোস হচ্ছে এই ভেবে, সেদিন কেন ওকে এভাবে ফিরিয়ে দিলাম, কেন বললাম না, আমিও তোমায় ভালোবাসি। এই একটা ছোট্ট ভুলের মাশুল তাকে কতটা সময় দিতে হবে জানা নেই।

অন্যদিকে রানার উপস্থিতি,
রানার কথা ভাবতেই প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে। একটা মানুষ কতটা নীচ মনের হলে এমনটা করছে পারে। ন্যুনতম মনুষ্যত্ববোধ থাকলেও হয়তো এমনটা করতে পারতো না। মনুষ্যত্ব থাকবে কি করে, সেতো কোনো মানুষের পর্যায়েই পরে না।

আশার চিন্তাভাবনার এক ফাঁকে রুমে এসে ঢুকলো আদিব। পেছন পেছন মৃদুলাও এসেছে। মৃদুলার মুখটা ভার হয়ে আছে, সে ভার হবার কারণটা আশার অজানা নয়, তাই সে নতুন করে তার কাছে কিছু জানতেও চায় নি। কিন্তু আদিবের দিকে তাকালো আশা। প্রশ্ন করলো
“কিছু বলবি ভাইয়া?
আদিব একবার দরজার দিকে তাকালো। ওর নজর লক্ষ্য করে আশাও নজর ফেরালো সেদিকে। ওই বেহায়া রানা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, এমন হাবভাব, যেনো কিছুই বুঝেনা। সহজ সরল দুগ্ধপুষ্য শিশু। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো আশার। আদিব আশার দিকে তাকিয়ে চুপিসারে বললো
“তোর ভাবীর গেস্ট হয় সে, কোনোদিন আসেনি এ বাড়ি। সে খুব করে চাইছে এ রুমে থাকতে। আমি প্রথমে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু এতটা মাখোঁ গলায় আবদার করছে, ফেরানো দায় হয়ে পরেছে। তোর ভাবীরও ইচ্ছে ও এ রুমেই থাকুম। আমার কথা চিন্তা করে দুটো দিন কষ্ট কর বোন।
“ভাইয়া তুইও!! হতাশায় বললো আশা। আদিব নিরুপায় হয়ে বললো
“আমি জানি আমার বোনটার কষ্ট হবে, কিন্তু আমি এদুজনের কাউকেই মানাতে পারছিনা, অন্তত তুই আমার কথাটা রাখ।

আশা এবার দুটানায় পরলো। এবার কি করবে সে? তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, যাইহোক, এ রুমে রানার ঠাঁই সে কিছুতেই দিবেনা। আশা একনজর মৃদুলার দিকে তাকালো। মৃদুলা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, চোখমুখ বেশ শক্ত.. এমন একটা ভাব যেনো এ বাড়িটা শুধুই তার। আশা এ বাড়ির আশ্রিতা মাত্র। আশা নজর সরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। রানার দিকে চোখ পরতেই সে আবারও সেই বীভৎস হাসিটা হাসলো, যেনো সে রাজ্য জয় করেছে।
আশার রক্ত মাথায় চেপে গেলো। এতই এ রুমে থাকার সাধ জমেছে, এ সাধ মেটাবে সে।
আশা কোনো কথা না বলে উঠে পরলো, মৃদুলা এবার দম ছেড়ে হাসলো। ভাবলো, এই বুঝি কাজ হাসিল হয়েছে। ওইদিকে রানার চোখেমুখেও এক ঝাঁক তিরস্কার।

মৃদুলা সবেমাত্র রানার দিকে ফিরেছে ওকে ভেতরে আসতে বলার জন্য ঠিক সেই মুহুর্তে ঝপ করে আওয়াজ হলো। ঘরে উপস্থিত তিনজনই ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো আশার দিকে। আশার হাতে পানির জগ, অথচ সেটা পানিশূন্য। জগের সকল পানি সে ঢেলে দিয়েছে পুরো বিছানাজুরে। আদিব হতবাক হলো, বোনের এমন ব্যবহার কখনোই সে দেখেনি। বিশেষ করে মেহমানদের ব্যাপারে সে ছিলো খুবই সজাগ। এ বাড়িতে কোনো মেহমান এসে অপমানিত হবে কিংবা ঠিকমতো আপ্যায়ন হবেনা, এটা ওর দ্বারা কখনোই সম্ভব হতোনা। কিন্তু আজ বোনের এ কোন রুপ দেখছে সে?

মৃদুলা রেগে চিৎকারে বলে উঠলো
“এটা কি করলে তুমি?
“যা করেছি বেশ করেছি, এইবার তোমার গেস্টকে বলো, যদি ইচ্ছে হয় এই ভেজা বিছানায় এসে ঘুমোতে। আমি চলে যাচ্ছি এ রুম ছেড়ে।
আশা হনহন করে চলে গেলে মৃদুলা সামান্য তেজ নিয়ে আদিবের দিকে তাকালো। ঝাঝলো গলায় বললো
“তোমার বোনের ব্যবহার ঠিক করতে বলে দিও.. আমার সাথে যেনো ঝাঁঝ দেখাতে না আসে, আমি ওর খাইও না, পড়িও না। বরং সে আমার স্বামীর টাকায় খায়, পড়ে…..

আদিব রাগীচোখে তাকালো মৃদুলার দিকে। ভারী গলায় বললো
“কার নামে কার সাথে কথাগুলো বলছো একবার ভেবে দেখেছো?
আদিবের এমন ভারী কন্ঠস্বর শুনে সামান্য দমে গেলো মৃদুলা। ভেবেছিলো চোখের সামনে বোনের এমন কান্ড দেখার পর সে বোনের পক্ষ না নিয়ে মৃদুলার পক্ষপাতিত্বই করবে। কিন্তু সেতো উলটো সুরে কথা বলছে।

চলবে……

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-২৭

মায়ের রুমের সামনে বারান্দায় গিয়ে বসে রইলও আশা। চোখদুটো টলমল করছে আজ, বার বার তাকেই কেন সব ঝামেলায় সম্মুখীন হতে হয়?
আশাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে দিলারা এগিয়ে এলো। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বললো
“অবেলায় এইখানে বসে আছিস কেন মা, ঘুমাবি না?
আশা চোখের পানি মায়ের চোখের আড়ালে কোনোমতে মুছে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো
“ঘুমাবো, আর একটু এখানে বসি। ভালোই লাগছে।
দিলারা হেসে বললেন
“শহরের বন্ধ ঘরে থাকিস, ওইখানে না আছে উঠান, আর আছে গাছপালা… একটু রোদ ছায়াও বোধহয় পাস না…
“ঠিক তাই মা।
দিলারা সেখান থেকে চলে যেতে যেতে বললো
“আমি শুয়ে পরতেছি মা, বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিস না। এমনিতে আজ আবহাওয়া ভালো না, তারউপর বাড়িতে মৃদুলার মেহমান আসছে, ওই ছেলের ভাবগতি আমার কেন জানি ভালো লাগে না। তারাতাড়ি শুয়ে পরিস।
আশা মাথা নেড়ে সায় জানালো।

দিলারা চলে গেছে প্রায় পনেরো বিশ মিনিট হতে চললো, হয়তো ঘুমিয়েও পরেছে এতক্ষণে। কিন্তু আশা, সে আগের মতই বসে আছে। উঠে যেতে ইচ্ছে করছেনা। এতক্ষণে বৃষ্টিটাও কমে এসেছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে চারিদিকে। আশা একভাবে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে৷ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলো আশা, কিন্তু নড়লো না। সে জানে কে এসেছে৷ আদিব ধীরে ধীরে বসলো আশার পাশে৷ কয়েক মুহূর্ত সেও আশার ন্যায় সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুটা সময় দুইজনই নিরব। একটা সময় নিরবতা ভেংগে আশা বললো
“কিছু বলবি আমায়?
আদিব দু চার না ভেবেই বললো
“তোর জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে। ভাবছি এটা তোকে বলা যাবে নাকি যাবেনা।
“প্রস্তাব? ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন করলো আশা।

আদিব খানিক চুপ থেকে বললো
“হুম, বিয়ের প্রস্তাব।
আশা এবার কোনো কথা না বলে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো আদিবের দিকে। আদিব এবার আশার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো
“তোর ভাবীর যে আত্মীয়রা এসেছে তারা মুলত বেড়াতে আসেনি৷ এসেছে তোর জন্য।
“আমার জন্য? অবাক হয়ে বললো আশা।
আদিব হেসে বললো
“মৃদুলার যে বোনটা এসেছে ওর দেবর মানে রানা নাকি তোকে ছবিতে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে। সে তোকে বিয়ে করতে চায়। এজন্যই এসেছে ওরা…
আশা হঠাৎ থমকে গেলো। অস্ফুটে বলে উঠলো
“এটা কি বলছিস ভাইয়া, এ কিছুতেই সম্ভব নয়। ওই বখাটেকে বিয়ে করার চেয়ে গলার দড়ি দিবো, তাও ভালো।

আদিব আশার হাত ধরে টেনে বসালো নিজের পাশে। নরম গলায় আবারও প্রশ্ন করলো
“ওরা আসার পর থেকেই তোকে দেখছি একটু অন্যরকম ব্যবহার করছিস, কিছুক্ষণ আগেও যেটা করলি, সেটা তোর সাথে কিছুতেই যায় না। আমার মন বলছে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ আছে৷ আমাকে কি বলা যাবে বিষয়টা?
আশা হতাশায় ভাইয়ের দিকে তাকালো। খুব কান্না পাচ্ছে এবার। চোখের পানিগুলোও বাঁধ মানছেনা। আদিব বোনকে এক হাতে জরিয়ে ধরে বললো
“তুই যদি কোনো সমস্যায় থাকিস আমায় বল বোন, আমি কথা দিচ্ছি, তোকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবোই… সমস্যাও মুছে দিবো সব।

আশা এবার নিজেকে স্বাভাবিক রেখে শান্ত গলায় বললো
“রানা কোথায়?
“এখনো তোর রুমেই আছে। চেয়ারে বসে আছে।
“তোর ফোনটা কোথায়?
“কেন?
“দরকার আছে।
আদিব ওর ফোনটা পকেট থেকে বের করে আশার হাতে দিলো। আশা ওর মোবাইল ঘেটে একটা নাম্বার বের করে আদিবের ফোনে উঠিয়ে ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বললো
“এবার ওই রানার কাছে যা, গিয়ে এই নাম্বারে কল কর। অবশ্যই রানা যেনো ভুলেও বুঝতে না পারে তুই কর করেছিস।
আদিব অবাক হলো। বিস্ময়ে বললো
“এটা কার নাম্বার?
“তোকে যা করতে বললাম সেটাই কর, দেখ না কি হয়।।

আদিব কিছুক্ষণ বিস্ময়ে বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে পরলো। এরপর আশাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“তুই এখানেই থাকিস, আমি আসছি।
আদিব ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আশার রুমের সামনে। জানলা দিয়ে রুমের ভেতর টা স্পষ্ট দেখা যায়। রানা রুমের ভেতর একভাবে পায়চারি করছে। আদিব ভ্রু বাকায়। এরপর ডায়াল প্যাডে থাকা নাম্বারটায় কল করে। আশ্চর্যজনক ভাবে কলটা গিয়ে ঢোকে রানার নাম্বারে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় আদিব।। কল এখনো বেজেই যাচ্ছে। রানা ফোনটা রিসিভ করে এবার। ওকে রিসিভ করতে দেখে ফোন কানে ঠেকায় আদিব। তবে কথা বলেনা। রানা ওপাশ থেকে বার বার হ্যালো হ্যালো বলে চলেছে, এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে রানা বলে উঠে..
“এই কে রে, কে আমার সাথে এমন মশকরা করস? জানোস আমি কে? তোর বাপ, একবার যদি তোর পরিচয় পাই তাইলে বুঝামু আমার সাথে মশকরা করার ফল কতটা ভয়ানক হয়।।

আদিব ফোনটা কেটে দেয় এবার। এই ভদ্রবেশী ছেলেটার ব্যবহার সত্যিই তাকে অবাক করেছে। সে সেখানে আর এক মুহুর্তও দাঁড়িয়ে না থেকে ফিরে আসে আশার কাছে। আশা ওকে প্রশ্ন করে
“কিছু দেখতে পেলি?
“ওর নাম্বার তোর কাছে কি করে? তুই ওকে চিনিস আগে থেকেই?
আশা উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে সামান্য হাসে। ধীর গলায় বলে
“বস আমার পাশে।
আদিব আশার কথা মেনে নিয়ে বসে। আশা এবার নিজের হাতে থাকা ফোনটার মেসেজ অপশন বের করে রানার নাম্বার থেকে আসা মেসেজগুলো বের করে ফোনটা আদিবের সামনে ধরে। আদিব বিস্ময় নিয়ে আশার হাত থেকে মোবাইল নেয়। এরপর অদ্ভুতভাবে তাকায় ফোনের দিকে। এক এক করে প্রথম থেকে আসা এই অব্দি সকল মেসেজ সে পড়ে ফেলে। হঠাৎ চোখমুখ শক্ত হয়ে যায় আদিবে। কপালের রগগুলো ফুলতে থাকে। শক্ত গলায় আশাকে প্রশ্ন করে
“এতসব হুমকি, এর কারণ কি?
আশা এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা। হাউমাউ করে কেঁদে জরিয়ে ধরে ভাইকে। আদিব ওকে শান্তনা দিয়ে বলে
“কাঁদিস না আশামনি, বল কি হইছে?
আশা এবার নিজেকে কোনোমতে সামলে বসে। আকাশের দিকে তাকায় সে, এতোক্ষনে তারারা উঁকি দিচ্ছে আকাশের বুকে। কালো মেঘ সরে গিয়ে সেখানে দেখা যাচ্ছে এক ফালি চাঁদ। আশা বলতে শুরু করে, সেই প্রথম দিন থেকে ঘটে আসা সকল ঘটনা, যার জন্ম দিয়েছিলো রানা।

____
পরের দিন সকাল…
দূরসম্পর্কের বোন, বোনজামাই আর বোনের দেবর যে কিনা কিছুদিন পর তার ননদী জামাই হবে, তাদের আপ্যায়নে বিশাল রান্নার আয়োজন করেছে মৃদুলা। একা হাতে সামলাতে পারবেনা তাই এলাকার এক গরীব মহিলাকে টাকার বিনিময়ে খবর দিয়ে আনিয়েছে সাহায্য করার জন্য। যদিও এখনকার সমস্ত রান্না শুধু সকালের জন্য নয়। সকালের নাস্তা হিসেবে কিছু পিঠা আর সেমাই নুডলস দেওয়া হবে, সাথে আরো কিছু ডেজার্ট আইটেম। ভারী রান্না গুলো হচ্ছে দুপুরের জন্য। আগেবাগেই সেড়ে রাখছে…
দিলারা নিজের ঘরের বিছানায় বসে পানের বাটাটা সামনে নিয়ে পান চিবোচ্ছে… আর আশা মায়ের পাশেই ঠিক উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে আছে৷ সকাল থেকে তাকে বেশ কয়েকবার ডাকা হয়েছে, কিন্তু সজাগ থাকা সত্বেও সে উঠবেনা। বেরোলেই সে জঘন্য মানুষটার মুখ দেখা লাগবে সেই জন্য।

রানাকে বেশ ভদ্রসভ্যই দেখা যাচ্ছে। একটা ব্রাশ হাতে নিয়ে বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। আদিব সেদিক দিয়ে বাইরে যাবার পথে রানাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু বাকালো। এরপর একটু হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। পিঠে সামান্য চাপড়ে দিয়ে বললো
“কি করা হচ্ছে?
রানা প্রথমে কপাল কুচকালো, পিঠে চাপড়টা ভালো লাগেনি ওর কাছে, কিন্তু নেহাৎ দায়ে পরেছে তাই মেজাজ ঠিক রাখা লাগবে৷ সেই কারণে সেটা হজম করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো
“এইতো দাঁড়িয়ে আছি ভাইয়া।
আদিব কিঞ্চিৎ হেসে বললো
“তা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে কোনো ছক কষছো নাকি?..
“মানে? ভ্রু বাকালো রানা।
আদিব প্রসঙ্গ পালটে বললো
“না বলছিলাম আমাদের এখানে কেমন লাগছে? এরপর কি করবে কোনো পরিকল্পনা করলে?
কথাটা বোধগম্য হলো না রানার। আদিব আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বললো
“আচ্ছা বাদ দাও.. থাকো তাহলে। আমি দোকানে যাচ্ছি।
“আমি আসবো আপনার সাথে ভাইয়া?
“তার দরকার নেই, আমি একাই যেতে পারি। কথাটা বলে আবারও হাসলো আদিব।
ব্যাপারটায় বেশ অপমানিত বোধ করলো রানা। কিন্তু ওই যে, সবটা হজম করা লাগবে।

বেশ কিছুটা সময় পর কাজের মহিলাটাকে রান্নাঘরে রেখে মৃদুলা এলো আশার রুমে। আশাকে এখনো শুয়ে থাকতে দেখে খানিক রাগ হলো তার। কিন্তু শাশুড়ি মা সামনে আছে তাই রাগটা ঝাড়া যাবেনা.. সে কারণে মিষ্টি স্বরে ডেকে বললো
“আশা, এখনতো উঠো। অনেক বেলা হয়ে গেছে, গেস্টদের নাস্তা দেওয়া দরকার। আমি একা হাতে কত সামলাবো বলো তো।
আশা কোনো জবাব দিলো না, আগের মতোই শুয়ে রইলো। মৃদুলা আবারও চাপা গলায় বললো
“এই আশা, কি বলছি তুমি শুনতে পাচ্ছো না?
আশা এবার তেজ দেখিয়ে উঠে বসলো। চাপা আক্রোশে বললো
“এত ডাকছো কেন?
“গেস্টদের নাস্তা দেওয়ার টাইম হয়েছে, আমি রেডি করে দিচ্ছি। তুমি একটু ওদের সার্ভ করো তো।
মৃদুলার কথায় আশার রাগ হলো। সে কিঞ্চিৎ চেচিয়ে বললো
“তোমার গেস্টদের আমি কেন সার্ভ করবো? তুমিই করো না।
মৃদুলা একবার দিলারার দিকে তাকালেন। দিলারা নিজের মতোই বসে আছেন, যেন তিনি ওদের দুইজনের কথোপকথন কিছুই শুনেন নি। মৃদুলা জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো
“তুমি সার্ভ করাবে ওদের, এর কারণ নিশ্চয়ই তোমার ভাইয়া তোমায় বলেছে।
এবার মাথা তুলে তাকালেন দিলারা। ভারী গলায় বললেন..
“কি এমন কারণ থাকতে পারে বউমা, যার কারণে আমার মেয়েকেই ওদের বেড়ে বেড়ে খাওয়াতে হবে?

মৃদুলা এবার একটু সাহস নিয়ে দিলারার সামনে গিয়ে বসলো। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো
“একটা দারুণ খবর আছে আম্মা, শুনে আপনিও অনেক খুশি হবেন?
“কি এমন খুশির খবর শুনি?
“ওই যে আমার বোনের দেবরটা দেখেছেন না, কত্ত হ্যান্ডসাম বলুন। দারুণ ভদ্র ছেলে, শহরে নিজেদের যায়গা জমি আছে, অনেক ভালো চাকরিও করে। মেয়েদের বাবারা তো উঠে পরে লেগেছে তাদের মেয়েকে ওর কাছে বিয়ে দেবার জন্য।
দিলারা ভ্রু বাকিয়ে বললেন
“কাজের কথা কও.. এত বর্ণনা আমি জানতে চাই নাই।
মৃদুলা কয়েকবার ঢোক গিলে বললো
“কিন্তু আশার একটা ছবি দেবার পর ওকে পছন্দ করে ফেলে রানা, তাই ওকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।
“কার কাছে প্রস্তাব দিছে?
“আম্মা আমার কাছে?
“তুমি কি কইলা?
“আমি তো সোজা রাজি হয়ে গেছি, তাদেরকে হ্যাঁ ও জানিয়ে দিছি। এতবড় ঘরে আমার ননদের বিয়ে হবে, এটা কি কম কথা নাকি। ওর ভাগ্য কত ভালো একবার চিন্তা করেন, রানার মতো ছেলে ওকে পছন্দ করছে। সবদিক চিন্তা করেই ওদের আসতে বলছি, তাই ওরা বিয়ে পাকা করার জন্যই আসছে।

দিলারা কিঞ্চিৎ রেগে গিয়ে বললো
“মেয়েটা আমার, কষ্ট করে মানুষ করছি আমি, সেই যায়গায় আমারে না জানাইয়া আমার মেয়ের বিয়া তুমি ঠিক করবা?
মৃদুলা সামান্য দমে গিয়ে বললো
“সকালের নাস্তার পরে উনারা আপনার সাথে কথা বলবে আম্মা।
“কথা বলা সেইটা পরের কথা, তুমি কার কাছে জিজ্ঞাসা কইরা ওদের হ্যাঁ বললা? আমার অনুমতি নিছিলা?

চলবে……