ভালোবাসি তাই পর্ব-৩৩+৩৪

0
471

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩৩

সাদ হাসলো। বললো
“ইচ্ছেগুলো অপূর্ণ রাখতে নেই। আমি নিশ্চয়ই বলবো আপনার প্রশ্নের উত্তর গুলো।
সাদ একবার ঢোক গিলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলো। আদিব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো সাদের দিকে।। সাদ এবার বলতে শুরু করলো…
“কিউটিকে কবে থেকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছিলাম ঠিক বলতে পারছিনা, হয়তো প্রথম দিন থেকেই, যেদিন ওকে দেখেছিলাম। একে দেখে এতটাই কিউট লেগেছিলো, সেদিনই আমি ওর নাম কিউটি রেখেছিলাম। একটা সুন্দর বন্ধুত্ব হয়েছিলো আমাদের। এ বন্ধুত্বের আড়ালে ওর জন্য আমার অন্য একটা ফিলিংস আছে সেটা বুঝতে পারলাম সেদিন, যেদিন আপনি ওকে বাড়ি নিয়ে চলে এসেছিলেন। দুটো দিন খুব কষ্টে কেটেছিলো আমার, মিস করছিলাম অনেক কিউটিকে। এও বুঝতে পেরেছিলাম, কিউটিকে আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।

আপনাদের বাড়ি যাওয়ার পর কিউটিকে দেখে আমার কলিজায় পানি এসেছিলো, ভালোবাসাটা তখনও প্রকাশ করিনি। যেদিন আপনার কাছে কেউ একজন কিউটির জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে আমি তখন খুবই টেনশনে পরে গেছিলাম, আপনি ওকে বিয়ে দেবার জন্য রাজি হয়ে যান কিনা সেটা ভেবে। কিন্তু যখন শুনলাম আপনি বিয়েটায় মানা করে দিয়েছেন শুধু ছেলেটা বিদেশে থাকে সেই কারণে, তখন চিন্তার পরিমাণ টা অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। শুধু চিন্তা নয়, মনের মধ্যে এক ভয় কাজ করা শুরু করে দিয়েছিলো। আমি কিউটিকে আমার মনে কথা জানানোর পর সে আমায় মানা করে দিলো, আমি জানি কিউটিও আমায় ভালোবাসে, আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু জোর কাটাতে পারছিলাম না। আমার বারবারই মনে হচ্ছিলো কিউটিকে পেতে হলে আমাকে আমার জবটা ছাড়তে হবে, কানাডাকে গুডবাই জানাতে হবে। একদিকে আমার জব, যেটা আমার লাইফের খুবই ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট, অন্যদিকে কিউটি… যে কিনা আমার পুরো লাইফ।

সেদিন অনেক মন খারাপ করেই চলে গেছিলাম, কিউটির উপর সামান্য অভিমানও হয়েছিলো। এতটুকু বলে সাদ থামলো। আদিব প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বললো
“তারপর?
সাদ মুচকি হেসে বলল
“ওখানে গিয়েও কাজে মন লাগাতে পারছিলাম, চোখের সামনে শুধু কিউটিকেই দেখতে পেতাম। বার বার মনে হতো.. আমার শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেনো কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটার তীব্র যন্ত্রণা আমি অনুভব করছিলাম। একটা সময় ডিসাইড করলাম, আমি কিউটিকে ছেড়ে কখনোই থাকতে পারবোনা। সেদিনই জবটা ছেড়ে দেশে চলে আসার প্ল্যান করি, এর জন্য যদিও আমাকে অনেক ফর্মালিটি করতে হয়েছে।

জব ছাড়ার আগে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলেছি, প্রথমে মা জব ছাড়ার কথা শুনে বেশ কিছুটা রেগে গেছিলো, কিন্তু মাকে আমি অনেক বুঝলাম, কিউটির কথা জানালাম…
কিউটিকে মা এমনিতেও অনেক পছন্দ করতো, তাই এর ব্যপারে মা আমার দ্বিমত করেনি, কিন্তু আমার ক্যারিয়ার নিয়ে খুব চিন্তিত হন তিনি। আমি মাকে শান্তনা দিয়েছিলাম এটা বলে যে, “রিজিকের মালিক আল্লাহ, তাই আমার খাবার ভবিষ্যতে কিভাবে জুটবে সেটা নিশ্চয়ই আল্লাহ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। আমাকে শুধু চেষ্টা টা করতে হবে। তাছাড়া আমার যে যোগ্যতা আছে, তিনবেলা খাবার জোটাবার মতো কোনো না কোনো জব নিশ্চয়ই পেয়ে যাবো।
আদিব এবার হেসে বললো
“আমাদের দেশে ভালো চাকরি পাওয়া খুবই দুষ্কর, যদি আনফরচুনেটলি না পাও।

সাদ মুচকি হেসে বললো
“তখন আপনাকে আমার আইডল বানিয়ে নেবো, আপনার মতো ব্যবসা শুরু করে দিবো।।
আদিব হাসলো। বললো
“সে নাহয় হলো, কিন্তু এত ভালো পজিশন ছেড়ে, ক্যারিয়ারের এত ভালো একটা দিক রেখে কেউ এভাবে চলে আসে?
সাদ বিমর্ষ কন্ঠে বললো
“বলেছি তো, ওটা আমার লাইফের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্ট ছিলো, কিন্তু কিউটি আমার পুরো লাইফ। আমি আমার পুরো লাইফটাকে ছেড়ে দিয়ে কোনো একটা পার্ট নিয়ে কিভাবে থাকতে পারি!
“দেশে ফিরলে কবে?
“গতকাল রাতে।
আদিব অবাক হয়ে বললো
“রাতে এসে সকালেই এখানে চলে এলে?
“কি করবো? খুব মিস করছিলাম যে কিউটিকে।
“আমার নাম্বার পেলে কোথায়?
“মায়ের ফোনে ছিলো।
আদিব প্রথমে অবাক হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তার মনে পরে যায় সে দিনটার কথা, যেদিন সে প্রথম সে বাসাটায় গিয়ে বোনের জন্য রুম ঠিক করে আসে। সেদিন সে সাদের মায়ের কাছে নিজের নাম্বার দিয়ে আসে এমনকি উনার নাম্বারটাও সে নিয়ে আসে।
সাদ আবারও বলতে শুরু করে,
“রওনা করেই আমি আপনার নাম্বারে কল দিয়েছিলাম। আসলে খুব আনইজি লাগছিলো, আপনারা আমাকে কিভাবে নিবেন ভেবে। তাই নিজেকে ইজি করার জন্যই আপনাকে ফোন দিয়ে এখানে আসার ব্যপারে জানানো। কিন্তু আমি বেশ অবাক হয়ে গেছিলাম এটা ভেবে যে আপনি কোনো বাজে রিয়েক্ট না করে উল্টো আমাকে আরো উৎসাহ দিয়েছিলেন তারাতাড়ি আসার জন্য…

সাদ হেসে বললো
“তুমি গতকাল রাতে ফিরেছো, আর আশ্চর্যজনক ভাবে গতকাল রাতেই আমার বোন তোমার ব্যাপারে আমাকে জানিয়েছে, সেও তোমায় প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে। মাঝখান থেকে রানাও খুব ঝামেলা করছিলো, সব মিলিয়ে আমি চাইছিলাম৷ তুমি ফিরে আসো, আর তাই হলো। আল্লাহ মনের আশা পুরো করলেন। তোমার আসার খবর পেয়ে খুবই ভালো লাগছিলো এটা ভেবে যে, আমার বোনের ভালো বাসা ফিরে আসছে। আর তুমি শুধুই আমার বোনের ভালোবাসা নও, আমার বোনের খুশি, আমার বোনের হাসি… আমার বোনের চপলতা, চঞ্চলতা… মোটকথা, ও যেমন তোমার পুরো লাইফ, ঠিক তেমনি তুমিও আমার বোনের পুরো লাইফ।

সাদ আবেশে চোখ বুঝলো। এরপরও নরম গলায় বললো
“আমি খুব টেনশনে ছিলাম, অনেক মুভিতে দেখেছি দুজনের প্রেমে তাদের পরিবারগুলো ভিলেন হয়ে মাঝে দাঁড়ায়। আমাদের মাঝেও এমন কিছু ভেবে আমার গায়ে কাঁটা দিত মাঝে মাঝে।
আদিব ভ্রু বাকিয়ে বললো
“আমাকে দেখে তোমার কি ভিলেন ভিলেন মনে হতো?
সাদ সশব্দে হেসে বললো
“মোটেও না, কিন্তু মনে তো একটা ভয় থেকেই থাকে।

যখন ওরা বাড়ি ফিরলো তখন সবেমাত্র বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। মৃদুলা রান্নায় ব্যস্ত আছে, দিলারা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অপরদিকে বারান্দায় পাতানো মাদুরটাতে বসে দেয়ালের সাথে হেলান গিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে আশা। সাদের জন্য মন খারাপ তার। সেই কখন গিয়েছে ভাইয়ার সাথে, এখনো ফেরার নাম নেই। প্রচন্ড মিস করছিলো তাকে, এভাবে যদি বনে বাদারে ঘুরেই বেড়াবে তাহলে আসার কি দরকার ছিলো এখানে? সামান্য অভিমান হয় আশার। এরই মাঝে এরা এসে উপস্থিত হয় সেখানে। আশাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সাদ মৃদু হাসে। আদিব বলে উঠে..
“অবেলায় এভাবে এখানে বসে আছিস কেন আশামনি?
আশা চমকে তাকায় ওদের দিকে। এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি ওরা চলে এসেছে। আশা নিজেকে সামলে একবার সাদের দিকে তাকায়। ছেলেটা কিভাবে হ্যাংলার মত করে তাকিয়ে আছে। আশা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আদিবের দিকে তাকায়। মিহি গলায় বলে উঠে
“বাতাস খাচ্ছি, ঘরে বেশ গরম।।
“কেন কারেন্ট নেই?
“আছে, কিন্তু ফ্যানের বাতাসও খুব গরম।

আদিব হাসে। এরপর বলে
“মৃদু কোথায়?
“রান্না করছে।
আদিব সেখান থেকে চলে যায়। সে চলে গেলে সাদ ধীরগতিতে আশার দিকে আসে। এরপর মাদুরের এক মাথায় সেও বসে পরে। আশা একবার আঁড়চোখে তাকায় সাদের দিকে। কিন্তু কিছু বলেনা। সাদ মুচকি হাসে, আশার দিকে তাকিয়ে আবেশি গলায় বলে
“মিস করছিলে তাইনা?
“আমার বয়েই গেছে।।
সাদ আবারও হাসে। বলে..
“কিউটি?
“কি? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় আশা। সাদ আশার চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে দৃষ্টি খুবই গভীর, আশা সে গভীরে নিমজ্জিত হতে থাকে ধীরে ধীরে। এক পর্যায়ে চোখ সরিয়ে নেয় আশা। একটা ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছিলো সে। নিশ্বাসের পরিমাণ বেড়ে গেছে হঠাৎ। সাদ হাসে, মৃদু গলায় বলে
“আমি মারা যাচ্ছি..
আশা চমকে উঠে। বিস্ময় নিয়ে বলে
“মানে, কি বলছেন এইসব?
“এ মরা সেই মরা নয়, এ মরা প্রেমের মরা।
আশা চোখ পাকিয়ে বললো
“হঠাৎ প্রেমের মরায় মরতে যাবেন কেন
“ভালোবাসি তাই।
“কাকে?
“আমার কিউটিকে। তাকে না পেলে কিন্তু সত্যি সত্যিই মরে যাবো।
আশা উত্তর দেয় না কোনো। তবে কথাটা তার কলিজায় আঘাত করে। সাদ আবারও বলে
“কিউটি…
“আবার কি?
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
আশা এবার ক্ষীপ্ত গলায় বললো
“আপনার কথা শুনেই বুঝে গেছি আপনি পাগল হয়ে গেছেন। কিন্তু পাগল হওয়ার পেছনের লজিক টা কি?
“ওই যে, ভালোবাসা।
আশা এবার সাদের চোখ বরাবর তাকায়। দুষ্টুমি করে ক্ষীণ গলায় বলে
“মাথায় এত ভালোবাসার ভুত কেন চেপেছে?
“ভালোবাসি তাই, তাইতো ভালোবাসার ভুত চেপেছে।
আশা হাসলো এবার। এর মাঝে মৃদুলা এসে উপস্থিত হলো সেখানে।

ওর হাতে একটা ট্রে। তাতে দুকাপ চা আর একটা বাটিতে কিছু পাকোড়া ভাজা। ট্রেটা ওদের সামনে রেখে সাদের দিয়ে তাকিয়ে মৃদুলা হাসিমুখে বললো
“কেমন লাগছে আমাদের এখানে?
সাদ হেসে বললো
“এক কথায় বলবো?
“হুম, হেসে হেসে বললো মৃদুলা।
সাদ আশার দিকে তাকালো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো
“এ বাড়িতে ঘর জামাই হতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।
সাদের এমন কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠে মৃদুলা। অন্যদিকে সামান্য রেগে যায় আশা, লজ্জাও পায় কিছুটা। রেগে যাওয়ার কারণ তার সবচেয়ে অপছন্দ নীয় ব্যাপার হলো পুরুষদের ঘর জামাই হয়ে থাকাটা। আর এই সাদ, যাকে সে ভালোবাসে.. সে কিনা ঘরজামাই হতে চায়?

মৃদুলা হাসিমুখে বলে
“কিন্তু আমরা তো ঘরজামাই করে কাউকে রাখবোনা।
সাদ হেসে বললো
“কিন্তু রাখতে চাইলেও আমি আপত্তি করবো না।

মৃদুলা সাদের হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বললো
“আচ্ছা, সে দেখা যাবে পরে। এইবার চা টা খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাবে যে।
সাদ মৃদুলার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে নেয়। মৃদুলা আশার দিকে তাকিয়ে বলে
“তুমিও খেয়ে নাও আশা।
মৃদুলা চলে যেতে নিলে পেছন থেকে সাদ বলে উঠে
“আপনিও আমাদের সাথে বসুন না ভাবী।
“তোমাদের দুজনের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হতে চাইনা ভাই।
সাদ হাসে, পরক্ষণে বলে
“ভাইয়া কোথায়? উনাকেই পাঠিয়ে দেন তাহলে।
মৃদুলা পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে
“বারে, তোমরা দুজন রোমান্টিক মুডে সন্ধ্যা বিলাস করবে… আমি কেন বাদ যাবো বলোতো.? আমিও নাহয় আমার বরটার সাথে একটু সময় কাটাই।
সাদ হেসে বলে
“অল দ্যা বেস্ট ভাবী।
“তোমাদের জন্যেও…

মৃদুলা চলে গেলে রাগী চোখে সাদের দিকে তাকায় আশা। সাদ বিষম খায় সে দৃষ্টি দেখে৷ সে সামান্য ভীত গলায় বলে
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন কিউটি?
“ভাবীকে এইসব কেন বললেন?
“কি বলেছি?
“আপনি আমাদের বাড়ি ঘর জামাই হয়ে থাকতে চান, এটা কেন বলেছেন?
“ভুল কিছু বলে ফেলেছি তাইনা?
“অবশ্যই।
সাদ এবার হাসে। এরপর আশার মুখের কিছুটা সামনে গিয়ে ফিসফিস গলায় বলে
“আচ্ছা ঘরজামাই বাদ, তোমাকেই নাহয় ঘরবউ করে নিয়ে যাবো আমার বাড়ি।

চলবে…..

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩৪

রাতের আকাশের অসংখ্য তারার মেলা, চাঁদটা একটা টুকরো থেকে ধীর ধীরে তার পূর্ণাঙ্গ রুপে ফিরে এসেছে, চাঁদের সেই জোছনায় আলোয় আলোকিত হয়েছে চারিদিকটা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে এই পরিবেশ। আশা মায়ের ঘরেই ছিলো। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আর বাইরে বেরোনো হয়নি।

বাড়ি আসার পর ঠিকমতো বই হাতে নেওয়া হয়নি, একেতো মন খারাপ ছিলো, তার উপর রানার অত্যাচারে সে অতিষ্ঠ ছিলো। আজ মনটা বেশ ফ্রেশ, তাই একটা বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো সে। বই দেখার এক ফাঁকে ফোনে একটা শব্দ হলো। আশা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ব্যাটারি লো দেখাচ্ছে৷ দুদিন ধরে ঠিকমতো ফোন চার্জে বসানো হয় না। তারই কারণে এমনটা। তবে এখন যে চার্জে দিবে তারও কোনো উপায় নেই, চার্জারটা তার ঘরেই আছে। ওখানে যেতেও বেশ লজ্জা লাগে আশার, সাদ থাকে তাই। তবুও যেতে হবে। তা নাহলে দেখা যাবে ফোনটা অফই হয়ে যাবে।।

আশা পা বাড়ালো ও ঘরের দিকে। দিলারা পেছন থেকে বললো
“কোথায় যাচ্ছিস?
“চার্জার আনতে যাই মা। ফোন অফ হয়ে যাচ্ছে।
“ওহ।
আর কোনো কথা বাড়ান না তিনি। আশা ধীরপায়ে যাচ্ছিলো ওদিকটায়। রুমের সামনে গিয়ে দেখলো দরজা খোলা, সাদও রুমে নেই। আশা স্বস্থির নিশ্বাস ছাড়লো, যাক ভালোই হয়েছে উনি নেই। উনি সামনে আসলেই লজ্জা লজ্জা লাগে। আশা চার্জারটা খুঁজতে লাগলো, কিন্তু পাচ্ছে না। বিছানাতেই তো ছিলো। বালিশের নিচে, বিছানার উপর, বইয়ের টেবিলের উপর সব যায়গাতেই খুঁজলো আশা, কিন্তু পেলো না। এক পর্যায়ে সুইচবোর্ডের দিকে তাকালো সে। এবার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ফুটলো। আশা চার্জারটা নিতে গিয়ে দেখলো এ চার্জার দিয়ে একটা ফোন চার্জে বসানো। এটা নিশ্চয়ই সাদের ফোনই হবে। বেশ দামী ফোন দেখেই বুঝা যাচ্ছে৷ আশা ফোনটা চার্জার থেকে খুলবে কিনা ভাবছে, চার্জ কতটুকু হয়েছে দেখার জন্য সে পাওয়ার বাটনে চাপ দিলো। এমনি অবাক হয়ে গেলো সে।

ডিসপ্লে তে আশার একটা ফটো সেট করা, আশা অবাক হলো। এ ছবি সাদের কাছে কি করে? ছবিটা তখনকার যখন সে আদিবের বিয়ের সময় বউ এর জিনিসপত্র দেখার এক ফাঁকে শাড়ির ওড়না টা মাথায় দিয়েছিলো। ছবিটায় বেশ কিউট দেখাচ্ছে আশাকে। আশার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো। এমন সময় পেছন থেকে সাদ বলে উঠলো
“কিউটি!
আশা থতমত খেয়ে ফোনটা রেখে দিলো। তারাহুরো করে পেছন ফিরে বললো
“চার্জারটা নিতে এসছিলাম।
সাদ এগিয়ে এলো আশার দিকে। সামনে চোখ যেতেই দেখল ফোনে আশার পিকটা জ্বলজ্বল করছে। সে হেসে বললো
“আমার ফোন দেখছিলে?
আশা লজ্জিত গলায় বললো
“আসলে চার্জারটা নিতে আসছিলাম। এসে দেখলাম আপনার ফোনটা চার্জে বসানো। কতটুকু চার্জ হয়েছে সেটাই দেখছিলাম।
সাদ হেসে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। ফুল চার্জ হয়ে গেছে এতক্ষনে। সে আশার দিকে তাকিয়ে বলে
“আসলে তারাহুরো করে চলে এসেছি তো, তাই চার্জারটা আনতে ভুলে গেছি, ওটা বাসাতেই রয়ে গেছে বোধহয়। তবে আমার কিউটির চার্জার থাকায় কোনো প্রব্লেম হয়নি, যদিও এটাতে চার্জ হতে অনেক সময় লেগেছে, তবে ব্যাপার না।।

আশা কোনো কথা বলে না। সে চুপচাপ চার্জারটা নিয়ে চলে যেতে চায়। ঠিক সে সময় ওর এক হাত চেপে ধরে সাদ। আশা বিস্ময় নিয়ে তাকায় সাদের দিকে। অন্যসময় সাদের চোখেমুখে দুষ্টুমি থাকলেও এবার তার ছিটেফোঁটাও নেই। এবার তাকে খুবই সিরিয়াস দেখাচ্ছে। আশা মাথা নিচু করে। সাদ এখনো ওর হাত ধরেই আছে। মাথা নত অবস্থায় আশা প্রশ্ন করে
“কিছু বলবেন?
“আমি থাকতে পারছিনা কিউটি।
আশা সাদের দিকে তাকায়। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে সাদকে প্রশ্ন করে
“এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে আপনার?
সাদ হেসে বলে
“অনেক সমস্যা হচ্ছে।
“কি সমস্যা? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে আশা।
সাদ আশার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে
“আমি আমার কিউটিকে কাছে পাচ্ছিনা, এর চেয়ে বড় সমস্যা আর কি হতে পারে।

এবার লজ্জা পেয়ে যায় আশা। সে হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়াতে থাকে। তবে সাদ অনড়, সে যেনো প্রতিজ্ঞা করে বসেছে এই হাত সে আর ছাড়বে না। সাদ আশাকে সামান্য টেনে নিজের দিকে দেয়। আবেশি গলায় বলে
“আমার ফোনের ডিসপ্লে তে যার পিকটা দেখলে সে কে জানো?
আশা সাদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সাদ মুচকি হেসে ফোনটা সামনে আনে, ডিসপ্লে তে থাকা আশার পিকটায় আলতো করে চুমু খায় সে। আশা কেঁপে উঠে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো চুমুটা ছবিতে দেয় নি, বাস্তবে তাকেই দিয়েছে। সাদ আবারও আশার দিকে তাকিয়ে বলে
“আমার ভালোবাসা, আমার কিউটি। এটা সেই মুহূর্তে তোলা ছবি, যে মুহুর্তে আমার মনে হিয়েছিলো এই পৃথিবীতে বোধহয় একমাত্র নারী তুমিই, যে কিনা এই অপূর্ণ সাজেও পূর্ণ বউ হিসেবে আমার বুকে কাঁপন ধরিয়েছিলে। আমি লোভ সামলাতে পারিনি, তাই ফোনে ক্লিক করেছিলাম মুহুর্ত টা। যখনই তোমার কথা মনে হত, বের করে দেখতাম।।
আশা নিরব, তার মুখে কোনো কথা নেই। সাদ অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো আশার দিকে। এভাবে কতটা সময় কেঁটেছে তার জানা নেই। এক সময় নিরবতা ভেঙ্গে সাদ বলে
“আমায় ভালোবাসো তো কিউটি?
আশা নির্বাক। সাদ আবারও বলে–

“সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে চলে এসেছি কিউটি, নিজের ভালোবাসার কথা বার বার জানান দিচ্ছি। কিন্তু তুমি নির্বাক, এখন পর্যন্ত আমাকে ভালোবাসি কথাটা বলো নি।
আশা সাদের দিকে মাথা তুলে তাকায়। সে চোখে ভালোবাসা স্পষ্ট, তবে মুখে কেন যেনো বলতে পারছেনা সে।
সাদ হেসে বললো
“আমি জানি তুমি আমায় প্রচন্ড পরিমাণে ভালোবাসো কিউটি, মন থেকে ভালোবাসো। কিন্তু আমি চাই একটাবার আমায় মুখ ফুটে বলো।
আশার ঠোঁট জোরা কাপে। কিছু একটা মুখ দিয়ে বেরোতে চেয়েও আসছে না। সাদ আবারও তাড়া দেয়। জোর খাটিয়ে বলে
” একটা বার বলো কিউটি, আমি তোমার মুখ থেকে একটাবার ওই কথাটা শুনতে চাই।

আশার সারা শরীরে এবার কাঁপন ধরেছে, চোখের কোনে বিন্দু পরিমাণ পানির ফোঁটা। সাদের নজরে এলো সেটা। তৎক্ষনাৎ সে আশার হাত ছেড়ে দেয়। নরম গলায় বলে
“আমি বোধহয় বেশিই জোর কাটিয়ে ফেলছি।
আশা আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায় না। দৌড়ে চলে আসে সেখান থেকে। সারা শরীর কাঁপছে তার, কপালে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে। আর চোখের কোনে যে পানি, সেটা কোনো কষ্টের পানি নয়, বরং অতি সুখে সেটা চলে এসেছি। এমন ভালোবাসা সহজে পাওয়া যায় না, অতি ভাগ্যবানেরাই বুঝ এটা পেয়ে থাকে। তাদের মধ্যে আমিও একজন, কথাটা ভাবতেই খুশির ঝলকানি তে সারা শরীর শিহরিত হলো।
আশা নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমে এলো। রুমে এসেই অবাক হলো সে। আদিব খুব গুরুত্বের সাথে মায়ের সাথে বসে কথা বলছিলো। মায়ের চোখেমুখেও গম্ভীর ভাব দেখা যাচ্ছে৷ আশাকে দেখা মাত্রই ওরা কথা থামিয়ে দিলো। আশার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে আদিব বললো
“কোথায় গিয়েছিলি?
“ওই চার্জার আনতে।
আদিব হেসে বললো
“ওহ।
সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে উঠে পরলো সেখান থেকে। দিলারার দিকে তাকিয়ে বললো
“আমার রুমে এসো মা।

আদিব চলে গেলে কয়েক মিনিট পর দিলারাও উঠে দাঁড়ালো ও ঘরে যাবার জন্য। আশা বিস্ময় নিয়ে বললো
“হঠাৎ ভাইয়া ডাকলো কেন মা?
“গিয়েই দেখি না, কেন ডেকেছে।
দিলারা চলে যাবার পর আশার মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন ভর করতে শুরু করলো। কি এমন কথা হচ্ছিলো এখানে, যে ওকে দেখেই কথা বন্ধ করে দেওয়া হলো? আলাদা করে মাকেই বা ডেকে নিলো কেন ভাইয়া?
এক পর্যায়ে এইসব সকল প্রশ্ন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মোবাইলটা চার্জে বসায় আশা। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পরে যায় ও ছবিতে সাদের কিস করার দৃশ্যটা। একা একা আবারও লজ্জা পেয়ে যায় আশা। উফফ, কি একটা অনুভূতি, বলে বুঝানোর মত না। আশা একান্তেই হাসে।

আশা আবারও বইয়ের পাতা খুলে। এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠে। আশা সামান্য বিরক্ত হয়, এই সবেমাত্রই ফোনটা চার্জে বসিয়েছে, এরই মাঝে আবার কে কল দিলো। সে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। নিয়াশা কল করেছে। মুখটা হঠাৎই মলিন হয়ে যায় তার। আসার পর থেকে তাদের কারো সাথেই আর যোগাযোগ হয়নি। না ওরা কল করেছে আর না সে। এতকিছুর পর ইচ্ছে হয়নি কল করার। সে কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকায়। মৃদু গলায় বলে…
“নিয়াশা!
“কেমন আছিস আশা?
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
“ভালোই।
আশার মনে হলো নিয়াশার কন্ঠস্বরটা কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঠেকছে। সে প্রশ্ন করলো
“তোমার গলাটা এমন শোনাচ্ছে যে, কিছু কি হয়েছে?
“আমি ঠিক আছি, কি করছিস?
আশা মলিন মুখেই বললো
“কিছু করছি না, বসে আছি এমনি।
ওপাশ থেকে নিয়াশা আবারও বলে উঠলো
“সাদ কি করছে?
আশা অবাক হয়ে বললো
“তুমি জানো ও এখানে?
নিয়াশা হেসে বললো
“হ্যাঁ জানি, আন্টির কাছ থেকে শুনেছি।
“ওহ!! নীলা কোথায়? কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে প্রশ্ন করলো আশা।

নিয়াশা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললো
“ও সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে গেছে বাড়িতে।
“মানে? বিস্ময়ে বলে উঠলো আশা।
নিয়াশা তার মলিন গলায় আবারও বলে উঠলো..
“তুই চলে যাবার পর ওর সাথে আমার বেশ মনোমালিন্য হয়েছে। এরপর দেখলাম ফোনে রানার সাথেও তার বেশ ঝামেলা হয়েছে।
“কেন?
“আমাকে স্পষ্ট ভাবে কিছু বলেনি ও। তবে যতটুকু বুঝলাম, রানা বোধহয় ওকে বিয়ে করার অঙ্গীকার করেছিলো। কিন্তু তুই চলে যাবার পর রানা পালটি খেয়েছে।
“বুঝলাম না ব্যাপারটা। ও তো সাদকে ভালোবাসতো বললো, তাহলে রানা কি করে ওকে বিয়ের অঙ্গীকার করতে পারে?
“আরে বোকা, ও তো সাদকে ভালোবাসতো। কিন্তু পরে তো ও জেনে গেছিলো সাদ ওকে ভালোবাসেনা, ইনফ্যাক্ট জীবনেও বাসবে না।।তাইতো রানার সাথে হাত মিলিয়েছিলো। ভেবেছিলো হয়তো এক ঢিলে দুই পাখি মারবে। এক, প্রতিশোধ নেওয়াও হবে আর জীবন সঙ্গী হিসেবেও রানাকে পেয়ে যাবে।
“তাই বলে সব ছেড়ে চলে যাবে?
“কি করবে আর বেচারি। প্রথমত, সে সাদের সান্নিধ্য পায়নি, দ্বিতীয়ত, তোর কাছে সে ধরা খেয়েছে, তৃতীয়ত, রানা তাকে বেশ বড়সড় ছ্যাঁকা দিয়েছে.. আর লাস্ট সে শুনেছে সাদ আবারও ফিরে এসেছে, এবং তোর কাছে চলে গিয়েছে। এতগুলো ধকল মেয়েটা নিতে পারেনি রে।

কয়েক সেকেন্ড দুইজনই নিরব। আশার কানে কেমন যেনো একটা শব্দ আসতে লাগলো। শব্দটা চাপা কান্নার আওয়াজের মতো। তবে কি নিয়াশা কাঁদছে? আশা ঘাবড়ে গিয়ে বললো
“তুমি কি কাঁদছো?
নিয়াশা জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বললো
“কই, কাঁদছি না তো। আমি কেন কাঁদতে যাব পাগলী। রাখছি এখন।।
ফোনটা চট করে কেটে দিলো নিয়াশা। সত্যিই সে কাঁদছিলো, অনেক জোর করেও কান্না আটকাতে পারছিলো না সে। সাদকে সেও তো ভালোবাসতো.. ভালোবাসা কি এত সহজে ভুলা যায়? তার উপর বেস্ট ফ্রেন্ড নীলা, তার এতসব কারসাজি.. সর্বশেষ তাকেও হারিয়ে ফেলা…
এইসব প্রতিনিয়ত প্রচন্ড ভাবে আঘাত করছে নিয়াশা কে।

চলবে……